গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭

সুধাংশু চক্রবর্ত্তী / দুটি গল্প

 এবার দেখ তোরা   

বারো বছরের জন্য বনবাসকালে সপাণ্ডব ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যখন কাম্যক বনে অধিষ্ঠান করছেন তখনই একদিন মহর্ষি মার্কণ্ডেয় এসে উপস্থিত হলেন । পাণ্ডবগণ তাঁকে সমাদরে বসিয়ে পূজোআর্চা করার পর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কথাপ্রসঙ্গে মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে শুধোন – হে মুনিবর, আমার মনে প্রায়শই কিছু প্রশ্নের উদয় হয় । পুরুষ যে-সকল শুভ-অশুভ কর্মের আচরণ করে তার ফল তারা কীভাবে ভোগ করে এবং ঈশ্বর কীভাবে কর্ম নিয়ন্ত্রণ করেন ? মানুষ কী কারণে সুখ বা দুঃখ পায় অনুগ্রহ করে বলুন মুনিবর ।

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বলেন – “শুনুন ধর্মরাজ , এই ব্রহ্মাণ্ডে সর্বপ্রথম প্রজাপতি ব্রহ্মা উৎপন্ন হন । তিনি জীবদের জন্য নির্মল ও বিশুদ্ধ শরীর গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে শুদ্ধ ধর্মজ্ঞান উৎপন্নকারী উত্তম শাস্ত্র গঠন করেন । সেই কালে সকলেই উত্তম ব্রত পালন করতো এবং তাদের কোনো সংকল্পই ব্যর্থ হতো না । সব মানুষই ব্রহ্মভূত, পুণ্যাত্মা এবং দীর্ঘায়ু হতো । সকলে স্বচ্ছন্দে আকাশে বিচরণ করে দেবতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতো এবং পুনরায় নিজ ধামে ফিরে আসতো । তারা নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী জীবিত থাকতো অথবা মৃত্যু বরণ করতো । কালের গতিতে মানুষের আকাশে বিচরণ একদিন বন্ধ হয়ে যায় । তারা পৃথিবীতেই বিচরণ করতে থাকে । তাদের ওপর কাম-ক্রোধ অধিকার কায়েম করে । তারা ছল-কপটতা শিখে লোভ  ও মোহের বশীভূত হয় । তাই নিজের শরীরের ওপর তাদের আর কোনো অধিকার থাকে না । তাদের কামনা, সংকল্প এবং জ্ঞান সবই নিষ্ফলে যায় । স্মরণশক্তি ক্ষীণ হয় । একে অপরকে সন্দেহ করে কষ্ট দিতে থাকে । এইভাবে পাপকর্ম করে পাপীরা তাদের কর্ম অনুসারে আয়ু ক্ষীণ করে ফেলে । ইহজগতে মৃত্যুর পর জীবের গতি তার কর্ম অনুসারেই হয়ে থাকে । কোনো প্রাণী ইহলোকে সুখ পায় পরলোকে দুঃখ । আবার কেউ সুখ পায় পরলোকে এবং ইহকালে দুঃখ । তোমরা তপস্যা এবং সদাচারে সর্বদাই তৎপর এবং শূরবীর । এখন যে কষ্ট পাচ্ছো তারজন্য তোমরা দুঃখ কোরো না । এই দুঃখ তোমাদের ভবিষ্যতে সুখের কারণ হবে ।

এক নাম না জানা অসুর সব কথা শুনেছে আড়াল থেকে । সব শুনে সে মনেমনে বলে , “রইলো আপনার পাপাচার মুনিবর । আমরা যা ইচ্ছে হয় তাই করবো । রইলো আপনাদের পরলোক । কে দেখেছে ঐ পরলোক ? আমরা জীবিতকালেই সর্বপ্রকার সুখভোগ করে যাবো । আমাদের আকাশে বিচরণ করার ক্ষমতা হরণ করে নিলে কীহবে আমরাও একদিন বায়ুযানে চেপে আকাশে বিচরণ করবো । মহাকাশ পরিভ্রমণ করবো । এমনকি গ্রহান্তরেও যাবো নিজেদের ইচ্ছেমতো । হা হা হা ।

ব্রহ্মা তার মনের কথা পড়ে হেসে বলেন – “তথাস্তু । সাধে কি আর কলিকাল বানিয়েছি রে বোকা । এবার জানতে পারবি কি কি লিখে দিলাম  তোদের ওই সুখের কপালে ।”  



আক্রোশ

ভবানীচরণ এক প্রহরকাল মাথা ঘামাইয়াও সন্মুখে খুলিয়া রাখা খাতাখানির সাদা পৃষ্ঠায় ঝর্ণাকলমের কালির একটিও আঁচড় বসাইতে পারিলো না । সে অতিশয় দুঃখে ঝর্ণাকলমটি গৃহকক্ষের মেঝের ওপর সজোরে আছড়াইয়া ফেলিয়া উষ্মা প্রকাশ করিলো । কলমখানি মেঝের উপর একবার গোঁত্তা খাইয়া অনতিদূরে আছড়াইয়া পড়িয়া বার দুয়েক আন্দোলিত হইয়া একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেল । তাহাতে ভবানীচরণের মধ্যে কোনো আবান্তর পরিলক্ষিত হইলো না । সে নিষ্কলঙ্ক খাতাখানি পুস্তকের আলমারির ওপর তুলিয়া রাখিয়া শয্যার ওপর টানটান হইয়া শুইয়া পড়িলো ।

শয্যায় শুইয়া বিস্ফোরিত নয়নে চাহিয়া রহিলো গবাক্ষের বাহিরের অন্ধকারে । সহসা এক ঝাঁক দুরন্ত বাতাস আসিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িলো সুসজ্জিত কক্ষের ভিতর । লহমায় লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল কক্ষের যাবতীয় বস্তু । ভবানীচরণের কবিতার খাতাখানিও বাদ গেল না । উপরন্তু বাতাসের সাহচর্য পাইয়া খাতাখানি ডানা মেলিয়া ক্ষণকাল উড়িয়া বেড়াইলো কক্ষের ভিতর । তাহাকে উড়িতে দেখিয়া ভবানীচরণের মনে হইলো কোনো ধবল ক্রৌঞ্চ ভ্রমবশত তাহার কক্ষে প্রবেশ করিয়াছে ।

উহা দেখিয়া ক্রৌঞ্চ লইয়া একটি কবিতার উদয় হইলো তাহার নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্কে । কবিতাটি এক্ষুনি এক্ষুনি লিখিতে না পারলে ভুলিয়া যাইবার প্রবল সম্ভাবনা রহিয়াছে ভাবিয়া ভবানীচরণ দ্রুত গাত্রোত্থান পূর্বক ভূলুণ্ঠিত খাতাখানি তুলিয়া আনিলো । অহরহ কতশত কাব্যকাহিনীই না ঘাই মারিতে থাকে তাহার অলস মস্তিষ্কে । আলস্যতার দরুণ সেসব লিখিয়া খাতাবন্দী করিয়া ফেলিতে পারে না বলিয়া তাবৎ কাব্যকাহিনী বিলীন হইয়া যায় শতসহস্র ভবনার ভিড়ে ।

ভবানীচরণ ভাবিয়া দেখিলো এই মুহূর্তে যে-কবিতাটি তাহার মনমন্দিরে জাগরিত হইয়াছে তাহাকে যেনতেন প্রকারেণ লিখিয়া ফেলিতে হইবে । নচেৎ উহাও হারাইয়া যাইবার প্রবল সম্ভাবনা রহিয়াছে । সেইমতো ভূলুণ্ঠিত ঝর্ণাকলমটি পুনরায় হস্তগত করিয়া কবিতাটি খাতার পাতায় বন্দী করিতে গিয়া দেখিলো ঝর্ণাকলমটি দ্বারা কোনোমতেই লেখা সম্ভব হইতেছে না । পরম আক্রোশে আছড়াইয়া ফেলিবার দরুন উহার নিবখানা ভোঁতা হয়ে গিয়েছে ।