গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

দেবাশিস কোনার

রহমতের বিয়ে

    রহমত আলির একটাই নেশা,সেটা হল ঘন ঘন চা পান করা আর চেনা বা অচেনা যেই হোক সবার সাথে সেধে আলাপ জমানো তার মা এখনও বেঁচে
আছেন ,তিনি বলেন এমন নেশা নাকি তার বাপেরও ছিল তার আব্বার নাম ছিল আকবর আলি ,লোকে তার ওই বিশেষ গুনের জন্য আলাপ আলি বলে ডাকতেন তাতে
আব্বু রাগ করতেন না উল্টে যারা তাকে আলাপ নামে ডাকতেন,তাদেরকে তিনি চা খাইয়ে বকশিস দিতেন এখনও এই গঞ্জের মুরুব্বি যারা ,তারা তাকে আলাপের বেটা 
বলেই উল্লেখ করেন রহমতও সে জন্য রাগরোশ করে না তার কাজ হল সকাল হলেই মোরের মাথায় এসে কাজলের চায়ের দোকানে বসা এখন সকাল সাতটা এর 
মধ্যেই সে তিন কাপ চা হজম করে ফেলেছে রহমত এখন খড় কেনাবেচার ব্যবসা করে এবার তাকে কাজের জায়গায় যেতে হবে এই এলাকায় যত গ্রাম আছে প্রায়
সব গ্রামের চাষিবাসি মানুষই তার পরিচিত তার কথার দাম আছে আব্বার কাছ থেকেই সে এই ব্যবসাটা শিখেছে তিনি বলতেন , 'বেটা ব্যবসায় কথার দাম রাখাটাই
আসল কাজ এই কাজটা ঠিকমত করতে পারলেই দেখবি তোর ব্যবসা তড়তড় করে এগিয়ে যাবে '
       রহমত নিজের অভিঙ্গতায় দেখেছে আব্বার বলা উপদেশ কতটা সত্য মনে মনে সে আব্বাকে সালাম জানায় তার দোয়ায় সে আজ করে কম্মে খাচ্ছে আকাশে আজ
ঘন মেঘের আনাগোনা রহমত ভয় পায় এখন যদি বৃষ্টি নামে তাহলে সর্ব্বনাশ তার একদল লেবার গেছে নন্দপুরে খড় বাঁধতে সেই খড় গাড়িতে লোড করার কথা ঠিক
দুপুর তিনটেয় বৃষ্টি হলে প্রথমত লেবাররা কাজ করতে পারবে না দ্বিতীয়ত বোঝা বাঁধা খড়ের ওজন বেড়ে যাবে গৃহস্থ ভুল বুঝবে ভাববে রহমত বুঝি বেশি খড় নিয়ে
তাদের ঠকিয়েছে তার যতটুকু নামডাক তার পিছনে সততার হাত আছে যদি সেই সততা না থাকে তাহলে বিশ্বাসের ভিতটা নড়ে যাবে রহমত তখন আর ব্যবসা করে 
খেতে পারবে না সেজন্য সে এসব বিষয়ে খুব সচেতন
    তার জীবনের একটাই দুঃখ , বোনটি পোলিও রোগাক্রান্ত ওর পা দুটো দিনদিন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে অনেক চেষ্টা করেও রহমত রুকসানার পা দুটো ভালো 
করতে পারে নি এখনো সে চেষ্টার কসুর করে না যে যা বলে রহমত তাই করে কেউ হয়তো বলল কোন একজন ম্নত্রপুত তেল বানিয়ে দেয় , যা মালিশ করলে পা সোজা হয়ে
যাবে রহমত সেই তেল এনে দেয় , আম্মা সেই তেল নিয়মিত মালিশও করে দেয় কিন্তু রুকসানার পা তাতেও দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না বোনকে
সে একটা তিন চাকা হাতে চালানো ভ্যান কিনে দিয়েছে ফলে ঘরে চুপচাপ বসে থাকা থেকে সে রেহাই পেয়েছে এখন মাঝে মাঝে সে এদিক সেদিক যেতে পারে মেয়েটার মনের
জোর আছে বটে গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে পাশ করার পর আম্মা বলেছিল আর ওকে পড়াবার দরকার নেই রুকসানা কারো কথা শোনে নি তিন কিমি দূরের হাই স্কুলে ভর্তি
