গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

৬ষ্ঠ বর্ষ ৯ম সংখ্যা ।। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭

এই সংখ্যায় ৯টি গল্প । লিখেছেন - সুবীর কুমার রায়, উত্তম বিশ্বাস, বিবি বসু, পার্থ রায় শীলা পাল, সোনালি ভট্টাচার্য মুখার্জী, সুমনা পাল ভট্টাচার্য ও পাপড়ি গুনিয়োগী । 

            সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করে পড়ুন ।

সুবীর কুমার রায়

নাম মাহাত্ম্য

জ্যোতিষ শাস্ত্র বা জ্যোতিষী, তাবিজ, কবচ, মাদুলি, ইত্যাদির ওপর আমার কোনকালে বিশ্বাস বা আস্থা না থাকলেও, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বছর তিনেক আগে সেই জ্যোতিষ ও তন্ত্র সম্রাট, গভর্নমেন্ট রেজিষ্টার্ড, শ্রী শ্রী আচার্য্য লোকনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের কাছে তাঁর আশ্রমে যেতেই হয়েছিল।

বাল্য বন্ধু ফাল্গুনী খুব অসুস্থ। পেটের তীব্র যন্ত্রণায় সে মরণাপন্ন। ডাক্তাররাও একপ্রকার হাল ছেড়ে দেওয়ায় ওর স্ত্রী নন্দিনী একবারে ভেঙ্গে পড়ে আমাকে শেষ চেষ্টা হিসাবে শাস্ত্রী মহাশয়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য মিনতি জানায়। তার বিশ্বাস, কিছু করতে পারলে একমাত্র তিনিই করতে পারবেন। হাতের রেখা দেখারও তাঁর প্রয়োজন হয় না, তিনি নাকি জন্মের স্থান, সময়, ও হাতের লেখা দেখেই সব বলে দিতে পারেন ও জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, ব্যর্থ প্রেম, বিবাহে বাধা, দাম্পত্য কলহ, শত্রু দমন, ইত্যাদি সব সমস্যার সমাধান ও মনোস্কামনা পূর্ণের জন্য অব্যর্থ। এই অবস্থায় আমার বিশ্বাস অবিশ্বাস মূল্যহীন। তার মানসিক শান্তির জন্য ও মৃতপ্রায় স্বামীর পুনঃজীবনের জন্য আর এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে শাস্ত্রী মহাশয়ের কাছে যেতেই হ’ল। তাঁর পারিশ্রমিক ডাক্তারের পারিশ্রমিকের থেকেও অনেক বেশি। পারিশ্রমিকের পুরো টাকা জমা দিয়ে তাঁর কাছে বসলাম।

শাস্ত্রী মহাশয় হাতের লেখার নমুনাটি হাতে নিয়ে, নাম, জন্ম তারিখ, জন্ম সময় ও সমস্যাটা ঠিক কি জানতে চাইলেন। তাঁকে জানালাম আমার বন্ধুটির নাম ফাল্গুনী, সে বড় অসুস্থ, তীব্র পেটের  যন্ত্রণায় সে কাহিল, ডাক্তার একপ্রকার জবাব দিয়ে দিয়েছেন। এখন আপনিই শেষ ভরসা।

অনেকক্ষন ধরে হাতের লেখার নমুনাটি বিভিন্ন ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তিনি চোখ বুজলেন। কিছুক্ষণ পরে জলদ গম্ভীর গলায় তিনি জানালেন বন্ধুটির জরায়ুতে গভীর সমস্যা দেখা দিয়েছে, এই রোগ সারানো ডাক্তারের কর্ম নয়, কারণ এই রোগ কোন ওষুধ বা অস্ত্রোপচারে সারানো সম্ভব নয়। একমাত্র মা কালীর মন্ত্রপুত বিশালাক্ষী কবজ ধারণই এই রোগমুক্তির উপায়। দাম বারোশ’ টাকা, সামনের বুধবার পাওয়া যাবে।

বুঝলাম ফাল্গুনী নামটাই জরায়ু বিভ্রাটের কারণ, তাই আজ সঙ্গে অত টাকা নিয়ে আসি নি, পরের দিন দিয়ে যাব বলে সঙ্গের বন্ধুটিকে নিয়ে কোনমতে ফিরে আসলাম। নিয়মিত চিকিৎসায়, বন্ধুটিও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে আগের জীবন ফিরে পেল।

