গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

 প্রাপ্তি

ভুবনবাবুর গ্যারেজ থেকে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল নিতাই। আজ কয়েকমাস হল সে এখানে কাজে লেগেছে। ভুবনবাবুই খুশী হয়ে তাকে নিজের গ্যারেজে বহাল করেছেন। ভাগ্যিস কাজটা সে পেয়ে গেল, নইলে পার্ট ওয়ান বিদ্যে নিয়ে  আজকাল কে আর কাজ পায়! চাকরিটা পেয়ে বেঁচে গেল নিতাই। ভুবনবাবু মাস গেলে তিনহাজার টাকা আর দুপুরের ভাত দেন। সকাল-বিকেল দুবেলা চা ফ্রী। শুধু এক কাপ করে চা-ই দেবার কথা। কিন্তু মনোরমা, মানে ভুবন বাবুর স্ত্রী চায়ের সঙ্গে  দুটো করে বিস্কুটও দেন। এখানে সকালের চা-টা নিতাই একটু বেলা করে খায়। বাড়ি থেকে চা-মুড়ি খেয়ে আসে। এখানে দেরী করে চা-বিস্কুট খেলে আর জলখাবার খেতে হয় না। যদিও দুপুরের ভাত খেতে খেতে বেলা প্রায় তিনটে। ভুবনবাবু, মাসীমাতাঁর দুই ছেলে-ছেলের বৌদের খাওয়া মিটবে, তবেই না! আবার কোন কোনদিন ছেলেরা ব্যবসার কাজে বাইরে গেলে তারা না ফেরা অবধি খাওয়া হয় না, সকলেই বসে থাকে। সেদিন প্রায় বেলা চারটে। তা হোক, তবু তো ভাতের খরচ বাড়িতে বেঁচে যায়, তাই বা কম কি! আর তাছাড়া গ্যারেজের আরো দুজন যারা কাজ করে, তাদের দুপুরে খাবার কোন ব্যবস্থা নেই। শুধু বিষ্টুবাবুর কথা শুনে নিতাইয়েরই দুপুরে এখানে ভাত খাবার ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন ভুবনবাবু। ভুবনবাবু এখানকার ধনী  লোক, মানীও বটে। তাই নানান লোকের সঙ্গে ওঠা বসা। পাঁচজনে গাড়ি পাঠায় এখানে, ভুবনবাবুকে ভরসা করে, ভুবনবাবুও তাদের কথা রাখেন। গ্যারেজের ব্যবসা তাঁর ভালই চলে, যদিও শহরে তাঁর লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা, একটা ওষুধের দোকান  আরো কি কি সব আছে, ছেলেরা দেখা শোনা করে। এসবই লোকমুখে শোনা কথা নিতাইয়ের।

হাতে কলমে কাজটা তাকে শিখিয়েছিলেন বিষ্টূবাবু, বাবার এক সময়ের বন্ধু। তখন নিতাইদের অবস্থা ভাল। নানা রকমের লোকজন বাড়িতে আসা যাওয়া করেন। নিতাই তখন কলেজে ঢুকবে ঢুকবে, দিদি কলেজে পড়ে, সঙ্গে টাইপ, এটা-সেটা। শুধু দাদা বাবা থাকতেই রেলে একটা কি করে চাকরি পেয়ে সেই রায়পুর না বিলাসপুর কোথায় যেন চলে গেল। গেল তো গেলই, আজ দাদা প্রায় দুবছর হল বাড়ি আসেনি, বাবা মারা যাবার সময়েও না। দাদার সঙ্গে বাড়ির সম্পর্ক খুবই কম, দাদাই রাখেনি, কেন কে জানে! বাবা থাকতে চলছিল ভালই, তারপর কোথা থেকে কি যে হল। তাশের ঘরের মত সব হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল। টাকা গেল, বাড়ি গেল, সম্মান গেল.. বাবা ও গেলেন, সব একসঙ্গে।  বাবা যে জুয়া খেলতেন কেউ জানত না, এমন কি মাও না। বাড়িটারও অনেকটাই বাবা মর্টগেজ দিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু নিচের তলার দুটো ঘর, একফালি বারান্দা  আর একটা ছোট মত কলঘর যা ওরা বাবা থাকতে রাতের কলঘর হিসাবে ব্যবহার করত, সেটুকু থাকায় ওরা রাস্তায় দাঁড়ানোর হাত থেকে বেঁচে গেল। এই সময়েই বিষ্টুবাবু এলেন। খুব করেছিলেন ওদের জন্য। কেন করেছিলেন, নিতাই জানে না। কিছু মানুষ থাকেন, যারা শুধু অন্যের জন্য করেন, বিষ্টুবাবু তাদের একজন। নিতাইকে ধরে গ্যারেজের কাজ  শিখিয়েছিলেন। বিষ্টুবাবুর কথাতেই নিতাইয়ের এই গ্যারেজে চাকরি, দুপুরের খাওয়াটাও উনিই ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। দিদি তখন ঐ সামান্য টাইপের বিদ্যে নিয়ে ছোট বড় সব জায়গায় হন্যে হয়ে ঘুরছে। কে দেবে চাকরি? শেষে বিষ্টুবাবুই ধরে করে একটা ছোট মত অফিসে দিদির চাকরি করে দিলেন। মাইনে কিছুই না, কোনমতে হাতখরচটা পেত, কিন্তু দিদির সম্মানটা বাঁচল। যে নিতাইরা বাবা  চলে যাবার পর কোনমতে একবেলা খেয়ে, না খেয়ে বেঁচে ছিল, নিতাইয়ের টাকা আর দিদির ঐ হাতখরচের মত টাকায় আজ তিনমাস হল দুবেলা ভাত খেয়ে বাঁচছে, মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় দুপুরে মাংস ভাতও। কম  কি! 

