গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭

তাপসকিরণ রায়

 ধারাবাহিক

জবলপুর, হান্টেড কাহিনী--১২

অভিশপ্ত বসন্ত


একটা ছেলে নিচে দাঁড়িয়ে, সে যেন কারও সঙ্গে কথা বলছিল আর মুচকি মুচকি হাসছিল। ব্যাপারটা তখন আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। এটুকু জানা ছিল, যে কোয়াটারের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটা কথা বলে তাতে কেউ থাকে না। তবে, তবে ছেলেটা কার সঙ্গে কথা বলে ? ঘটনাটা পরিষ্কার হল কয়েক দিন পরে। সন্তোষ লেখা নগর কলোনির বাইরে থাকে ও এখানে কাজ করতে আসে। ও গ্যাস সিলিন্ডার এনে দেয়, লোকের ফাই ফরমাশ খাটে, দোকান-পাট হাত বাজার করে দেয়। ও ওর ফুরসত সময়ে আমাদের এখানে ঘুরতে এসেছিল। উদ্দেশ্য কিছু কাজ-কর্ম করার আছে কি না তা জানতে। আমি বললাম, না সন্তোষ, আজ তো কিছু কাজ নেই !
সন্তোষ বলল, তা হলে যাই, ঘরে যাই, নিজের ঘরের কাজ করি গিয়ে--
সন্তোষ এ কলোনির খবরাখবর রাখে। আমার একটা কথা ওকে জিজ্ঞেস করার ছিল, ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা সন্তোষ, এই সামনের ব্লকের গ্রাউন্ড ফ্লোরে তো কেউ থাকে না ?
সন্তোষ জানলার কাছে গিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, কোন ঘরের কথা বলছেন ? ওই যে সামনের খোলা জানালা দেখা যাচ্ছে সেটার কথা ?
আমি ওর পাশে এসে দেখে বললাম, হ্যাঁ।
সন্তোষ বলল, আপনারা এ কুয়াটারে আসার কদিন আগেই ওরা চলে গেছে। সে বিরাট ঘটনা সার, এই ঘরের মেয়েটা তো ফাঁসি দিয়ে মরেছে। ওই যে সামনে নতুন কলোনি তার কুয়াটারে একটা ছেলে আছেতার সঙ্গে মেয়েটার ভাব-ভালবাসা ছিল। মেয়েরা মুসলমান আর ছেলেরা হিন্দু। এ নিয়ে ভীষণ গণ্ডগোলছেলেটাকে তার বাড়ি থেকে ইন্দোরে পাঠিয়ে দিলো। মেয়েটাকে তার কলেজ ছাড়িয়ে দিয়ে ঘরে আটকে রাখত। তাই মেয়েটা ছেলেটার বিরহে আত্মহত্যা করলো।
আমি বললাম, সব তো বুঝলাম কিন্তু রোজ দেখি নিচে একটা ছেলে এসে অনেক ক্ষণ ধরে ওই জানলার সামনে দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে ?
সন্তোষ বলল, ওই তো মেয়েটার প্রেমিকা, ওর মাথার নাকি কিছু গণ্ডগোল হয়ে গেছে। ও নাকি রোজ সন্ধ্যায় এখানে আসে। ছেলেটা কারও সঙ্গে নাকি কথা বলছে না, ও নাকি শুধু তার প্রেমিকার সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে,  হাসে। অনেকে নাকি শুনেছে ওর কথা, কেমন আছো ? কাঁদছ কেন ? বা বা, খুব ভালো--এস না একবার জানলার কাছে--এমনি সব কথা বলে চলে ছেলেটা।
সন্তোষ একটু থেমে আবার বলল, আমি ওই খোলা জানলা দিয়ে উঁকি মেরে     দেখেছি। দেখেছি মেয়েটার একটা লাল ওড়না ঝুলে আছে। লোকে বলে ওই ওড়না গলায় দিয়েই নাকি নগমা ফাঁসি দিয়েছে !
আমি বলি, ভেতর থেকে মেয়েটার কথা কেউ শুনতে পায় না ?
--না, তা কেউ পেয়েছে বলে তো শুনিনি ! সন্তোষের কাছ থেকে গল্পটা মোটামুটি জানা হয়ে গিয়ে ছিল আমার। গল্পটা গুছিয়ে বললে এমনি দাঁড়ায়---

প্রীতম ও নগমা প্রেমিক-প্রেমিকা। ওরা জবলপুরের ডিফেন্স কলোনি, লেখা নগরের বাসিন্দা ছিল। অনেকেই জানে, ওদের প্রেম কথা।  কলোনিতে এসে ওরা উভয়েই এক প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়ে ছিল। সাধারণত ছোট বয়সের ছেলে মেয়েরা বড় উদার-উদাস থাকে। ওদের মনে সংকীর্ণ ভাব থাকে না। স্থানকালপাত্র জাতপাত উচ্চনীচ ধনী-দরিদ্র সব তাদের চোখে সমান  হয়ে থাকে। নিষ্পাপ ভালবাসার ভাবনায় ওরা সদাই আপ্লুত থাকেআর বড়রাও ছোটদের ভাবনার মাঝে এত জটিলতার মারপ্যাঁচ খুঁজে দেখতে যায় না।
সময়ের ধারায় প্রীতম ও নগমা এক সাথে বড় হতে লাগলো।  ঘরের গার্জিয়ানরা কেউ তাদের জীবনযাত্রার মেলামেশায় বিশেষ একটা বাধার সৃষ্টি করেনি। উভয়ের বাবা-মার মধ্যে সাধারণ মেলা মেশার কোন বাধা ছিল না। এমনি ভাবেই ওপরে ওপরে চলছিল উভয় পরিবারের মেলামেশা। কোন পক্ষই গভীর ভাবে ব্যাপাটাকে গ্রহণ করতে যায় নি। আর তা ছাড়া কোন জটিল পরিস্থিতির সামনাসামনি ওদের কারও আসতে হয়নি। এমনি ভাবে দীর্ঘ  সময় পার হয়ে গেলো।  এক সংগের পড়া শেষ করে  উভয়ের আলাদা আলাদা কলেজ হল।  এত দিনে প্রীতম ও নগমা বুঝতে পারলো যে ওরা উভয়ে উভয়কে ভালবাসে। ওরা কেউ  কাউকে ছেড়ে থাকতে পারছে না। এক জনের অনুপস্থিতি অপর জনকে বেশ পীড়া দিচ্ছে। ওরা ঘন ঘন একে অন্যের বাড়ি হাজির হচ্ছে। ঠিক এমনি সময় বোধহয় উভয়ের বাড়ির বাবা-মাদের টনক নড়ে উঠলো। ছেলে মেয়েদের মধ্যে প্রেম ভাবনার আঁচ করতে পেরে, তার পরিণতির কথা ভেবে ওরা যেন শিউরে উঠলো। নিজেদের জাতি ধর্মের পার্থক্যের ব্যাপারটা ওদের কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়ালো। মেয়ের বাবা মা, ছেলের বাবা মা, উভয় পক্ষ ছেলে ও মেয়ের উভয়ের মেলামেশায় বাধা দিল। এ দিকে প্রীতম ও নগমা বুঝতে পেরেছে যে ওরা উভয়ে উভয়ের দিকে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওরা পরস্পর পরস্পরকে সত্যি ভালবেসে ফেলেছে।  কিন্তু তা হলে কি হবে, ঘরের প্রচণ্ড চাপে ওরা তখন দিশাহারা হয়ে পড়েছে।
কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারছিল না, তবু থাকতে হচ্ছিল। ওদের কলেজের পড়াশুনা হচ্ছিল না। প্রীতম নিজের কলেজ ছেড়ে নগমার কলেজের আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। একটু সময় পেলেই ওরা লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করে। নগমার ঘর থেকে তার বাবা ও বড় দাদা বড় করা হয়, ওরা একদিন নগমার কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দেয়। নগমাকে তার বাবা শাসিয়ে দেয়, প্রীতম হিন্দু,  আমরা মুসলমান, আলাদা জাত ধর্মের। হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের মেয়ের বিয়ে হতে পারে না। তোর পড়া লেখার দরকার নেই। ঘর থেকে বের হলে তোর ঠ্যাং ভেঙে দেব ইত্যাদি ইত্যাদি। নগমার দাদা আরও রগচটা, বলে, নগমা বেশী বাড়াবাড়ি করলে প্রীতমের জান থাকবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি !
এদিকে প্রীতমের মা বাবা ছেলেকে আটকাতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না, সে সময়, সুযোগ পেলেই চলে যায় নগমার খোঁজে। এর মধ্যে নগমার বাবা ও দাদা তাদের বাড়ি এসে ধমকে গেছে, তোমরা জানো, মুসলমান হিন্দুর মধ্যে কখনও বিয়ে হয় না। তোমাদের ছেলে যেন আমাদের বাড়ির ধারেকাছে না আসে।  তাকে সাবধান করে দিও। জান তো, আমার বড় ছেলে বড় গুণ্ডা, ও কারও কথা মানে না। নগমার দাদা কোন কথা বলে না। সে কঠোর চেহারা বানিয়ে টানটান দেহ নিয়ে  প্রীতমদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে
বাবা মার অনেক অনুনয় বিনয়ে প্রীতম বাধ্য হয়ে জবলপুর ছেড়ে ইন্দোরে চলে গেল। ঠিক হল প্রীতম ওখানের কলেজেই পড়াশুনা করবে।
তারপর এক দিনের ঘটনা, মায়ের একটু আস্কারা থাকবে হয়ত, নগমা সে দিন লুকিয়ে প্রীতমদের ঘরের গিয়ে ছিল। ওর বাবা আর দাদা জানতে পেরে ভীষণ রেগে গিয়ে নগমাকে ঘরে বন্ধ করে রাখে। দিন ভর তাকে নাকি খেতে দেওয়াও হয়নি। আর সেদিন রাতেই ঘটে গেল ঘটনাটা। নগমা রাতেই ফাঁস নিলোসকালে জানা গেল, নগমা আর বেঁচে নেই।
পরদিন আর দেরী না করে চুপচাপ নগমার দেহর অন্তিম সংস্কার হয়ে গেল।  লোক জানাজানির ভয়ে, পুলিশের হুজ্জতের ভয়ে, নগমার দাদা ও বাবা মিলে এ ব্যাপারটা তড়িঘড়ি করে সেরে ফেলেছিল। আর দুদিন চুপচাপ কলোনিতে থেকে একদিন হঠাৎই নগমার পরিবার কলোনি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেল।
একটা ভালবাসার সমাধি এমনি ভাবেই ঘটে গিয়েছিল। জাতি বিদ্বেষের বিষম চেহারায় ভালবাসার বলি হয়ে গিয়েছিল।
প্রীতম তার প্রেমিকার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আর চুপ বসে থাকতে পারেনি। সে কাউকে না বলে ইন্দোর ছেড়ে ঘরে চলে আসে। ঘরে এসে সব ঘটনাই সে শুনতে পায়। প্রীতমের বাবা মাও মনে মনে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। তাঁদের দুঃখ ছেলের দুঃখের ভেতর দিয়ে আরও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছিল। ছেলেকে তাঁরা কিছুই বলেননি, বরং সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, ভবিতব্যের ওপর মানুষের হাত নেই, বাবা, তোমার মনকে শক্ত করতে হবে, বাবা !
