গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৭

অলভ্য ঘোষ

  ভাগ
 ২য় অংশ   (আগের অংশটি পড়ুন এই লিঙ্কে - http://galpogucchho.blogspot.in/2017/03/blog-post_14.html)                    
                                          পর্ব-

গ্রামের স্কুলের পাঠ শেষ করে বিমল কলকাতায় মামার বাড়িতে থাকতো। তারপর থেকে এখনো অবধি সে মামার বাড়িতেই থাকে বেশি। মামার বাড়িতে বিমলের কোন মামা নেই। মরণাপন্ন এক দাদু বিষয় সম্পত্তি আর খান দুয়েক চাকর বাকর। প্রমোটার এর দৌরাত্ম আছে; তবে একদা তেজস্ক্রিয় পুরুষ বিমলের দাদুর ডাঁট এখনো ষোলো আনা। দুই পুরুষের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি ভেঙ্গে বিল্ডিং হোক সেটা সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না।

হঠাৎ চাপা জন্ডিসে সুবলের দাদা মারা গিয়েছিল। স্বামী মারা যাবার পর মনিমালাকে তার বাবা কলকাতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। স্বামীর ভিটে আর সুবলকে ছেড়ে মনিমালা কখনো কলকাতায় স্থায়ীভাবে থাকার কথা ভাবতে পারেনি। শহরে জন্ম হলেও বিধির কোন অমোঘ বন্ধনে ভাগ্য দোষে জড়িয়ে পড়ে মনিমালার প্রাণ কেঁদে ওঠে সুন্দরবনের এই অজপাড়াগ্রামের শ্বশুরের ভিটে আর সন্তান তুল্য দেয়োর সুবলের জন্য।

পরশ্রীকাতরতা। গায়ে মানে না আপনি মোড়ল। বট তলার তাসা পাশা খেলা পরনিন্দা পরচর্চা করা লোকগুলোর সুবল বিমলদের বনেদী উঠানে যাত্রা পালার অন্তিম দৃশ্যে দর্শকদের মতো উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছে আজ মনিমালার সংসারের পালাবদল দেখতে। কলকাতা থেকে বিমল এসেছে। না বিমল এর পৈত্রিক বিষয় সম্পত্তি নিয়ে অতো মাথাব্যথা নেই। মামার বাড়ির দিকে তো সে দাদুর সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। বিমলের মামা মাসি কেউ নেই। অতি আভিজাত্যে মানুষ মনিমালা। কপাল দোষে বিয়ে হয়ে এসেছিল এই অজপাড়াগাঁয়ে। মানিমালার এ ব্যাপারে কোন আক্ষেপ ছিল না। বাপের বাড়ির পারিবারিক ঘরানা, সংস্কার ও বনেদিআনার ছোঁয়া সে আস্তে আস্তে তার শ্বশুর বাড়িতেও বলবত করেছে। বিমল আজকাল চ্যাটার একাউন্টেন্ট পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এ ব্যস্ততায় মনিমালা তাকে ডেকে আনেন নি। ডেকে এনেছে সুবল। শেষমেশ ভাগ যখন হচ্ছে। সুবল চায় বিমল যেন সঠিক ভাগটি দাঁড়িয়ে থেকে বুঝে নেয়। মন থেকে কি সুবল এই ভাগ চায়?

