গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭

৬ষ্ঠ বর্ষ ১৯তম সংখ্যা ১৭ই অগস্ট ২০১৭

এই সংখ্যার লেখকসূচি - তাপসকিরণ রায়, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, সুধাংশু চক্রবর্তী, নীহার চক্রবর্তী, সোনালি ভট্টাচার্য মুখার্জী, মৌসুমী ঘোষ দাস, পার্থ রায় ও শান্তিময় কর ।


   সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করুন

 

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক

জবলপুর, হান্টেড কাহিনী--৯

রাত যখন একটা


ঈপ্সিতা ও প্রবালের মধ্যে ভাব ভালবাসা ছিল, একথা সবাই জানতো। অনেকেই ওদের এক সঙ্গে ঘুরতে দেখেছে। পার্কে, নির্জন স্থানে, ওদের কেউ কেউ বসে গল্প করতেও দেখেছে। ঘরে প্রবালের মা-বাবাও এ কথা জানেন। এমন কি ঈপ্সিতা কয়েকবার প্রবালদের ঘরে ঘুরে গেছে। প্রবালের মাকে মাসিমা বলে প্রণাম করে গেছে। একমত সব ঠিকঠাক ছিল যে  প্রবালের বিয়ে ঈপ্সিতার সঙ্গেই হবে বলে। ঈপ্সিতার  ঘর থেকেও এ ব্যাপারে কোন রকম আপত্তি ছিল না।  
ইতিমধ্যে এক দিনের ঘটনা। ঈপ্সিতার সঙ্গে প্রবালের মন কষাকষি হয়ে গেলো।  
প্রবাল বলে উঠলো, না আমি পারবো না--
ঈপ্সিতা বলল--তা বললে হবে না, তোমায় পারতে হবে। অন্য জাগায় ঠিক হয়ে যাবে আর তুমি চুপ করে বসে থাকবে ?
ওদের কথায় বার্তায় বোঝা যাচ্ছিলো, ঈপ্সিতার ঘর থেকে তার জন্যে অন্য ছেলে দেখছে। কিন্তু কেন ?
প্রবাল জানে, ঈপ্সিতার মা বাবাও জানেন যে ওদের বিয়ে এক মত ঠিক হয়ে আছে। তা ছাড়া ওদের মেলামেশা তো অনেকদিন আগে থেকেই চলে আসছে।
প্রবাল রাগত বলে উঠলো, তোমার মা, বাবা তো আমাদের সম্পর্ক মেনে নিয়ে ছিলেন জানি, তাহলে কেন আজ অন্য ছেলে দেখার প্রশ্ন ওঠে ?  
--সে যাই হোক--তুমি এসে আমার মা বাবাকে বল, তাদের বোঝাও যে তুমি থাকতে অন্য ছেলে যেন তাঁরা না দেখেন--
প্রবাল বলে ছিল, না আমি পারবো না--কয়েকটা দিন যেতে দাও--
ঈপ্সিতা রেগে গিয়েছিল, না কালই তুমি আসবে--
রাগের মাথায় প্রবাল বলে দিয়েছিল, না কাল পারবো না--
ব্যাস, ঈপ্সিতা ফোন কেটে দিয়েছিল।
প্রবালের মেজাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সব কিছুই তো ভালো চলছিল তার মধ্যে এই বাধা ? সে দিন রাতে প্রবালের ঘুমাতেও বেশ দেরী হয়ে গেলো। শেষ রাতের দিকে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল তার, ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে, কি বলছ মা ?
মার গলা কাঁপছিল, বললেন, হ্যাঁ ঠিক বলছি বাবা, ঈপ্সিতার এক্সিডেন্ট হয়েছে, তারপর কেঁদে উঠলেন মা, সে নাকি মারা গিয়েছে--
শেষ রাত। প্রবাল ঝিম মেরে বসে থাকল--ও  কি করবে এখন ?
মা বললেন, তোর মেজো মাসি এই মাত্র খবরটা দিলো। পুলিশ ঈপ্সিতাকে নাকি এখন মর্গে নিয়ে রাখবে।
স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রবাল। এত রাতে কিছু করার নেই। মনে মনে ওর খুব খারাপ লাগছিল। ঈপ্সিতার সঙ্গে কালকের খারাপ ব্যবহারের কথা তার মনে পড়ছিল। ওর ভেতর থেকে একটা কান্না ঠেলে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছিল। কি করবে প্রবাল এখন ? যাবে নাকি একবার ঈপ্সিতার মা-বাবার কাছে ? তাতে কি হবে ? প্রবাল বিছানায় চুপচাপ বসে থাকলো। অতীতের সমস্ত স্মৃতি মনের মাঝে তার ছুটে বেড়াচ্ছে। মুহুর্মুহু ঈপ্সিতার মুখটা তার চোখের সামনে জেগে উঠছিল।
ঠিক এমনি সময়ের কথা, প্রবালের মোবাইলে টুং করে ম্যাসেজের ঘণ্টি বেজে উঠলো। এত রাতে কার ম্যাসেজ হবে ? মোবাইল তুলে নিয়ে চোখ রাখতেই সে আশ্চর্য চকিত হয়ে গেলো--ঈপ্সিতার ম্যাসেজ--জানো আমি এক অদ্ভুত জাগায় এসে পড়েছি। আমি গাড়িতে বসে ছিলাম। হঠাৎ একটা ভীষণ শব্দ শুনতে পেলাম। আর কিছু জানি না। এখন দেখছি আমি অন্ধকারে পড়ে আছি !
প্রবাল চকিত হল, মোবাইলের স্ক্রিনে  সে ঝটপট লিখল, তুমি কোথায় ?
বেশ কিছু সময় ওপার থেকে আর কোন সাড়া এলো না. প্রায় পনের মিনিট যেন পনের ঘণ্টা বলে প্রবালের মনে হতে লাগলো, তার বিশ্বাস ঈপ্সিতা বেঁচে আছে। হঠাৎ আবার ঠুং করে শব্দ হল, প্রবাল ত্রস্তে মোবাইল হাতে তুলে নিয়ে দেখল, ঈপ্সিতার ম্যাসেজ--এখন ভাল লাগছে, আমি চাইলে আলো দেখতে পারছি--
--তুমি হসপিটালে ?
--না, তা তো বলতে পারবো না ! ওসব জানি না, এই মুহূর্তে তোমার কথাই ভাবছি।
--তুমি কোথায় ?
--জানি না, আমাকে তোমার কথা ভাবতে দাও--
আবার স্তব্ধতা। আর ম্যাসেজ নেই। শেষ রাতে আর ঘুম এলো না, প্রবালের মনে হল ঈপ্সিতা নিশ্চয় বেঁচে আছে। সব খবরই তা হলে মিথ্যা ?
সকালে সব কিছুই জানতে পারলো প্রবাল। ঈপ্সিতার দেহ বিকেলের দিকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল। প্রবাল গেলো শ্মশান ঘাটে। ওই তো ঈপ্সিতা শায়িতা। খানিক দূর থেকে তার মনে হল, এখনো সামান্য সাজ-সজ্জা লেগে আছে তার দেহে। আরও কাছে এগিয়ে গেলো প্রবাল। সত্যি কি ঈপ্সিতা মরে গেছে ! তার দেহের প্রায় সবটাই ঢাকা কিন্তু তার মুখমণ্ডল কেন এমন তরতাজা মনে হচ্ছে ! ওর হঠাৎ যেন মনে হল, ঈপ্সিতা নড়েচড়ে উঠলো--ও চোখ খুলে দেবে না তো ? না আর পারছে না প্রবাল, সে দূরে সরে গেলো। সেখান থেকেই ও দেখল তার চোখের সামনে তার প্রেমিকা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে !
সবকিছু পুড়ে ছাই হতে দেখল প্রবাল। ঈপ্সিতা আর কথা বলতে পারবে না। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, তবে কোন ঈপ্সিতা তার সঙ্গে কথা বলল ? রহস্য থেকেই যায়, পৃথিবীতে অনেক রহস্যই আছে যার সমাধান নেই। মাঝ রাতে, ঠিক রাত একটায় প্রবালের ঘুম ভেঙে গেলো। ঠুং ঠ্যাং শব্দ হয়ে চলেছে মোবাইলে, তার মানে ম্যাসেজ আসছে ! প্রবাল এক লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। ঝট করে মোবাইল হাতে নিয়েই ম্যাসেজ বাক্স খুলে দেখল, হ্যাঁ ঈপ্সিতার ম্যাসেজ--ঘুমিয়ে পড়েছ ? আমায় পুড়ে যেতে দেখলে আজ ? ভেবেছ আর আমি ম্যাসেজ করবো না ? কি হল, ঘুমচ্ছ কেন ? আমি ম্যাসেজ করে যাচ্ছি আর তুমি ঘুমিয়ে যাচ্ছ ? ওঠো, ওঠো
প্রবাল কি করবে এখন বুঝতে পারছে না। কিছু সময় চুপ থেকে শেষে সে লিখল, তুমি সত্যি ঈপ্সিতা ? নাকি অন্য কেউ ?
--কেন তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না ? নাম্বার মিলিয়ে নাও --
--তুমি কোথা থেকে বলছ ? আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করতে পারি ?
--আমি কোথায় আছি তা আমি নিজেই বলতে পারবো না। তবে তোমার সঙ্গে ম্যাসেজে কথা বলতে পারছি এটাই আমার সুখ--
এ ব্যাপারে প্রবাল কাউকে কিছু বলতে গেলো না। ঈপ্সিতার অস্তিত্ব ব্যাপারে সে কোন খোঁজ খবর নিলো না। এখন সে প্রতিদিন রাত একটায় ঈপ্সিতার সঙ্গে, ম্যাসেজে কথা বলে। সুখ দুঃখের কথা, নিজেদের প্রেমের কথা, প্রেমের খুনসুটির কথা, এমন কি ওদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথাও হয়।
দিন এগিয়ে যায়, ওদের মধ্যে প্রেমের গল্প, ছোঁয়াছুঁয়ি ভাবনার কথা, দাম্পত্য জীবনের উত্তেজিত কথা, সব হয়। একটা নেশা প্রবালকে পেয়ে বসে। তার নিত্যনৈমিত্তিক রাত্রি যাপনের জীবন যেন দাম্পত্য জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘরের সবাই চিন্তিত, ওরা জেনে গেছে এ সব ঘটনার কথা। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না এটা কি করে সম্ভব ? এমনি অস্বাভাবিক ঘটনা সমাজ সংসারের পক্ষে ভাল লক্ষণ নয়। এমনি করে একটা বছর কেটে গেলো, একদিন হঠাৎ প্রবাল মাঝ রাতে দেখতে পেলো তার হ্যাঙ্গারে রাখা শার্ট প্যান্টগুলি কেউ যেন সরিয়ে নিচ্ছে। সেগুলি হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। সে তাকাল। প্রথমটায় কিছুই তার চোখে পড়লো না. ঘরের এক কোন থেকে খুট খাট শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। সে দিকে তাকাতেই প্রবাল দেখতে পেলো, একটা মেয়ে অনেকটা ঈপ্সিতার মতই দেখতে, তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মেয়েটি মৃদু মৃদু হাসছিল। ঠিক এমনি সময়, রাত একটা বাজলো আর টুং টাং শব্দ করে ম্যাসেজ আসা শুরু হল। প্রবাল হতবাক হয়ে গেলো, সে ভাবল, অরে ঈপ্সিতা তো চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তবে এ কার ম্যাসেজ আসছে ! মোবাইল খুলে সে দেখল, ঈপ্সিতার ম্যাসেজ, সে লিখেছে সাবধান, এ কিন্তু আমি নই--
--তবে ? প্রবাল ভয় পেয়ে ঘরের মেয়েটির দিকে তাকাল কিন্তু কৈ ? ঘরে তো কেউ নেই, সেই মেয়েটি ভ্যানিস হয়ে গেছে !
                                                                



ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

বাঁচা 


তিনটে হাঁসের ছানাকে টানতে টানতে উঠোনের একপ্রান্তে ভাঙ্গা টালি দিয়ে ঘেরা একচিলতে খুপরিতে ঢোকাতে গিয়ে ওপারে ইঁটের গাঁথনি করা নতুন বাড়িটার দিকে তাকাল রহিমা।  রহিমার উঠোন বলতে একেবারেই এক চিলতে ভাঙ্গাবেড়ার উঠোন। একপাশ দিয়ে নর্দমার জল বয়ে যাচ্ছে। হাঁসগুলো সেখান থেকে কিছু খুঁটে খাওয়ার চেষ্টা করতেই এক তাড়া লাগাল রহিমা। তারপর জোর করে হাঁসগুলোকে খুপরীর মধ্যে টেনে ঢুকিয়ে একটা ভাঙ্গা ঝুড়ি মুখটায় আটকে দিল। এবার সে নিশ্চিন্ত। হাত ধুয়ে এসে বসল উঠোনের একদিকে, যেখানে একটা জুঁইঝাড় লটকানো আছে  দড়ি দিয়ে ছাদের টালির সঙ্গে। একটু ঘেরা,আড়াল মত হয়ে রয়েছে। তারপর অপলকে চেয়ে রইল নতুন বাড়িটার দিকে।
 
রহিমা বিবি বছর খানেক হল বেওয়া হয়েছে। তার স্বামী জয়নাল বয়সে কুড়ি বছরের বড় ছিল বটে কিন্তু অমন একখানা জোয়ান সারা গাঁয়ে খুঁজলেও পাওয়া যেত না। সেই জোয়ান মদ্দ মানুষটা শহর থেকে ফিরবার পথে
  রোদ লেগে একদিন  পটাশ করে মরে গেল রাস্তার উপরে। আর পড়বি  তো পড় একেবারেই গাঁয়ে ঢুকবার মুখে। জোয়ানের অমন মিত্তু কে কবে দেখেছে!
রহিমা, জয়নালের সদ্য বেওয়া, বছর তিরিশের যুবতী রহিমা অনেক বুক চাপড়ালো, অনেক দুঃখের কান্না কাঁদলো, আছাড়ি-পিছাড়িও কম করল না। সব কিছুর শেষে,সব কিছুকে বিফল করে  জয়নালের জানাজা বেরোল। সেই থেকে রহিমা এই ভাঙ্গা বেড়ার মধ্যে নিজেকে নিয়ে থাকে, একেবারে একা। প্রথম প্রথম পাড়ার বৌ-ঝিরা এসে বসত, তারপর রহিমার উদাসীন মুখ দেখে তারাও একে একে মুখ ফিরিয়ে নিল, আর আসে না।  রহিমার উদাসী মুখ এখন শুধু একদিকেই চেয়ে থাকে, ঐ রাস্তার ওপারে নতুন গাঁথনি  করা ইঁটের বাড়ির দিকে।

ও বাড়ির মালিক শফিকুল,  একটা ছোট পাঁউরুটি কারখানার মালিক  বয়সে যুবক, কিন্তু বুকের ব্যামো আছে, সে হাঁপায়, তাঁর হাঁপানীর রোগ আছে, ক্ষয়াটে চেহারা। রহিমা শুনেছে, এই রুগী সহজে মরে না। 
রহিমা বাঁচতে চায়
, এয়োতী হয়ে, তার বড় সাধ!


সোনালি ভট্টাচার্য মুখার্জী

পুরোনো পাড়ার রহস্য



সকালের রোদটা এখনও একই রকম বেঁকে আসে এই রাস্তায় । পুনপুন আস্তে আস্তে
লেকের পাড় ধরে হেঁটে যেতে যেতে ভাবেন ; কিছু ছোটবেলা টিকে থাকে এ রাস্তা,
এই রোদের সঙ্গে।পেট্রল পাম্পের কাছাকাছি এসে রাস্তা পার । ডান দিকের ফুটপাথ
ধরে,বড় পোস্টঅফিস পেরিয়ে হাঁটতে থাকেন। যতীন দাস রোডের মোড় অব্ধি আজ
টার্গেট।

ওজন বাড়ছে বলে ডাক্তার সকালে হাঁটতে বলেছেন। ভালই লাগে পুনপুনের। এই
পাড়ায় বড় হয়েছেন। সবাইকে চেনেন। বাবা মার আদরে গোবরে ছিলেন যখন, তখন
পুনপুন বা খুকি বলত দোকানদাররা। সেই ফ্রকপরা বেলায়।পরে দিদি, এখন মাসি,
বা বেশির ভাগই আন্টি বলে।মন্দ লাগে না।ইস্কুলেও স্টুডেন্টদের থেকে ওই
সম্বোধনটাতেই ত অভ্যস্ত। এসে পৌঁছে গেছেন যতীন দাস রোড লেখা গলির মোড়ে ।

এ পাড়ার ফুটপাথদের দেখলেই অনায়াসে বোঝা যায় কলকাতা কতটা কসমোপলিটান। বড়
রাস্তার দুধারের সারি সারি খাবারের দোকান দেখে তো বটেই, ফুটপাথের এধারে
ওধারে ও। এদিকে কলা পাতার ওপর ধোসা ইডলির ঠেলাগাড়িতে দক্ষিন ভারত, তো
ওদিকে শাল পাতার বাটিতে পুরি ঘুগনি গরম জালেবি। একটু এগোলেই ধোকলা, দহি
বড়া, সামোসা, কচুরি । পশ্চিম, উত্তর,উপর নিচ, দেশের কোন দিকের খাবার বাকি
নেই।

      যা ভিড় সব কটা দোকানে, সব রাজ্যের মানুষ যে তৃপ্তি করে খেয়ে দেয়ে
দিব্যি খুসি হয়ে থাকেন কলকাতায়, সক্কাল বেলাতেই বোঝা যায়। পুনপুন দেবী ও ভারি খুশি হয়ে থাকেন। ডাক্তারের কথা শুনে মর্নিং ওয়াক ও হল। আবার রোজ নিত্য নতুন খাদ্যখাদক ও হল। নইলে ত বাড়িতে সেই স্বাস্থ্যকর কর্নফ্লেক্স দুধ, নয় ত টোস্ট আর ডিম পোচ। ধুত,পচে গেছে ।

আজ এই কোনার পুরি জিলিপির দোকানে দাঁড়িয়ে পুনপুনের চোখ পড়ল আরও একটা
খাবার দোকানের দিকে। মোমো।আবার থুপকাও। রীতিমত চিনেম্যানিও শব্দ দিয়ে
হলুদ দেওয়ালে লাল হরফে মেনু লেখা আছে। মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরে দুই নং
বাড়িটাই। পুরোনো বাড়ি। পুনপুনের বাবা মায়ের আমলের। সুন্দর গ্রিল দেওয়া
ঝোলানো বারান্দা তিন কোনা মতন। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ঘসা কাঁচ দেওয়া
ডিজাইন। নতুন তেল রঙ হয়েছে একতলায়, খাবার দোকানের কল্যানেই বোঝা যাচ্ছে।
সেই সঙ্গে ওপরের জানলায় রঙ্গিন বিলিতি ডিজাইনের শেড, এসির বাক্স। এ
বাড়িটা মনে হয় মোমোওয়ালারাই প্রমোটারদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতে পেরেছে।

