গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০১৭

নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

অবুঝ মন 
      
"কি করে এটা সম্ভব ? আমার লেখার সাথে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক 'আগন্তুকের' লেখার মিল ? না এটা হতে পারেনা রচনা এটা ঠিক বলছে না লেখা একান্ত আমার এর সাথে কারও লেখার মিল থাকতেই পারেনা এটা আমার সম্পূর্ণ নিজের জীবনের কাহিনী এই কাহিনীর সাথে মিল হয়তো একজনেরই থাকতে পারতো ; কিন্তু সেই তো আজ আর এই পৃথিবীতে নেই দুই যুগেরও বেশী হয়ে গেছে সে শুধু আমাকেই ছেড়ে নয় ,এই পৃথিবী ছেড়েই অনেক দূরে ,বহুদূরে চলে গেছে যেখান থেকে কেউ কোনোদিনও আর ফিরে আসতে পারেনা
           একাকী জানালার কাছে বসে কথাগুলি ভাবতে ভাবতে বিপাশা ফিরে যায় সাতাশ বছর আগের কলেজ জীবনের দিনগুলিতে যাদবপুর উনিভার্সিটিতে সে আর তুষার বাংলায় এম . করছে তখন থেকেই বিপাশা একটু আধটু লেখালেখি শুরু করেছে আর ফাইনাল ইয়ারে ওঠার আগেই তুষারের দুটি গল্পগ্রন্থ বেরিয়ে গেছে সেই বই দুটি আজও বিপাশার আলমারীর শাড়ির ভিতর রয়েছে বিয়ের পর যখন সে অষ্টমঙ্গলায় বাড়িতে এসেছিলো তখনই বইদুটি সে নিয়ে এসেছিলো আজ সাতাশ বছর ধরে যক্ষের ধনের মত বই দুটিকে লুকিয়ে রেখেছে মাঝে মাঝে যখন সে একা ঘরে থাকতো তখন বইদুটি বের করে শুধুই তার পৃষ্ঠাগুলি উল্টে পাল্টে দেখতো বই যাতে পোঁকা না ধরে তারজন্য সে নিমপাতা বইয়ের ভাঁজেভাঁজে রেখে দিয়েছিলো কিন্তু এখন আর লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে বইদুটি বের করে দেখতে হয়না এখন সে সম্পূর্ণ একা এক বিশাল বাড়িতে মেয়ের বিয়ের পর জামাই এর সাথে মেয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যায় বিপাশার স্বামী ব্যাংকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন রিটায়ার করার 'মাসের মধ্যেই হার্টঅ্যাটাকে বিপাশাকে একা রেখে তিনিও চলে যান চিকিৎসা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ সুখেন্দু বিপাশাকে দেয়নি বছর খানেক হলো বিপাশা আবার ডাইরী ,কলম নিয়ে বসেছে এখন বিপাশার সময় কাটানোর একমাত্র সঙ্গী ডাইরী আর কলম
                 তুষার বিপাশা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসতো বিয়ে করে সুখী হওয়ার স্বপ্নও তারা দেখেছিলো তুষার থাকতো তার দূরসম্পর্কের এক পিসিমার বাড়িতে গ্রামে ছিলো তুষারদের বাড়ি এম . .করার জন্য কলকাতায় এসে পিসিমার বাড়িতে একখানা ঘর ভাড়া করে টাকার বিনিময়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করে সেখানেই থাকতো তুষারের কাছেই বিপাশা গল্প শুনেছে পিসিমার অৱস্থাও খুব একটা ভালো ছিলো না| পিসিমার একটি ছেলে ছিলো তুষারেরই বয়সী ; সে ছিল খুব মেধাবী তুষারদের গ্রামের বাড়িতে প্রচুর জমিজমা ছিলো খুব ধনী না হলেও স্বচ্ছপরিবার
              বিপাশা তুষার একসাথে সিনেমা দেখা ,ভিক্টোরিয়া ,চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়ানো ,ফুঁচকা খাওয়া --আজও মনে পড়লে বিপাশা ভাবে এই তো সে দিনের কথা বেশ ভালোই কাটছিলো দিনগুলি কিন্তুহঠাৎ করেই এম , .ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর তুষার  যেন কর্পূরের মোট উবে গেলো অনেক চেষ্টা করেও বিপাশা তার কোনো সন্ধান পেলোনা শেষের পরীক্ষার দিনগুলিতেও তুষার পরীক্ষার হলে ঢুকতো একদম ঘন্টা পড়ার পর কেমন যেন উদভ্রান্তের মত লাগতো তাকে| পরীক্ষা শেষ হলেই বিপাশার অগোচরে বেরিয়ে যেত একদিন বিপাশা দৌড়ে যেয়ে তুষারকে ধরে ,  
--- কি ব্যাপার বলোতো ? তুমি আজ কদিন ধরে এমন ভাব করছো যেন আমাকে চিনতেই পারছো না !
