গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮

৭ম বর্ষ ১০ম সংখ্যা ৬ এপ্রিল ২০১৮

এই সংখ্যার ৯টি গল্পের লেখকসূচি - সুবীরকুমার রায়, তাপসকিরণ রায়, দীপলেখা মুখার্জী, নীহার চক্রবর্তী, আফরোজা অদিতি, সুমনা সাহা, মহম্মদ জসীম, মনোজিৎকুমার দাস ও ত্রিভূবন জিৎ মুখার্জী ।

সুবীর কুমার রায়

 পারুলবালা

শ্বশুরের পৌনে এক কাঠা জমির ওপর টালির চালের দেড়খানা মাটির ঘরে ছেলেকে নিয়ে বাস করে বাল্য বিধবা পারুলবালা। পাড়ার সবার বিপদের ত্রাতা, পারুল। বেশ কয়েক বাড়ি কাজ করে সে অতি কষ্টে সংসার চালিয়ে ছেলেকে বড় করেছে। ঠাকুর দেবতায় তার অগাধ বিশ্বাস। অল্প জায়গার ওপর টালির চালের মাটির বাড়ি হলে কি হবে, বাড়ির সামনের অধিকাংশ জমিই সে নিজের জন্য ব্যবহার না করে, অতি কষ্টে সাদা পাথরের তৈরি ছোট্ট একটা মন্দির করে মা কালীর এক মুর্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। লোকে বলে পারুলের স্বপ্নে পাওয়া দেবীটি খুব জাগ্রত, তাঁর কাছে ভক্তিভরে চাইলে, সকল মনস্কামনা পূর্ণ হয়। বাড়ির সামনে সকাল বিকাল বহু মানুষের ভিড়। দিনের মধ্যে যতটুকু সময় পারুল পায়, মন্দির পরিচর্যার কাজেই ব্যয় করে। আর কাউকে মন্দির, বা মন্দির সংলগ্ন বাঁধানো জায়গাটা পরিস্কার করতেও পারুল কোনদিন দেখেনি। পূজার প্রসাদ হিসাবে কোন ফল বা মিষ্টিও তার হাতে কেউ কোনদিন তুলে দেয়নি, অবশ্য পারুল সেটা আশাও করে না।
বেশ চলছিল, সমস্যা দেখা দিল পারুলের ছেলের বিয়ে ঠিক হওয়ায়। একটা অতিরিক্ত ঘর তৈরি না করলে, সেই শুভ কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। জমি অনেকটাই আছে, মন্দিরটি একটু এগিয়ে তৈরি করলেই, সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। নিজেদের খরচ কমিয়ে, ধারদেনা করেও সে সকলের জন্য নিজেই আবার নতুনভাবে মন্দিরটি তৈরি করে দিতেও চায়, কিন্তু তার জন্য পারুলের জমির অংশ ছাড়া আর সামান্য একটু জমির প্রয়োজন।
বাড়ির সামনের ফাঁকা জমিটি ধনী ব্যবসায়ী অলোকবাবুর। তিনিও গরদের কাপড় পরে ওই মন্দিরে পূজো না দিয়ে কোনদিন জল পর্যন্ত পান করেন না, কারণ তাঁর বিশ্বাস মায়ের আশীর্বাদেই তাঁর ব্যবসার আজ এই রমরমা অবস্থা। তাঁর প্রাসাদসম বাড়িটির ঠিক পিছনেই পারুলের জমি সংলগ্ন অনেকটা জমি ফাঁকা পড়ে আছে। তাছাড়া পারুল তাঁর বাড়িতে বাসন মাজা, ঘর মোছা, ইত্যাদি কাজও করে। তাই সাহস করে সে অলোকবাবুকে চার-পাঁচ ফুট জমি তাকে মন্দির নির্মাণের জন্য দান করতে অনুরোধ করে, যাতে পারুলের জমির সাথে তাঁর সামান্য জমিটুকু নিয়ে সে নিজ খরচায় আবার মন্দিরটি তৈরি করতে পারে।
ছেলের বিয়ের জন্য মন্দিরটি ভাঙতে হবে শুনে অলোকবাবু আঁতকে ওঠেন। পাড়ার এতগুলো লোকের বিশ্বাস ধুলিসাৎ করে মন্দির ভেঙে জাগ্রত দেবীর বিগ্রহ স্থানচ্যুত করার ফল খুব সুখকর হবে না বলে ভয়ও দেখান, কিন্তু নিজ জমির এক ইঞ্চি জায়গাও তিনি মন্দিরের জন্য ছাড়তে রাজি নন বলে পরিস্কার জানিয়ে দেন। মাসে মাসে পারুলের মাইনে থেকে জমির দাম শোধ করে দেওয়ার প্রস্তাবে, তিনি উত্তেজিত হয়ে ‘তোর বড় টাকার দেমাক হয়েছে’, ইত্যাদি বলে চিৎকার করতে থাকেন।
বাধ্য হয়ে পারুল পাড়ার সবার কাছে, বিশেষ করে যাঁরা রোজ সকাল-সন্ধ্যা মায়ের আরাধনা করতে আসেন, তার হয়ে অলোকবাবুকে অনুরোধ করতে বলেন, কিন্তু তার প্রস্তাবে কেউই সাড়া দিলেন না।  
সব কিছুই আগের মতো চলতে লাগলো, অলোকবাবু রোজ সকালে গরদের কাপড় পরে মায়ের মুখ দর্শন করে পূজো দিয়ে বাসায় গিয়ে জলপান করেন। অন্যান্যরা রোগমুক্তি, অর্থ কামনা, পুত্র কামনা, ব্যবসা বা চাকরিতে উন্নতি, মামলায় জয়, ইত্যাদি কামনা করে মন্দিরে পূজা বা প্রণাম করতে নিয়মিত আসেন। পারুলও তার ছেলের বিয়ে দিয়ে পুত্রবধু ঘরে নিয়ে আসে।
পারুল আগের মতোই বাড়ি বাড়ি কাজ সেরে, মন্দির পরিস্কার করে, রাতে এখন মাদুর পেতে মন্দিরের বাইরেটায় খোলা আকাশের নীচে শোয়। সবাই দেখে, এই অবস্থায় তার ছেলের বিয়ে করা উচিৎ হয়েছে কী না, বা ছেলের এখন তার মায়ের জন্য কি করা উচিৎ, ইত্যাদি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেও বা পারুলকে মুখে কিছু না বললেও, দেবী মুর্তিটির সেই হাসি মুখ ও কমনীয় দৃষ্টির কিছু পরিবর্তন হয়েছে বলে তাদের যেন মনে হয়।


তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী--২২

রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ব্যাখ্যা হীন ঘটনা
   
রাজধানী কলকাতার বিবাদীবাগ অঞ্চলে লালদিঘীর উত্তরে রাইটার্স বিল্ডিং অবস্থিত। ১৭৭০ সালে স্থাপিত ঐতিহাসিক রাইটার্স বিল্ডিঙের নকশা টমাস লায়ন্স প্রস্তুত করেছিলেন। ১৭৭৬ সালে লায়ন্স ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইউরোপীয় কেরানিদের বসবাসের জন্য উনিশটি পৃথক অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করে। এগুলি দেখতে ছিল সারিবদ্ধ দোকানের মত। এখানকার কর্মরত কেরানিদের বলা হত রাইটার। এদের নাম থেকেই ভবনের পূর্বতন নাম রাইটার্স বিল্ডিং হয়ে ছিল। ১৮৮৯ সালে ভবনটি গথিক স্থাপত্যে সেজে ওঠে।  ভবনের সম্মুখভাগ করিন্থীয় স্থাপত্য নব্য রেনেসাঁ স্থাপত্য শৈলীর একটি উদাহরণ। এর প্রধান প্রবেশদ্বারের শীর্ষে ব্রিটানিয়ার একটি মূর্তিও স্থাপিত হয়। ভবন সম্প্রসারণের কাজ হয় সবচেয়ে বেশি ১৮২১, ১৮৩০, ১৮৭১-১৮৮২ এবং ১৮৭৯ সালে। প্রত্যেকবারই মূল ভবনের সঙ্গে নতুন নতুন অংশ সংযুক্ত হয়ে রাইটার্স বিল্ডিং তার বর্তমান কাঠামো ধারণ করেছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর রাইটার্স বিল্ডিং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্য সচিবালয়ে পরিণত হয়ে ছিল। ঐ সময় বাংলায় ভবনটির নামকরণ হয় "মহাকরণ"। যদিও ইংরেজি নাম হিসেবে "রাইটার্স বিল্ডিং" কথাটিই প্রচলিত আছে।
আজ থেকে প্রায় আড়াই শ বছর আগের তৈরি এই রাইটার্স বিল্ডিং। এর মধ্যে আছে অসংখ্য কামরা। তখনকার সময়ে কর্মচারীদের তুলনায় এর ঘরের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী। জানা যায় এতে এমন ঘরও আছে যা কিনা কোন দিন খোলাই হয়নি !
এখানকার নৈশ ব্যাখ্যাহীন ঘটনা নিয়ে আজ লিখতে বসা। আমরা যদি কোন গভীর রাতে দেখতে যাই রাইটার্স বিল্ডিঙের চেহারা বা সেখানকার প্রচলিত অপ্রাকৃতই ঘটনাগুলি যদি যাচাই করে নিতে যাই তবে কি হবে ? আমাদের মনে হবে ওই ভবনে তখনও দিনের মতই জনসমাগম চলছে, যদিও বাইরে থেকে কোন জনপ্রাণীর দেখা মিলবে না, তবু মনে হবে যেন রাতের রাইটার্সও কর্ম-কোলাহল মুখরিত হয়ে আছে। আমরা যদি সে ইমারতে প্রবেশের সাহস করি তবে কি দেখব বা জানতে পারব ? লোকে বলে, সেখানে অশরীরীর উপস্থিতি অনুভব করতে পারব।  আমাদের মনে হবে, লন ধরে কেউ যেন হেঁটে চলে গেল। সেই ছায়ামূর্তিকে দেখে আমি হয়ত তাকে চীৎকার করে ডেকে উঠলাম, এই যে দাদা শুনছেন ? ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে দেখব সেই ছায়ামূর্তি কোথাও মিলিয়ে গেল।  তবে এ ছায়ামূর্তি এলো কোথা থেকে ?
লোকের ধারনা যে প্রথমে কোম্পানির রাইটারদের আবাসিক ভবন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও তা পরিণত হয় ব্রিটিশ সরকারের রাজকীয় দফতরের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান কেন্দ্র হিসেবে। যদিও বাংলার সাধারণ জনগণের কাছে রাইটার্স বিল্ডিং আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার, লাল ফিতার দৌরাত্ম্যর এবং দুর্নীতির প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। সাধারণ জনগণকে ধরে নিয়ে এসে এই বিল্ডিঙে ইংরেজরা বিচারের নামে তাদের ওপর নিঃশংস অত্যাচার চালাত। কত জনকে যে বিনা বিচারে শুধুমাত্র প্রতিহিংসা মিটাতে এখানে এনে মেরে ফেলা হয়েছিল তার কোন হিসাব ছিল না। জানা যায়, এখানে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের একাধীক ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতন বা ধর্ষণের পরে তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। এই সব মৃত অত্যাচারিত অতৃপ্ত আত্মারা আজও রাতে জেগে ওঠে। তারা যেন আজও এখানে বন্দিত্ব জীবন যাপন করছে। কারণ অপঘাতে  মৃত আত্মার যে কোন দিন মুক্তি হয় না। কোন দিন তারা মৃত্যু যন্ত্রণার দুঃখ ভেদ করে আর ইহলোকে স্বাভাবিক জীবন ধারায় ফিরে আসতে পারে না। তাদের হায়, হুতাশ, দীর্ঘশ্বাস তাই আজও বুঝি জমে আছে এই রাইটার্স বিল্ডিঙের ঘরে ঘরে। অত্যাচারের এ সব কাহিনী এখানকার দেওয়ালে দেওয়ালে আজও ছায়ায় ছায়ায় যেন প্রতিফলিত হয়ে যায়--প্রতিবিম্বিত হয় জীবন যন্ত্রণার চালচিত্র রেখা !
নবান্নের আগে প্রতিটি রাতেই নাকি এই ভবনে ঘটে নানা রহস্যময় সব ঘটনা। নাইট গার্ডরা এখানকার নিশীথ ভয়ের অনেক কথা বলে, বিশেষ করে ওরা রয়টার্সের ৫ নম্বর ব্লকের কথা বলে।  রাত বাড়লেই সেখান থেকে কারও চীৎকার ভেসে আসে। কোন কোন ঘরে হাড়হীম করা শীতের অনুভব হয়। কর্মচারীরা সন্ধ্যের পরে কাজ করতে চায় না। এমন কি নৈশ প্রহরীরা ভয়ে ভয়ে তাদের রাতের পাহারা সারে। ওরা জানে এখানকার কথা। অনেক ঘরে রাতে আপনি আপনি আলো জ্বলে ওঠে আবার সে আলো ধপ করে নিভেও যায়। কখনো মনে হয় অনেক লোকের সমাগম যেন এখানে। কোন কোন ঘর থেকে ঠক ঠক টাইপরাইটারের আওয়াজ ভেসে আসে। কখনও স্তব্ধতা ভেঙে ধপ ধপ পায়ে চলা শব্দে মুখরিত হয় গভীর রাত।
এই রাইটার্সেই ঘটে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৩০ সালের ৮ নভেম্বর বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশ রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে কারা বিভাগের প্রধান অত্যাচারী ইংরেজ অফিসার এন. জি. সিম্পসনকে হত্যা করেন। এই ঘটনার অব্যবহিত পরে ভবনের অলিন্দে নিরাপত্তারক্ষী ও কমিশনার টেগার্টের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবী-ত্রয়ীর যে সংঘর্ষ হয় তা "অলিন্দ যুদ্ধ" নামে প্রসিদ্ধ। শোনা যায়, নিহত এন জি সিমসনের আত্মার নাকি এখনো মুক্তি হয় নি। আজও কোন নিশুতি রাতে বিল্ডিঙের ভেতর থেকে হঠাৎ হঠাৎ তাঁর মৃত্যু-আর্তনাদ ভেসে আসে।
এক সময় এই রয়টার্সের আশপাশে ছিল বড় বড় কলাগাছের বাগান। ইংরেজ আমলে বিচারের অজুহাতে মানুষকে হত্যা করে এই সব কলাবাগানে নাকি পুঁতে ফেলা হত। জানা যায় কিছু ইংরেজ মৃত দেহের কবরও নাকি এখানে দেওয়া হয়েছিল। ব্যালিংটনের বন্ধক যুদ্ধ, ঘোড়ায় চলা গাড়ির খেলা, মল্লযুদ্ধের খেলা, অনেক খুন জখমের ঘটনা এখানে ঘটেছে। এ সব ঘাত-অপঘাতের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এই রাইটার্স বিল্ডিং। এসব ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্যেই রাইটার্স ও তার আশপাশের জাগার এমনি বদনাম হয়ে আছে। হঠাৎ কোন গভীর রাতের নির্জনতা ভেঙে রাইটার্সের বিগত সংঘর্ষময় রক্ত-ক্লেদাত্ম ঘটনার যেন ব্যাখ্যাতীত পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে এই রাইটার্সের বিল্ডিঙে ও তার আশপাশে।
                                                                 




দীপলেখা মুখার্জী

সমর

প্রথম যখন স্বামীর ঘর করতে গেল পরী তার বয়স সবে আঠেরো। দশ বছরের বড় ব্যবসাদার ছেলের সাথে বাবা মায়ের আশীর্বাদ নিয়েই সংসারে নেমে ছিল সে। না কোন প্রেম পীরিতের চক্কোরে পরেনি পরী। রীতিমত চুলের গোছা,পায়ের পাতা, শুক্তোর ফোড়ন, গানের গলা, হাতের লেখার পরীক্ষায় উতরে তবে, ওই শশুরঘরে আলতার ছাপ ফেলে প্রবেশাধিকার মিলেছিল। পরীর চাওয়া পাওয়া চিরকালই খুব সাধারন কুলের পাশে নুন, ভাতের পাশে কঁাচা পেঁয়াজ বা লাল জামার সাথে লাল টিপেই সে খুশি।
বাসর রাতে প্রথম তার বরকে দেখল পরী। সক্কলে বলছিল, ওমন ফর্সা, লম্বা মেয়ের এমন কালো মোটা বর!.কিন্তু পরীর নিজের স্বামীকে দেখে খুব যে অপচ্ছন্দ হল তাও নয়। দিম্মা বলত, ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে একটু কমা দেখতে হলেই ভাল, তাতে মেয়েদের সুখ বারে। মেয়েরা বর সোহাগি হয়,তাছাড়া সোনার আংটি আবার  বেঁকা?!
পরীর স্বামীর কুরিয়ারের ব্যবসা।সচ্ছল পরিবার।
  সকাল দশটায় বেরিয়ে যায় অমর, ফেরে রাত নটায়।তবে অমরকে একটু ভয়ই পায়।
সব বন্ধুরা, আত্মীয়রা জিজ্ঞেস করতে লাগল,হানিমুনে কোথায় যাবি রে?তাই সেদিন রাতে একটু ভয় ভয়েই জিজ্ঞেস করল স্বামী কে, "আচ্ছা আমরা হানিমুনে কোথাও যাব?" শুধুই জিজ্ঞাসার সুর, আবদার বা আদেশ কিছু নয়। কিন্তু সেইটুকুতেই যেন, আগুনে ঘি পারল। "কেন এরই মধ্যে ঘরে মনটিকছে না বুঝি?..বিয়ের আগে খুব বেড়াতে না? কার সাথে যেতে ওই পিসতুতো দাদা? নাকি ওই মাসির ছেলে,যে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়,তোমার জন্য,সাবানটা, চকলেটা নিয়ে আসে.. চকলেট খাবে, আমার ছোট বুনুরে!!" বলে এমন নোংরা অভিব্যক্তি করতে লাগল, ভয়ে পরী বাথরুমে ঢুকে পড়েছিল।
রোজ রাতেই প্রায় নেশা করে ফেরে তার স্বামী।
  তার বিরুদ্ধে গোছা গোছা অভিযোগ জমা পরে অমরের কাছে,খাবার টেবিলে, আজ বারান্দায় দঁাড়িয়ে চুল বঁাধছিল, আজ মাছ পুড়িয়ে কয়লা, সন্ধ্যেবেলা গা ধুয়ে চুল বেঁধে সেজে বসেছিল, পিসতুতো দাদা আসবে বলে, একটা কাজ যদি পারে তোর বউ, ভাত গলিয়ে পাঁক,.. কাপ ভেংগেছে, ছাদ ঝাড় দেওয়ার নাম করে, পাশের বাড়ির বউয়ের সাথে কি আড্ডা! কি আড্ডা!.. বড়ির নাক সব থেবরা, একটা রুটিও ফুললো না,রুটিবেলার এমন ছিরি!!...
দোষের শাস্তি পেত রাতে,মার,নোংরা গালাগালি, দৈহিক অত্যাচার। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পছিল পরী। নরম পরীর চোখে জলও আসে না। বাবা মায়ের ওপর অভিমান করে বাপের বাড়ি যাওয়া ছাড়ল, এরকম ভাবেই আস্তে আস্তে নিজেকে শেষ করে ফেলবে ঠিক করে ফেলেছিল সে, কিন্তু বিধি বাম। বছর তিনেকের মাথায় শরীর জনান দিল, সে একা নয়, তার শরীরে আর একটি ক্ষুদ্র প্রাণ বাসা বেঁধেছে। ভাবল, সে যা পারেনি,হয়ত এই পুচকিটা তাই পারবে, দালান বাড়িটাকে কে ঘর বানিয়ে দেবে। খবরটা পেয়ে বাবা মা এল, তাকে নিয়ে গেল সাথে করে, এই সময় মেয়েদের বাপের বাড়িই থাকা ভাল, তাই  সাত মাসে 'সাধ' দিল, পরীর মা ঘটা করে, শশুরবাড়ির লোকজন সব এল, খেল,  যাবার আগে জানিয়ে দিয়ে গেল, "শোন মা পরী, তোমাদের বাগানে তো একটা কুয়ো আছে দেখলাম। মেয়ে হলে ওখানে ফেলে দিয়ে যেও।" কথাটা শুনে আপাদমমস্তক কেঁপে উঠল পরী, পেটের ভিতর বাচ্চাটাও ভয়ে পাশ ফিরল বোধ হয়।"ওর স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখল, মিট মিট করে হাসছে! ঠিক সেই মূহুর্তেই ঠিক করে ফেলল, পরী সে আর কখনো ওই বাড়ি ফিরবেনা।
 ছেলেই হল,কিন্তু শশুরবড়ি আর ফিরলনা পরী। তারপর অনেক ঝড়, বাবা মারা যাওয়া, দাদারা আলাদা হওয়া, শশুরবাড়ির সাথে কোর্টকাছারি। উদয় অস্ত খেটে নিজের একটা বুটিক  খোলা,ছেলেকে মানুষ করে তোলা। মায়ের দেখা শোনা করা।সেই নরমসরম পরী আজ পালটে গেছে অনেকখানি। আজ পরী খুব ব্যাস্ত, কাল তার ছেলে সমরের আঠেরো বছরের জন্মদিন। ছোট খাটো একটা অনুষ্ঠান, কিছু সমরের বন্ধুরা আসবে, তার ব্যবস্থা করেছে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে, সমরের জন্য টি সার্ট, জিন্স, কেক, কোল্ডডিন্স, মোমবাতি, চকলেট সব কিনে ঘরে ফিরল রাত করে। মা বলল, "দেখতো সমর কোথায়? সেই দুপুরে খেয়ে বেড়িয়েছে। 
"ও!দেখছি, চিন্তা করোনা মা,আমি ফোন করছি, তুমি প্রেশারের ওষুধ খেয়েছ?" বলতে বলতে সমর কে ফোন করল,  এই ছেলে তুই কোথায় রে? সেই দুপুরে বেড়িয়েছিস।" ওই প্রান্ত থেকে সমর বলল, বাবার সাথে কথা বলো, আমি এখন থেকে বাবার কাছেই থাকব, আমারতো একটা ভবিষ্যৎ আছে, বাবা আমাকে বিদেশে পাঠাবে বলেছে, হায়ার স্টাডিরর জন্য। তুমি আমায় আর ফোন করোনা মা।"......ফোনটা কেটে গেল। অনন্ত নিঃশব্দতা।হাত থেকে সদ্য কেনা উপহার সব মাটিতে ছড়িয়ে পরল!...মা পাশের ঘর থেকে ছুটে এল। বহুদিন পর, পরী তীক্ষ্ণ চিৎকার করে কেঁদে উঠল, "আমি পারলাম না মা!!হেরে গেলাম, আমি হেরে গেলাম.".. বলে মাটিতে লুটিয়ে পরল পরী। রাত যখন অনেক পরী,ঈশ্বরের কাছে   হাতজোড় করে প্রার্থনা করল,ওকে ক্ষমা করো,ওর স্বপ্ন সফল করো ঠাকুর।


অন্যদিকে তখন উৎসব, ঘড়ির
কাঁটায় বারোটা।




নীহার চক্রবর্তী

গহন মায়া 
 
ওপার বাংলার ফারুক এপার বাংলায় বেড়াতে এসেছে ওর এক ফেসবুকের বন্ধু মন্মথদের বাড়িতে । শুরুতে ওকে দেখে মন্মথর মা,বাবা আর দিদি খুব চমকে উঠলো । পরের ফারুকের ব্যবহারে তারা সবাই মুগ্ধ । মন্মথর তো আনন্দের শেষ নেই ।
ফারুক মন্মথদের বাড়িতে ছিল চারদিন । তার মধ্যে একদিন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছিল । ফারুক নিজে খেলে । ঢাকার মাঠে গিয়ে দেশের জয়ের জন্য চিৎকার করে অন্যের গলা কান ফাটায় ।
এবার সমস্যা তৈরি হল । বাংলাদেশ ভালো খেলতে শুরু করলে ফারুন বারবার চেঁচাতে শুরু করলো । বেমালুম ভুলেই গেলো ও এখন ওর ভারতের মাটিতে । বন্ধু মন্মথ আর ওর পরিবারের সবাই ভারতের নাগরিক ।
মন্মথ একবার খুব বিরক্তির সঙ্গে বলল ফারুককে,''তোমার বোঝা উচিৎ এ দেশ বাংলাদেশ নয় । ভারত । এ দেশ তোমাদের স্বাধীনতা পেতে সাহায্য করেছে একসময় ।''
মন্মথর কথা শুনে ফারুক হেসে ফেললো ।
ও হেসে-হেসে বলল,''সব মানছি । কিন্তু আমার মন-প্রাণ হুড়ে আমার প্রিয় দেশ । আমি এখানে দেশ-বিদেশ বুঝি না ।''
সেইথেকে সে রাতে ফারুকের সঙ্গে মন্মথর এক ব্যবধান তৈরি হয়ে গেলো । ভারত জিতেছে সে ম্যাচে । ফারুক ভারতীও দলের প্রশংসা করলো বেশ । কিন্তু মন্মথ তা কানেও নিলো না । বিরক্তি আর বিরক্তি তখন ওর । মন্মথর বাবাও খুশী নয় ফারুকের ব্যবহারে ।
সে রাতেই ফারুক সিদ্ধান্ত নিতো দেশে ফেরার । মনে মনে বলল,আর একদিন থাকা যেতো । কিন্তু আর এক মুহূর্ত থাকলে আমার দেশের অপমান । আস্র নয় । সকাল হলেই দেশের দিকে পা বাড়াচ্ছি ।
তাই করলো ফারুক । ভোরে ঘুম থেকে উঠে মন্মথকে জানিয়ে দিলো ওর সিদ্ধান্ত । মন্মথর তাতে কোন হেলদোল নেই । ওর বাবাও শুনল ।
সে বিরস=বদনে বলল,''ঠিক আছে ।''
কিন্তু মন্মথর মা শুনে চমকে উঠলো ।
 
সে ফারুকের হাত ধরে সস্নেহে বলল,''আর একদিন থেকে গেলে হয় না,বাবা ?''
ফারুক তখন ছলছল চোখে প্রায় অস্ফুট-গলায় তাকে বলল,''আর হয় না,মা । আমি আমার দেশের সম্মান বাঁচাতে মরীয়া । তার সাথে আপনার সম্মানও জড়িত । আপনার দেশ ছিল তো সেই পাবনা । তবে ? আসি,মা । সবাই মিলে ভালো থাকবেন ।''
সেই প্রথম । সেই শেষ ফারুক আসে এপার বাংলায় । তারপর আর ভাবতেই চায়নি । অন্য দেশে যাওয়ার সুযোগ ছিল ওর । তাও হেলায় দূরে সরিয়ে দিয়েছে । নিজের দেশের ধূলি-কণা দেহমনে মাখতে ও কি যে আনন্দ পায় । সে আর ভাষায় কহতব্য নয় ।


আফরোজা অদিতি

গৃহপ্রবেশের দিন


   বাড়িটি সুন্দর হয়েছে! ফ্ল্যাটটি অনেক যত্নে গুছিয়ে করেছে বীথি; গুছিয়ে করার চেয়ে বড় কথা নিজের মাথা গুঁজবার একটি নির্দ্দিষ্ট ঠাঁই; বাবুই পাখির বাসাবাড়ি! এতোদিন ভাড়া বাসায় থেকেছে, থাকতে থাকতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েও কিছু বলতে পারেনি কিছু, ইচ্ছে হলেও মনের মতো গুছিয়ে রাখতে পারেনি। স্থান সংকুলান হয়নি তাই তৈরি করতে পারেনি নিজের পছন্দের আসবাব। ভাড়া বাড়িতে নিজের পছন্দমতো আসবাব তৈরি করা যায় না। স্থানাভাব ছাড়াও আছে বাসা বদলের ঝক্কি! এই সব ঝয়-ঝক্কি যাতে পোহাতে না হয় সেজন্য নিজের শখকে বুকের ভেতর কষ্ট-চাপা দিয়ে রেখেছিল বীথি। স্বামী, মহিদুল একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে; একজিকিউটিভ। ভালো বেতন। এছাড়া বীথিও একটা চাকরি করে; ওদের সংসার বড় নয়। ওরা দুজন আর ওদের একটি ছেলে। শ্বশুর-শাশুড়ি গ্রামে থাকেন। মাসে একবার এসে ঘুরে যান। দুজনের বেতন মিলিয়ে সংসার চালাতে কোন অসুবিধা হয় না বীথির।  তাই মহিদুল যখন গৃহনির্মাণ ঋণ নিয়ে এই ফ্ল্যাটটি বুকিং দিলো তখন খুব খুশি হয়েছিল বীথি; ভেবেছিল ফ্ল্যাটের আসবাব ফিটিংস সবই নিজের পছন্দমতো কিনবে, সেকথা জানিয়েছিল স্বামীকে। স্বামীর পরামর্শে নিজের পছন্দে কিছু কিনেছে, কিছু তৈরি করেছে তারপর সাজিয়েছে। পছন্দের জিনিসে তৃপ্তি থাকে, পরিপূর্ণ থাকে মন। ওরও তাই!

    যেদিন নতুন বাড়িতে এলো সেদিন বীথির চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়লো বসন্তের আভা; দুপায়ে ভর করলো শালিক পাখির চঞ্চলতা। হৃদয় জুড়ে শান্ত নদীর উদাম্মতা! নিজের একটি ফ্ল্যাট! একান্তই নিজস্ব। পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছা করছে ওর! উচ্ছল উদ্বেল বুকের ভিতর প্রশান্তি! বাড়িওয়ালার চোখ রাঙানি থাকবে না, থাকবে না বাসা বদলের নোটিশ। যখন তখন টোপলা-টুুপলি বাঁধা, কার্টুনের পর কার্টুন সাজিয়ে ঠেলা গাড়ির পেছন পেছন এসে খোলাখুলি করে আবার সজানো-গোছানো লাগবে না! উঃ বাসা পাল্টাতে পাল্টাতে হাঁফিয়ে গিয়েছিল বীথি! এখন একটু নিস্তার পাবে। প্রতিমাসে সংসার খরচের সিংহভাগ তুলে দিতে হবে না বাড়িওয়ালা নামক ঐ মহাজনের হাতে; একদিন দেরীতে হলে শুনতে হবে না বাড়িওয়ালার কোন হম্বিতম্বি!  কী বিশাল ভার নেমে গেছে মাথা থেকে!
গৃহপ্রবেশের দিন ছুটি পায়নি মহিদুল। অফিসে জরুরি কাজ থাকায় ছুটি দেয়নি ম্যানেজার সাহেব। ওদের শনিবারেও অফিস করতে হবে তাই সাপ্তাহিক ছুটির একটি দিনেই সব মালপত্র আনতে হয়েছে। সবকিছু গাদাগাদি করে রাখা। পা ফেলার জায়গা নেই। এর মধ্যে শ্বশুর-শাশুড়ি এসেছেন।  ওদের আসার কথা কয়েকদিন পর; বীথি ভেবেছিল ঘর-বাড়ি একটু গুছিয়ে নিয়েই শ্বশুর-শাশুড়িকে আসতে বলবে! কিন' আগেই চলে এসেছেন তাঁরা; তাদের কোথায় বসাবে, কোথায় বিশ্রামের জায়গা দিবে, খেতে দিবেই বা কী এসব নিয়ে বড় বিব্রত হয়ে আছে বীথি। একঘর  একঘর করে যতোটা সম্ভব এবং জরুরি জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখছে বীথি আর ব্যস্ত মহিদুল ঘর-বার করছে ঠেলাওয়ালাদের সঙ্গে। বীথি শ্বশুরের বিশ্রামের জায়গা ঠিক করে নিজের বেড-রূমটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। হঠাৎ মহিদুলের চিৎকারে চমকে উঠে বাইরে আসে।কী হয়েছেজিজ্ঞেস করার আগেই দেখতে পায় ওর হ্যান্ডব্যাগ যেটি শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভুলে মেঝেতে নামিয়ে রেখেছিল সেটি নিয়ে বাথরূমে রেখে এলো মহিদুল। কেন? কেন বাথরূমে রেখে এলো! মহিদুল তো ব্যাগটি ঘরের বিছানায় রাখতে পারতো! ঠিক আছে ব্যাগটা ঘরে না রেখে ঐ খানে রাখাটা ওর ভুল হয়েছে! কিন' ও তো ইচ্ছে করে ওখানে রাখেনি, শাশুড়িকে সাহায্য করার জন্যই ব্যাগ নামিয়ে রেখেছিল ওখানে। এই কথা ভেবেই বিরক্ত হলো বীথি; সেই সঙ্গে রাগও। বিরক্ত আর রাগ হলে বীথির কান্না পায়। ঘরে এসে কাঁদলো কিছুক্ষণ! কেঁদে কেঁদে মন হালকা হলে চোখ মুছে বাইরে এসে আবার গোছানোর কাজে হাত লাগায়। এই গোছগাছের মধ্যেই পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা এলেন দেখতে; ‘আপনারা আজই এলেন বুঝি।
হ্যাঁ।বীথি ছোট্ট দিয়ে বলে, ‘বসুন আপা।
না-না। আপনাদের কাজের সময় বিরক্ত করছি।
বিরক্ত কিসের আপা, বসুন। কাজ তো থাকবে।পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা বসলেন না। এঘর-ওঘর ঘুরে ফিরে গেলেন।

   মহিলা চলে গেলে রান্নাঘরে এলো বীথি। তৈজসপত্র গোছাতে গোছতে দেখতে পেলো যা ভেবেছিল তা হয়নি; আসলে সবকিছু পরিকল্পনামতো হয় না। আর সেই কথাটি বলতেই স্বামীকে ডাকলো বীথি। স্বামী এলে বলল, ‘দেখ, এখানে চালের ড্রামটা ঢুকছে না।
ড্রাম ঢুকছে না তো শাবল এনে ভেঙে ফেল।মহিদুলের এই রকম বাঁকা জবাব শুনে বীথির সহ্য হলো না। বুক ভেঙে কান্না এলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘এতো খারাপ ব্যবহার করো কেন? এই রকম ব্যবহার কোন স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে করে না। তুমি কী একাই কাজ করছো, আর কেউ করছে না।মহিদুল কথা বলে বেরিয়ে গেছে; বীথির কান্না তো আর থামে না। মহিদুল এমনই। একটু বাড়তি কাজ করতে গেলেই মেজাজ গরম হয়ে যায়! কিছুই যেন পছন্দমাফিক হয় না তার কাছে। সব সময়ই তার ধারণা, কাউকে দিয়ে কিছুই হয় না। এবারও তাই হয়েছে; ফ্ল্যাটের কাজকর্ম দেখেছে বীথি তাই সব দোষ এখন ওর। মানুষ এমনই। সবকিছুই নিজের মতো করতে চায়! মহিদুলও এর ব্যতিক্রম নয়! মহিদুল সম্পর্কে এসব জেনেও কান্না থামাতে পারে না বীথি; কেঁদেই চলে।

   রান্নাঘরে জল খেতে এসে দেখে তখনও কাঁদছে বীথি। বীথির কান্না সহ্য করতে পারে না মহিদুল; কান্নায় বিচলিত হয়ে ওর গা ঘেঁষে বসে মহিদুল। পিঠের পরে হাত রেখে আলতো জড়িয়ে ধরে। বীথি কেঁদেই চলে; কিছুক্ষণ কান্নার পরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে, ‘এই বাড়িটি অপয়া, এ বাড়ি ভালো নয়! এখানে ঢুকেই চোখের পানি ফেলতে হলো। কার মুখ দেখে যে ঘুম থেকে উঠেছিলাম।আবার কাঁদতে শুরু করে। ডোর-বেলের আওয়াজ শুনে মহিদুল উঠে যায়। বীথিও কান্না বন্ধ করে; করতে হয়! জীবনে সবসময় কান্না করা যায় না! কষ্ট চেপে কান্না বন্ধ করতে হয় এটিই হলো জীবনের নিয়ম। দোতলা থেকে ভদ্রলোক এসেছেন পরিচিত হতে। ভদ্রলোক কথা বললেন কিছুক্ষণ। এখানে মাত্র কয়েকদিন, কাজের জন্য কোন লোক পায়নি এখনও। ঐ এলাকার বুয়া এই এলাকায় কাজ করতে আসবে না। বাড়ি গোছানো পর্যন্ত থাকতে বলেছিল ওকে  কিন' থাকেনি। বুয়ার স্বামীর বারণ। এখন একাই সব করতে হচ্ছে। দোতলার ভদ্রলোককে এক গ্লাস শরবত আর মিষ্টি দিতে যেতে হয় বীথিকেই।  

   রাত বারোটা বেজে গেছে। সকাল থেকে কাজ করছে। খাওয়াও হয়নি! সব ঘরেই কিছু কিছু জিনিস ডাঁই করে রাখা; রাখতে হয়েছে। একদিনে সব গুছিয়ে ওঠা সম্ভব নয়! এখন মধ্যরাত; শ্বশুর,শাশুড়ি, ছেলে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। ওরা দুজন খেতে বসেছে।  সারাদিনের কাজের ধকলের পর এমনিতেই খাওয়ার ইচ্ছা থাকে না, তার পরে আবার রাত হয়েছে অনেক! এতো রাতে খাওয়ার অভ্যেস নেই ওদের; সামান্যই খেল ওরা। খাওয়ার সময় ম্লান মুখে বলে মহিদুল, ‘ তুমি আমার ওপর রাগ করো না। আমি তো এইরকমই। বেশি কাজের ঝামেলা হলেই অকারণ রাগ হয় আমার। আর রাগ হলে কী যে করি সে খেয়ালও থাকে না। সরি।মহিদুলের কথার কোন উত্তর করে না বীথি; করতে ইচ্ছে করে না। একমনে খাবার-দাবার গুছিয়ে রাখতে থাকে। বীথি কাজ করলেও যে কাঁদছে তা বুঝতে পারে মহিদুল। এগিয়ে আসে কাছে; বলে, ‘অমন করে কেঁদো না সোনা, আমার ভালো লাগে না।
তবুও কথা বলে না বীথি। ওকে দুই হাতে জড়িয়ে বলে, ‘তুুুমি এমন করে কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়!’
থাক ন্যাকামো না করে, শুতে যাও।
কী বলছো ন্যাকামো করছি! না না তা করছি না। তুমি আমার সব! এই সবই তো তোমার জন্য! আমার আর কে আছে বলো! তুমি ছাড়া কেউ নেই আমার! তাই রাগ-গোস্সা যাই বলো সব দেখাই তোমাকে। সরি, আমার কলাবতী বউ!’ বীথি তবুও মুখ ঘুরিয়ে থাকে। মহিদুল পাগলের মতো স্ত্রীর হাতে পায়ে মুখে চুমু খেতে থাকে। এবারে বীথি অস্বস্তিতে পড়ে! বলে, ‘থাম, করো কী! আমি তো রাগ করিনি, কষ্ট পেয়েছি! আজকের যে কষ্ট দিয়েছ তুমি, এই কষ্ট আমার কখনও যাবে না।বীথি আবার কাঁদতে শুরু করে। মহিদুল স্ত্রীর কান্না সহ্য করতে পারে না। বুকের ওমে জড়িয়ে রাখে। বলে, ‘আার কাঁদিস না বউ; আর কখনও এরকম করবো না। কত্তবার ভাবি এই অভ্যাস বদলে ফেলবো কিন' হয় না, পারি না, পারি না রে বউ! আমারে বিশ্বাস কর। না হলে জান.. .স্বামীর কথায় এবারে জোরে ফেুঁপিয়ে ওঠে; ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়েই বলে, ‘ এমন কথা বলো না। তোমার জন্যই তো সব কিছু করি! তুমি আর ছেলে ছাড়া আমাকে দেখার আর কে আছে বলো তো! তাছাড়া তুমি জানো এই রকম ছোট ছোট কথাতেই ভেঙে যায় আমার মন, অথচ অনেক বড় আঘাতেও কিছু হয় না আমার।এই কথার পরে নিরব হয়ে যায় দুজনে। মহিদুল বুকের ওমে গভীরভাবে জড়িয়ে রাখে আর বীথি স্বামীর এই মমতামাখা ভালোবাসার স্পর্শ নিয়ে বসে থাকে। ওকে এভাবে জড়িয়ে রেখে কিছুক্ষণ পরে বলে মহিদুল, ‘আর ভুল হবে না, এবারের মতো .. ..’ বলেই বীথির মুখ দুহাতে তুলে ধরে চুমু দিয়ে মুছে নেয় চোখের জল।
          
