গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১১ জুন, ২০১৭

শ্যামশ্রী চাকী

এপার ওপারের গল্প

কাঠি লজেনটা চুষতে চুষতে ফাৎনা হাঁটছিল ফুটবল মাঠটার দিকে। ফাৎনার প্যান্টের পকেটটা ছেঁড়া। গালে জলের দাগ গুলো কালো হয়ে বসেছে, জামার ধুলোগুলো ঝেড়ে ফাৎনা চোখটা মুছেনিল  আবার। এত বড়ো হয়ে গেছে তাও ফাৎনার কান্না পায়,...কেউ কান মুললে কান্না পায়, চোখ গোলা গোলা করে তাকালে কান্না পায়,বকলে কান্না পায়।
এদিক ওদিক তাকিয়ে খুব খানিক্টা কেঁদে নিয়ে হাতের চেটোয় চোখ মুছল ফাৎনা, লজেন্সটা শেষ হয়ে গেছে কাঠির গোড়ায় একটা মিঠেভাব সেটা চিবিয়ে দূরে ওই লাল ঢিবিটার ওপারে ছুঁড়ে ফেলল ফাৎনা।প্যান্টের পকেটটা অনেকটাই ছিঁড়ে গেছে মার্বেল গুলিগুলো পরতে পরতে মাত্র তিনটে পকেটে, আবার কান্না পেল ফাৎনার সকাল থেকে এই সাতবার ওর কান্না পেল।আজ ফুটবল খেলতে গিয়ে পরে গিয়ে খুব লেগেছে হাঁটুতে, একবার হাতবুলিয়ে মাঝমাঠে বসল ফাৎনা। হাতে কাঁচের নীল সবুজ মার্বেল গুলি। দুবার নাচাতেই কড় কড় কড়াৎ আকাশ চিরে বাজ! শাঁ শাঁ হাওয়া ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব। দৌড়ে বটতলার কাছাকাছি যেতেই হুড়মুড়িয়ে মোটা গুঁড়ি ওয়ালা পুরো গাছটাই ফাৎনার ওপরে।

ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট গুলো ভ্রু কুঁচকে দেখছিল ডাক্তার আংকেল,বার্বির এক হাতে স্যালাইনের নল আরেক হাতে ব্লাডের জন্য চ্যানেল করা,বার্বি চোখ পিটপিট করে দেখছিল ডাক্তার কাকুর বিরাট টাক আর ভুঁড়িটা। বার্বি দেখেছে বেশিরভাগ টাক ওয়ালা মানুষের ভুঁড়ি থাকে, আর যাদের টাক আর ভুঁড়ি দুটোই থাকে তারা খুব মজার মানুষ হয়। এই ডাক্তার আংকেলও খুব মজার মানুষ, খুব মজার মজার কথা বলে তবে এখন মুখ খুব গম্ভীর।এখন বার্বিকে একদম চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে বলেছে নার্স আন্টি।
বার্বি তাই পিটপিট করে দেখে নিচ্ছে কে কি করছে, একটা লম্বা চার্টে সব লিখে রাখে নার্স আন্টি বার্বির জ্বর কতটা বাড়ল কমল, 'বার পটি টয়লেট সব। বার্বির খুব ইচ্ছে করছে কাল মাসিমনির নিয়ে আসা বড়ো ডার্ক চকলেট টা খেতে কিন্তু খাওয়া নিষেধ,  অনেক চকলেট জমা হয়েছে বার্বির। ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে সব গুলো খাবে। কিন্তু বার্বির মাথাটা এমন করছে কেন? শরীর খুব হালকা লাগছে, একি?? নাক দিয়ে কেমন চটচটে আঠালো গরম কি বেরিয়ে আসছে!! নার্স আন্টি মুছিয়ে দিল, রক্ত!!

