গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭

শাশ্বতী সরকার



বিসর্গকাহিনী
 

শ্রীর জীবনে বিসর্গের ভূমিকাটা বরাবরই খুব উল্লেখযোগ্য। সতীন কাঁটার মত বিসর্গ তাকে ছেয়ে থাকে সর্বক্ষণ। প্রথম তার সাথে দেখা হয়েছিল দাদা মারা যাওয়ার পর। ঠাকুরদাকে শ্রী দাদা বলেই ডাকত। দুঃখের অনুসঙ্গে সেই প্রথম বিসর্গের সাথে মোলাকাত হয়েছিল শ্রীর। অথচ দাদার সঙ্গে তার স্মৃতিই বা কতটুকু! সেই কোন ছোটবেলায় ফ্রক পরা বয়সে দাদা পৃথিবীর মায়া কাটান। লাঠি হাতে হেঁটে বেড়ানোর দুটো দিনের স্মৃতি ছাড়া বাকী সব স্মৃতিতেই ছড়িয়ে আছে বিছানার সাথে মিশে যাওয়া সুবিশাল এক প্রাচীন বটবৃক্ষের অথর্ব দেহের ছবি। সে প্রাচীন তার আত্মজকে বিরামহীন ডেকে যান প্রিয় ডাকনামে কিন্তু নিষ্ঠুর দেওয়ালটুকু অতিক্রম করে তাঁর আত্মজ কোনদিনই আর পৌঁছতে পারেন না তাঁর কাছে। ঠিক যেভাবে সূতিকাগৃহ থেকেই যক্ষায় আক্রান্ত তাঁর স্ত্রীর সতৃষ্ণ নয়ন ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো সন্তানকে রেখে পৃথিবী ছেড়েছিলেন।দুলাল’ ‘ও দুলালনামের সে বিরামহীন করুণ আর্তনাদ শত টুকরো হয়ে এসে বিঁধত শ্রীর ছোট্ট বুকে, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারত না। যাওয়ার কালে অবশ্য কানে কৃষ্ণনাম আর মুখে সন্তান সন্ততির দেওয়া গঙ্গাজলটুকু পেয়েছিলেন তিনি। তাতে তাঁর স্বর্গলাভ হয়েছিল কিনা জানা নেই কিন্তু শ্রীর আকাশে আজীবন চিরউজ্জ্বল হয়েছিলেন তার দাদা। এরপর আবার বিসর্গ এসে জুড়ে বসে যখন দেখে তার ভাইয়ের ঘটা করে অন্নপ্রাশন হয়, প্রচুর ছবি ওঠে, দাদার কোলে বসা ফুলের গয়নায় সজ্জিত কাজলের টিপ পরা ছমাসের দিদির ছবিও দেওয়ালে জ্বলজ্বল করে কিন্তু তার জীবনে এই নামের কোন অনুষ্ঠানেরই অস্তিত্বই নেই। ছোট্ট শ্রীকে বিসর্গ আবার এসে ধাক্কা মারে , বলতে থাকেতুই ব্রাত্য, বুঝলি, তুই অনাকাঙ্খিত। তোর আবার কোনও দাম আছে নাকি?” শ্রী বুঝে পায় না কী উত্তর দেবে। এরপর আবার আসে বিসর্গ সামান্য একটা দুর্ঘটনায় শ্রীর নামের আগে যখনবিযোগ হয়ে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই শয়তান বিসর্গটা এসে ভেঙ্গাতে থাকে। শ্রী ছুটে পালিয়ে যায়, অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে বাঁচে। আস্তে আস্তে বিসর্গকে ভাল লাগতে থাকে শ্রীর, ওর সঙ্গেঁ বন্ধু পাতিয়ে ভাব করে নেয়। শ্রীর সমস্ত রচনার অনিবার্যভাবে বিসর্গ এসে পড়ে। সমকালও যেখানে যেখানে বর্জন করেছে বিসর্গকে এমনকি যেখানে হয়তো কোনদিন অস্তিত্বও ছিল না তার সেখানেও তাকে আদর করে এনে বসায় শ্রী। সমকাল রেগে গিয়ে থাবা বসায় শ্রীর দীর্ঘদিনের পরিশ্রমলব্ধ রচনার ওপর। নির্মম হাতে কুঠারের আঘাতে ছিন্ন করে দেয় বিসর্গের সঙ্গেঁ সকল সম্পর্ক। এবার কি তবে সুখের দিন এল! বড় মায়া হল শ্রীর। বিসর্গ ছিল বলেই সতীন কাঁটা জয় করে তাঁর সাথে মিলনেও বড় তৃপ্তি ছিল, বিসর্গহীন জীবন বড়ই পান্সে হয়ে যাবে না কি!