মনটা খুশি হয়ে গেলো পুনপুনের। এগিয়ে যাচ্ছিলেন সামনে, দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ের দিকে।

হঠাৎ খুব হই হই করতে করতে তিন চার জন মানুষ সুন্দর ছোট্ট আড়াই তলা বাড়িটার থেকে বেরিয়ে আসতে দাঁড়িয়ে গেলেন। ব্যাপারটা কি? শোনা গেলো একটু আগে দোতলার জানলার সামনের পড়ার টেবিলে একটা দামি ট্যাব আর মোবাইল রেখে ওপরের ঘরের পেইং গেস্ট ছেলেটি স্নানে গেছিল। এখন বেরিয়ে এসে দেখছে টেবিল ফাঁকা।ফোনগুলো নেই।পাশের ঘরেই বাড়ির বৃদ্ধ মালিক পেপার
পড়ছিলেন। এই ছেলেটির ঘরে কাউকে ঢুকতে হলে ওনার সামনে দিয়ে ছাড়া উপায় নেই।
তিনি কাউকেই দেখেননি। কাজের ছোকরা, রান্নার মাসি সবাই হাউমাউ করতে করতে নিচে নেমে এসেছে। ছেলেটা ভীষণ খেপে গিয়ে বলছে, নিশ্চই কেউ নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, কেউ একমপ্লিস
ছিল তুলে নিয়ে চলে গেছে। উড়ে ত আর যেতে পারে না। সবাই কোনার পুরির দোকানেই এসে কথা বলতে শুরু করলো । এখানকার কাজের ছেলেগুলোকে জিগেস করতে থাকলো কাঁদোকাঁদো মুখের পেইং গেস্ট ছেলেটা। ঠিক সে বোলিয়ে না, দেখা কিসি কো? গলি কি তরফ টার্ন লিয়া কোই ? ইয়েহি এক
ঘন্টা পাহেলে?” পুনপুন এগিয়ে এসে বললেন, ওই জানলায় গ্রিল নেই?
 কাজের ছেলেটা এগিয়ে এল। আসলে মাসিমা, অনেকটা ওপরে ত। মই ছাড়া ওখানে হাত যাবে না । সেই ভেবেই কাকু আর
” “তো হো গীয়া না লোকশান মেরা? ভাইয়া আপ দেখা কিসি কো ল্যাডার লেকে সুবে সে ?” ক্ষুব্ধ ছেলেটি সামনে দাঁড়ানো জিলিপি ভাজিয়েকেই জিগেস করে। বেচারার চোখে জল এসে গেছে প্রায়। জিলিপি ভাজা থামিয়ে , রসুইওয়ালা বলে, নহি ভাইয়া, কোই নহি ঘুসা ইস তরফ
সুবে সে। ম্য কব সে চুলা জালায়া । বাস উয়ো দেখিয়ে,দো মিস্ত্রি যা রহা হ্য
সাইকেল পে না? উও দোনো উস তরফ যাকে উও রড ঔর সাইকেল উধার ছোড় কে আয়া থা।
পুরি খাই দো প্লেট, চায়ে ভি লিয়া। আউর বাস আভি দো মিনিট পহলে চলে,আভি উস
ফুটপাথ কে পাস যা রহা হ্য।
পুনপুন তাকিয়ে দেখলেন ঠিক উলটো দিকের রাস্তায় লেকের দিকে সাইকেল চালিয়ে
যাচ্ছে সাদা ফুলহাতা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা একটা রোগা ছেলে ।সাইকেলের
গায়ে তার দিয়ে বাঁধা এক গোছা লম্বা লোহার রড। ডবল করে ভাঁজ করে বাঁধা আছে
রড গুলো। একটা হাফ প্যান্ট পরা বেঁটে ছেলে পিছনের সিটে বসে ধরে আছে রডের
পিছনদিক গুলো,আর ঘাড় কাত করে এদিকেই তাকাচ্ছে।

পুনপুন উত্তেজিত হয়ে বললেন, ওদের কাছেই আছে মোবাইল। ক্যা !”
 “দেখুন না,ডাকুন, ডাকুন ওদের ।কাজের মাসি ফুটপাথের ধারে এগিয়ে গিয়ে হাত নেড়ে চীৎকার করে ডাকতে থাকে। ওদের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখানো হচ্ছে বুঝেই আচমকা প্রচণ্ড জোরে ঝুঁকে পড়ে
স্পিড বাড়ায় সাদা শার্ট। পেইং গেস্ট ছেলেটা ফ্র্যান্টিকালি বলে , হেল্প, কোই রোকিয়ে
কাজের ছেলে তপন, জিলিবিওয়ালা, দৌড়োয় ফুটপাথ ধরে।সামনের ধোসাওয়ালা এইবার
বুঝতে পেরেছে, কেউ পালাচ্ছে।সামনের বড় মোবাইলের দোকানের গায়ে দাঁড় করিয়ে
রাখা কার একটা সাইকেল টেনে নিয়ে এই ছেলে দুটোকে ধাওয়া করে সে।

চারপাশে জোরদার চেঁচামিচি শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে । ফুটপাথে খদ্দেররা চেঁচাচ্ছে। মোবাইল হারানো ছেলেটা, কাজের মাসি, আবার যার সাইকেল নিয়ে ধোসাওয়ালা দৌড়লো, সবাই পরিত্রাহি চেঁচামেচি ।

ধরে ফেলা গেছিল মিস্ত্রিদের। পুনপুন আগেই পেইং গেস্ট ছেলেটিকে বললেন, কল দা পোলিস।নো বিটিং।

সে বলল, এখনও ত কিছুই পাইনি। পুনপুন বললেন , পাবেই। ওই লোহার রড ভাঁজ করে তার দিয়ে দিয়ে বাঁধা আছে দ্যাখো। ওরা ওটাকেই দেওয়ালের গায়ে মইয়ের মত রেখেছিল।বড়জন যখন খেয়েছে, হাফ
প্যান্টপরা খোকা তারে পা রেখে উঠে গিয়ে জানলা দিয়ে মুণ্ডু বাড়িয়ে তুলে নিয়েছে তোমার জিনিস।

আবার আলতো নেমে এসে খাওয়া দাওয়া সেরেছে। বাট নো ম্যান হ্যান্ডলিং। আই অ্যাম কলিং টালীগঞ্জ পুলিস স্টেশান । নিজের মোবাইল থেকেই পুলিশে খবর দিয়ে ছিলেন পুনপুন। একা থাকেন বাড়িতে ,
ফোনে থানার নম্বর সেভড আছে । হ্যাঁ,পাওয়া গিয়েছিল জিনিস গুলো। পেইং গেস্ট ছোকরা গরম জিলিপি খাওয়ালো সব্বাইকে। ধোসাওয়ালার কি চওড়া হাসি। ফোন ফিরে পাওয়া ছোকরা হ্যান্ডসেক করে , মোবাইল নাম্বার নিয়ে আল্লাদে গদগদ হয়ে বলল, পুনপুন আন্টি ইউ আর গ্রেট!



সুধাংশু চক্রবর্ত্তী / দুটি গল্প

 এবার দেখ তোরা   

বারো বছরের জন্য বনবাসকালে সপাণ্ডব ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যখন কাম্যক বনে অধিষ্ঠান করছেন তখনই একদিন মহর্ষি মার্কণ্ডেয় এসে উপস্থিত হলেন । পাণ্ডবগণ তাঁকে সমাদরে বসিয়ে পূজোআর্চা করার পর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কথাপ্রসঙ্গে মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে শুধোন – হে মুনিবর, আমার মনে প্রায়শই কিছু প্রশ্নের উদয় হয় । পুরুষ যে-সকল শুভ-অশুভ কর্মের আচরণ করে তার ফল তারা কীভাবে ভোগ করে এবং ঈশ্বর কীভাবে কর্ম নিয়ন্ত্রণ করেন ? মানুষ কী কারণে সুখ বা দুঃখ পায় অনুগ্রহ করে বলুন মুনিবর ।

