গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

৫ম বর্ষ সংখ্যা ১৪ ।। ২৭ মে ২০১৬

চল্লিশজন গল্পকারের ছাপ্পান্নটি গল্প । লেখকসূচি - ব্রতী মুখোপাধ্যায়, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, দময়ন্তী দাশগুপ্ত, তাপসকিরণ রায়, সুধাংশু চক্রবর্তী, তাপস মৌলিক, সাঈদা মিমি, অসিত চট্টোপাধ্যায়, মোহম্মদ আনওয়ারুল কবির, প্রদীপভূষণ রায়, রুখসানা কাজল, মুস্তাইন সুজাত, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, নীহার চক্রবর্তী, পৃথা রায়চৌধুরী, মৌ দাশগুপ্তা, প্রদীপ ঘটক, সিদ্ধার্থ দত্ত, সুবর্ণা রায়, দেবাশিস কোনার, গৌতম সেন, শুভাশিস চক্রবর্তী, অমিতাভ দাস, দেবাশিস সেনগুপ্ত, মেহেদি সম্রাট, খোরশেদ খোকন, নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত, দীপঙ্কর বেরা, সরিৎ চট্টোপাধ্যায়, জাকিয়া জেসমিন যুথি, সালাউদ্দিন আহমেদ, তুষার সেনগুপ্ত, আলি হাসির গুঞ্জন, জাহিদুল ইসলাম, নির্মল্রন্দু কুন্ডু, জুবায়ের আহম্মদ, কাওসার পারভিন, সুস্মিতা মহলানবিশ ও সফিক আমিন ।

                 সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করুন

সম্পাদকীয়



ঘোষণা মত বিশেষ অণুগল্প সংখ্যা প্রকাশিত হল । দুটি করে গল্প চেয়েছিলাম । বলে রাখি, বিপুল সাড়া পেয়েছি । যারা দুটি করে গল্প পাঠিয়েছেন তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই একটি করে গল্প গ্রহণ করেছি । স্পষ্ট নির্দেশ ছিল গল্পের শব্দসীমা অন্তত ২৫০ এবং সর্বাধিক ৩৫০ কাম্য । ৭০/৮০ শব্দের গল্প যেমন পেয়েছি, ৪০০/৪৫০ শব্দের লেখাও পেয়েছি । এমন কিছু লেখা দেওয়া গেলো না । লেখা পাঠানোর সময়সীমা ছিল ২০শে মে, তারপরেও অনেকে লেখা পাঠিয়েছেন । সেই লেখাগুলি গ্রাহ্য হয়নি, আমি নিরুপায় । সাড়ে তিনশো শব্দসীমা অতিক্রম করেছে এমন কিছু লেখা গল্পগুচ্ছর নিয়মিত সংখ্যায় দেবো । অন্যান্য কারণেও অনেক লেখা গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি । অমনোনীত লেখাগুলি সম্পর্কে কোন পত্রালাপ করা সম্ভব নয় ।

গল্প বা গদ্যকাহিনীর ক্ষেত্রে ‘অণুগল্প’ ধারণাটি নিতান্তই নবীন । ওয়েব পত্রিকাগুলিই অণুগল্পের ধাত্রীগৃহ । অভিধা থেকেই স্পষ্ট এমন গল্প আকারে ছোট হবে । কিন্তু কত ছোট তার কোন সর্বজনগ্রাহ্য মিমাংসা এখনও পর্যন্ত কেউ করেছেন এমন জানা নেই । আকারে ছোট হলেও সেটি ‘গল্প’ হয়ে উঠেছে কি না এটাই বিচার্য । ‘অণুগল্প’ ও ‘ছোটগল্প’র মধ্যে কোন প্রকরণগত প্রভেদ আছে বলেও আমি মনে করি না । নাটকীয় আকর্ষণীয়তা, উৎকন্ঠা, চরম মুহূর্ত, লিখনশৈলীর দৃঢ় সঙ্ঘবদ্ধতাই সার্থক ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য । অণুগল্পের ক্ষেত্রেও এই মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় থাকা চাই । রবীন্দ্রনাথই বাংলা ছোটগল্পের ভগীরথ । তাঁর কথায় –
“ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা
ছোট ছোট দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বস্মৃতিরাশি
প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল ।
নাহি বর্ণনার ছটা
ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ব নাহি উপদেশ ।
অন্তরে অতৃপ্ত রবে
সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ” ।
অর্থাৎ ‘ছোটগল্পে ঘটনার ঘনঘটা, বর্ণণার ছটা থাকে না, তত্ব, উপদেশও থাকে না, থাকে অতৃপ্তি যাতে মনে হয় শেষ হয়ে না হইল শেষ’ । এর চেয়ে ছোটগল্পের বা অণুগল্পের যোগ্যতম সংজ্ঞা আর কিইবা হতে পারে ।
  
