গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

৮ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ।। ১০ই পৌষ ১৪২৫

এই সংখ্যার লেখকসূচি : অরুণিমা চৌধুরী, সুবীর কুমার রায়, রিমি মুৎসুদ্দি, তাপসকিরণ রায়, স্বরাজ দত্ত, পার্থ রায়, সুদীপ ঘোষাল, মনোজিৎ কুমার দাস, ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী ও দেবাশিস কোনার ।

সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করুন

অরুণিমা চৌধুরী

মন জানালা খুলে দে না

তখন সেজোদিদার কাছে থাকতুম। সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে তুলিয়ে মা দিদার জিম্মায় দিয়েই ছুটতো বাস ধরতে। আর আমি বগলে চারটি এবিসিডির প্লাস্টিক ছাঁচ, বই টই কিছু একটা, একটা ইজের অতিরিক্ত- নিয়ে ঢুকে পড়তুম দুকামরার ব্যারাক বাড়িটায়। বাড়িটার বারান্দায় গোল লোহার পাইপ, দুহাতে ধরে ঘুরেঘুরে দোল খাওয়া যায় বেশ, অবশ্য দিদার নজরে এলেই বকবে অতএব সবটাই চুপিচুপি। নীলুমাসি, শিলুমাসি, ইলুমাসি সব্বাই ঘুম থেকে উঠে পড়লেও নিপুমামার তখনো ঘুম ভাঙেনি। ঘুম ভাঙলে তবে চা হবে। আর তাইতে আমার খুব লোভ। কেন! না, দিদা নোনতা বিস্কুট দেবে, যত দেবে আমি সওব চায়ে ডুবিয়ে দেবো। খাবো না। বলবো, "আরো বিস্কুট দাও!" তারপর সবটা চায়ে ভিজে, বিস্কুট কাদাকাদা হয়ে, আমার ছোট্ট কাপ উপচে উঠলেই চামচ চাইব। কি আরাম চায়ে ভেজানো বিস্কুট খেতে! তারপর মাসিরা বই খুলে বসলে আমিও আমার সম্বল খুলে বসবো। মাসিরা খবরদারি করবে আমার উপর। আমি কিন্তু অপেক্ষায়, কখন ইস্কুলের রিক্সা আসবে ওরা বেরিয়ে পড়লেই আমি চৌকির নীচ থেকে ইলুমাসির পুতুলের বাক্স হাঁটকাব।
এমনি করে সকাল কিছুটা পাতলা হবে, দিদা রান্নাঘরে চাল ভিজিয়ে বারান্দায় আসবে। আমি ঠিক ফাঁকতালে গিয়ে ভেজা চালের ভিতর মুঠো ডুবিয়ে খলবল করব। আমার কি যে ভালো লাগতো চাল খাবলাতে! অথচ এখন রোজই চাল ধুচ্ছি, রান্না করছি, সেই অনুভূতি নেই তো!
সে যাইহোক, সেজোদাদুর বাড়িতে থাকত আরেক দিদা,মায়ের এক সম্পর্কিত বালবিধবা পিসি, যাকে আমরা ডাকতুম "কোদাল দিদা" বলে। অমন সুন্দরী, ফর্সা, ছেলেদের মতো করে চুল কাটা, কোমর পড়া মানুষটিকে কেন যে আমরা ভাইবোনেরা সবাই "কোদালদিদা" বলেই ডাকতুম,তার কোন হদিশ আজ আর দিতে পারব না।
কোদাল দিদা নিরামিষাশী, বারান্দায় এইটুকু একটা পিঁড়ি পেতে সবজি কাটতো। এমনিতে ভালোই, কিন্তু আমি তাকে এড়িয়ে চলতুম। কেন না কোদাল দিদার ভারী ছড়াকাটার অভ্যেস। আমায় দেখলেই তার প্যারোডি করার ঝোঁক( এখন প্যারোডি বুঝলেও, তখন কি ছাই বুঝতুম!) দিদা সুর করে গাইতো, "অমিতার বর এসেছে ল্যাংটা লো ল্যাংটা, অমিতা মাথায় দেলো ঘোমটা "..
এর পিছনের গল্পটি একটু জানা দরকার, আমাদের পাড়ায় একটি পাগল আসতো। হাঁটতে পারতো না, পাছু ছেঁচড়ে রাস্তা দিয়ে যেতো। কাউকে মারাকোটা করেনি কখনো। গরমের দিনে আম কাটলে,প্রায়ই মা আমার হাত দিয়ে তাকে আম পাঠাতো। তাতেই সবাই আমায় ক্ষেপাতো, আমি রাধুপাগলাকে বিয়ে করব। বলা বাহুল্য, পাছু ছেঁচড়ে চলার কারণে রাধুর প্যান্ট ছিল ছেঁড়া।
 
এবার বলুন, ছোট বলে আমার কি একটা মান সম্মান নেই! খুব রাগ হতো কোদালদিদার উপর।
তবে সে বুড়ির অনেক গুণ, অবসরে পুরনো কাপড়ের পাড় থেকে সুতো খুলে এমন সুন্দর নক্সি কাঁথা সেলাই করতে আর কাউকে দেখিনি।
বেলা আরেকটু গড়ালে, মাসিরা আমায় নিয়ে খেতে বসতো। সেই ছোট্ট রান্নাঘরেই সেজোদিদার উনুন একদিকে, আরেকদিকে সার বেঁধে নীলুমাসি, শিলুমাসি ইলুমাসি আর আমি। আমি তখন কোদালদিদার পিঁড়িটি কায়দা করে দখল করেছি।
এইবার খেতে বসে আমার অনেক শিক্ষেদীক্ষে হতো। শিলুমাসি যা শেখাবে, ইলুমাসি ঠিক তার উল্টো কথা কইবে। এই যেমন খেতে বসে আমি ছোট মানুষ, থালার বাইরে ভাত ছড়াতুম ঢের। শিলুমাসি হয়ত বল্লো, "ভাত কুড়িয়ে নে, নষ্ট করতে নেই। " আমিও লক্ষ্মী মেয়ের মতো যেই না কুড়িয়ে নিয়ে খেতে যাব, অমনি ইলুমাসি হাতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বলবে, 'মাটির থেকে কুড়িয়ে খাচ্ছিস, পেট ব্যথা করবে না!"দিদা বলতো, " অমন জিভ বের করে, হাঁ করে খেতে নেই, বিয়ে হলে লোকে নিন্দে করবে"... তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, বিয়ে ব্যাপারটা শিলুমাসি ইলুমাসির দ্বন্দ্বের মতো, যাই করো জিভ নাড়াও বা নাই নাড়াও, দোষের। এই দ্যাখো! আবার অফ দ্য ট্র‍্যাক কইতে বসে গেছি..
মাসিরা যেদিন ইস্কুলে যেতো,সেদিন তো যেতোই, তারপর সেজোদিদার মাথায় ছোট ছোট হাতে তেল থাবড়ে বাচ্চা মতো ত্যাড়াবেঁকা একটা বিনুনি বেঁধে দিতুম। দিদা চানে যাবার আগে খবরের কাগজটি মেলে বসতো। সেরকমই একদিন পাতা জুড়ে ছবি এলো উত্তম কুমার আর নেই। যেদিন মাসিরা ইস্কুল যেতো না, তিনজনেই বাড়ি থাকতো, সেদিন অবধারিত ভাবে আচার চুরি করতো। নীলুমাসি তিনজনের মধ্যে বড়, তাই কিছু দায়িত্ববোধ ছিল। তেঁতুল, কুলের আচার আমার মুখে ঢুকিয়ে বীজ গুণে রাখতে হতো তাকে। তা সত্ত্বেও আমি ও কম্মোটি করতুম। বীজটি গিলে ফেল্লেই ভয় দেখানো হতো, "পেটে গাছ হবে".. আমি পুকুরের পাড়ে ভাবতে বসতুম, তাইতো! মাথার উপর দিয়ে ডালপালা উঠছে, পা দিয়ে শিকড় নেমে যাচ্ছে, আমি মা যাব কেমন করে! মা! ব্যস! মায়ের কথা মনে পড়লেই তো কান্না গিলে কাঠ হয়ে থাকা.. মা কেন ইস্কুলে যায়! যায় যদি, আমায় কেন নেয় না! 
এমনি দুপুরের দিনে ঘুলঘুলি দিয়ে অন্ধকার ঘরে আলো আসতো, রাস্তার ধারের ব্যারাক বাড়ি, দুপুরভর তাতে লোক চলাচল করে। আর চৌকির উপর শুয়েশুয়ে তিন মাসির সঙ্গে আমি উলটো মুখো লোকের চলাচলের সিনেমা দেখি..
এখনো অবসরে সেই মানুষগুলো চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, সবাই উল্টোমুখো। আয়নায় ছায়া পড়ে। অনেকদিন চুলে কলপ করিনি। কেমো নেবার পরে আমার প্রায় সব চুল সাদা হয়ে গেছে। আর নীলুমাসি! অনেক অনেক বছর আগে যখন দেখেছি, তার বিয়েটাও দোষের হয়ে গেছে, অথচ সে কোনদিন মুখ হাঁ করে সপসপ করে ভাত খায়নি। আমার অসুন্দর নীলুমাসির সুন্দর মেসোমশাই এ বাড়িতে আসা যাওয়ায় আগল পরিয়েছেন। শিলুমাসির বাচ্চাটা সেরিব্রাল পলসিতে মাত্র সাত বছর বয়সে চলে গেছে.. কোদালদিদা তো আমার সেই ইস্কুলে ভর্তির আগের বয়েসেই নেই হয়ে গেলো। একদিন রাতে ঘুমিয়ে আর উঠলোনা। সেজোদিদার কোমর পড়ে গেছে। বাড়িটা এখনো আছে, কিন্তু স্থান সঙ্কুলান হয়নি কারো..
সময় এগিয়ে যায়,আমি পিছিয়ে আসি.. শীতকাল কবে ফুরোবে, আমার কবিতা আসেনা বড় ডিপ্রেশন হয়।


সুবীর কুমার রায়

সুখস্মৃতি

জীবনে চলার পথে এমন ছোট ছোট কিছু ঘটনা ঘটে, সারাটা জীবন যা মনের কোণে সুখস্মৃতি হয়ে রয়েই যায়। আমার জীবনে এরকম অনেক, অনেক ঘটনা ঘটেছে। আজও হঠাৎ কোন বিশেষ ঘটনার কথা স্মৃতি হঠাৎ করে মনে করিয়ে দিলে, খুব ভালো লাগে, দিনটা ভালো কাটে। আজ হঠাৎ এরকমই একটি পরিবারের কথা মনের কোণে ভেসে উঠলো। তাঁরা কোথায় আছেন জানি না, তবু সেই দিনের সুখস্মৃতির জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানানোর জন্যই এই স্মৃতিচারণা।
বিয়ের কয়েক মাস পরেই আমরা হিমাচল প্রদেশে ঘুরতে যাই। আমার এক সহকর্মী, তার স্ত্রী, আড়াই বছরের শিশু কন্যা, ও শ্যালিকাকে নিয়ে আমার সাথে ভ্রমণ সঙ্গী হিসাবে গিয়েছিল। দু-একটা জায়গা ঘুরে আমরা পালামপুরে এসে হাজির হলাম। এখনকার অবস্থা আমার সঠিক জানা নেই, কিন্তু সেই সময় পালামপুরে রাস্তার ওপরেই একটা সম্ভবত তিনতলা বড় হোটেল ছিল। সেই সময় এই হোটেলটাকেই নিরাপদ ও সুন্দর মনে হওয়ায়, আমরা সেই হোটেলে দুদিনের জন্য দুটো ঘর নিয়ে দিব্যি গুছিয়ে বসলাম। পরের দিন সকালের দিকে পাকা রাস্তা ধরে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে নিউগল্ পার্কের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময়, জায়গাটার সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়ে গেলাম। একসাথে হাঁটা শুরু করলেও, আমার বন্ধুটি সম্ভবত আমাদের একটু একা হাঁটার সুযোগ দেওয়ার জন্যই, ধীরে ধীরে সপরিবারে অনেকটা পথ পিছিয়ে পড়লো। অবশ্য তাদের সাথে একটা বাচ্চা ছিল, এটাও ধীরে হাঁটার একটা কারণ অবশ্যই ছিল। সে যাহোক, নিউগল্ পার্কে আমরা অনেকক্ষণ সময় শুয়ে বসে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে হোটেলে ফিরে স্নানাহার সেরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, এমন সময় হোটেলের একজন কর্মচারী আমায় এসে জানালো, যে আমার একটা ফোন এসেছে। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম যে, আমাকে এখানে কেউ চেনে না, তাছাড়া আমি যে আজ এখানে থাকবো ও এই হোটেলে উঠবো তাও কারও জানার কথা নয়, কাজেই আমায় কেউ ফোন করতে পারে না, তার নিশ্চই কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। হনহন্ করে নীচে ফিরে যাওয়ার আগে সে শুধু জানালো, যে একজন ডাক্টার সাব আপনার রূম নাম্বার ও নাম জানিয়ে ফোনটা করেছেন, নীচে গিয়ে ফোনটা ধরুন।
এবার  আমার ঘাবড়াবার পালা। বাড়িতে টেলিফোন নেই, অবশ্য তখন হাতেগোনা দু’-একজনের বাড়িতেই টেলিফোনের দেখা মিলতো। যে দু’-চারজন ডাক্তার আমার পরিচিত, তারা আমার অফিসেও আজ পর্যন্ত কোনদিন ফোন করেননি। তাহলে কি বাড়িতে কোন বিপদ ঘটায় কোন ডাক্তার আমায় ফোন করে জানাচ্ছেন? কিন্তু তিনিই বা এই হোটেলে আমার উপস্থিতি, এমনকী আমার রূম নাম্বার জানবেন কিভাবে। নীচে যাওয়ার সময় পাশের ঘরে বন্ধুকে ডাকতে গিয়ে শুনলাম, যে সে সম্ভবত সিগারেট কিনতে বেড়িয়েছে। অগত্যা একা একাই নীচে গিয়ে রিসেপশনে ফোনটা ধরলাম। অপর প্রান্ত থেকে এক পুরুষ কন্ঠ আমায় আমার নাম উল্লেখ করে জানালেন, যে তিনি ডক্টর অআকখ (এতবছর পরে আর তাঁর নাম মনে নেই) বলছেন। আমি তাঁকে জানালাম যে তাঁর বোধহয় কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। কারণ এখানে, এই পালামপুরে আমি গতকালই এসেছি, এবং এখানে আমার কোন পরিচিত ব্যক্তিও বসবাস করেন না। উত্তরে তিনি শুধু বললেন, যে তাঁর কোন ভুল হচ্ছে না। আমি আমার বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলেই তাঁর পরিচয় পাবো। আমার বন্ধুর নাম উল্লেখ করে তিনি জানালেন, যে আজ সন্ধ্যায় যদি আমি সপরিবারে বন্ধুর পরিবারকে নিয়ে তাঁর বাসায় আসি, তাহলে তিনি খুব খুশি হবেন। সন্ধ্যায় দেখা হলে জমিয়ে আলাপ হবে জানিয়ে, সন্ধ্যার সময় তাঁর বাড়িতে যাবার জন্য আর একবার অনুরোধ জানিয়ে, তিনি ফোনটা ছেড়ে দিলেন।