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বলেন – “শুনুন ধর্মরাজ , এই ব্রহ্মাণ্ডে সর্বপ্রথম প্রজাপতি ব্রহ্মা উৎপন্ন হন । তিনি জীবদের জন্য নির্মল ও বিশুদ্ধ শরীর গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে শুদ্ধ ধর্মজ্ঞান উৎপন্নকারী উত্তম শাস্ত্র গঠন করেন । সেই কালে সকলেই উত্তম ব্রত পালন করতো এবং তাদের কোনো সংকল্পই ব্যর্থ হতো না । সব মানুষই ব্রহ্মভূত, পুণ্যাত্মা এবং দীর্ঘায়ু হতো । সকলে স্বচ্ছন্দে আকাশে বিচরণ করে দেবতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতো এবং পুনরায় নিজ ধামে ফিরে আসতো । তারা নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী জীবিত থাকতো অথবা মৃত্যু বরণ করতো । কালের গতিতে মানুষের আকাশে বিচরণ একদিন বন্ধ হয়ে যায় । তারা পৃথিবীতেই বিচরণ করতে থাকে । তাদের ওপর কাম-ক্রোধ অধিকার কায়েম করে । তারা ছল-কপটতা শিখে লোভ  ও মোহের বশীভূত হয় । তাই নিজের শরীরের ওপর তাদের আর কোনো অধিকার থাকে না । তাদের কামনা, সংকল্প এবং জ্ঞান সবই নিষ্ফলে যায় । স্মরণশক্তি ক্ষীণ হয় । একে অপরকে সন্দেহ করে কষ্ট দিতে থাকে । এইভাবে পাপকর্ম করে পাপীরা তাদের কর্ম অনুসারে আয়ু ক্ষীণ করে ফেলে । ইহজগতে মৃত্যুর পর জীবের গতি তার কর্ম অনুসারেই হয়ে থাকে । কোনো প্রাণী ইহলোকে সুখ পায় পরলোকে দুঃখ । আবার কেউ সুখ পায় পরলোকে এবং ইহকালে দুঃখ । তোমরা তপস্যা এবং সদাচারে সর্বদাই তৎপর এবং শূরবীর । এখন যে কষ্ট পাচ্ছো তারজন্য তোমরা দুঃখ কোরো না । এই দুঃখ তোমাদের ভবিষ্যতে সুখের কারণ হবে ।

এক নাম না জানা অসুর সব কথা শুনেছে আড়াল থেকে । সব শুনে সে মনেমনে বলে , “রইলো আপনার পাপাচার মুনিবর । আমরা যা ইচ্ছে হয় তাই করবো । রইলো আপনাদের পরলোক । কে দেখেছে ঐ পরলোক ? আমরা জীবিতকালেই সর্বপ্রকার সুখভোগ করে যাবো । আমাদের আকাশে বিচরণ করার ক্ষমতা হরণ করে নিলে কীহবে আমরাও একদিন বায়ুযানে চেপে আকাশে বিচরণ করবো । মহাকাশ পরিভ্রমণ করবো । এমনকি গ্রহান্তরেও যাবো নিজেদের ইচ্ছেমতো । হা হা হা ।

ব্রহ্মা তার মনের কথা পড়ে হেসে বলেন – “তথাস্তু । সাধে কি আর কলিকাল বানিয়েছি রে বোকা । এবার জানতে পারবি কি কি লিখে দিলাম  তোদের ওই সুখের কপালে ।”  



আক্রোশ

ভবানীচরণ এক প্রহরকাল মাথা ঘামাইয়াও সন্মুখে খুলিয়া রাখা খাতাখানির সাদা পৃষ্ঠায় ঝর্ণাকলমের কালির একটিও আঁচড় বসাইতে পারিলো না । সে অতিশয় দুঃখে ঝর্ণাকলমটি গৃহকক্ষের মেঝের ওপর সজোরে আছড়াইয়া ফেলিয়া উষ্মা প্রকাশ করিলো । কলমখানি মেঝের উপর একবার গোঁত্তা খাইয়া অনতিদূরে আছড়াইয়া পড়িয়া বার দুয়েক আন্দোলিত হইয়া একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেল । তাহাতে ভবানীচরণের মধ্যে কোনো আবান্তর পরিলক্ষিত হইলো না । সে নিষ্কলঙ্ক খাতাখানি পুস্তকের আলমারির ওপর তুলিয়া রাখিয়া শয্যার ওপর টানটান হইয়া শুইয়া পড়িলো ।

শয্যায় শুইয়া বিস্ফোরিত নয়নে চাহিয়া রহিলো গবাক্ষের বাহিরের অন্ধকারে । সহসা এক ঝাঁক দুরন্ত বাতাস আসিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িলো সুসজ্জিত কক্ষের ভিতর । লহমায় লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল কক্ষের যাবতীয় বস্তু । ভবানীচরণের কবিতার খাতাখানিও বাদ গেল না । উপরন্তু বাতাসের সাহচর্য পাইয়া খাতাখানি ডানা মেলিয়া ক্ষণকাল উড়িয়া বেড়াইলো কক্ষের ভিতর । তাহাকে উড়িতে দেখিয়া ভবানীচরণের মনে হইলো কোনো ধবল ক্রৌঞ্চ ভ্রমবশত তাহার কক্ষে প্রবেশ করিয়াছে ।

উহা দেখিয়া ক্রৌঞ্চ লইয়া একটি কবিতার উদয় হইলো তাহার নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্কে । কবিতাটি এক্ষুনি এক্ষুনি লিখিতে না পারলে ভুলিয়া যাইবার প্রবল সম্ভাবনা রহিয়াছে ভাবিয়া ভবানীচরণ দ্রুত গাত্রোত্থান পূর্বক ভূলুণ্ঠিত খাতাখানি তুলিয়া আনিলো । অহরহ কতশত কাব্যকাহিনীই না ঘাই মারিতে থাকে তাহার অলস মস্তিষ্কে । আলস্যতার দরুণ সেসব লিখিয়া খাতাবন্দী করিয়া ফেলিতে পারে না বলিয়া তাবৎ কাব্যকাহিনী বিলীন হইয়া যায় শতসহস্র ভবনার ভিড়ে ।

ভবানীচরণ ভাবিয়া দেখিলো এই মুহূর্তে যে-কবিতাটি তাহার মনমন্দিরে জাগরিত হইয়াছে তাহাকে যেনতেন প্রকারেণ লিখিয়া ফেলিতে হইবে । নচেৎ উহাও হারাইয়া যাইবার প্রবল সম্ভাবনা রহিয়াছে । সেইমতো ভূলুণ্ঠিত ঝর্ণাকলমটি পুনরায় হস্তগত করিয়া কবিতাটি খাতার পাতায় বন্দী করিতে গিয়া দেখিলো ঝর্ণাকলমটি দ্বারা কোনোমতেই লেখা সম্ভব হইতেছে না । পরম আক্রোশে আছড়াইয়া ফেলিবার দরুন উহার নিবখানা ভোঁতা হয়ে গিয়েছে ।  



নীহার চক্রবর্তী

জবাব

''বাবা তাহলে চলেই গেলেন ? ইশ... ভাবতে পারছি না ।''
সুধাংশু দত্ত একথা বলে উঠতেই বেশ রাগ হল সদ্য-মৃত দেবদাস সেনের ছেলে দেবাশিসের ।
 
সে বলে উঠলো,''এ আবার কেমন কথা ? বাবা মরতে পারে না ? ভগবান কি তার জন্য আলাদা নিয়ম করবেন নাকি ? ভারী বাজে কথা ।''
শুনে বেশ চমকে গেলো সুধাংশু দত্ত । আমতা আমতা করতে থাকলো ।
পরে বলল সে,''ঠিক তা নয় । অনেকদিনের চেনা-জানা মানুষ তো । তাই আর কি । তা কাজ কবে ?''
''অনেকদিনের চেনা মানে ? বুঝলাম না কিছু । দিনের পর দিন নিজের কাজ হাসিল করার জন্য বাবার কাছে আসতেন না আপনি ? বাবার সঙ্গে বন্ধু পাতিয়ে ছিলেন না ? প্রায়ই তো তখন আসতেন । আর মার হাতের রান্না খেয়ে যেতেন ।''
দেবাশিস কথাগুলো একনাগাড়ে বলার পর সুধাংশু দত্তের দিকে খুব বিরক্তির সঙ্গে তাকাল । ওদের বাড়ির গেটের কাছেই দুজনের কথা হচ্ছিলো ।
 
হঠাৎ দুজনকে ছাদ থেকে দেখতে পেলো সদ্য বিধবা দেবাশিসের মা ।
সে ছাদ থেকে হাত নেড়ে নেড়ে দেবাশিসকে বলতে থাকলো,''অনেক দুঃখ পেয়েছি এ কদিনে । আর দুঃখ ডেকে আনিস না । দুর্জনকে গেট থেকে বিদায় কর এবার । নইলে তোর বাবার আত্মা শান্তি পাবে না ।''
মার কথা শুনে দেবাশিস এক-মুখ কষ্টের হাসি হেসে ফেললো ।
তারপরেই সুধাংশু দত্তের তাকিয়ে বলল,''আমি আর কি বলি । মা কম কথায় অনেককিছুই বলে দিলো । আসুন । ভালো থাকুন । আমাদের কথা আর না ভাবলেও চলবে ।''
কথাগুলো শেষ করেই দেবাশিস বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো । আর সুধাংশু দত্ত অপার-বিস্ময়ে সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে থেকে অসহায়-মুখে সেখান থেকে বিদায় নিলো ।
বিদায় নেওয়ার আগে আবার সে আঘাত পেলো ।
পেপার-বিক্রেতা রতন দেবাশিসদের বাড়িতে ঢোকার সময় রহস্যের হাসি হেসে তাকে বলল,''এখানে আপনি ? কতদিন দেখিনি আপনাকে এ বাড়ির মুখে । তা ব্যাপারটা কী ? কিছু পেন্ডিং পড়ে আছে নাকি ? হতেও পারে ।''
সাথে-সাথে সুধাংশু একরাশ লজ্জা নিয়ে সেখান থেকে হাওয়ার থেকেও হাওয়া । তার গতি দেখে ছাদ থেকে ছাদে দেবাশিসের মা মুহূর্তে সব দুঃখ ভুলে হেসে গড়াগড়ি গেলো প্রায় । দেবাশিস তখন ওর মার পাশেই ছিল ।
এক চিলতে ও হেসে বলল তাকে,''এ হাসি ঈশ্বরের কষ্ট ভোলানোর ওষুধ । তাই না,মা ?''
কিন্তু নিমেষে মার দু'চোখ জলে ভরে এলো বুঝি তার দেবদাসের কথা ভেবে ।



মৌসুমী ঘোষ দাস

 কে ?
               

