গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

শীলা পাল

মনে মনে



অনেক দিন পর পৃথা আজ নিজের ভুল বুঝতে পারলো।আমার  আজভীষণ আনন্দ হচ্ছে ।মনের সব মেঘ কেটে গিয়ে একঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে আমাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল । আমি অয়ন রায়।বিখ্যাত ব্যবসায়ী র পুত্র।তাই পি এইচ ডি  করেও আমাকে  বাবার ব্যবসায় ঢুকতে হয়েছে।বাবা মায়ের  একটি মাত্র সন্তান।তাই বিদেশে পড়ার সুযোগ এলেও আমাকে যেতে দেওয়া হয়নি।আমি তা মেনে নিয়ে নিজের না পাওয়া টি মেনে নিয়েছি।কারণ  আমার প্রথম ভালোবাসা  আমার মা।তাঁকে কষ্ট বা দুঃখ  দিয়ে আমি কিছুই করতে পারি না ।মা যখন কোন মতেই মেনে নিতে পারছেন না আমি  আর ও পথে পা বাড়াই নি।এখানে থেকেও অনেক কিছু করা যায়।বাবার এই যুক্তি আমি মেনে নিয়েছি।

অনেক গুলো বছর কেটে গেছে । আমার জন্য  সুন্দরী শিক্ষিতা পাত্রী বাবা  মা নির্বাচন করলেন আমি নির্দ্ধিধায় সেই মেয়েটিকে ই বিয়ে করলাম। আমি প্রতিষ্ঠিত হলাম আমার সমাজে ।বিজ্ঞ হলাম আমার কাজে।বেশ স্বচ্ছন্দে দিন গুলো কেটে যাচ্ছিল। আকস্মিক বাবার মৃত্যু  আমাকে একেবারে সবদিক দিয়ে যেন নিঃস্ব  করে দিল। আমার মাকে আমি  প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি।আমার মায়ের শোক আমাকে ভীষণ ভাবে বিচলিত করলো।সেই সময়ে আমার সাথে পৃথাও সমানে সঙ্গ দিয়ে গেছে  মায়ের শোকসন্তপ্ত সময় টিতে।মা আমার  একলা মনে বিষন্ন মুখে দিনের পর দিন থাকত ।কথা বলতে ভুলে গেছে।রাতের পর  রাত  না ঘুমিয়ে কাটাত ।আমার  ডাক্তার বন্ধুরা বলতো একটা  সময় আছে তুই এখন কিছু করতে পারবি না।উনি যেরকম ভাবে থাকতে চান থাকতে দে।আমার ছেলে  মেয়ে  ওনার ভীষণ কাছের ভীষণ প্রিয় তবু কী উদাসীন হয়ে থাকত। আমার এতো কষ্ট হতো আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম আমার মাকে তুমি স্বাভাবিক করে দাও।
পৃথা আমাকে বোঝাতো।ঠিক হয়ে যাবে সব ।তুমি  এতো ভেঙে পোড়ো না।প্রায় একবছর  এরকম নির্লিপ্ত ছিলো আমার মা।

       একদিন  আমরা দুজনে মাকে বললাম মা তোমার কষ্ট  আর  আমাদের সহ্য হচ্ছে না ।ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি মা।আমরা কষ্ট পাচ্ছি  একথা শুনে মা আস্তে আস্তে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে  শুরু করল ।মা যে আমার কষ্ট দেখতে পারতো না ।আদর করে জড়িয়ে ধরে বলল আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোরা যেন  কষ্ট না পাস।কি করি বল তো বুকের ভেতর টা একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগে যে। তারপর থেকে মা আপ্রাণ চেষ্টা করে হাসি ফুটিয়ে  আমাদের ব্যথা কমানোর চেষ্টা করত।ভালোবেসে আদর করে সবাই কে বুকে টেনে নিল।

       আজ সেই পৃথা আমাকে  কেমন ভুল বুঝলো।জানি  ও মাকে খুব ভালোবাসে।তবু আমি খেতে বসে বলে ফেললাম আগে মাকে দাও।ও চুপ করে গেল ।কোন ভাল জিনিস  আমাকে  দিতে এলে আমার মুখ  থেকে  বেরিয়ে যেত  আগে মাকে দাও। ও চুপ করে  থাকতো।একদিন বলেই ফেললো মাকে ঠিকই  দিই আমি তবু তুমি কেবলই মাকে দাও মাকে আগে দাও বলো কেন ।তুমি ভাবো কি করে মাকে না দিয়ে আমি  তোমাকে দিচ্ছি । একটা  দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরী হলো।তবু আমি  বলেই ফেলি ।আজ ও বেশ  রাগ করে ই কথাগুলো বললো।মা অস্থির ।তুই কেন এমন করে বলিস। ও তো খুব যত্ন করে আমার ।তবু আমার মনে হয় আমার মা আগে সব ভালো নেবে তারপরে আমরা। পৃথা যতোই রাগ করুক আমি  বলবোই।

আজ যখন পৃথা বলল তোমার মা তোমার  একার নয় আমারও । একটু দুঃখ হলো মনে।তবে ভালো লাগলো ।তাও মন ঠিক  মানতে চাইলো না ।মা আমার ।মা আমার একার ।
জানি না  কেন আমার  এমন হয়। আমি এই ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিতে পারবো না।

