গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

সুমনা পাল ভট্টাচার্য্য

কাঠগড়ায় রোদ্দুর


বাইরের আকাশটা কেমন ধোঁয়াটে হয়ে আছে।
ব্যালকনি থেকে জামাকাপড় গুলো ঘরে নিয়ে আসতে গিয়ে সামনের রকে বসা কুকুর দুটির দিকে নজর গেল মোহরের...
একটার শীত করছে বোধহয়,কেমন কুঁকড়ে আছে, পাশের কুকুরটি মুখ ঘষে চলেছে ওর বুকে,পেটে..
কুকুরেরও প্রেম জাগে..
ভাবতেই ভাবতেই হাতের ফোস্কাটার দিকে নজর গেল, সত্যি আরেকটু হলেই আজ কেলেঙ্কারি হত।অতোটা ফুটন্ত গরম জল একসাথে হাতে ধপ করে পড়লে আর দেখতে হত না, ভাগ্যি ভাল কমের উপর দিয়ে গেছে...
অবিনাশ ফিরেছে লন্ডন থেকে খবরটা রিঙ্কু ফোনে জানানোর পর থেকেই সব কেমন উথালপাতাল হয়ে যাচ্ছে।  সে এখন মস্ত সেলিব্রিটি। মস্ত বড় পরিচালক। আজ মুম্বাই,কাল লন্ডন, পরশু প্যারিস এই করে বেড়াচ্ছে।
প্রায় দিনই কাগজে বড় বড় করে ছবি থাকে, ওকে নিয়ে কভার স্টোরি থাকে।
মোহর মন দিয়ে পড়ে সব 'টি আর ছবির দিকে অপলক চেয়ে থাকে।
চোখদুটো অবিনাশের কপাল,চোখ, নাক ছুঁয়ে ঠোঁটে এসে আটকে যায়।
জীবনের প্রথম চুম্বন। তার কুমারী ঠোঁটের প্রথম স্বাদ নেওয়া পুরুষটির ঠোঁটে নিজের ছাপ খোঁজে বুঝি!!
একসময় অবিরাম আর মোহর পাশাপাশি হেঁটে যেতো।
ওরা দুজন কলেজস্ট্রীট, কফিহাউস বইপাড়া ছুঁয়ে কখন যে যশোর রোড ছুঁয়ে ফেলতো পায়ে পায়ে তা টেরই পেতোনা। রোজ অবিনাশের দায়িত্ব ছিল মোহরকে ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দেওয়ার..
সারাটা পথ দুজনের আঙুলে আঙুল কথা বলে যেতো,  চোখের মদ ছলকে মিশে যেতো অপরজনের চোখে,এই ছিল প্রেম, সম্পর্ক।
তারই মাঝে এক সরস্বতীপূজার সন্ধ্যেবেলা এই রিঙ্কুদেরই বাড়ির ছাদে, অবিনাশের ঠোঁটের আগুনে পুড়ে গেছিল মোহরের ঠোঁট, চিবুক,স্তন,স্তনের বাদামী বৃন্ত-
ভিজে গেছিল অন্তর্বাসের ভিতরে বেসামাল হয়ে ওঠা অন্তরের আনাচ-কানাচ।
তারপর অবিনাশের বেকারত্ব, মোহরের বিয়ে, সন্তান সবই সময়ের খাতায় ফুটে ওঠা বাস্তব।
একমাত্র মেয়ে মেহুল প্রেসিডেন্সি কলেজে ইকোনমিক্স অনার্সের ছাত্রী। সেকন্ড ইয়ার।
মেয়ে ভারি আধুনিকা।অমন সেকেলে বাপের মুখেও তাই ভয়ে ভয়ে মাঝে মাঝে প্রশ্ন শুনতে পায় মোহর, " আজও রাতে ফিরবি না?"..
মেহুলের স্পষ্ট জবাব, " আশ্চর্য বাপী, নাইট পার্টি, রাতে কি করে ফিরব?"
সঞ্জীব থতমত খেয়ে ঢোঁক গেলে, " সাবধানে থাক,বুঝে শুনে চল মা.."
মেহুলের নিরুত্তাপ হয়ে কাঁধ শেক করে বলে ওঠা, "বাপী জীবনটা তো ওই দোকান আর বাড়ি করে কাটিয়ে দিলে, কি করে বুঝবে বলো, এইসব!প্লিজ আমায় একটু আমার মত থাকতে দাও তো! অসহ্য লাগে এইসব..."
সঞ্জীব মোহরের কর্তা। বড়বাজারে শাড়ির দোকান, তাছাড়াও একটা খাবারের দোকানও আছে। রোজগার পাতি ভালোই।
এম. টা আর কমপ্লিট করা হয় নি মোহরের,মেয়ে বেকার আঁতেল ছেলের সাথে মিশে সর্বনাশ ঘটাবে সেই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন বাবা,মা মোহরের জন্য সুপাত্র হিসেবে খুঁজে এনেছিল এই একান্নবর্তী পরিবারের মেজো ছেলে সঞ্জীবকে।

অনেক পথ পেরিয়েছে মোহর।
ফুলশয্যার রাতেই সঞ্জীব মোহরকে বুঝিয়ে দিয়েছিল নিজের বিবাহিতা স্ত্রীর উপর কি করে অধিকার ফলাতে হয়।
মোহরের যোনিপথের মুখ থেকে রক্ত নদী কেন বইলো না, এই নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা তার স্বামীর ছিল, যে মোহরের কুমারীত্ব প্রমাণ করতে সে একই রাতে তিন তিনবার নিজের সম্পত্তির সুড়ঙ্গে হানা দিতেও দ্বিধা করেনি।
সেদিনই মোহর বুঝেছিল যে তার হাতে গরম জল পড়ে ফোস্কা পড়লে তার স্বামীটি উফ করার পাত্র নন।
তবু তো দেখতে দেখতে এই মানুষটার পণ্য হিসেবে, সংসারের দুধ দেওয়া গাভী হিসেবে, দুহাতে ভার বহনকারী শক্ত চাকা হিসেবে মোহর কাটিয়ে দিল ২০ টা বছর...
আজ বাড়িতে কেউ নেই, সবাই শ্রীরামপুরের মাসির মেয়ের বিয়েতে গেছে, মোহর যায় নি।
মুক্তি পেয়েছে।
কাজের লোকেদের দিয়ে কাজ করিয়ে রাখতে হবে, ঘর বাড়ির দেখাশোনা করতে হবে, মেয়ে ফিরলে খেতে দিতে হবে এসব অকাট্য ন্যায্য দায়িত্বের যুক্তি তে।
দরজায় কলিং বেল। ছ্যাঁত করে উঠলো বুকের ভেতরটা। তবে কি....
রিঙ্কু বলেছিল, অবিনাশ একবার দেখা করতে চাইছে তার সাথে। মোহরের কোথাও বেরোনোর উপায় নেই, তার পায়ে পায়ে হাজার চোখের ভিড়, কেবল রিঙ্কুকে ফোন করে জানিয়েছিল দুপুরটুকু সে একা থাকবে বাড়িতে।
তবে কি....
দরজাটা খুলে কেমন ঠান্ডা হিম হয়ে যেতে লাগল মোহরের সমস্ত শরীর। বুকের ভেতর ধ্বস নামছে, কে যেন টিপে ধরছে গলা।
অবিনাশ.....
চোখে এখনও সেই পাগল চাউনি, ঠোঁটের কোল জুড়ে আদুরে চাঁদ, বলিষ্ঠ সুঠাম চেহারা, চুলগুলো সাদা-কালোয়..
"
এসো"..
মোহর সরে দাঁড়িয়ে ঢুকতে দিল তার অভি কে।
এই নামেই ডাকতো মোহর..
"
কেমন আছো হিয়া?"...
হিয়া...হিয়া...হিয়া...
মনে হল আছড়ে পড়ছে সমস্ত সমুদ্র আজ মাটির বুকে। ভিসুভিয়াস দাউ দাউ করে জ্বলছে...
মোহর ঘুরে তাকালো, এক লহমায় অবিনাশের ঠোঁট হাজার কথা বুনতে লাগল মোহরের মরুভূমি হয়ে ওঠা দুটো কঠিন মৃত্তিক ঠোঁট জুড়ে।
কেবল নিশ্বাসের শব্দ আর ভেসে যাওয়া অনুভব।
বাধ ভাঙা আবেগ, শরীরী যৌনতা না প্রেম! এসব মোহরের মাথার ভেতর কেমন তালগোল পাকাতে লাগল..
