গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


    নীলাঞ্জনা

    পঞ্চাশ বছরের জীবনটাকে কোন চেনা ছকেই বাঁধতে পারেনি মনোতোষ । চুলে পাক ধরেছে অনেকদিন । লেখালেখি আর নাটক নিয়েই চলে গেলো দিনগুলো । কোন বিষাদ, বিষন্নতা কোন দিন তার মনে বাসা বেঁধেছিল কি না কেউ জানে না, হয়তো কাউকে জানতেই দেয়নি । একটা মাত্র পেট, কটা টিউশানি করে বেশ চলে যায় । টিউশানির বাজারে বেশ চাহিদা আছে মনোতোষের । তবে খুব বেশি টিউশানি করে না । দল বেঁধে পড়ুয়ারা পড়তে আসা তাও নয়, অত সময় কোথায় ? ক্লাস টেনের নিচের কাউকে সে পড়াতে চায় না । লেখালেখির সূত্রে কিছু উপার্জন হয় । এই দুই মিলে একলা জীবন বেশ চলে যায় । মনোতোষের নিস্তরঙ্গ জীবন-জলে কেউ কোন ঢিল ফেলেনি যে সামান্যতম ঢেউ খেলবে ।
     
পাড়ার চায়ের দোকানে বাপ্পার  সঙ্গে দেখা । বাপ্পা রবীন্দ্রপল্লীতে থাকে । দশ থেকে বারো  তিন বছর মনতোষ অঙ্ক শেখাতো বাপ্পাকে, এখন বোধয় কলেজের পাট চুকিয়েছে । ‘কেমন আছেন স্যার’ বলে মনতোষকে প্রণাম ঠুকে বললো -

স্যার আমাদের পাড়ায় একজন তার ছেলেকে অঙ্ক দেখানোর জন্য আপনাকে চাইছিলেন । ক্লাস সেভেনে পড়ে, যাবেন স্যার ? আমাদের পাড়ায় নতুন এসেছেন উনি, আগে বাইরে থাকতেন । 

- তুমি তো জানো বাপ্পা, আমি ক্লাস টেনের নীচের কাউকে পড়াই না ।
- বলেছিলাম স্যার ।
 - তাহলে ?
- বললেন, আমার কথা উনি না করবেন না, তুমি ওনার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দাও । উনি আপনাকে  চেনেন বলে মনে হলো স্যার । 

    অবাক হয়েছিল মনতোষ, তাকে কি করে চিনবে ! বাপ্পা তো বললো নতুন এসেছে, আগে বাইরে থাকতো । মনতোষ চুপ করে আছে দেখে বাপ্পা বললো ‘ঠিক আছে স্যার আমি কাল সকালে আপনাকে নিয়ে যাবো, কাল তো রবিবার । মনতোষ হ্যাঁ বা না কিছুই বললো না ।

    বাপ্পা মনতোষকে নিয়ে এলো । কলিং বেলে চাপ দিয়ে বললো,  আমি আর যাচ্ছি না স্যার, আপনি কথা বলে নিন । কাজের মেয়েটি দরজা খুলে আসুন বলে ভেতরে নিয়ে গেলো, বসতে বললো । বসার ঘর আভিজাত্য আর রুচির ছাপ স্পষ্ট । দামি সোফাতে রাখা খবরের কাগজে ডুব দিল মনতোষ । মিনিট তিনেক পরে তেরো চোদ্দ বছরের ছেলেকে নিয়ে গৃহকর্তৃ এলেন । বললেন “এর কথাই বলেছিলাম, আমার ছেলে শুভ্রদীপ, ক্লাস সেভেনে পড়ে । মনতোষের চোখ তখনো খবরের কাগজে । চোখ না তুলেই বললো, কিন্তু আমি তো নীচু ক্লাসের ছেলেদের পড়াই না । মৃদু কন্ঠে উত্তর, “তাও জানি, আর জানি, মানে বিশ্বাস করি আমার অনুরোধ আপনি ফেলবেন না । উত্তর পেয়ে অবাক হল মনতোষ । এমন অধিকারবোধ কোথায় পেলেন উনি ? বললো আমি বরং  ভালো কাউকে যোগাযোগ করিয়ে দিই । “না আমি চাই আপনিই আমার ছেলেকে পড়ান মনতোষ দা । কথায় ঘনিষ্ঠতার সুর, দৃঢ়তাও, যেন অনেকদিনের চেনা । চমকে উঠলো মনতোষ । চোখ তুলে তাকালো  “আপনি... । কথা শেষ হলনা,একই কন্ঠ বললো, আমাকে নীলাঞ্জনা বলেই ডাকতেন। আর ছাত্রীকে কেউ আপনি সম্বোধন করে না” ।
     
মুহুর্তে যেন একটা পর্দা সরে গেলো । অনেক কথা মনে পড়ে গেল । মনতোষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল । বিস্ময় আর হতবাক মনতোষ কোন কথা বলতে পারলো না। নিজের অজান্তেই তার প্রিয় একটা কবিতার পংক্তি “জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার”... গলার কাছে এসে থেমে গেলো, উচ্চারণ করতে পারলো না । সাহস হল না ।

    খুব উজ্বল ছাত্রী ছিল নীলাঞ্জনা । মনতোষ তখন সবে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে, নীলাঞ্জনার অঙ্কের টিউটর । অঙ্কে লেটার নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ওর বাড়িতেও মনতোষের খাতির বেড়ে গিয়েছিল । ওর মা চেয়েছিলেন গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত মনতোষই নীলাঞ্জনাকে পড়াক । মনতোষ রাজী হয়নি । তারপর নীলাঞ্জনাদের আর কোন সংবাদ মনতোষের কাছে ছিল না, শুধু জানা ছিল গ্রাজুয়েশনের পরেই ওর বাবা মা নীলাঞ্জনার বিয়ের ব্যবস্থা করেন আর স্বামীর চাকুরীর সূত্রে এলাহাবাদে চলে যায় । ওর বাবাও বদলি হয়ে যান বিহারের জামালপুর না কোথায় । সেই নীলাঞ্জনা তার সামনে দাঁড়িয়ে । কুড়ি বছর পরে যেন আরো স্নিগ্ধ, আরো পবিত্র । কপালে সিঁদুর না দেখেও কিছু জিজ্ঞাসা করলো না । অশোভন কৌতুহল মনতোষের কোনদিনই ছিল না । সন্বিত ফিরলো নীলাঞ্জনার কথায় “ এখনও থিতু হতে পারলেন না মনতোষ দা ! এ কথার কি উত্তর দেবে মনতোষ ? ঠোটের কোণে এক ঝিলিক শুকনো হাসিতে কোন উত্তর ছিল কি না, জানে না সে । নীলাঞ্জনাই আবার বললো “আপনার জন্য তো কেউ অপেক্ষা করলো না, শুধু আপনিই কার জন্য অপেক্ষা করে গেলেন মনতোষদা” ?

এ কথার কোন উত্তর মনতোষের জানা ছিল না । প্রসঙ্গ পালটাতে বললো “ কিন্তু তোমরা এখানে ...?
“তোমরা, মানে আমি আর আমার ছেলে শুভ্রদীপ । সে অনেক কথা মন্তোষ দা । গ্রাজুয়েশনের পরেই বাবা বিয়ের জন্য চাপ দিল । বিয়েতে তোমার আসার কথা ছিল না, আমিই বারণ করি তোমাকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করতে । সংসার আমারও হয়নি ।  শুভ্রদীপের জন্মের দু বছর পরে ওর বাবা চলে গেল, আমি ছেলেকে নিয়ে জামালপুরে চলে গেলাম বাবা মায়ের কাছে । গত বছর ক মাসের তফাতে দুজনেই চলে গেলেন আর আমি ভাসতে ভাসতে আমার পুরনো ভূমিতেই ফিরে এলাম” ।

মনতোষ নীলাঞ্জনার সেই কথাটা বুঝতে চাইলো, বুঝতে চাইলো তার নিস্তরঙ্গ জীবন-জলে নীলাঞ্জনার কথাটা কোন ঢেউ তুলে দিল কি না । 

 যাবার জন্য উঠলো মনতোষ । দরজার দিকে যেতে যেতে শুভ্রদীপের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো “আমি তাহলে সোমবার থেকেই আসছি’ । পেছনে নীলাঞ্জনার উজ্বল মুখমন্ডলে চিকিচিক করা চোখদুটো দেখতে পেলো না মনতোষ ।