গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মৌসুমী ঘোষ দাস

৬৪/বি কালিচরণ লেন                                 
  

রাত একটা বাজে। নিঝুম নিস্তব্ধ ৬৪/বি কালিচরণ লেনের ভাড়া বাড়ির বড় খাটটার ওপর অতিশ গভীর ঘুমে মগ্ন। কিন্তু পারমিতার চোখে ঘুম নেই। ধীরে ধীরে পূবের বড় জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো পারমিতা। খোলা জানালা দিয়ে নির্নিমেষে চেয়ে রইলো বাইরের আকাশটার দিকে। সন্ধ্যেবেলার জমাট মেঘটা কেটে যাওয়াতে একটা দুটো করে বেশ কিছু তারা এসে ভিড় জমিয়েছে নিকষ কালো আকাশটার বুকে। কোনটা মিটমিট কোনটা বা স্থির হয়ে আলো দিচ্ছে। ৬৪/বি কালিচরণ লেনের এই বাড়িটাতে আসার পর থেকে কবে যে এভাবে আকাশের দিকে চেয়ে তারা দেখেছে মনে করতে পারলো না পারমিতা।

ছোটবেলায় ছাদে বসে বাবার সাথে প্রথম তারা দেখার শুরু। মনে আছে গরমকালে লোডশেডিং হলে বাবা ছোট্ট পারুকে নিয়ে ছাদে এসে বসতেন। আঙ্গুল দিয়ে দিয়ে তারা চেনাতেন, “ওই দেখ ধ্রুবতারা, ওই লালচে রঙের তারাটা হল মঙ্গলগ্রহ আর সাদা ঝকঝকে উজ্জ্বল যে তারাটা দেখছিস, ওটা হল বৃহস্পতি। আকাশের ওই তারাদের ভিড়ে মিশে আছেন তোর ঠাকুরমা, তোর মা। ওইখান থেকে ওঁনারা আমাদের দেখছেন, আমাদের কথা শুনছেন”।

চোখের কোনটা ভিজে উঠলো পারমিতার! অনেকদিন পর মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ছে! খোলা জানালা দিয়ে আকাশের বুকে তারাদের ভিড়ে কেবলি তাঁদের খুঁজে বেড়াচ্ছে! মা সেই কোন ছোটবেলায় আকাশে চলে গেছেন! বাবার কাছেই বেড়ে ওঠা। আর সব মেয়েদের মত মায়ের সঙ্গ পায়নি বলে ছোট থেকেই পারমিতা একটু ভীতু, মুখচোরা, প্রতিবাদ না করে মানিয়ে চলা গোছের মেয়ে। বাবা মেয়েকে যথেষ্ট আগলে রেখেছেন, তবুও মায়ের স্থান তো নিতে পারেন নি। মেয়েলী সমস্যার সমাধানে মায়ের সাহায্য থেকে বঞ্চিত পারমিতা একটু বেশিই নিজেকে গুটিয়ে রাখে।

যদিও আজ বেশি করে বাবার কথাই মনে পড়ছে! এতদিনে সে বুঝে গেছে গুরুজনেরা যা বলেন বা করেন, সবটাই সন্তানের ভালোর জন্য। বাবা প্রথম যেদিন অতিশকে দেখেছিলেন সেদিনই প্রবল আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু পারমিতা তখন অতিশের প্রেমে এতটাই উন্মত্ত যে বাবার আপত্তির কথা ভাল তো লাগেইনি বরং যে বাবা পারমিতার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে না করে ছোট্ট মেয়েটাকে আঁকড়ে এতদিন বেঁচেছিলেন, সেই বাবাকে নিজের চরম শত্রু বলে মনে করেছিল। আর তারপর একদিন বাবাকে না জানিয়ে মাত্র চার মাসের প্রেমিক অতিশের চাপে কলেজ থেকে বাড়ি না ফিরে, নদীর ধারের কালী মন্দিরে কোনোরকমে বিয়েটা সেরে সোজা এসে উঠেছিল ৬৪/বি কালিচরণ লেনের অতিশের ছোট্ট এই ভাড়া বাড়িতে।