সিগারেট কিনে বন্ধুটি হোটেলে ফিরলে, তাকে সব জানালাম। সে জানালো যে নিউগল্ পার্ক যাওয়ার পথে একটা ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট বাড়িতে একজন বাঙালি ডক্টোরেট ভদ্রলোক থাকেন, যিনি সম্ভবত এখানকার কোন এনিমেল হাজবেন্ড্রী এন্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স্ কলেজের প্রিন্সিপাল। আরও জানলাম যে যাওয়ার পথে তাঁর সাথে ওর আলাপ হয়েছিল, ভদ্রলোককে সে আমাদের কথা, আমরা এখানে কোন হোটেলে উঠেছি, কোথা থেকে এসেছি, এখান থেকে কোথায় কোথায় যাবো, ইত্যাদি সবকিছুই বলেছিলএতক্ষণে বুঝলাম, যে নিউগল্ পার্কে তাদের পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ার তৃতীয় কারণটা কি।
যাইহোক বিকালের শেষভাগে আমরা ভদ্রলোকের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। নিউগল্ পার্ক যাওয়ার পথে, পার্ক থেকে অনেকটা পথ আগে, রাস্তার ডানদিকে সত্যিই একটা ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির সামনে ফুলগাছে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে। বার দু’-তিন কলিং বেল বাজানোর পরে দুটো ফুলের মতো সুন্দর বাচ্চা দরজা খুলে আমাদের দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা বড়, বছর আষ্টেক বয়স, মেয়েটা বছর দুয়েকের ছোট। বাবাকে ডেকে দিতে বললে তারা নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি করে জানালো, বাবা বাড়ি নেই। বাধ্য হয়ে মাকে ডেকে দিতে বললে, তারা মাম্মি মাম্মি করে  চিৎকার শুরু করে দিলো। তাদের ডাকাডাকিতে বাচ্চা দুটোর মা এসে আমাদের সোয়া পাঁচজনের বিরাট অচেনা দলটাকে দেখে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কাকে চাই”? সর্বনাশ, আমাদের অত দূর থেকে ডেকে এনে এ কি রসিকতা! আমার বন্ধুটি আমাদের আসার কারণ জানাতে ভদ্রমহিলা আমাদের বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তায় বুঝে গেলাম, ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও তাঁর বাড়িতে আমাদের আসার অমন্ত্রণের কথা স্ত্রীকে বলতে সম্ভবত ভুলে গেছেন। আমরা চা খেয়ে আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে কেটে পড়ার ধান্দা করছি, এমন সময় ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন। জানা গেল কি একটা কাজে গিয়ে তিনি আটকে গেছিলেন।
ভদ্রলোক আমাদের পাশে বসে জমিয়ে নানারকম গল্প শুরু করলেন। বুঝলাম ভদ্রলোক কথা বলতে বেশ  ভালবাসেন। তাঁর হাতে ও পায়ের পাতার বিভিন্ন জায়গায় দেখলাম  লাল লাল রঙের ছোপ। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, খরগোশের কামড়ের জন্য মারকিউরোক্রম লাগিয়েছেন। ওষুধ লাগিয়েছেন বেশ করেছেন, তা বলে সারা হাতে পায়ে? উনিই জানালেন, যে তাঁর অস্ট্রেলিয়া না কোথাকার যেন খরগোশের একটা ছোট্ট ফার্ম আছে। এই প্রজাতির খরগোশের লোম থেকে অত্যন্ত মূল্যবান উল তৈরি হয়। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নাকি সেই উল। ওই খরগোশগুলো ভীষণ কামড়ায়, এবং তাদের কামড়ের জন্যই, এতো জায়গায় ওষুধ লাগাবার প্রয়োজন হয়েছে। শুনলাম ভদ্রলোক দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন এবং বিদেশ থেকেই তিনি দু’-দুবার ডক্টোরেট করেছেন। তিনি জানালেন, যে এখানকার মানুষের বিশ্বাস যে এই অঞ্চলে মাছ চাষ করা সম্ভব নয়। তিনি কিন্তু মাছ চাষ করে দেখিয়েছেন, যে এখানেও মাছ চাষ সম্ভব। হিমাচলে ব্যবসা করতে গেলে হিমাচলের একজন মানুষকে পার্টনার হিসাবে নিতে হবে, না এরকম কি একটা নিয়ম আছে। তিনি বোধহয় সে ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন। ইতিমধ্যে একপ্রস্ত চা জলখাবারের আয়োজনও সম্পন্ন হয়ে গেছে।
ওনার স্ত্রী জানালেন যে তাঁর বাপের বাড়ি কলকাতার গরচায়। দীর্ঘদিন এই ফাঁকা জায়গায় থেকে থেকে ওনার স্বামীর কলকাতার রাস্তাঘাট ও যানবাহনের ভীড়ভাট্টার ওপর একটা আতঙ্ক এসে যাওয়ায়, তিনি সহজে আর কলকাতামুখো হন না, ফলে তাঁরও বাপের বাড়ি বিশেষ যাওয়া হয়ে ওঠে না। প্রসঙ্গক্রমে আমি বললাম যে গরচায় আমি অনেকবার গিয়েছি, কারণ আমার এক আত্মীয় দীর্ঘদিন গরচায় বসবাস করেন। আমার কথা শুনে ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন, যে আমার সেই আত্মীয় গরচার কোথায় থাকেন। রাস্তার নাম উল্লেখ করতেই তিনি জানালেন, যে তাঁর বাড়িও গরচার ওই একই রাস্তায়। বাড়ির নম্বর জানতে চাওয়ায় তাঁকে বাড়ির নম্বর বলতেই, তিনি উল্লাসিত হয়ে জানালেন, যে তিনিও ওই একই বাড়ির বাসিন্দা। সত্যি কি অদ্ভুত যোগাযোগ। এবার তিনি আমার আত্মীয়র নাম জিজ্ঞাসা করলেন। শিবপুর বি.. কলেজ থেকে পাস করা, অবিবাহিত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বৃদ্ধ ভদ্রলোকের নাম শুনে তিনি হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করে বললেন, “শচীন কাকা আপনার আত্মীয়? উনি আপনার কে হন? আমার জীবনে লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার পিছনে সমস্ত অবদান ওনার। জিওগ্রাফি ভালবাসলেও ওই সাবজেক্টটার ওপর একটা ভীতি আমার ছিলই। উনি আমায় জিওগ্রাফি বুঝিয়ে দেওয়া শুধু নয়, আমি জিওগ্রাফিতে মাস্টার্স করার সময়, উনি আমার সমস্ত নোট তৈরি করে দেন। এবার আমার বিষ্মিত হবার পালা। অবাক হয়ে তাঁকে বললাম,“উনি সম্পর্কে আমার দাদু হন, লেখাপড়ায় উনি খুবই ভালো ছিলেন শুনেছি, কিন্তু উনি তো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, উনি আপনাকে জিওগ্রাফির নোট কিভাবে তৈরি করে দিতেন বুঝলাম না উত্তরে ভদ্রমহিলা জানালেন যে উনি যতটা সময় পেতেন, নোট তৈরি করে দেওয়ার জন্য আমার জিওগ্রাফির বইপত্র পড়তেন। পরবর্তীকালে আমি আমার ওই দাদুর কাছ থেকে শুনেছিলাম, যে তিনি ওই ভদ্রমহিলাকে জন্মাতে দেখেছেন। পড়াশোনায় খুব ভালো হলেও, জিওগ্রাফির প্রতি ভীতিতে মাস্টার্স পড়া ছেড়ে দেবার উপক্রম হওয়ায়, তিনি তাঁকে সাহায্য করেন। অবশ্য এর জন্য তাঁকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
যাইহোক এইসব নিয়ে আড্ডা আলোচনায় বেশ একটু রাতই হয়ে গেছিল। এবার আমরা হোটেলে ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াতেই, ভদ্রলোক হঠাৎ বললেন এখন হোটেলে ফিরে গিয়ে রাতের খাবার না খেয়ে, এখানে দুটো ডাল ভাত খেয়ে গেলে হতো না”? এক মুহুর্ত সময় অপচয় না করে আমি সরাসরি বললাম, “এই কথাটা   শুনবার জন্য আমি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে ছিলাম। কয়েকদিন ধরে লাউকি, আলু গবি, আর আলু মটর খেয়ে খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গেছেআমার কথায় ভদ্রলোক হেসে ফেলে বললেন, এতো লজ্জা পেলে চলে? তিনি তাঁর স্ত্রীকে চটপট্ কিছু আয়োজন করে ফেলতে বললেন। আমিও আমাদের সঙ্গের তিনজন মহিলাকে ওনাকে একটু সাহায্য করতে বললাম।
অল্প সময়ের মধ্যেই খানা প্রস্তুত। খুব সুন্দর কি একটা চালের গরম ভাত, সুন্দর ঘি, ডাল, আলু চোখা, বেগুন ভাজা, আর ভদ্রলোকের চাষের সেই বাটা মাছের মতো দেখতে, কি একটা মাছ ভাজা। আহা ঠিক যেন অমৃত খেলাম। ভদ্রলোক অবশ্য একটু দুঃখ করেই বললেন যে এতো রাতে ভালো কিছু জোগাড় করা মুশকিল,  আপনাদের হয়তো খেতে একটু কষ্টই হলোআমরা জানালাম, যে বেশ কয়েকদিন পরে বাঙালি খানায় যেন অমৃতের স্বাদ পেলাম।
এবার ওঠার পালা। ভদ্রলোক বললেন এই পথে রাত হলেও কোন ভয় নেই। নিশ্চিন্তে চলে যান, কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে, আমার নাম বলবেন আর হোটেলে পৌঁছে আমায় একটা ফোন করে জানাবেনধীরে ধীরে একসময় আমরা হোটেলে ফিরে এসে তাঁকে আমাদের পৌঁছানো সংবাদ জানালাম।  
এবার আপনারাই বলুন, এই দিনটাকে কি ভোলা যায়? প্রার্থনা করি ওনারা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।




