গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৬

৫ম বর্ষ ১৯তম সংখ্যা ।। ২০শে অগস্ট ২০১৬

এই সংখ্যার লেখকসূচি - সুবীর কুমার রায়, রুখসানা কাজল, তাপসকিরণ রায়, নীহার চক্রবর্তী, সতীশ বিশ্বাস, শীলা পাল, সুকান্ত পাল ও পলাশকুমার পাল ।

            সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করুন

সুবীর কুমার রায়

সাইকেল

         প্রথম প্রথম যেমন সব ছেলেরই সাইকেল চালানোটা নেশার মতো হয়ে যায়, আমার ক্ষেত্রেও তাই ছিল। অথচ এমন কোন সাইকেল নেই, যেটা চালাবার সুযোগ পাওয়া যায়। ষষ্ঠীতলায় অনুপ নামে একটা ছেলে ছিল। সে আমার প্রায় সমবয়সি হলেও, কাছেই একটা ঘড়ির দোকানে কাজ করতো। সে একটা সাইকেলে চেপে দোকানে যেত। খুব ছেলেবেলা থেকে সে সাইকেল চালাচ্ছে, তাই সাইকেলের প্রতি তার তেমন কোন আকর্ষণ নেই। অনুপ আমাদের পরিচিত ছিল। শেষে অনেক ভেবে তাকে সাইকেলের কথা বললাম। সে আমাকে বললো, দুপুরে সে সাইকেলটা নিয়ে আসতে পারে এবং বিকেল পর্যন্ত আমি তাকে নিয়ে সেই সাইকেল চালাতেও পারি, তবে এর মধ্যে তার দুটো শর্ত আছে। এক, সে নিজে সাইকেল চালাবে না। শুনে তো আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। আর দ্বিতীয় শর্ত, তাকে রোজ আইসক্রীম ইত্যাদি খাওয়াতে হবে। মরেছে, এখানেই তো ঝামেলা দেখা দেবে। রোজ রোজ তাকে আইসক্রীম খাওয়াবার মতো পয়সা কোথায় পাব? অন্য সময় হলে নাহয় অঞ্জনের দৌলতে রাধামোহনের কাছ থেকে বাকীতে নিয়ে, তাকে যত খুশী আইসক্রীম খাওয়াতে পারি, কিন্তু সাইকেল চালানোর সময়, ঐ ভরদুপুরে রাধামোহনকে কোথায় পাব? কিন্তু এত কিছু ভাবতে গেলে সাইকেল পাওয়া যাবে না। তাই রাজী হয়ে গেলাম। আশ্চর্য, আইসক্রীমের পয়সা নিয়ে এত ভাবনা হ, অথচ দুপুর বেলা সাইকেল চালালে স্কুলের কী হবে, তা কিন্তু একবারও ভাবলাম না, মনেও হল না।

         শুরু হল স্কুল পালানো। দুপুর বেলার চড়া রোদে অনুপকে সামনে বসিয়ে, সাইকেল চড়া শুরু হল। আইসক্রীমওয়ালা দেখলে, কাঠি আইসক্রীম খাওয়ানোও শুরু হল। এর জন্য সুযোগ মতো পয়সা হাতানোও শুরু হল। একদিন সাইকেল নিয়ে দুজনে জগাছা দিয়ে গিয়ে, বম্বে রোড পর্যন্ত গেলাম। অসম্ভব গরম ও চড়া রোদে ঘেমে নেয়ে অনুপকে সামনের রডে বসিয়ে, অকারণে সাইকেল চালাচ্ছি। অনুপের সব থেকে বড় গুণ, সে কখনও নিজে সাইকেল চালাতে চায় না। বম্বে রোড থেকে আবার একই পথে ফিরে কদমতলা হয়ে যোগমায়া সিনেমা হলের কাছাকাছি এসে দেখি, একটা পাগলী রাস্তার মাঝখানে বসে আছে। তার পাশেই, সম্ভবত সে নিজেই, অনেকটা বড় বাইরে করে রেখেছে। অভিজ্ঞ অনুপ আমাকে আগেই সতর্ক করে দিল। আমিও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে পাগলীর কোন পাশ দিয়ে যাব, ঠিক করতে শুরু করে দিলাম। শেষপর্যন্ত পাগলীকে দক্ষ হাতে কাটিয়ে চলে গেলাম বটে, তবে ঐ এক সের বড় বাইরেকে কাটাতে পারলাম না। ফলে সাইকেলের সামনের চাকায়, বস্তুটা মাখামাখি হয়ে গেল। রিম, স্পোক্, টায়ার, সর্বত্র নারীবরে মাখামাখি। ঐ অবস্থাতেই কোন মতে আমাদের খেলার ছোট্ট মাঠটায় এসে, পুকুরে সাইকেল নামিয়ে, অনেক চেষ্টায় সাইকেল পরিস্কার করা হল। ঐ রোদে প্রায় চোদ্দো-পনের কিলোমিটার পথ ডবলক্যারী করে, ঘেমে নেয়ে হাঁপিয়ে গিয়ে, শেষপর্যন্ত যাত্রার পরিসমাপ্তি হল।

         একদিন এক ভীষণ বিপদের সময় জানতে পারলাম, সাইকেলটা আদৌ অনুপের নয়, অনুপ যে দোকানে কাজ করে, সেই ঘড়ির দোকানের মালিকের সাইকেল। সেদিন সাইকেলটা আমি একাই চালাচ্ছি। কথা ছিল বিকেলবেলা অনুপকে ফেরৎ দিয়ে দেব। দুপুরবেলা বাড়ির পাশের স্ল্যাব ঢালা রাস্তা দিয়ে বেশ জোরে বড় রাস্তায় এসেই দেখি, ডান দিক থেকে একটা পুলিশের জীপ তীর বেগে এগিয়ে আসছে। ব্রেক কষলাম, সাইকেল দাঁড়ালো না। সাইকেলের কোন ব্রেকই কাজ করছে না। আমাকে দেখে বিপদ বুঝে পুলিশের জীপ খুব জোরে ব্রেক কষে, তীব্র শব্দ করে, আমার সামনে জীপটা দাঁড় করিয়ে দিল বটে, কিন্তু আমি তীর বেগে সাইকেল নিয়ে গিয়ে জীপে ধাক্কা মারলাম। সামনের চাকা ভয়ঙ্কর ভাবে বেঁকে গিয়ে, টায়ার ফেটে গেল। জীপ থেকে দুতিনজন পুলিশ নেমে, আমাকে খুব ধমকাতে শুরু করলো। দুপুরবেলা হলেও, অনেকেই ঘটনাটা দেখলো। জীপ চলে গেল বটে, কিন্তু আমি বোকার মতো সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সাইকেল চেপে যাওয়া তো দুরের কথা, টেনে নিয়ে যাওয়াও যাচ্ছে না। শেষে অনেক কষ্টে সাইকেলের দোকানে টেনে নিয়ে গিয়ে, সাইকেলটা সারাতে দিলাম। এত দিন পরে ঠিক কত মনে নেই, তবে অনেক টাকা চার্জ লাগবে ও অনেকক্ষণ সময় লাগবে শুনে প্রমাদ গুনলাম। অনুপকে সাইকেল ফেরৎ দেবার সময়, সাইক্লোনিক গতিতে এগিয়ে আসছে। টাকাই বা কোথায় পাব? স্কুল পালিয়ে পরের ব্রেকহীন সাইকেল নিয়ে পুলিশ জীপকে ধাক্কা মেরেছি শুনলে, বাড়িতে আহ্লাদিত হয়ে, সাইকেল সারানোর টাকা দেবার সম্ভাবনা বড়ই ক্ষীণ। শেষে সন্তুকে দিয়ে ওর মাকে বলে, টাকা নিয়ে গিয়ে সন্ধ্যাবেলা সাইকেল ফেরৎ নিলাম। সাইকেল সারানোর দোকানের কাছেই, একটা চায়ের দোকান ছিল। ঐ দোকান থেকে অনেকবার চা পাতা কিনে নিয়েও গেছি। দোকানের মালিক যে আবার অনুপের কাকা হয়, জানা ছিল ন।। তিনি কেন যে লালবাজারে পুলিশের চাকরি না করে, চা পাতা বেচতে বসেছেন, কে জানে। তিনি অনুপকে চিনতেন কিনা জানিনা, তবে তিনি অনুপের সাইকেলটা ঠিক চিনতে পেরেছেন। অপরকে সাইকেল দেওয়ার জন্য ও সাইকেলটা বেঁকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য, অনুপকে দোকানের মালিক ও তার কাকা, উভয়েই খুব বকাবকি করেন। সেদিনই প্রথম জানতে পারলাম, সাইকেলটা ঘড়ির দোকানের মালিকের এবং সেদিন থেকেই আমার অনুপের সাইকেল চালানো বন্ধ হয়ে গেল।