হয়েছে সে রহমত আপত্তি করে নি তবে আম্মার কথার অবাধ্য হয়ে রুকসানা হাই মাদ্রাসায় না পড়ে সাধারণ হাই স্কুলে জেদ ধরে ভর্তি হওয়ায় সে একটু বিরক্ত যে হয় নি , তা
কিন্তু নয় বোনের কথার যুক্তিতে সে হার মেনেছিল রুকসানা বলেছিল , 'এখন পৃথিবীটা আর ছোট নয় ,মুসলিম জাহান নিয়ে দুনিয়া চলে না বড়ভাই পড়তে হলে ভাল করে পড়াটাই
উচিত ওখানে সুযোগ এবং প্রতিযোগিতা দুটোই পাওয়া যাবে ' তাই রহমত আর কিছু বলে নি ছোট বোনটার জন্য করতে পারে না এমন কাজ এই জগতে নেই রুকসানা তার সাধের
তিন চাকা গাড়িটাকে প্রচণ্ড যত্ন করে নিয়ম করে ধুয়ে-মুছে সাফসুতরো করে সপ্তাহে এক দিন  
    বছর বড় পূজার আগেই ঈদ হয়ে গেছে আর পূজার ঠিক পরেই কুরবানি ঈদ রুকসানার মনে ভীষণ আনন্দ ওর শরত কালটা খুব ভালো লাগে বড় ভাই আর মা - এদের
দু'জনের উচ্চারণেই অনেক খামতি আছে আসলে মুসলিম সমাজে বড় হওয়া মা কখনও বাড়ির বাইরে বের হয় নি শুনে শুনে যা শিখেছে তাই বলে এসেছে মা কে দোষ দিয়ে লাভ নেই
বড় ভাই রহমত বাইরে ঘোরে বটে কিন্তু সেও বেশি দূর শিক্ষার আলো গ্রহণ করতে পারে নি ফলে নিজে যতটুকু শিখেছে সবটাই শুনে এবং দেখে পড়াশুনা করলে ঘাটতি থাকত না বাড়িতে
এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিন মা-মেয়ে নয়তো ভাইবোনে তর্কাতর্কি হয় শেষমেশ মা বা বড়ভাই তার কাছে হেরে যায় হারলেও তারা গর্বিত হয় কারন রুকসানা যে এত কিছু জেনেছে তাতে তাদের
খুশি হওয়া ছাড়া উপায় কি ! 
    রহমত পাশের গ্রামে এক চাকুরীজীবী যুবককে তার বোনের কথা বলেছে যুবকটি কোলকাতায় বড় চাকরি করে রুকসানার জীবন সংগ্রামের কথা শুনে সে তো অবাক সে
বলেছে শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা আছে রুকসানার জন্য সে চেষ্টা করবে তবে সেটা এখনই নয় নন্দপুরের পাঁজা ফ্যামিলির নাম সকলেই জানে ওরা
খুব শিক্ষিত এবং পরোপকারি মনে মনে সে তার প্রতিবন্ধী বোনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে রুকসানা শারীরিক ভাবে অক্ষম তো কি হয়েছে ? সে শিক্ষায় , বিদ্যায় , ঞ্জানে , বুদ্ধিতে একদিন
সকলকে ছাপিয়ে যাবে  
    রহমত কিছুতেই চায় না এখন বিয়ে করতে কিন্তু বাড়িতে তার মা আর বাচাল বোনটি উঠেপড়ে লেগেছে তার বিয়ে দেবার জন্য আয়েসা বলে একটি মেয়ে ইদানিং খুব আসাযাওয়া
করছে তাদের বাড়ি ওর আব্বা ইদ্রিশ চাচা এই গ্রামেরই তার আব্বার সাথে দহরম মহরম ছিল খুব ছেলেবেলায় দুই বন্ধুতে নাকি বেয়াই পাতাবার কসম অবধি খেয়েছিল কিন্তু সে সব
বহুদিন আগের ঘটনা তার আব্বা আজ বেঁচে নেই সুতরাং কসম বা ওয়াদা যাই হোক , সেটা পূরণ করার দায় বা দায়িত্ব কোনটাই রহমতের ওপর বর্তায় না  
    পোলিও একবার হয়ে গেলে সে রোগ নাকি সারে না রুকসানা ওড়গ্রামে , গুশকরায় এমনকি বর্ধমান অবধি বহু ডাক্তারের সাথে আলোচনা করেছে সকলেই বলেছে রোগ সারবার
নয় তাই সে তার অক্ষমতাকে আর কোনভাবেই আড়াল করার চেষ্টা করে না রুকসানা শুধু মন দিয়ে পড়াশুনা করে বুঝে নিয়েছে শিক্ষাই তাকে দিতে পারে মুক্তি আর সে চায় তার বড়ভাইটি