   --- না ,ঠিক তা নয় আসলে পরীক্ষা নিয়ে একটু টেনশনে আছি
   --- আমার যে তোমার সাথে খুব দরকারী একটা কথা আছে   
---এক্ষুণি বলবে ?   
---বাড়ি থেকে আমার বিয়ের জন্য ছেলে দেখছে| তুষার অনমনভাবে উত্তর দিলো ,"হ্যাঁ জানি তো !" 
---কি বললে ? তুমি কি করে জানলে ? আমি তো তোমায় কিছু বলিনি !  
--- না ,না ,আমি কি করে জানবো ? এই মাত্র তো তোমার কাছ থেকেই জানলাম |
    ---কি বলবো আমি এখন বাড়িতে ?
    ---আরে আগে পরীক্ষাটা শেষ হোক তারপর আমি যেয়েই নাহয় তোমার বাড়িতে প্রস্তাব দেবো তাঁরা তো আর পরীক্ষার মধ্যেই তোমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন না
|
  ---না তা নয় তবুও তোমার তো কথাটা জানা দরকার   ---চিন্তা কোরনা | দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে তারপরদিনই ছিলো শেষ পরীক্ষা পরীক্ষা শেষে তুষার এসে বিপাশার সামনে দাঁড়িয়ে তার হাতে তুষারের লেখা দ্বিতীয় বইটি "শুধু তোমারই জন্য " তুলে দিয়ে বলে ,"এটা তোমার গিফ্ট "
   ---গিফ্ট মানে ? তোমার আর একটা বই বেরিয়েছে ?   ---হ্যাঁ | প্রথমটাই তোমাকে দিলাম    
---
তুমি আমার বাবার কাছে কবে যাবে ?
   
---
তুষার আস্তে আস্তে বললো ," যাবো ,এর মধ্যেই যাবো তুমি ভালো থেকো আর হ্যাঁ - দু'একের মধ্যে না গেলে চিন্তা কোরনা "
              
বিপাশা তুষারের মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলে ,"কি হয়েছে তোমার ? কথাগুলি তোমার এরকম লাগছে কেন ? সত্যি করে বোলো নাগো ,কি হয়েছে ?" তুষার হেসে পড়ে "আরে কিছুই হয়নি তুমি ভালো থেকো , আসি "               
       বিপাশার সেদিন মনে হয়েছিলো তুষার জোড়করে তার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে তুষারের সাথে বিপাশার এই শেষ দেখা                                       
                     এই ঘটনার পর পাঁচ ,সাতদিন কেটে গেলো তুষার কিন্তু বিপাশাদের বাড়িতে আর গেলোনা পাগলের মত তুষারকে বিপাশা খুঁজে বেড়িয়েছে কিন্তু কোথায় তুষার ? তুষারের নিজের বন্ধুদের কাছে ,তুষারের দূরসম্পর্কের ওই পিসিমার বাড়ি  গ্রামের বাড়ির ঠিকানা জানতে চেয়েছে | কিন্তু কেউই তার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি আর পারবেই বা কি করে ? বিপাশাকেও তো সে কোনোদিন তার পিসিমার বাড়ি বা গ্রামের বাড়ির ঠিকানা বলেনি বহুবার বিপাশা তার কাছে জানতে চেয়েছে ,পিসিমার বাড়ির কথা কিন্তু কোনোদিনও তুষার তাকে ঠিক কোন জায়গাটায় পিসিমার বাড়ি সেটা বলেনি                           