প্রীতম একটাও কথা বলেনি, রাতভর চুপ থেকে শেষ রাতেই সে গিয়ে হাজির হয়েছিল নগমার ঘরে। নগমার বাবা দাদা জানতে পারে ওকে পিটিয়ে ঘরের বাইরে বের করে দিয়েছিলো ওকে শাসিয়ে দিয়ে ছিল, এ দিকে দেখতে পেলে ওকে ওরা জানে মেরে ফেলবে--
প্রীতম একটি কথাও বলেনি, ও শুধু কেঁদেছে, কখনও ও হাউমাউ করে, কখনও চীৎকার করে কেঁদে উঠেছে। বন্ধুদের কোন কথার সে জবাব দেয় নি--ও ইন্দোর থেকে আসার পরে কেউ তার মুখ থেকে একটা কথাও শুনতে পায়নি। কলোনির অনেকেই তার এমনি নীরব ব্যথায় ব্যথিত হয়ে পড়েছিল। উদভ্রান্ত প্রীতম এখন সারাদিন কোথায় যে ঘুরে বেড়ায়, কি করে, কেউ তা জানে না কেবল সন্ধ্যে হবার আগে ও ঠিক এসে হাজির হয় আমার পাশের নিচের কোয়াটারে। সে নগমাদের খালি ঘরের খোলা জানলা দিয়ে বারবার তাকায়, নগমার সঙ্গে কথা বলে, আপন মনে হাসে।
দিন সাত এমনি চললসবাই তাকে বোঝাতে চাইলো, নগমা মারা গেছে, ওকে তার কথা ভুলে যেতে বলল, আবার পড়ালেখায় মন লাগাতে বললমা বাবার একমাত্র ছেলে প্রীতম। ওর সুখের জন্যে একটা সময় ওরা নাজমাকে বৌ হিসাবে ঘরে নিতে রাজিও হয়েছিল কিন্তু কি হবে তাতে ? নগমার মা একটু নরম থাকলেও তার বাবা-দাদা ছিল ওদের বিয়ের ব্যাপারে চরম বিরোধী।
এমনি চলছিল। নগমা আজ দিন দশ হল মারা গেছে। সাত দিন হল, নগমাদের পরিবার কলোনি ছেড়ে চলে গেছে। আর এত দিন ধরে প্রীতম হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে--রোজ সন্ধ্যার আগে দিয়ে হাজির হচ্ছে নগমার সঙ্গে মিলতে। প্রীতম হয় তো বুঝতে পারছিলো, ধীরে ধীরে নগমার মৃত্যুর ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে আসছিল। কিন্তু সবচে বড় কথা ছিল, সে এখানে আসার পর থেকে এত দিনে একটা কথাও সে কারও সঙ্গে বলে নি--কেবল নগমার অশরীরী আত্মার সঙ্গে হয়ত তার কথা বিনিময় হয়েছে !
নগমা আজ বার দিন হল মারা গেছে। সে দিন মেঘলা আকাশ ছিল। প্রীতম হঠাৎ হাতে বই নিয়ে ছাদে গিয়ে হাজির হল। খোলা ছাদ হলেও নিচ থেকে তাকে ভাল ভাবে দেখা যাচ্ছিলো না কখনও মনে হচ্ছিলো, ও কিছু পড়ছে, আবার কখনও মনে হল ও বুঝি ব্যায়াম করছে। ব্যায়াম ভঙ্গিমায় সে বার বার ঝুঁকে দাঁড়াচ্ছিল কেন ? ঠিক  সন্ধ্যের আগের মুহূর্ত হবে, চারদিক স্তব্ধ হয়ে ছিল। কলোনিতে যেন নির্জনতা ঘিরে ছিল, আর ঠিক সেই সময় হঠাৎই আশপাশের লোকদের কানে কানফাটা  ভয়ংকর এক চীৎকার এসে আঘাত করল। সে সঙ্গে ভয়ঙ্কর এক পতনের শব্দ হল। সবাই ঘর থেকে  ছুটে বেরিয়ে এলো, ওরা দেখল, একটা লাশ মাটির সঙ্গে লিপ্টে উপুড় হয়ে পড়ে আছে চারদিক তার  রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
প্রীতমের নিষ্প্রাণ দেহটা মুখ থুবড়ে মাটির সঙ্গে লেগে আছে। চারদিকে তার রক্ত আর রক্ত। এদিকে সন্ধ্যের এক করুণ বিষণ্ণ স্তব্ধতা নেমে এসেছে, আকাশে ধোঁয়াটে মেঘ কুণ্ডলী পাকিয়ে আরও, আরও ওপরের দিয়ে উঠে যাচ্ছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে কেউ বা করা যেন সারা আকাশ জুড়ে হিংস্র রক্তের হোলী খেলে গেছে !
সমাপ্ত