গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭

যুগান্তর মিত্র

সাইকেলের ঘণ্টি 

পেছন থেকে কেউ এমনভাবে সাইকেলের ঘণ্টি বাজাচ্ছিল যেন এই মুহূর্তে তার সামনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে সরে না-গেলেই হুড়মুড়্ করে এসে পড়বে তার সাইকেলের উপরে তারপর … 

অত কিছু তখন ভাবার মতো অবস্থা ছিল না প্রমিতের দ্রুত সরে যেতে হবে এই কথাটাই তার মাথাতে ঘণ্টির মতো বেজে গেল হঠাৎই আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে গেল কেঁপে গেল হাত হয়তো পাও কাঁপছিল তার আড়চোখে পিছনের দিকে দেখতে দেখতে সাইকেল নিয়ে বাঁদিকে সরে যেতে থাকে আর এভাবেই একেবারে সোজা নয়ানজুলিতে গিয়ে পড়ল সে

বর্ষা বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই ভরা বর্ষার সময় নয়ানজুলি জলে টইটই করে সন্ধের পরেই শুধু নয়, দিনের বেলাতেও ব্যাঙেদের একটানা ডাকের কনসার্ট বেজে চলে তখন কিন্তু একটা একটা করে দিন কেটেছে, আকাশের ঘন জমাট মেঘ ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে গেছে যত, ততই নয়ানজুলির জলও কমে গেছে কমতে কমতে তখন একেবারে তলানিতে তার মধ্যেই সাইকেল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল প্রমিত প্যান্ট কাদায় মাখামাখি, জামাতেও কাদার ছোপ ছোপ মুখের চারপাশে কতটা কাদা লেগেছে বুঝতে না-পারলেও দাঁতে যে কাদা ছিটকে লেগেছে তা বেশ মালুম হচ্ছে কিচকিচ করছে কিন্তু অত ভাবার মতো অবকাশ নেই প্রমিতের বিন্তিপিসি ওকে চিনি আনতে পাঠিয়েছিল দোকানে বাড়ি থেকে দোকানটা বেশ খানিকটা দূরে তাই সাইকেল ছাড়া উপায় নেই অবশ্য অনেক সময় হেঁটেই যেতে হয় তাকে বিন্তিপিসিই বলে, সাইকেল নিস না টুকাই সাইকেলে কোনো গোলমাল হলে তোর পিসার খুব অসুবিধা হবে আর যখন তাড়াহুড়ো থাকে, কোনো জিনিস এখুনি চাই, তখন হেঁটে যেতে গেলে বলবে, এতটা হাঁটবি এখন ? আনতে আনতে তো দিন কাবার হয়ে যাবে রে যা যা, সাইকেল নিয়ে যা 

শরতের মেঘ ভাসছে আকাশে নয়ানজুলির ওপারে কাশফুল ফুটে আছে সেসবও যেন তার এই চূড়ান্ত বিপদে পড়ার ঘটনায় হেসে উঠল চিনির ঠোঙা জলে কাদায় পড়ে গেছে সেখান থেকে তুলে নেওয়ার উপায় নেই হাতে ছিল চিনি কেনার পরে ফেরত দু-টাকার একটা কয়েন সেটা যে জলে পড়ে গেছে এটাও প্রমিতের আর একটা বিপদের কারণ এমনিতে চিনির জন্য বিন্তিপিসির অনেক কথা শুনতে হবে আর যখন জানতে চাইবে, দু-টাকা ফেরার কথা ছিল সেটা কই ? খেয়ে ফেলেছিস নাকি ? যার খাস যার পরিস, তারই তো দাড়ি উপড়াবি তুই জানি না তোকে ! হাড়েবজ্জাত ছেলে 

বিন্তিপিসি কোনো জবাবই শুনতে চায় না নিজে যা ভাবে সেই সূত্র ধরেই বলতে থাকে একনাগাড়ে অথচ এমন কোনো ঘটনা কখনোই ঘটেনি যে প্রমিত ফেরতের টাকা দিয়ে কিছু কিনে খেয়েছে গুণে গুণে পয়সা দেয়, ফেরতেরও চুলচেরা হিসেব নিয়ে নেয় তবু কোনোকিছুর দাম বেড়ে গেলে ফেরত মেলাতে গিয়ে সন্দেহ করে প্রমিতকে কিছুতেই মানতে চায় না যে দাম সত্যিই বেড়েছে সবসময়ই পিসেমশাইয়ের থেকে দাম যাচাই করে নেবেই পিসেমশাই অনেক বলেছে, এত টিকটিক কোরো না ছেলেটার সঙ্গে কি না বলে নেয় কখনো ? পিসি ধমক দিয়ে উঠবে, তুমি চুপ করো সব ব্যাপারে তুমিই বা এত মাথা ঘামাও কেন ? পিসি যখন জানতে পারে দাম সত্যিই বেড়েছে সেই জিনিসের, তখন আবার উল্টো কথা শোনাবে, তুই কেমন হাঁদা ছেলে রে ? আমি যখন জিজ্ঞাসা করলাম তখন বলবি তো একবার দাম বেড়েছে ! এত হাঁদু হলে চলে আজকালকার দিনে ? তখন কিন্তু কিছুতেই বলা যাবে না, আমি তো বলছিলাম পিসি তুমিই বলতে দাওনি বললেও মানতে চাও না মুখে মুখে কথা একদম পছন্দ করে না পিসি তার সাফ কথা, যত্তসব হাড়জ্বালানো এসে জুটেছে আমারই কপালে !

প্রথম প্রথম এসবে খুব কষ্ট পেত কিন্তু কিছুদিন যেতেই সব গা-সওয়া হয়ে গেছে প্রমিতের তাই সেসব নিয়ে খুব-একটা ভাবে না সে তবে পয়সা মেরে দেওয়ার অপবাদ মাথায় নিতেও ইচ্ছে করে না এবার তো আর দাম যাচাইয়ের কোনো ব্যাপার নেই এর কী প্রমাণ পাবে পিসি ? তাই অবধাতির ভাবেই পয়সা মেরে দেওয়ার কথা জোর দিয়েই বলবে এই চিন্তাটাই আচমকা পেয়ে বসল তাকে তাই কাদার মধ্যেই হাত ঢুকিয়ে প্রাণপণে কয়েনটা খোঁজার চেষ্টা করে প্রমিত কিন্তু সে জানে বিপদের সময় আশেপাশের সবকিছুই কোনো-না-কোনো ভাবে তার সাথে এমন কাণ্ড করবে যে সে আরও বিপদে পড়ে যাবে সমস্ত পারিপার্শিক যেন সেইসময় ষড়যন্ত্র করে তার সঙ্গে এখনও ঠিক তাই হল কিছুতেই পাওয়া গেল না কয়েনটা কিছুক্ষণ খুঁজে তাই হাল ছেড়ে দিতে হল বিপদ যে তার আরও জামাকাপড়ে কাদা লেগেছে সাইকেলটাও কাদায় মাখামাখি তাই খোঁজা থামিয়ে সাইকেলটাকে রাস্তার কলের জলে ধুয়ে নিতে হবে কোনোরকমে সাইকেল উপরে তুলে টাইম কলের কাছে নিয়ে যায় ভাগ্য ভালো এইসময় জল আছে, আর কলের কাছে কেউ নেই তাই কিছুটা নিশ্চিন্তে কলের জল হাতের আঁজলায় নিয়ে সাইকেলটা ধুয়ে ফেলে তাড়াতাড়ি তারপর গভীর চিন্তা উদবেগ নিয়ে বাড়ির পথ ধরে আর তখনই সাইকেলের ঘণ্টির শব্দ তার কানে বেজে ওঠে পিসির বাড়ি যাওয়ার সরু গলিপথে অন্য কোনো সাইকেল আসার কথা নয় আসেওনি তবু কেন যেন ঘণ্টি বাজার শব্দ পায় প্রমিত সেই থেকে বিপদ আসন্ন হলেই সাইকেলের ঘণ্টির শব্দ শুনতে পায় সে এরপর থেকে বিপদ নয় শুধু, যে-কোনো বিপন্নতাতেই ঘণ্টিশব্দ টের পায় প্রমিত

()

বিপন্নতা অবশ্য তার আশৈশব মুর্শিদাবাদের লালবাগে তাদের বাড়ি বাড়ি বলতে চাঁচরের বেড়ার ঘর আর টালির চাল সেখানে যজমানি করে প্রমিতের বাবা অভাবের সংসার বলে লেখাপড়া করতে পারেনি সেভাবে বামুনের ছেলে বলে অন্য কোনো কাজও করতে সায় দেননি প্রমিতের ঠাকুরদা ফলে যজমানিই ছিল ভরসা ঠাকুরদা গত হয়েছেন অনেক আগে 'বছর আগে ঠাকুমাও নিজের পিসি কাকলি ছিল অসম্ভব সুন্দরী রাজপুত্তুরের মতো না-হলেও মনোতোষ পিসেমশাই বেশ লম্বাচওড়া চেহারার এবং সরকারি চাকরি করে বন্ধুর বোনের বিয়েতে এসে রূপে গুণে লক্ষ্মী পিসিকে পছন্দ করে সে তারপর প্রস্তাব আসে ঠাকুরদাও এমন হীরের টুকরো ছেলেকে হাতছাড়া করতে চাননি তাই যেটুকু জমিজিরেত ছিল বন্ধক রেখে কোনোক্রমে মেয়ের বিয়ে দেন সেই বন্ধকী জমি আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি প্রমিতের বাবা দিনে দিনে যজমানি কারবারও তলানিতে ঠেকেছে এখন আর আয় তেমন হয় না তাই নিঃসন্তান বিন্তি যখন তার বাবাকে বলল, তোমার ছেলেটাকে আমার কাছে দাও দাদা নিজের ছেলের মতো মানুষ করি তখন যেন হাতে চাঁদ পেল প্রমিতের বাবা যদিও প্রমিতের মা আর ঠাকুমার মন সায় দিচ্ছিল না, কিন্তু দুবছরের ছোটো ছেলে আর আট বছরের বড় ছেলেকে যে এক সঙ্গে মানুষ করা সম্ভব নয়, তা বুঝতে পেরেছিল তার বাবা তাই শেষপর্যন্ত বিন্তির বাড়িতেই বড় ছেলে প্রমিত ওরফে টুকাইকে পাঠাতে বাধ্য হয় তারা 
বিন্তিপিসি প্রমিতের নিজের পিসি নয় খুব দূর সম্পর্কের পিসি তবে প্রমিতের পিসির সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল কাকলি আত বিন্তি যেন দুই পিঠোপিঠী বোন সেভাবেই তারা বেড়ে উঠছিল বিন্তির আগেই বিয়ে হয়ে গেছে রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেশ ভালো মনের মানুষ বলে জানে সবাই ভালো চাকরিও করে চমৎকার তার কথা বলার ধরন সবমিলিয়ে বেশ গ্রহণযোগ্য সবার কাছেই 

কাকলি আর বিন্তির প্রায় কাছাকাছি বয়স এক ক্লাশ উঁচু-নিচুতে পড়ত দুজনে থাকেও কাছেই সেই সূত্রে নিত্য যাতায়াত ছিল তাদের বাড়ি নিজের পিসির কথা ভাবলে খুব খারাপ লাগে প্রমিতের বিয়ের পর মাত্র একবার এসেছিল, তারপর থেকে পিসেমশাই নিজেও আসেনি, পিসিকেও পাঠায়নি অনেক দূরে চলে গেছে কোনো যোগাযোগই রাখেনি আর প্রথম দিকে চিঠি লিখত পিসি কিন্তু কোনো জবাব দিতে বারণ করত একসময় সেই চিঠিও আসা বন্ধ হল তবে খবর পায় ভালোই আছে কতটা ভালো আছে সে খবর অবশ্য পায় না মোটেই 
()
বিন্তিপিসির বাড়িতেই বড় হয়ে উঠছে প্রমিত বাবা আসেই না প্রায় তবে প্রতিবছর গরম আর পুজোর ছুটিতে নিয়ম করে দেশের বাড়িতে নিয়ে যায় পিসি-পিসেমশাই যে কদিন মুর্শিদাবাদে থাকে ওরা, প্রমিত তার বাবা-মায়ের কাছেই থাকে ভাইয়ের সঙ্গে খেলে, ঘুরে বেড়ায় পথেঘাটে আর মায়ের প্রচুর আদর পায় সে মাকে একবার বলেছিল পিসির খিটখিটে মেজাজের কথা মা চোখ মুছে বলল, বিন্তির বরাবরের স্বভাব খিটখিট করা কিন্তু তোকে তো ভালোবাসে বাবা !