রিমি মুৎসুদ্দি

লাদাখের ডায়রি

সময়টা শুনতে বড় কম, দিল্লি থেকে মাত্র ৯০ মিনিট। অথচ ৯০ মিনিটে যেন একটা জগত থেকে, একটা টপোগ্রাফি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অচেনা কোন মানচিত্রের রাস্তা বরাবর চলে আসা। পাহাড়ের রঙ বলতে ছোটবেলা থেকে সবুজ জেনে আসলেও প্রথম বরফের চাদরে মোড়া বাদামী পাহাড় দেখা। ধূসর মাটিপাথরের রূপও যে এমন নেশা জাগানিয়া তা বুঝে ওঠার আগেই শ্বাসবায়ু বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কেবিন ক্রুয়ের ঘোষণা, প্রথমে স্পষ্ট হতে হতে অস্পষ্ট- উই আর এবাউট টু আরাইভ এট লে ইনটারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ।ঊই আর এট দি হাইট অফ ১১৪৮০ ফিট । প্লিস ডু নট শ্লিপ ডিউরিং দি ডে টাইম । ইফ ইউ ফিল আনকমফোর্টেবেল ... এর বেশী আর কিছু দময়ন্তীর মাথায় ঢুকল না, একটু একটু করে কোথায় যেন ডুবে যাচ্ছে? বাতাসে কি আর একটুও অক্সিজেন অবশিষ্ট নেই? পাশ থেকে যেন ভেসে এল কয়েকটা শব্দ। এক্লেমাটাইজেশন- হাই অল্টিটিউড সিকনেস।
আর্মি বেসক্যাম্পে যখন দময়ন্তীর জ্ঞান ফিরল, প্রথমেই পপাইকে খুঁজছিল। নাড়ীর টান যে সবচেয়ে বড় টান। তাঁবু-হাসপাতালের বিছানা থেকেই ও দেখতে পেল পাঞ্জাব, বিহার, বাংলা, হিমাচলপ্রদেশ, গোর্খা, তেলেঙ্গানা- বিভিন্ন রেজিমেন্টের সেনাদের ভীড়। সবার মুখেই হাসি। নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা মশকরায় মশগুল। আর কয়েকদিনের মধ্যেই এরা যাবে সেই দুর্গম সিয়াচেন ক্যাম্পে। তাই মেডিক্যাল ফিটনেস পরীক্ষা দিতে সবাই একের পর এক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন অল্পবয়সী ডাক্তার প্রেশার ইত্যাদি চেক করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন ভেতরে। সেখানে আরেকজন মেডিক্যাল অফিসার ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু করছেন।  মোবাইলের টাওয়ার নেই, দীর্ঘদিন প্রিয়জনদের থেকে বহু বহু দূরে বাইরের পৃথিবী থেকে একেবারে যোগাযোগহীন দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতিও যে এরকম নির্বিকার সহজভাবে নেওয়া যায় তা সেদিন অসুস্থ হয়ে বেসক্যাম্পে না গেলে ও বুঝতেই পারত না। বুঝতেই পারত না কত মিথ্যে অহমিকায়, কলহ-বিবাদে কেটে যাচ্ছে দিন।
-পাহাড় আমাদের নম্র হতে শেখায়, নত হতে শেখায়। পপাইকে কথাগুলো বলার চেষ্টা করল দময়ন্তী।
আর মনে মনে নিজেকে বলল, মরুপাহাড়ের ঐ ধূসর ভার্জিন শাদার  কাছে আজ যে ঋণ জমা হচ্ছে, সেই পুরোন ঋণের মতোই বহুদূর থেকে ভেসে এসেছিল কোনও স্বর্গীয় এক সুর-
জয় শঙ্খ গদাধর নীল কলেবর  পীত পটাম্বর দেহি পদম।
জয় চন্দনচর্চিত কুন্ডলমুন্ডিত কৌস্তভলাঞ্ছিত দেহি পদম।
...... একজন্মে বহু ঋণ জমা হয়ে যায়, সব কি শোধ করা যায়?