আজ একটি সাহিত্য সভা থেকে একই গাড়িতে নকুলেশ্বর বাবুর সাথে ফেরার পথে এতদিন পরে লোকনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের কথা মনে পড়লো। নকুলেশ্বর বাবুকে সবাই এক কথায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসাবে চেনেন। আজকের মতো প্রায়ই তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। তাঁর বাড়িতে গিয়ে বই-এ ঠাসা কাচের আলমারিগুলো দেখে মুগ্ধ হয়েছি। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা  প্রসঙ্গে কথা সাহিত্যিক অনিলা দেবীর প্রসঙ্গ এসে পড়ায়, তিনি তাঁর সেই গম্ভীর গলায় জানালেন অনিলা দেবী অত্যন্ত বলিষ্ঠ লেখিকা। তাঁর লেখা অনেক বই তিনি পড়েছেন, খুঁজলে বাড়ির আলমারিতে এই বিখ্যাত লেখিকাটির কিছু বই এখনও খুঁজে পাওয়া যাবে।



উত্তম বিশ্বাস

 বাস্তুসাপ
                       

আচমকা কার্বলিকের গন্ধে পাড়ার সর্পভীরু মানুষগুলো উঁইপোকার মত কিলবিল করে বেরিয়ে পড়েছে! নৃপেন মুদির গুদামঘরের সামনে এই মুহূর্তে সুচ রাখারও সুজোগ নেই। মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দুএকজন ধর্মপ্রাণ দেশভক্তও থাকেন ,--‘যাক এতদিনে দেশটার শনির দশা কাটল তাহলে! এত উপদ্রব আর নেওয়া যাচ্ছিল না! মানুষগুলো এমনভাবে উদ্বেগ নিয়ে ঝুঁকে আছে, যেন একটা ক্ষুদে পিঁপড়ের ঘাড়ে আর একটা  ডেও। শাপমোচনের স্বপ্নে এখন বিভোর গোটা দেশ; সেক্ষেত্রে নৃপেন মুদির দুঃসাহসে মনসারও চোখ কপালে ওঠার অবস্থা! –‘সাপ কি বেরোল জেঠু?’ শ্রমিক ইউনিয়নের বরখাস্ত নেতা কাশেম; তার বস্তাপচা ধ্যানধারণায় নৃপেনের তিরিক্ষি জবাব,--‘ একটু ধৈর্য ধর বাপু! সবে তো লেজ ধরে টানটা মেরেছি। খেলিয়ে খেলিয়ে বার করতে হবে যে! বাস্তুসাপ বলে কথা। এক টানে এমন একটা জন্তু বার করা কী চাট্টিখানি কথা!  উৎসাহ আর উদ্দীপনার কোপে দেশবাসীর চোখের ঘুম চটকে পিচুটি হবার উপক্রম।
--এতটা বাহাদুরি দ্যাখান ঠিক না নৃপেন। তুমি তো বাপু সামান্য একজন মুদি; এখন যদি গায়ের জোরে ওঝার বিদ্যেও ফলাতি যাও---! এসব কাজে তিন-মাথার বুদ্ধি নিতে হয়। আমাদের কালে ফাঁসজাল পেতে হ্যেইয়া হ্যেইয়া সব হেতের মেরেছি! 

--
তুমি সর তো বাপু। তোমরা অনেক ঘাস উপড়িয়েছ। অত গাল বাজিও না। দ্যাখলাম তো তুমাদের মুরোদ! দুধকলা খাইয়ে যত দেশের কালকেউটে গুলোকে মোটা করেছো; আর এখন একটা হেলে ধরতে বললেও তোমরা সুইচ বোর্ডের গল্প শোনাও!মেনকা খুড়ির মুখের ওপর আর রা কাড়ে না মনোহর সিং। উইপোকার পাখনা এখন বাবুদের পায়ে পায়ে প্রসাদ।-- সাপটা বেরবে তো? ল্যাজটা জোরসে টেনে ধরে থাক জেঠু; আমরা আছি তোমার সাথে!কৌতুহল ফেনিয়ে ফেনিয়ে অ্যালকোহল হয়ে ওঠে,---‘কি সাপ রে? শাখামুটে; নাকি শঙ্খচূড়?-- ওফ! পুরনো কংক্রিটের নীচে এত সরু গর্ত -----পাতাল পুলিশের বাপেরও সাধ্যি নেই ওকে বাগে আনা!’ 