প্রমিত মানে যে পিসি তাকে সত্যিই ভালোবাসে খিটখিট করা ছাড়া পড়াশুনা, খাওয়াদাওয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, জামাকাপড়, কোনোটাতেই কার্পণ্য নেই আর অনেক সময় আদর করে এমন আদর তার মাকেও করতে দেখেনি কোনোদিন গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, চুলে বিলি কেটে দেয় আর বলে, টুকাই রে, তুই আমার জন্মজন্মান্তের ছেলে কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যাসনি বাবা বুকে ভরে উঠত প্রমিতের কী এক খুশির হাওয়া তার বুকের মধ্যে লুটোপুটি খেত যেন চোখ ভিজে উঠত পরম আনন্দে 
প্রমিতের মনে পড়ে, তখন পিসির বাড়িতে এসেছে প্রায় মাসখানেক হবে পাড়ার মাঠে খেলতে যেত পিসেমশাই নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে করে পিসিও গেল গিয়ে ক্লাবের ছেলেদের বলল, এটা আমার ছেলে কিন্তু ওকে তোরা খেলাধুলায় নিস বাবা ক্লাবের ছেলেরাও নতুন বন্ধু সদস্য টুকাইকে কাছের করে নিল সহজেই

সেদিন স্কুলে যেন কীসের মিটিং ছিল স্কুল বন্ধ কিন্তু অফিসঘর খোলা স্কুলের মাঠের পাশেই ওদের ক্লাব স্কুলমাঠটাই ক্লাবের মাঠ হিসাবে ব্যবহার করে ওরা দলবেঁধে ফুটবল খেলছিল সবাই বিল্টু কর্নার কিক করল গোলমুখ থেকে বল  বাঁচাতে গিয়ে গোলকিপার সুবল খুব জোরে পা চালাল বলটা মাঠ পেরিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকল টিচার্স রুমে কে যাবে আনতে বল? ওকে ঠেলে তারপর ভবেনদা বলল, যা তো টুকাই, তুই গিয়ে বল নিয়ে আয় কোনোকিছু না-ভেবেই প্রমিত দৌড়ে গেল বল আনতে না-আনলে যদি রেগে যায়, যদি আর খেলায় না-নেয় ওকে এইসব ভেবেই বল আনতে ছুটেছিল সে টিচার্স রুমে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল সব টিচারের চোখ প্রমিতের দিকে কালো মোটা আর খুব গম্ভীর ফিজিক্যাল সায়েন্সের চিত্তরঞ্জন স্যার জিজ্ঞেস করল, এই ছেলে, তোমরা এভাবে বল খেলো কেন যে স্টাফরুমে চলে আসে ? দেখেশুনে মারতে পারো না ? 
সে আমতা আমতা করে বলল, না মানে, আমি মারিনি সুবলদা
~ আমি কি কারও নাম বলেছি ? আর সুবল তো গোলকিপার, নাইনের ব্যাচ ওকে আমি চিনি ওর তো বল মারার কথা নয় কেন বাজে কথা বলছ ? চিত্ত স্যারের গমগমে গলা আছড়ে পড়ল প্রমিতের কানে
আসলে, গোল বাঁচাতে গিয়ে বলটা জোরে মেরে দিয়েছে আর সোজা চলে এসেছে এখানে ইচ্ছে করে মারেনি কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলবে ভেবেছিল সে কিন্তু কিছুতেই মুখ থেকে বের হল না সাইকেলের ঘণ্টি ততক্ষণে বাজতে শুরু করেছে ওর কর্ণকুহরে ক্রিং ক্রিং শব্দে কেমন ঝিমঝিম লাগছে তার মাথাটা ভারী হয়ে উঠছে মাথায় পিন ফোটানোর অসহ্য যন্ত্রণা টের পাচ্ছে তখন মাত্র দুদিন আগেই সাইকেল নিয়ে নয়ানজুলিতে পড়ে গিয়েছিল আর তখন থেকেই যেকোনো বিপন্নতায় সাইকেল-ঘণ্টি তার নিত্যসঙ্গী 
~ চিত্তদা, ছেলেটাকে দেখুন, ভয়ে চোখমুখ কেমন হয়ে গেছে দিয়ে দিন
এবার প্রমিত খেয়াল করে বলটা সেই চিত্তবাবুর হাতেই আছে 
~ তোমার বাড়ি কোথায় ? আগে তো দেখিনি নতুন নাকি ? 
কোনোক্রমে মাথা নাড়ে হ্যাঁ নতুন 
~ কোন্ বাড়ি ? 
কোন্ বাড়ি বলবে বুঝে উঠতে পারে না প্রমিত কী করে বোঝাবে ? এখনো তো ভালো করে জায়গাটাই চেনা হয়নি 
~ কোনো ফ্ল্যাটের হবে এখন তো ফ্ল্যাট কালচার শুরু হয়ে গেছে ডিসগাস্টিং ! মন্তব্য করলেন হরিপদ স্যার 
বিমলবাবু তখন বললেন, আমাদের স্কুলেই পড়ে নতুন ভর্তি হয়েছে 
~ এই নাও বল আর সাবধানে খেলবে এদিকে যেন না চলে আসে মনে থাকবে ?
সাইকেলের ঘণ্টির তীব্র শব্দের মধ্যেই কথাগুলো প্রমিতের কানে এসে পৌঁছোয় আর সেও কোনোমতে ঘাড় হেলিয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বল হাতে ধীরে ধীরে ফিরে আসে মাঠে যন্ত্রণার তীব্রতা মাথায় নিয়েই বলটা জোরে ছুঁড়ে মারে মাঠের বন্ধুদের দিকে তারপর বসে পড়ে মাঠের পাশে 