‘গল্পগুচ্ছ’ বিগত পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশ হয়ে চলেছে, বিপুল পাঠক সমাদরও ইতিমধ্যেই পেয়েছে । আশা করবো এই বিশেষ অনুগল্প সংখ্যাটিও পাঠক সমাদৃত হবে । এই সংখ্যায় প্রকাশিত হল ৪০ জন লেখকের ৫৬টি গল্প, তার মধ্যে ১৯ জন গল্পকার এই প্রথম লিখছেন গল্পগুচ্ছতে  । বিপুল সংখ্যক প্রাপ্ত লেখার মধ্য থেকে প্রকাশিতব্য লেখার নির্বাচন, সম্পাদনা ও প্রকাশনা এক কঠিন কাজ, সময় ও শ্রমসাধ্য তো বটেই । একসঙ্গে বাংলা গল্পের এমন বিপুল সমাবেশ এর আগে কোন ওয়েব পত্রিকায় হয়েছে বলে আমার জানা নেই । সেই হিসাবে কিছু ভুল-ভ্রান্তি মার্জনীয় । আমার শংশয় নেই যে সংশোধনযোগ্য অনেক ভুলভ্রান্তি থেকে গেছে । সুধী পাঠক মার্জনা করবেন । খুশি হবো পাঠকের পাঠ-প্রতিক্রিয়া ও মতামত জানতে পারলে ।

ব্রতী মুখোপাধ্যায়



ঔরস 
 
খানিকটা নিজে নিজে হেঁটে আর বেশিটাই বাপের কাঁধে চেপে চড়াই ছেড়ে নিচে নামছে দুর্বি। মহাকোশলের এ দিকটায় পাহাড়ঘেরা আকাশিয়া গাঁয়ে ফিবছরশীতের শেষে পুরানা মায়ের থানে যে জমজমাট মেলা বসে সেখান থেকেইফিরছে। হাতে একটা কাগজের চড়কি, লালনীলহলুদসবুজ রঙের। পকেটেমোমফালি।
দুর্বি বলল--- বাপু! মেসোকে তো দেখলাম না।  
 
দুর্বিরা
 বেরিয়েছিল ভোরে। মাসির ঘর আকাশিয়ার মাঠের নিচে। সেখানে বাসিভাত ডাল আর সবজি দিয়ে সেঁটে নিয়েছে দুজন। 
দুর্বির
 বাপ বলল--- মেসো বাগি হয়ে গেছে। 
--- বাগি কি, বাপু?
--- বুঝবি না এখন। 
দুর্বি
 দুহাত দিয়ে বাবার গাল চেপে ধরে আদর করে একবার। তারপরই জানতে চায়--- বাঘ দেখেছ, বাপু?  
---
 দেখেছি। 
---
 ভালুক দেখেছ?
---
 দেখেছি, বাপ।
---
 হাতি?

বাপ ছেলেকে বলতে থাকে--- পাহাড়জঙ্গলে সাতপুরুষের বাস, জমিন ছিল,এখন নেই। ভিনগাঁয়ে কাজ না জোটে যখন, জঙ্গলে কাঠপাতা, গাছের মূল,ইঁদুর, সাপ এইসমস্ত আনতে যেতে হয়। পাশ দিয়ে বাঘ হাঁটে নিজের মনে। দলবেঁধে ভালুক গাছে উঠে চাক ভেঙে মধু খায়। দূরে দাঁড়িয়ে হাতি এক একদিনঅবাক হয়ে দেখে।
দুর্বি বলে--- জঙ্গল দিয়ে এলাম। বাঘ দেখলাম না তো? 
---
 সন্ধের বাদে বারণঝিলের ধারে জলের জন্যে আসে। বকাস নি আর, বাপ। আলো থাকতে ঘর যেতে হবে। তোর মার পরশু থাকতে জ্বর।

দুর্বির খিদে পেয়েছে। মোমফালি পকেটে আছে মনে পড়ল। কিন্তু সে তো মারজন্যে। মোমফালি মার খুব প্রিয়।  বাপকে বলল--- পা দুখছে।

যখন ঘরের বেশ কাছেই, গুলমোহর গাছগুলোর লম্বা লম্বা ছায়া অন্ধকারেই মিশেযেতে প্রস্তুত, জনাকয় লোক তাদের সামনে। হঠাৎ একটা শব্দ, আর একটা শব্দ,আরও একটা তারপর। দুর্বির বাপ উপুড় হয়ে মাটির উপর আর সে বাপের কাঁধথেকে ছিটকে মাটিতেই একটুখানি দূরে, বাপের মুখ তার দিকে ফেরানো। সেচেঁচিয়ে কেঁদে উঠল--- বাপু---!!! 
একজন
 বলল--- লড়কা ঠো?
একজন
 বলল--- ডায়না হাত কী আঙ্গুলি ছাঁট দেঁ? 
---
 ছোড় দে ইসে।
তৃতীয়
 জন।

দুর্বির বয়েস তিন বছর সবে। মরতে মরতেও তার বাপ ভাবছিল কেউ হয়ত ছেলেকে একদিন বলে দেবে জলপাইউর্দির  লোকগুলো কারা আর রাইফেল কি।    

বিছে 

বিলাইতির বিছেকে বড় ভয়। বৃষ্টিবাদলার দিনে বিছেদের আনাগোনা বাড়ে। যেজন্যে সে বারান্দা বলে একচিলতে যা আছে সেখানে রাতের বেলা ছেঁড়া মাদুর পেতে দুবলাপাতলা শরীরটা এলিয়ে দিতে পারে না। তাকে একটিমাত্র দরজার বাঁদিক করে একটুখানি জায়গা নিয়ে ঘরেই শুতে হয়। শুয়েই সে, গরম যতই লাগুক, পুরনো ছেঁড়া সুজনি দিয়ে মাথা থেকে পা অব্দি সারা শরীর ঢেকে নেবে ভাবে।   
 

ছোট্ট একটা ঘর। তারই মধ্যে জানালার পাশটায় কালু তার বউকে নিয়ে শোয়। কালু যখন খুদে,
 মানে বুকের দুধ ছাড়ে ছাড়ে যখন, তখন রাতে এক একদিন ঘুম ভাঙলে তার বাপ পাগল যেমন আদর করত, আদর করতে করতে  বলত--- বিলাইতি, আমি তোকে অন্ধকারেও  দিব্যি দেখতে পাই।  
মানুষটাকে, বছর চার হবে, লেবেল ক্রসিং আছে অথচ নেই বলে রেলগাড়ির চাকার তলায় যম তুলে নিল।  
 

বিলাইতির জোছনাপারা রঙ। ঘুম না এলে হঠাৎ সে ভাবে---
 তাকে কি কালুরাও রাত্রে দেখতে পায়?    
 

কালুর সবে বিশ। রঘুবীরের মেয়েটার ছুকছুকুনি বেশি,
  গায়েগতরে বেড়ে উঠল সেদিন। কালু তার চোখের মণি অল্প বয়েস থেকে। বিলাইতি লক্ষ করল, দুইজনে ক্রমশই বেপরোয়া। সুযোগ পেলেই চকাস চকাস চুমু। বিলাইতি দেখে ফেলল কালু শুধু চুমুই খাচ্ছে এমন না, টুকুসোনার বাতাবীবাতাবী মাইদুটোয় যখনতখন হাত দিচ্ছে---  কে আছে কে নেই খেয়াল করছে না।     
 

কি বলতে কী করে ফেলে! টুকুসোনার পেট হয়ে যায় যদি?
 ভয় করে তার। নরেন মুদির কাছে কিছু ধার নিয়ে,  সঙ্গেসঙ্গেই প্রায়, ছেলের জন্যে সে কানেখাটো গোপাইল্যার রাস্তার কিনারায় ফেলে রাখা পানগুমটিটা জলের দরে কেনে। তারপরই টুকুসোনার মা জামাইএর হাতে ওই অকালধাড়ী মেয়ে ছাড়া আর কিছুটি না ঠেকালেও বিলাইতি দেরি না করে ছেলের বিয়ে দেয়।   

কালু চায় দেরি না করে রাত্তির নেমে আসুক। সে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে মুখে কিছু পুরে বউকে জড়িয়ে শুয়ে পড়তে চায়। কথা বলে না কেউ। তবে শব্দ ভেসে আসে। টুকুসোনা এমন সব শব্দ করে,
 মাদুরের ভেতর থেকে অন্ধকাররঙের বিছে বিষাক্ত দাঁড়া উঁচিয়ে বিলাইতির দিকে তেড়ে আসতে চায়। তার চোখের পাতা ভিজতে থাকে নিশব্দে।   
বিলাইতির এখনও মাসে একবার ছেঁড়া কাপড় লাগে।