         আজ এত বছর পরে, এ কাহিনী লিখতে বসে, অনুপকে খুব মনে পড়ছে। তার ঘড়ির দোকান আজও আছে, কাকার চায়ের দোকানও আছে, হয়তো সাইকেলটাও আছে, শুধু অনুপ-ই আজ আর নেই। নকশাল আন্দোলনের সময় পাইপ গানের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। সে নিজে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়েছিল, না নকশালরাই তাকে মেরেছিল বলতে পারবো না।


রুখসানা কাজল

সবকিছু ভেঙ্গে গেল
   
              তিনতলা কাঠের গ্যারাজের সামনে দড়ির টুলে বসে তাকিয়ে ছিল সহদেব। সামনে অবারিত সবুজ ক্ষেত। কচি ধানেরা একে অন্যের গায়ে লুটিয়ে পড়ছে বাতাসে।  পলকের  জন্য এক আধবার মাটির  শ্যামাবুক দেখা যাচ্ছে। মনোরম দৃশ্য।  সহদেব তাকিয়ে আছে কিন্তু  দেখছে না। ওর মন উতলা।চোখের সামনে ভেসে উঠেছে  তেলহীন একরাশ রুখুসুখু চুলের ভেতর বিধবা মায়ের ফর্সা মুখ। কোমর ছাপিয়ে  লকলক  করে দুলছে গোছা গোছা কোঁকড়াচুল। ঠাকুমা কাঠের পিঁড়িতে বসে মোটা চিরুণি দিয়ে চড়চড়  করে আঁচড়ে দিচ্ছে আর নিজেদের ভাগ্যকে মনের সুখে শাপশাপান্ত করে চলেছে।  চুল আঁচড়ানোর ফাঁকে এক আধবার  মার মাথার সাদা খুলি দেখা যেত।  সাদা  সিঁথিকে  মনে হত  জমির ভেতর শুয়ে থাকা ফাঁকা আলপথ।

               ঠাকুমার পেছনে বিশাল বাঁশবন। আর বাঁশবনের পেছনে ছবির মতন মন মাতানো   জমিরপর  জমি। বাবার অপঘাত মৃত্যুর পর পুরানো বর্গাচাষীদের  নিয়ে একসাথে কাজ করে মা ঠাকুমাই সব দেখেশুনে রেখেছিল। কিছুদিন হয় সহদেব হাত লাগিয়েছে জমির কাজে।মা ঠাকুমাই ডেকে নিয়েছিল, একজন পুরুষ মানুষ হাতের পাঁচ না হলি কি চাষাদের সাথে পারা যায়! সহদেবেরও পড়াশুনা ভাল লাগছিল না। ব্যস জুটে গেল সে মা ঠাকুমা জমি আর ফসলের সাথে।

পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বড়দা মেজদা  শহরে থেকে  পড়াশুনা করত। স্বচ্ছলতার অভ্যাসে তারা গ্রামে আসতে চাইত না বেশি।ফলে তাদের জন্যে চাল ডাল তেলের সাথে নগদ টাকা পাঠাতে হত মাস গেলেই। বড়দা  শহুরে জীবনকে আপদমস্তক গ্রহন  করে নিয়েছিল। বলেই দিয়েছিল সে গ্রামে থাকবে না। বিয়েও করবেনা গ্রাম্য কোন মেয়েকে। মাঠাকুমা বুঝেছিল বড়দা তার উকিল বন্ধু্র বোনকে বিয়ে করে শহরেই থাকবে। কেউ কোন আপত্তি করেনি। জ্যাঠা মশাই  বলেছিলেন, আপত্তি করলেই কি  শুনবে? শুধুমুদু মান সন্মান খোয়ানোর কি দরকার।

             মেজদা ছোটবেলা থেকেই ধূর্ত। বাবা তো প্রায়ই রেগে মেগে বলত ওটার নাম শকুনি রাখলে ভাল মানাত। লম্বা ফাজিল ছেলে। ওর হাতে সম্পত্তি গেলে   ভিক্ষার থালা হাতেরাস্তায় নামতে হবে সকলকে ।  ইয়ার দোস্তোদের সাথে মস্তি করে টাকা  উড়ানোই ছিল  মেজদার প্রথম কাজ। এর জন্যে যখন তখন টাকা চাইত। না দিলে  ঘরের টিন, ধান চাল পুকুরের মাছ বিক্রি করে দিত শহরে বসে থেকেই। মারধর  বকাঝকায়  মেজদার কিছু হত না। জেঠু বলতেন হারামজাদা বিলাইয়ের স্বভাব পাইছে ।
             সেবার অঘ্রাণে বাগচী অপেরা নতুন পালা নামিয়েছিল “আলেয়া”। জব্বর হিট চলেছে। আলেয়ারূপী মঞ্জুশ্রীর নাচ গান অভিনয়ে নারী পুরুষ সবাই মুগ্ধ। বাবা জেঠু কাকারা এই  নিয়ে পাঁচদিন আলেয়া দেখেছে। মা ঠাকুমাসহ  তাদের বাড়ির জ্ঞাতিগোষ্ঠীও মুড়িমুড়কি, নাড়ু, বিস্কিট আর ফ্লাস্কে চা নিয়ে দুদিন দেখে এসেছে মঞ্জুশ্রীর অভিনয়। ছোট কাকিমা তো আলেয়ার গান মুখস্থ করে ফেলেছিল। যখন তখন গেয়ে উঠত!

বড়দা মেজদা জিন্নাভাই ফারুক ভাইরা রোজ যাত্রা দেখে।  ওরা  থাকে প্যান্ডেলের শেষ দিকে বাবা কাকাদের চোখের আড়ালে। ওখান দিয়েই অভিনেতা অভিনেত্রী নর্তকীরা মঞ্চে ছুটে আসে। দাদারা গাঁজা মেশানো সিগ্রেট খায় আর   প্যান্ডেলে  আসা সুন্দর সুন্দর মেয়েদের দেখে আওয়াজ দেয়। অনেকেই দেখেছে  জিন্নাদা আর মেজদা  যাত্রা্পার্টির  ছেলেমেয়েদের সাথে  বাংলা টানে আর হুলোড় করে। বাবা জেঠুকে বলেছে, যেকোন দিন  সুবলরে নিয়ি বসতি হবেনে দাদা।    শূয়োরটা পাক্কা ফক্কড় হয়ি উঠিছে দিনকে দিন।”ঠিক হয় যাত্রাপালা শেষ হলেই সুবলকে কড়া টাইট দেওয়া হবে।

             বাবা জ্যাঠা কাকারা আবার আলেয়া দেখতে যাচ্ছে । বাবার হাতে সাত ব্যাটারির  ঝকঝকে টর্চ। মা জেঠিমা কাকিমা মাঝে মাঝে উঠতে বসতে ঠেস দিচ্ছে, ঘুমের মাতালে ভোর রাতি দরোজা খুলতি পারবনা কলাম! মঞ্জুশ্রীর আঁচলের তলি  মাথা রাখি ঘুমায় থাকলিই ত হয়! ছোটকা ছিল বেশী  চালাক। ছোটকাকিমা প্রাইমারী ইশকুলের শিক্ষিকা। প্যাচের প ও  জানেনা। প্রথমদিনই  আলেয়ার শাড়ী দেখে বলে রেখেছে, ওই শাড়ি চাইইই চাই।  অন্যসময় খ্যাচ করে  উঠলেও ছোটকা একবারে রাজী হয়ে যায়। অফিসের বন্ধু আকবরকে হাসতে হাসতে বলে, আরে অই শাড়ি পালি ত কেনব। রাজী হলাম ত  মঞ্জুশ্রীরে দেখতি।”  ছোটকাকে দুই বেলা শাড়ির কথা  মনে করিয়ে দেয় কাকিমা।  ছোটকাও হ্যা হ্যা করে, শুনুরে শুনু, দরকার হলি আমি প্যারিস থেকি তোরে অই শাড়ি আনি দিবানি। মঞ্জুশ্রীর কসম।  ছোটকার ডায়লগ শুনে  বাবা জেঠা  বিষম খায়। ঠাকুমা শাসায়, দূর দূর শয়তানের ঝাড়। সরল মাইয়াডারি ঠকালি কিন্তুক খপর করি দিবানি তোগের কয়িদিলাম।

            বাড়ির দুই মাইল পেরিয়ে শিবঠাকুরের  এক থান। বট অশত্থ পাকুড়ে প্যাচ খেয়ে একসাথে উঠে গেছে আকাশ ছেয়ে। পূজা আচ্চাও হয়। খুব জাগ্রত থান। গল্প করতে করতে থান পেরুচ্ছে এই সময়ে আর্তনাদ করে উঠে বাবা, দাদারে লতা আমারে কাটিছে। বান দে বান দে শীগগিরি!আমারেবাঁচা দাদা।ধপধপ করে  সবগুলো টর্চ জ্বলে  উঠে। মাটি থেকে অনেকখানি মাথা উঁচু করে দুলে যাচ্ছে লতা।সাত ব্যাটারির টর্চ দিয়ে বাড়ি মারতে মারতে পাগলের মত বাবা চেঁচায়, তোরে মারিই  মরব।আমি কি তোর পর আছিলাম রে শয়তান!” মন ভিজে উঠে সহদেবের। মরার সময় মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়েস ছিল বাবার।  শত চেষ্টা , হাহাকার, বিলাপ পেছনে  ফেলে দুদিনের ডাক্তার বদ্যি ওঝাকে ফেল করে দিয়ে মরে গেল বাবা। মনে আছে  দাহ হয়নি বাবার। নদিই নিয়েছিল বাবারে।

            বড়দা এসেছিল। মাথা ন্যাড়া করে ফিরে গেল। মেজদা  জাঁকিয়ে বসল তার সম্পত্তির ভাগ চাই। ভাগ নিয়েই চলে গেল। বড়দা সম্পত্তি নিল না কিন্তু সংসারের দায়ও নিতে চাইল না। সেই সময়  এগিয়ে এলো বাবা জ্যাঠার বন্ধুহাবিবচাচা। সব রকমের সাহায্য দিয়ে ঠাকুমাকে বলে দিল যেমন চলছিল সংসার তেমনই চলবে। আপনি চিন্তা করবেন না মা।

           সহদেবের  বিয়ের দু বছর বাদে মেজদা একরাতে এসে হাজির। সহদেবের বউকে সোনার আংটি দিয়ে বলেছিল, জমপেশ করি রান্ধো ত বোউমা। বালছাল খায়ি মুখ মরি গেছে। তারপর মাকে ডেকে বলেছিল, ওমা তোমার ঘরে ঘুমাতে গেলাম। রান্ধা হলি  ডাকি দিও । খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরদিন সকালে চলে গেছিল। খালি হাতে এসেছিল আবার খালি হাতেই চলে গেল।

            পরের  মাসে দুই গ্রাম দূরের হাবুল মন্ডল বাড়িতে এসে জানালো সে বাঁশবাগান থেকে শুরু সব আবাদি জমি কিনে নিয়েছে সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।  জমি পর্চা সব আসল। বিক্রি করেছে সুবল দাস এবাড়ির মেজোছেলে। বড়দাও ছুটে এসেছিল।কিন্তু উকিল হয়েও কিছু করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত হাবিবচাচার শালিসে  হাবুল মন্ডল জমি ফিরিয়ে দিতে রাজী হয় কিন্তু তাকে তো  তার টাকা ফেরত দিতে হবে। কোথায় পাবে অত টাকামেজদা তখন নাগালের বাইরে। নেপাল ঘুরে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে।
                বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে যে পরিবারে কখনো অভাব দেখা যায়নি আজ সে পরিবার অভাব অনটনের সামনে ভেঙ্গে পড়ে। মধ্যবিত্তের যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচতে বউ আর দু ছেলেমেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির আশ্বাসে চলে আসে এপারে। এখানে কামলা খাটলেও লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই। সত্যিকার ভাবেই কামলা খেটেছে সহদেব। কলকাতা থেকে  বহুদূর রেলের জমিতে ছাপরা তুলে থেকেছে বছরের পর বছর। সারাদিন জমিতে  কাজ করে রাত গভীর হলে ছাপরা ঘরের গুমোট ছেড়ে রেলরাস্তার ওপারে বিস্তৃত জমির দিকে তাকিয়ে বসে থাকত। সহদেবের কথা কম। বউ এই বিদেশেও কিছু মানুষের সাথে ভাব করে নিয়েছে। তাদের গল্পের বিষয় ছেড়ে আসা স্বদেশের একটুকরো উঠোন, একটি ছোট্ট পানাপুকুর, খেয়েপরে চলার মত ক্ষেতি জমি আর বংশ বংশ পরম্পরায় গড়ে তোলা ভিটেমাটি ঘর, উড়ে আসা কবুতরের সাথে কাক চড়ুইয়ের ঝগড়া, ক্ষেত থেকে তুলে আনা তরিতকারির তাজা সবুজ ঘ্রাণ, আকাশ বাতাস জুড়ে মন মাতানো কত রকমের গান ! বউয়ের গল্পে আস্তে আস্তে মিশে যায় এখানকার সিনেমা দেখা, হিং, পোস্তবাটা, দল বেধে বেড়ানো। কিন্তু  সহদেবের কোন গল্প নেই।  কাজের কথা ছাড়া সে আর কোন গল্প জানে না। প্রতিদিন ভোরে পুব আকাশের দিকে একটি প্রণাম সে রেখে দেয়। মা ঠাকুমা মারা গেছে। ভাইদুটোও  চলে এসেছে এপারে। বাংলাদেশের ঘরবাড়িতে  এখন মেজদা থাকে। 

               কুড়ি বছর বাদে বউ নিয়ে বাড়ি এসেছিল সুবল।  সাথে দুই বাচ্চা। কেউ ঠাঁই  দিতে রাজী হয়নি। সুবল বউকে বলেছিল আমি যা করিছি তাতি ক্ষমা আমি পাইনা।  আশাও করিনা।  আমার  আর ক্ষমতা নাই। থাকতি পারলি থাক । না পারলি চলি যা। আমার মনে কোন বাঁধন নাই জানিস তুই।” বউ ভালই জানে।  কাচারি ঘরে দুদিন অনাহারে  থেকে বউ নেমে এসেছিল বাচ্চাদের জন্যে জেঠু কাকাদের সংসারে কাজ করতে।  যতদিন মা বেঁচে ছিল কথা বলত না ওদের কারো সাথে । মৌনব্রত নিয়েছিল মা। সারাদিন ঘরের  বারান্দায় বসে বাঁশঝাড় আর তার পেছনে ফসলের ভারে নুয়ে থাকা থরে থরে সাজানো জমি দেখত। মরে যাওয়ার আগে বলে গেছিল সুবল যেন তার দাহ কাজে না আসে। বাড়িঘর জমি  লিখে দিয়েছিল সুবলের বউয়ের নামে। হাবিবউল্লা কাকার ছেলে নবি শেখ গ্রামের  চেয়ারম্যান । তার কাছে দলিল জমা রাখার দায় দিয়ে নিরাসক্ত অমায়াবী মুখে  মা বলেছিল, নবি তোর ত অজানা নাই কিছু। সুবলে য্যান আর কেউরে ভিটে ছাড়া না  করতি পারে সে দায় আমি তোরে দিলাম। তোর ধর্ম সাক্ষী।” নবির জন্যেই আজ মেজদার ছেলেমেয়রা পড়াশুনা করছে। মেজদা ঝুলে আছে ভাঙ্গা কব্জার মত । দরকারে বে দরকারেও যার কোন মূল্য নাই।  কেবল ঝনাৎ  করে একটু শব্দ হয় ।

             দেশে যাওয়ার কথা আর ভাবে না। এখানে ভালই আছে এখন। সহদেবের গ্যারেজের নাম ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে গ্রামে। ভাড়া সে চায় না কারো  কাছে। যারা সাইকেল রাখে তারাই ভাড়া ঠিক করে তুলে দেয়। জ্যৈষ্ঠের গরমে হাত পাখার  বাতাস নিচ্ছে গ্যারেজে বসে একজন ভাল পোশাকের সুন্দরপানা মানুষ হেঁটে এসে  হঠাত জিগ্যেস করে, কিরে কেমন আছিস নুটু?  এই আছি, ভাল আছি, আর  থাকা---উদাস  উত্তর দিয়ে মোটাসোটা  সহদেব জোরে পাখা ঘুরায়। এখানে তার জেলার অনেকেই আছে । গ্রাম ফাঁকা করে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা চলে আসছে।  তাদেরই কেউ হবে হয়তবা। বউদি কি রান্দিছে রে আইজকে?  তোর সাথে দুপুরে  ভাত খাবো, এই  বসলাম--- এবার চমকায় সহদেব।  তাদের গরীবগুবরো চাষাভুশোদের পোশাক ত এমন নয়। তাছাড়া এমন টকটকে রঙের সাহেবি স্বচ্ছল মানুষ এখানকার হাতের বগলে দেখা যায়না সচারাচর। কিরে চিনিছিস ? মাথা নেড়ে না  বলে সহদেব।  ভবেন  পন্ডিতের পাঠশালা! এবার ঘুরে সামনা সামনি বসে  সহদেব। চশমা খুলে হাসছে মানুষটা। সহদেব কিছুতেই চিনতে পারেনা। ভবেন পন্ডিতের পাঠশালায় তারা অনেকেই পড়াশুনা করেছে। কিন্তু সে ত ছিল বালকবেলা। তালের পাতায় কয়লাকালিতে লেখা অ আ ক খ র কুসুম সময়। ভবেন পন্ডিত  কিছুতেই কাগজ কলম ধরতে দিত না। কারো কাছে কলম পেলেই বেধড়ক মার দিত। এই পরিণত মুখের বন্ধুতা ধরে রাখা হাসিমুখের  মানুষটি কি সেই পাঠশালার কোন বালক? কিন্তু কে ?

                  শেষ বিকেলে দুজন হাঁটতে হাঁটতে রিকশা স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। অমলের পাকাধান গায়ের রঙ্গে বিকেলের আলো ঠিকরে পড়ছে। সহদেবের ইচ্ছে  করছে না বন্ধুকে ছাড়তে। সহদেবের উদাস নির্লিপ্ত বুকে ঢেউ তুলেছে বন্ধুসুগন্ধ । সেই  তালের ডিঙ্গি, পাকা খেঁজুর কুড়ানো সকাল, সেই সরকারী ইশকুলে লালসবুজ পতাকার সামনে, আমার সোনার বাংলা গাওয়া দিন ! জোর করে রিকশা ভাড়া দিয়ে দেয় সহদেব । অকালবৃদ্ধ, ক্লান্ত, ভাবলেশহীন, ভাগ্যের বাহাতের পুতুল সহদেবকে  জড়িয়ে ধরে অমল। কোথাও ঝর্ণা পতনের শব্দ হচ্ছে ! হাজার হাজার লক্ষকোটি ঝর্ণা মূক পাথরের গায়ে সশব্দে ভেঙ্গে পড়ছে----
      





তাপসকিরণ রায়

রমাকান্ত নামা—আত্মকথা


         রমাকান্তর এক সাবেকি বন্ধু এখনও কাছেভিতেই থাকেন। জীবনের ধার ঘেঁষে কত যে বন্ধু এলো গেল সে সব হিসেব আজ হারিয়ে গেছে ! যে জন এখন টিকে আছেন তাঁকে নিয়েই চলা। অম্বিকা, ওর সঙ্গে আগে প্রায়ই দেখা হত, কুশল বিনিময় হত। 
--কেমন আছ অম্বিকা ?
--ভালো, শরীর চলছে এখনও ঠিকঠাক। তুমি কেমন আছ বল ?
--শারীরিক ভালো--নানান চিন্তা তো লেগেই থাকে মনে।
--শৈলবালার শরীর এখন ভালো?
--একটু ভালোর দিকে। তোমার নাতি নাতনীরা এলো ? 
--ওরা চলে যাবে, এত দিন তো ছিল, একবার আসতে পারতে ? 
--কি করে আসি বল ? ঘরে স্ত্রী অসুস্থ। দেখাশোনারও তো কেউ নেই। 

         এমনি গল্পস্বল্প চলে অম্বিকার সঙ্গে। ওঁর বউ মারা গেছেন বছর দুই আগে। সেই থেকে ওঁ একা। এক মাত্র ছেলে, বউ-মেয়ে নিয়ে বিদেশে থাকে। বছরে, দু বছরে একবার আসে। রমাকান্তর স্ত্রী এখনও বেঁচে আছেন। অনেক দিন ধরে বিছানায়। ডাক্তার ওষুধ পাল্টে যাচ্ছেন। এই ভালো, এই খারাপ অবস্থা। রমাকান্ত জানেন আর বেশীদিন নেই শৈলবালা। এ কথা কাকে বলবেন তিনি, কেই বা শোনার আছে ? অম্বিকার মত তাঁর ছেলেও বিদেশে পড়ে আছে। বছরে এক পাক দিয়ে যায়। বাপ, মাকে দেখে যায়। তাও রমাকান্তর মাঝে মাঝে মনে হয় ভেতরে কতটা আন্তরিকতা নিয়ে বাপ মাকে দেখতে আসে কে জানে ! তবে হ্যাঁ, নাতনী তার খুব ভালো, দাদু দিদাকে যে মনে প্রাণে চায় এটা তার হাব-ভাবে ধরা পড়ে। নাতনী আসলে রমাকান্ত তাঁর বয়েসটা ভুলে যান। সময়ে অসময়ে নাতনীর সাথে নেচে ওঠেন--এমন কি স্ত্রী ভাল থাকতে তাঁকে নিয়ে নাতনীর সঙ্গে এক আধবার লুকোচুরিও খেলেছেন। এ সব ক্রমশ: যেন স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে! সময় সময়ের মত কেটে যাচ্ছিল,তাকে এক মুহূর্ত ধরে রাখার সাধ্যি বুঝি স্বয়ং ভগবানেরও নেই !
         
         এক দিন হঠাৎই শৈলবালা মারা গেলেন। আসলে মৃত্যুর দরজাতেই তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। আশপাশের কিছু লোকজন এসে ছিল। তারা অতি পরিচিতের মত কথা বলছিল রমাকান্তর সঙ্গে। কিন্তু রমাকান্ত আশ্চর্য হয়ে ছিলেন, ওদের বেশীর ভাগকেই তাঁর অপরিচিত মনে হয়েছে। তার মানে তার চোখে পরিচিতরাও এখন ক্রমশ অস্পষ্ট অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে ! তিনি জানেন যে ওরা গতানুগতিক সান্ত্বনা দিয়ে চলে যাবার পর বাকী পরিচয়টুকুও মুছে যাবে। 

         আজ রমাকান্ত একলা। অম্বিকার মতই ঝারা হাত-পা। সাধু-সন্ন্যাসী না হয়েও এমনি নির্ঝঞ্ঝাট কজন হতে পারে ? জন্মের পর অনেকের মাঝে মানুষ লালিত পলিত হয়। বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন সব মিলিয়ে চেনা জানা পরিচিতের এক ছড়ানো জাল বিছিয়ে যায়। হাসি কান্না গানের মাঝ দিয়ে বয়ে যায় সংসার। তারপর মাঝ বয়স পেরোলে ভাঁটার টান শুরু হয়। জীবনের লতাপাতা ডালপালা ধীরে ধীরে ছাঁটতে থাকে। এমনি করে  সবাই, সবাই আজের রমাকান্তর অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। 

         রোজ ভোরে হাঁটতে বের হন রমাকান্ত। তিনি জানেন এই সচল অবস্থার পতন মানে তাঁরও পতন। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ--বেঁচে থাকার আশ কার নেই? যে বৃদ্ধ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে সেও আরও ক’বার এ পৃথিবীর শ্বাস টেনে নিয়ে যেতে চাইবেন। কারণ মৃত্যু হল এক মহা অনিশ্চয়তা। মৃত্যুই যদি মানুষের এক জন্মের সমাপ্তি হয় তবে এ জন্ম কেন ? আর ভাবতে পারছিলেন না রমাকান্ত। আজ ভোরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা পথ তিনি এসে গেছেন। বেশ পরিশ্রান্ত লাগছিল তাঁর। পাশের পার্কে এসে বসলেন তিনি। আজকাল একটু পরপর বিশ্রাম নিতে হয়। তিনি জানেন দিন প্রতিদিন শরীরের ক্ষয় হয়েই চলেছে ! এ ক্ষয়ই তো জীবনের ধর্ম--বৃদ্ধি ক্ষয় জন্ম মৃত্যু। সব প্রাকৃতিক ধর্ম। সব জানি আমরা, তবু ভুলে থাকতে চাই ! তবু একটা সময় আসে যখন অহরহ তা মনে পড়ে যায়।   
--তুমি এখানে ?

         রমাকান্ত দেখলেন তাঁর সামনে অম্বিকা দাঁড়িয়ে। ওঁর হাতে অবলম্বনের লাঠি উঠে এসেছে। অম্বিকা বসলেন রমাকান্তর পাশটিতে। ওঁরা উভয়ে উভয়ের গা ছুঁয়ে বসে আছেন। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। সামনের মাঠে ছোট ছেলে মেয়েরা খেলে বেড়াচ্ছে। বাগানে রং ফুল ফুটে আছে। রাস্তা দিয়ে গাড়ি হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। লোকেরা আসছে যাচ্ছে। হাওয়া বইছে। স্নিগ্ধ হওয়া। রমাকান্ত, অম্বিকার গায়ের ধুতি শার্ট কাঁপছে। ওঁদের চুলগুলি বাতাসে এলোমেলো উড়ছে। ওঁরা নির্বাক বসে আছেন। মনে হচ্ছে অনন্ত কাল ধরে এমনি ভাবে ওঁদের ওপর দিয়ে হাওয়া বয়ে চলেছে। 
     


নীহার চক্রবর্তী

শুদ্ধ-বেলার গান


         খুব দরকার ছিল রাহুলের একটা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট । কিন্তু ১৫ই আগস্ট সারা ভারতে ছুটির দিন । এলাকায় ডাক্তার পাওয়াই ভার । নানা ফার্মেসিতে ও ঘুরলো । কিন্তু সবাই ওকে বলল,আজ কাউকে পাবেন না । বেশ হতাশ হল রাহুল । শেষে খোঁজ পেলো এক ডাক্তারবাবুর । স্মৃতিকণা ফার্মেসিতে বসেছে । রাহুল শুনেই ছুটে গেলো সেখানে ।

         কিছুক্ষণ বাইরে বসে থাকার পর রাহুল শুনল ডাক্তার প্রদীপ্ত রায় বসেছেন । সে শিশু-বিশেষজ্ঞ । প্রদীপ্ত নামে অনেককেই চেনে রাহুল । তাই নামটা নিয়ে ওর ভাবার সময় ছিল না । ফার্মেসির এক ছেলে বলল রাহুলকে,অপেক্ষা করুন । স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি । সে ছেলে রাহুলকে বেশ চেনে । ও স্থানীয় কেদার স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ।

         একটু পরেই ছেলেটি এসে রাহুলকে স্মিত হেসে বলল,আরে,আপনার নাম করতেই স্যার লাফিয়ে উঠলো । আপনি তো ডাক্তারবাবুর স্যার । তা উনি বললেন স্যারকে একটু অপেক্ষা করতে বল । আমি রোগীগুলো দেখেই ডাকছি । তার কথা শুনে রাহুল উল্লসিত । চোখের কোণে জল এলো । প্রদীপ্ত নামটা তখন ওর মনের মধ্যে আন্দোলিত করতে থাকলো খুব ।

         তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো । শিক্ষক-ডাক্তার মুখোমুখি কিংবা পিতা-সন্তানের মধ্যে অনেকদিন পর দেখাদেখি । প্রদীপ্তকে দেখে এবার মধ্যবয়স্ক রাহুল নিজেই প্রায় লাফিয়ে উঠলো । মুখ-ভরা হাসি । হাসি আর থামে না । রাহুলকে প্রদীপ্ত এক-মুখ হেসে বলল,বসুন,স্যার । কতদিন যে আপনাকে দেখিনি । মনে পড়ে খুব আপনার মুখটা । এখনো বুঝি সেই গো-বেচারা আছেন ? ছাত্ররা এখনো বিরক্ত করে আপনাকে ?ছাত্রের কথায় রাহুল বেশ মজা পেলো । লজ্জাও পেলো খুব । আমতা আমতা করে বলল,বুড়ো হতে থাকলে মানুষ তেজী হয় । জানিস তো ? প্রদীপ্ত হেসে ফেলে ওর সঙ্গে সহমত হল ।

         তারপর আর কি । রাহুলের কথামতো প্রদীপ্ত একটা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট লিখে দিলো । রাহুল তা হাতে নিয়ে ওকে বলল,কত দিতে হবে রে তোকে ?শুনে ভারি লজ্জা পেলো প্রদীপ্ত । অস্ফুট-স্বরে বলে উঠলো,কি যে বলেন স্যার । এই প্রথম বুঝি আমাকে পাপ কাজ করতে শেখাচ্ছেন ? ওর কথা শুনে রাহুল বাক্যহারা । চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো । হাতে পয়সা ছিল না । এক বন্ধুর কাছে থেকে কিছু এনেছিল ফিজ দেবে বলে ।

         হঠাৎ রাহুল প্রদীপ্তর মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকলো কীসব যেন । প্রদিপ্ত দাঁড়িয়ে উঠে রাহুলকে প্রণাম করে বলল,এই আশিস অনেক-অনেক চাই,স্যার । অনেক পেন্ডিং আছে কিন্তু ।তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের সাগরে নিজেদের ভাসিয়ে দিলো ।

বাইরে এসে রাহুল মহানন্দে এক প্যাকেট উইলস্ফ্লেক কিনে বসলো । মনে মনে বলল,এ আমার ছেলের টাকায় কেনা । বৌ কিছু বললে আচ্ছা করে শুনিয়ে দেবো না ? ইয়ার্কি পায়া হ্যায় ? পরে অবশ্য রাহুলের বৌ সব শুনে খিলখিল করে হেসে বলে উঠলোছেলের দেওয়া অমৃত তো । আমার কিছু বলার নেই । যত পারো ধোঁয়া ছাড়ো । এক প্যাকেটের বেশী তো নয় ।


সতীশ বিশ্বাস

 প্রতিবাদ
                                         

আসুন,আসুন। বাড়ি চিনতে কোন অসুবিধা হয় নি তো?’--ছেলের বাবার সৌজন্য। মেয়ের বাবা সার্থক সরকার বললেন,‘না,না। টোটোওলাই—’
-ও টোটো নিয়ে এসেছেন?
-হ্যাঁ,বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়ের মা,বাবা আর কাকা সোফায় বসলেন। ছেলে এসে নমস্কার করে তাদের পাশে বসল। ৩ প্লেটভর্তি মিষ্টি এল। ছেলের বাবা একটু হেসে বললেন,‘সামান্য...। খেয়ে নিন।সরকারবাবু সে কথায় গা না করে, ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,‘তা বাপু, তোমাকে প্রথমেই একটা কথা জিজ্ঞেস করি। বলতো,তোমার সামনে যদি কেউ কোন অন্যায় করে, তুমি তাহলে কী করবে?’ছেলেটি উজ্জীবিত হয়ে বুক টান করে বলল,‘আমি তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করব।সরকারবাবু ২ সেকেন্ড ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে পড়লেন। তারপর, হাতজোড় করে  ছেলের বাবাকে বললেন,‘দুঃখিত। আপনার এই ছেলের হাতে আমি আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারব না। চলি।
ছেলের বাবা হা! সেই হা বন্ধ হবার আগেই টোটো চলে গেল।
                                                
 কাক

বাড়ির তারে মাঝে মাঝেই ৪/৫টা কাক এসে বসে। জনালা দিয়ে সুনীল তাদের দেখে। কাকগুলো ড্রেনের মধ্যে,আস্তাকুঁড়ে,আবর্জনার গাদায় ঠোঁট দিয়ে নোংরা ঘেটে কীসব খায়। কাকেরা চলে গেলে,সুনীল বাইরে বেরিয়ে দেখে প্রাচীরের ভিতরটা সাফ।
সেদিন সকালে কান্নার শব্দ শোনে গেল। সুনীল শুনলো--পাড়ায় নন্তুর দাদু মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল ৯০। খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন।
পরদিন কাকেরা আবার এল। প্রতিবারের মতো জঞ্জাল পরিষ্কার করে চলে গেল। দিন দুই পরে ও পাড়ার পঞ্চুর ঠাম্মা চলে গেলেন। প্যারালাইজ্‌ড হয়ে পড়ে ছিলেন। বিছানা থেকে উঠতেই পারতেন না।
উড়ে এসে বাড়ির তারে আবার এসে বসল কাক।






শীলা পাল

পাহাড়ে পাহাড়ে

পাহাড়ে পাহাড়ে একটা সময় খুব ঘুরে  বেড়িয়েছি ।হিমালয়ের আনাচে কানাচে ট্রেকিং করার নেশায় বছরে  দুবার  ঠিক  বেড়িয়ে পড়তাম।আমাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু ছিল ।ছ সাতজনের  মতো।নিজেরা ম্যাপ দেখে জায়গা ঠিক  করে  সমস্ত খবরাখবর নিতাম।যোগাযোগ করতাম গাইড দের সঙ্গে।তারপর সবকিছু  বাঁধাছাঁদা করে  জয় মা বলে তরী টি ভাসিয়ে দিতাম । কিছুদিনের জন্য  এই সভ্য  জগতটিকে ভুলে মনের আনন্দে পাহাড়ের সরল মানুষ গুলির সঙ্গে দিন কাটিয়ে  আসতাম ।এতো শান্তিতে দিনগুলো কাটতো যেন ফিরতে ইচ্ছে করতো না।মনে হতো চিরটাকাল যদি এখানে ই থেকে যেতে পারতাম। এই রকম এক ট্রেকিং এর পথে আলাপ হয়েছিল জন আর মারিয়া র সঙ্গে।হিমাচলের কিন্নর  উপত্যকায় সেবারের ভ্রমণ ঠিক  হয়েছিল। অনেক  কাল আগে প্রায় চল্লিশ বছর আগে র পুরনো স্মৃতি । কিন্তু মনের মধ্যে এখনও  স্পষ্ট  হয়ে  আছে।

       কোজাগরী  পূর্ণিমা ছিল সেদিন । আমরা কল্পা ফরেস্ট বাংলোর কাচে ঘেরা বারান্দা থেকে সামনের পাহাড়ের চাঁদের আলো ভরা রূপ মোহিত হয়ে দেখছি।আমাদের  পাশের  ঘরে  দুজন  বিদেশী  এসেছেন  আমাদের  গাইড  আগেই  বলেছিল।রাত  হয়ে গেছে তাই  ওরা শুয়ে  পড়েছে।কাল সকালে  আলাপ হবে।হঠাত  খুট করে আওয়াজ হলো।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক মেমসাহেব  হন্তদন্ত হয়ে  আমাদের  কাছে  এলো।"এক্সকিউস মি "আমরা কিছু বলার  আগেই  বলতে শুরু করলোতোমাদের কাছে  মাথা যন্ত্রণার মেডিসিন আছে।আমার  ফ্রেন্ড অসহ্য মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করছে  "।আমরা একটু  অবাক  হয়ে ওর হেল্পলেশ অবস্থা  দেখে বললাম  এই অলটিচুডের জন্য  হতে পারে । ও প্রায় কেঁদেই ফেললো।বললো এর আগে  অনেক অনেক হাই অল্টিচুডে গেছি এরকম হয় নি কখনও।আজকের যন্ত্রণাটা আমি দেখতে  পারছি না। প্লিজ  তোমরা আমাকে  একটু  হেল্প করো । আমাদের ডাক্তার বন্ধু জিৎ উঠে পড়ল । চলো আমি দেখে আসি আমি ডক্টর তুমি কোন চিন্তা  কোরো না ।আমি মারিয়া।আমরা একে একে সবাই  হ্যালো বললাম । জিৎ ওর সঙ্গে গেল ।মারিয়া খুব  সুন্দরী ছিল  অল্প বয়সে দেখেই বোঝা যাচ্ছে । এখন  পঞ্চাশ মতো হবে তাও কি রূপ । নীল চোখে যেন  পরীর মতো লাগে । আমাদের গ্রুপের  সব ছেলেরা যেন ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে । আমরা দুজন মেয়ে ছিলাম শ্রেয়া আর আমি । দুজনে চোখ  টিপে হাসতে লাগলাম। জিৎ আসতে দেরী করছে দেখে জয় আর অংশু বললো চল কি ব্যাপারটা দেখে আসি । আমরা দুজনেও বললাম চল আমরাও যাই ।সদলবলে ওদের  ঘরের  দিকে যাবো বলে উঠতে যাবো জিৎ ফিরে এলো।মুখটা খুব সিরিয়াস ।কি রে কেমন দেখলি? ও বলে এখন  ঠিক আছে । ঘুমিয়ে পড়েছে । সকালে মনে হচ্ছে ঠিক হয়ে যাবে  ওষুধ  দিয়ে  এসেছি। তাহলে তোর মুখটা এতো গম্ভীর  কেননা না একটু  ভাবছি । আমাকে একটু চুপ করে বসতে দিবি ? আমি ওর কাছে গিয়ে  জিজ্ঞেস করলাম মুড অফ  কেন রে? ও বললো তোদের ও হবে সকাল  হতে দে। আমরা  কিছু বুঝতে না পেরে আমাদের  ঘরে চলে  গেলাম ।আর ভালো লাগছে না  সারাদিনের  ক্লান্তি  এতক্ষণে মালুম  হলো।শুয়ে পড়লাম । 

           সকাল  বেলা উঠে সবাই  ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্টের জন্য  ডাইনিং হল এর দিকে যাচ্ছি । সামনে ছোট্ট একটা  ঘাসের লন। দেখি  চেয়ার নিয়ে এক সাহেব চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়স হবে আনমনে বসে আছে । আমাদের খেয়ালও করলো না।কতো ফরেনার যে এসেছে আমরা ভাবলাম ।জিৎ চুপচাপ  কাল থেকেই।আমরা ওকে আর ঘাঁটাইনি। ডাইনিং হল এ মারিয়ার সঙ্গে  দেখা  হলো।ও একগাল হেসে গুড মর্নিং বললো।আমরাও উইশ করে  বললাম  তোমার  ফ্রেন্ড  ভালো আছে ও হেসে  বললো ফর গড সেক হি ইজ অল রাইট। ও একটা  ফ্লাস্ক নিয়ে প্রায় দৌড়ে বাই বলে বেরিয়ে  গেল।জিৎ যেন একটু  ক্ষুন্ন হলো । ওকে আলাদা করে  কিছু  বললো না।আমরাও  একটু  অবাক । জয় একটু খোঁচা  দিয়ে  বললো গুরু তোমাকেও দেখতে পেলো না !জিৎ গম্ভীর গলায় উত্তর দিল ফিঁয়াসে একা বসে আছে ।মন তো ওখানেই। আমরা কিছু না বুঝে  চা য়ে চুমুক  দিলাম ।

        ব্রেকফাস্ট সেরে বাইরে আসতেই  আমাদের  গাইড  এসে হাজির।এখানকার  গ্রামে  বেড়াতে নিয়ে যাবে । উঁচু নীচু পাহাড়ী পথ।মে জুন মাসের পাহাড়।চারিদিকে এতো ফুল  ফুটে আছে চোখ জুড়িয়ে গেল। ক্ষেতে ক্ষেতে সুন্দরী কিন্নরী  রমনী।এতো রূপ তাদের  সবকিছু ভুলে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। আমাদের বন্ধুরা বলে আর ফিরবো না এখানেই থেকে যাবো। সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার একটু আগেই ফিরে এলাম। দেখি বাংলোর সামনে মারিয়া আর ওর বন্ধু ঘাসের ওপর আধশোয়া হয়ে গল্প করছে । আমরা তো ওর  বন্ধুকে কাল রাতে দেখি নি। এখন দেখি  সকালে সেই চেয়ারে বসে থাকা  যে সাহেবকে দেখে ছিলাম সেই ছেলেটি ।এতো চব্বিশ পঁচিশ বছরের  একটি ছেলে! ও মারিয়ার এতো ঘনিষ্ঠ  হলো কীভাবে ।জিৎ রেগে বললো দ্যাখ কী প্রেম ।কাল জানিস আমার  সামনে ওকে এতো অসভ্যের মতো আদর করছিল আমার  তো মনে হচ্ছিল ঠাস করে বুড়িকে একটা চ্ড় মারি।কি করে   ভিড়লো বল তো? জয় রেগে গিয়ে বললো ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক  কর জিৎ। একজন  অজানা ভদ্রমহিলার সম্পর্কে এটা না বললেই ভালো করতিস । ওরা নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি করে চললো। আমরা পাত্তা না দিয়ে ওদের কাছে গিয়ে বসলাম ।মারিয়া  খুশি হয়ে বললো আজকে জন একদম ফিট। অনেক  থ্যাঙ্কস জানালো আমাদের বন্ধুকে।জিৎ ভাগ্যিস সেখানে  ছিল না কি যে হতো তাহলে ।ও এমনিতেই  বদমেজাজি । গোঁয়ার টাইপের ।প্রথম দিনেই  ওর এতো খারাপ লেগেছে মানতে দেরী হবে ওদের সম্পর্কটা। এখন চার  পাঁচ দিন থাকব অপ্রীতিকর  কিছু  না ঘটলেই ভালো।বেড়াতে এসেছি  কি দরকার  পরের চরকায় তেল দেওয়ার।

       পরদিন সকালে ওরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে একমনে একটা  বিশাল  ম্যাপ খুলে ঝুঁকে দুজনে দেখতে ব্যস্ত ।আমরা ডাইনিং হল  এ সবাই একসঙ্গে  ঢুকলাম। আমি  জিৎ কে হাত ধরে টেনে  এনে একপাশে  বসলাম । ইশারায় ওকে কোন সিন ক্রিয়েট করতে বারণ করলাম । ওরা মর্নিং বলে জয় অংশু আর  শ্রেয়ার সঙ্গে গল্প  করত লাগলো।হঠাত  মারিয়া জিৎকে হেসে হেসে  ডাকল ওদের টেবিলে  বসার  জন্য । আমি বললাম আমরা এখানেই ঠিক আছি। কিছু মনে কোরো না। ও ঘাড় নেড়ে আবার গল্প করতে শুরু করলো।