ডক্টর আংকেল দৌড়ে এল,  সবাই কি সব বলছে, একবার মায়ের মুখটা এক ঝলক দেখতে পেল বার্বি, আর কিছু দেখতে পাচ্ছেনা, মনিটর মেশিনের একঘেয়ে বিপ বিপ শব্দ কানে আসছিল আস্তে আস্তে থেমে গেল।

ফাৎনা যখন লালরঙা বাড়িটার নীচে এসে দাঁড়ালো আবার খুব কান্না পেল তার হঠাৎ একটা পুতুল পুতুল মেয়ে একটা ইয়াব্বড়ো চকলেট ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল এমা!! এত বড়ো ছেলে কাঁদে নাকি? ফাৎনা লজ্জায় কান্নাটাকে কোনমতে সামলে নিল।
মেয়েটা আর ফাৎনা ঢুকে গেল ওই বাড়িটার ভেতরে। এত্তবড়ো চকলেট ফাৎনা আগে কখনো খায়নি। সে চকলেট খাচ্ছিল আর চারদিকটা তাকিয়ে দেখছিল, ওই মেয়েটার নাম বার্বি, কি বকবক করতে পারে রে বাবা!! লাল বাড়িটা একটা স্কুলের মত কত ছেলে মেয়ে, সবাই ওদের বয়েসী কেউ খেলছে কেউ ছবি আঁকছে কেউ গান গাইছে কেউ গল্প করছে।সবার মুখে একটা আশ্চর্য শান্তির ছাপ।ফাৎনা অবাক হয়ে দেখল কেউ মারামারি করছেনা, ঝগড়া করছেনা। সবাই শুধু হাসছে।সাদা পোশাক পরে এক দাদা এগিয়ে এলো বার্বি আর ফাৎনাকে নিজের ঘর চিনিয়ে দিতে, দাদার নাম সোহম। এক কার এক্সিডেন্টে এখানে.....এখানে কোন তাড়ানেই, হিংসেনেই, গরীব বড়োলোক নেই, ক্ষিদে নেই, কান্না নেই, হিংসে নেই, পড়ে গেলে ব্যথা লাগেনা, হাত পা কাটেনা,হোমওয়ার্কের ক্লান্তি নেই, পরীক্ষার নাম্বার নেই, শুধু হাসি গান আর ভালোথাকা। একটা লম্বা বারান্দা দিয়ে দাদা বার্বি আর ফাৎনা হাঁটতে হাঁটতে এগুচ্ছিল। প্রথম প্রথম মা বাবার জন্য মন কেমন করবে তিন দিন বাদে সব ভুলে যাবে। ফাৎনা অবাক হয়ে দেখল তার আর কান্না পাচ্ছেনা!! বার্বির মাথা ব্যথাটাও এক্কেবারে গায়েব।

বার্বি আর ফাৎনার চোখে কেমন একটা আলো এসে পরল, চমকে তাকিয়েদেখল কত রঙ বেরঙের রাশি রাশি বেলুন উড়েযাচ্ছে আকাশ জুড়ে। আকাশ কত কাছে এখানে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়।

ধীরে ধীরে ওরা একটা ঘরে এসে পৌঁছলো,খোলা জানালা দিয়ে হু হু বাতাস আর দূরে কোন মন্দিরে সন্ধ্যারতির কাঁসরঘণ্টা বেজে উঠছে, বেলুন ওড়া আকাশটা রঙ বদলে একদম মায়ের শাড়ির আঁচলের মত নরম। সারাঘরে তুলোর মেঘের মত বালিশ, পাখির পালকের মত চাদর ছড়িয়ে আছে। কি এক নাম নাজানা ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা। ঘরটা কি মায়া মায়া ঠিক মায়ের হাসির মত।
ওদের পৌঁছে দিয়ে সোহম ঘুরে দাঁড়ালো কেউ ডাকছে আবার ওকে যেতে হবে লাল বাড়ির একতলায়, কেউ এসেছে তাকে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে।