গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী--২২

রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ব্যাখ্যা হীন ঘটনা
   
রাজধানী কলকাতার বিবাদীবাগ অঞ্চলে লালদিঘীর উত্তরে রাইটার্স বিল্ডিং অবস্থিত। ১৭৭০ সালে স্থাপিত ঐতিহাসিক রাইটার্স বিল্ডিঙের নকশা টমাস লায়ন্স প্রস্তুত করেছিলেন। ১৭৭৬ সালে লায়ন্স ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইউরোপীয় কেরানিদের বসবাসের জন্য উনিশটি পৃথক অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করে। এগুলি দেখতে ছিল সারিবদ্ধ দোকানের মত। এখানকার কর্মরত কেরানিদের বলা হত রাইটার। এদের নাম থেকেই ভবনের পূর্বতন নাম রাইটার্স বিল্ডিং হয়ে ছিল। ১৮৮৯ সালে ভবনটি গথিক স্থাপত্যে সেজে ওঠে।  ভবনের সম্মুখভাগ করিন্থীয় স্থাপত্য নব্য রেনেসাঁ স্থাপত্য শৈলীর একটি উদাহরণ। এর প্রধান প্রবেশদ্বারের শীর্ষে ব্রিটানিয়ার একটি মূর্তিও স্থাপিত হয়। ভবন সম্প্রসারণের কাজ হয় সবচেয়ে বেশি ১৮২১, ১৮৩০, ১৮৭১-১৮৮২ এবং ১৮৭৯ সালে। প্রত্যেকবারই মূল ভবনের সঙ্গে নতুন নতুন অংশ সংযুক্ত হয়ে রাইটার্স বিল্ডিং তার বর্তমান কাঠামো ধারণ করেছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর রাইটার্স বিল্ডিং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্য সচিবালয়ে পরিণত হয়ে ছিল। ঐ সময় বাংলায় ভবনটির নামকরণ হয় "মহাকরণ"। যদিও ইংরেজি নাম হিসেবে "রাইটার্স বিল্ডিং" কথাটিই প্রচলিত আছে।
আজ থেকে প্রায় আড়াই শ বছর আগের তৈরি এই রাইটার্স বিল্ডিং। এর মধ্যে আছে অসংখ্য কামরা। তখনকার সময়ে কর্মচারীদের তুলনায় এর ঘরের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী। জানা যায় এতে এমন ঘরও আছে যা কিনা কোন দিন খোলাই হয়নি !
এখানকার নৈশ ব্যাখ্যাহীন ঘটনা নিয়ে আজ লিখতে বসা। আমরা যদি কোন গভীর রাতে দেখতে যাই রাইটার্স বিল্ডিঙের চেহারা বা সেখানকার প্রচলিত অপ্রাকৃতই ঘটনাগুলি যদি যাচাই করে নিতে যাই তবে কি হবে ? আমাদের মনে হবে ওই ভবনে তখনও দিনের মতই জনসমাগম চলছে, যদিও বাইরে থেকে কোন জনপ্রাণীর দেখা মিলবে না, তবু মনে হবে যেন রাতের রাইটার্সও কর্ম-কোলাহল মুখরিত হয়ে আছে। আমরা যদি সে ইমারতে প্রবেশের সাহস করি তবে কি দেখব বা জানতে পারব ? লোকে বলে, সেখানে অশরীরীর উপস্থিতি অনুভব করতে পারব।  আমাদের মনে হবে, লন ধরে কেউ যেন হেঁটে চলে গেল। সেই ছায়ামূর্তিকে দেখে আমি হয়ত তাকে চীৎকার করে ডেকে উঠলাম, এই যে দাদা শুনছেন ? ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে দেখব সেই ছায়ামূর্তি কোথাও মিলিয়ে গেল।  তবে এ ছায়ামূর্তি এলো কোথা থেকে ?
