গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭

নীহার চক্রবর্তী

একেশ্বর 


বন্ধু পঞ্চুর মা আবার বিয়ে করেছে । 
 এ খবর কেষ্ট ওর মাকে দিয়ে সকরুণ-মুখে বলল,’’ওমা, তুমিও তো আবার বিয়ে করতে পারো । পারো নাকি ?’’
কেষ্টর কথা শুনে তখন ওর মা এক-মুখ স্মিত হাসল । 
 পরে বলল,’’তা পারি না কেন ? খুব পারি । আর এ কোন দোষেরও নয় । কিন্তু ’’
‘’কিন্তু কেন,মা ? আমাকে বল এখুনি ।‘’ 
 বেশ আগ্রহের সঙ্গে কেষ্ট ওর মাকে বলল ।
ওর মা তখন অনাবিল হেসে উত্তর দিলো,’’তুই আমার বালক কেষ্ট । কোনোভাবে তুই আমার থেকে আঘাত পেলে আসল কেষ্ট কষ্ট পাবে । আমাকে পাপ দেবে ।‘’ 
মার কথা শুনে কেষ্ট কষ্টের হাসি হেসে বলল ,’’তা হোক । আমি বুঝি কম কষ্ট পেয়েছি বাবা পালিয়ে যাওয়ায় ? আর তুমি আমাকে কষ্ট দেবে না আমি জানি । খুব কষ্ট হয়,মা । খুব কষ্ট হয় । আমার বন্ধুরা ওদের বাবার সঙ্গে কি আনন্দে ঘুরে বেড়ায় ।‘’ 
 কেষ্টর মার দুচোখ ছলছল করে উঠলো সাথে-সাথে ।
অস্ফুট-গলায় উত্তর দিলো,’’ভাবি তবে ।‘’
মার কথা শুনে কেষ্টর বালক-মুখ কত না খুশিতে ভরে উঠলো ।
মকসুদের সঙ্গে কেষ্টর মার অনেকদিনের পরিচয় । 
কেষ্টর বাবা থাকতে সে প্রায়ই বাড়িতে আসতো । কেষ্টকে নিয়ে বাড়ির উঠোনে হেসে-হেসে ঘুরে বেড়াতো । শুধু তাই নয় । কেষ্টর বাবার অনেক ভুল সে ধরিয়ে দিতো । পরে এই ভুল ধরানোর কারণে দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কে ছেদ পড়ে যায় । তখন খুব কষ্ট পায় কেষ্টর মা ।
কেষ্টর বাবা বাড়ি থেকে পালানোর দুমাস পরেই মকসুদের বৌ সাপের কামড়ে মারা যায় । সে খবর শুনে কেষ্টর মা কেষ্টকে কোলে নিয়ে তার বাড়িতে ছুটে যায় । অনেক সান্ত্বনা দেয় মকসুদকে ।
তারপর থেকে পথে দেখা হতে থাকে । কেষ্টর মা যখন সকালে পরের বাড়িতে কাজে যায়,তখন মকসুদ মাঠে চাষের কাজে যায় মলিন-মুখে স্মিত হাসতে হাসতে ।
সেই মকসুদের কথাই মনে এলো কেষ্টর মার । ভেবে লজ্জাও পেলো খুব ।
কেষ্ট দেখে জিজ্ঞেস করে,’’হাসো কেন,মা ?’’
ওর মা তখন লজ্জার সুরে বলে্’’কিছু না । একটু অপেক্ষা কর ।‘’
কেষ্ট মার দিকে তখন অবাক-চোখে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ । এর দুদিন পরেই এক সকালে মকসুদের সঙ্গে কেষ্টর মার দেখা । 
সে নিজেই বেশ আগ্রহের সঙ্গে মকসুদকে বলে,’’এভাবে একা-একা থাকলে চলবে ? ঘর করতে হবে না আর ?’’
মকসুদ শুনে যারপরনাই বিস্মিত ।
বেশ কিছু সময় চুপ থেকে সে আমতা আমতা করে বলে,’’আর বিয়ে । কেই বা দেবে মেয়ে আমাকে । এই বেশ আছি বুড়ী মাকে নিয়ে ।‘’
বলেই মকসুদ মাথা নামিয়ে নেয় ।
কেষ্টর মা এরপর বলতে থাকে হেসে-হেসে,’’মেয়ের অভাব নাকি ? আর তুমি তোমার অবস্থা বুঝে মেয়ে দেখবে । কুমারী মেয়ের কথা ভাবো নাকি ?’’
মকসুদ এবার মুখ তুলে নিচু-গলায় বলে,’’তা নয় । কিন্তু তেমনই বা কোথায়,শুনি ?’’
‘’
জানি না যাও ।‘’
বলে কেষ্টর মা সাথ্র-সাথে একচোট হেসে তার কাজের পথে এগিয়ে যায় । বুঝি তখুনি সে কি এক দাগ রেখে গেলো মকসুদের বুকে ।
এই ঘটনার পনেরোদিন পরে মকসুদ এক বৃষ্টির দিনে এলো কেষ্টদের বাড়িতে । তার দুচোখ তখন বৃষ্টির জলকে ছাড়িয়ে ছলছল করছে ।
সবিস্ময়ে কেষ্টর মা তাকে জিজ্ঞেস করলো,’’কী হয়েছে গো তোমার ? ব্যাপারটা কিন্তু আমার ভালো ঠেকছে না । আমাকে খুলে বল সব ।‘’
তখন হঠাৎ মকসুদ কেষ্টর মার হাত ধরে বলল,’’মা আমার যায়-যায় । কেউ দেখার নেই মাকে । আমার আত্মীয়রা দেখেও দেখে না । কি যে করি এখন । তোমাকেই বা কিভাবে বলি ।‘’ 
সব দেখছিল কেষ্ট ঘর থেকে ও মকসুদের কথা শুনে বাইরে বেরিয়ে এলো । তারপর মকসুদের হাত চেপে ধরল ।
বলতে থাকলো মুখে এক-আকাশ হাসি নিয়ে,’’লজ্জা পাও কেন,কাকা ? আমরা দুজন আছি না ? আমরাই দেখবো তোমার মাকে । আমার তো ঠাম্মা নেই । এবার তাহলে ঠাম্মা পাবো ।‘’
‘’কিন্তু আমি যে মুসলমান । মানুষ ভুল বুঝবে না ?’’ 
মকসুদ একথা বলে উঠলে কেষ্টই অম্লান-হেসে বলে বসলো,’’আমি তো কেষ্ট,কাকা । আমাকে ভগবান বলতে পারো । তাই আমি মেনে নিলেই হবে মা তো আমার কথা শুনবেই । তাই না,মা ?’’ 
প্রথমে মকসুদের দিকে আর পরে মার দিকে কেষ্ট একথা বললে অলক্ষ্যে ঈশ্বর আর আল্লাহ্‌ একসাথে বুঝি হাসতে হাসতে তখনকার মতো বৃষ্টি থামিয়ে দিলো ।

সব নিন্দা আর তুচ্ছতা পেরিয়ে এখন কেষ্টর মা সাবেরা বেগম মকসুদের । আর কেষ্ট নিজে মন্দির আর মসজিদ দুইই সামলায় পরবে-পরবে । বেশ আছে ওর ঠাম্মা । কেষ্টর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে মাঝেমাঝে হেসে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে ।