গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮

সুমনা সাহা

ভবিতব্য

শেষ রাতে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় সুষমার। ডিসেম্বরের ২২ তারিখ আজ, সামনে মকর সংক্রান্তি। ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে কদিন ধরে। তবুও সমস্ত শরীর তার ঘামে ভিজে একসা। কী একটা দুঃস্বপ্নই দেখছিল বোধহয়। খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম হলেই অ্যাসিড হয়ে যায়আর তার থেকেই উল্টোপাল্টা স্বপ্ন তৈরি হয় বলে সুষমার বিশ্বাস। সে যথেষ্ট যুক্তিবাদী। অকারণে ভাবাবেগের বাড়াবাড়ি তার পছন্দ নয়। মশারি উঁচু করে মেঝেতে পা দিয়ে হাতড়ে চপ্পল জোড়ার নাগাল পেতে চায়। চপ্পল পায়ে গলিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে টেবিল থেকে মোবাইল তুলে দেখে দুটো পঞ্চাশ। এমনিতে সুষমার খুব ভোরে ওঠার অভ্যেস। মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে তিনটে পঞ্চান্নর। উঠেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে চোখেমুখে জল দিয়ে কাপড় ছেড়ে জপ করতে বসে যায়। উনিশ বছর হল, সে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষা নিয়েছে, তারপর থেকে নিষ্ঠাভরে সকাল সন্ধ্যে গুরুদেবের নির্দেশ মতো জপে বসে, গাফিলতি করে না। আজ এক ঘন্টা আগেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। যাক, এখন আর শোব না,” মনে মনে ভাবে সুষমা। ধীরে সুস্থে হাতমুখ ধোয়, কাপড় পালটায়, স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করেকিছুতেই ধরা দেয় না, অস্পষ্ট! কিছু একটায় ভয় পেয়েছিল, সেটা এখন মনে পড়ছে। কিন্তু কীসের ভয়? যাকগে বাবা, সক্কাল সক্কাল কেন এসব বাজে কথা ভেবে মরি! সে ধূপ জ্বেলে জপের মালা নিয়ে বসে যায়। জপে বসলেই মনটা শান্ত হয়ে যায়, আর বহুকালের ভুলে যাওয়া অনেক স্মৃতিও মানসপটে ভেসে ওঠে। এই নিয়ে তাঁর গুরুদেব ভারি মজা করতেন। বলতেন, “কোনকিছু ভুলে গেলে মনে করার জন্য মাথার চুল ছেঁড়ার দরকার নেই। যখন জপে বসবে, যত রাজ্যের ভুলে যাওয়া কথা সব মনে পড়বে। ধীরে ধীরে মনকে চিন্তামুক্ত করে জপে ডুবতে চায় সুষমা।

আজ পার্থ আসবে। বাজার যেতে হবে। পার্থ চুনো মাছের ঝাল খেতে ভালবাসে। যদি ভাল মৌরলা মাছ পাওয়া যায়, নিয়ে আসব। আজ শনিবার, বেগুন পোড়াব। কালকের রান্না করা লাউ ডাল আর কলমী শাক ভাজা ফ্রিজে আছে। পার্থর জন্য একটু চিকেন নিয়ে নিলে হবে। রাত্রে রুটির সঙ্গে খেতে ওর ভাল লাগবে। এইসব ভাবতে ভাবতে বাজারের থলিটা নিয়ে এগোয়। ওর ঠিক এক পা আগে আগে এক পৃথুলা মহিলা পথ আটকে চলেছে, গায়ে কালো চাদর। যতই ওকে পাশ কাটাতে চাইছে সুষমা, ততই ওই মহিলা পথ আগলে চলেছে। বিরক্ত সুষমা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। অবশেষে পাশ কাটাতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ওর সামনে কেউ পথ আটকে চললে খুব বিরক্ত লাগে। ঘাড় ঘুরিয়ে মহিলার দিকে একবার তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে ওর সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়, “এই তো! একেই তো ও শেষ রাত্রে স্বপ্নে দেখেছে!” সেই মহিলা সুষমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি দেয়। কেন জানি না সুষমার সমস্ত শরীর শিরশির করে ওঠে! যে অস্বস্তি নিয়ে আজ এক ঘন্টা আগে ঘুম ভেঙ্গে গেছিল, সেই অস্বস্তিটা আবার ফিরে আসে। সুষমা মনের মধ্যে বিচার করতে শুরু করেকোথাও তো অস্বস্তির কোন কারণ নেই। সব কিছু অত্যন্ত স্বাভাবিক! তবে! অন্যমনস্ক ভাবে বাজার করতে থাকে। একসময় মহিলার মুখটা মন থেকে মিলিয়েও যায়। সব নেওয়ার পর আবার মনে পড়ে, কাঁচালংকা নেওয়া হয়নি। কাঁচালংকার দোকানী বলে, “মাসিমা, এই ধনেপাতাটুক দিয়ে দেব? আমার ঘরের উঠোনে হয়েছে। সুষমা হেসে বলে, “দাও বলছ যখন, কত দেব?” মনে মনে ভাবে, “ভালই হল, বেগুন পোড়ায় ধনেপাতা দিয়ে মাখলে বেশ লাগে। আমার তো মনেই ছিল না!” দোকানী ছেলেটা বলে, “নিয়ে যান, কিছু দিতে হবে না। সুষমা নিচু হয়ে ধনেপাতাটা ব্যাগে রাখছে, ঘাড়ের ঠিক পিছনে কার নিঃশ্বাস পড়ল। বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘোরাতেই দেখে সেই কালো চাদর পরা মহিলা, মুখে একটা বাঁকা হাসি! সুষমার সমস্ত অন্তরাত্মা যেন কেঁপে উঠল সেই মহিলাকে দেখে। কিন্তু উপরে সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। ভাবল, “আমার হল কী? এই মহিলাকে আমি কি আগে কোথাও দেখেছি? ওকেই স্বপ্নেও দেখেছিলাম এখন সেটা মনে পড়ছে। এইরকমই পদে পদে আমার পিছু নিয়েছিল। আবার এখন সত্যি সত্যিই সেই মহিলা আমার আগেপিছে ঘুরছে। এটা কি নেহাত কাকতালীয়? সুষমা এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। আচ্ছা, ঐ মহিলার সঙ্গে আলাপ করে জেনে নিলে তো হয়, ওকে আগে কোথাও দেখেছি কি না! হয়তো ওনারও আমাকে চেনা চেনা লাগছে। তাই হয়তো আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। কিম্বা একটু ফাঁকা পেলে কিছু চাইবে, লোকজন আছে বলে লজ্জায় চাইতে পারছে না। হয়তো ভদ্রঘরের বৌ, কোনও কারণে অসুবিধায় পড়েছে।সাতপাঁচ দ্রুত চিন্তা করে মহিলার সঙ্গে আলাপ করার জন্য পিছন ফেরে। নেই, কোথাও নেই সেই মহিলা! আশ্চর্য! এই এক্ষুনি তো ছিল! এরই মধ্যে গেল কোথায়? আজ বাজারে এমন কিছু ভীড় নেই যে ভীড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাবে,দেখাই যাবে না? কী অদ্ভুত ব্যাপার! সত্যি, মহিলাকে যতদূর চোখ যায় আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কী হচ্ছে? সুষমার মনটা ডিস্টারবড লাগে।

পার্থ সুষমার একমাত্র ছেলে। ও এই বয়সের আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। ছোটবেলা থেকেই অন্তর্মুখ। পাড়ায় বিশেষ বন্ধুবান্ধব ছিল না। হয় বইয়ে মুখ গুঁজে নয়তো কম্প্যুটার নিয়ে বসে থাকা অভ্যাস। মেয়ে শতরূপাও ছিল ভারী ঠাণ্ডা প্রকৃতির। যে ওর সঙ্গে একদিনও কথা বলেছে, সেই বলত, “কী মিষ্টি কথা গো! প্রাণ জুড়িয়ে যায়!” সুষমা ধর্মপ্রাণ পরিবারের মেয়ে। বাড়িতে লক্ষ্মীপূজো, সরস্বতী পূজো, সত্যনারায়ণ পূজো এইসব লেগেই থাকত। সেই ধর্মবোধ সে ছেলেমেয়ের মনেও সঞ্চারিত করেছে। সুষমার স্বামী প্রবালবাবু চাইতেন ছেলেমেয়েরা জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযুক্ত চৌকষ হোক। সুষমা যে তাদের মাথায় ধার্মিকতার অসুখ ঢুকিয়ে দিচ্ছেএই নিয়ে প্রবালের আপত্তি ছিল। স্বামী-স্ত্রীতে প্রায়ই মতান্তর থেকে মনান্তর হতো। কিন্তু তা কখনোই বড় ধরনের সাংসারিক অশান্তির সৃষ্টি করেনি। কারণ সুষমা ঝগড়া করতে পারে না। তাই কথা কাটাকাটি ঝগড়ার দিকে মোড় নিলেই সে একেবারে চুপ করে যেত। একটি নামকরা বেসরকারি সংস্থায় উঁচু পদেই ছিলেন প্রবালবাবু। হঠাৎই একদিন অফিস থেকে অসময়ে ঘরে ফিরলেন বুকে সামান্য ব্যথা নিয়ে। চিরকালই নিজের মতে চলেন, কারো কথা মেনে নেবার লোক নন। তাই সুষমা ডাক্তারবাবুকে খবর দেবার কথা বললেও শুনলেন না, অম্বলের ওষুধ খেয়ে বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি সেই যে শুয়ে পড়লেন, আর উঠলেন না। সকালে ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে দেখে বললেন,রাত্রে ঘুমের মধ্যে হার্টফেল করেছেন। তখন মেয়ের বয়স নয় আর পার্থ মাত্র পাঁচ বছরের শিশু। এতবড় ধাক্কায় সুষমার দিশেহারা মন একটা অবলম্বন খুঁজছিল। তাদের এলাকায় কাছাকাছি যে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রম ছিল, তখন থেকেই সেখানে যাতায়াত শুরু। ছেলেমেয়ে দুজনেই মায়ের সাথে সাথে মিশনে যাতায়াত শুরু করে। মহারাজরাও তাদের খুবই স্নেহ করেন। দুজনেই একটু বড় হওয়ার পর থেকে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে সন্ন্যাস জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই নিয়ে মিশনের মহারাজদের সঙ্গেও সুষমার আলোচনা হয়। সকলেই একবাক্যে বলেন, “মা, তোমার দুটি সন্তানকেই কোলছাড়া করতে আমরা চাই না। তুমি ঠাকুরের বাগানের মালী। সুন্দর ফুল ফুটিয়েছ, এখন প্রভু যদি সেই ফুল উপহার চান, তবে তুমি ধন্য। সন্তান তিনিই দিয়েছেন, তাঁরই সন্তান। তোমার কাজ ছিল শুধু পালন করা। কিন্তু একটি সন্তান ঠাকুরকে দাও, একটি তোমার থাক। নইলে তুমি যে বড় একলা হয়ে যাবে মা!” সুষমা মৃদুস্বরে বলেছে,“সব কী আমার হাতে মহারাজ! ঈশ্বরের যা ইচ্ছা তাই হোক। আমি কাউকে বেঁধে রাখতে চাই না। শতরূপা অংকে অনার্স নিয়ে বি এস সি পড়ছিল। সারদা মঠের সঙ্গে ওর কথা হয়েছিল, এম এস সি কমপ্লিট করে ও মঠে যোগ দেবে। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। মাত্র তিনদিনের জ্বরে শতরূপা সকলের মায়া কাটিয়ে চলে গেল ভগবানের কোলে। সুষমা যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। আর পার্থ তখন থেকে আরও বেশী করে নিজের মধ্যে ঢুকে পড়ল। মনের সাধের একটা ঘরে চিরতরে তালাবন্ধ করে দিল সে। ছেলে বুঝেছে,মায়ের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন সে। তার মাকে ছেড়ে যাওয়া চলবে না। সুষমা বুঝল সবই। তাঁরই জন্য ছেলের সন্ন্যাসের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাবে! সহস্র জন্মের শুভ কর্মফলে পরম ভাগ্যে হৃদয়ে বৈরাগ্য ধনের উদয় হয়। সে রত্নগর্ভা। দুই সন্তানই বৈরাগ্যের পথে হাঁটতে চেয়েছিল। কিন্তু ভবিতব্য বলে একটি অমোঘ বস্তুকে মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। তার এখন সাহস হয় না যে ছেলেকে বলে, “আমার কথা ভাবিস না, তুই চলে যা তোর মন যেদিকে চায়!” পারে না একথা বলতে। মনে বল পায় না। বয়স বাড়ছে, বড় অসহায় লাগে।
পার্থ সদ্য একটা চাকরি পেয়েছে। পাঁচ মাসের ট্রেনিং-এর পর পোস্টিং দেবে। এই শহরেই ট্রেনিং-এ জয়েন করেছে। কিন্তু ওরা ট্রেনিদের রেখেছে ওদের গেস্টহাউসে। শনি-রবিবারে ও বাড়িতে মায়ের কাছে আসে। ছেলেকে ছেড়ে থাকার সুষমারও একটা ট্রেনিং চলছে। এরপর হয়তো চেন্নাইয়ে পাঠাবে, নয়তো হরিয়ানা। কে জানে! তখন তো আরও বেশীদিন ছেড়ে থাকতে হবে।

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সুষমা রান্না করে। স্নান করে পূজো সেরে অল্প খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে সে যাবে আশ্রমের সন্ধ্যা আরতী দর্শনে। সাড়ে ছটার মধ্যে ঘরে ফিরবে। পার্থ আসতে আসতে সাতটা-সাড়ে সাতটা বাজবে। আজকে মেয়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। চোখে জল আসে। মনে মনে বলে, “ঠাকুর, যেখানে যেভাবে আছে, ওকে তুমি শান্তি দিও!” একটা বই নিয়ে বিছানায় আসে। দিবানিদ্রার অভ্যাস যে আছে তার, এমন নয়। তবে পনের মিনিটের জন্য হলেও একটু চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম না নিলে, শরীরটা ভাল লাগে না। কেমন বুক ধড়ফড় করে। ঘড়িতে তিনটে বাজে দেখে বই মুড়ে রেখে চোখ বন্ধ করল সুষমা। ধীরে ধীরে চারপাশটা কেমন ঘোর কালো হয়ে এল। ভীষণ শীত করছিল তার। পায়ের কাছ থেকে কম্বলটা টেনে নিতে গেলেই ঘুমের আমেজটা কেটে যাবে। চোখ দুটো একদম খুলতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু বড্ড ঠাণ্ডা লাগছে। কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে গা টা একটু গরম করে নিই, ভেবে সুষমা চোখ খোলা মাত্র দেখে সেই মহিলা তার বিছানার উপর বসে একেবারে মুখের কাছে মুখটা ঝুঁকিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ভয়ে সমস্ত শরীর হিম হয়ে যায় সুষমার। একি সর্বনাশ! একটা অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে আসে তার অসাড় কণ্ঠ ভেদ করে। প্রবল মনের জোরে সে এক ধাক্কায় ঐ মহিলাকে সরিয়ে উঠে বসে। দেখে জানলার কাঁচের বাইরে কাঁঠাল গাছের ছায়া নড়ছে। ঘুলঘুলিতে চড়াই পাখি কিচমিচ করছে। বিকেলের আলো মরে এসেছে। ঘড়ির কাঁটা দেখাচ্ছে চারটে পঁচিশ। কেউ কোত্থাও নেই। চারিদিক অসম্ভব চুপচাপ। অনেকক্ষণ বসে থেকে সুষমা নিজের বুকের ধুকপুক আর ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শুনতে থাকে। দেওয়ালে প্রবালের ছবিএকদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকে সুষমা। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে যান্ত্রিক ভাবে ওঠে, তৈরি হয়ে বেরোয়।

যাতায়াতের পথে লোকটাকে রোজই দেখে সুষমা। উস্কোখুস্কো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। একটা প্লাস্টিকের চাদর পেতে বটগাছের নিচে বসে থাকে। সামনে কতগুলো শিকড় বাকড় আর পাথর ছড়ানো। ক্বচিৎ কখনো কেউ তার সামনে নিজের হাতের তালু মেলে ধরে। নয়তো বেশীরভাগ সময়ে লোকটা ফাঁকাই বসে থাকে। আজকে সুষমা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বেরিয়ে পড়েছে। ঘরের মধ্যে ভাল লাগছিল না। লোকটার সামনে দাঁড়াতেই উৎসুক ঘোলাটে চোখ তুলে বলে, “মা, ভাগ্য গণনা করাবেন? আসুন না, দশটা টাকা দেবেন মাত্র। আমি তো ভিক্ষা চাইছি না। এতো একটা বিদ্যা। নেহাৎ ডিগ্রি নেই বলে দোকানে বসতে পারি না। একদিন দেখুন না, যদি কিছু না মেলে পয়সা দেবেন না। সুষমা জানে, ভাগ্য বদলানো যায় না। তাই যদি যেত, ঐ লোকটা এত লোকের ভাগ্যবিধাতা, আর নিজের দুঃখ ঘোচাতে পারে না কেন? কেন তাকে দশটা টাকার জন্য লোককে খোশামোদ করতে হয়? আর যা বদলানো যাবে না, তা জেনে কী লাভ? কিন্তু আজকে সকালে ঘুম ভাঙ্গার থেকেই মনটা যেন ছানা কেটে গেছে। ভীষণ অস্থির লাগছে। কিছুই ভাল লাগছে না। তাই যন্ত্রচালিতের মতো সে লোকটার সামনে বসে পড়ল। লোকটা কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে সুষমার হাতটা হাতে নিল। হাতের দিকে তাকিয়ে সে স্পষ্ট চমকে উঠল। অনেকক্ষণ তাকিয়েই থাকল,তারপর সুষমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে শুকনো গলায় বলল, “আপনার কী বিশেষ কোন জিজ্ঞাসা আছে?” সুষমা বলল, “আমি আর কতদিন বাঁচব বলতে পারবেন?” জ্যোতিষি কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে কি জানি কি ভাবল। তারপর বলল, “জীবন মৃত্যু তাঁর হাতে মা! আমরা তো পুতুল! যখন সময় হবে, তিনি নোটিশ পাঠাবেন। সকলে তো তা বোঝে না। তবে যাদের মন খুব শুদ্ধ, তারা মৃত্যুর আগে কিছু ফিল করতে পারে!” সুষমা দ্রুত উঠে পড়ল। তাকে আরতীতে যেতে হবে।
একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে সুষমা বলল, “এই নিন আপনার দক্ষিণা। 
খুচরো দশ টাকা দিন না মা!”
সুষমা হেসে বলল, “আমার ফেরৎ চাই না,আপনি রেখে দিন।
জ্যোতিষি টাকাটা কপালে ঠেকিয়ে বলল,“ভগবান আপনার মঙ্গল করুন!”