() 

গ্র্যাজুয়েশনের পর থেকেই চাকরির চেষ্টা করছে প্রমিত পিসেমশাই রিটায়ার করেছে বড় চাকরি করত পেনশন ভালোই পায় ভালোই চলে যাচ্ছে তাদের তাছাড়া কোনোদিন চাকরি-বাকরি খোঁজ করার কথাও বলেনি তার একটাই কথা, পড়াশোনা কর, ভালোভাবে নিজের পায়ে দাঁড়া কিন্তু পিসি তাকে আড়ালে বলে, পিসার কথা শুনিস না পড়াশুনা কর, চাকরিও খোঁজ টুকাই দুঃখী বাবা-মারে দেখিস ভাইটারে দেখিস আমি আর কয়দিন ?  

তবে পিসি নয়, পিসেমশাই- আগে চলে গেল একদিন বিকেলে বাগানে টবের গাছে জল দিতে দিতে বুকে হাত চেপে ধরল তারপর ঘরে এসে শুয়ে পড়ল দ্রুত আর উঠল না কানে সাইকেলের একটানা শব্দ নিয়েই ডাক্তার ভরদ্বাজকে ডেকে এনেছিল প্রমিত তিনি এসে অল্প সময়ের মধ্যেই ডাক্তারঘোষণা করলেন সব শেষ 
বিশাল চেহারার পিসির শরীরে নানা রোগের বাসা অথচ নীরোগ পিসেমশাই আগে চলে যাওয়ায় খুব ভেঙে পড়েছিল পিসি মাঝে মাঝেই বলত, আমার মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচব না এই রোগভোগ নিয়ে আর বাঁচতে চাই না এখন গেলেই বাঁচি 
~ হা হা হা, এত তাড়াতাড়ি গেলে হবে সু ? ছেলের বউ দেখবে না? পিসেমশাইয়ের কথায় পিসির চোখ চিকচিক করে ওঠে প্রমিতের মনে পড়ে পিসির ভালো নাম সুলেখা পিসেমশাই তাকে সু বলে ডাকে আর বাকি পৃথিবীর কাছে পিসির পরচিতি বিন্তি নামেই
~ কী জানি এত সুখ কি আমার হবে ?রোগেভোগেই শেষ হয়ে গেলাম
প্রমিত বোঝে, এখন পিসেমশাইয়ের স্মৃতি আর সে নিজে পিসির প্রধান সম্বল সে তাই চাকরি খোঁজে একটা চাকরি, পিসির জন্য বউ নিয়ে আসার কথা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় চাকরি পেলেই পিসির ইচ্ছে পূরণ করবে সে পিসেমশাই যতই মজা করে বলুক, নিজেরও যে সেই ইচ্ছেই ছিল বোঝে প্রমিত সে যে এদের কাছে ছেলের মর্যাদা আর ভালোয়াসা পায় তা জানে প্রমিত চাকরি তার পেতেই হবে কিন্তু ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রশ্নগুলো যখন আছড়ে পড়ে তার দিকে, তখনই সাইকেলের অনিবার্য বেল বেজে ওঠে কোথাও সব কেমন গুলিয়ে যায় 
এর মধ্যেই একবার শ্রীকান্তদা চোখ নাচিয়ে বলল, অনেক দিন তো নিরামিষ কাটালি এবার একটু আমিষ নেড়েচেড়ে দেখ বাবু মেঘে মেঘে বেলা তো কম হল না 
প্রথমটা বুঝতেই পারেনি কী বলল শ্রীকান্তদা পরে যখন খোলসা করে সব জানাল, তখন কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করছিল পরে অবশ্য রাজি হয় অদম্য কৌতূহল পেয়ে বসে তাকে 
