গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

সুবীর কুমার রায়

নিদ্রা ভঙ্গ

অনেক চেষ্টা করেও বিপাশা দেবী লেখাটায় মন দিতে পারলেন না। স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর প্রায় একমাস পর আজ তিনি আবার কাগজ কলম নিয়ে বসেছেন। স্থানীয় মহিলা উন্নয়ন সমিতির তিনি একজন অপরিহার্য সদস্যা। পুরুষ শাসিত সমাজে মহিলাদের প্রতি অবহেলা, বঞ্চনা, অন্যায় শোষণ, শুধুমাত্র ভবিষ্যৎ বংশ রক্ষার যন্ত্র বা বাড়ির কাজের লোক ভাবা, ইত্যাদি নিয়ে তাঁর কত লেখা যে আলোরণ তুলেছে তার ইয়ত্তা নেই। মহিলারা ছাড়া পুরুষের জীবন যে অচল, মহিলারা যে শুধু কন্যা, স্ত্রী বা মা হওয়ার জন্যই জন্মান নি, এর বাইরেও তাঁদেরও যে নারী হিসাবে একটা স্বাধীন সত্ত্বা আছে, এ সম্বন্ধে তাঁর বলিষ্ঠ মতবাদ সমিতির আর সব মহিলাদের সমৃদ্ধ করেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে, স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছে। তবে আজ কেন তিনি আগের মতো তাঁর মনের কথা আর অবলীলাক্রমে লিখতে পারছেন না, আজ কেন বারবার তাঁকে লেখা শুরু করেও কাগজগুলো ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে পাশে ফেলে দিতে হচ্ছে?
আজ এই একমাসেই তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন মহিলারা যেমন সন্তান পালন, ঘর সংসার আগলে রাখা, বাড়ির প্রায় সমস্ত কাজ সামলানো, স্বামী সেবা………..
না, এবার তাঁর চিন্তায় ছেদ পড়লো। স্বামী সেবা বোধহয় তিনি কখনও করেন নি, কেউ করে না। তিনি যেটা এত বছর ধরে করে এসেছেন, সেটা তো সংসারের স্বার্থে, সারাদিন বাড়িতে উপস্থিত থাকতেন বলেই। ওই মানুষটাও কিন্তু রোদ বৃষ্টিতে বাড়ির বাইরে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধুমাত্র টাকা রোজগার করতেই যান নি। অফিসের কাজের বাইরেও অনেক, নেক কাজ আছে, যেটা তাঁর নিজের স্বার্থে নয়, সংসারের স্বার্থেই তাঁকে করতে হতো। তাছাড়া অর্থই তো সংসারের ভিত, যার ওপর সংসারটা সব ঝড়ঝাপটা সামলে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে থাকে। মহিলা সমিতির সাথে যুক্ত হওয়ার পর সময় পান না বলে, তাঁকে রান্না ও সবসময়ের কাজের জন্য দুদুটো মহিলাকে রাখতে হয়েছিল। আচ্ছা ওই দুই মহিলাকেও তো তিনি স্বাধীন ভাবে থাকবার সুযোগ না দিয়ে তাঁর বাড়ির কাজের লোক হিসাবে রেখে, ঘরে তাদের শিশু সন্তানকে ফেলে তাঁর সেবায় নিয়োজিত করেছেন। তাহলে তাদের বাড়ির দোকান, বাজার, রেশন তোলা, ব্যাঙ্কের কে.ওয়াই.সি. ফর্ম জমা দেওয়া......
তার মনে পড়লো তার পেনশনের জন্য নতুন করে ফর্ম ভরে সমস্ত জেরক্স দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলার কথা ব্যাঙ্ক থেকে জানিয়েছিল। দুদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ফিরে এসেছেন।  কর্পোরেশনের ট্যাক্সের ডিমান্ড নোটিশটাও তো দিন পনেরো হলো পড়ে আছে। না, আজ আর তার কাগজ কলম নিয়ে বসতে ইচ্ছা করছে না।
তৈরি হয়ে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে তিনি ব্যাঙ্কে গিয়ে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্ম নিয়ে, দীর্ঘক্ষণ লাইন দিয়ে টাকা তুলে, বাজার করে ফিরে এলেন। এক কাপ চা খেতে ভীষণ ইচ্ছা করলেও তাঁর আর গ্যাস জ্বালতে ইচ্ছা করলো না।
ইজি চেয়ারটায় শরীর এলিয়ে দিয়ে কবজি ঘুরিয়ে হাতঘড়িটা দেখলেন, আড়াই ঘন্টা বাড়ির বাইরে কেটে গেল। ভীষণ ক্লান্তি লাগায় বিপাশা দেবী চোখ বুজে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে নিতে ভাবলেন, লেখাটা তৈরি করতে হবে, তবে পুরুষশাসিত সমাজ, মহিলা উন্নয়ন, সমাজ সেবা, ইত্যাদি নিয়ে আর নয়, তিনি বোধহয় নিজের পরিবারের উন্নয়নের কথাই এতদিন ঠিক ভাবে চিন্তা করেন নি। আজ তিনি বড় একা, বড় অসহায়। হাতে অনেক কাজ, মহিলা সমিতি ছেড়ে দেওয়ার চিঠিটা গুছিয়ে লিখতে হবে।