খেতে খেতে পার্থর সঙ্গে গল্প করছিল সুষমা। ওর ট্রেনিং-এর গল্প শুনছিল। খাওয়া কখন শেষ হয়ে গেছে। মা-ছেলে কথা বলতে এতই মশগুল ছিল যে এঁটো হাত শুকিয়ে গেছে, হুঁশ নেই। সুষমা বলল, “বাবু, আমি তোর বিরাট বন্ধন, নারে?”
পার্থ মায়ের দিকে তাকালো,ওর বড় বড় শান্ত চোখ দুটোয় জল চিকচিক করে উঠল, বলল, “মা, এরকম কেন বলছ? তুমিই তো আমার সব! যেখানেই পোস্টিং দেবে, আমিতো তোমাকে নিয়ে যাব। একলা থাকতে দেব নাকি?”
সুষমা ধীরে ধীরে একটা একটা শব্দ যত্ন করে উচ্চারণ করে বলল, “দেখ বাবু, আমি যদি মরে যাই, তুই মঠে জয়েন করিস,মনে কোনও বাধা রাখিস না! আমার আত্মা তাহলে শান্তি পাবে জানিস!”
পার্থ বাঁ হাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,“মাগো,তুমি যদি এমন কথা বলো,আমার যে কত কষ্ট হয়,বোঝ না!”
সত্যি বাবা!যে কূলে কেউ সন্ন্যাসী হয়,তার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার হয়ে যায়,জানিস তো?”
আবেগে পরিবেশ আর্দ্র হয়ে ওঠে।
খাওয়ার পর সুষমা রান্নাঘরের কাজ সারে,পার্থ টিভিতে নিউজ শোনে। তারপর একসময় মা ছেলে দুই ঘরে শুতে যায়।

সুষমার চোখে আজ ঘুম নেই। স্থির হয়ে শুয়ে সে ঘড়ির টিক টিক শুনতে থাকে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়। অনেক দূরে কোথাও রাতের পাখি টি টি করে একটানা ডেকে চলে। কীসের যেন প্রতীক্ষায় সুষমার সমস্ত মনপ্রাণ টানটান হয়ে আছে। রাত ক্রমে ঘন হয়। চোখটা বুঝি একটু জড়িয়ে এল! খুব শীত করছে। চারদিকটা নিকষ কালো হয়ে এসেছে। জড়ানো চোখ খুলে সুষমা তাকায়। সে এসে বসেছে সুষমার বিছানায়, অতি নিকটে। গায়ের কালো চাদরটা দিয়ে সুষমাকে জড়িয়ে ধরে। সুষমার আর ভয় করে না। তার মনের মধ্যে একটা গানের কলি ভেসে ওঠে—“প্রভু আমার প্রিয় আমার পরম ধন হে!” সরাসরি তাকায় সেই মহিলার দিকে, আশ্চর্য! এ যে সে নিজেই নিজের ছবি দেখছে, কী আশ্চর্য! মুখোমুখি দুই সুষমা পরস্পরকে গাঢ় আলিঙ্গনে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে। এসেছ,তুমি এসেছ!” ফিসফিস করে বলে সুষমা। আহ! কী গভীর প্রশান্তি নেমে আসছে সমস্ত শরীর-মন ছেয়ে! এবার সুষমার ঘুম পায়। সে কালো চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।