~ তা তুমি কী করতে এসেছে গো করতে নাকি আমার হাঁড়ির খবর নিতে ? 
কেমন গুটিয়ে যায় প্রমিত না না, তোমার কথা একটু জানতে ইচ্ছে করল 
~ জানতে ইচ্ছে করল তা কী করবে শুনি এসব জেনে? 
~ এমনিই
কাচ-ভাঙা হাসি এমনি ? তুমি খুব ঢ্যামনা আছো মাইরি লাগালে লাগাও না-হলে তাড়াতাড়ি বিদেয় হও এখান থেকে 
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে প্রমিত মাথা নীচু কেন এই লাইনে এসেছিল জানার কৌতূহল ছিল তার তাই দু-চারটে প্রশ্ন করে বসে কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া এইরকম হবে মাথাতেই আসেনি 
~ আমি একটু টয়লেট থেকে আসছি কী করবে ভাবো তুমি
কিছুক্ষণ মানে যে মিনিট দশ-পনেরো তা বুঝতে পারেনি প্রমিত যখন এল তখন আঁচল দিয়ে শরীর ঢাকা যেন পাশের বাড়ির পদ্মা বৌদি সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে এল তুলসীতলায় এবার ধূপকাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠাকুরের আসনের পাশের ধূপদানিতে গুঁজে দিয়ে হাত বাড়িয়ে তুলে নেবে শাঁখটা আর শঙ্খধ্বনির একটানা ঘোরলাগা সুর বাতাসে ছড়িয়ে পড়বে এখনই 
~ কী ঠিক করলে খোকাবাবু ? বলেই চোখ টিপে হাসে সেই পদ্মা বউদির মতো নারী এরপর কাছে এগিয়ে এসে বলল, দাও আজ বরং তোমারটা একটু নেড়েচেড়ে দিই অন্যদিন চেষ্টা কোরো
আবার হাসি আছড়ে পড়ে প্রমিতের বুকে কেমন যেন কুঁকড়ে যায় সে তারপর জানালা খুলে দেয় ঘরের, দরজাও খুলে দেয় আচমকা আর ঝনঝন হাসির শব্দে মাতাল হাওয়া লুটোপুটি খায় তার সারা শরীরে কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর অপমানে আর লজ্জায় মাথা খসে পড়তে চাইছে গলা থেকে ঘণ্টির শব্দের মধ্যেই শ্রীকান্তদা দরজা খোলা পেয়ে সোজা ঢুকে এলো ভেতরে
~ কী রে, তুই তো কামাল করে দিলি !  প্রথম বার এসেই এর মধ্যে কাজ সারা ? আমার তো প্রথমদিন আধঘণ্টা এমনি এমনিই চলে গেল জিও মেরে লাল
পান খাওয়া, ছোপ-ধরা দাঁত বের করে খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠল সেই নারী তারপর বলল, নাদান বাচ্চা তো পঞ্চ সতীর এক সতী মাইরি কিছুই করতে আসেনি শুধু আমার কীভাবে চলে, কে কে ছিল বাড়িতে এইসব হালচাল জানতে এসেছে 
সাইকেলের ঘণ্টি এবার আরও জোরে বেজে উঠল কোনোক্রমে প্রমিত বলতে পারল, এখান থেকে চলো বাচ্চুদা আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে 