             বাড়িতে বিয়ের জন্য নিত্য অশান্তি বিয়েতে মত না দিলে বিপাশার মা জলস্পর্শ করবেননা বলে দরজায় ছিটকেনি দিলেন সকলের চাপের কাছে বিপাশা শেষ পর্যন্ত বিয়েতে রাজী হয় বুকের যন্ত্রণার উপর একটা মস্তবড় পাথর চাপা দিয়ে সকলের সামনে সে হাসিমুখেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে কিছুতেই সে বুঝতে পারেনা তুষার তার সাথে কেনো এমন করলো ! বিয়ের প্রায় মাসখানেক পর খবরের কাগজে বিপাশা দেখে তুষারের ভারসিটির লাইব্রেরীর কার্ডের ছবিটা চমকে ওঠে কাগজটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে খবরটা পড়ে হাওড়া রেললাইনের উপর অপরিচিত এক যুবকের ট্রেনে কাটা লাশ পাওয়া গেছে মুখাকৃতি তার এতটাই বিকৃত হয়েছে যে তার পকেট থেকে পাওয়া ভার্সিটির কার্ডের সাথে মেলানো সম্ভব হচ্ছেনা| কার্ডে পাওয়া নাম অনুযায়ী মনে করা হচ্ছে - যুবকটির নাম তুষার মজুমদার                                  
             কাগজটি হাতে ধরে কতক্ষন এভাবে বিপাশা বসে ছিলো তা সে নিজেই জানেনা চোখেরজল পড়তে পড়তে একসময় তাও বন্ধ হয়ে যায় বিয়ের পর থেকেই সুখেন্দু অফিস চলে যাওয়ার পর স্নান সেরে সে খবরের কাগজটা নিয়ে শুয়ে পড়তো প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তো সংসারে তো মানুষ দুজন ; সে আর সুখেন্দু  বিয়ের মাসখানেক আগে সুখেন্দু চাকরী পায় কিন্তু তার পোস্টিং হয় কলকাতার বাইরে - কুচবিহার শ্বাশুড়িমা তার স্বামী ,শ্বশুরের ভিটা ছেড়ে আসবেন না তাই চাকরী পাওয়ার পরই তিনি ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন অন্ধকার ঘরে পেপার হাতে বিপাশা যেন জগতেই নেই বারবার কলিং বেলের আওয়াজ তার কানে যাচ্ছে কিন্তু পা দুটো তার যেন চলছে না অনেকক্ষন পর সে উঠে দাঁড়ায় ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দেখে সন্ধ্যা সাতটা তারমানে সুখেন্দু এসে গেছে | কোনো রকমে হেঁটে যেয়ে দরজাটা খুলে দেয় সুখেন্দু হেসে পরে জিজ্ঞাসা করে ," কিগো ঘুমিয়ে পড়েছিলে ?" অস্ফুট স্বরে বিপাশা উত্তর দেয় ," হ্যাঁ "             
     
       জীবনে এরপরে কি করে যে সাতাশটা বছর কেটে গেছে তা বোধকরি বিপাশা নিজেও জানেনা বিয়ের দুবছরের মাথায় তাদের একটি ফুটফুটে মেয়ে হয় নিজেরা দেখেশুনে প্রবাসী ছেলের সাথে মেয়ের বিয়েও দিয়ে দেয় মেয়ে ,জামাই অস্ট্রেলিয়াতেই থাকে তাদেরও একটি সুন্দর ,ফর্সা একদম মোমের পুতুলের মত মেয়ে হয়েছে যার বয়স এখন ছমাস নাতনীর জম্মের কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ্য ,স্বাভাবিক সুখেন্দু স্ট্রোকে মারা যায় সম্পূর্ণ একা হয়ে যায় বিপাশা মেয়ে বারবার করে তার কাছে চলে যাওয়ার জন্য বলেছে কিন্তু বিপাশা