গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

আমোদিনী পর্ব

শহর কে আমোদিনী বুঝিতে পারে না।তাহার যৌবন কাটিয়াছে পল্লীতে। সে প্রবল ক্ষুধা দেখিয়াছে। সর্প দংশনে শক্ত সমর্থ স্বামীর মৃত্যু দেখিয়াছে।তথাপি সে  সকল কিছু বুঝিতে সক্ষম ছিল। পল্লীবাস কালে কষ্ট থাকিলেও সে বড় মুক্ত ছিল।পুত্র তারাপদর দ্বিতীয় বিবাহ হল আধা শহরের কন্যা মিলির সহিত। মিলি শহর বুঝিতে পারে। মিলি পল্লী জীবনের সরলতায় বীতশ্রদ্ধ হইয়া উঠিল।নিত্য বিবাদে তারাপদ স্থির করিল এবার সে শহরে যাইবে। তারাপদ  তার মাতৃদেবী কে লইয়া আসিল। শহরে মাথা গুঁজিবার অন্ধকারময় খুপরি হস্তগত হইল।জীবিকা পাইল তারাপদ, মিলি পাইল নাইটি পরার স্বাধীনতা, আর আমোদিনী পাইল বদ্ধতা। চোখের দৃষ্টির ন্যায় তাহার ঘ্রানেন্দ্রিয় টির ক্ষমতা কিছু যদি কম হইত তাহলে যাতনা কিছু কম হইত।আবর্জনার দুর্গন্ধের পাশে রন্ধন করিতে হয়। মদ্যপান রত দের নিত্য হল্লা শব্দে গভীর ঘুম হইতে চমকাইয়া উঠিয়া সে হাঁপাইতে থাকে। পল্লীর ক্ষুদ্র পুষ্করিণী, বৃক্ষরাজি, মুক্ত আকাশের কথা , ভাবিয়া চোখে তাহার জল চলিয়া আসে।পানীয় জলের লাইনের নিত্য কলহ, চারিপাশে অবিরাম যান্ত্রিক গোলযোগে সে  হতভম্ব হইয়া পড়ে। ইতিমধ্যে তারাপদ বুঝিতে পারে শহরে তারপক্ষে একাকী অন্নসংস্থান করা সম্ভব নয়।মিলি নিয়ত অনুধাবন করিতে লাগিল শহরে জীবন অধিক জটিল। যাহা সে বুঝিতে পারিলেও উপভোগ করিবার সামর্থ্য অর্জন করে নাই।মিলিও নাতি দুরের ফ্ল্যাট বাড়িতে রন্ধনকার্যে নিযুক্ত । এই তিনটি গ্রাম্য মানুষ প্রতিনিয়ত শহরের বুদ্ধিমত্তার কাছে নিজ সরল মনন কে হাস্যস্পদ  প্রতিপন্ন হইতে দেখে।

একদিন রাত্রিকালে অন্ন গ্রহণ কালে তারাপদ বলিল, “মা তুমার জন্নি একখান কাজ পেল্যাম। তুমি ঘরে যেমন বসে থাকো ওখানেও তুমি ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে থাকবে।” আমোদিনী বুঝিতে পারিল তাহাকে শেষ বয়সেও উপার্জন করিতে হইবে। সেই হইতে আমোদিনী ভি আই পি রোড পারাপার করিবার ভূগর্ভস্থ শান বাঁধানো পথ টির একপাশে হাত পাতিয়া বসিয়া থাকে। রাত্রি দশ ঘটিকায় তারাপদ কাজ শেষ করিয়া উপার্জন শীলা মাতা কে লইতে আসে। আমোদিনী কেবল পা দেখে। কেহ দ্রুত যায়, কেহ খুঁড়িয়ে হাঁটে , গট গট করিয়া যায় কেহ।আমোদিনী বোধ শূন্য অবস্থায় কেবল দক্ষিণ হস্ত টি পাতিয়া থাকে। শহর তাহার পাশ দিয়া বসিয়া থাকে। শহর তাহার পাশ দিয়া কেবল বহিয়া যায়।

আজ তাহার মন কেবল গ্রামের ছোট পুষ্করিণীটার কথা মনে হইতেছে। তাহার চারপাশে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বালিকা কালের মতো ছুটিয়া বেড়াইতেছে। হাতে কেহ পয়সা ফেলিয়া চলিয়া গেলে ঘোর কাটিয়া গেল। অবাক হইয়া আমোদিনী বুঝিতে পারিল সে সব কিছু পুর্বের চাহিতে স্পষ্ট দেখিতেছে।আজ সে না বলা কথাও অনুধাবন করিতেছে।  যে লোক টি পাঁচ টাকার কয়েন ফেলিয়া গেল তাহার কন্যার অসুখ।হাইহিলের দশটাকা দান করিয়া চলিয়া যাওয়া মহিলা টি অদ্য প্রেমিকের সহিত হেস্ত নেস্ত করিবে । আমোদিনী র নাসিকা তে কোন দুর্গন্ধ বোধ নাই।

রাত্রি দশ ঘটিকায় তারাপদ তাহার মাতাকে লইতে আসিল। দেওয়ালে ঠেস দিয়া কাঠ হইয়া পড়িয়া থাকা আমোদিনী গায়ে হাত দিয়া সে প্রমাদ গনিল।আমোদিনী বালিকা বেলার ন্যায় সিঁড়ি দিয়া দ্রুত উঠিতেছে, নামিতেছে। উঠিতেছে, নামিতেছে।