শাইলু নদীর দুধারে ছড়ানো নুড়িপাথরের মাঝে প্লাস্টিকের বোতল। ঈশ! দময়ন্তীর নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছে। কী দরকার ছিল সব দুর্গম অঞ্চলগুলোকেই ট্যুরিস্ট স্পট বানানোর? সুদীপ্ত স্যারের কথা মনে পড়ল ওর।
স্যার বলতেন, কী দরকার ছিল বল তো? মানুষের এভারেস্টের চূড়ায় উঠে? কী এমন লাভ হয়েছে মানব সভ্যতার? অথচ যদি অনাবিষ্কৃত থাকত এভারেস্টের পথ তাহলে এত পর্যটনপ্রিয় মানুষের ভিড়ের চাপ সহ্য করতে হত না দেবতাত্মা নগাধিরাজকে। এত দূষণ বাড়ত না। পৃথিবীর কোথায়ই বা একটা ভার্জিন বিউটি আছে বলতে পারবি?
-কালিদাসের একটা শ্লোক মনে আসছে। হিমালয়কে দেবতাত্মা ও নগাধিরাজ বলে কালিদাসই বোধহয় প্রথম সম্বোধন করেছেন। কিন্তু তোমার ভার্জিন বিউটিশব্দবন্ধটায়  একটা পিউরিটান গন্ধ আছে। আই অবজেক্ট।
-আচ্ছা রাখ তোর পিউরিটান, ফেমিনিস্ট সব গন্ধমার্কা কথাবার্তা। তোরা কি কার্গিল যাচ্ছিস? ট্যুর প্ল্যানটা তুই জানিস তো? না সেসব তোর লিবার‍্যাল হাজব্যাণ্ডই জানে শুধু।
স্যারের এই হাল্কা বিদ্রূপটা দময়ন্তী গায়ে মাখে নি। সত্যি বলতে ও জানেই না কার্গিল ওরা যাচ্ছে কি না? সবটাই শান্তনুর ঠিক করা। দময়ন্তী নানা কাজে সময়ও পাইনি এই নিয়ে ডিটেলে আলোচনা করার। যা আলোচনা একেবারে প্লেনে উঠেই করবে ভেবে রেখেছে। অথবা এয়ারপোর্টের পথে।
দময়ন্তীকে চুপ করে থাকতে দেখে ব্যাপারটা টের পায় সুদীপ্তস্যার। আসলে সেই ছোটোবেলা থেকে চেনেন তাঁর ছাত্রীটিকে। সবটা বলে দেওয়ারও প্রয়োজন হয় না।
-কার্গিল থেকে আরও ১০ কিমি ওপরে একটা গ্রাম আছে। সীমান্তগ্রাম। হুন্দারমেন। পারলে যাস। স্টোরি করতে পারবি।
-একটু হিন্টস দিন না স্যার?
-নাহ! নিজে রিসার্চ কর। হিন্টস যা দিয়েছি যথেষ্ট। এতবড় সাংবাদিক বা গল্পকার হয়ে যাস নি তুই যে রিসার্চ টিম লাগবে!
দময়ন্তী জানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আর কিচ্ছু বলবেন না স্যার।
  


 দময়ন্তীর ফোনের রিংটোনে কৃষ্ণস্তোত্র স্যারই সেট করেছিলেন। আর গানটাও তাঁর নিজেরই গাওয়া। তাই ফোন বাজতেই- দেহিপদম দেহিপদম।
-ম্যাডামজি আভি আপ ঠিক হো? ম্যায় গাড়ি লেকর আ রাহ্যা হুঁ। আগর ঠিক হো তো হোটেল পে চলতে। আজ রেস্ট লেকর কাল প্যাংগং যায়েঙ্গে?
-ওকে হাসান ভাই প্লিজ আইয়ে।
হোটেলে যেতে হবে রেস্ট নিতে হবে সকলকে। বিশেষ করে পপাইকে। নবছরের পপাই এই গোটা জার্ণিতে একবারও কোনও আবদার করেনি। একবারও বলেনি, মা, টায়ার্ড লাগছে বা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।দময়ন্তী মনে মনে স্বস্তি বোধ করে।
হোটেলের বিছানায় গা এলিয়ে দময়ন্তী টের পায় খুব খিদে পেয়েছে ওর। এই কদিনধরে শুধু ম্যাগি খেয়ে খেয়ে বিস্বাদ লাগছে। অবশ্য শাইলু নদীর একধারে ছোট্ট একটা আর্মি ক্যান্টিনে চিলিফ্লেভারের একরম নুডলস আর কফি খেয়ে খুব ভাল লেগেছিল ওদের সবারই।
দময়ন্তী হাসানভাইকে ঘরে ডাকে।
-নমস্তে ম্যাডাম। অব ক্যায়সে হো?
একরাশ উজ্জ্বল হাসি উপহার দিয়ে হাসান ভাই কথা বলে। মিষ্টি স্বভাবের এই মানুষটির সঙ্গে কথা বলে দময়ন্তীর শরীরটাও বেশ চনমনে হয়ে ওঠে। শান্তনুর মতো চুপচাপ মানুষও হাসান ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দেয়। কফি পকোড়া সহযোগে আড্ডা চলে। ডিনারে ওরা ভাত খাবে জানিয়ে দেয় হোটেলের ছেলেটিকে। ভাত আর আণ্ডাকারি।
-হাসান ভাই হুন্দারমেন কার্গিলসে কিতনা দূর হ্যায়? হামহে উধর জানা হ্যায়।
শান্তনু একটু বিরক্ত হয়। প্যাংগং থেকে কার্গিল জাসকর যাওয়ার পরিকল্পনা। তুমি আবার কোন গ্রামে যাবে বলছ?
-না না একটু দরকার আছে গো। গেলে ভাল হতো। একটু প্রোগ্রামটা ওভাবেই সেট করি?
-আশ্চর্য! বেড়াতে এসেও তোমার কাজ! আমি আগেই বলেছিলাম, লাদাখ ট্রিপ আমার ফোটোগ্রাফিক এক্সপিডিশন। এখন হুন্দারমেনটেন যেতে পারব না। এমনিতেই তোমার শরীর খারাপে দুদিন নষ্ট হয়েছে।
এবার শান্তনুর কথায় দময়ন্তী আহত হয়। তবে আহত হওয়ার মতো খুব একটা নরম সরম ও নয়। তাই আহত হতে গিয়ে ও বরং রেগে যায়।
-কী যে বলো? নষ্ট হওয়া কাকে বলে? বোঝো তুমি? কোথাও কি একমুহুর্ত দাঁড়িয়েছ তুমি আমার জন্য। খারদুংলা পাসে আমার ওরকম শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তুমি তো গরম খাবার খেতে আর ছবি তুলতেই ব্যস্ত ছিলে। পপাই শুধু মা মা করছিল। আর এই হাসানভাই ছিলেন বলে।
দময়ন্তীর কথা শেষ না করতে দিয়েই শান্তনু প্রায় চিৎকার করে বলে ওঠে,
-সারাবছর অত্যন্ত পরিশ্রম করে কোনোমতে ছুটি বাঁচিয়ে এতদিনবাদে বেড়াতে এসেছি। তা ছবি তুলবো না? তুমি এডযাস্ট করতে পারছ না বলে কি আমি আমার বেড়ানোটা নষ্ট করবো?
হাসানভাই বোধহয় গল্পের মাঝে স্বামীস্ত্রীর ঝগড়ায় একটু অস্বস্তিবোধ করছিলেন। হাসানভাই বললেন, আরে আপলোক বেফিকর রহ্যে। পহেলে প্যাংগং  আচ্ছে সে দেখকে কার্গিল, হুন্দারমেন, জাসকর সব যায়েঙ্গে। আওর সাহব একবার আপ হুন্দারমেন চলিয়ে তো আপ লাদাখকে গাঁও দেখেঙ্গে। এ ভি গাঁও হ্যায়। লেকিন ইধার ট্যুরিস্ট বহুত আতা হ্যায়। উধার লেকিন লাদাখ কাশ্মীর কি হি লোগ র‍্যাহতে হ্যায়। আপকো জরুর আচ্ছে লাগেঙ্গে।
এরপর আর শান্তনু কিচ্ছু বলে না। রাতের খাওয়াটা দময়ন্তী ভাল করে খেতে পারে না। শান্তনুর এই একগুঁয়ে স্বভাব আর অদ্ভুত এক আত্মমগ্নতা ওর স্বার্থপরতাই মনে হয় মাঝেমাঝে। আবার অন্যভাবে ও নিজেও তো ওর কাজ নিয়ে ভাবনা নিয়ে বড় বেশি একমুখী। তাই ওভাবে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। একটা কথা খুব মনে হয় আজকাল। সম্পর্ক বা বন্ধন মানেই একটা চুক্তি। আর সেই চুক্তি মেনে চলতে চলতে ক্রমে একা হয়ে যাওয়া।