রাজী হয়নি  আবার তাই ডাইরী কলমকে সঙ্গী করেছে দু'একটা ম্যাগাজিনে ছোট গল্প লিখতে লিখতে হঠাৎই সে তার নিজের জীবনী লিখে ফেলে ছেলেবেলার বন্ধু রচনার সাথে তার নিত্য যোগাযোগ ডাইরীটা সে রচনাকে পড়তে দেয় কিন্তু রচনা তাকে অবাক করে দিয়ে ফোনে জানায় ,"তোর এই লেখাটার সাথে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক আগন্তুকের 'শেষ দেখার' হুবহু মিল রয়েছে "  " তোর কাছে আছে আগন্তুকের উপন্যাসটা ?"  " হ্যাঁ আছে তো ,আমি কাল নিয়ে তোর কাছে যাবো "
       পরদিন ঠিক সকাল এগারোটা নাগাদ রচনা তার ছোট নাতনীটিকে সাথে নিয়ে বিপাশার বাড়িতে আসে রচনা চিরকালই গল্প ,কবিতা পড়ার পোঁকা যাকে বলে কারও কোনো নুতন লেখা বেরিয়েছে জানতে পারলেই তা সে কিনবেই বলতে গেলে নিজের বাড়িটাকে ছোটোখাটো একটা লাইব্রেরী বানিয়ে ফেলেছে
     রচনারা চলে যাওয়ার পর বিপাশা বইটা নিয়ে বসে গল্পের নাম "শেষ দেখা" লেখক আগন্তুক বিপাশা শুয়ে শুয়ে বইটা পড়তে শুরু করে তার লেখা "উত্তর পাইনি" আর আগন্তুকের লেখা "শেষ দেখা"- ঘটনা এক শুধু লেখাটাই অন্যভাবে বিকালের আগেই খাপছাড়া ,খাপছাড়া ভাবে বিপাশা পুরো উপন্যাসটাই শেষ করে পার্থক্য শুধু একজায়গাতেই তার নিজের লেখা গল্পটি বিয়োগান্তক আর আগন্তুকের লেখা উপন্যাসটি মিলনাত্মক ঘটনার বিস্তৃত বিবরণে বিপাশার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিই কল্পনার সাহায্যে এক সুন্দর মাত্রা এনে দিয়েছেন আগন্তুক বিপাশা ভাবতে থাকে - কে এই আগন্তুক ? কি করে এটা সম্ভব হলো ? জানতেই হবে আমাকে ! আমার জীবনের খুঁটিনাটি ঘটনাসমূহ তিনি কি করে জানলেন ?                             
      পরদিন ভোরবেলা বিপাশা ঠিক করে প্রথমে সে প্রকাশকের কাছে যাবে সেখান থেকে সে জোগাড় কোরবে আগন্তুকের বাড়ির ঠিকানা যে ভাবেই হোক এই লেখকের সাথে তাকে দেখা করতেই হবে         
      ভোরবেলা উঠে স্নান ,খাওয়া সেরে সে বেরিয়ে পরে কলেজ স্ট্রিটের 'মানবী' প্রকাশক সংস্থার উর্দ্দেশ্যে অলিগলি অনেক হাঁটাহাঁটির পর সে পৌঁছায় সঠিক জায়গায় দুপুর বারোটার আগে প্রকাশক সংস্থার মালিক আসেননা অগত্যা বসেবসে পুরানো দিনগুলিতে ফিরে যাওয়া ভিক্টোরিয়ায় ফুচ্কা খেতে যেয়ে টকজলটা পরে যেয়ে যে বিপাশার হলুদ শাড়িতে দাগ লেগে গেছিলো - সেটা তো তুষার ছাড়া আর কেউই জানেনা ! তাহলে লেখক আগন্তুক কিভাবে এইরূপ একটি ঘটনা তার উপন্যাসে এনে দাঁড় করলেন ? এইরূপ আরও অনেক ঘটনা যা তুষার ছাড়া আর কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয় ..... তার ভাবনায় ছেদ পরে হঠাৎ কারও কথায় --    
---আপনি আমার জন্য বসে আছেন ?     
