গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭

নীহার চক্রবর্তী



ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত

সেলের বাইরে বেদী-ঘেরা এক গাছের নীচে বসেছিল রিয়াজুল । ছলছল চোখ তার । অনেকদিন বাড়ি থেকে তাকে কেউ দেখতে আসেনি । সেই মাস খানেক আগে এসেছিলো তার বৌ । দেখেই খুব কেঁদেছিল সে । অনেক খুনের আসামী রিয়াজুল নিজেও সেদিন নিজেকে সামলাতে পারেনি । দুজনের চোখের জলে সেদিন উদাস হয়েছিলো খুব জেল-প্রাঙ্গণ ।

একে-একে অনেকের বাড়ির মানুষ এসে তাদের মানুষকে দেখে চলে গেলো । অনেকে আসছে । মাইকে বারবার নাম ধরে বলছে,''আপনার ইন্টার্ভিউ আছে । গেটের কাছে আসুন ।''
কিন্তু রিয়াজুলের বেলায় শুধু শূন্যতা । তবু সে সজল-চোখে কান পেতে রয়েছে কখন বলে-- ''রিয়াজুল শেখ । পিতা লেট নাসির শেখ । নাকাশিপাড়া থানা । আপনার ইন্টার্ভিউ আছে । গেটের কাছে চলে আসুন ।''
সে আর হচ্ছে কই । দেখতে দেখতে বেলা একটা হয়ে গেলো । রিয়াজুল ভাবতে থাকলো,আজকে কি আর আসবে ? মনে হয় না । বড় অভিমানে রিয়াজুল এও ভাবল,আর কোনোদিন এখানে কাউকে আসতে হবে না । এভাবেই তো চারবছর কেটে গেলো এখানে । আরও কত সময় যাবে ।

এসব ভেবে যখন রিয়াজুল উঠতে যাচ্ছে,ঠিক তখুনি মাইকে তার নাম ঘোষণা হল । সে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো । চোখের জল হাত দিয়েই মুছতে থাকলো ।
কে এক আসামী তাকে হেসে বলল,''আমি কইছিলাম না তুমার বিবি আইজ আইব ? দেকলা তো । যাও পরাণডা ভইরা বিবির লগে কতা কইয়া আসো । কি কইলা আমারে বল কিন্তুক ।''
তার কথা শুনে রিয়াজুল এক-মুখ হেসে উত্তর দিলো,''কে আইছে কে জানে । তবে মুন বলতাছে বিবিই হইব । আসি । সব কবানে আমি তুমারে ।''
তারপরেই রিয়াজুল দ্রুত গেটের দিকে এগোতে থাকলো ।

তারপর দেখা হল । কিছু কথা হল রিয়াজুলের সঙ্গে তার স্ত্রী সাবিনার । কিন্তু সে কথায় আর কতটা তৃপ্তি পাওয়া যায় ? দুজনের মাঝখানে জালের বেড়া । ব্যবধান বেশ । সময়ও বড় অল্প ।
সাবিনা অশ্রু-সজল চোখে রিয়াজুলকে বলতে থাকলো,''আমি তো আগেই আসতে চেয়েছিলাম গো । কিন্তু ছেলেটার জ্বর হয়েছে । সারছেই না । হেমুডাক্তার আর ওষুধ দিতে চায় না । দিতে চাইবেই বা কেন ? ঠিকমতো পয়সা দিতে পারি না তাকে । দু'বাড়ি কাজ করে যা পাই,তাতে আমাদের সংসারই চলে না । তোমার মা খুব রাগ করে আমার ওপর । কষ্ট পায় । গালি দেয় আমাকে খুব । আমি যে কি করি ।''
সাবিনার কথা শুনে রিয়াজুল ফুঁফিয়ে উঠলো তখন ।

সাবিনার কথাগুলো শুনে রিয়াজুল অঝোর-ধারায় কাঁদতে থাকলো ।
ঝাপসা-চোখে অস্ফুটে বলল,''কি পাপ যে করছি আমি । আইজ বুজতে পারতাছি । পোলাডা আমার বুজি যাইব গা এমন কইরা । গিয়া আইর দেকতি পামু না অরে বুঝি । আল্লারে ডাহ । তিনি যদি কিসু সুরাহা করেন ।''
আর সামান্য কিছু কথা বলার পর জেলের এক পুলিশ এসে বলল রিয়াজুলকে,''সময় শেষ । এবার নিজের ঘরে চলে যাও ।''
ইচ্ছা থাকলেও থাকার উপায় নেই রিয়াজুল আর সাবিনার । তাই চোখ-ভরা জল নিয়ে নিজেদের পথ বদলে দিলো বুক-ভরা হাহাকার নিয়ে । আবার কবে আসবে,সে কথাও জানা হল না রিয়াজুলের ।াপেছনে তাকাতেই জেলের দুর্ভেদ্য গেট ।
তারপর রিয়াজুল সেই গাছের নিচে এসে আবার বসলো । বৃষ্টি পড়ছিল তখন । কিন্তু উঠতে চাইলো না সেখান থেকে । চোখের বৃষ্টি ধোয়ার চেষ্টা করছিলো বুঝি ঈশ্বরের বৃষ্টি দিয়ে ।

রিয়াজুলকে একা-একা বৃষ্টিতে বাইরে ভিজতে দেখে ছুটে এলো সেই আসামী তার ঘর থেকে । তারপর সে এসে তার হাত ধরে বেদী থেকে তুলতে চাইলো । কিন্তু রিয়াজুল উঠতে চাইলো না ।
বৃষ্টি-ধোওয়া চোখের জল নিয়ে বলল,''আমারে এহানে এগডু শান্তিতে থাকতি দাও গো । আমি আর এগডু শীতল হতি চাই আইজ ।''
তখন সে বলল কষ্টের হাসি হেসে,''বৃষ্টির দিন এখন । রোজই বৃষ্টি হইব । আইজ আর নয় । অন্যদিন ভিজো আবার ।''
উত্তর দিলো রিয়াজুল,''আইজ যে বৃষ্টি হইতাছে,সে আমারে কিসুদিন শান্তিতে রাখব । তুমি বুজতি পারতছ না কিসু ।''
''সব বুজছি গো আমি । সব বুজছি । তাইলে এগডা কাম করি । আমিও ভিজি তুমার লগে । আমার ব্যাতা কম বইলা মনে কর ? আমার মা মরছে অনাহারে কদিন আগে । এ কতা কাউরে কইছি ? মানাইয়া লইছি সব । চল,দুজন মিইল্যা খুব ভিজি আইজ । কেউ না করলিও আমরা সরবো না এহান থেইক্যা । খুব কষ্ট গো । আমারও খুব কষ্ট ।''

কিন্তু দুই পুলিশের রক্তচক্ষু দুজনকে সরিয়ে দিল সেখান থেকে একটু পরেই ।
এক পুলিশ কড়া চোখ করে দুজনকেই বলল,''তোমাদের কিছু হলে কে দায় নেবে ? আমাদের চাকরী খেতে চাও নাকি ? ঘরে যাও এক্ষুনি । নইলে কপালে বেদম মার আছে তোমাদের ।''
কি আর করা । রিয়াজুল আর সেই আসামী তাদের ব্যথা আপ্রাণ আড়াল করতে করতে নিজেদের ঘরের মধ্যে চলে গেলো । পরের কাহিনী জেলখানার নিত্যদিনের ।