-"ভাগাভাগি ব্যাপারটা ভীষণ আপেক্ষিক ছেলেমানুষি। কিসের ভাগ? কার ভাগ? কার জমিন, কার আকাশ, কার বায়ু, কার জল, কার ফুল, কার ফল, আমরা কারা ভাগ করি! আমরা কে ভাগ করার।ভাগত গ্রহের ফের। মোহের মোরব্বা, ভোগের থেকে ভাগ। মুখে দিলে মাখনের মত গলে যাবে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।"
সুবলের এসব উৎপটাং কথায় শ্বশুর মশাই বিরক্ত বোধ করেছিলেন।
তুমি এখন একা নও সুবল। তোমার সন্তান আসছে। তার একটা ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে তো নাকি! তোমার এই ভাবের ফকির মার্কা জীবনটাকে একটু সংস্করণ করো
ফকিরের কোন সংস্করণ হয় না। তাহলে তো তার ফকিরি থাকে না। ভগবান যাকে ফকির করেন; ভবের হাটে ভাবের ঠেলায় তার প্রাণ যায়। বেহিসেবি বোহেমিয়ান জীবনের হদিশ চালের কারবারি মিতব্যয়ী সুবলের শ্বশুর মশাই কি বুঝবেন।মাগুর মাছের ঝোল-যুবতীর কোল-বোল হরিবোল! সুবলের যখন ভাবান্তর হল না শাশুড়ি ঠাকরুন গাজী পীরের মাজার থেকে ভাতার বসের তন্ত্র মন্ত্র পুতও শিকড় বাকর নিয়ে এসেছিল। কয়েকটি বেটে খাওয়াতে হবে খাবারের সাথে; আর কয়েকটা রাখতে হবে বালিশের তলায় নুকিয়ে। জল পোড়া, তেল পোড়া, নুন পোড়া সব রকম চলছিল। মনিমালার কাছ থেকে সুবলকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। তবুও যখন কাজ হল না; শাশুড়ি ঠাকরুন মেয়ের মাথায় ঢুকলো;
-"ওই আধ বুড়ি মাগী টাই জামাইয়ের মাথা খেয়েছে। ওকে বশ করে রেখেছে।"
মায়ের কথা সবিতার রাতের ঘুম; দিনের আহার কেড়ে নিয়েছিল। চিন্তা রোগ গুপ্ত বাণ মরার মত ভিতর থেকে শুকিয়ে দেয় মানুষকে। কাটা নয় কুটো নয়। জ্বর নয় জ্বালা নয় অন্তরের দহনে মানুষ পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। 
চোখের কোণে কালি দেখে মনিমালা সবিতা কে নিয়ে গিয়েছিল বড় ডাক্তারের কাছে কলকাতায়। ডাক্তার বলেছিল রক্তশূন্যতা। অপুষ্টি খাওয়া দাওয়ার অভাব।
-"
এ অবস্থায় শরীরের অযত্ন করছিস ছোট!"
বাড়ি ফিরে ভীষণ বকাবকি করেছিল মনিমালা। সবিতা হাউমাউ করে কেঁদেছিল। বৌদির বুকে মাথা রেখে খুব আস্তে আস্তে বলেছিল;
-"তোমার দেয়োর আমাকে একটুও ভালবাসে না।"
মনিমালা সবিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল; 
-"বোকা মেয়ে এ সময় খারাপ কথা কিছু ভাবতে নেই; আনন্দে থাকতে হয়।"
পরের শনিবার সংসারের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সত্য নারায়ণের পূজা দিয়েছিল মনিমালা। শান্তি জল ছিটিয়ে ছিল সারা বাড়িতে। বিমলকে দিয়ে কালি ঘাটের মায়ের পায়ের ফুল এনে ছুঁইয়েছিল সবিতার মাথায়।।
এসব কথা শুনে সবিতার মা সবিতা কে বলেছিল;
-"মায়াবিনী রাক্ষসী। সুবল কে বশ করেছে। এবার ছলে বলে কৌশলে তোকে আর তোর পেটের বাচ্চাটাকে খাবে।"
মায়ের কথায় সবিতার আর কিছু হোক বা না হোক স্বাস্থ্যহানি হয়ে চলেছিল; মনের ছাপ পড়েছিল শরীরে। ভীষণ খিটখিটে হয়ে উঠেছিল সবিতা। কথায় কথায় সে সুবলের উপর রেগে যেতো। হাতের কাছে যা পেত ছুঁড়ে মারত সুবলকে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘটিয়ে ফেলল অঘটন।