(২)
দুপুরে ভুবনবাবুর বাড়িতে খেতে এসে বিষম খেল নিতাই। ভুবনবাবুর বাড়িতে যে মহিলা রান্নাবান্না করেন, খেতে দেন, সব দেখাশোনা করেন, তিনি নিতাইকেও খেতে দেন। ভদ্রমহিলার নাম সুষমা, সকলে সুষমা মাসি বলে ডাকে। দেখাদেখি নিতাইও। নিতাই এসে দাঁড়াতেই সুষমা উঠে দাঁড়াল। এই ঘরটা ঠিক খাবার ঘর নয়। ঘরটা বাইরের দিকের একটা ঘর, বেরোলেই উঠোনের একটা দিক। বেশ বড়, প্রশস্ত উঠোন। ঘরে মধ্যে একটা বড় টেবিল পাতা। নতুন নয়, কয়েক জায়গায় রং চটা। দুদিকে চেয়ারের বদলে লম্বা বেঞ্চি পাতা, চেয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সকলে। বাড়ির কাজের লোকজন, বাইরের কেউ এলে এই ঘরেই খায়। সকলের খাওয়া-দাওয়া না হলে সুষমার ছুটি নেই। নিতাই না আসা অবধি বেঞ্চিতে বসে কুরুশ বুনছিলেন, নিতাইকে ঘরে ঢুকতে দেখে সুতো-কুরুশ রেখে উঠে দাঁড়ালেন। মুখে বললেনবসো, বলে এক গ্লাস জল রেখে  ভিতরে গেলেন ভাত আনতে। একটু পরেই একটা স্টিলের থালায় ভাত এনে নিতাইয়ের সামনে টেবিলের উপর  রাখলেন। আজ নিতাই অবাক হয়ে দেখল, স্টিলের থালায় ভাত, খানিককটা চচ্চড়ি, ডাল একটা বাটিতে, এক টুকরো মাছের সঙ্গে একপাশে কিছুটা পোলাও আর একটা পানতুয়া। গত তিনমাসে এখানে পোলাও তো দুরের কথা, মিষ্টির মুখও দেখেনি কোনদিন। আজ কি তবে ভুবনবাবুর জন্মদিন, নাকি কোন পুজো-টুজো? জিজ্ঞেস করবে না ভেবেও সুষমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল নিতাই---আজ কি মাসি, বাবুর জন্মদিন, নাকি পুজো-টুজো কিছু?
সুষমা ঠিক হাসলেন না, কিন্তু মুখটা একটু নরম করে বললেনআজ মুন্নীর জন্মদিন। 
কে মুন্নীবলেই মনে হল বেশী কৌতুহল দেখানো হয়ে গেল। সুষমা এবার কিছুটা বিব্রত, কিছুটা বিস্ময় মেশানো স্বরে বলে উঠলেন, বাবুর মেয়ে।
বলবে না ভেবেও নিতাই বলে ফেলল---ওনার তো দুই ছেলে, মেয়েও আছে, কোনদিন দেখিনি তো!
একটু চুপ থেকে সুষমা বললেন---হাঁটতে পারে না, চেয়ারে বসে থাকে, খাইয়ে দিতে হয়...সব কিছু করে দিতে হয়, কিছুই পারে না। বাইরে বেরোতে পারে না . এক্সিডেন্ট...অনেকদিন আগে...
গলার কাছে কেমন যেন ভাতগুলো দলা পাকিয়ে গেল নিতাইয়ের, আর খেতে ইচ্ছে করল না। ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। সুষমা দেখে বললেনও কি! ভাত খাও, মাছটুকু দিয়ে খেয়ে নাও। মাছের যা দাম!’ 
কথাগুলো শুনল নিতাই, কিন্তু মুখ নিচু করে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল, মুখে তুলতে পারছে না। কেন এমন হল, সে নিজেও বুঝতে পারছে না। সুষমা মাসি আবার বললেনবললাম তো, আচ্ছা ভাত টা থাক, মাছ, পোলাও আর মিষ্টিটা খাও, জন্মদিনের খাবার ফেলতে নেই, অকল্যাণ হয়। ওর তো সবই গেছে, আর অকল্যাণ বাড়িয়ে লাভ কি!
লজ্জ্বায় মাথা নিচু করেই রইল নিতাই। তারপর কোনরকমে পোলাওটা গলায় ঢুকিয়ে মিষ্টিটা মুখে পুরে উঠে পড়ল। আজ আর খাবার পর জল খাওয়ার কথা মনে পড়ল না, গেলাসের জল পড়ে রইল। বাইরে উঠোনের দিকটায় এসে হাত মুখ ধুয়ে নিল। একফালি রুমাল পকেট থেকে বের করে হাতমুখ মুছল। তারপর একবার এদিক-ওদিক তাকাল। কোনদিকে থাকে সেই মেয়েটা! বেরিয়ে এল নিতাই, গ্যারেজের দিকে পা বাড়াল।