লোকের ধারনা যে প্রথমে কোম্পানির রাইটারদের আবাসিক ভবন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও তা পরিণত হয় ব্রিটিশ সরকারের রাজকীয় দফতরের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান কেন্দ্র হিসেবে। যদিও বাংলার সাধারণ জনগণের কাছে রাইটার্স বিল্ডিং আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার, লাল ফিতার দৌরাত্ম্যর এবং দুর্নীতির প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। সাধারণ জনগণকে ধরে নিয়ে এসে এই বিল্ডিঙে ইংরেজরা বিচারের নামে তাদের ওপর নিঃশংস অত্যাচার চালাত। কত জনকে যে বিনা বিচারে শুধুমাত্র প্রতিহিংসা মিটাতে এখানে এনে মেরে ফেলা হয়েছিল তার কোন হিসাব ছিল না। জানা যায়, এখানে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের একাধীক ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতন বা ধর্ষণের পরে তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। এই সব মৃত অত্যাচারিত অতৃপ্ত আত্মারা আজও রাতে জেগে ওঠে। তারা যেন আজও এখানে বন্দিত্ব জীবন যাপন করছে। কারণ অপঘাতে  মৃত আত্মার যে কোন দিন মুক্তি হয় না। কোন দিন তারা মৃত্যু যন্ত্রণার দুঃখ ভেদ করে আর ইহলোকে স্বাভাবিক জীবন ধারায় ফিরে আসতে পারে না। তাদের হায়, হুতাশ, দীর্ঘশ্বাস তাই আজও বুঝি জমে আছে এই রাইটার্স বিল্ডিঙের ঘরে ঘরে। অত্যাচারের এ সব কাহিনী এখানকার দেওয়ালে দেওয়ালে আজও ছায়ায় ছায়ায় যেন প্রতিফলিত হয়ে যায়--প্রতিবিম্বিত হয় জীবন যন্ত্রণার চালচিত্র রেখা !
নবান্নের আগে প্রতিটি রাতেই নাকি এই ভবনে ঘটে নানা রহস্যময় সব ঘটনা। নাইট গার্ডরা এখানকার নিশীথ ভয়ের অনেক কথা বলে, বিশেষ করে ওরা রয়টার্সের ৫ নম্বর ব্লকের কথা বলে।  রাত বাড়লেই সেখান থেকে কারও চীৎকার ভেসে আসে। কোন কোন ঘরে হাড়হীম করা শীতের অনুভব হয়। কর্মচারীরা সন্ধ্যের পরে কাজ করতে চায় না। এমন কি নৈশ প্রহরীরা ভয়ে ভয়ে তাদের রাতের পাহারা সারে। ওরা জানে এখানকার কথা। অনেক ঘরে রাতে আপনি আপনি আলো জ্বলে ওঠে আবার সে আলো ধপ করে নিভেও যায়। কখনো মনে হয় অনেক লোকের সমাগম যেন এখানে। কোন কোন ঘর থেকে ঠক ঠক টাইপরাইটারের আওয়াজ ভেসে আসে। কখনও স্তব্ধতা ভেঙে ধপ ধপ পায়ে চলা শব্দে মুখরিত হয় গভীর রাত।
এই রাইটার্সেই ঘটে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৩০ সালের ৮ নভেম্বর বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশ রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে কারা বিভাগের প্রধান অত্যাচারী ইংরেজ অফিসার এন. জি. সিম্পসনকে হত্যা করেন। এই ঘটনার অব্যবহিত পরে ভবনের অলিন্দে নিরাপত্তারক্ষী ও কমিশনার টেগার্টের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবী-ত্রয়ীর যে সংঘর্ষ হয় তা "অলিন্দ যুদ্ধ" নামে প্রসিদ্ধ। শোনা যায়, নিহত এন জি সিমসনের আত্মার নাকি এখনো মুক্তি হয় নি। আজও কোন নিশুতি রাতে বিল্ডিঙের ভেতর থেকে হঠাৎ হঠাৎ তাঁর মৃত্যু-আর্তনাদ ভেসে আসে।
এক সময় এই রয়টার্সের আশপাশে ছিল বড় বড় কলাগাছের বাগান। ইংরেজ আমলে বিচারের অজুহাতে মানুষকে হত্যা করে এই সব কলাবাগানে নাকি পুঁতে ফেলা হত। জানা যায় কিছু ইংরেজ মৃত দেহের কবরও নাকি এখানে দেওয়া হয়েছিল। ব্যালিংটনের বন্ধক যুদ্ধ, ঘোড়ায় চলা গাড়ির খেলা, মল্লযুদ্ধের খেলা, অনেক খুন জখমের ঘটনা এখানে ঘটেছে। এ সব ঘাত-অপঘাতের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এই রাইটার্স বিল্ডিং। এসব ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্যেই রাইটার্স ও তার আশপাশের জাগার এমনি বদনাম হয়ে আছে। হঠাৎ কোন গভীর রাতের নির্জনতা ভেঙে রাইটার্সের বিগত সংঘর্ষময় রক্ত-ক্লেদাত্ম ঘটনার যেন ব্যাখ্যাতীত পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে এই রাইটার্সের বিল্ডিঙে ও তার আশপাশে।