বাসটা যখন খয়েরতলা মোড়ে এসে দাঁড়ালো তখন রাত সাড়েনয়টা বাজে। আরও আগেই এসে পৌঁছনোর কথা, কিন্তু রাস্তায় একটা এক্সিডেন্টের জন্য বাসটা আড়াই  ঘণ্টার বেশি জ্যামে আটকে ছিল। তাই দেরি হল। খয়ের তলা মোড় থেকে গ্রামের ভেতর দিকে আমার বাড়ি এক কিলোমিটারের একটু বেশি। এমনিতে তেমন কোন ভয়ের ব্যাপার নেই এই রাস্তায়। কখনো কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নি।  খেলাধুলা করার জন্য আমি একাই চলাফেরা করি। তাছাড়া অন্যদিন ডি,এস,এর মাঠে প্র্যাকটিস সেরে ফিরতে এতো রাতও হয় না।বাস থেকে নেমে হারু কাকুর দোকানে সাইকেল রাখা থাকে, সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরি। কিন্তু হারুকাকুর দোকান দুদিন বন্ধ থাকবে আগেই বলে দিয়েছিল। কুচবিহার যাবে কোন এক আত্মীয়ের বাড়ি। আমাদের মালদা জেলা মহিলা কাবাডি দল রাজ্যস্তরে দ্বিতীয় হয়েছে। এই দলের হয়ে খেলতে পরশু নদীয়া গিয়েছিলাম। আজ বিকেলে ফিরেছি। মালদা ষ্টেশনথেকে গাড়ি করে সোজা ডি,এস,এ-র মাঠে নিয়ে আমাদের দলকে ফুলের তোরা আর মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে সম্বর্ধনা দিল। তারপর যে যার বাড়ি নিজ দায়িত্বে ফেরা। বেশির ভাগেরই শহরে বাড়ি। শুধু মুক্তাদি ওল্ড মালদার আর আমি এনায়েতপুরের। সবার বাড়ি থেকেই কেউ না কেউ এসেছে নিয়ে যেতে, একমাত্র আমার বাড়ি ছাড়া। কারণ, আমার বাড়িতে শুধু মা আছে।
কোনোদিন এতো রাত না হলেও, এপথে বহুবার একা যাতায়াত করেছি। গেম স্যারের কাছে আত্মরক্ষার জন্য ক্যারাটে শিখেছি। ভয় আমি পাই না। তবে ভুতের ভয় একটু আছে। কারণ,  গ্রামে ঢোকার মুখেই ওই বড় পুকুরটা। আমাদের গ্রামে বিজলি বাতি আছে, তবে বহুদূরে দূরে টিমটিম করে জ্বলে। শহরের মতো অত ঝকঝকে আলো নেই। আর প্রায়ই লোডশেডিং হয়। একবার লাইন গেলে কয়েক ঘণ্টার আগে আসে না। সেজন্যই একটু ভয় করছে।
তাড়াতাড়ি হেঁটে ঢালাই রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা ধরলাম। দুপাশে আমবাগানের বড় বড় গাছের ছায়ার জন্য রাস্তাটা কি অন্ধকার লাগছে। আকাশের ফালি চাঁদ কখনো কখনো মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। রাস্তায়  দুই একটা লোক চলাফেরা করছে। আসলে আমাদের গ্রামের লোকেরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তারপর সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যে হতেই যে যার বাড়ি ঢুকে যায়। খেয়েদেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়ে। শহরের মতো এখানকার লোকেরা অনেক রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকে না।
আমার পিঠে বড় ব্যাগ, হাতে পলিপ্যাকে মিষ্টির প্যাকেট, ফুলের তোরা। স্যারের ডায়েট চার্ট অনুযায়ী  আমার মিষ্টি খাওয়া বারণ তাই মার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। মা আমার জন্য খুব চিন্তা করছে জানি। আমি ছাড়া মার আর কেই বাআছে?  বাড়িতে মোবাইল নেই যে আমার দেরীর কথা মাকে জানাবো। শুধু কথা বলার জন্য গেম-স্যার একটা মোবাইল আমাকে দিয়েছেন। সেটারও চার্জ শেষ। অবশ্য একটা ফোন করে নিলুদাকে আমার আসার কথা জানানোই যেতো। আর জানালেই আমাকে নিতে খয়ের তলা মোড়ে আসতোই আসতো সে আমি জানি। কিন্তু পাড়া গাঁয়ে এই ব্যাপারটা ভালোভাবে নেবে না। একে তো আমরা নমশূদ্র, তাতে আবার বাবা মারা যাবার পর সংসার চালাতে মা বিড়ি শ্রমিক হয়েছে।
নিলুদারা ব্রাহ্মণ, ধনী। নিলুদা আমার থেকে মাত্র দুই বছরের বড়।  ছোট থেকেই এক পাড়াতে একসাথে বড় হয়েছি। জঙ্গলে ফড়িংধরা, খেলাধুলা,পড়াশুনো,  ঘুড়ি ওড়ানো, সাইকেল চালানো সব একসাথে। আজকাল আমার ওপর তারখবরদারিএকটু বেড়েছে। কেবল বলে, “তুই এখন বড় হয়েছিস সুপ্রিয়া, কোথাও কেউ তোকে কোনোরকম হেনস্থা করলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে বলবি। আমি দেখে নেবো”। মনে মনে হাসি পায়। সেই কোন ছোটবেলায় বর-বউ খেলার সময় আমি তার বউ হতাম। এখনো যেন তিনি আমার-
আমরা ছোট জাত, মা বিড়ি বাধে  বলে ওর বাবা আমাদের পছন্দ করে না। আমিও চাই না, বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে।তাই একটু এড়িয়েই চলি আজকাল। গরীব হলেও লোকের কুকথা শুনতে নারাজ। কিন্তু নিলুদাকে বোঝাবে কে? আমি ভালো খেলি, তাই স্যার বলেছেন একটা পাশ করলেই খেলার কোটায় আমার চাকরি হয়ে যাবে। তখন মাকে নিয়ে শহরে থাকবো। মাকে কোন কাজ করতে দেবো না।
হাঁটতে হাঁটতে বটতলা পেরিয়ে বড় পুকুর পাড়ের কাছে চলে এসেছি। এই পুকুরে এক বছর  আগে নায়েকদের বাড়ির মেজো বউ ডুবে মরেছিল। কেউ কেউ তো বলে নায়েকরাই নাকি খুন করে দেহ পুকুরে ডুবিয়ে দিয়েছিল। দুদিন পর যখন তাঁকে জল থেকে তুলেছিল, বীভৎস ভাবে ফুলে গেছিল। চোখদুটো গর্ত মতো, বড় মাছে নাকি চোখ খুবলে খেয়ে ফেলেছিল।তারপর থেকে অনেকেই সন্ধ্যের পর তাঁকে দেখেছে ওই পুকুর থেকে উঠে এসে দাঁড়াতে। যে ওই পুকুরপাড় দিয়ে যায় তার নাম ধরে নাকি ডাকে। যদিও আমি কোনোদিন দেখিনি। আর এতো রাতও যে কোনদিন হয় নি। পুকুরটার চারদিকে এতো বাগান, কেমন যেন ছায়াছায়া ভুতুরে পরিবেশ। আলো নেই এখানে। সেজন্যই হয়তো মানুষ এতো ভয় পায়।
আজ এতো রাতে পুকুরটার কাছে আসতেইগায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। দূরেকোথায় একটা কুকুর টেনে টেনে কাঁদছে।  মা বলে কুকুর, বেড়ালের কান্না নাকি অশুভ। কোনদিকে না তাকিয়ে আমি হনহন করে হাঁটতে লাগলাম। একটু এগোলেই বুড়ো নিমতলা। তারপর আর ভয় নেই। পাশাপাশি ঘর থেকে আলো আসবে। কিন্তু হঠাৎ অনুভব করলাম কে যেন আমায় ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। পায়ে হাঁটার শব্দ নেই অথচ দিব্যি একটা অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। এতো রাতে এই বড় পুকুর ধারে আর কে হতে পারে নায়েকবাড়ির মেজো বউ ছাড়া? পেছন ঘুরে তাকাতেও ভয় করছে। যদি ওই বীভৎস চোখ খুবলানো চেহারা দেখি। তাহলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবো। আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। চিৎকার করার শক্তি হারিয়েছি। কোনমতে এগিয়ে চলেছি।
খানিক বাদে শুনি ফিসফিসিয়ে কে আমার নাম ধরে ডাকছে আর একটা বরফের মতো ঠাণ্ডা বাতাস আমার গায়ে এসে লাগছে। কোন  অপশক্তি বলে পাদুটো অসাড় হয়ে গেছে। এগোতে শক্তি পাচ্ছি না। তবে কি আজ এখানেই ভয়ে মরে পড়ে থাকবো? ভোরের আগে কেউ জানতেও পারবে না। এবার ডাকটা আমার কানের কাছে স্পষ্ট শুনতে পেলাম। একেবারে যেন আমার গা ঘেঁসে হাঁটছে! আমি আর আমাতে নেই। বেশ কয়েকবার ডাকার পর মনে হল ডাকটা কি খুব চেনা চেনা লাগছে? সাহস সঞ্চয় করে তাকিয়ে দেখি নিলুদা।
-“ কি রে , কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না? কালা হয়ে গেলি নাকি?”
ধরে প্রাণ ফিরে এলো আমার। সত্যি মনের মধ্যে একবার ভয় এসে বাসা বাধলে কত কিযেবাজে অনুভূতি হয়!
- “তুমি? এতো রাতে তুমি পেছন পেছন আসবে, ভাবতেই পারি নি। আমি তো ভাবলাম-”
-“নায়েকবাড়ির মেজো বউ? তাই তো? তুইও এসব বিশ্বাস করিস? আজ তোর  ফিরতে রাত হতে পারে, তুই আবার এই পুকুর পার দিয়ে একা ফিরতে ভয় পাস।  আমি মল্লিক পাড়া গিয়েছিলাম একটা কাজে। তাই সেখান থেকে ফেরার সময় ভাবলাম তোর জন্য অপেক্ষা করি। তা তুই এমন হনহন করে হাঁটছিস যে আমাকে দেখতেই পেলি না? ”
-“ না গো,  একা ফিরছি তো তাই একটু তাড়াহুড়ো করছিলাম।জানো নিলুদা, আমরা খেলায় সেকেন্ড হয়েছি”।
_“ বাহ! এর পরের বার কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে, আর সাথে পড়াটাও ভাল করে কর। চাকরি তোকে পেতেই হবে। আমি চাই তুই নিজের পায়ে দাঁড়া”।
কথা বলতে বলতে এগোতে লাগলাম দুজনে। বুড়ো নিমতলার কাছে এসে নিলুদা বলল,
-“এবার কোন অসুবিধা নেই, তুই একা যেতে পারবি, যা, বাড়ি যা”
-“সেকি? তুমি বাড়ি যাবে না?”
-“আমি একটু পরে যাচ্ছি। দুজনে একসাথে পাড়ায় ঢুকবো না।”
বুঝলাম, নিলুদাও অশান্তি চায় না। নিলুদা দাঁড়িয়ে থাকল। আমি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ির দিকে এগোলাম। দরজায় কড়া নাড়তেই মা দরজা খুলে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
-“এতো রাত হল সুপ্রিয়া, একা এতোটা পথ আসবি ভেবে আমি খুব চিন্তা করছিলাম। যা অন্ধকার পথঘাট, বড় পুকুরপাড়,  কখন কি হয়। তারপর যা সাপের উপদ্রব বেড়েছে। কাল তো- ”
মার চিন্তা দেখে আমি আশ্বস্ত করে বললাম,
-“না মা, নিলুদা আমাকে বড় পুকুরটা পার করে দিল।”
-“কে? কে পার করে দিল?”
-“নিলুদা গো।”
-“কি বলছিস? নিলু পার করে দিল? তুই ঠিক বলছিস?”
-“বারে, দিলই তো! আমাকে বুড়ো নিমতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। কত কথা বলল।”
মা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে খানিক আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, -“ কাল  রাতে নিলুকে সাপে কেটেছিল, হাসপাতাল নিতে নিতে রাস্তাতেই সব শেষ। আজ সকালে ওঁকে দাহ করে এসেছে।”