(৩)
আজ রবিবার। একটু বেলা করেই উঠেছেন ভুবনবাবু, কয়েকটা জরুরী কাজ আছে, করে ফেলতেই হবে কিন্তু সকালবেলায় নিজের ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে মেজাজ হারালেন। তাঁর ঘরের সামনে একটা চেয়ারে মুন্নীকে কেউ বসিয়ে দিয়ে গেছে।  অথচ, তা করার কথা নয়। কে অমান্য করল তাঁর কথা? মুন্নীকে দেখতে তিনি চান না, আবার  সেই পুরনো দিনের যন্ত্রণার কথা তিনি মনে আনতে চান না, তাই নিষেধ করেছেন মুন্নীকে যেন তাঁর সামনে না আনা হয়, তিনি সহ্য করতে পারেন না সেই দৃশ্য। বারবার বলা সত্বেও কে এ কাজ করল, কে? অনেকদিনের রাগ যেন উঠে আসতে চাইল। কিছু বলতে যাবেন, দেখলেন সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে নিতাই। নিতাই ভিতরের ঘরে কেন, তার এতো সাহস হয় কি করে? কে তাকে এখানে ডেকে দিল, কে তাকে দেখাল ভিতরে আসার রাস্তা? নিতাই ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছে। চীৎকার করে উঠলেন সমস্ত শক্তি  দিয়ে ভুবনবাবু---তুমি এখানে কেন, কে আসতে বলেছে তোমাকে এখানে, এতো সাহস তোমার? যাও...যাও, নিচে যাও বলছি...!!!
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিতাই। অপমানে সারা শরীর তখন কুঁকড়ে গেছে, অথচ কাল সন্ধ্যেবেলায় তিনি নিজেই  বলেছিলেন নিতাইকে আসতে, এখানেই বসে কিছু কাজ সেরে নিতে চান, নীচে আর নামবেন না। তিনি কি তা ভুলে গেছেন? কিন্তু কিছু বলার আগেই একটা অদ্ভুত চীৎকার শুনে ডান দিকে ঘাড় ফেরালো নিতাই। দোমড়ানো মোচড়ানো সারাশরীর নিয়ে  একটা চেয়ারে কোনরকমে বসে আছে একটা মেয়ে, তার টলটলে মুখখানিতেও থুতনির নীচে আর ডান চোখের উপরে গভীর কাটা দাগ। সেই মেয়ের বিস্ফারিত চোখে জল, ঠোট কাঁপছে থর থর করে, আর জোরে জোরে মাথা নাড়ছে দুদিকে...যেন কিছু বলতে চাইছে......। বিস্ময়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল নিতাই। ভুলে গেল অপমান, ভুলে গেল ভুবনবাবুর চীৎকার। হঠাত যেন সম্বিত ফিরে পেলেন ভুবনবাবু মেয়েকে দেখে। নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারা করলেন, যাও। নিতাই কিছু বলতে কি চেষ্টা করছিল? ভুবনবাবু আবার তার দিকে চেয়ে বললেন-- নীচে বসো, আমি পরে আসছি।
ততক্ষনে মনোরমা মাসীমা, ভুবনবাবুর  এক ছেলের বৌ মঞ্জুলা এসে পড়েছেন চীৎকার শুনে। কেউ একজন এগিয়ে এসে  মেয়েটির চেয়ারটিকে ধরে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল। নিতাই সেদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এল নীচে। অদ্ভুতদর্শন, অসহায় মেয়েটি তাকে যেন কোথায় টেনে নিয়ে গেল!

এর পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। নিতাই প্রতিদিন গ্যারেজে আসে। দুপুরে ভাত খেতে ভিতরে যায়। ভাত খেয়ে বাইরে হাত  ধোয়। তারপর বারান্দার একটি কোনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সুষমা ভাতের থালা ইত্যাদি সব উঠিয়ে রেখে উপরে যান। দোমড়ানো, মোচড়ানো সারাশরীরের একটি মেয়ে শুধু তার কাটা দাগ ধরা টলটলে মুখখানি নিয়ে বারান্দায় এসে একবার দেখা দেয়। সুষমাই তাকে নিয়ে আসেন চেয়ারে করে, আবার ঘরে নিয়ে যান। নিতাই একবার দেখে গ্যারেজে ফিরে আসে নিজের কাজে।

ভালবাসা বড় অদ্ভুত!  কোথায়, কখন যে কাকে দেখা দেয়, তার অল্প একটু ছোঁয়ায় পূর্ণ হয় জীবন।
মুন্নী এখন ভাল আছে।