বিয়ে-থা করে সংসারী হোক তার জন্য যেন পরিবারের কারোর কোন সমস্যা না হয় আয়েসা তার সমবয়সী একসময় সে স্কুলে যেত এখন আর যায় না ওর আব্বা বলে দিয়েছে ,'মেয়ে মানুষের
বেশি লেখাপড়া শেখার দরকার নেই ' বেচারা আয়েসা ! বিয়ে করে সংসার আর ছেলেপুলে মানুষ করাই ওর ভবিতব্য অবশ্য তার অবস্থাও আয়েসার মতোই হত , যদি সে আর পাঁচটা গড়পড়তা
মুসলিম মেয়েদের মতো স্বাভাবিক হত রুকসানা মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবে খুশিতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে
    আয়েসা এখন যে কোন ছুতোয় ঘন ঘন তাদের বাড়ি আসে রুকসানা ঘরে বসে একমনে পড়ছিল সবে গৃহস্থের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে রহমত দিবানিদ্রা দিচ্ছে মা 
এঁটো বাসন কোসন ধোয়ায় ব্যস্ত কলতলায় ঠিক এসময়ে আয়েসা একবাটি কয়েত বেল বেশ জম্পেশ করে নুন , লঙ্কা ,তেল সহযোগে মেখে হাজির হয় রুকসানার ঘরে ' বেল খেতে রুকসানা
ভীষণ ভালোবাসে হৈ হৈ করে ওঠে রুকসানা বলে ,' তুমি আমার ভাবি হবার উপযুক্ত আয়েসা আমি কি খেতে ভালোবাসি , কি পড়তে ভালোবাসি, কোন গান আমার পচ্ছন্দ - সব তুমি জান আর
খেয়াল রাখ বড় ভাইকে বলে আমি আজই রাজি করাব '
    আয়েসা লজ্জ্বায় রাঙ্গা হয়ে বলে ,' আহা , আমি যেন সেজন্য তোমার কাছে এসেছি ? মরণ আর কি ! '
    'আচ্ছা বাবা আমার ঘাট হয়েছে তবে তোমাকে ভাবি হিসাবে পেলে আমার যে কি উপকার হবে ,তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না বলো না ,আমার বড়ভাইকে তোমার পচ্ছন্দ কি না ?'
রুকসানা জটিল বিষয়টাকে হাল্কা করে দেয়
    আয়েসা আরও লজ্জ্বা পেয়ে বলে , ' জানি না যাও ! তুমি না ভীষণ বদ !'
    রুকসানা সুযোগ পেয়ে আয়েসাকে জড়িয়ে ধরে ,তারপর চুমায় চুমায় ভরিয়ে দেয় কাতুকুতু একদম সহ্য করতে পারে না আয়েসা সে খিলখিল করে হেসে ওঠে আম্মা এবং রহমত দু'জনেই 
ওদের উপস্থিতি টের পায় মায়ের পশ্রয় আছে রহমতের কাঁচা ঘুম ভাঙ্গানোর মাশুল গুনতে হল আয়েসাকে ' কি হচ্ছেটা কি ? নিজে তো লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছ কবে ? এখন আমার বোনের পড়াটা
নষ্ট করতে এসেছ ,না ?'
    কয়েকটা মুহুর্ত কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে আয়েসা তারপর ঝরঝর করে তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতে থাকে রুকসানা বিহ্বলতা কাটিয়ে কি করবে ভেবে পায় না ? মা হাতের কাজ 
ফেলে দৌড়ে আসে , বলে , ' আবার কি কথার ছিরি ? মেয়েটাকে শুধু শুধু কাঁদিয়ে ছাড়লি তো ? ' মা, আয়েসার চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলে , ' ওর কথা ধরিস নে মা ! আমার ছেলেটা ওরকমই
কখন কাকে কোন কথাটা বলতে হয় জানেনা ' তবুও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আয়েসা