গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

কোয়েলী ঘোষ

অহংকার 

সুদীপ্ত অফিস থেকে ফিরে জামা খুলতে খুলতে বলল ---জানো কি হয়েছে ? এতদিন পর বন্ধুদের সাথে সব একসঙ্গে দেখা হবে ফেসবুক টুইটার থেকে সবাই নিজেদের এত বছরের পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পেয়েছে এমন কি যারা বিদেশে চলে গেছে তারাও ---
পৃথার চা তৈরি হয়ে গিয়েছিল টেবিলে নামিয়ে বলল --সত্যি ভাবা যায় না তারপর? 
আনন্দে সুদীপ্ত বলে উঠল --এবার যাব আমরা। সেই পুরনো কলেজ ! সেই বন্ধু --কতবছর পর --আবার একসঙ্গে
সুদীপ্ত পড়াশোনা করেছে দিল্লির কাছে বন্ধু মানে নানা প্রদেশের --কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী তিনদিন তারা ঘুরবে, বেড়াবে ,খাওয়াদাওয়া সব ব্যবস্থা দিল্লির এক বন্ধুই করে ফেলেছে টাকাটা সবাই মিলে ভাগ করে নেবে অতএব গোছগাছ আর যাত্রা
হাওড়া স্টেশনে দেখা হল রায় দম্পতির সাথে দুই বন্ধু গলা জড়াজড়ি হল পরিচয় হল দীপার সাথে পৃথা বলল ---যাক বাবা ! বাঁচা গেল ! দুটো বাংলা কথা বলা যাবে দীপা পৃথা বেশ বন্ধু হয়ে গেল রাজধানী ছুটল ----
বিশাল বড় রাজপ্রাসাদের মত হোটেল বন্ধুরা একে একে গাড়ি থেকে নামছে কেউ কাউকেই চিনতে পারছে না প্রায় চল্লিশ বছর পর ---অনেক পালটে গেছে সব
আরে ইয়ার ! আরে দোস্ত ! বলে বুকে জড়িয়ে জড়িয়ে সে কি পিঠ চাপড়ানো
পৃথা ভাবছে ---বাঙ্গালীর পিঠ এবার বুঝি গেল ! বন্ধু পরিচয়ের পর তাদের মিসেসদের পালা
পৃথা অবাক হয়ে দেখছে আর ভাবছে --কি রঙ ! কি সাজগোজ ! যেন কোনদিন কোন দুঃখের আঁচ এদের স্পর্শ করেনি মাখনের মত গালে লালচে আভা বিশাল বড়লোক ! দামি ড্রেস ,জুয়েলারী ! হিরে প্লাটিনাম ঝকঝক করছে
কথা ইংরাজিতে বা হিন্দিতে পৃথা দীপা দুজনেই ইংরাজি হিন্দিতে একটু আধটু কথা বলছিল
বিরাট হলঘরের চারিদিকে বন্ধুরা বসেছিল কে কোথায় চাকরি করে , কার ছেলেমেয়ে এখন কি করে ,মানে কার কি স্ট্যাটাস এক এক করে নিজের কথা বলছে সব অহঙ্কার গর্ব এবার ফুটে উঠছে চোখেমুখে সবাই বিশাল মাপের চাকরি করে ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করে তাদের শিক্ষা দীক্ষা --কে কাকে টেক্কা দেবে ! সুদীপ্তর চাকরি খারাপ নয় কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মাইনে অন্য প্রদেশের চেয়ে কম মাথায় তার অনেক চাপ বাবা মা ভাই বোন --বোনের বিয়ে। একমাত্র সেই ছেলেমেয়ে পশ্চিমবঙ্গেই পড়িয়েছে
পৃথা বলল -- একটুও নিজেকে ছোট মনে করো না আমাদের দেশেও পড়াশোনা হয় আমাদের ছেলেমেয়েও যথেষ্ট শিক্ষিত তবুও কেন যেন সুদীপ্তর হীনমন্যতা যায় না
দুটো দিন আনন্দে কেটে গেছে নানা খাবার দাবার কন্টিনেন্টাল , থাই , চাইনিশ ,দেশি ,বিদেশি শুধু বাঙালীর মাছের ঝোল ভাত বাদ দীপা বোধ হয় সেটি মিস করছে
শেষের দিনে বড় হলঘরে শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হল সামনে স্টেজ মাইক্রোফোন হেঁড়ে গলায় এবার এক ভদ্রলোক মহম্মদ রফির একটা গান গাইলেন অজস্র জায়গায় সুর নড়ে গেল রফির গান গাওয়া এত সোজা নয়। দিল্লির মিসেস কাপুর একখানা গজল গাইলেন
এবার সুদীপ্ত পৃথাকে বলল -যাও তুমি একখানা গান গাও অনেকক্ষন ধরে যে গানখানা মনের মধ্যে গুন গুন করছিল সেইটা দিয়ে শুরু করল --''পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায় ! ''
গান শেষ কিন্তু তার যে কি মানে , কেউ বোঝেনি রায়বাবু উঠলেন বুঝিয়ে দিলেন ইংরাজিতে , পৃথা তখন ভাবছে --আশ্চর্য! এরা রবীন্দ্রনাথ জানে না ? তিনি তো বিশ্বকবি
এবার কেউ একজন বলল --এক হিন্দি গানা শুনাইয়ে না ম্যাডাম ! পৃথা ভাবছে কি গাইবে ---অমনি অন্তর থেকে কেউ বলল --ভারতীয় রাগসঙ্গীত গাও ! খেয়াল , ঠুমরী , কাজরী , ভজন ! সব গানই তো হিন্দি বেজে উঠল শ্রীকৃষ্ণের বাঁশী রাধা চলেছে অভিসারে --''নিরভরন ক্যায়সে যাউ সখি অব ''---- ''চলরি হোরি খেলন সজনী '' কখন সে রাধা কখনও সে মীরা , আত্মমগ্ন দরবারী কানাড়ায় --
''
ঘর জানে দে ছোড় মেরি বৈয়া '' রাধার বিরহ মিলন অভিসার ফুটে উঠেছে সাধিকার মুখে চোখে এই পৃথিবীতে সে আর নেই
সামনে টেবিলে পড়ে আছে শ্যাম্পেনের বোতল , তুচ্ছ যত পোশাক , বিলাস , ব্যসন ,ভোগ --- মিথ্যে যত অহঙ্কার