তখন অতিশ একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ছিল। পারমিতা সবে কলেজের প্রথম বর্ষ। পরবর্তীতে অতিশ বিভাগীয় পরীক্ষা দিয়ে তৃতীয় শ্রেণির কর্মীতে প্রোমোশন পায়। কিন্তু পারমিতা আর পড়াশুনা করেনি। এদিকে এভাবে বিয়ে করার জন্য বাবার সাথে অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না ওদের। তারপর অভিমান করে থাকতে না পেরে এক বিকেলে স্নেহ বৎসল বাবা নিজেই এসেছিলেন একমাত্র মেয়ের বাড়িতে। তারপর থেকে আসা যাওয়া শুরু হলেও অতিশ কোনোদিন পারমিতার বাবাকে ভাল চোখে দেখেনি। পারমিতাকেও বাবার বাড়ি যেতে দিত না। যদিও ঘরের বাইরের লোকের কাছে অতিশ খুব নম্র ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত! মাথা নিচু করে পথ চলে। কারো সাথে কোন ঝামেলায় নেই ।স্ত্রী ছাড়া কোন মহিলার দিকে চোখ তুলে চায় না।

তা প্রথম দিকে পারমিতাও স্বামীর চাকরি, স্বভাব নিয়ে খুব অহংকার করতো। বিশেষ করে নিজের স্ত্রী ছাড়া কোন মহিলার দিকে চোখ তুলে চায় না, বাড়িতে ফিরেই স্ত্রীকে নিয়ে আদরে মেতে ওঠে। সে স্বামীর ঘরণী মানে স্বামী সোহাগিনী! আর কোন মেয়েই বা স্বামী সোহাগিনী হতে চায় না! কিন্তু ধীরে ধীরে অতিশের দিনের বেলার নম্র ভদ্র রুপটা সরেগিয়ে রাতের অন্ধকারে বন্ধ ঘরের ভেতর একটা জানোয়ারের রুপ নিতে শুরু করলো! অতিশেরভালোবাসা ভয়ঙ্কর রকমের বিকৃত যৌন অত্যাচারে পরিণত হল। স্ত্রীর ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক,শরীর ভাল আছে কি না আছে, কোন কিছুকেই আমল না দিয়ে যখন তখন জোর-জবরদস্তিচলতো। বিভিন্ন ধরনের বিকৃত উত্তেজক ছবি দেখা আর স্ত্রীর ওপর তা প্রয়োগ করাটা এক নেশায়পরিণত হল! অতিশের বিকৃত ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনরকম আপত্তি করলেই ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতো।একে তো স্বেচ্ছায় বাবার বাড়ি ছেড়ে এসেছে অতিশের কাছে, তায় আবার লেখাপড়া ও উচ্চমাধ্যমিকে ইতি টেনেছে। কি যে করবে পারমিতা বুঝে উঠত না!  ভোর হলেই অতিশ ভালমানুষ হয়ে যায়! তখন পারমিতা কান্নাকাটি করে, বোঝায় অতিশকে, কিন্তু কোন পরিবর্তন নেই!রাত হলে আবার সেই হিংস্র জানোয়ারের রূপ নেয়।

বাবাকে তো আর এসব কথা বলা যায় না! তবুও একদিন আভাষে ইঙ্গিতে মানসিক অশান্তির কথা জানালে বাবা বলেছিলেন “একদম যদি মানিয়ে নিতে না পারিসতবে চলে আয় না আমার কাছে । পড়াশুনাটা আবার শুরু কর,আমি বেঁচে থাকতেই দেখ যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিস”। কিন্তু চলে আসতে পারে নি পারমিতা।বাবার কাছে পাকাপাকি ভাবে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই আচমকা একদিন স্ট্রোক হয়ে বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান!উচ্চমাধ্যমিক পাশ পারমিতার তিন কূলে আর আপন বলতে কেউ রইল না। অগত্যা বাধ্য হয়েই স্বামীর ঘরে মুখ গুঁজে থাকা। কিন্তু পারমিতা অতিশকে ত্যাগ করে বাবার বাড়ি ফিরে যাওয়ারসিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই কারণে অতিশ দিনে দিনে অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে পারমিতার ওপর বিকৃত অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়!

মুখচোরা অন্তর্মুখী চরিত্রের পারমিতা কাকে বলবে এসব কথা?মাঝে মাঝে ভাবতো, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে! কিন্তু কোথায়, কার কাছে যাবে? কাকেই বা বলবে এসব কথা? যদি অতিশের কানে ওঠে তবে হয় অত্যাচার করে মেরে ফেলবে, নয় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে! তখন কি করবে সে? তবুও একদিন সাহস সঞ্চয় করে তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বয়সীবড় ননদকে অতিশের বিকৃত যৌন অত্যাচারের কথা জানায়। শুনে বড় ননদ অবাক হয়ে বলেছিল,
 “আমার হীরের টুকরো ভাইয়ের সম্পর্কে এসব কি বলছ তুমি? ওকত ভাল ছেলে তা তুমি জানো? ছেলেদের একটু আধটু অমন শারীরিক চাহিদা থাকে! স্ত্রীদের কর্তব্য তা পূরণ করা! তোমার জামাইবাবুরও আছে! আমি নিঃশব্দে তা পূরণ করি। আমি কি ঘরেরবাইরে সে সব কথা পাঁচ কান করতে গেছি? শুনেছো কোনোদিন? আর তুমি কিনা এসেছো তোমাদের চার দেওয়ালের ভেতরের কথা আমাকে জানাতে? ভাইয়ের কথামত চললেই তো পারো!কি গুণ আছে তোমার শুনি? ওই তো একটু রূপ! তাও তো আমার ভাই বউঅন্তঃপ্রাণ! অন্যমহিলার দিকে চোখ তুলেও চায় না! ভাই যদি তোমাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের কাছে রাত কাটাতো তোমার ভাল লাগতো?”

পারমিতা ভয়ে আর কথা বাড়ায় না! যদি অতিশের কানে ওঠে!নইলে ননদের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, “সঙ্গমের সময় জামাইবাবুও কি বড়দির স্তন দুটোশক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে? সিরিঞ্জ দিয়ে গরম জল জোর করে যৌনাঙ্গে প্রবেশ করায়? শরীরের গোপন জায়গায় সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়? স্ত্রীর মুখে রেতঃপাত করে? বাবার মৃত্যুর পর চারদিনের কালাশৌচের মধ্যেও একজন পিতৃহারা কন্যাকে শোক করার সময়টুকু দেয় না যে স্বামী, তাঁকে কিভাবে মানুষ বলবে পারমিতা? চোখের জল মুছে ফিরে এসেছিল ননদের বাড়ি থেকে। তাই আজখুব মনে পড়ছে বাবার কথা! বাবার ইচ্ছেমত যদি লেখাপড়া মন দিয়ে করতো, তবে এদিন আজদেখতে হত না!

তাও যদি একটা সন্তান হত ওদের, তাহলে হয়তো কিছুটা পাল্টাতো অতিশ! কিন্তু ভগবানের কি যে মহিমা কে জানে! আট বছর হল বিয়ে হয়েছে, একটি সন্তানও আসেনি পারমিতার গর্ভে। অথচ দিন দিন অতিশের অত্যাচার বেড়েছে। আজকাল বাইরেরকারো সাথে সেভাবে মিশতে দেয় না। অফিস যাওয়ার সময় পারমিতাকে ঘরে তালা বন্ধ করে যায়।পারমিতাও ভয়ে কাউকে কিছু বলে না। স্বল্প শিক্ষিতা পারমিতা মহিলা কমিশনের নাম শোনেনি কখনো!