হঠাত হঠাত জোনাকির মত ঝিকমিক করে ওঠে হাজার জোড়া চোখ,---‘ হ্যাঁ! হ্যাঁ! বেবুচ্ছে! বেরুচ্ছে! টান! টান! ওফ শেট! মাথাটা আটকে গেল!হুড়োহুড়ির কোপে হাঁড়ির মুখ আরও সরু হয়ে আসে,--‘ টর্চটা জ্বাল না রে! উঁহু খোঁচা দাও কোন দুঃখে!ল্যাজের আগায় শোনা যায় বিষ নেই; কানে কানে ছড়িয়ে পড়ে উৎকণ্ঠা মাখানো উপকথা।--ওই বুঝি গ্যাকগোক করে ডাকল! ইয়েস! এইজন্যই মাথার দিকটায় এতটা প্রবলেম। নিশ্চই ঘেপো এক কোলাব্যাঙ গিলেছে!এইবার অনন্ত ধৈর্যের পরীক্ষা। বুদ্ধিমানেরা মাথা ঝাকালেন, ‘ব্যাঙটাই আসলে বিশাল একটা ম্যাটার! 

ধৈর্যশীলা তারারা জলটুঙির গায়ে ঝুলিয়ে রাখা লন্ঠনের মত টিমটিম করে জ্বলতে লাগলেন। নৃপেনের উঠোনে ঝুঁকে পড়েছে ঘুমে ঢুলুঢুলু গোটা দেশ। দেশিয়ালী সমস্ত শান্তি স্বৈস্তয়ন ও শবযাত্রার সকলপ্রকার অন্তিম উপকরণ সাথে নিয়ে প্রহর গুনতে থাকল প্রহেলিকা আচ্ছন্ন একটা জাতি। বাকলমোচনের ব্যথা আলাদা করে লেখেনা কেউ; শুধুমাত্র বাধ্য হয়ে খসাতে হয় বর্ষবলয়ের ভাজে শিথিল হয়ে আসা অবাঞ্ছিত কিছু বাসনা। বুদ্ধের দেশে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সহিষ্ণুতার দীক্ষা একপ্রকার এভাবেই নিয়ে থাকেন। হল্লা ও হরিধ্বনির ফাঁকে ফাঁকে, নৃপেন মুদির হয়ে বলতে থাকেন অনেকেই, ‘দ্যাখাই যাক না, কিছু তো একটা বেরোবে। মরতে তো একদিন হবেই; ষষ্ঠীচরণের মত নাহয় লাইনে দাঁড়িয়েই মরি। ভূভারতে এমন দুঃসাহস নৃপেনের আগে কেউ কোনকালে দ্যাখাতে পেরেছে?’ আশা আর হতাশা জাগিয়ে মাঝে মাঝে ধূধূ ভারতভূমির বুকের ওপর দিয়ে এখনও গরম দমকা হাওয়া হুশহুশ করে বয়ে যায়,--‘জীর্ণ বুকের হাপর ঠেলে উচ্চারিত হয় শাশ্বত সত্য,--‘আসলে আমাদের মরণটাই হল শেষ কথা! সুজোগ বুঝে কাশেম আবার সেই কাসুন্দিতেই কাঠি দিল,---’নৃপেনদা যে বললেন সাপটা তিনি বার করেই ছাড়বেন? তাহলে আমরা এই যে এতটা ত্যাগ স্বীকার করে উনার উঠোনে এসে হাঁটু ভাঙলাম, এখন তবে অকারণ অনিশ্চয়তা নিয়ে ক্যান বাঁচব? আমাদের ভবিষ্যতের গ্যারান্টি কী?’  

বয়ঃবৃদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানীরা দাড়ি চুলকে বললেন
, ‘এই রঙ্গ রয়ানীর শেষ দৃশ্য দেখে সারমর্ম যা বুঝলাম,’এখন ওই মাথামোটা ব্যাঙটার বাঁচা ও মরার ওপর নির্ভর করছে আমাদের সবার সম্ভাব্য সুদিনের ভূত ও ভবিষ্যত।

  


সোনালি ভট্টাচার্য মুখার্জী

সরোজিনী

বাপমায়ের আদরের প্রথম সন্তান সরোজ। দুর্গাষষ্টীর দিন জন্ম বলে বাবা ভারিপ য়মন্ত মানতেন তাকে। বাবা হঠাৎ কলকাতায় অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।দেশে ফিরে এসেছে সে মায়ের সংগে। সংগে ছোট দুইবোন। এখানে সাজগোজ রংহীন মাকে সাদা পাথরের মূর্তির মত লাগে। সরোজ বোনেদের নাওয়া খাওয়ায়। কলকাতার মেমসাহেব টিচারের কাছে শেখা লেখাপড়া মনে রাখার চেষ্টায় খাতাবই নাড়ে চাড়ে। একদিন পাশের শরিকের খুড়িমা দাওয়ার নিচে থেকে ডাক দিলেন এসে।
"হ্যাঁলা সরো, মায়ে কই ? সুখবরডি শুনসে ?