শ্রীকান্তই শিখিয়েপড়িয়ে এনেছে কোনোভাবেই আসল নাম বলা যাবে না এখানে তার নাম শ্রীকান্ত নয়, বাচ্চু ঘণ্টিশব্দের মধ্যেই ঠিকঠিক বাচ্চু শব্দটাই বেরিয়ে এল প্রমিতের মুখ থেকে 
আও বাচ্চে গালে টোকা মেরে বলে সেই রমণী, কিন্তু যাবার আগে আমার টাকাটা
শ্রীকান্ত পার্স থেকে কড়কড়ে টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়, কত টাকা বুঝতে পারে না প্রমিত শুধু চেয়ে দেখে টাকাটা রোল করে দু-আঙুলের ফাঁকে নিয়ে ব্লাউজের ভেতর চালান করে দিল সে মুখ ফিরিয়ে ঘরের বাইরে চলে আসে প্রমিত তারপর সোজা রাস্তায় শ্রীকান্তও পিছন পিছন বেরিয়ে আসে 
~ কাউকে এসব বোলো না শ্রীকান্তদা প্লিজ হাত চেপে ধরে তার 
~ ধুর বাঞ্চোত, কাকে বলব ? বললে নিজে ফেঁসে যাব না শালা ? তোকে ভরসা করি বলেই না আনলাম তুই কাউকে বললে … 
~ না না দাদা, বিশ্বাস করো, আমি কাউকে বলব না আবার হাত চেপে ধরে 
~ নাটক মারাস না টুকাই চল, কেটে পড়ি 

দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চকিতে চোখ পড়ে একজনের চোখে অবিকল শ্যামশ্রীর মতো দেখতে একসঙ্গেই কলেজে পড়ত শ্যামশ্রী কি মুখ ঘুরিয়ে নিল ? সত্যিই শ্যামশ্রী তো ? সাইকেলের অবিরাম ঘণ্টির শব্দ মাথায় বেজে চলে এর মধ্যেই শ্রীকান্তদা হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে বাসে তুলে নেয় তাকে একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফেরে আর কোনোদিন ওদিকে যায়নি প্রমিত 
একদিন মধ্যরাতে প্রমিতের ফোন বেজে উঠল বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে তুলে দেখে পিসির ফোন নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে তাড়াতাড়ি ফোন ধরে সে

~ কী হল পিসি? ওদিক থেকে পিসির গলা পায় না সে বিনিময়ে ঘরঘর শব্দ ভেসে আসে যেন পিসি কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না মাঝরাতে বাথরুমে গেলে টুকাইকে এভাবেই ডেকে নেয় পিসি একা-একা যেতে চায় না বাথরুমে সারাদিন কোনো ভয় নেই, রাত বাড়লেই ভয় চেপে বসে কী ভয়, কীসের ভয় বোঝাতে পারে না টুকাইকে আবার কখনো পায়ের ব্যথা বাড়লে বলে গরম জল ভরে হট ওয়াটার ব্যাগটা দিতে বলে তাকে তাতে খানিকটা আরাম পায় পিসি 

পাশের ঘরেই ঘুমায় প্রমিত পিসির ঘরে গিয়ে দেখে তার হাতের মুঠোয় ধরা ফোন, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না প্রথমে তারপর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্লাবে ফোন করে বন্ধুদের সাহায্য চায় রাতে তিন চারজন ক্লাবেই ঘুমায় সব্বার বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা প্রমিতের ডাকে বন্ধুরা ছুটে আসে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনে ওরাই ধরাধরি করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে পিসিকে পিসি তখন অচৈতন্য

অ্যাম্বুলেন্স ছোটে আরোগ্য নার্সিং হোমের পথে ক্রমশ অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ মুছে যেতে থাকে তার বদলে সাইকেলের ঘণ্টি বেজে চলে অবিরাম বিন্তিপিসির নিথর শরীরের দিকে তাকিয়ে সেই ঘণ্টিশব্দে ক্রমশ ডুবে যেতে থাকে প্রমিত, যা আসলে তার বিপন্নতারই শব্দ ক্রিং ক্রিং অবিরাম