আজ সন্ধ্যেবেলা, হ্যাঁ, যে অতিশ বাইরের কারো সাথে পারমিতাকে মিশতে দেয় না, সে অতিশ সন্ধ্যেবেলা সাথে করে একজন অপরিচিতকে নিয়েএসেছিল। লোকটার চোখ দুটো যেন কেমন! বাইরে থেকে অনেক রকম খাবার কিনে এনেছিলঅতিশ। সেসব খাবার পারমিতাকে পরিবেশন করতে বলে। পারমিতা খাবার পরিবেশন করে দিয়েবেডরুমে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর অতিশ এসে পারমিতাকে ড্রইং রুমে যেতে নির্দেশ দেয়। আরসঙ্গে এও বলে, “ইনি নাকি অফিসের বস। এনাকে একটু খুশি করতে হবে। বেশি কিছু না, একটুহেসে কথা বলা, অথবা উনি হাত টাত ধরলেও ধরতে পারেন। যদি শুতে চায়, পারমিতা যেন হেসেরাজি হয়! তাহলেই নাকি নতুন ফ্ল্যাটের জন্য অফিস থেকে অতিশ একটা বড় মাপের লো পাবে”।

অতিশের কথাটা শুনে পারমিতা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল! দিনের পর দিন নিজে শারীরিক মানসিক অত্যাচার করেও ক্ষান্ত হয় নি! আজ আবার বাইরের লোকের কাছে নিজের স্ত্রীকে পাঠাতে চাইছে!! আজ এই লোকটিকে মেনে নিলে কাল আবার যে অন্যকাউকে বাড়ি আনবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই! আর তাই এই প্রথম আজ তীব্র প্রতিবাদকরেছিল পারমিতা! কিন্তু সে প্রতিবাদের মাসুল দিতে হয়েছিল চরম ভাবে। অপরিচিত সেই লোকটা অধস্তন কর্মচারীর সুন্দরী বৌকে হাতে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে অতিশকে গালাগাল দিয়ে চলেগিয়েছিল। আর তারপর ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে, অবাধ্য স্ত্রীর মুখ বেঁধে, বেল্ট দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মেরেছিল অতিশ। সারা শরীরে চাকা চাকা কালশিটে করে দিয়েছে! তারপর নিজে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে শুরু করে। প্রবল শ্বাসের সমস্যা শুরু হয় অতিশের!

কিছুদিন ধরেই অতিশ শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছে। সকালসন্ধ্যায় নিয়ম করে ইনহেলার নিতে হচ্ছে। আজ সন্ধ্যের ইনহেলার সময় মত নেওয়া হয়ে ওঠেনি।অতিশ হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানায় বসে পড়ে। টেনে টেনে শ্বাস নিতে নিতে পারমিতাকে আদেশ করেইনহেলারটা পাশের ঘর থেকে এনে দেওয়ার জন্য। পারমিতা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটাকেকোনোরকমে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পাশের ঘরে, যেখানে টেবিলের ওপর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে ইনহেলার রাখা ছিল। কিন্তু হঠাৎ কি যে বুদ্ধি হল পারমিতার! প্রচণ্ড আক্রোশে অতীশকে একটু শাস্তি দিতে চট করে ইনহেলারটা লুকিয়ে ফেলল। আর পুরনো খালি একটা ইনহেলার এনে এগিয়ে দিল অতীশের দিকে। অতীশ কোন প্রশ্ন না করেই সেটা নিয়ে প্রাণপণে পাফ নিতে লাগল। কিন্তু ফাঁকা ইনহেলারে কিছুই হল না। শ্বাসকষ্ট বেড়েই চলল। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে লাগল! মুখের শিরা উপশিরা ফুলে উঠলো অতিশের!

এখন বিছানায় শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে অতিশ। ভোরের আলো এসে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে পূবের খোলা জানালা দিয়ে। অনেক দিন বাদে আজ এই ভোরেরআলোটা খুব সুন্দর আর মিষ্টি লাগছে! পারমিতা জানালার কাছ থেকে সরে এলো। বিছানার একপাশ থেকে অতিশের মোবাইলটা তুলে নিল। একটা নম্বর ডায়াল করে বলল, “হ্যালো, কালিপুকুর থানা? আমি ৬৪/বি কালিচরণ লেন থেকে বলছি। এখুনি চলে আসুন। কাল রাতে এখানে একটা খুনহয়েছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুনই হয়েছে! আমি ওনার বাড়ি থেকেই বলছি। আমি কে? মৃতর স্ত্রী পারমিতা বলছি!”