---হ্যাঁ ,আমি এই প্রকাশক সংস্থার মালিকের সাথে একটু কথা বলতে চাই        ---হ্যাঁ ,আমিই মালিক বলুন আপনি কি জানতে চান ?       ---আপনার এখন থেকে লেখক আগন্তুকের সব লেখা ছাপা হয় আপনি যদি দয়া করে তার ঠিকানাটা আমায় দেন ,তাহলে খুব উপকৃত হবো।        
---
কিন্তু এইভাবে অনুমতি ছাড়া আমরা কোনো লেখকের ঠিকানা দিতে পারিনা                         অনেক কাকুতি ,মিনতি ,অনুনয়বিনয় শেষে নিজের দুটি হাত জড়ো করে লেখক আগন্তুকের ঠিকানা মিললো বিপাশারকলেজ স্ট্রীট থেকে বেশি দূরে নয় তবুও তাড়াতাড়ির জন্য বিপাশা একটি টাক্সিই নিলো প্রকান্ড এক বাড়ির সামনে এসে ট্যাক্সি দাঁড়ালো বাইরে থেকে বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে একটি বিশাল বাংলো লেখকবাবু বাড়িতে আছেন কিনা জানতে চাওয়ায় দাড়োয়ান মাথা নাড়িয়ে 'হ্যাঁ' বলে একটা কাগজের চিরকুট হাতে ধরিয়ে দিলো বিপাশার বিপাশা নিজের নাম আর বাবার পদবীটা লিখে দাড়োয়ানকে চিরকুটটা ফেরৎ দিল খানিক বাদে ফিরে এসে বিপাশাকে সঙ্গে নিয়েই লেখকবাবুর ঘর দেখিয়ে দিলো বাড়ির সামনে এসে যখন ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়েছিলো তখন বিপাশা দেখে গেটের কাছেই প্রাচীরের গায়ে শ্বেতপাথরের উপর কালো রঙ্গে লেখা বাড়ির নাম 'প্রতীক্ষা'              
      বিপাশা এসে পর্দা সরাতেই অপর প্রান্ত থেকে গলা ভেসে এলো ,  
---পদবীটা ভুল আছে ;ওটা মিত্র হবে দাস পদবীটা সাতাশ বছর আগেকার পদবীটা না লিখলেও শুধু নামেই আমার চিনতে কোনো অসুবিধা হতনা      .        
বিপাশা পর্দা ধরে সেখানেই দাঁড়িয়ে হাঁটতেই যেনো সে ভুলে গেছে "তুষার - তূষার বেঁচে আছে?" নিজেকেই নিজে বিপাশা প্রশ্ন করে তার গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হয়না এতগুলো বছর বাদেও তুষারের গলা চিনতে বিপাশার বিন্দুমাত্র ভুল হয়না বিপাশা ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে দেখে তুষার এগিয়ে এসে বিপাশাকে বলে ," কি হলো ? ভিতরে এসো "  
        
    তুষারের কথাগুলি এতটাই স্বাভাবিক লাগে বিপাশার যেন রোজ তার সাথে বিপাশার দেখা হয় ,কথা হয় বিপাশা আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় মুহূর্তে তার মাথাটা ঘুরে যায় তুষার তাকে ধরতে গেলে সে নিজেকে সামলে নেয় তুষার একগ্লাস জল তার হাতে ধরিয়ে দেয় গ্লাসটা হাতে ধরেই বিপাশা বসে   থাকে ; যেন কিভাবে জল খেতে হয় তা পর্যন্ত সে ভুলে গেছে তুষার খুব আস্তে করে বলে,"জলটা খেয়ে নাও "
     বেশ কিছুক্ষন দুজনেই চুপচাপ থাকার পর নীরবতা ভেঙ্গে বিপাশায় তুষারকে জিজ্ঞাসা করে ,
---কেন করলে আমার সাথে এরকম ?
--- কোনো উপায় ছিলোনা যে পিসিমার কাছে আমি থাকতাম সেই পিসীমার ছেলে সুখেন্দু প্রথমদিন পরীক্ষা দিয়ে যখন নিজের ঘরে ফিরি ; তখন পিসীমা একটি ছবি এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন ,' এই মেয়েটার সাথে সুখেন্দুর বিয়ে ঠিক করছি ,দেখতো মেয়েটা দেখতে কেমন ?' ছবিটার দিকে তাঁকিয়ে দেখি তোমার ছবি মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো তখন সুখেন্দু তখন সবে চাকরী পেয়েছে ,ভালো চাকরি ,উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না খুব ভালো ছেলে সে প্রায় সমবয়সী আমরা মনকে শান্তনা দিলাম - তোমায় যখন ভালোবাসি ,তোমার সুখই আমার সুখ সুখেন্দুর সাথে বিয়ে হলে তুমি খুব সুখী হবে তাই তোমার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম সত্যি বলোতো সেই মুহুর্তে আমার আর কি করার ছিল ? আমি তখন বেকার ,এদিকে তোমার বাড়িতে বিয়ের সম্মন্ধ দেখছেন আমার স্বল্প বুদ্ধিতে মনে হয়েছিলো যেহেতু আমি তোমায় ভালোবাসি ; তুমি সুখী হলেই আমি ভালো থাকবো "
---আর আমার ভালোবাসা ? তার কোনো মূল্যই তো দিলেনা ?