 

সুমনা সাহা

ভবিতব্য

শেষ রাতে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় সুষমার। ডিসেম্বরের ২২ তারিখ আজ, সামনে মকর সংক্রান্তি। ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে কদিন ধরে। তবুও সমস্ত শরীর তার ঘামে ভিজে একসা। কী একটা দুঃস্বপ্নই দেখছিল বোধহয়। খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম হলেই অ্যাসিড হয়ে যায়আর তার থেকেই উল্টোপাল্টা স্বপ্ন তৈরি হয় বলে সুষমার বিশ্বাস। সে যথেষ্ট যুক্তিবাদী। অকারণে ভাবাবেগের বাড়াবাড়ি তার পছন্দ নয়। মশারি উঁচু করে মেঝেতে পা দিয়ে হাতড়ে চপ্পল জোড়ার নাগাল পেতে চায়। চপ্পল পায়ে গলিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে টেবিল থেকে মোবাইল তুলে দেখে দুটো পঞ্চাশ। এমনিতে সুষমার খুব ভোরে ওঠার অভ্যেস। মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে তিনটে পঞ্চান্নর। উঠেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে চোখেমুখে জল দিয়ে কাপড় ছেড়ে জপ করতে বসে যায়। উনিশ বছর হল, সে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষা নিয়েছে, তারপর থেকে নিষ্ঠাভরে সকাল সন্ধ্যে গুরুদেবের নির্দেশ মতো জপে বসে, গাফিলতি করে না। আজ এক ঘন্টা আগেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। যাক, এখন আর শোব না,” মনে মনে ভাবে সুষমা। ধীরে সুস্থে হাতমুখ ধোয়, কাপড় পালটায়, স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করেকিছুতেই ধরা দেয় না, অস্পষ্ট! কিছু একটায় ভয় পেয়েছিল, সেটা এখন মনে পড়ছে। কিন্তু কীসের ভয়? যাকগে বাবা, সক্কাল সক্কাল কেন এসব বাজে কথা ভেবে মরি! সে ধূপ জ্বেলে জপের মালা নিয়ে বসে যায়। জপে বসলেই মনটা শান্ত হয়ে যায়, আর বহুকালের ভুলে যাওয়া অনেক স্মৃতিও মানসপটে ভেসে ওঠে। এই নিয়ে তাঁর গুরুদেব ভারি মজা করতেন। বলতেন, “কোনকিছু ভুলে গেলে মনে করার জন্য মাথার চুল ছেঁড়ার দরকার নেই। যখন জপে বসবে, যত রাজ্যের ভুলে যাওয়া কথা সব মনে পড়বে। ধীরে ধীরে মনকে চিন্তামুক্ত করে জপে ডুবতে চায় সুষমা।

আজ পার্থ আসবে। বাজার যেতে হবে। পার্থ চুনো মাছের ঝাল খেতে ভালবাসে। যদি ভাল মৌরলা মাছ পাওয়া যায়, নিয়ে আসব। আজ শনিবার, বেগুন পোড়াব। কালকের রান্না করা লাউ ডাল আর কলমী শাক ভাজা ফ্রিজে আছে। পার্থর জন্য একটু চিকেন নিয়ে নিলে হবে। রাত্রে রুটির সঙ্গে খেতে ওর ভাল লাগবে। এইসব ভাবতে ভাবতে বাজারের থলিটা নিয়ে এগোয়। ওর ঠিক এক পা আগে আগে এক পৃথুলা মহিলা পথ আটকে চলেছে, গায়ে কালো চাদর। যতই ওকে পাশ কাটাতে চাইছে সুষমা, ততই ওই মহিলা পথ আগলে চলেছে। বিরক্ত সুষমা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। অবশেষে পাশ কাটাতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ওর সামনে কেউ পথ আটকে চললে খুব বিরক্ত লাগে। ঘাড় ঘুরিয়ে মহিলার দিকে একবার তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে ওর সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়, “এই তো! একেই তো ও শেষ রাত্রে স্বপ্নে দেখেছে!” সেই মহিলা সুষমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি দেয়। কেন জানি না সুষমার সমস্ত শরীর শিরশির করে ওঠে! যে অস্বস্তি নিয়ে আজ এক ঘন্টা আগে ঘুম ভেঙ্গে গেছিল, সেই অস্বস্তিটা আবার ফিরে আসে। সুষমা মনের মধ্যে বিচার করতে শুরু করেকোথাও তো অস্বস্তির কোন কারণ নেই। সব কিছু অত্যন্ত স্বাভাবিক! তবে! অন্যমনস্ক ভাবে বাজার করতে থাকে। একসময় মহিলার মুখটা মন থেকে মিলিয়েও যায়। সব নেওয়ার পর আবার মনে পড়ে, কাঁচালংকা নেওয়া হয়নি। কাঁচালংকার দোকানী বলে, “মাসিমা, এই ধনেপাতাটুক দিয়ে দেব? আমার ঘরের উঠোনে হয়েছে। সুষমা হেসে বলে, “দাও বলছ যখন, কত দেব?” মনে মনে ভাবে, “ভালই হল, বেগুন পোড়ায় ধনেপাতা দিয়ে মাখলে বেশ লাগে। আমার তো মনেই ছিল না!” দোকানী ছেলেটা বলে, “নিয়ে যান, কিছু দিতে হবে না। সুষমা নিচু হয়ে ধনেপাতাটা ব্যাগে রাখছে, ঘাড়ের ঠিক পিছনে কার নিঃশ্বাস পড়ল। বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘোরাতেই দেখে সেই কালো চাদর পরা মহিলা, মুখে একটা বাঁকা হাসি! সুষমার সমস্ত অন্তরাত্মা যেন কেঁপে উঠল সেই মহিলাকে দেখে। কিন্তু উপরে সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। ভাবল, “আমার হল কী? এই মহিলাকে আমি কি আগে কোথাও দেখেছি? ওকেই স্বপ্নেও দেখেছিলাম এখন সেটা মনে পড়ছে। এইরকমই পদে পদে আমার পিছু নিয়েছিল। আবার এখন সত্যি সত্যিই সেই মহিলা আমার আগেপিছে ঘুরছে। এটা কি নেহাত কাকতালীয়? সুষমা এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। আচ্ছা, ঐ মহিলার সঙ্গে আলাপ করে জেনে নিলে তো হয়, ওকে আগে কোথাও দেখেছি কি না! হয়তো ওনারও আমাকে চেনা চেনা লাগছে। তাই হয়তো আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। কিম্বা একটু ফাঁকা পেলে কিছু চাইবে, লোকজন আছে বলে লজ্জায় চাইতে পারছে না। হয়তো ভদ্রঘরের বৌ, কোনও কারণে অসুবিধায় পড়েছে।সাতপাঁচ দ্রুত চিন্তা করে মহিলার সঙ্গে আলাপ করার জন্য পিছন ফেরে। নেই, কোথাও নেই সেই মহিলা! আশ্চর্য! এই এক্ষুনি তো ছিল! এরই মধ্যে গেল কোথায়? আজ বাজারে এমন কিছু ভীড় নেই যে ভীড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাবে,দেখাই যাবে না? কী অদ্ভুত ব্যাপার! সত্যি, মহিলাকে যতদূর চোখ যায় আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কী হচ্ছে? সুষমার মনটা ডিস্টারবড লাগে।

পার্থ সুষমার একমাত্র ছেলে। ও এই বয়সের আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। ছোটবেলা থেকেই অন্তর্মুখ। পাড়ায় বিশেষ বন্ধুবান্ধব ছিল না। হয় বইয়ে মুখ গুঁজে নয়তো কম্প্যুটার নিয়ে বসে থাকা অভ্যাস। মেয়ে শতরূপাও ছিল ভারী ঠাণ্ডা প্রকৃতির। যে ওর সঙ্গে একদিনও কথা বলেছে, সেই বলত, “কী মিষ্টি কথা গো! প্রাণ জুড়িয়ে যায়!” সুষমা ধর্মপ্রাণ পরিবারের মেয়ে। বাড়িতে লক্ষ্মীপূজো, সরস্বতী পূজো, সত্যনারায়ণ পূজো এইসব লেগেই থাকত। সেই ধর্মবোধ সে ছেলেমেয়ের মনেও সঞ্চারিত করেছে। সুষমার স্বামী প্রবালবাবু চাইতেন ছেলেমেয়েরা জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযুক্ত চৌকষ হোক। সুষমা যে তাদের মাথায় ধার্মিকতার অসুখ ঢুকিয়ে দিচ্ছেএই নিয়ে প্রবালের আপত্তি ছিল। স্বামী-স্ত্রীতে প্রায়ই মতান্তর থেকে মনান্তর হতো। কিন্তু তা কখনোই বড় ধরনের সাংসারিক অশান্তির সৃষ্টি করেনি। কারণ সুষমা ঝগড়া করতে পারে না। তাই কথা কাটাকাটি ঝগড়ার দিকে মোড় নিলেই সে একেবারে চুপ করে যেত। একটি নামকরা বেসরকারি সংস্থায় উঁচু পদেই ছিলেন প্রবালবাবু। হঠাৎই একদিন অফিস থেকে অসময়ে ঘরে ফিরলেন বুকে সামান্য ব্যথা নিয়ে। চিরকালই নিজের মতে চলেন, কারো কথা মেনে নেবার লোক নন। তাই সুষমা ডাক্তারবাবুকে খবর দেবার কথা বললেও শুনলেন না, অম্বলের ওষুধ খেয়ে বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি সেই যে শুয়ে পড়লেন, আর উঠলেন না। সকালে ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে দেখে বললেন,রাত্রে ঘুমের মধ্যে হার্টফেল করেছেন। তখন মেয়ের বয়স নয় আর পার্থ মাত্র পাঁচ বছরের শিশু। এতবড় ধাক্কায় সুষমার দিশেহারা মন একটা অবলম্বন খুঁজছিল। তাদের এলাকায় কাছাকাছি যে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রম ছিল, তখন থেকেই সেখানে যাতায়াত শুরু। ছেলেমেয়ে দুজনেই মায়ের সাথে সাথে মিশনে যাতায়াত শুরু করে। মহারাজরাও তাদের খুবই স্নেহ করেন। দুজনেই একটু বড় হওয়ার পর থেকে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে সন্ন্যাস জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই নিয়ে মিশনের মহারাজদের সঙ্গেও সুষমার আলোচনা হয়। সকলেই একবাক্যে বলেন, “মা, তোমার দুটি সন্তানকেই কোলছাড়া করতে আমরা চাই না। তুমি ঠাকুরের বাগানের মালী। সুন্দর ফুল ফুটিয়েছ, এখন প্রভু যদি সেই ফুল উপহার চান, তবে তুমি ধন্য। সন্তান তিনিই দিয়েছেন, তাঁরই সন্তান। তোমার কাজ ছিল শুধু পালন করা। কিন্তু একটি সন্তান ঠাকুরকে দাও, একটি তোমার থাক। নইলে তুমি যে বড় একলা হয়ে যাবে মা!” সুষমা মৃদুস্বরে বলেছে,“সব কী আমার হাতে মহারাজ! ঈশ্বরের যা ইচ্ছা তাই হোক। আমি কাউকে বেঁধে রাখতে চাই না। শতরূপা অংকে অনার্স নিয়ে বি এস সি পড়ছিল। সারদা মঠের সঙ্গে ওর কথা হয়েছিল, এম এস সি কমপ্লিট করে ও মঠে যোগ দেবে। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। মাত্র তিনদিনের জ্বরে শতরূপা সকলের মায়া কাটিয়ে চলে গেল ভগবানের কোলে। সুষমা যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। আর পার্থ তখন থেকে আরও বেশী করে নিজের মধ্যে ঢুকে পড়ল। মনের সাধের একটা ঘরে চিরতরে তালাবন্ধ করে দিল সে। ছেলে বুঝেছে,মায়ের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন সে। তার মাকে ছেড়ে যাওয়া চলবে না। সুষমা বুঝল সবই। তাঁরই জন্য ছেলের সন্ন্যাসের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাবে! সহস্র জন্মের শুভ কর্মফলে পরম ভাগ্যে হৃদয়ে বৈরাগ্য ধনের উদয় হয়। সে রত্নগর্ভা। দুই সন্তানই বৈরাগ্যের পথে হাঁটতে চেয়েছিল। কিন্তু ভবিতব্য বলে একটি অমোঘ বস্তুকে মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। তার এখন সাহস হয় না যে ছেলেকে বলে, “আমার কথা ভাবিস না, তুই চলে যা তোর মন যেদিকে চায়!” পারে না একথা বলতে। মনে বল পায় না। বয়স বাড়ছে, বড় অসহায় লাগে।
পার্থ সদ্য একটা চাকরি পেয়েছে। পাঁচ মাসের ট্রেনিং-এর পর পোস্টিং দেবে। এই শহরেই ট্রেনিং-এ জয়েন করেছে। কিন্তু ওরা ট্রেনিদের রেখেছে ওদের গেস্টহাউসে। শনি-রবিবারে ও বাড়িতে মায়ের কাছে আসে। ছেলেকে ছেড়ে থাকার সুষমারও একটা ট্রেনিং চলছে। এরপর হয়তো চেন্নাইয়ে পাঠাবে, নয়তো হরিয়ানা। কে জানে! তখন তো আরও বেশীদিন ছেড়ে থাকতে হবে।

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সুষমা রান্না করে। স্নান করে পূজো সেরে অল্প খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে সে যাবে আশ্রমের সন্ধ্যা আরতী দর্শনে। সাড়ে ছটার মধ্যে ঘরে ফিরবে। পার্থ আসতে আসতে সাতটা-সাড়ে সাতটা বাজবে। আজকে মেয়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। চোখে জল আসে। মনে মনে বলে, “ঠাকুর, যেখানে যেভাবে আছে, ওকে তুমি শান্তি দিও!” একটা বই নিয়ে বিছানায় আসে। দিবানিদ্রার অভ্যাস যে আছে তার, এমন নয়। তবে পনের মিনিটের জন্য হলেও একটু চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম না নিলে, শরীরটা ভাল লাগে না। কেমন বুক ধড়ফড় করে। ঘড়িতে তিনটে বাজে দেখে বই মুড়ে রেখে চোখ বন্ধ করল সুষমা। ধীরে ধীরে চারপাশটা কেমন ঘোর কালো হয়ে এল। ভীষণ শীত করছিল তার। পায়ের কাছ থেকে কম্বলটা টেনে নিতে গেলেই ঘুমের আমেজটা কেটে যাবে। চোখ দুটো একদম খুলতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু বড্ড ঠাণ্ডা লাগছে। কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে গা টা একটু গরম করে নিই, ভেবে সুষমা চোখ খোলা মাত্র দেখে সেই মহিলা তার বিছানার উপর বসে একেবারে মুখের কাছে মুখটা ঝুঁকিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ভয়ে সমস্ত শরীর হিম হয়ে যায় সুষমার। একি সর্বনাশ! একটা অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে আসে তার অসাড় কণ্ঠ ভেদ করে। প্রবল মনের জোরে সে এক ধাক্কায় ঐ মহিলাকে সরিয়ে উঠে বসে। দেখে জানলার কাঁচের বাইরে কাঁঠাল গাছের ছায়া নড়ছে। ঘুলঘুলিতে চড়াই পাখি কিচমিচ করছে। বিকেলের আলো মরে এসেছে। ঘড়ির কাঁটা দেখাচ্ছে চারটে পঁচিশ। কেউ কোত্থাও নেই। চারিদিক অসম্ভব চুপচাপ। অনেকক্ষণ বসে থেকে সুষমা নিজের বুকের ধুকপুক আর ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শুনতে থাকে। দেওয়ালে প্রবালের ছবিএকদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকে সুষমা। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে যান্ত্রিক ভাবে ওঠে, তৈরি হয়ে বেরোয়।

যাতায়াতের পথে লোকটাকে রোজই দেখে সুষমা। উস্কোখুস্কো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। একটা প্লাস্টিকের চাদর পেতে বটগাছের নিচে বসে থাকে। সামনে কতগুলো শিকড় বাকড় আর পাথর ছড়ানো। ক্বচিৎ কখনো কেউ তার সামনে নিজের হাতের তালু মেলে ধরে। নয়তো বেশীরভাগ সময়ে লোকটা ফাঁকাই বসে থাকে। আজকে সুষমা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বেরিয়ে পড়েছে। ঘরের মধ্যে ভাল লাগছিল না। লোকটার সামনে দাঁড়াতেই উৎসুক ঘোলাটে চোখ তুলে বলে, “মা, ভাগ্য গণনা করাবেন? আসুন না, দশটা টাকা দেবেন মাত্র। আমি তো ভিক্ষা চাইছি না। এতো একটা বিদ্যা। নেহাৎ ডিগ্রি নেই বলে দোকানে বসতে পারি না। একদিন দেখুন না, যদি কিছু না মেলে পয়সা দেবেন না। সুষমা জানে, ভাগ্য বদলানো যায় না। তাই যদি যেত, ঐ লোকটা এত লোকের ভাগ্যবিধাতা, আর নিজের দুঃখ ঘোচাতে পারে না কেন? কেন তাকে দশটা টাকার জন্য লোককে খোশামোদ করতে হয়? আর যা বদলানো যাবে না, তা জেনে কী লাভ? কিন্তু আজকে সকালে ঘুম ভাঙ্গার থেকেই মনটা যেন ছানা কেটে গেছে। ভীষণ অস্থির লাগছে। কিছুই ভাল লাগছে না। তাই যন্ত্রচালিতের মতো সে লোকটার সামনে বসে পড়ল। লোকটা কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে সুষমার হাতটা হাতে নিল। হাতের দিকে তাকিয়ে সে স্পষ্ট চমকে উঠল। অনেকক্ষণ তাকিয়েই থাকল,তারপর সুষমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে শুকনো গলায় বলল, “আপনার কী বিশেষ কোন জিজ্ঞাসা আছে?” সুষমা বলল, “আমি আর কতদিন বাঁচব বলতে পারবেন?” জ্যোতিষি কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে কি জানি কি ভাবল। তারপর বলল, “জীবন মৃত্যু তাঁর হাতে মা! আমরা তো পুতুল! যখন সময় হবে, তিনি নোটিশ পাঠাবেন। সকলে তো তা বোঝে না। তবে যাদের মন খুব শুদ্ধ, তারা মৃত্যুর আগে কিছু ফিল করতে পারে!” সুষমা দ্রুত উঠে পড়ল। তাকে আরতীতে যেতে হবে।
একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে সুষমা বলল, “এই নিন আপনার দক্ষিণা। 
খুচরো দশ টাকা দিন না মা!”
সুষমা হেসে বলল, “আমার ফেরৎ চাই না,আপনি রেখে দিন।
জ্যোতিষি টাকাটা কপালে ঠেকিয়ে বলল,“ভগবান আপনার মঙ্গল করুন!”