পার্থ রায়

যাবজ্জীবন 


হাতে ধরা মোবাইলটা আবার বেজে উঠলো রুমনার।অপেক্ষা করে করে অস্থির হয়ে উঠেছে নিলয়। স্বাভাবিক, রুমনা পৌঁছয়নি ষ্টেশনে, ধরছেও না ফোনটা।আসলে, রুমনার মাথাটা জট পাকিয়ে আছে।বাড়ী থেকে বের হবার সময় যে দৃঢ়তা নিয়ে বের হয়েছিল, যত হাঁটছে ততই যেন ওর দুটো পা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে।দুটো স্বত্বার অনবরত লড়াই চলছে। মনের একটা স্বত্বা অনবরত একঘেয়ে ভাবে বলে চলেছে,“রুমনা,কিসের দ্বিধা?কিসের দ্বন্দ?।মুক্তি পাওয়ার এই সুযোগ কেউ ছাড়ে? নিলয় তোকে ভালবাসে, বিয়ে করবে, সুখে রাখবে। এখনো জীবনের অনেক বসন্ত বাকি”। আবার আর একটা কেউ যেন মনের ভেতর থেকে খুব নরম কিন্তু বড্ড দাগ কেটে বলছে, “রুমনা, কোথায় চলেছিস?১৬ বছরের দাম্পত্য পায়ে ঠেলে, পঙ্গু স্বামী কে অসহায় অবস্থায় ফেলে সুখের খোঁজে?যদি তোদের সন্তান থাকত? পারতিস? যদি আজ তোর নিজের এই অবস্থা হতো যেমন দুর্ঘটনায় নির্ঝরের হয়েছে?তোদের সন্তান হয়নি, সে তো প্রথমবার তুই চাকুরী করবি বলে গর্ভপাত করিয়ে নিলি, নির্ঝর কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল। তোর ইচ্ছেতেই সায় দিয়েছিল। পরের বার তোর মিস ক্যারেজ হোল- তারপরে তো ওর এই দুর্ঘটনা”।
ইঞ্জিনিয়ার নির্ঝর একটা কন্সট্রাকশন সাইটে ক্রেন থেকে পড়ে যায় অনেকটা নীচে, বাঁচার কথা ছিলনা। মাথায় সেফটি ক্যাপ পড়া ছিল বলে প্রাণে বেঁচে যায় কিন্তু কোমরের নীচ থেকে অসাড় হয়ে যায়।হুইল চেয়ারে যাবজ্জীবন বন্দী হয়ে পড়ে নির্ঝর।নির্ঝর যে নারসিং হোমে ভর্তি হয়েছিল, সেখানেই নিলয়ের সাথে দেখা এত বছর পরে। স্কুলে রুমনার সহপাঠী ছিল। পরে নিলয় ডাক্তারি পড়তে চলে যায় মেডিক্যাল কলেজে। যোগাযোগটা আর ছিলনা। নির্ঝরের নিউরলজির ব্যাপারটা নিলয়ই দেখত।
নির্ঝরের পঙ্গু হয়ে যাবার পরে রুমকির জীবনে যেন সীতার অগ্নি পরীক্ষা।স্কুলের চাকুরীটা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে সব ভুলে নিজেকে নির্ঝরের সেবায় সঁপে দিয়েছিল। সদ্যোজাতকে মা যেমন সব করে দেয়, করিয়ে দেয় ঠিক তেমনি করে নির্ঝরের সব কিছু ওকে করে দিতে হয়। প্রথম দিকে সবই ঠিক ছিল, কিন্তু যত দিন যেতে লাগল নির্ঝর যেন কেমন পালটে যেতে লাগল।খিটখিট করত, কথায় কথায় খুঁত ধরত, সব সময় যেন রুমকিকে ব্যতিব্যাস্ত করে রাখার একটা আপ্রাণ প্রচেষ্টা।মাঝে মাঝে অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছে যেতো। আজকাল নির্ঝর গায়েও হাত তুলছিল। রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারত না রুমনা, জেগে জেগে উঠত আতঙ্কে, এই বুঝি নির্ঝরের  বেড প্যান দরকার পড়ল, এই বুঝি ও জল খেতে চাইল।দুপুরে ও ঘুমলে, কিছুটা সময় রুমনা একা নিজের মত করে পেত। আনমনা হয়ে সেসব আদর, সোহাগের সোনা ঝরা দিনগুলোর কথা ভাবত, আর চোখে জল নিয়ে হাসত।কি প্রানবন্ত আর দামাল ছিল নির্ঝরটা।বড় আদর ভালবাসায় ভরা রঙ্গিন ছিল সেসব দিনগুলো।    
 নিলয় নারসিং হোম থেকে ফেরার পথে প্রতিদিন দেখে যেত।কিভাবে কখন যেন ওরা দুজনে খুব কাছাকাছি এসে পড়েছিল। নির্ঝরের অবুঝপনা আর অত্যাচার যত বাড়ছিল, ততই দুজনের মধ্যে চিড়টা ক্রমে ক্রমে বড় একটা ফাটলের আকার নিয়েছে আর সেই ফাটলে কিভাবে জানি একটা মুক্তির স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে। সে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল নিলয়।
আবার ফোনটা বাজছে। নাহ!সব ভাবনার শেষ। আর ভাববে না রুমনা। এখন নির্ঝরের ওষুধ খাওয়ার সময়, চা খেতেও চাইবে নিশ্চয়, ঘুম থেকে উঠে। পাগলের মতো বাড়ীর দিকে দৌড়ুতে লাগলো রুমনা।



