গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক

জবলপুর, হান্টেড কাহিনী--৯

রাত যখন একটা


ঈপ্সিতা ও প্রবালের মধ্যে ভাব ভালবাসা ছিল, একথা সবাই জানতো। অনেকেই ওদের এক সঙ্গে ঘুরতে দেখেছে। পার্কে, নির্জন স্থানে, ওদের কেউ কেউ বসে গল্প করতেও দেখেছে। ঘরে প্রবালের মা-বাবাও এ কথা জানেন। এমন কি ঈপ্সিতা কয়েকবার প্রবালদের ঘরে ঘুরে গেছে। প্রবালের মাকে মাসিমা বলে প্রণাম করে গেছে। একমত সব ঠিকঠাক ছিল যে  প্রবালের বিয়ে ঈপ্সিতার সঙ্গেই হবে বলে। ঈপ্সিতার  ঘর থেকেও এ ব্যাপারে কোন রকম আপত্তি ছিল না।  
ইতিমধ্যে এক দিনের ঘটনা। ঈপ্সিতার সঙ্গে প্রবালের মন কষাকষি হয়ে গেলো।  
প্রবাল বলে উঠলো, না আমি পারবো না--
ঈপ্সিতা বলল--তা বললে হবে না, তোমায় পারতে হবে। অন্য জাগায় ঠিক হয়ে যাবে আর তুমি চুপ করে বসে থাকবে ?
ওদের কথায় বার্তায় বোঝা যাচ্ছিলো, ঈপ্সিতার ঘর থেকে তার জন্যে অন্য ছেলে দেখছে। কিন্তু কেন ?
প্রবাল জানে, ঈপ্সিতার মা বাবাও জানেন যে ওদের বিয়ে এক মত ঠিক হয়ে আছে। তা ছাড়া ওদের মেলামেশা তো অনেকদিন আগে থেকেই চলে আসছে।
প্রবাল রাগত বলে উঠলো, তোমার মা, বাবা তো আমাদের সম্পর্ক মেনে নিয়ে ছিলেন জানি, তাহলে কেন আজ অন্য ছেলে দেখার প্রশ্ন ওঠে ?  
--সে যাই হোক--তুমি এসে আমার মা বাবাকে বল, তাদের বোঝাও যে তুমি থাকতে অন্য ছেলে যেন তাঁরা না দেখেন--
প্রবাল বলে ছিল, না আমি পারবো না--কয়েকটা দিন যেতে দাও--
ঈপ্সিতা রেগে গিয়েছিল, না কালই তুমি আসবে--
রাগের মাথায় প্রবাল বলে দিয়েছিল, না কাল পারবো না--
ব্যাস, ঈপ্সিতা ফোন কেটে দিয়েছিল।
প্রবালের মেজাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সব কিছুই তো ভালো চলছিল তার মধ্যে এই বাধা ? সে দিন রাতে প্রবালের ঘুমাতেও বেশ দেরী হয়ে গেলো। শেষ রাতের দিকে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল তার, ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে, কি বলছ মা ?
মার গলা কাঁপছিল, বললেন, হ্যাঁ ঠিক বলছি বাবা, ঈপ্সিতার এক্সিডেন্ট হয়েছে, তারপর কেঁদে উঠলেন মা, সে নাকি মারা গিয়েছে--
শেষ রাত। প্রবাল ঝিম মেরে বসে থাকল--ও  কি করবে এখন ?