                                             পর্ব-

সুবলের কিছুতেই ঘুম আসছিল না। স্ত্রীর সাথে বনিবনা ছিল না ইদানীং।সন্তান আসায় পেটের শিশুকে অপবিত্র করতে না চাওয়ায় । একই বিছানায় সবিতা সুবলের 
রাত্রিযাপন বন্ধ হয়েছিল। স্বামী স্ত্রীর মনোমালিন্যের কথা সবিতা বলেছিল মনিমালাকে। সুবলের উদাসীনতার কারণ কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি মনিমালা। বৃহস্পতিবার 
রাতে যখন সুবল মনিমালার ঘরে এসে বলেছিল;
-"বৌদিমনি আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না। ঘুম আসছে না।"
মনিমালা স্বস্নেহে সুবলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। পেটের সন্তান তুল্য এই দেবর টি তার ছোট থেকেই মনিমালার ভীষণ কোল ঘেঁষা। কষ্ট পেলে মনিমালার বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত । প্রত্যহ কাজে যাবার আগে সুবল কখনো বৌদিকে প্রণাম করতে ভোলে না। সুবল গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সবিতাকে দেখিয়ে আনার সময় বাড়ী ফিরে জড়িয়ে ধরেছিল মনিমালাকে।
-"জ্যাঠাই মা হতে চলেছ কাঁথা বানাও। বৌদিমনি তুমি তৈরি হও গু মুত ঘাটতে। "
মনিমালা উত্তর করেছিল;
-"তোর বেলা বৌদি হয়ে করতে পেরেছি; আর জ্যাঠাই মা হয়ে পারবো না আমার ছেলের যত্ন করতে।"
বাংলার মায়েদের এই স্নেহ পরায়ণ সত্ত্বা যদিও বিলুপ্ত প্রায় আজ পারিবারিক ভাঙনের সমাজে; তবুও চ্যানডোবার মাটিতে অনুর্বর নোনা পাতুরে জমির পাথরের খাঁজেও প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে অঙ্কুরিত হয়ে থাকা বীজের মত; সুদূর গ্রামের পল্লিবাসী এই পরিবার টি মমত্বের আঁচলে বাঁধা রয়ে গিয়েছিল সভ্যতার বিচ্ছিন্নতার রোষানল থেকে। যেমনটি হয় কোন পুরাতন বাড়ির নব সংস্করণের পরেও পাঁচিলের গাত্র দেশের ফাঁকে ছোট একটা বটবৃক্ষের রয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে। যার শিকড় সকলের অগোচরে বহু যুগ ধরে রয়েছে গোপনে নিভৃতে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত।তবে এবার সে শিকড় উৎপাটিত হবার জো হল। মায়ের কান ভাঙ্গানি তে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ ছিল না সবিতার কাছে; সে প্রমাণ গত বৃহস্পতিবার রাতে সে পেয়ে গেল। 

সত্যিই কি তা যথার্থ প্রমাণ ছিল? সে হুশ ছিল না সবিতার। সবিতা-তো তখন অন্ধ; তার চোখে তখন কেবল পাপ; চোখ, কান সব ইন্দ্রিয়ের ওপর চাপা দেওয়া 
হিংসার লাল কার্পেট। ভীষণ অবহেলা বোধ করেছিল সবিতা।
স্বামী তার চাইতে অন্য কাউকে বেশি ভালবাসুক এটা কোন মেয়ের পক্ষেই কাম্য নয়। মনিমালাও বোঝে এটা;কতবার সুবলকে আলাদা ডেকে বুঝিয়েছে;
-"বউয়ের প্রতি যত্ন নে। ও যেন এখন কোন রকম কষ্ট না পায়।"
গত রাতেও সুবল মনিমালার কাছে আসার পরে মনিমালা সুবলকে বলেছিল;
-"ছোটর কাছে যা কাঁচা পোয়াতি ওকে এখন একা রাখা ঠিক না।"
হাওয়া বাতাস অপদেবতার প্রকোপে প্রাচীন বিশ্বাস এখনো গ্রামে গঞ্জে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। ঝাঁর ফুকের জন্য কত ওঝা গুনিন ও আছেন।
সুবল বলেছিল;
-"ভূতে-তো ওকে সব সময় ধরেই আছে। আমি কি করবো! ওঝা হয়ে সারারাত বৌ পাহারা দেব! ও দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।"
ঘুম ছিল না সবিতার চোখে। সে পাশ ফির কাঁদছিল।তার চোখের জলে বালিশ গিয়েছিল ভিজে। সুবলের মেঝে থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা সবিতা ঠাহর করতে পেরেছিল। সেও অন্ধকার ঘরের দরজা ডিঙ্গিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল বারান্দার একটা সাবেকি স্তম্ভের গায়ে সেটা এই পরিবারেরই মত সাবেকিয়ানা হারিয়ে রং চোটে জীর্ণতায় ভুগছে। মনিমালার ঘরের দরজা ছিল হাট করা সুবল মনিমালার ঘরে ঢোকার পর থেকে। কোন মলিনতা নেই এই দেয়র ও বৌদির সম্পর্কের মধ্যে।তাই কোন সংশয় ছিল না; গোপনীয়তার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ ছিল না সুবল মনিমালার মনে।

তবে যেখানে সন্দেহ রজ্জু কেও সর্প ভ্রম হয়।
পা টিপে টিপে মনিমালার ঘরে ঢুকেছিল সবিতা। ঘরের লো ভোল্টেজ হ্যারিকেনের মতো আলোটা সুইচ টিপে নিঃশব্দে দিয়েছিল জ্বালিয়ে। মনিমালার কোলের কাছে শিশুর মতো শুয়ে ছিল সুবল।মনিমালার হাত ছিল সুবলের মাথার উপরে।আলোটা অদ্ভুতভাবে জ্বলে যাওয়ায় অবাক হয়েছিল মনিমালা। অপ্রস্তুত ভাবে উঠে বসে ছিল সে।
-"ছিঃছিঃ-“ছিঃ! নিজের স্বামীকে খেয়েছিস । এবার ছেলের বয়সী দেয়রের মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছিস।"
সবিতা চিৎকার করে কেঁদে পাড়া মাত করেছিল।
আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ পায়নি সুবল। সবিতার বাপের বাড়ি তো বেশি দূরে নয়; একই পাড়ায় থাকে। কাঁদতে কাঁদতে উঠেছিল বাপের বাসায়। রাতের ঘটনায় সারা পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল।

                                              পর্ব-

মনিমালার ইচ্ছে করছিল আত্মহত্যা করতে। কিন্তু সেটাও পারছিল না সুবলের কথা ভেবে। সবিতাতো এর আগে কতবার দেখেছিল সুবলকে বৌদির বিছানায় ঘুমাতে। মনিমালাকে সুবলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। কিংবা পিঠের ঘামাচি মেরে দিতে। খুব তুচ্ছ সামান্য ব্যাপার ছিল সেগুলো।