সময়, সময়, সময় তুমি আর এগিও না...
টিংটং...
"
খুলছি"...
অবিনাশের এলোমেলো চুল, দামাল নিশ্বাসে তখনও মারমুখী ঝড়। মোহরের ব্লাউজের হুক খোলা, আঁচল বাউল...
সিঁদুরের টিপে তির্যক ইঙ্গিত।
"কি ব্যাপার কি মা?এতো দেরি লাগে একটা দরজা খুলতে?"..
মোহরের গলা অব্ধি অপরাধের সাপ লেপ্টে রয়েছে। অবিনাশ জামার বোতাম আটকে, সিঁড়ির মুখে।
"
আরে ইনি? কি ব্যাপার? কেউ বাড়ি নেই আর তুমি তোমার পুরোনো বয় ফ্রেন্ড কে ডেকে এনে, মা জাস্ট শেম অন ইউ...ছি: নিজের দিকে চেয়ে দেখেছো? আমি সবই জানি মা, সবই, বাবা সাধে তোমায় সারাজীবন সন্দেহ করে?"..
"
ভুল বুঝছো তুমি, তোমার মায়ের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না, আমি তো কালই আবার চলেই যাচ্ছি,  জাস্ট দেখা করতে এসেছিলাম।"
অবিনাশের কথাগুলোর ভেতর কেমন দূর্গন্ধ, ঝেড়ে ফেলা ময়লার মতোই যেন একটু আগের সমস্ত  মুহুর্তকে কুয়াশায় ঢেকে দিতে চাইছে সে।
"
আই নো দ্যাট ইউ আর ভেরি রিনাউন্সড সেলিব্রিটি স্যার। দিস থিংস আর নাথিং টু ইউ পিপল।বাট হাউ ডেয়ার শি ইস,একজন বাড়ির চারদেওয়ালে থাকা মহিলা হয়ে এই ধরনের স্টেপ তুমি নাও কোন সাহসে মা..."
"
প্লিজ কুল ডাউন বেবি।কিছুই হয়নি এতো কিছু বলার মত। উই আর জাস্ট ওল্ড ডেজ ফ্রেন্ড। দেখা করেই চলে যেতাম। আমার মারাত্মক টাইট শিডিউল, বুঝতেই তো পারছো। সো কুল ডাউন।"
মেহুল এতো বড় একজন নামজাদা পরিচালকের সামনে একটু সমীহই করল এবার, চুপ করে রইলো।
"
ইউ আর কোয়াইট গ্রোন আপ, এন্ড ম্যাচিওর।
প্লিজ এই বিষয়টাকে আর টেনো না। ফরগেট ইট। বাই, কিপ ইন টাচ।দিস ইস মাই নাম্বার।" বলেই একটা ঝকঝকে কার্ড ধরিয়ে দিল মেহুলের হাতে।
মেহুল মুচকি হেসে, " ওকে স্যার, ইউ ডোন্ট ওরি, আমি সামলে নেবো।"..
অবিনাশ কাছাকাছি এলো মোহরের, মোহরের পা গুলি অবশ, হাতের পাতায় ঠান্ডা স্রোত বইছে। কেউ যেন তাকে ভরা বাজারে উলঙ্গ করে শত কোটি চাবুক মারছে সপাটে। নিজের মুখ নিজেই লুকিয়ে ফেলতে চাইছে দশ আঙুলের অন্ধকার জালে।
"
সামলে নিয়েছি, চিন্তা কোরোনা, কুল ডাউন, নর্মাল বিহেভ করো। এতো আড়ষ্ট হবার মত কিছুই তো হয়নি।"
অবিনাশের ঠোঁটের চাঁদে কালো আমাবস্যা,  কেমন রক্তচোষা হায়নার মত কালো ধারালো দাঁত।এক অদ্ভুত ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি অবিনাশের মুখে।
মোহরের দুচোখ টলটলে, কিন্তু একফোঁটা জলও গড়ালো না।চেয়ে রইলো তার অভির দিকে।
তার অভি?মাথার ভেতর চিরিক করে উঠছে জ্বলন্ত কারেন্ট...
বড় করুণা হল মোহরের এই পুরুষটির উপর, যাকে সে প্রেমিক ভেবেছিল এতোদিন, এতোদিন....

অবিনাশ বেরিয়ে গেল দরজা ঠেলে, এঁদো গলি পেরিয়ে আলো ঝলমলে রাজপথে...
"খেতে দাও, খেতে দাও".. এক অসম্ভব অশ্রদ্ধায় কিছুটা তার হাতে খেতে চেয়ে খানিক করুণা করছে তাকে এমন ভঙ্গিমায় মেহুল ঝনঝনিয়ে উঠলো। দুম দুম করে পা ঠুকে উঠে গেল উপরে...
ঠোঁটদুটো অসম্ভব জ্বালা করছে মোহরের। বুকের ভেতরের মুখ যে দাঁত দিয়ে কেটে গেছে তা বুঝতে পারছে শিরিশিরানি জ্বালায়।
মাথা টা ঘুরছে।
পড়েই যাবে এবার, হঠাৎই দুহাতে জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে তাকে দুটি স্নেহের হাত, " বৌদি গো'...
কাজের মেয়ে বাসন্তী।
"
কি হল গো বৌদি, ওঠো দেখি,ওঠো। আমি অনেক্ষণ এসেছি বৌদি, ওই বাবু তখন দিদির সাথে কথা বলছিল। দিদি যা চিল্লাচ্ছিলো,পাড়ার মোড় থেকে শোনার মতো।
সব শুনেছি বৌদি গো। তোমার এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে বলো দেখি বৌদি? তোমার মন, তোমার শরীর, তোমার জীবন, তুমি  কাউকে ভালবেসে যদি দুদন্ড বাঁচতে চাও, তাতে কি অপরাধ বৌদি। ওঠো দেখিনি ওঠো।
দিদির তো কতো ছেলে বন্ধু, তোমার একজন এলেই এতো দোষ? কোনো অন্যায় করো নি তুমি বৌদি, আমি বলছি তোমায়, আমাদের রাধা সতী, সেও ভালবেসেছিল কানাই কে। সে দেবী। তুমি তো কারোর ক্ষতি করো নি। কেবল ভালবাসার একটু ছোঁয়াই তো চেয়েছিলে..."
মোহর হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। বাসন্তী ছুট্টে গিয়ে সদর দরজা টা দিয়ে এলো। তারপর উঠানে বসে পড়া মোহরের আঁচল গুছিয়ে দিয়ে বলল, " বোরোলিন লাগিয়ে দিই গরম করে, ঠোঁটে কালো দাগ হয়েছে গো বৌদি, রাতে আরেক মিন্সে নইলে তোমার ওই দাগের উপর দাগ করবে। আমরা মেয়ে রা কেবল শরীরই হয়ে যাই বৌদি গো। বুকের বাইরেটাই সবাই হাতে মুচড়ে গেলো, ভিতরটা ছুঁয়েও দেখলো না গো।"
বাসন্তীর চোখে জল,মোহরের চোখে জল শুকিয়ে জ্বলে ওঠা আত্মসম্মান। এই মুহুর্তে নিজের আধুনিকা মেয়েটির তার দিকে ওঠানো আঙুল গুলি  বড় আবছা লাগছে বাসন্তীর বাসন মাজা আশ্রয়ী হাতদুটোর সামনে।
মোহর উঠে দাঁড়ালো, তার দুপায়ের পাতা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল সমস্ত পাপ-বোধ, সতীত্বহীনতার মিথ্যে অন্ধকার।
চোখ মুছে, খুব গম্ভীর স্বরে বলল, " মেহুল খেতে এসো, এরপর আমার অনেক কাজ আছে, তাড়াতাড়ি নামো।"...
খাবার টেবিলে বাসনের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ হল না।
কেবল, তিনটি নারীর মনের ভেতর দিয়ে কোথাও রঙ এঁকে দিচ্ছিল এক বারুদ ওঠানামা।
সমাজ তুমি যবানিকা খোলো,
     কাঠগড়ায় আজ রোদ্দুর...