মা বললেন, তোর মেজো মাসি এই মাত্র খবরটা দিলো। পুলিশ ঈপ্সিতাকে নাকি এখন মর্গে নিয়ে রাখবে।
স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রবাল। এত রাতে কিছু করার নেই। মনে মনে ওর খুব খারাপ লাগছিল। ঈপ্সিতার সঙ্গে কালকের খারাপ ব্যবহারের কথা তার মনে পড়ছিল। ওর ভেতর থেকে একটা কান্না ঠেলে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছিল। কি করবে প্রবাল এখন ? যাবে নাকি একবার ঈপ্সিতার মা-বাবার কাছে ? তাতে কি হবে ? প্রবাল বিছানায় চুপচাপ বসে থাকলো। অতীতের সমস্ত স্মৃতি মনের মাঝে তার ছুটে বেড়াচ্ছে। মুহুর্মুহু ঈপ্সিতার মুখটা তার চোখের সামনে জেগে উঠছিল।
ঠিক এমনি সময়ের কথা, প্রবালের মোবাইলে টুং করে ম্যাসেজের ঘণ্টি বেজে উঠলো। এত রাতে কার ম্যাসেজ হবে ? মোবাইল তুলে নিয়ে চোখ রাখতেই সে আশ্চর্য চকিত হয়ে গেলো--ঈপ্সিতার ম্যাসেজ--জানো আমি এক অদ্ভুত জাগায় এসে পড়েছি। আমি গাড়িতে বসে ছিলাম। হঠাৎ একটা ভীষণ শব্দ শুনতে পেলাম। আর কিছু জানি না। এখন দেখছি আমি অন্ধকারে পড়ে আছি !
প্রবাল চকিত হল, মোবাইলের স্ক্রিনে  সে ঝটপট লিখল, তুমি কোথায় ?
বেশ কিছু সময় ওপার থেকে আর কোন সাড়া এলো না. প্রায় পনের মিনিট যেন পনের ঘণ্টা বলে প্রবালের মনে হতে লাগলো, তার বিশ্বাস ঈপ্সিতা বেঁচে আছে। হঠাৎ আবার ঠুং করে শব্দ হল, প্রবাল ত্রস্তে মোবাইল হাতে তুলে নিয়ে দেখল, ঈপ্সিতার ম্যাসেজ--এখন ভাল লাগছে, আমি চাইলে আলো দেখতে পারছি--
--তুমি হসপিটালে ?
--না, তা তো বলতে পারবো না ! ওসব জানি না, এই মুহূর্তে তোমার কথাই ভাবছি।
--তুমি কোথায় ?
--জানি না, আমাকে তোমার কথা ভাবতে দাও--
আবার স্তব্ধতা। আর ম্যাসেজ নেই। শেষ রাতে আর ঘুম এলো না, প্রবালের মনে হল ঈপ্সিতা নিশ্চয় বেঁচে আছে। সব খবরই তা হলে মিথ্যা ?
সকালে সব কিছুই জানতে পারলো প্রবাল। ঈপ্সিতার দেহ বিকেলের দিকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল। প্রবাল গেলো শ্মশান ঘাটে। ওই তো ঈপ্সিতা শায়িতা। খানিক দূর থেকে তার মনে হল, এখনো সামান্য সাজ-সজ্জা লেগে আছে তার দেহে। আরও কাছে এগিয়ে গেলো প্রবাল। সত্যি কি ঈপ্সিতা মরে গেছে ! তার দেহের প্রায় সবটাই ঢাকা কিন্তু তার মুখমণ্ডল কেন এমন তরতাজা মনে হচ্ছে ! ওর হঠাৎ যেন মনে হল, ঈপ্সিতা নড়েচড়ে উঠলো--ও চোখ খুলে দেবে না তো ? না আর পারছে না প্রবাল, সে দূরে সরে গেলো। সেখান থেকেই ও দেখল তার চোখের সামনে তার প্রেমিকা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে !
সবকিছু পুড়ে ছাই হতে দেখল প্রবাল। ঈপ্সিতা আর কথা বলতে পারবে না। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, তবে কোন ঈপ্সিতা তার সঙ্গে কথা বলল ? রহস্য থেকেই যায়, পৃথিবীতে অনেক রহস্যই আছে যার সমাধান নেই। মাঝ রাতে, ঠিক রাত একটায় প্রবালের ঘুম ভেঙে গেলো। ঠুং ঠ্যাং শব্দ হয়ে চলেছে মোবাইলে, তার মানে ম্যাসেজ আসছে ! প্রবাল এক লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। ঝট করে মোবাইল হাতে নিয়েই ম্যাসেজ বাক্স খুলে দেখল, হ্যাঁ ঈপ্সিতার ম্যাসেজ--ঘুমিয়ে পড়েছ ? আমায় পুড়ে যেতে দেখলে আজ ? ভেবেছ আর আমি ম্যাসেজ করবো না ? কি হল, ঘুমচ্ছ কেন ? আমি ম্যাসেজ করে যাচ্ছি আর তুমি ঘুমিয়ে যাচ্ছ ? ওঠো, ওঠো
প্রবাল কি করবে এখন বুঝতে পারছে না। কিছু সময় চুপ থেকে শেষে সে লিখল, তুমি সত্যি ঈপ্সিতা ? নাকি অন্য কেউ ?
--কেন তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না ? নাম্বার মিলিয়ে নাও --
--তুমি কোথা থেকে বলছ ? আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করতে পারি ?
--আমি কোথায় আছি তা আমি নিজেই বলতে পারবো না। তবে তোমার সঙ্গে ম্যাসেজে কথা বলতে পারছি এটাই আমার সুখ--
এ ব্যাপারে প্রবাল কাউকে কিছু বলতে গেলো না। ঈপ্সিতার অস্তিত্ব ব্যাপারে সে কোন খোঁজ খবর নিলো না। এখন সে প্রতিদিন রাত একটায় ঈপ্সিতার সঙ্গে, ম্যাসেজে কথা বলে। সুখ দুঃখের কথা, নিজেদের প্রেমের কথা, প্রেমের খুনসুটির কথা, এমন কি ওদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথাও হয়।
দিন এগিয়ে যায়, ওদের মধ্যে প্রেমের গল্প, ছোঁয়াছুঁয়ি ভাবনার কথা, দাম্পত্য জীবনের উত্তেজিত কথা, সব হয়। একটা নেশা প্রবালকে পেয়ে বসে। তার নিত্যনৈমিত্তিক রাত্রি যাপনের জীবন যেন দাম্পত্য জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘরের সবাই চিন্তিত, ওরা জেনে গেছে এ সব ঘটনার কথা। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না এটা কি করে সম্ভব ? এমনি অস্বাভাবিক ঘটনা সমাজ সংসারের পক্ষে ভাল লক্ষণ নয়। এমনি করে একটা বছর কেটে গেলো, একদিন হঠাৎ প্রবাল মাঝ রাতে দেখতে পেলো তার হ্যাঙ্গারে রাখা শার্ট প্যান্টগুলি কেউ যেন সরিয়ে নিচ্ছে। সেগুলি হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। সে তাকাল। প্রথমটায় কিছুই তার চোখে পড়লো না. ঘরের এক কোন থেকে খুট খাট শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। সে দিকে তাকাতেই প্রবাল দেখতে পেলো, একটা মেয়ে অনেকটা ঈপ্সিতার মতই দেখতে, তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মেয়েটি মৃদু মৃদু হাসছিল। ঠিক এমনি সময়, রাত একটা বাজলো আর টুং টাং শব্দ করে ম্যাসেজ আসা শুরু হল। প্রবাল হতবাক হয়ে গেলো, সে ভাবল, অরে ঈপ্সিতা তো চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তবে এ কার ম্যাসেজ আসছে ! মোবাইল খুলে সে দেখল, ঈপ্সিতার ম্যাসেজ, সে লিখেছে সাবধান, এ কিন্তু আমি নই--
--তবে ? প্রবাল ভয় পেয়ে ঘরের মেয়েটির দিকে তাকাল কিন্তু কৈ ? ঘরে তো কেউ নেই, সেই মেয়েটি ভ্যানিস হয়ে গেছে !