--- তুষার চুপ করে বসে থাকে বিপাশা তাকে আবারও একই প্রশ্ন করে                          
--- তুমি সুখেন্দুকে ভালোবেসে সুখী হয়েছিলে কিন্তু বিপাশা
   ---ওটাকে ভালোবাসা বলেনা  ওকে বলে জীবনে কাউকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার জন্য এ্যাডজাষ্টমেন্ট আর একসাথে থাকতে থাকতে মানুষটার প্রতি মমত্ববোধ ,সহনুভূতি ,কর্তব্য ; যেটাকে বাইরে থেকে দেখে অনেকে ভালোবাসা বলে ভুল করে হ্যাঁ ,এইভাবে থাকতে থাকতে পরস্পরের প্রতি একটা ভালোবাসা তৈরী হয় ! কিন্তু সেটা জীবনের প্রথম ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ প্রকৃত ভালো তো একবারই বাসা যায় তুষার ,সমস্ত মন ,প্রাণ উজাড় করে যদি পরস্পরের কেউ একের জীবন থেকে অন্যে হারিয়ে গেলেও মনের ভিতর তারজন্য একটা জায়গা থেকেই যায় - যা শূন্য অবস্থায় সারাটাজীবন পরে থাকে , সে একাকিত্বকে সঙ্গ দেয় , চোখের জল ঝরায় ,বুকটাকে মাঝে মাঝে মরুদ্যান করে তোলে ,বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় তার ফেলে আসা অতীত জীবনে তুমি আমার ভালোবাসাকে যদি সামনাসামনি প্রত্যাখ্যান করতে তাহলে হয়তো এত কষ্ট আমি পেতামনা ; কিন্তু আমার ভালোবাসা নিয়ে তুমি ছিনিমিনি খেলেছো নিজের মনের মত করে নিজের মনগড়া ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়েছো ,আমার মনের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দাম দেওয়া তো দূরের কথা - জানতেও চাওনি জানি আজ এই কথাগুলি বলে কোনো লাভ নেই ,কিন্তু তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি - কারণ কি জানো ? তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার, এখানে আসার পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত কোনো চিড় ধরেনি "         
     তুষার অন্যমনস্কভাবেই উত্তর দেয় ,"আমিও তোতোমায় সেই একই রকম ভালোবাসি তাইতো তোমার সব খবর আমার জানা আমি বিশ্বাস করতাম ,মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত হলেও তোমার সাথে আমার দেখা হবে আর সেই অপেক্ষাতেই আমি ছিলাম পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেরদিনই আমি গ্রামে ফিরে যাই তোমাদের বিয়ের সময় পিসীমা সুখেন্দুকে জানিয়ে দেই আমার শরীর খুব খারাপ তাই বিয়েতে উপস্থিত হতে পারবোনা আস্তে আস্তে সুখেন্দুর সাথে যোগাযোগটাও বন্ধ করি আর তোমাদের খবর রাখার জন্য পিসীমার সাথে যোগাযোগটা বাড়িয়ে দেই কলকাতার কলেজ এবং স্কুলগুলিতে চাকরীর আশায় তখন সমানে ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছি আর অন্যদিকে সবকিছু ভুলে থাকার জন্য লেখার পিছনেই বাকি সময় ব্যয় করতে লাগলাম একবার কলকাতায় ইন্টারভিউ দিতে আসার সময় আমার মানিব্যাগটা পকেটমারী হয়ে যায় ঘটনাচক্রে ওই পকেটমার রেললাইনে কাটা পরে মারা যায় সমস্ত আত্মীয়স্বজন,পরিচিত মানুষ ,পাড়াপ্রতিবেশী সকলের কাছে আমি মারা গেলাম আমার কাছে সেটা শাপে বড় হলো সেদিন