হঠাৎ সবিতার মনটা এত জটিল হল কি করে? এই ভাবনা সুবলের ছিল না; ছিল মনিমালার। এত নিচ প্রবৃত্তি জন্মানোর পেছনে যে দীর্ঘ মন্ত্রণার সংক্রমণ থাকে; থাকে এক অনুঘটক। তা মনিমালার অজানা নয়। কিন্তু যা ঘটেছে তার থেকে যা রটেছে সে কথা ভেবে মনিমালা নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারে না ; কষাঘাত করে চলে অন্তঃকরণে; কিন্তু তবুও কেবল নিষ্ফল অশ্রুপাত ছাড়া অসত্য খণ্ডনের কোন উপায় পেলনা ।সুবল কে শেষমেশ মনিমালা ; সবিতাকে এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছিল। সুবল খোলাখুলি বলেছিল;
-"যার এত বড় সাহস তোমার মতো দেবীকে পূজার বদলে কুলটা বলে অপমান করে। সে এ বাড়ির যোগ্য নয়।"
যে অপমান লজ্জা মনিমালা কে ভেতরে ভেতরে কুরে খাচ্ছিল; এবার তার প্রকাশ ঘটলো ! আজ পর্যন্ত যা করেনি তাই করে বসেছিল মনিমালা। থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিল সুবলের গালে।

-"
কত বার বলেছিলাম ছোটর যত্ন নে। একা একা থেকে থেকে ও ছাইপাঁশ ভাবতে শুরু করেছে।"
সুবলের চোখ থেকেও কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল।
-"ওর বাপ মা ওর মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছে। তুমি ওদের চেন না বৌদিমনি; ওরা নরকের কীট গু য়ের পোকা।"
মনিমালাও ভেতরে ভেতরে কাঁদছিল কাঁদায় পড়া হস্তি শাবক এর মত।সে উত্তেজনায় চিৎকার করে বসলো।
-"আজেবাজে কথা বলিস না সুবল! কোন স্ত্রী চায় রাতে স্বামী তার ঘরে না থেকে অন্য কোথাও থাকুক। ভুল মানুষ মাত্রই করে ছোটও করেছে। তুইও করেছিস; আধ দামড়া তোকে এই বুড়ো বয়সে শিশুর মত আশ্রয় দিয়ে হয়তো আমিও ভুল করেছি।তবে ভুলটা ধরে বসে থাকলে তো সংসার চলে না। সংসারের মঙ্গল ভুল গুলো শুধরানোতে; ভুল ভাঙাতে! যা ওকে নিয়ে আয় এ বাড়িতে।"
মনিমালা সুবলকে সুবি বলেই ডাকে আদর করে। রেগে গেলে বলে পুরো নামখানা। বৌদিমনির কথা শুনে সুবল গিয়েছিল সবিতাদের বাড়ি। সবিতা আসতে চায়নি তার সাথে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। সবিতার বাবা কাজে বেড়িয়েছিল সে সময়; সবিতার মা ঘোমটার ফাঁক থেকে মিহি গলায় যা বলেছিল তা মিছরির ছুরি ।
-"যদি বৌদির সাথেই ঘর করবে বাবা; বিয়েটা করতে গেলে কেন?"
শেষ মেশ উপায়ন্তর না দেখে লাঞ্ছিত হবে জেনেও মনিমালা নিজেই গিয়েছিল এ বাড়ির ছোট বউকে তার নিজের ঘরে ফিরিয়ে আনতে।
সবিতা মনিমালাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল সে আর একি বাসায় মনিমালার সাথে থাকতে পারবে না। পারবে না মনিমালার সাথে তার স্বামীকে ভাগ করে নিতে। মনিমালা বুঝেছিল ; যখন সকল আগল ছিঁড়েছে; তখন এ পরিবারে ভাগ রোখা ঈশ্বর ছাড়া আর কারো সাধ্যের মধ্যে নেই। অনিবার্যভাবে আজকের এই ভাগাভাগির দিনটি এসে উপস্থিত হয়েছে।

                                                   পর্ব-

দলিল দস্তাবেজ, বাসনকোসন, আসবাবপত্র, মনিমালার পালঙ্ক, সাবেকি কয়েক পুরুষের সিন্দুক, জামা কাপড়, ছটা গাই ও বাছুর। সঞ্চিত ধানের বস্তা, গোলা ঘর থেকে এনে উঠানের এক কোণে রাখা হয়েছে। এমনকি মনিমালার পানের বাটা, পানের সাজি, অতি প্রিয় যাঁতি এ বাড়ির একটা সেপ্টিপিন ও আজ বাদ পড়েনি উন্মুক্ত উঠানে লোক সম্মুখে সকল গরিমা সকল আভিজাত্য বিসর্জন দিয়ে ভাগের জন্য প্রস্তুত হতে।