শান্তিময় কর

   শুধুই গল্প নয় 
  
সেই কোন ছোটবেলা থেকে এরকমটা হয়ে আসছে । ঘুমিয়ে পড়লেই যত রাজ্যের স্বপ্ন এসে আমার সামনে ভিড় করে । এমন একটা রাত যায় না, যেদিন আমি স্বপ্ন না দেখি । অদ্ভুত অদ্ভুত কিম্ভুত কিমাকার সব স্বপ্ন । এক একটা স্বপ্নে আমিতো ভয়ে আতঙ্কে পাগলের মত হয়ে যাই । কিন্তু রেহাই নেই, স্বপ্নেরা সব আসবেই এবং এটা আমার জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে । এমনি একটা বীভৎস স্বপ্নের কথা বলতে চাই। মারাত্মক ঘটনা,এবং ঘটেছিল আমার ঘুমের মধ্যে ঐ স্বপ্নেই । এটাকে দুঃস্বপ্ন বলবো না অন্য কিছু, ভেবে পাই না । তবে এটুকু বলতে পারি, ঐ ভয়ংকর স্বপ্নের কথা ভাবলেও এখনও কেমন যেন সারা শরীরটা শিরশির করে ওঠে -- ভয়ে আতঙ্কে সিটিয়ে যাই । কদিন ধরেই প্রচণ্ড জ্বর, সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম । জ্বর ও ব্যথার কাতরানির মধ্যে মাথায় মায়ের হাতের কোমল স্পর্শে কখন এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । আর তার পরেই সেই বীভৎস, ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা । সবার যা হয়, স্বপ্ন দেখার সময় মনে হয় সমস্ত ঘটনা বাস্তবে ঘটছে । তাই স্বপ্নে যা যা ঘটে, সবই সত্য মনে হয় । আমার বেলাতেও তাই হয়েছিল । এখনও আমি চোখের সামনে সমস্ত ঘটনাটা দেখতে পাই । একা থাকতে পারি না --- মূর্তিমান বিভীষিকা যেন আমায় তাড়া করে ফেরে ।
স্বপ্নটা এইরকম --- দেখলাম অনেকগুলো লোক মাঝরাতে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে " বল হরি হরিবোল " চিৎকার করতে করতে দড়ির খাটিয়ায় একটা মৃতদেহ কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানে । ঐ চিৎকারে ধড়মড়িয়ে উঠতে গিয়ে মাথাটা কেমন যেন বনবনিয়ে ঘুরতে লাগলো । যাই হক, কোন রকমে নিজেকে সামলে নিলাম । লোকগুলো প্রবল উৎসাহে নেচে নেচে ' বল হরি হরিবোল ' আর ' রাম নাম সত্য হ্যায় ' বলতে বলতে একটু এগিয়ে পথের ধারে বুড়ো শিব মন্দিরের সামনে মৃতদেহের খাটিয়াটা নামালো । বোধ হয় শিব ঠাকুরের কাছ থেকে লোকটার জন্য শেষ আশীর্বাদটুকু পাইয়ে দেওয়ার জন্যই । আমি সামনে এগিয়ে গেলাম । মুখটুকু বাদ দিয়ে মৃতের পুরো দেহটা সাদা চাদরে ঢাকা । গ্রামের  সবাইকেই চিনি, তাই ঐ লোকগুলোকে কোন প্রশ্ন না করে এগিয়ে গেলাম কে মারা গেছে স্বচক্ষে দেখার জন্য এবং মৃতের উদ্দেশে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর ইচ্ছায় ।

কিন্তু  সামনে গিয়েই যা দেখলাম তাতে আমার সারা শরীরের রক্ত হিম হয়ে যাবার জোগাড় । মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যেতে থাকলো । থরথর করে কাঁপতে লাগলো আমার পা দুটো । মনে হল শরীরটা অবশ ঠাণ্ডা হয়ে জমে যাচ্ছে । চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে । এ কী দেখছি আমি ? কে ঐ মৃত লোকটা, কার মৃতদেহ ওটা ? আমি কি ভুল দেখছি ? আমি বিহ্বল আর অবাক বিস্ময়ে দেখছি সামনের খাটিয়ায় আমারই মৃতদেহ শোয়ানো আছে --- আমিই শুয়ে আছি মৃতদেহ হয়ে । এটা কি করে সম্ভব ? আমি তো জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছি । তবে ঐ লোকটা কি করে আমি হল বা আমি কি করে ঐ লোকটা হলাম ? আর তা ছাড়া আমার তো কোন যমজ ভাই নেই । অথচ ও আর আমি হুবহু একই লোক । ' আমি ও ', ' ও আমি ' ভাবতে ভাবতে মাথাটা আমার ঝিমঝিম টলমল করে উঠলো । মনে হল মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছি । পড়েই যাচ্ছিলাম সত্যি সত্যি, হঠাৎ কে যেন আমাকে পিছন থেকে জাপটে ধরলো --- " কি হল ঘণ্টা দা, এমন করছো কেন, কি হল তোমার ?" এই বলে ও আমাকে গাছতলায় শুইয়ে দিল । পাশ থেকে আর একজন কে টিপ্পনী কাটল , " শালার কলজের জোর নেই তো ভড়ং করে মড়া দেখতে আসা কেন ? দে মাকড়াটাকে তুলে দে খাটে, এক সাথেই পার করে দিই "
এই রকম ডায়ালগ বাজির মধ্যেই আমি আস্তে আস্তে জ্ঞান হারালাম --- কিন্তু অবচেতনে মানসচক্ষে সব কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম । মৃত ভেবে নিয়ে ওরা সবাই মিলে আমাকেও ঐ একই খাটিয়ায় তুলে দিয়ে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললো । কিন্তু এ কী অবাক কাণ্ড রে বাবা ? একটু আগে যে লোকটা এই খাটিয়ায় শুয়েছিল, সে গেল কোথায় ? যেন কর্পূরের মত উবে গেল । আর আমি তো বেঁচে আছি, আমাকে এরা কাঁধে চাপিয়ে হরিবোল বলতে বলতে নিয়ে যাচ্ছে কেন ? আমি একবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে চাইলাম, " আমি বেঁচে আছি ", কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোল না, শুধু ফসফস করে কিছুটা হাওয়া বেরিয়ে গেল । হাত, পা, সারা শরীরে বজ্র আঁটুনি, নড়াচড়ারও উপায় নাই । পালানোর কথা তো ভাবাই যায় না । নেহাৎ নিরুপায় অসহায়ের মত চুপচাপ পড়ে থাকলাম । ভাবলাম, যা হবার হক --- কী আর করতে পারি আমি । জন্মেছি যখন, মরতে তো হবেই একদিন । বেশী ভেবে কি লাভ ? তাছাড়া এই বেহেড মাতালগুলোর হাত থেকে তো নিস্তার নাই কোনমতেই । কিন্তু তবুও আমার দুচোখ দিয়ে ভরা শ্রাবনের ধারা বইতে লাগলো । এমন বেঘোরে জীবনটা যাবে ? আমি ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না এটা কি রকম উদ্ভট ব্যাপার ? একটু আগে যে এই খাটিয়ায় বিরাজমান ছিল, সে উধাও । সে আর আমি দুজনই এক, কোন তফাৎ নেই  । ওরা নেচে নেচে সুর করে হরিবোল গাইতে গাইতে শ্মশানের বুড়ো বটগাছ তলায় আমার খাটিয়াটাকে নামিয়ে দিয়েই যে যার বোতলের ছিপি খুলে বসে গেল গোল হয়ে একটু দূরে গাছতলায় । আমি হাত পা বাঁধা অসহায়ের মত পড়ে রইলাম একধারে একলা, একটু পরে নিজের অন্ত্যেষ্টির স্বাক্ষী হয়ে থাকার জন্য । আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছিল না । আমি ভাবছিলাম আমার শেষ পরিণতিটা এই ছিল ! নানা ভাবনা আমার মাথায় ভিড় করে আসছিল । হঠাৎ দেখি সেই উধাও হয়ে যাওয়া লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে ----

-কি ঘণ্টা দা, কেমন লাগছে?
- আমি ঘণ্টা হলে তুমি কে? ' আমি তুমি, তুমি আমি তো মিলে মিশে একাকার --কি করে হয় ?
- হ্যাঁ হয়, ঘণ্টা দা, হয় । এ রকমটাই হবার ছিল । বিদায় বন্ধু, বিদায় -- তোমার স্বর্গের পথ সুগম   ', হ্যাপি জার্নি ।    
- কি বলছো তুমি ?
-তা নয়তো ? আমি মরে মরা, তুমি না মরেও মরা । ওপারে তোমার সাথে দেখা হবে।
- আচ্ছা, তুমি আমায় মুক্তি দিতে পারো না?
- মুক্তি কোথায় হে দাদা? মুক্তি নাই । সব শালার তোমার আমার মতই বেঘোরে প্রাণ যাবে ।

কথোপকথন শেষ হয় না । তার মধ্যেই মুর্দাফরাস মাতালগুলো হৈহৈ রই রই করতে করতে এসে আমার দড়িদড়া খুলে আমাকে চ্যাংদোলা করে চিতায় তুলে ফেলে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল । আমি হাউমাউ করে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলাম ----- বাঁচাও, বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও ।
আর ঠিক তখনই সেই মুহূর্তে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল । শুনতে পেলাম মা চিৎকার করে বলছেন, " খোকা, ওরকম করছিস কেন, কী হল তোর ? " এই বলে মা আমার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে সম্বিত ফিরে পেলাম । মনে হল যমলোক থেকে ফিরে যেন নবজীবন প্রাপ্তি হল আমার । 
                           


মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০১৭

৬ষ্ঠ বর্ষ ১৮তম সংখ্যা ২রা অগস্ট ২০১৭

এই সংখ্যায় ৮টি গল্প । লিখেছেন - তাপসকিরণ রায়, শান্তিময় কর, মৌ দাশগুপ্ত, নীহার চক্রবর্তী, নন্দা মুখার্জী রায়চৌধুরী, স্বাগতা মুখার্জী মুর্মু, জয়িতা ভট্টাচার্য ও পলাশ কুমার পাল ।

সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করে পড়তে হবে

তাপসকিরণ রায়

জবলপুর, হান্টেড কাহিনী

ভয়ানক রাত্রি


গত সেপ্টেম্বর মাসে কলেজের ছেলেদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছিল ইয়াং ছেলেরা হুজুগে মেতে স্থির করলো ওরা রাতে বেরোবে ভেড়াঘাট আর বর্গীড্যাম ঘুরে আসতে। যেই ভাবা সেই কাজ। সবাই ওরা জবলপুর সিটি এরিয়াতে থাকে। এমনিতেই ছেলেরা রাতবিরাতে ঘুরে বেড়ায়। ওরা ঘরের  মা-বাবার বাধা খুব একটা মানতে চায় না। রাত এগারটায় যখন মানিক ঘর থেকে বেরচ্ছিল তার মা একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন--এই এতো রাতে কোথায় বেরচ্ছিস, মানিক ?
মানিক বলেছিল, এই এক ঘণ্টার মধ্যে এসে যাবো মা !