যে ইন্টারভিউটা দিতে গেছিলাম সেই চাকরীটাও আমি পেয়ে গেলাম এখনো মাসতিনেক চাকরী আছে পিসীমার কাছ থেকেই খবর পেলাম তোমার আর সুখেন্দুর মেয়ে তৃষার জম্মের মা ,বাবা মারা যাওয়ার পর গ্রামের বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করে পাকাপাকি ভাবে আমার এই 'অপেক্ষা' তৈরী করলাম পিসীমা মারা যাওয়ার পর আমি ফেসবুক ঘেটে ঘেটে সুখেন্দুর একাউন্ট বের করে সেখান থেকেই তোমাদের যাবতীয় খবরাখবর নিতাম তৃষার বিয়ের খবরও আমি ওখান থেকেই পাই এরপর তৃষার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয় আমিই তাকে বলি আমাকে কাকু বলে ডাকতে তার কাছ থেকেই আমি সুখেন্দুর মৃত্যুর খবর পাই আর এও জানতে পারি কলকাতায় তুমি এখন একই ওই বাড়িতে ..."        তুষারের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিপাশা হাতে তালি দিয়ে বলে উঠলো ,
    ---- বাহ্ তুষার বাহ্ ....সত্যি তোমার তুলনা নেই !পুরো রামায়ণ শুনিয়ে গেলে আমায় ! সাতাশ বছর ধরে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যেয়ে আমার অগোচরে নিত্য আমার খবর রেখে তুমি আমায় কি প্রমান দিতে চাইছো ? তুমি কত মহান ? নাকি তুমি আমায় কত ভালোবাসো ? ভুল করেছিলাম আমি ,তোমায় আমি চিনতে পারিনি ! আসলে তুমি তোমার মনগড়া জীবনে বাস করো ! তুমি এক মানসিক রোগী !" - বলেই বিপাশা উঠে দাঁড়ায়
    সকরুণ স্বরে তুষার বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলে ,"বিপাশা, কি বললে তুমি ? আমি মানসিক রোগী ? সারাটা জীবন ধরে আমি অপেক্ষা করলাম যারজন্য সে আমায় বলছে আমি মানসিক রোগী !
--- আর কি বলার আছে বলোতো ?
---আচ্ছা বিপাশা ,একটা কথা আমায় বলতো ? তোমায় ভালোবেসে ,তোমায় সুখী দেখতে চেয়ে সারাজীবন ধরে কষ্ট আর যন্ত্রনা ছাড়া আমি কি পেলাম ?
     কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বিপাশা বাইরের দিকে পা বাড়ায়
---চলে যাচ্ছ ? রাত হয়ে গেছে আজ নাইবা গেলে ?
--- তা আর হয়না তুষার একজন পরপুরুষের বাড়িতে রাত কাটালে লোকে আমায় কি বলবে ? জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পিছনে ফেলে এসেছি যে প্রশ্নের উত্তরটা আমার অজানা ছিলো ,যা আমাকে তিলেতিলে দগ্ধ করেছে - এতগুলো বছর বাদে তার সব উত্তর আমার পাওয়া হয়ে গেছে আজ থেকে আমার আর কোনো কষ্ট নেই তোমার সাথে আমার আর কোনোদিন দেখা হবেনা তুমি ভালো থেকো
    বিপাশা বেরিয়ে গেলো তুষার হতভম্বের মত তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বলতে লাগলো ,ভুল বুঝলে বিপাশা ,খুব ভুল বুঝলে ! ওই সময় আমি ছিলাম অসহায় আমার কিছুই করার ছিলোনা আমার চাকরী পেতে বেশ কিছুদিন লেগেছে সুখেন্দু না হোক অন্য কোনো ছেলের সাথে তোমার বাড়ির লোক বিয়ে দিতোই আমার মত এক বেকার ছেলের চাকরী পাওয়ার আশায় তোমায় বসিয়ে রাখতো না স্বীকার তুমি না করলেও আমি জানি তুমি খুব সুখী হয়েছিলে ভালো থেকো তুমিও এখন থেকে আমায় শুধু ঘেন্নায় কোরো