গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

আফরোজা অদিতি

নিছক প্রেমের গল্প

          চিঠিটা হাতে নিয়ে অনুপম অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে বেখেয়ালে। মনের ভেতর অজস্র চিন্তা ভীড় করছে। প্রায় দুই বছর পর এই চিঠি। এতোদিন পর চিঠি! চিঠিটি না খুলেই অনুপম বুঝতে পারে কার চিঠি। এই লেখা কি কখনো ভোলার? যে লেখার জন্য দুইটি বছর উৎকণ্ঠা আর প্রতীক্ষায় দিন গুনছে ; সেই চিঠি এলো কিনা দুই বছর পর তাও আবার অফিসের ঠিকানায়। ওদের তো কথা ছিল প্রতিদিন একটা করে চিঠি দেওয়ার এবং পাওয়ার। ওর চিঠির আসার কথা বাড়ির ঠিকানায় এবং চিঠি দেয়ার কথাও বাড়ির ঠিকানায়।

অনুপম মনে মনে হিসাব করে এই দুই বছরে মোট ৭৩০টি চিঠি পাওয়ার কথা কিন' ৭৩০-এর বদলে ৭টি চিঠিও পায়নি, আসেনি চিঠি। যদি পেতো অনুপমের জীবনটা অন্যরকম হতো। ওর জীবনটা এমনভাবে একটা জায়গায় থমকে থাকতো না। জীবনের সমস্ত আকাঙক্ষা আগ্রহ নষ্ট হয়ে যেতো না। তিল তিল করে ওর জীবনীশক্তি ক্ষয়ে যেতো না ওর!

অনুপম নিজে কি এখন মানুষ আছে; নেই। মানুষ নামে একটা যন্ত্র মাত্র। ওর ভালোবাসা, যাকে সে বুকের ভেতর সযত্নে লালন করছে, আজও করে। যার হাসিতে বিশ্ব ভুলতে পারতো; যার কথাতে কখনই কোন বিরক্তি আসেনি; যার স্পর্শের জন্য প্রতিটি সময় প্রতীক্ষায় থেকেছে সেই মানসপ্রতিমা তার কথা রাখেনি। অথচ অনুপম নিজে এই দীর্ঘ দুই বছর চিঠি লিখেছে, চিঠির উত্তর না পাওয়া সত্ত্বেও। আজও একটা চিঠি লিখেছে মনের আবেগ মিশিয়ে ভালোবাসার ফুল-চন্দনে আরতি করে।

 চিঠির উত্তর না পেয়ে মাঝে মাঝে অনুপমের মনে হয়েছে ওরা বাসা বদল করেছে কিংবা খুব সহজ ভাবে  মধুলেখা তার মৌখিক বাক্যকে ভুলে গেছে। ভুলে গেছে তার অনুকে। অনুপম বহুরাত জেগে চিঠি না পাওয়ার যে কারণ খুঁজেও পায়নি তা আজ চিঠি হাতে পেয়ে খুঁজে পায়। মধুলেখা আজও তাকে মনে রেখেছে ভোলেনি। ভোলেনি কিন' চিঠি দেয় নি কেন? অভিমান করে দেয়নি! কিন' কে? যায়নি বলে। যাওয়ার কথা তো ছিল না ওর।

অনুপম আর মধুলেখা।
দুজনের মন এক প্রাণ এক হলেও একে অপরকে ছেড়ে থাকতে না পারলেও সমাজ সংস্কার ওদের মিলন ঘটতে দেয়নি। ভারতির সঙ্গে বাগদান হয়েছিল বলেই মধুলেখাকে বিয়ে করতে পারেনি। বিয়ে করতে না পারলেও ভুলতে পারেনি ওকে! শত চেষ্টা সত্ত্বেও পারেনি।