সামনে নীল জলরাশি আর পরিষ্কার আকাশে অসংখ্য তারা দেখতে দেখতে ও কিছুটা আত্মমগ্নই ছিল। পপাই আর শান্তনু একটা ছোটো টেলিস্কোপ দিয়ে ধ্রুবতারা লোকেট করছে। ঐ তো অত্রি, পুলহ, পুলস্ত্য, অঙ্গিরা। বাবা আর ছেলে মিলে কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে কিছুক্ষণ ধরে।
-পপাই-এর এবার ঘুম পেয়েছে। হাই তুলছে।
শান্তনুর কথায় চমক ভাঙে। দময়ন্তী পপাইকে নিয়ে তাঁবুর ভেতর চলে যায়। বিছানায় শোওয়ামাত্রই ঘুমে ঢলে পড়ে পপাই।
-ম্যাডাম, আপকে লিয়ে কাওয়া টি। অন্দর আয়ে?
-হ্যাঁ। শিওর।
প্যাংগং-এ ওদের হোস্ট বৃদ্ধ আংকেল তাশি চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকলেন তাঁবুর ভেতর। দময়ন্তীর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল আংকেলের সাথে। চায়ের কাপটা তাশি নামিয়ে রাখলে দময়ন্তী জিজ্ঞেস করে, ‘কাওয়া টি সে সর্দি কম হো যাতা?’
-হ্যাঁ, ম্যাডাম। বিলকুল কম হয়ে যাবে।
-আরে আপনি বাংলা জানেন?
-হ্যাঁ, এত বাঙালি ট্যুরিস্ট আসে। জানি তাই। কুছকুছ। হিন্দি ভি। আমার ভাষা অবশ্য লাদাখি।
-আমাকে কয়েকটা লাদাখি ভাষা শিখিয়ে দেবেন?
-জি।
-লাদাখি ভাষায় পাহাড়কে কী বলে?
-রি।  
-লাদাখি ভাষায় রি মানে পাহাড়।
-জি।
-আচ্ছা ডিনার একটু তাড়াতাড়ি লাগবে। ছেলে ঘুমিয়ে পড়ছে প্রায়।
-জি। আভি হো যায়গা।
-কী আছে ডিনারে?
-দেশি মুরগা আছে। রোটি আর চিকেন কারি?
-ঠিক আছে।
বৃদ্ধ আংকেলের নাম সোনম তাশি। দময়ন্তীর জানার ইচ্ছে ছিল আরও কিছু। তাশি কী বৌদ্ধ? হাসান ভাই বলেছিল লাদাখি। তিব্বতী আর লাদাখি ভাষায় বেশ মিল। থিক সে মোনাস্ট্রি র থিক মানে এক লাদাখি ভাষায়। হয়ত কখনও এই একটাই মোনাস্ট্রি ছিল এখানে।
রাতে খেতে খেতে তাশির সাথে গল্প হল আরও। হুন্দারমেন ব্রোলমো- এই দুটো গ্রামকে ওরা বরবাদি গ্রাম বলে।
-কার্গিল ওয়্যারকে বাদ তো ইয়ে দো গাঁওকে জিন্দেগিহি চলি গ্যায়ি।
রুটি বেলতে বেলতে তাশি কথাগুলো বলল। একটা চুলায় রুটি সেঁকতে সেঁকতে কাঠের স্প্যাচুলা দিয়ে পাশের চুলায় মাংসের হাঁড়িতে একটু নাড়া দিয়ে তাশির বউ কমলা আন্টি দময়ন্তীকে বলল, ম্যাডাম, আপ কাল হুন্দারমেন যা রহ্যে হোঁ। হামরা সহেলি জাঈনা উধারই যায়েগি। উসে ভি গাড়ি মে লে লোগে?
এস ইউ ভি তে আরও একজন যেতে পারবে কি না এটা হাসান ভাই বলতে পারবে। মুম্বাইতে বৃষ্টি পড়লে একটা ট্যাক্সিতে দশ-বারোজনও একসাথে বাড়ি ফেরে। তারপরও পথে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের সহযাত্রীরা বলেন, আইয়ে হো যায়গা।
দময়ন্তী মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
-জাঈনা বাঈ আপকে সহেলি হ্যায়? হুন্দারমেন গাঁও সে ইধার আপসে মিলনে আয়ে হ্যায়?
প্রশ্নটা কমলা আন্টিকেই করে দময়ন্তী।
-জি। মেরে সে মিলকর যাতি হ্যায়। লেকিন ও তো আপনে বেটে সে মিলনে আয়ি হ্যায়।
-ম্যাডাম, জাঈনার ছেলে নুব্রাতে সিয়াচেন বেসক্যাম্পে পোর্টারের কাজ করে। ও ছেলের সাথে দেখা করতে আসে। আউর হাম সে ভি মিল কর যাতে হ্যায়।
তাশির কথায় দময়ন্তীর প্রশ্ন জাগল। ছেলে কি মার কাছে যায় না? মাকে আসতে হয়? তাশি বোধহয় বুঝতে পারল দময়ন্তীর কথাগুলো।
-জাঈনার জীবনে এমনকিছু ঘটনা ঘটেছে যে ও একটু অন্যরকম। এমনি খুব চুপচাপ। তবে খুশদিল। কিন্তু দুমাস ছেলে বাড়ি না গেলেই ও অস্থির হয়ে যায়। নিজেই চলে আসে। আর ছেলেও তো বেসক্যাম্প শেষ হলে লে-তে চলে যায়। সেখানেও আর্মি ক্যাম্পে কাজ থাকে। এত হুট বলতে বাড়ি যেতে পারে না। আবার ছুটি পেলে তো যায়ই। ওসব কোনো প্রবলেম নয়। লেকিন প্রবলেম আছে ম্যাডামজি।
দময়ন্তীর জানতে ইচ্ছে করছে জাঈনার কথা। এখনও অবশ্য দেখাই হয়নি তার সাথে। তবুও আগ্রহ হল। তাশি যেন ইচ্ছে করেই একটা গল্প শোনার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল। খাওয়ার খুব তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়ে যায় এখানে। তাই দময়ন্তী চাইছিল পপাই গরম খাবারটা খেয়ে নিক আগে। গল্প শোনার দারুণ লোভও হচ্ছে।
-আন্টি চিকেন হো গিয়া?
-হ্যাঁ। আভি সার্ভ করতে হ্যায়।
-ঠিক হ্যায়। বেটা কো বুলাকে লাতি হুঁ।
পপাই আর শান্তনুকে নিয়ে ওরা খেতে বসেছে। খাওয়ার সার্ভ করতে যে লাদাখি মহিলা এলেন দময়ন্তী বুঝতে পারল, ইনি নিশ্চয়ই জাঈনা। তাশিও এসেছে সঙ্গে। কী যেন বলল। লাদাখি ভাষায়।
দময়ন্তীর আগ্রহ যেন তাশি পড়তে পারে।
-ম্যাডাম, কাল সফর হ্যায়। জাঈনাকে বললাম, এটুকু আমি আর কমলাই করে নিতে পারবতুমি রেস্ট নাও। তা ও শুনবে না। আমরা তো রোজই করি এই কাজ। এখন ট্যুরিস্ট সিজন না বলে ভিড় নেই। নাহলে তো ফুরসৎই মিলত না। রুম ভি ইধার মিলনা মুশকিল হ্যায়। আভি তো রুম হ্যায়। লেকিন আপলোগ টেন্ট পসন্দ করতে হো।
-হ্যাঁ, আংকেল হামরা বেটা কো ফার্স্ট চয়েস টেন্ট।
গরম মাংসের টুকরোয় একটা কামড় দিয়ে বেশ পরিতৃপ্তির সাথেই শান্তনু কথাগুলো বলল।
দময়ন্তীর জাঈনার কথা জানতে ইচ্ছে করছে। রান্না করতে করতে কী একটা যেন অর্ধেক বলল তাশি আংকেল। কিসের প্রবলেম? দেখে তো আংকেলের সমবয়স্কই মনে হচ্ছে। গল্পটা কী?
-আংকেল কাল জাঈনা আন্টি হামারে সাথ যায়েঙ্গে। কিধার হ্যায় উনকা ঘর?
-ইয়েস ম্যাডাম। কাইণ্ডলি, ডু দ্যা ফেভার।
-আপ তো সব ল্যাংগোয়েজ জানতে হো। হিন্দি, বাংলা, ইংলিশ আউর আপকা লাদাখি তো হ্যায়হি।
-ম্যাডাম, আপ ভি তো বাঙালি হো কে কিতনা ফ্লুয়েন্ট হিন্দি বোলতে হো।
ওরা যেখানে খেতে বসেছে সেটাও একটা টেন্ট। বেশ একটা হাসি আর ফুরফুরেভাব খেলা করে গেল টেন্টের ভেতর। বেশ কয়েকবার রুটি সার্ভ করতে এল জাঈনা। কমলা আন্টি বোধহয় কিচেনেই রয়েছে। ডাইনিং স্পেসে আর আসেনি একবারও।
খাওয়া শেষ হলে তাশিকে দুটো গরম জলের বোতল দিতে বলে নিজেদের টেন্টে চলে গেল ওরা। পপাই বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। প্যাংগং-এ আকাশটা বড় বেশি নীল। লেকের জলও বোধহয় এই কারণেই ঘননীল। তাঁবুর ভেতরটা বড় আরামের। বাইরে বেরোলে এখনও দময়ন্তীর শ্বাসকষ্ট। তবুও বাইরেটা যেন টানছে ওকে। হাসানভাই বলে গেছে রাত্রে এখানে পাহাড়ি কুকুর ছাড়া থাকে। তাই না বেরোনোই ভাল। বেরোলে হাতে স্টিক থাকে যেন।
