গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৭

তাপসকিরণ রায়

                                          
মান্ডলার হান্টেড কাহিনী - ২ 
(আগের অংশ এই লিঙ্কে - http://galpogucchho.blogspot.in/2017/03/blog-post_87.html)                                         
বিশ্বাস অবিশ্বাস


মান্ডলা জেলার বিছিয়া ব্লক। ছোট্ট এক শহর--মফস্বল ধরনের জাগা। এ জাগার আশপাশের তিন চার কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু আদিবাসী গ্রাম। ঘন জঙ্গলের মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম বসতি। মাড়িয়া-মুড়িয়া জাতির আদিবাসী এরা। এখানকার আদীমবাসী। এক সময় ওরা গভীর জঙ্গলে বাস করতো। তখন এদের গায়ে পোশাক পরিচ্ছদ থাকত না বললেই চলে। আজ সভ্যতার আলো কিন্তু এখানেও উঁকি মেরে গেছে। গ্রামে এক আধটা পাকা ঘর দেখা যায়। এখানকার মেয়েরাও পড়াশুনা করে। রঙিন শাড়ির সঙ্গে রঙ প্রসাধনীর ব্যবহারও শিখেছে। অনেক ছেলেরা স্কুল ছাড়িয়ে কলেজে পড়ছে , শহর-নগরে সরকারি বেসরকারি চাকরিও করছে। আর এভাবেই শহর-নগর সভ্যতার ছোঁয়া এসব গাঁওয়ের দিকেও লেগে যাচ্ছে। বনারণ্যে--ক্ৰমশঃ বন-বনানী ভেঙে নতুন ভাবে গ্রাম সজ্জিত হয়ে উঠছে।
আজ এমনি এক গ্রাম, নাম তার ঝিরি, তার কথাই বলতে যাচ্ছি। বিছিয়া ব্লকের অন্তর্গত একটি ছোট গ্রাম, ঝিরি। আজ আমার কাহিনীর প্রেক্ষাপট এই ঝিরি গ্রামের সাতজন ছাত্রীকে নিয়ে। এই সাতজন ছাত্রীর নাম দুধী, যমুনা, নিক্কা, আন্নু, কুলনা এমনি সব। এরা রোজ একসঙ্গে স্কুলে যায়। মেয়েদের অসুরক্ষা একাকীত্ব ভাঙতে এমনটাই বুঝি ভাল নিয়ম। গ্রামের অনেক ছেলে মেয়েরাই স্কুলে পড়ে। ওরা যার যার মত সময় করে নিজেদের মত করে স্কুলে যায়।
সে দিনও সেই সাতটি মেয়ে একসঙ্গে স্কুলে যাবে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে ছিল। এক সঙ্গে প্রতিদিনের মত হাসি কথা-বার্তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে। তা প্রায় দেড় দু কিলোমিটারের দূরত্বে ওদের স্কুলে যেতে হয়।
স্কুলের নাম হ্যারভেট (Harrabhaat), বোধহয় খ্রিষ্টান স্কুল হবে, হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। স্কুল পথে রাস্তার কোথাও হালকা, কোথাও ঘন জঙ্গল ছাড়াও পড়ে অন্য গ্রাম, খালি পতিত জমিন। সব পার করে ওদের পৌঁছাতে হয় স্কুলে। পথে কোন অসুবিধা নেই, নিত্যদিনের যাবার পথ, দু-তিন বছর ধরে ওরা এ পথেই স্কুলে যাতায়াত করে যাচ্ছে। তবে ওরা শুনেছে যে স্কুলে পৌঁছাবার আগে যে জঙ্গল গাছপালা শূন্য বিরাট বিরান মাঠটা পড়ে আছে সে জাগাটার নাকি বদনাম আছে। কিসের বদনাম ? ভূত প্রেতের উৎপাত নাকি--নির্দিষ্ট ভাবে মেয়েরা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। আর জানলেই বা দিনের বেলা আবার কিসের ভয় ? দিনের আলোয় বা বিকেলের আলোয় কোন রকম ভয়ের ব্যাপার হতে পারে--এমন বিশ্বাস ওদের কারও মনেই ছিল না। ওরা তখন সেই বিরান মাঠ ধরে হাঁটছিল। ভয়ের কথা কারো মনে  থাকার কথা নয়। ওদের পেছনে ও সামনে একটু দূরে হলেও দু-চারজন ছাত্র-ছাত্রী স্কুলের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। চলতে চলতে তখন ঠিক মাঠের মাঝখানে এসে পড়েছে ওরা। আর ঠিক সে সময় হঠাৎই এক সঙ্গে মেয়েদের শরীর কেঁপে উঠলো। আর তারপর থেকেই মনে হল ওদের নিজস্ব সত্ত্বা ওরা যেন হারিয়ে ফেলেছে। অনেকটা কলের পুতুলের মত ওরা সবাই গিয়ে স্কুলে পৌঁছল। ওরা যে যার ক্লাসে গিয়েও ঢুকে পড়লো। কিন্তু ওরা কেউ স্বাভাবিক ছিল না। ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীরা ওদের নিয়ে হাসি তামাশা শুরু করলো। কেউ জিজ্ঞেস করলো, কি রে দুধী কুথা থেকে দারু পিয়ে এলি ?
দুধী তার শরীর ঝাঁকিয়ে হাসে আর বলে ওঠে কেন, তুদের গ্রামের সলফ  ঝাড় থেইক্যা--আমি ঝাড়ে তরতর করি উঠে গিলামহা হা হা--
হাসে ক্লাসের ছেলে মেয়েরা, ওর পেছনেই লেগে যায়। ক্লাসে শিক্ষক ঢোকেন, তাঁরও সন্দেহ হয়, দুধীকে অস্বাভাবিক মনে হয়। তিনি বলেন, কিরে দুধী কি হয়েছে ? দুধী আর কিছু বলে না, শুধু গা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে থাকে। ওদিকে যমুনা, নিক্কা, আন্নু, কুলনা, ওদের সাত জনেরই একই হাল। ওরা কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, আবার কেউ থুম মেরে বসে থাকে। ওদের সবার শরীর কেমন যেন কাঁপতে থাকে। কোন মত স্কুলের সময় পার করে সেদিন ওরা ঘরে ফেরে। ফেরার সময় ওই মাঠ পার করতে গিয়ে ওরা সবাই শরীরে আবার ঝাঁকুনি অনুভব করে আর একি ! ঝাঁকুনির পরে ওরা আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। স্কুলে ওদের নিজেদের কার্য-কলাপ সব যেন স্বপ্নের মত আবছা হয়ে ওদের মনে লেগে থাকে--ভাল ভাবে মনে করতেও পারে না যে তারা স্কুলে কি কি অস্বাভাবিক ব্যবহার করেছিল !
স্কুল থেকে পরদিন খবর আসে.কিন্তু সে খবর আসতে বেশ দেরী হয়ে যায়, ইতিমধ্যে সাতজন ছাত্রীই পরদিন স্কুলের জন্যে বেরিয়ে পড়েছে। আবার সেই পথ, সেই জঙ্গল, গ্রাম পেরিয়ে দীর্ঘ নেড়া বিরান ময়দান। আজও নির্দ্বিধায় ওরা মাঠ ধরে হেঁটে চলেছে--হাসছে, গল্প করছে। কিন্তু যেই ওরা মাঠের মাঝখানে পৌঁছল অমনি অনুভব করলো ওদের শরীরটা হঠাৎ যেন ঝাঁকুনি মেরে উঠলো--ঠিক তেমনি গতকাল যেমনটা ঘটেছিল। গত দিনের মত আবার সবাই অস্বাভাবিক হয়ে গেল--ওরা সবাই যেন নিজেদের সত্ত্বা হারিয়ে ফেললো। আর কালকের মতই প্রতিদিনের অভ্যাস মত পা ফেলে ফেলে ওরা পৌঁছল স্কুলে। আজও একই অবস্থা ঘটলো। স্কুলে ওরা পাগলের মত করলহাসল, অযথা শরীর দুলাল, কখনও হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল, তার মধ্যে ওদের সবার চোখগুলি মাঝে মাঝে কেমন যেন স্থির হয়ে থাকল। শিক্ষকরা, ছাত্ররা সবাই আজ ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। স্কুলের শিক্ষকরা আন্নু, যমুনা, নিক্কা ওদের সবাইকে জেরা করতে লাগলো। কি ভাবে কি হয়ে যাচ্ছে, কেউ বুঝতে পারছে না। মেয়েরা কেউ কিছুই বলতে পারছে না। ওদের সবাইকে বারবার জিজ্ঞাসা করা হল, কি হয়েছে তোদের ?
কারও মুখে কোন উত্তর নেই, ওরা নিজের মনে হাসছে, কাঁদছেশরীর দুলাচ্ছে আবার মূক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে। নিক্কা কেবল একবার বলে উঠেছিল, আঙুল তুলে পাশের মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল। একজন শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, কি আছে ওখানে ?
--আমি থাকি, ওরা সবাই থাকে, বলে নিক্কা খুব জোরে হেসে উঠেছিল।     
আর থাকা যায় না। প্রধান শিক্ষক মশাই মেয়েদের বাড়ি পৌঁছে দিতে লোক পাঠালেন। লোকেরা মেয়েদের অবস্থার পূর্ণ বিবরণ তাদের গ্রামে ও বাবা, মাকে জানাবে। মেয়েরা ফেরার সময় সেই মাঠের মাঝখানে গিয়েই আবার গত দিনের মত সবাই একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেলো। সঙ্গের লোকেরা ব্যাপারটা লক্ষ্য করে খুব অবাক হল, ওদের মনে হয়ে ছিল, মাঠের মাঝখানে আসতেই মেয়েরা সবাই কেমন যেন মুহূর্তের জন্যে থ মেরে দাঁড়াল, তারপর সবাই যেন একবার কেঁপে উঠল !
পরের দিন গ্রামের লোকেরা মিলে ঠিক করলো আজও মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়া হবে, তবে সঙ্গে থাকবে গ্রামের শিক্ষিত ও মাতব্বর শ্রেণীর কিছু লোক।
সব মেয়েরা স্বাভাবিক-- প্রতিদিনের মতই স্কুলে যাচ্ছে। তফাৎ শুধু এটুকুই যে তাদের সঙ্গে বেশ কিছু লোক উপস্থিত থাকছে। আবার সেই মাঠ, তার মাঝখানে যেতেই মেয়েরা আবার নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেললো। ওদের মাঝে যেন অন্য কোন সত্ত্বার উপস্থিতি ঘটলো। মেয়েরা আজ আর স্কুল  এটেণ্ড করল না--তেমনি মাঠ পার করিয়ে মেয়েদের আবার সুস্থ স্বাভাবিক ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল। এবার শুরু হল জল্পনা কল্পনা--কি হল মেয়েদের--কিসে ধরল--ভূতে না পেত্নীতে, নাকি জ্বিন পরীতে ? স্থানীয় পালক ও শিক্ষক সঙ্ঘের মেম্বার ফুল সিং ও উক্ত মেয়েদের একজন মা, ছোটি বাই, এ ব্যাপারে বলল, মেয়েরা রোজ সুস্থভাবে স্কুলে বেরিয়ে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে..!
এরপর আসলো ওঝা, বৈদ্য। শুরু হল অনেক ঝাড়ফুঁক তন্ত্রমন্ত্র পাঠ। কিছুতেই  কিছু হল না। শেষে পত্রিকার রিপোর্টার এলো, সরকারের নজরে এলো ঘটনা। কয়েক দিনের মধ্যে মান্ডলার বিছিয়া তহসীলের ঝারি গ্রাম হ্য়ান্টেড বলে পরিচিত হয়ে গেল। 
কিন্তু এমনি ঘটনা--স্বাভাবিক ভাবে যার কোন কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, মানুষের জীবনকে উথলপাথল করে যায়। আর এখানে একজন বা দুজনের ব্যাপার নয়--সাত সাতটা মেয়ের জীবন জড়িত। তারপর মিডিয়ার দৌলতে ঘটনাটা সমস্ত দেশ ব্যাপী ছড়িয়ে গেলো। সরকারও বোধহয় অনেকটা চাপের মাঝে পড়ে গেল। তাই মেয়েদের সমস্যার সমাধান করার জন্যে সরকারী তরফ থেকে চেষ্টা চলল। শেষ পর্যন্ত ডিস্টিক হেড কুয়াটার মান্ডলা থেকে এক চিকিৎসক দল পাঠানো হল। ডাক্তাররা মেয়েদের, গ্রামের লোকদের ও স্কুলের শিক্ষকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। মেয়েদের মানসিক অবস্থার যাঁচ-পরতাল হল। অবশেষে ডাক্তাররা রায় দিলেন, না, এ ঘটনার মধ্যে অলৌকিকতার কিছুই নেই। মেয়েদের মধ্যে দু তিনজন নাকি ঘটনার কিছুকাল আগেই ম্যালেরিয়ায় ভুগ ছিল। অন্য মেয়েরাও কিছুদিন ধরে  ফিজিক্যাল প্রবলেমে ছিল। সব কিছু মিলিয়ে ডাক্তারদের রায় ছিল--মেয়েরা প্ৰত্যেকেই ছিল মানসিক রোগের শিকার।
এমনি ভাবে ঘটনার নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়াটা যেন অনেকেরই মনপুত হল না-- অনেক লোকের মনেই কিন্তু অনেক প্রশ্ন থেকে গেল। বিশেষ করে ওখানকার স্থানীয় লোকজনের মনে সন্দেহাস্পদ অনেক প্রশ্ন উঠে আসছে। জানি না, বর্তমানে সেই মেয়েরা কতটা সুস্থ হতে পেরেছে। 
                                                                 
                                                        শেষ