মা পুজোর আসনে মাথা ঠেকিয়ে মাথায় গায়ে আঁচল জড়িয়ে এসে বলেন,"কয়েন খুড়িমা। কিসের খবর” ?
ভারি দুল পরে পরে কানের লতিটি কাটা। তাই টানা দেওয়া ভারি কানপাশা খুড়িমার কানে। কাঁচাপাকা চুলে চওড়া সিঁদুর।  একগাল হেসে বললেন, "মেয়ের পাত্তর ঠিক হল বউ, এর চাইতে আর ভাল খবরকি? মাথার উপর তিনডি ভারি পাথর তোমার। একটার গতি হইলেও কিসু তো নিশ্চিন্দি।
কার পাত্র ?
দিশেহারা দেখায় হেমাংগিনীকে।
এইবার রসিয়ে বলেন খুড়ি
কত কাঠখড় পুড়িয়ে বাড়ির পুরুষরা এই বাপহারা সরোজের জন্য পাত্র ঠিক করে কথা দিয়ে এইয়েচেন। বংশের সকলে কি আতান্তরেই না পড়েছে তিন মেয়ে সমেত এই অনাথা বিধবাকেনিয়ে
পাত্রের নাম ধাম জিজ্ঞেস করেন হেমাংগিনী।
শুনে ঠান্ডা গলায় বলেন, "আমার মেয়ের বিয়ে আমি এখানে দেবনা,খুড়িমা আমার মত নেই।
ঘরে যেতে গিয়ে পিছনে কাংস্যনিন্দিত গলার চীৎকারে একটু থমকে গেলেন।
"আলো আবাগীর বেটি! কপালে আগুন পোড়া, অকালে সোয়ামীকে খেয়ে কলকেতা ফেরত হয়ে এইয়েচ, ঘরে দোরে ঢুকতে দিয়েছে মানুষ এই না কত? আবার বড়বড় কতা বলি,একটা পুতের মুখ দ্যাখনের ক্ষেমতা থাকলে তবু বুইজতাম প্যাটে ধরসো তিন তিনডি মাইয়ামানুষ। তোমার মত জানতে চায় কেডা?
আমি কি না ভালমুখে সুখবর দিতে আইলাম। ওমা!
লুড়া জ্বালি মুখে তোমার। যত বড় মুখ নয় তত বড় কতা পরিবারের পুরুষ মানুষেরা,সব গন্যিমান্যি মিলে পাত্রস্থ করে দিতাসে মাইয়া। গৌরীদানে কুলীনস্থ পাত্রে বংশের পুন্য কত! আরে মরণ...

দিনকাটে। রাতযায়। অবশেষে এল একটা সকাল।
বন্ধ কাঠের দরজার এপারে দাঁড়িয়ে হেমাংগিনী। নায়েব চিন্তাহরণ চৌধুরীর সদ্য বিধবা তিরিশ ছোঁয়া বউ। ওপারে চৌধুরী পরিবারের বাকি লোকজন।
বড় মেয়ে সরোজের না কি বিয়ের দিন আজ।
মেধাবিনী, অপরূপ সুন্দরী সরোজ।
ডুরে শাড়ির আঁচল খানা গায়ে জড়িয়ে স্থির হয়ে বসে আছে ঘরের মেজেতে।
অশ্রাব্য ভাষার চীৎকার শোনা যাচ্ছে ঘরের বাইরে থেকে। কর্কশ পুরুষ কন্ঠে গর্জন করছেন মেয়ের বড়কাকা। সংগে বহু কন্ঠের গুঞ্জন ভেসে আসছে ঝাঁপফেলা বেড়ার জানালার ফাঁক দিয়ে।
রাসভ নিন্দিত কন্ঠমৃত দাদার অপুত্রক বউয়ের অসহ্য স্পর্ধার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ছিল। এমন সৃষ্টিছাড়া সাহস পেল কোত্থেকে এই মেয়েছেলেটা ?
বাপের অবর্তমানে কাকারাই যেখানে অভিভাবক, সেখানে মেয়ের মাকে জানায়নি বলে বিয়ে ভেংগে যাবে?
আরে বাবা মেয়ের ভবিষ্যৎ কিসে ভাল হয় সেত গুরুজন এই কাকারাই বুঝবে। তুমি মেয়েমানুষ,বোঝই বা কি,আর করবাইবা কি?
পাত্র কি কম লোভনীয়? সাংঘাতিক কুলীন বংশের বংশধর! কাজেই বয়েস একটু বেশি, দোজবরে হবেই। আর গাঁজাটা আশটা নেশা সব পুরুষ মানুষেই করে।
পৌরুষের প্রবল আস্ফালন ভাসে।
"দাঁড়ারে নষ্ট মাইয়ামানুষ, ত্যাজ বাইর করি। হেই ক্কে আছস। ডাক পাইকদের। ভাংগ দরজা লাঠির বাড়ি দিয়া। চুলে ধইরা টাইন্যা আনুম মা বিটিরে। কথা ভংগ হইব না কিসুতেই।"
রে রে রে হাঁকার দেওয়া চৌধুরী বাড়ির বাগদী লেঠেলদের ভয়পায় সবাই। এলাকায় এদের জন্যেই বাঘে-গরুতে জল খায়।
ঘরের ভিতর বসে থাকা কিশোরী মূর্তিটি থরথর করে কেঁপে ওঠে।
"মা--

ধীর পায়ে উঠে গিয়ে জানালার বাঁশের ঝাঁপ খুলে তুলে দ্যান হেমাংগিনী বাইরের ভীড় তীব্র গুঞ্জন ছড়িয়ে স্তব্ধ হয়।
কালো কুচকুচে লেঠেলের দল ভাবে, " নায়েব মশয়ের পুজো করা দুগগিপিতিমে খান সাদা কাপড় পরি জলের তল থে উঠি আল নাহি?"
সেই থান পরা হাতে আলো ঝলসায়। পুকুরের বড় মাছ কাটার চকচকে লোহার আঁশবটির বাঁকানো ফলাখান ধরা আছে।
তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর থমথমে বাইরের বাতাসকে কেটে ঘোষনা করে,
"চেয়ে দ্যাখো, এইআঁশবটি। আর ভাল করে দেখে নাও এই যে মেয়ে।"
মায়ের হাতে বঁটি উঠে আসার পর সরোজ মূর্তির মত হাঁটু মুড়ে পায়ের কাছে এসে বসেছে
" ভাল করে শুনে নিন সকলে। যে মুহুর্তে লাঠির বাড়ি দরজায় পড়বে এক কোপে নেমে যাবে মেয়ের মাথা। আমি যে সকল পূজা-আচ্চায় বিরাট রুই-কাতল এক কোপে ফালা দিই বাড়ির সকল মানুষ জান।"
দা এর ফলায় আলো লেগে ঝকঝক করে ওঠে।
বাইরের নিস্তব্ধ ভীড় জানে অনায়াসে বিরাট ভোগের হাঁড়ি,জলের কলস একঝটকায় নামানো হাতের জোর কত।
আস্তে আস্তে ফিসফিস, গুজগুজ, চাঞ্চল্য দেখা দেয় ভিড়ের মধ্যে। বয়স্ক গলায় রবওঠে।
"হেই থামো থামো। খুনোখুনি হইলে দারোগা পুলিশ বাড়ির কুনডিরে বাদ দিবনা। চলচল। একটা নষ্ট মাইয়া মানুষের লাইগ্যা বাড়িসুদ্ধা হাজত হাতকড়া হইলে হয়না।"
হেরে যাওয়ার অপমানে গালির ঝড় তুলে দু হাতের ধাক্কায় ভীড় সরিয়ে চলে যান কর্তারা।
বেলা গড়িয়ে বিকেল।
বাড়ির অন্যদিকে শাঁখের আওয়াজে ধরমড় করে উঠে বসে সরোজ।
"মা!"
সিধা হয়ে বসেন হেমাংগিনীও দা খানার দিকে দৃষ্টি দ্যান।
পিছনের দরজায় মৃদু টোকার শব্দ।
"কে?"
"আমি মাঠাইন, মাঝি বউ উদিকে বিয়া বসল
"তোমার দ্যাওরের দ্যাড় বসরের মাইয়াডি ঘুমাইতাসিলো দাওয়ায়। একখান বড় কাঁসার থালায় উঠাইয়া ঘুরাইয়া দিয়া কয় বিয়া হইতাসে।"
আঁতকে ওঠেন হেমাংগিনী।
ভয়ার্ত গলা মাঝিবউয়ের,
"চল মা গো,ঘাটে নাওলা গায় মাল্লারা। হেরা কয় কইলকাতার বাসায় যাইতে। এইহানে রাইতে হয়ত ঘরে আগুন দিবারো পারে। এগো বিশ্বাস নাই। ত্বরা কর মা।
মেয়েরা ছইঘরে ঘুমিয়ে কাদা।
হেমাংগিনী জেগে বসে থাকেন।
কলকাতা কত দূর।