গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

ক্ষমা রায়

নাতির কীর্তি

এখন তাতাইয়ের স্কুলের উইন্টার ভেকেশন চলছে । রোজ রাত্রে ঘুমোবার আগে দাদানকে বলে রাখে তাতাই ,যেন পরদিন ওকে সঙ্গে নিয়েই মর্নিং ওয়াকে যান । কিন্তু এই শীতের ভোরে আর ঘুমন্ত তাতাইকে ডেকে তুলতে ইচ্ছে করে না শঙ্কর বাবুর । প্রতিদিন ভোর সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন তিনি । তারপর প্রাতঃকৃত‍্য সেরে সোয়েটার , মাঙ্কি ক‍্যাপ পরেও একটা জলন্ধরী আলোয়ান ভালো করে গায়ে জড়িয়ে হাঁটু পর্যন্ত মোজা জুতো পরে যখন বেরোন তখন বৌমাও ঘুম থেকে উঠে পড়ে । তাতাই ঘুম থেকে উঠেই দাদানকে ঘরে দেখতে না পেয়ে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে ৷ তারপর শঙ্করবাবু মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরলে ব্যাস .... তখন দাদানের ওপর চলে যত অনুযোগ ,অভিযোগ,মান অভিমানের পালা ৷ পরদিন ঠিক নিয়ে যাবেই করার করে , চকলেট দিয়ে , তাতাই এর সাথে খানিক খেলে তবে শঙ্করবাবু রেহাই পান ৷ আজ কিন্তু শঙ্করবাবু বাথরুম থেকে ঘরে পা দিয়েই শুনতে পান তাতাইএর ঘুমজড়ানো গলা ৷ "দাদান আমিও যাবো ৷ " শঙ্করবাবু মনে মনে হেসে ওঠেন ৷ আজ আর ছাড়া নেই ৷ কিন্তু মুখে বলেন ---- " আজ যে ভীষণ ঠাণ্ডা দাদাভাই ,ছোট ছেলেরা এই ঠাণ্ডায় বেরোয় না ৷ ঠাণ্ডা লেগে যাবে ৷ কদিন যাক ,ঠান্ডাটা একটু কমুক,তখন ঠিক নিয়ে যাবো তোমায় ।" প্রবলবেগে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যেতে যেতে তাতাই বলে যায় সোয়েটার, জ‍্যাকেট মাফলার টুপি সব পরে বেরোলে ঠাণ্ডা মোটেই লাগবে না । মহা ভাবনায় পড়েন শঙ্কর বাবু । এই ঠাণ্ডার মধ‍্যে বেড়িয়ে যদি জ্বরজারি কিছু হয় .... ! স্বল্প অথচ স্পষ্টভাষী বৌমাটিকে তিনি একটু সমীহ করেই চলেন । ঠাণ্ডায় বেড়িয়ে নাতির শরীর খারাপ হলে যদি কিছু মনে করেন ! যদি দোষারোপ করেন !! শঙ্করবাবু এসব ভাবছেন আর জামাকাপড় পড়ছেন । এর মধ্যে তাতাইও বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ওদের ঘরে গিয়ে সোয়েটার,জ‍্যাকেট ,টুপি ,মোজা সব দাদানের ঘরে নিয়ে এসে হাজির করেছে । ইতিমধ্যে রুবীও উঠে পড়েছেন । রুবীকে দেখেই শঙ্করবাবু অপরাধীর মতো কাচুমাচু মুখে বলেন , "দেখো দেখি বৌমা ,তাতাই এর কাণ্ড দেখো ! বাথরুম থেকে ঘরে এসে দেখি বাবু জেগে বসে আছেন । এই ঠান্ডার মধ্যে ..... কী করি বলো দেখি ? " রুবী হেসে বল . "কী আর করবেন বাবা ... ধরা যখন পড়েই গেছেন , নিয়ে যান সাথে । "তারপর ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন .... " তাতাই .. দাদানের হাত ছেড়ে কোথাও ছুটে চলেএ যাবেনা ... দাদানকে জ্বালাবে না ,কথা শুনবে ,কেমন !!! " তরপর টেনে নিয়ে তাতাই কে সোয়েটারের ওপর জ‍্যাকেটটা পরিয়ে টুপি টা ভালো করে বেঁধে দিয়ে সাবধান করে দিলেন ... " একদম টুপি নামাবে না ।" প্রতিদিন মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরার পথে বুড়োর চায়ের দোকানে বসে সবাই চা খেয়ে খানিক গল্প করে যে যার বাড়ীর পথে হাঁটা লাগায় । আজ তাতাই সঙ্গে থাকায় ওকে কেন্দ্র করে যে যার নাতি নাতনীর গল্পে মেতেছে । শঙ্করবাবু তাতাইকে দুটো বেকারির বিস্কুট কিনে দিয়েছেন । ও বিস্কুট হাতে নিয়েই পায়ে পায়ে বুড়োর ছেলেটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে । বুড়োর ছেলেটা প্রায় তাতাই এরই বয়সী হবে ।কি দু এক বছরের বড় । কিন্তু মাথায় তাতাই এরই সমান । বাবাকে দোকানে সাহায্য করে এই বয়সেই । উনুনে আঁচ দেয় । বাবুদের চা বিলি করে । ফাই ফরমাস খাটে আর কি ! এই প্রচণ্ড শীতেও ওর গায়ে শুধু একটা ফুলহাতা জামা আর হাঁটু নীচ পর্যন্ত বাড়মুডা প‍্যান্ট । তাতাই খানিকক্ষণ ওর কাছে দাঁড়িয়ে বিস্কুট খেতে খেতে ওর কাজ কর্ম লক্ষ করছিল । তারপর ছুটে এসে শঙ্করবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো ,"দাদান ওর শীত করে না ?" প্রশ্ন শুনে হতভম্ব শঙ্করবাবু কিছু বলার আগেই বিশ্বনাথ বাবু বললেন , " করে তো রে ব‍্যাটা ! তোর আমার মতো ওরও শীত করে । কিন্তু ওর তো গরম জামা নেই । এই চায়ের দোকান থেকে যা টাকাপয়সা পায় ,তা দিয়ে ওদের ভাইবোন মা বাবা ভালো করে খেতে ই পায় না ,গরম জামা কিনবে কোথ্থেকে ?" এতক্ষণ অবাক হয়ে বিশ্বনাথবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনছিল তাতাই । এখন চট করে শঙ্করবাবুর দিকে ফিরে আস্তে জ‍্যাকেটের চেনটা একটু নাবিয়ে সোয়েটারটা দেখিয়ে বলল .... " দাদান , আমার দুটো , ওর একটাও নেই । একটা ওকে দিই ... ?" শঙ্করবাবু কিছু বলার আগেই জ‍্যাকেটের চেনটা টেনে খুলে বলে "ও দাদান খুলে দাও না তাড়াতাড়ি" ... "আ রে না না ঠান্ডা লেগে যাবে ... আজ নয় , কাল আমি ওর জন্য একটা তোর পুরোনো সোয়েটার নিয়ে আসবো । এখন চল তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরি , নইলে তোর মা আবার চিন্তা করবে ।" কথাটা বলেই শঙ্করবাবু তড়িঘড়ি জ‍্যাকেটের চেনটা লাগিয়ে টেনে দিলেন । বিশ্বনাথ বাবু তাতাই এর কাছে সরে এসে আস্তে আস্তে বললেন , " তাতাইবাবু তোমার যখন মন হয়েছে তখন দিয়েই দাও । কালকের জন‍্য কোনো কাজ ফেলে রাখতে নেই ।" বলে আগেই ওর টুপির বাঁধনটা খুলে দিলেন । শঙ্করবাবু বাধা দেওয়ার সময়টুকুও পেলেন না । তাতাই জ‍্যাকেট খুলে ছুটে গিয়ে বুড়োর ছেলের পিছনদিক দিয়ে গিয়ে ওর গায়ে জ‍্যাকেটটা জড়িয়ে দিল । ওরা বাপ-ব‍্যাটা উনুনের ধারে বসে হাত সেঁকছিল । অতদুর থেকে ওদের কথা এদের কানে হয়তো পৌঁছায়নি । আচমকা এই ঘটনায় দুজনেই অবাক হয়ে গেল । বিশ্বনাথ বাবুও তাতাই এর সাথে এগিয়ে এসেছিলেন । উনি ওদের আশ্বস্ত করে বললেন , " নাও , নাও .., ছোট ছেলে দিচ্ছে যখন , ওকে বাধা দিও না । কষ্ট পাবে ।" তারপর তো খুব ভয়ে ভয়েই শঙ্কর বাবু বাড়ি ফিরে রুবীকে সব কথা খুলে বললেন । বারবার জানালেন যে তিনি মানা করেছিলেন কিন্ত্ত ঐ আহাম্মক বিশ্বনাথবাবুই যত নষ্টের গোড়া । ওঁরই প্ররোচনায় তাতাই এই কাজ করেছে । ও ছেলেমানুষ , ওর কি দোষ ? ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি ....... রুবী সব শুনে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঘরের কাজ সারতে লাগলো । শঙ্করবাবুর খুবই অস্বস্তি হতে লাগলো । বৌমা খুশি না অখুশি কিছুই বুঝতে পারছেন না । রাগটা কার ওপর ... নিজের সন্তানের ওপর নাকি শ্বশুরের ওপর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না । বাবু শুনে বললো , "জ‍্যাকেটটা তো আরোও কিছুদিন পরা যেত । দেখতে ভালো ছিল । কেন দাদানের কথা শুনতে পারলি না ? কাল না হয় তোর পুরোনো একটা সোয়েটার দিয়ে আসতো বাবা । " যথা সময়ে ছেলে অফিসে বেড়িয়ে যাবার পর ছেলে ও শ্বশুরের লাঞ্চ ডাইনিং টেবিলে ছোট বড় চারটে ক‍্যাসারোলে রেখে রুবীও স্কুলে বেড়িয়ে গেল । ঘটনাটা ঘটলো পরদিন ভোরে । বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ঘরে ঢুকেই দেখলো বৌমা তাতাইকে ঘুম থেকে টেনে তুলছে । " শিগগির ওঠ তাতাই . ... দাদান কিন্তু রেডি হচ্ছেন । তোকে না নিয়েই মর্নিং ওয়াকে বেড়িয়ে যাবেন । ওঠ . ... শিগগির উঠে পর .." তাতাইও মায়ের ডাকে বাধ‍্য ছেলের মতো উঠে বাথরুমে চলে গেল । হতবুদ্ধি শঙ্করবাবু শুধু বললেন , .. "বৌমা ..." রুবী তাড়াতাড়ি বললো , "বাবা চলুন আমি ও আজ আপনার সাথে হাঁটতে যাবো ।" শঙ্করবাবু সোয়েটার পড়তে পড়তেই ধপ করে বিছানায় বসে পরে ম্লান মুখে আস্ত আস্ত বললেন , "বৌমা ,না হয় আর একটা জ‍্যাকেট কিনে দেওয়া যাবে .. কিন্তু একবার দিয়ে কি .... ফিরিয়ে নেওয়াটা ..... ঠিক হবে ... ? " অস্ফুটে একটা আর্তনাদ শোনা গেল । " বাবা .... একি বলছেন ? আআমি ... আমি কি তাতাই এর জ‍্যাকেট ফেরত আনতে আপনার সাথে যেতে চাইছি ?" বলেই রুবী দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল । মিনিট দুই যেতে না যেতেই দুটো বড় বড় ব‍্যাগ হাতে এঘরে ঢুকে বলল , " বাবা দেখুন । ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দেবো । তাই আপনার ছেলেকে ছাড়া আপনাকে আর বলিনি । কাল যখন আপনি বাড়িতে এসে ওভাবে বলছিলেন তখনই বুঝতে পেরেছিলাম নাতির কীর্তিতে মনে মনে খুশি হলেও আমাদের কাছে প্রকাশ করতে পারছেন না । ভাবছেন বুঝি আমরা রেগে যাবো । না বাবা .. বিশ্বাস করুন কী যে খুশি হয়েছি আমি ,আমরা ... !! কাল সকালেই আপনার ছেলে অফিস যাওয়ার আগেই দুজনে ঠিক করে ফেলি কিছু ছোটবড় সোয়েটার কিনে আজ আপনার সাথে বেড়িয়ে তাতাই আর আপনার হাত দিয়েই পথশিশুদের বিলি করবো ।" বলেই তাতাইকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেলল । শঙ্করবাবু ছলছল চোখে রুবীর মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলল , "বৌমা আমাদের কিন্তু দেরী হয়ে যাচ্ছে ।"