-ম্যাডাম, গরম পানি।
-হ্যাঁ। আসুন আংকেল।
দময়ন্তী ভেবেছিল সারাদিনের কাজ সেরে ক্লান্ত তাশি জলের বোতলগুলো দিয়েই চলে যাবে। কিন্তু তাশি গল্পের মেজাজে। পাহাড়ি মানুষেরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে। ক্লান্তি সহজে ওদের বশ করতে পারে না।
-ম্যাডাম আপকো জাঈনার স্টোরি বলছিলাম না? লেকিন জাঈনার কোয়ি আলগ স্টোরি নেই। এ স্টোরি তো হামাদের দেশের পলিটিক্সের স্টোরি আছে।
দেশ, পলিটিক্স- শব্দগুলো শুনে দময়ন্তীর মনে প্রশ্ন জাগল কাশ্মীরের মতো এখানেও কি কোনো ক্ষোভ অভিমান রয়েছে মানুষের মনে? অথচ লাদাখ তো খুব শান্ত, নিরীহ। তাশির পরের কথায় অবশ্য ভুল ভাঙল ওর।
-কার্গিল ওয়্যারের আগে ব্রোলমো আর হুন্দারমেনের মধ্যে কোনো কাঁটাতার ছিল না। সিল্করুট জানেন তো ম্যাডাম?
-হ্যাঁ, সিল্করুট তো হিস্টোরিক্যালি সিগনিফিকেন্ট।
শান্তনুও মন দিয়ে গল্প শুনছে।
-স্কার্দু, ব্রোলমো, হুন্দারমেন-সব কাছাকাছি ভিলেজ। এগুলো পাকিস্তান কাশ্মীরের পার্ট ছিল। ওয়্যারের পর হুন্দারমেন ইণ্ডিয়ার দখলে চলে আসে। খুব ভালই হয়। কিন্তু এই ইতনাদিন ধরে যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই তিনগ্রামে থাকত, সে মানুষরা হঠাৎ সব পরদেশী হয়ে পড়ে। জাঈনার মা ও সব আপনজনরাই থাকত ব্রোলমোতে। হুন্দারমেনে কেবল ওর শ্বশুরাল ছিল। ওয়্যারের সময় তো আলাদা ক্যাম্পে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গাঁওয়ের লোকেদের। ওয়্যার শেষে ফিরে এসে জাঈনা জানতে পারে ব্রোলমো যেতে গেলে বহুত খরচ।
-আচ্ছা, আগে কি তাহলে সড়কপথেই যেতে ওরা?
-হ্যাঁ, স্যার। মোস্টলি।
-জাঈনার মা তখন খুব অসুস্থ। ওদের অবস্থাও খুব বেশি ভাল নয়। তবুও পঁচাশ হাজার টাকা যোগাড় করে বহুত কষ্ট করে পারমিট নিয়ে ওয়াগা বর্ডার দিয়ে গিয়েছিল ও। মায়ের সেবা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারমিটের মেয়াদ বেশিদিনের ছিল না। হাতেপায়ে ধরে তো আর মেয়াদ বাড়ানো যায় না। আর বর্ডারের সববিষয়ই ন্যাশনাল সিকিউরিটির আণ্ডারে। জাঈনার এপ্লিকেশন খারিজ হয়। এরকম এপ্লিকেশন অনেক লোক বুঢ়া উদ্দেশ্যেও দেয়।
-তার মানে টেররিস্টরাও দেয়?
-হ্যাঁ, এভাবেই থাকার মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়। কিন্তু আম-আদমি আর টেররিস্ট আলাদা হওয়ারই বা উপায় কী? জাঈনার এপ্লিকেশন যে সচ্চা ছিল তা বোঝার মতো কি আইন আছে বাবুজি?
একটা দীর্ঘশ্বাস যেন ওদের তিনজনেরই একসাথে পড়ে। জাঈনা হুন্দারে ফিরে এসেই খবর পেল যেদিন ও চলে গেল, সেদিনই রাত্রে ওর মা মারা গেছে। নিজের আম্মির ইন্তেকালের সময় থাকতে পারল না। আর একদিন বেশি মায়ের কাছে থাকার মেয়াদ ওর হল না। খুবই আঘাত পেয়েছিল ও। তারপর থেকেই কেমন যেন অস্থির থাকে। গাঁওতে বেশীদিন মন টেকে না। ছেলের কাছে আমাদের কাছে চলে আসে মাঝেমাঝে। বলে, কব ফির সরকার বোলেগা ইয়ে তুমহারা মুলুক নেহি হ্যায়। কব ফির বিছর যায়েঙ্গে? খুদাই জানে।
-রাত বহুত হুয়া ম্যাডামজি। কাল ফির সফর। আপলোক রেস্ট লিজিয়ে। গুডনাইট।
সেদিন ঘুমের মধ্যে দময়ন্তী কয়েকটা টুকরো ছবি দেখলো। যেগুলো আসলে সেই কবেকার ফেলে আসা স্পর্শাতীত শূন্যতা। অথচ ছবিটা যেন জাঈনাবাঈয়ের গল্পেই ডুব দিয়ে উঠে এল এইমাত্র।
আকাশে একটা ধুলোয় ঢাকা চাঁদ। লোডশেডিং-এর কারণে জানলা দিয়ে গলে আসা আলোটুকু বোঝা যাচ্ছে। হ্যারিকেনের আলোয় পড়ার বইয়ের ফাঁকে ঝিমুনি এসে যাচ্ছে ওদের দুবোনের। তারই মাঝে সুর করে রামায়ণ পড়ছে ওদের ঠাকুমা। শেষ হলে গুরুদেবের অষ্টোত্তর শতনাম। ঝিমুনি কেটে গিয়ে ইতিহাস ভূগোলের বইয়ের থেকে মন সরিয়ে কানখাড়া করে সে সুর যেন ভরে নিচ্ছে দুজনেই। হয়ত পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার বয়সে এই সুরগুলোই অজুহাত। আর সেই সুরে মিশে রয়েছে অনেককিছু। ইতিহাস, স্মৃতি, ক্ষত, হারিয়ে যাওয়া আত্মগৌরবের জন্য বিলাপ ও কিছু বেদনা। সেইসব কি বুঝতে পারছে বালিকাযুগল?
জিলা বরিশালে আছে বাখরগঞ্জ থানা।
তার অন্তর্গত রাজাপুর গ্রামখানা।।
এই অব্ধি পড়ে থেমে গেল ঠাকুমা। ঠাকুমার তোবাড়ানো গালে হাসি ফুটে উঠল। কুঁচকানো চোখ দুটো বইয়ের মধ্যে থাকলেও ঠাকুমা ঠিক বুঝতে পারল। ওরা দুবোন হা করে তাকিয়ে আছি তারই দিকে। এবার বুড়ি শুরু করল গল্প। আমাগো বরিশাল কী সুন্দর দ্যাশ আছিল। যে দিকে তাকাই শুধু নদী আর নদী। খাল, বিল, বাওড় আর সবুজ চারিদিক।
চাঁদের বুড়ি গল্প বলার ফাঁকে একঢোক জল খেয়ে নিল। বোধহয় নদীর কথা মনে পড়ায় তৃষ্ণা জেগে উঠল।
-নদীগুলোর নাম শুনবি? ভারী সুন্দর নাম। মধুমতী, পানগুছি, সুগন্ধা, সন্ধ্যা, ধানসিঁড়ি, কালিজিরা, কীর্তনখোলা, কালাবদর আর পায়রা নদী। কীর্তনখোলা তো আমাগো বাখরগঞ্জ দিয়া যাইত। পায়রা নদীতে বুঝি এসে মিশত।
নদীর কথা থেকে মাটির দোতলা বাড়ির কথায় চলে আসল ঠাকুমা। ...
-সে মাটির বাড়ি কী শীতল! সারাদিন একটা শিরশিরভাব থাকত।
দময়ন্তীর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের মধ্যে পপাই লেপ ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এটা ওর স্বভাব। ছেলেকে ভাল করে লেপে মুড়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করল ও। ইশ! সেই চাঁদের বুড়ির গল্পগুলো যদি আবার শুনতে পারত? না, আর কোনো স্বপ্ন দেখেনি সে রাতে ও। ঠাকুমাকে আদর করে চাঁদের বুড়িই ডাকত ওরা দুবোন। চরকা টরকা বইয়ের পাতায় পড়েছে ওরা। চাঁদের বুড়ির গল্প- বিষয়টায় একটা রূপকথা মিশে আছে যেন। ঠাকুমার বরিশালের স্মৃতিগুলো তো রূপকথার গল্পই। আর এইসব মনে করতে করতেই উত্তর কলকাতার দুকামড়ার ভাড়া বাড়িতে কীভাবে যেন বাকিজীবনটুকু কেটে গেল বুড়ির। বরিশালে আরো একবার যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল ঠাকুমার। কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে নি।

পরদিন গাড়িতে জাঈনাকেও তুলে নিয়ে ওরা হুন্দারমেনের পথে রওনা হল। হুন্দারমেন গোটা লাদাখের তুলনায় সবুজ। একট গেস্টহাউসের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালে জাঈনা ওদের থেকে বিদায় চায়। যাওয়ার আগে অবশ্য ওর বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণও জানিয়ে যায়।
দুপুরে গেস্টহাউসে রেস্ট নিয়ে ওরা হুন্দারমেন ঘুরতে বেরোয়। জাঈনার বাড়িতে গেলে দেখে বাড়ির সামনেই একটা বাচ্চা ছেলের সাথে কোথাও যাচ্ছে ও। ওদের দেখে খুব খুশি হয় বৃদ্ধা।
-আইয়ে।
-কাঁহা যা রহ্যেথে আপ? কাম পে?
-হাঁ। নদীকে পাশ। সূর্যাস্ত কে সময়ে হাম যাতে হ্যায়।
এখানে দিয়ে শিঙ্গ নদী বয়ে যায়। দময়ন্তীরাও জাঈনার সাথে শিঙ্গ নদী দেখতে যেতে চাইল। সূর্যাস্তের পরেই নাহয় জাঈনার বাড়িতে জমিয়ে বসবে ওরা।
মাটি-পাথরের পাহাড়ের আড়ালে সূর্যটা একটু একটু করে আড়াল হচ্ছে। দূরের বরফ চূড়ার ওপার থেকে তেরছাভাবে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। শিঙ্গ নদীর উত্তাল শব্দের মধ্যে দিয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে-“লা ইলাহ ইলাল্লাহ/মহম্মদুর রসুলুল্লা...।”
জাইনাবাঈ আর তাঁর দশবছরের নাতি  তাড়াতাড়ি মাটিতে বসে পড়ল। সূযার্স্তের হলুদ আলোর বিষণ্নতা লেগে আছে অশীতপর এই বৃদ্ধার গালে। নামাজ পাঠ শেষ হলে জাঈনা বলল, হয়ত নিজেকেই, “ইয়া আল্লা, আপকে দুনিয়ামে ইয়ে নদীও কা কোঈ বর্ডার নেহি হ্যায়। লেকিন হাম ইনসানোকে বিচ বহত দূরিয়া হ্যায়।”