অনুপম হাতের চিঠিটির দিকে তাকায়। এই চিঠি পাওয়া মাত্র ওর হার্টবিট ক্ষণিকের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চিঠিটি খোলা হয়নি এখনও। সেই চারটার সময় দিয়ে গেছে পিয়ন। এখন -৩০টা। এই আধঘণ্টা চিঠি হাতে নিয়ে বসে আছে। সকলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত; ফাইলপত্র গোছগাছ করছে। পাশের টেবিলের সহকর্মী অনুপমকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, ‘কি দাদা, কখন থেকে দেখছি চিঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। কোন ভাবের সমুদ্রে ভাই পাড়ি দিচ্ছেন ভাই?’
সহকর্মীর কথায় একটু হাসে। কোনো জবাব দেয় না। সহকর্মীটি আবার বলে, ‘সবাই তো চলে যাচ্ছে আপনি যাবেন না?’
আপনি যান। আমি একটু পরে যাবো। অনুপম বলে। অফিসে কেউ নেই। অনুপমের একটু নিরিবিলিই প্রয়োজন। নির্জনে একাকি চিঠিটা খোলে। খোলার আগে খামের উপরের লেখায় হাত বুলিয়ে অনুভব কওে মধুলেখাকে।মধুলেখা তুমি!-তুমি, তোমার এতোদিনে সময় হলো? আমাকে এতোদিনে মনে পড়লো। আমি কি এতোই অপাঙ্তেয়! অথচ এমন একটা দিন ছিল না যেদিন আমাকে না দেখলে তোমার চোখ ভরে থাকতো না জলে।অতীত কখনও সম্পূর্ণভাবে মুছে যায় না, বর্তমানের জাগতিক কর্মের আস্তরণে ঢেকে থাকে। যে কোন কর্মের অছিলায় আবার জেগে ওঠে। অনুপমেরও তাই হলো। অথীত ভাবতে ভাবতে চোখ জলে ভরে যায় অনুপমের। দুফোঁটা জল চিঠির ওপর পড়ে। সযত্নে সেটুকু মুছে সময় নিয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করে।

 অনুপম, হৃদয়ের বাঁশী, ভুলেছো কি ভোলোনি জানি না। ভালোবাসা জানালাম না তাই। যদিও মন বলে তুমি আজও মনের ভেতর রেখেছো আমাকে। তবুু বাস্তবে তার ঠিকানা মেলেনি, বাস্তব বড়ো কঠিন অনু। যাকগে, প্রতিদিন আমাদের একটা করে চিঠি লেখার কথা ছিল। কিন' কই একটা চিঠিও তো পেলাম না! জানি না কি করে তোমার মধুলেখাকে চিঠি না লিখে আছ। ভুলে আছ তোমার সুখের আকাশকে। হয়তো তুমি ভুলেছো আমাকে। ভুলেছো তোমার সুখের মধুলেখাকে। অথচ অতীতে পথ চাওয়া স্মৃতিকে নিয়ে আজও বেঁচে আছি, বেঁচে আছি শুধু তোমাকে একটিবার দেখার আশায়। আমি কেন যে তোমাকে ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না অনুকে, আমার সুরের বাঁশীকে! যেন সেই কবিতা-‘যতই ভুলিবার চাই, ততই মনে নেয়গো ঠাঁই

যাকগে, ওসব কথা। তুমি ভালো আছ তো। আমি কখনই তোমাকে অসুখি দেখতে চাইনি। সব সময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি তুমি ভালো থাকো সুখে থাকো তোমার কর্মে, তোমার সংসারে। গত দুই বছর, সেই যে  তুমি সিলেট চলে গেলে তারপর থেকে প্রতিদিন প্রতীক্ষায় থেকেছি তোমার চিঠির। কিন' চিঠি না পেয়ে ভেবেছি আর কখনো লিখবো না তোমাকে। কিন' পরক্ষণেই আবার চিঠি লিখেছি, লিখেছি কথার খেলাপ করতে চাইনি বলে।