উঠানের মাঝখানে পাড়ার মুরুব্বিরা ভিড় করে বসে আছে; অন্তিম লগ্নে; এ পরিবারের যবনিকা পাত দেখতে। ভাগাভাগির ব্যাপারটায় তারা বেশ রপ্ত। এ সংসারে তারা জুড়তে পারেনি কাউকে। অথচ ভেঙ্গে দিতে সিদ্ধহস্ত। সুবল আর বিমলকে ডেকে নেয় ফুটবল কিংবা মুষ্টিযুদ্ধ খেলা শুরুর আগে সে খেলার নিয়ন্ত্রক যেমনটি করে থাকে; ঠিক তেমনটি। মুখ মুখি পরস্পরের সৌহৃদ্য বিনিময়ের মাধ্যমে সামাজিক নিষ্ঠুর হার জিত লাভ লোকসানের খেলা। সুবল জানে এ সব আপেক্ষিক। তবুও সারা সংসার এ খেলায় মত্ত।
-"সাড়ে দশ কাঠা জমির ওপর যে বাস্তু ভিটে সুবল তার কোন দিকটা চায়? উত্তর না দক্ষিণ?"
সুবল চুপ করে থাকে । মাতব্বরদের প্রশ্নের কোন উত্তর করে না।
-"বিমল তুমি বলো।"
শিক্ষিত ছেলে বিমল; বিনর্ম ভাবে বলে;
-"ছোটকা যা ভাল বোঝে করুক; আমার এ ব্যাপারে কোন কিছু বলার নেই।
বারান্দার এক কোণে সাদা শাড়ি পড়ে একটা বেতের মোড়ার উপর বসে থাকা মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে নিষ্প্রভ ভাবে বসে পড়ে বিমল।
এ পাড়ার মোড়ল দের বোধ হয় একটু ধৈর্য চ্যুতি ঘটছিল। তিল বথ ভাগের অসামঞ্জস্যতায় কাকা ভাইপো একে অপরকে হ্যুকে হ্যুকে যাবে মোরগের লড়াইয়ের মতো। যেমনটি সচরাচর এ গ্রামের ভাগে এরা দেখে অভ্যস্ত।এই রোখ রোখ বলে ভাগের পিঠে ভাগাভাগি করবে। তলায় তলায় দান দক্ষিণা নিয়ে দাতার পক্ষে একটি একতরফা ভাগাভাগি করে এমন একটা ভাব দেখাবে বড় নিখুঁত দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে বাটোয়ারা করে দিয়ে গেলেন তারা। সুবলের শ্বশুরের সাথে জমির মাপ নিতে আসা আমিন সাহেব ও এই মাতব্বরদের একটা রফা হয়েছে গোপনে। তবে সুবলের অনীহা দেখে এরা চিন্তিত ভাগ সমাধা করে কি করে। যাদের ভাগ তারাই যদি এত চুপচাপ থাকে। আর ভাগ না হলে তারাই বা উপঢৌকনের ভাগি হবে কি ভাবে। একজন মাতব্বর বলে বসলেন;
-"তোমাদের যদি ভাগাভাগির কোন রকম ইচ্ছা নাই আমাদের ডেকে আনলে ক্যান? খামোখা লোকগুলোর সময় নষ্ট করো।"
সুবল রেগে গেল;
-"কে ডেকেছে আপনাদের।"
একজন মৃত্যু পথগামী অথচ স্বভাব দোষে পরশ্রীকাতর, পর ছিদ্র অন্বেষণ কারি, পরনিন্দা, পরচর্চায় সিদ্ধ হস্ত বুড়ো তার ফোকলা দাঁতে খাবি খেতে খেতে বলল;
-"এতো যে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কও! তোমার শ্বশুর য়ই তো আমাদের জনে জনের বাড়িতে ঘুরে ডেকে এনেছে বাপু।"

সুবল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সুদূরে উঠানের যে প্রান্তে এ পরিবারের সম্পত্তি সকল একসাথে জড়ো করা হয়েছে তারি এক প্রান্তে লোক লাগিয়ে এ কর্ম যে সমাধা করেছেন সেই নাটের গুরু সুবলের শ্বশুর আত্ম গর্বে গর্বিত হয়ে স্ত্রী কন্যার সাথে দণ্ডায়মান। সবিতার শরীরটা ভাল নেই; তবুও তাকে নিয়ে এসেছেন তারা। মেয়ের জোরেই জামাতার ওপর তাদের জোর। সুবলের ভাবান্তর না দেখে পঞ্চায়েতের লোকদের মনঃক্ষুণ্ণ তা লক্ষ্য করে শ্বশুর মশাই ভয় পেলেন। অনিবার্য জয়ের খেলা ভণ্ডুল হয়ে যাবে নাতো! মেয়ে আলাদা সংসার করুক সুবলের সাথে এই ইচ্ছে তার। সুবলের শ্বশুর মশাই মনোতোষ বাবু এগিয়ে এলেন ময়দানের মাঝখানে। একটা প্লেয়ার যেমন পরিবর্তিত খেলোয়াড়ের বদলে খেলার হাল ধরে তেমন ভঙ্গিমায়।
-"সুবল কি বলবে; বাচ্চা ছেলে! এসব বিষয় আশয়ের ও বোঝেই বা কি! আমি বরং ওর হয়ে দেখে শুনে নিচ্ছি।"
মাতব্বরদের ছিল মীমাংসা হয়ে যাবার ভয়। মিউচুয়াল হলে রাতে মদ মাংস খেউড় গান হাত ছাড়া হবে। তারা জানে মনোতোষ বাবুর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ না হলে তিনি গ্যাঁটের এক নয়াও খরচ করার লোক নয়।ফলত কিছুটা হলেও হালে পানি পেয়ে তারাও নড়েচড়ে বসল।
—"হ্যাঁ তাই হোক।"
আড়ে আড়ে একে অপরের দিকে তাকাল; আর একটা একটা করে সব কিছু এনে জড়ো করতে লাগলো দুটো বখরায় উঠানের মাঝখানে। যে বখরাটা বিমলের সে দিকে চেয়ে কেউ কেউ আবার মাঝে মাঝে ঢোকনা মেরে মেরে বলতে থাকলো;
-"বিমল বাবা তুমি শিক্ষিত ছেলে দেখে বুঝে নাও; পরে যেন বোল না; এ ভাগ তো একপেশে সামঞ্জস্য হীন।আপনারা সব এক চোখ।"
বিমলের কোন গাত্রোত্থান হলো না; বিমল একি ভাবে মায়ের পায়ের কাছে রইলো বসে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে রইলো সুবল। যেন কে তাকে চাবুকের বারি মেরে পিঠখানা ফালা ফালা করে দিচ্ছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষের শ্মশান পুরীতে স্বামী পুত্র আত্মীয় পরিজন হারা হয়ে হস্তিনাপুরের কোন মহিলাও এমনটি কেঁদেছিল কিনা ঈশ্বর জানেন। মনিমালা কেবল নিষ্পলক দৃষ্টিতে মাটির দিকে চেয়ে রইল পাথর হয়ে ।এক ফোটা জল ও আজ তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো না।সব শেষ! মৃত্যু পথগামী শাশুড়ি ঠাকরুনকে দেওয়া কথা সে রাখতে পারলো না; বুক দিয়ে রুখতে পারলো না পরিবারের ভাগ!