ব্যাস, এমনি ভাবে গার্জিয়ানদের বলতে গেলে না জানিয়ে মানক, শম্ভু, গজ্জু, তিলক ওরা সবাই বেরিয়ে গেলো ভেড়াঘাটের দিকে। ভেড়াঘাট জবলপুর সিটি থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটারের মত দূরে তা প্রায় আধা ঘণ্টা তো লেগেই যাবে পৌঁছাতে। ওদের সঙ্গে আছে পাঁচটা বাইক আর ওরা সংখ্যায় দশ জন। ইয়াং ছেলেরা একত্র হলে যা হয়--হৈহল্লা চেঁচামেচি করতে করতে বেশ স্পিডে ওরা পৌঁছে গেলো ভেড়া ঘাটে। নর্মদা নদীর জলে নৌকা বিহার করা, এখানকার বড় আমোদের ব্যাপার। কিন্তু এত রাতে নৌকা কোথায় ! এত রাতে মাঝিমাল্লারা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে হবে। আর তা ছাড়া মিউনিসিপাল্টির তত্ত্বাবধানে এখানকার নৌকা চলাচলের বাঁধাধরা নিয়ম আছে। যাই হোক, যা এত রাতে সহজ লভ্য, দশ জনের দলের ছেলেরা তাই নিয়ে দিশী মদ-দারু খেয়ে কিছু সময় হৈহল্লা করলো। তারপর ঠিক করলো এবার বর্গী ড্যাম যাওয়া যাক।

ওদের মধ্যে এক অবাঙ্গালী বন্ধু গজ্জু যেতে রাজি হচ্ছিল না। নাকি শুনেছে বর্গী ড্যামে রাতের বেলা যাওয়া নিষেধ। তা ছাড়া গজ্জুর শরীরও নাকি তেমন ভাল লাগছিল না। হবে মনে মনে ভয় পাচ্ছিল বলছিল, নেহী রে, মেয় নেহী যাউঙ্গা, আমার কেমন ভয় ভয় করছে, শরীর অবশ অবশ লাগছে। বাকি ছেলেরা ওর পিছে পড়ে গেলো। ওরা ওকে, ছে ছে, করলো, বলল, তুই একটা--তারপর এক রকম জোরজার করেই গজ্জুকে নিয়ে ওরা রওনা হল ড্যামের দিকে। মানিক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত  তখন দুটো বাজে--কুছ পরোয়া নেহী--
রাত প্রায় আড়াইটায় ওরা সবাই মিলে বর্গী ড্যামের কাছাকাছি পৌঁছল পথে তিলবারা ঘাট পড়ে। তিলবারা ঘাট নর্মদা নদীরই আর একটা ঘাট। গজ্জু এখানে এসে আবার ভয় পেতে লাগলো। ওর নাকি শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে ! গজ্জু বারবার বলে চলছিল ফিরে যাবে বর্গী ড্যামে যাবে না। ওদের মধ্যে এক আধজন গজ্জুর সমর্থন করছিল কিন্তু গরিষ্ঠ মতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব টিকল না। অগত্যা ওরা আবার বাইকে স্পিড বাড়াল

রাস্তা নিস্তব্ধ, জনপ্রাণী শূন্য, কেবল এই দশ প্রাণীর দল অন্ধকার বন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে। হঠাৎ একটা চীৎকার শোনা গেলো,  পালসার গাড়িতে ছিল গজ্জু, ওদের গাড়ি ছিল সবার মাঝখানে, গজ্জুর ভয়ের জন্যেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল চীৎকার শুনে কি হল, কি হল রব উঠলো। এখানে স্ট্রিট লাইটের বালাই নেই। অন্ধকারে বাইকের লাইটগুলি শেষ পর্যন্ত ফোকাস করলো গজ্জুকে সে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল, ভয়ে হবে, গোঙাচ্ছে ! ওকে ধরে তোলা হল বাইকে, ভয়ে কাঁপছে, আর মুখে বলে চলেছে, মেয় নেহী যাউঙ্গা, মেয় নেহী যাউঙ্গা ! প্রায় আধ ঘণ্টা সময় নিয়ে গজ্জুকে বুঝানো হল, ঘরে তো ফিতেই হবে, আর যে দিক দিয়েই ঘরে ফের এত রাতে সব জাগাই ভয়ের। ওকে জল-দারু খায়িয়ে কোন মত বাইকে বসিয়ে আবার ওরা ড্যামের দিকে রওনা হল

ড্যামের ব্রিজের কাছাকাছি আসতে আসতে হঠাৎ একটা কালো গাড়ি হুশ করে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। দ্রুত বেরিয়ে গেলেও তার নাম্বার নাম যেন আলোর ফ্ল্যাশ নিয়ে জ্বলে উঠে ছিল--ছেলেদের চোখে তা অনায়াসে ধরা পড়েছিল। কারটা আই ২০ ছিল। কিন্তু গাড়ির ব্যাপারটা কি হল ? দশজন ছেলেরা সমস্ত রাস্তা জুড়ে হেঁটে চলছিল--তা হলে গাড়িটা কি ভাবে ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো ? এটাই ওদের কাছে সবচে ভয়ের ব্যাপার মনে হল ছেলেরা সবাই আতঙ্কে এক জাগায় জড়সড় হয়ে জটলা বেঁধে আছে। গজ্জু একবার চাপা চীৎকার দিয়ে ঝিম মেরে গেছে, হয়ত ভয়ে তার গলা থেকে আর আওয়াজ বের হচ্ছে না। ছেলেরা দেখল, কালো গাড়িটা সামনের ব্রিজ পার করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। গাড়ির মধ্যে দুটো ছায়া মূর্তি বসে আছে, দূর থেকেও তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।  কারের ভিতরে মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশ  লাইটের মত আলো জ্বলে উঠছিল মনে হচ্ছিলো যেন ওরা ক্যামেরা বা মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটে ফটো তুলছে

ছেলেরা হতবাক, দাঁড়িয়ে নীরবে সব কিছু দেখে যাচ্ছে গজ্জু বেহোশ প্রায় হয়ে টালমাটাল দাঁড়িয়ে ছিল হঠাৎ ছেলেরা দেখতে পেলো কার থেকে একটা মানুষের ছায়া নেমে এলো আর সে ছায়াশরীর ধীরে ধীরে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে ! ছায়া যত ওদের দিকে এগিয়ে আসছিল তার ছায়ার আকারও ধীরে ধীরে তত বেড়ে যাচ্ছিলো। ছেলেরা ভয়ার্ত চীৎকার করে পিছিয়ে যেতে লাগলো অন্যদিকে একটা ছায়া আগের মতই কারের ভেতর বসে আছে। দীর্ঘ ছায়া ছেলেদের দিকেই এগিয়ে আসছে--ছেলেরা ভয়ে চীৎকার করে পিছনে ছুটে যাবে ভাবছিল, ঠিক এমনি সময় ওদের কানে এসে বাজল কোন ভারি গাড়ির আওয়াজ, মুহূর্ত সময় পরেই ওদের চোখে পড়লো বিপরীত দিশা থেকে একটা ট্রাক ওদের দিকেও এগিয়ে আসছে। ট্রাকের হেড লাইটের আলো ওদের চোখে এসে পড়লো। এবার ট্রাক ওদের কাছে এসে পড়লো ওদের পাস কাটিয়ে ট্রাকটা কালো কারের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা দেখল সে ছায়া মূর্তি আর নেই কি কোথায় গেলো সে ছায়া মূর্তি ? আর সেই কালো কার সব যেন মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল ! ওদের মনে হল ওদের এতক্ষণের দেখা দৃশ্যগুলি বুঝি মাত্র কোন যাদু-মন্ত্রের খেলা ছিল ! পড়িমরি করে ছেলেরা এবার বাইকে চড়ে বসল আর যে রাস্তায় এসেছিল সে রাস্তাতেই ঘরে ফিরে গেল।

ছেলেরা সেদিন যা দেখেছিল তার ব্যাখ্যা ওরা জানে না। তবে সে ঘটনার পর থেকে ওরা বন্ধুদের বলে বেড়াত, সাবধান, বেশী রাতে কখনও বর্গী ড্যামের দিকে যাবি না।