থাকগে এসব প্যাঁচাল। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি অসুস' অল্প অল্প জ্বর। ডাক্তার বলেছে ক্যানসার। বাড়ি-হাসপাতাল, হাসপাতাল-বাড়ি করতে আর ভালো লাগে না। জানি আমার সময় শেষ। এখন শুধু চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকি। তোমার লাগানো কামিনীগাছে এই বর্ষায় অজস্র ফুল ফুটেছে। রাতে সুগন্ধ আসে হাওয়ায় ভেসে, ভরিয়ে দেয় সুগন্ধে আমার ঘর-দোর। আমি ফুলের গন্ধে তোমাকে পাই; পাই বুকের কাছে, হৃদয়ের নিভৃতে। এই চিঠিটা নিয়ে তোমাকে মোট ৭৩০টি চিঠি লিখছি। আর এই বোধহয় শেষ চিঠি। তোমাকে বড্ডো দেখতে ইচ্ছা করছে। যদি এই চিঠিটা হাতে পেয়ে দেখতে ইচ্ছা করে তবে এসো। তোমাকে জোর করবো না, শুধু অনুরোধ জানাবো যদি আমার প্রতি হৃদয়ের কোন কোণে একটু ভালোবাসা ভুলেও পড়ে থাকে তবে এসো। তোমাকে দেখার সাধ পূরণ না হলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।

তোমাকে বড়ো দেখতে সাধ
দেখতে সাধ নয়নে মনে আমার নীরব অহংকারে
- তোমার মধুলেখা

পুনশ্চ এবার চিঠিটা বাড়ির ঠিকানায় না দিয়ে অফিসের ঠিকানায় দিলাম।

অনুপম আগাগোড়া চিঠিটা পড়লো। একবার, দুইবার, তিনবার। মধুলেখা ওর নামের আগে তোমার শব্দটা লিখে আবার কেটে দিয়েছে। অনুপমের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো মধুলেখা তুমি আমার আর আমিও তোমার। আমিও তোমাকে ৭৩০ টা চিঠি লিখেছি, আজ বুঝলাম চিঠি পাও নি। কিন' জানি না কেন পাও নি?
অনুপম ঘড়ি দেখলো। না এখনও হাতে ঘণ্টা দেড়েক সময় আছে। স্টেশনে গিয়ে প্রথমে টিকিট কাটলো, তারপর বাসায়। কিন' ঘরে ঢুকেই দেখে আজ সকালে যে চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলে গেছে গেছে সেই চিঠির ছেঁড়া টুকরো ছড়ানো ঘরের মেঝেতে। ওদের ডাকবাক্স থেকে পিওন চিঠি নিয়ে যায় আবার দিয়েও যায়। এতোদিন চিঠি পায়নি তার জন্য ঘুণাক্ষরেও ভারতীকে সন্দেহ করেনি। কিন' আজ বুঝতে পারছে চিঠিগুলো ছিঁড়ে ফেলা বা লুকিয়ে ফেলা হয়েছে! বিয়ের পর ভারতীকে সব কিছু খুলে বলেছে। ওদের চিঠি লেখার কথাও বাদ দেয়নি।
তুমি আমার চিঠি ছিঁড়েছো?’
হ্যাঁ, ছিঁড়েছি।
এতোদিনের সব চিঠি তুমি এভাবে ছিঁড়ে ফেলেছো?’
ফেলেছি। কি করবে তুমি আমাকে?’
অনুপম আর একটা কথাও বলে না। ব্যাগ গোছাতে থাকে।
যাচ্ছো কোথায়?’
ঢাকায়।
তুমি যেতে পারবে না।ভারতী প্রথমে রাগ, তারপর কাঁদতে থাকে। কিন' কোন কিছুই আজ অনুপমকে আটকাতে পারে না। কিছুই জানে না অনুপম, মধুলেখা বেঁচে আছে কি নেই! মধুলেখা, ওর বাঁশী। সমস্ত কিছুর বিনিময়ে আজ ওকে ঢাকা পৌঁছোতেই হবে।

ট্রেনটা ছুটে চলেছে। অনুপমের মনে হচ্ছে পারবে তো ওর মধুলেখাকে শেষ দেখা দেখতে! অনুপম চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে ওর বিশ্বাস যদি সত্যি হয় তবে মধুলেখাকে যেন শেষ দেখা দেখতে পায়। ঈশ্বর কেন এমন জীবন, এমন ভালোবাসা মানুষকে দাও? অনুপমের কথা ঈশ্বর শুনতে পায় কিনা অনুপম জানে না। শুধু ট্রেনের একটানা ঘটাং ঘটাং ঘটাং ঘটাং শব্দ বাতাস চিরে যেতে থাকে।