আমি পৃথা

 অয়ন আমার স্বামী । সুন্দর শিক্ষিত একটি উদার মনের মানুষ । আমি ভালোবাসি ভীষণভাবে ভালোবাসি । এই সংসারে বধূ হয়ে  আসার পর ওর বাবা মায়ের কাছ থেকে এতো ভালোবাসা পেয়ে এসেছি ।আমার  কখনও  মনে হয় নি আমি অন্য কোনো বাড়ীর মেয়ে ।অনেক ভাগ্য করলে তবে এরকম  একটি সুখের পরিবার পাওয়া যায়। আমার সবকিছু  ভুলে আমি দিনরাত এই মানুষগুলোর জন্য  ভগবানের কাছে আমি এদের  সুস্থতা দীর্ঘ জীবন  প্রার্থনা করে  এসেছি ।আমার  ছেলে  মেয়ে মনে হয় আমার  থেকেও  এই মানুষ দুটিকে বেশী ভালোবাসে ।হঠাত করে  অয়নের বাবা  মারা যান ।তারপর  থেকেই  অয়ন যেন  কেমন পাল্টে গেল  আমার  চোখে।সব ঠিক আছে ।কিন্তু  মা যেন ওর  একা।আমি এই ষোল বছর ধরে যাকে দেখেছি তার  চোখে  আমি কি করে এতো আলাদা  হয়ে  গেলাম ।ওকি জানে না ওকি এতোদিন আমাকে  দেখে নি? নিজের  বাবা মায়ের  থেকে ও আপন করে নিয়েছি ওর বাবা  মাকে।আমার  বড়ো কষ্ট  হয় ও যখন  আমাকে  জিজ্ঞেস করে মাকে ঠিক  মতোই দেখছি কি না।ঠিক মতোই যত্ন করছি কি না।আজ যখন  বললাম  তোমার মা কি শুধু  তোমার  একারআমার ও মা এটা বোঝ না কেনএকটু আশ্বস্ত হলো।জানি না  এই বিশ্বাস টা কতোদিন  ধরে রাখবে।আমি প্রাণপণে চেষ্টা করে যাবো ওর ভুল ভাঙাতে।মা তোমার শুধু  একার নয় আমারও। শুধু  আমাকে  সরিয়ে  নিজে একাই ভালোবাসবে তা আমি  কিছুতেই হতে দেব না।



আমি  সুজাতা

খুব  বর্ধিষ্ণু পরিবারের বউ হয়ে  এ বাড়ীতে এসেছিলাম।সে কতো যুগ আগে ।একে একে অনেক  প্রিয়জন কে হারিয়ে  আজ বড়ো একা মনে হয়।তবু আমি সুখে আছি ।বেশ আছি।আমার  একটা ছোট্ট পৃথিবী।আমি সেই জগৎটি  আঁকড়ে বসে আছি।ওরা ভালো  থাকলেই আমি  ভালো  থাকি।আমার  ছেলে বউমা আর নাতি নাতনী।ওদের  সুখেই আমার  সুখ ।ওদের  আনন্দ ই আমার  আনন্দ হয়েআআসে। এই কিছুদিন  যেন  একটা গুমোট ভাব  আমাকে  খুব  ভাবাচ্ছে আমার  ছেলে।ওর বাবা  চলে যাওয়ার পর  থেকে  ওই যেন  সেই ছোটবেলার মত হয়ে গেছে ।মাকে হারানোর  ভয়।সব সময়ই যেন আগলে রাখার  ভাব।খুব  ছোটবেলায় ও এরকম করতো।কাউকে  মায়ের ভাগ দেবে না।কেউ আমাকে  ভালোবাসলে ওর পছন্দ  নয়।বিরক্ত মুখে ঘুরে  বেড়াত।সেই মানুষ টিকে একদম সহ্য করতে পারত না ।সে কোনো পুরুষ বা মহিলা  যাই ই হোক না কেন। এমন কি আমার  কাউকে  ভালোবাসার উপায় ছিলো না ।আমি হাসতাম ।


তারপর তো জীবন নিজের ছন্দে বয়ে গেল।চাওয়া  পাওয়া  আনন্দ দুঃখ মিলে মিশে  একাকার হয়ে গেল । এখন  তো জীবনশেষের গান বাজতে শুরু  করেছে ।তবু ভালো  আছি।কিন্তু  একটা প্রশ্ন  বারবার  কেন যে আসছে।পৃথা আমার বৌমা।মেয়ে টি ভীষণ  ভালো । একদম নিজের মেয়ের মত । এখন আমার  নিজের  একান্ত প্রিয় মানুষ টি আমাকে  ছেড়ে  অনেক দূরে  চলে  গেছেন । আমার  ধরা ছোঁয়ার  বাইরে। তাই ভীষণ  আমাকে  আগলে আগলে রাখে।এখন  আমার  ভয় করছে খুব ।ছেলেটা আবার  সেই আগের মতোই হয়ে যাবে না তোএকথা তো একমাত্র  আমিই বুঝি  আমিই জানি ।