গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭

দেবাশিস কোনার




অন্তরীণ

    কথাটা যন্ত্রণার । কথাটা মন্ত্রনার। কথাটা সপ্ত জনার।কথাটা ষোলআনার।অথচ কথাটা শোনবার লোকই নেই।মারিতাঙ কত চেষ্টা করেছে জনে জনে কথাটা বলবার।কিন্তু কেউ শোনেনি।মারিতাঙকে গাঁয়ের কেউ মানুষ বলে ভাবে না।ভাবে ক্ষেপা ।

      হ্যাঁ, ছেলেটা স্বাভাবিক নয় বটে।ওর একটা ভাল নাম ছিল ।কালের প্রভাবে সে নাম হারিয়ে ওকে এখন সকলেই চেনে মারিতাঙ হিসাবে।ও জামা প্যান্ট পড়তে পারে না।চুমুক দিয়ে গ্লাসের জল খেতে পারে না।মারিতাঙ এর না পারার তালিকা বেশি ।কি ভাবে যে ছেলেটা এরকম হয়ে গেল তা ওর মা সাধনা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না।কিন্তু তার দায় এবং দায়িত্ব যে বেশি।সে জন্মদাত্রী মা।

    এ কাহিনী যাদের তারা ব্রাত্যজন।এখনও এই সমাজের মানুষ জানে লেখাপড়া শিখে কোনো লাভ নেই।লেখাপড়ার দরকার সামান্য ।মাঠের কাজ বা কলে কারখানায় কাজ করার সময় শুধু হিসাবটুকু বুঝে নেবার জন্য।ওদের ধারণা কত ছেলেই তো কত কত পাশ দিল,কই কারো তো চাকরি হল না ? সেজন্য ওরা ভবিতব্য বলে মনে করে নিজেদের মজুর জীবনকে।লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করাটাই ওদের জীবনের লক্ষ্য।

      তো এই পরিবারে জন্ম হল মারিতাঙ এর।একটু অস্বাভাবিক ।কিন্তু প্রকৃত চিকিৎসা হলে এরকম শিশু সুস্থ হয়ে যায়।তবে মারিতাঙ হল না। খেতমজুর পরিবারের সন্তান সে।কে চিকিৎসা করবে ? ধীরে ধীরে মারিতাঙ হয়ে উঠল তার পরিবার আর গ্রামের মানুষের কাছে বোঝা।অর্ধনগ্ন তাকে দেখে গ্রামের মানুষ লজ্জ্বায় মুখ ঢাকে। তার পরিবারের সদস্যরা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে।ওর বাবা ছেলের এইরকম স্বভাব দেখে বেশি বেশি করে পান করে মাতাল হয়ে বসে থাকে।কেবল সাধনা,যে সন্তানের মা - সে শত কাজের মাঝেও মারিতাঙ এর জন্য সময় দেয়।তাকে খাইয়ে দেয়।জামা প্যান্ট বা লুঙ্গি পড়িয়ে দেয়।কিন্তু কিছুক্ষন পরেই ,সেই বস্ত্র খুলে টুলে যায়।এই পরিবারের সকলেই মজুর।পেটের টানে
 মারিতাঙ এর মা সাধনাকেও ক্ষেতে খামারে কাজে যেতে হয়।তখন এই শিশুবত ছেলেটিকে কে দেখবে ? 
      মারিতাঙ এর একটা নাম ছিল।বেশ ভাল নাম।মলয়।বসন্তকালে জন্মে ছিল বলে এই নামটা রেখেছিল ওর বাবা নিত্যানন্দ।যে এখন পাঁর মাতাল।যাকে এখন গ্রামের সকলে চেনে শার্দূল জারাখ খাঁ হিসাবে।বেশ মজার ব্যাপার ঘটেছিল একবার। মানসিক রোগ না কি বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হয়।সেদিক থেকে দেখতে গেলে মারিতাঙ এর বাপ নিত্যানন্দের মধ্যে এই মানসিক ভারসাম্যহীনতার যথেষ্ট প্রকরণ দেখা যায়।পেটে মদ পড়লেই সে আজেবাজে বকতে থাকে।একবার শার্দূল জারাখ খান যাত্রা পালা দেখে এসে সে যতবার মদ পান করত ,ততবার শার্দূল জারাখ খাঁ বলে চিল চিৎকার করত । তাই নিত্যানন্দের নাম হয়ে গেল শার্দূল জারাখ খাঁ। সে ইতিহাস তো আলাদা।

       ছোট থেকে যত বড় হতে লাগল মারিতাঙ এর শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা তত প্রকট হতে থাকল। ছেলেটা হয়তো ভাল হয়ে যেতে পারতো ,যদি এই পরিবারটি শিক্ষিত হত।মলয় থেকে মারিতাঙ হয়ে ওঠার কাহিনীতিও বড় মর্মান্তিক। অনেক অস্বাভাবিক কাজ করত সে।হাতে করে নিজের খাবার খেতে পারত না।কিন্তু চুমুকে খেতে পারত। মা,বাবা এবং ভাই বা দাদারা যখন কাজে চলে যেত তখন মারিতাঙ খিদে পেলে নিজেদের অথবা অন্যদের গরুর বাঁটে মুখ লাগিয়ে দুধ পান করত । কিন্তু সব গরু বা গাভী সমান মনোভাবের না।গরুর স্বভাব পিঁছনের পা ছোঁড়ার।যাকে গোদা বাংলায় বলে চাঁট মারা।তো গরুর দুধ পান করতে গেলেই তারা চাঁট মারত। আর আমাদের মারিতাঙ সব কথা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে পারত না।সে বলত ,মারিতাঙ ।গরুটিকে দেখাত আর ওই কথা বলতো।ওর মা ছেলের কথা বুঝতে পেরেছিল। ভয়ে আর ও কখনো গরুদের কাছে যেত না।

       মারিতাঙ যত বড় হতে লাগল তত ওর মানসিক ভারসাম্যহীনতা প্রকট হতে থাকল।শেষ অবধি মা ছাড়া আর কেউই তাকে দেখতে পারত না।কথায় আছে কুপুত্র যদি বা হয়,কুমাতা কখনো নয়। এই সব ব্রাত্য সমাজে দৈনন্দিন খাওয়া পড়ার জন্য লড়াই চলতে থাকে।ফলে পরিবারের একজন অন্যের সাথে পৃথক হয়ে যায়।শুধুমাত্র ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য।মারিতঙ এর দাদা ও ভাইয়েরা পৃথক হয়ে গেল।পরে থাকল মা বাবা আর সে। সংসার বড় দুর্গম।মারিতাঙ মানসিক প্রতিবন্ধী হলেও কিছুটা বুঝতে পারত। কিন্তু তার সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না , কিছু করবার।ওর মার শরীর খারাপ হলে তাকে খাবার খাওয়ানোর লোক জুটত না। তাই সে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক নিয়মে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে চাইতো।চাইলেই তো আর সবাই সবটা পারে না।মারিতাঙ ও পারত না।তবু তার চেষ্টার কসুর ছিল না।

      শার্দূল এবং সাধনার বয়স বাড়ছিল।তার ওপর ছিল দুশ্চিন্তা।কি হবে তাদের ছেলেটার ? বিশেষ করে সাধনা ভাবত , সে চলে গেলে ছেলেটা না খেয়ে মরবে। পাড়া প্রতিবেশীদের গঞ্জনায় মারিতাঙ ঘরে টিকতেই পারত না।তাদের কথা যদি বা সহ্য হয় ,সে কিন্তু ভাই,দাদা বা মা- বাবার বকুনি একেবারে সহ্য করতে পারত না। 

      এরকমই একদিন সাধনা ধুম জ্বরে শয্যাশায়ী।মারিতাঙ এসেছে খিদের জ্বালায় ঘরে।মাকে ঠেলে ওঠাতে চায় ,তাকে খাবার দাবার জন্য।একে অসুস্থ মানুষটা জ্বরে কাবু ,তার ওপর এই অপদার্থ ছেলের জেদ।আর সহ্য হল না জারাখ খানের।সে সপাটে একখানা চর কষাল ছেলেকে। ওর জেদ বেড়ে গেল।আসলে এধরনের মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের যে কাজ করতে জোড় করে বারণ করা হয় , তারা সেই কাজটিই করতে চায়।মারিতাঙও সেই কাজটিই করল।ফলে তার অন্য ভাই ও দাদারা এসে বেধড়ক মারল ওকে।এমন মারল যে ও চলশক্তিহীন হয়ে গেল।

       সারাদিন ছেলেটার খাওয়া হল না।যার মা নেই,তার কেউ নেই।রাত্রে সাধনার জ্বর কমল।ছেলে এবং মা পাশাপাশি শুয়ে ছিল।মাকে সুস্থ দেখে ছেলের সে কি কান্না।তার যত আবদার মায়ের কাছে।মা নিজে হাতে ছেলেকে যা ছিল হাতের কাছে তাই খাইয়ে দিল।কিন্তু মারিতাঙ উপলব্ধি করল , এখানে আর তার স্থান হবে না।মা যদি না থাকে তাহলে কেউ তাকে খেতে দেবে না।পাগলের মন।

        গায়ে একটু শক্তি সঞ্চারিত হওয়ার পর সে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ল।আশেপাশের গ্রামের মানুষ মারিতাঙকে চিনত।সকলেই ভাবল , পাগলটা নিজের খেয়ালে হয়তো কোথাও ঘুরতে যাচছে। কিন্তু সে এক নীরব অভিমানে অনেক দূরে চলে গেল।মা,বাবা,দাদা,ভাই,প্রতিবেশীদের থেকে দূরে। যেখানে তাকে কেউ মারবে না।অপমান করবে না।তার মনের গভীরে বহু ক্ষোভ জমা ছিল।অনেক কথা তার বলবার ছিল।সেই সব কথা যতবার বলতে গেছে,ততবার তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।তার কথা কেউ শুনতে চায় নি।আদি অন্তহীন সেই সব কথা সে এবার বলবে। সে খুঁজছে , সেই মানুষটিকে ।