খেতে খেতে পার্থর সঙ্গে গল্প করছিল সুষমা। ওর ট্রেনিং-এর গল্প শুনছিল। খাওয়া কখন শেষ হয়ে গেছে। মা-ছেলে কথা বলতে এতই মশগুল ছিল যে এঁটো হাত শুকিয়ে গেছে, হুঁশ নেই। সুষমা বলল, “বাবু, আমি তোর বিরাট বন্ধন, নারে?”
পার্থ মায়ের দিকে তাকালো,ওর বড় বড় শান্ত চোখ দুটোয় জল চিকচিক করে উঠল, বলল, “মা, এরকম কেন বলছ? তুমিই তো আমার সব! যেখানেই পোস্টিং দেবে, আমিতো তোমাকে নিয়ে যাব। একলা থাকতে দেব নাকি?”
সুষমা ধীরে ধীরে একটা একটা শব্দ যত্ন করে উচ্চারণ করে বলল, “দেখ বাবু, আমি যদি মরে যাই, তুই মঠে জয়েন করিস,মনে কোনও বাধা রাখিস না! আমার আত্মা তাহলে শান্তি পাবে জানিস!”
পার্থ বাঁ হাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,“মাগো,তুমি যদি এমন কথা বলো,আমার যে কত কষ্ট হয়,বোঝ না!”
সত্যি বাবা!যে কূলে কেউ সন্ন্যাসী হয়,তার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার হয়ে যায়,জানিস তো?”
আবেগে পরিবেশ আর্দ্র হয়ে ওঠে।
খাওয়ার পর সুষমা রান্নাঘরের কাজ সারে,পার্থ টিভিতে নিউজ শোনে। তারপর একসময় মা ছেলে দুই ঘরে শুতে যায়।

সুষমার চোখে আজ ঘুম নেই। স্থির হয়ে শুয়ে সে ঘড়ির টিক টিক শুনতে থাকে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়। অনেক দূরে কোথাও রাতের পাখি টি টি করে একটানা ডেকে চলে। কীসের যেন প্রতীক্ষায় সুষমার সমস্ত মনপ্রাণ টানটান হয়ে আছে। রাত ক্রমে ঘন হয়। চোখটা বুঝি একটু জড়িয়ে এল! খুব শীত করছে। চারদিকটা নিকষ কালো হয়ে এসেছে। জড়ানো চোখ খুলে সুষমা তাকায়। সে এসে বসেছে সুষমার বিছানায়, অতি নিকটে। গায়ের কালো চাদরটা দিয়ে সুষমাকে জড়িয়ে ধরে। সুষমার আর ভয় করে না। তার মনের মধ্যে একটা গানের কলি ভেসে ওঠে—“প্রভু আমার প্রিয় আমার পরম ধন হে!” সরাসরি তাকায় সেই মহিলার দিকে, আশ্চর্য! এ যে সে নিজেই নিজের ছবি দেখছে, কী আশ্চর্য! মুখোমুখি দুই সুষমা পরস্পরকে গাঢ় আলিঙ্গনে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে। এসেছ,তুমি এসেছ!” ফিসফিস করে বলে সুষমা। আহ! কী গভীর প্রশান্তি নেমে আসছে সমস্ত শরীর-মন ছেয়ে! এবার সুষমার ঘুম পায়। সে কালো চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।






মোহাম্মদ জসিম

প্রতিবিম্ব

১.

'দিন থেকে শেষরাত অব্দি ঘুম হয় না-ভোররাতের দিকে একটু ঝিমুনিমতোন আসে, তারপর বেমালুম ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সেই আটটা ন'টা। অফিসে দেরি হবার ভয়ে প্রতিদিন অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে হচ্ছে ঘড়িতে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আটটায় অ্যালার্ম বাজলো-পড়িমড়ি করে উঠেই বাথরুমে দৌড়। অফিসে মাসিক মিটিং আছে আজ। কোনমতেই দেরি করা যাবে না। গোসলের আগে বেসিনের সামনে দাঁড়ালো তমাল-শেভ করবে। দেয়ালে লাগানো আয়নায় তাকালো-তাকিয়েই হতবাক! আয়নার ভেতরে তার এতদিনের পরিচিত প্রবিবিম্বটি হাসছে। মুখ গোমড়া করলো তমাল। যদিও সে নিশ্চিত-তার মুখে কোন হাসি ছিলো না। কিন্তু তাজ্জব হয়ে তমাল দেখলো তার প্রতিচ্ছায়াটি এখনো হাসছে।
ঘুমটুম ভাল না হলে মাথায় প্যাচ লেগে যায়,ইলিক বিলিক স্বপ্ন দ্যাখে চোখ- বাস্তবও স্বপ্নের মতো লাগে। ভাবলো তমাল। মুখের ভঙ্গি পাল্টালো,মাথা কাত করলো-চোখ কচলে আবার তাকালো। সেই একই দৃশ্য-না কোন হেরফের নেই। তার অঙ্গভঙ্গি নকল করছে ঠিকই হারামজাদাটা কিন্তু তার ঠোঁটের রহস্যময় হাসিটা মুছে যাচ্ছে না।
আপাদমস্তক বিবস বৃক্ষের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো সে-আয়নার সামনে, নিজেরই প্রতিবিম্বের মুখোমুখি। তারপর নিঃশব্দে শেভ করার সরঞ্জামাদি বেসিনের ওপর এলোমেলো ফেলে রেখেই বেরিয়ে এলো-শেভ করলো না,গোসলটাও করা হলো না আর।
ভয় পেয়েছে সে।
তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো তমালবাবু। মনের মধ্যে কেমন এক খচখচানি। অস্বস্থি তাড়ানোর সব চেষ্টাই ব্যর্থ-কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারলো না নিজের হাসিমুখ ছবিটিকে। অদৃশ্য ইঁদুরের মতো কে যেন কেটেকুটে সাবাড় করছে ভেতরটা তার। তমাল অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলো। গলির মুখে বিপ্লবের সেলুন। সেলুনের সামনে থেকেই রিক্সা ধরতে হয়। সেলুনের দিকে চোখ পড়তেই তমাল দ্রুতপায়ে ভিতরে ঢুকে যায়-দেয়ালজোড়া বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়ায়। না কোন পরিবর্তন নেই। আয়নার ভেতরের আমিটি হুবহু নকল করছে তাকে। সেই একই চোখ নাক চুল, সবই ঠিক আছে শুধু মুখভঙ্গিটি আলাদা। আয়নার তমালবাবু মিটিমিটি হাসছে, গা জ্বালা ধরা হাসি। সে হাসিটি অন্য
রকম, খুনিদের মতো, শিকারীর কাছ থেকে উপহার পাওয়া।
আজ নাস্তা করা হয়নি, কাজেও মন নেই একদম। তমালের মাথায় ভেতরে গেঁথে আছে আশ্চর্য এক হাসির নমুনা। নিঃসঙ্গ মোমের মতো, নিষ্পলক। জ্বলছে তো জ্বলছেই। সকাল থেকে বহুবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে তমাল। মোবাইল স্ক্রিনে বারবার নিজের চেহারা দেখেছে, বাথরুমে, বাসের জানালায় -জানালার কাঁচে। সব জায়গায়ই তার প্রতিবিম্বটি তার সাথে বিট্রে করছে।
মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার! ডিপ্রেশনে ভুগছে! নাকি হ্যালুসিনেশন? তমাল ভাবতে ভাবতে মাথার চুল টেনে ছেঁড়ে-অনবধানে। যে করেই হোক এই অস্বস্তিকর খুনে হাসিটির কবল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

২.

-তুবার সাথে ঝগড়া হয়েছে,জানিস?
-জানি।
-অনেক টাকা ঋন আছি...
-জানি।
-বাবা অসুস্থ।
-জানি।
-প্রমোশনের জন্য দেড়লাখ টাকা ঘুষ চাচ্ছে।
-জানি।
-ঘুম হচ্ছে না ইদানিং, শরীরটা ভেঙে পড়ছে দিনে দিনে...
-সবই জানি।
-সবই জানিস তাহলে তোর মুখে হাসি কি করে বেরোয় শুয়োরের বাচ্চা!
-হাহাহা।
আয়নাটা ঝমঝমিয়ে ওঠে, আয়নার শরীর জুড়ে তমালের ছবিটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
-তমালবাবু তমালবাবু! আপনাকে দেখে কেউ কোনদিনই বলবে না আপনি কষ্টে আছেন টেনশনে আছেন ডিপ্রশনে ভুগছেন। প্রতিদিনই তো দেখি, যার সাথেই দেখা হয় কথা হয় বেশ হাসিমুখে করমর্দন করেন কথা বলেন আন্তরিকতা নিয়ে। আমি শুধু আপনাকে নকল করে যাচ্ছি মাত্র।
তমাল অধৈর্য হয় আরো। রেগে যায়।
তমাল ঘরে ফিরেছিলো রাত করে। অফিস থেকে দুপুরের পরপরই বেরিয়ে পড়েছিল। তার পর থেকে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছে-পারতপক্ষে কোন আয়নার সামনে দাঁড়ায়নি। সারাটা দিন একরকম না খাওয়াই বলা যায়। খাওয়ার মধ্যে কাপের পর কাপ চা আর সিগারেট। এই মূহুর্তেও আঙুলের চিপায় ধরানো সিগ্রেটে টান দিতে দিতে আয়নার সামনে বসে আছে। এই খুনে হাসির অত্যাচার সইতে পারছে না আর। একটা এসপার ওসপার করেই ছাড়বে এরকম ভাব নিয়ে প্রতিবিম্বের সাথে সংলাপে বসেছে।
-হাসিমুখে কথা বলি এতে দোষের কি আছে। এটাই নিয়ম। সৌজন্যবোধ না থাকলে সভ্য সমাজে মিশবো কি করে।
-না দোষের কিছু আছে বলিনি তো তমালবাবু। আমি তো আপনারই প্রতিচ্ছায়া,তাই নই কি! তাহলে? আপনাকে নকল করে যাচ্ছি মাত্র।
-বালের নকল করছো আমাকে! কই আমি তো হাসছি না এখন। হাসছি? তাহলে তুই হাসছিস কেনো? কেন?
চিৎকার করতে থাকে তমাল। সে চিৎকারে উপচে পড়া রাগ ক্ষোভ বিদ্রোহ...
-আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন তমালবাবু! ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। আপনার হাজার কষ্টের মাঝেও আপনি হাসেন। এটাই আপনার পার্সোনালিটি। আপনার ভেতরে একধরনের ক্ষোভ আছে আমি জানি,আপনার কাছসম্পর্কের মানুষগুলো আপনাকে বোঝে না, বুঝতে চেষ্টাও করে না। তবু আপনি কাউকে কষ্ট দেন না বরং হাসিমুখে সবার সাথে মেশেন।
তমালেল প্রতিবিম্বটি বিরতি নেয় একটু। এখন মধ্যরাত। নৈঃশব্দ। তমালের আগুলের ফাঁকে সিগ্রেট পোড়ো। ঠিক একই ভঙ্গিমায় আয়নার ভিতরে বসা তমালের হাতেও একই ব্রান্ডের সিগারেট পুড়ছে।
-আপনার কষ্টগুলো আমারও তমালবাবু। আপনার অভ্যাসও আমি পাই টু পাই নকল করে যাচ্ছি।
-তাই বলে কুত্তার বাচ্চা আমার সাথেও নকল হাসি নিয়ে মিশবি তুই!
-আপনার সারাদিনের নকল হাসির অভিনয়টি আমি নকল করে যাচ্ছি আর কিছু না।
-তাই বলে আমি কি নিজের সাথেও কৃত্রিম হাসি নিয়ে মিশবো। একা হয়ে গেলে নিজের সাথেও কি প্রতারনা করে মানুষ? কৃত্রিম হাসি নিয়ে ভাল থাকার অভিনয় করে যায়!
-আপনি কদিন থেকে তাই করে যাচ্ছেন তমালবাবু। শুধু এটা বোঝানোর জন্যই আমার মুখে চিরস্থায়ী হাসি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম।
এসব কথা তমালের বিশ্বাস হয় না। রাগ হয় বরং। আমি কি সত্যিই নিজের সাথে অভিনয় করে যাচ্ছি? ভাল থাকার অভিনয়?
নাকি বিভ্রান্ত হচ্ছি আয়নার জগতে লুকিয়ে থাকা খুনে হাসির চতুর ষড়যন্ত্রের কাছে। তমাল হার মানতে চায় না, কোনদিনই হারতে চায়নি সে...
টেবিলের কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ফুলদানিটি অকস্মাৎ ছুড়ে দিলো সে,ঠিক আয়নার বুক বরাবর। ভেঙে পড়া আয়নার ঝনঝনানি তার কাছে অট্টহাসির মতো লাগলো। দিগন্তজোড়া অট্টহাসি মুখে নিয়েই মরে গেল তমালের প্রতিবিম্বটি।
সে রাতে খুব ভাল ঘুম হলো তার।


মনোজিৎকুমার দাস

লজ্জা                                                                                  

ব্রিটিশ আমল। গ্রামগঞ্জে থিয়েটারের হতো সেকালে।কলকাতা থেকে বাবুরা পুজোর সময় বাড়ি এসে থিয়েটার করতো গ্রামের ছেলেদের নিয়ে।মেয়েরা তখন এদিক মারাতো না।তাই ছেলেদেরকে সখি নায়িকা সাজতে হতো।দাঁড়ি গোঁফ না গজানা ফুটফুটে চেহারার ছেলেদের কদর ছিল মেয়ে সেজে সখি কিংবা নায়িকা হবার জন্যে।

পাশাপাশি দুটো গ্রাম ফুলঝুরি, আর মৌকুড়ি।গ্রাম দুটোর মধ্যে মিলমহব্বত থাকলেও গান বাজনা নিয়ে তাদের প্রতিযোগিতা ছিল বেজায় রকমের। ফুলঝুরির সেন জমিদার মৌকুড়ির মজুমদার জমিদারকে টেক্কা দেবার জন্য সেবার পুজোয় যাত্রাগানের বদলে থিয়েটার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সনাতন মল্লিকের ছেলে মুকুল এর নাচের তালে তালে সিন উঠবে। মুকুলকে মেয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে দেবার পর কে বলবে সে সনাতনের ছেলে মুকুল, ও যেন সনাতনের মেয়ে মুকুলিকা।                                                            সীতা সাজলো বনমালির মেজো ছেলে শোভন, সাজঘরে উঁকি দিয়ে পাড়ার অনেকেই বলাবলি করলো,বনমালির ভীমরতি ধরেছে। যৌবন উছলে পড়া মেয়ে শোভনাকে শেষ পর্যন্ত থিয়েটারে নামালো। ঘোর কলিকাল আর কারে কয়! আসলে শোভনা শোভনের যমজ বোন।

মজুমদার জমিদারের বাড়িতে যাত্রা দেখতে তেমন লোক  গেল না। সেন জমিদার বাড়িতে থিয়েটার দেখতে সন্ধ্যা হতে না হতেই পটল ভেঙলো লোকজন। দর্শকদের প্রথম সারিতে বসেছেন গ্রামের মাইনর স্কুলের হেড পন্ডিত গজেনবাবু,ডাক্তার ডমুরু প্রামানিক, পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্ট বঙ্কুবাবু ও আরো অনেকে। গ্রীনরুমে সাজগোজ কমপ্লিট। অকৃতদার কেশব খুড়ো সেজেছে মন্দাদরী। করো বলার সাধ্য নেই তাকে দেখে, তিনি আমাদের কেশব খুড়ো। নাটক শুরুর প্রস্তুতি প্রায় শেষ। স্টেজে একটা চৌকি পাতা হলো।মুকুল সুন্দরী বালিকা সেজে চৌকিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো নৃত্য পরিচালক ধীমানঋদ্ধ বটবেলের কথা মতো।তিনি ওকে দেখে পান চিবোতে চিবোতে মুচকি হেসে নিজে নিজে বললেন কে বলবে এ আমাদের বনমালি ছেলে মুকুল, এ যেন ওর যমজ মেয়ে মুকুলিকা। বটবেলবাবু মুকুলকে সব বুঝিয়ে সুজিয়ে দিলেন,সিন ওঠা মাত্র মুকুল সামনের দিকে মাথা উচিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক পাক ঘুরে নাচ শুরু করবে। সিন তোলার দায়িত্বে আছে গোপাল ঢালী, আর আলোক সঞ্চালনে অলোক বাকচী। সিন ওঠানোর জন্য পরিচালক সিগনাল দিতেই গোপাল ঢালী সিনের দঁড়িতে টান দিলো, মুকুল  একবার মাথা তুলেই আবার চৌকিতে মাথা রাখলে পরিচালক গলা নামিয়ে বার বার বললেন,'বিগিন বিগিন মু-----' কিন্তু মুকুলের নড়ন চড়ন নেই। এদিকে দর্শকদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো। পরিচালক ভাবলেন,সবতো মাঠে মারা গেলো। তিনি গোপাল ঢালীকে সিন ফেলে দিতে বললেন। ড্রপ সিন ফেলা মাত্র দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে হৈ হৈ করে উঠলো। তারপর পরিচালক সব কিছু ম্যানেজ করে শেষমেষে নাটক মোটামুটি সুন্দর ভাবেই শেষ করলেন।
মুকুল তখনো মেয়ে সেজে গ্রীনরুমে বসে আছে। নৃত্য পরিচালক বটবেল বাবু তাকে দেখে রেগে আগুন। ' তুই এখনো এখান বসে আছিস্ কোন লজ্জায়!' বটবেল বাবু'র রাগ দেখে মুকুল লজ্জিত মুখে মিনমিন করে কী যেন বলতে গেলে বটবেল বাবু বললেন,' তুই আমাকে এমন ভাবে লজ্জায় ফেলবি তা জানলে তোকে বালিকা সাজাতাম না। আর তুই যদি আমার নাতি না হতি তোকে আমি আড়ঙ ধোলাই দিতাম এতক্ষণে। আমি এখনো লজ্জায় মরে যাচ্ছি।'
 'বটবেল দাদু, লজ্জাই তো আমার কাল হয়েছে। মাথা উঁচু করে সামনে তাকাতেই দেখি- বড় তাওইমশায় মাথায় পাগড়ি বেঁধে সামনের সিটে বসে আছেন। তাই না দেখে আমার পা কাঁপতে শুরু করলো। তাকে দেখে লজ্জায় আমি উঠে দাঁড়াতে পাড়লাম না। লজ্জায়ই আমার কাল হলো!'                               
নিজের গিন্নিকে গ্রীনরুমে আসতে দেখে অপূর্ব সুন্দরী বেশে  মুকুলের বালিকা রূপটি দেখে বটবেল মনে দুষ্ট বুদ্ধ খেলে গেল । গিন্নি তাদের কাছে পৌছালে বটবেলবাবু তার সামনে দাঁড়ানো ষোড়শী বেশী মুকুলকে জাপটে ধরে তার গালে একটা চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। এ দৃশ্য দেখে তার গিন্নি বলে উঠলেন, এ কী লজ্জা! ঘরে আমার মতো সুন্দরী বউ থাকতে এ কী কান্ড মিনসের!ছি,ছি;এ কী  লজ্জা!