          আমাদের সঙ্গে ওরা খুব সহজেই মিশে গেল। মারিয়া কোনকিছু  গোপন না করে কীভাবে জনের সঙ্গে দেখা হল।দিল্লিতে প্রথম পরিচয়ে দুজনের দুজনকেই ভালো লেগে গেলো ।সেইদিন থেকেই  ওরা একসঙ্গে  থাকতে শুরু করে দিল।পরিকল্পনা করে দুজনেই  ইন্ডিয়া দেখতে এসেছিল একা একা । এখানে  এসে মনের সাথী জীবনের সাথী পেয়ে গেল ।জন পাগলের মতো ভালোবাসে মারিয়াকে।প্রতি সেকেন্ডে  সেকেন্ডে কিস না করে থাকতে পারে না । ও যেন মারিয়ার মধ্যে ডুবে  রয়েছে । মারিয়া বড়ো তাও ওর কাছে এসে শিশুর মতো হয়ে গেছে ।না দেখলে  কেউ  বিশ্বাস করতে পারবে না এরকমও হতে পারে ? আমরা  জানি  হিমালয়ের কাছে এলে সব মানুষ  সমাজ সংসার বাস্তব দুঃখ  বেদনা সব ভুলে  যায়। এই প্রশান্ত পরিবেশ সবাই কে পাল্টে দেয় । বিশেষ করে  প্রেমিক প্রেমিকাদের। ওদের  স্বপ্ন তো অলীক হয় আর হিমালয় সেই স্বপ্ন পূরণ করে । 

          ওরা ছমাস ধরে ঘুরে চলেছে পাহাড়ের পথে পথে ।যে জায়গাটা ভালো লাগে সেখানে  অনেক দিন  থেকে যায়।সোনালী চুলে বড় বড় নীল চোখে মারিয়া কে আমরাও  ভালোবেসে ফেলি,ও বিয়ে করে নি।মনের মতো মানুষ পায় নি বলে। পাহাড়ই ওর নেশা ।

        সেখানে এসে পেয়ে গেল জীবনের সাথী। আমি ওর কথা শুনতে  শুনতে প্রশ্ন করেছিলাম জন তো অনেক  ছোট  যদি ও কোনও দিন তোমাকে  ছেড়ে দিতে চায়। অসীম বিশ্বাস  ওর চোখে ফুটে উঠল।ঘাড় নেড়ে বললো ও পারবেই না। আমি ওকে যত ভালোবাসি তার  থেকে  হাজার  গুণ  ও আমাকে ভালোবাসে । এটা আমি নিজের হৃদয় থেকে বুঝতে পারছি । ওদের দুজনকে  দেখতে দেখতে  আমরাও কেমন আচ্ছন্ন হয়ে  পড়ি।কী সুন্দর  সবসময়েই নানারকম ভাবে দুজনে এক হয়ে বসে থাকে ।ঘোরাঘুরি করে সবসময়ই  কোন না কোন ভাবে  আদর করে চলেছে । যখন  তখন জড়িয়ে ধরে বিশ্ব সংসার ভুলে । সারা পৃথিবীতে যেন  ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই  কিছু নেই । আমাদের  খারাপ লাগে না ।বিশেষ  করে আমার  ওদের  প্রেম কে খুব  সন্মান  করতে ইচ্ছে করে । অসম বয়সি হলেও ওদের প্রেমের  যে গভীরতা  দেখেছি খুব  কম মানুষের মধ্যে  দেখা যায়। জিৎ এর অতো রাগ গলে জল  হয়ে গেছে।বলে প্রেম  যদি করি এরকম  করেই করবো। একদম সভ্য সমাজের  আড়ালে এইরকম করে থাকবো। আমরা হাসি আর  বলি ওরে ওদের  দেশে  সব চলে তোর দেশে মানবে কি? তুই কি ওদের মতো  জীবনের  অনেক টা সময় বিদেশে  পাহাড়ে  এরকম  করে কাটাতে পারবিও হেসে বলে এরকম  প্রেমিকা  পাই তারপরে তো ভাববো।মারিয়া  জনের  জন্য  কী করে দেখ। খাইয়ে দেওয়া  থেকে  ঘুম  পাড়ানো সব। ও এক সেকেন্ডের জন্য ছাড়া  ভাবতে পারে ?আর তোরা আগে নিজের কথা ভাবিস তারপরে  অন্য কারোর। ও আমরা  এখন  খারাপ  হয়ে গেলাম ।আয় তবে তোকে ঐরকম আদর করি শ্রেয়া হাসতে হাসতে বলে। জিৎ ক্ষেপে গিয়ে  একটা চড় তুলে মারতে যায়। আমরা হো হো করে হেসে উঠি।

         একদিন ভোরে উঠে সান রাইজ দেখবো বলে সবাই গরম চাদর দিয়ে মাথাটাথা ঢেকে সামনের  বনে গিয়ে  হাজির হলাম ।  আধো অন্ধকারে দেখি একটা  লাল কম্বল  কেমন  অদ্ভুত ভাবে  নড়াচড়া করছে ।আলো ফুটে উঠেছে ।সোনার সূর্য বরফের সাদা পাহাড়ের গায়ে নানা রঙের বাহার ছড়িয়ে উদয় হলো।এতো অপূর্ব সেই রূপ বলে বোঝানো অসম্ভব ।তার পর  দেখি  জন আর মারিয়া সেই লাল  কম্বল  থেকে  জড়াজড়ি করে বেরোচ্ছে । একগাল হাসি বারবার বলতে থাকে নাইস নাইস। দুজনের কোমর দুজনে জড়িয়ে গালে গাল ঠেকিয়ে ঘরে ঢুকে গেল ।

         সূর্যোদয় দেখা হলো এবার ঘরে লীলা হবে জিৎ ফুট কাটলো। আমি প্রতিবাদ করে বললাম  বেশ করবে। এরকম  রোমান্টিক মুহূর্তে  মানুষ  কি করবে।এটাই তো প্রেম করার উপযুক্ত সময়। ও তুইও? তো কি ওরা একে অপরকে প্রানের থেকেও ভালোবাসে।দেখছিস একটা মুহুর্ত ও কেউ কাউকে  ছেড়ে থাকতে পারে না ।আমাকে মারিয়া বলেছে ও জন কে একটুও  ছেড়ে  থাকতে পারে না । ওর মন খারাপ করে ।শরীর  অস্থির হয়।পাগলের মতো লাগে নিজেকে । ওর শরীরের স্পর্শ না পেলে ও থাকতে পারে না । জন ও ঠিক  তাই। মারিয়া  ছাড়া  সে কিছু  জানে না ।মারিয়া ওকে খাইয়ে দেয়।স্নান করিয়ে দেয়। নিজে কিছু পারে না। এই পাহাড়ে  একা কি সাহসে বেরিয়েছিল ভাবলে মারিয়ার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই ওকে আগলে আগলে রাখে । তোকে বললো তুই অন্ধ হয়ে গেলি জিৎ খেঁকিয়ে ওঠে। নারে তুই রাগ করিস না জিৎ। আমি অনেক  রকম ভাবে  ওদের  দেখেছি।এই ভালোবাসা  সবাই পায় না ।জন ওর কোলে মাথা রেখে সারারাত ঘুমিয়ে থাকে জানিস? মারিয়া সারারাত  বসে ওর মাথায়। হাত বুলিয়ে দেয়। ওর ক্লান্তি লাগে না ।ঘুম পায় না ।সারারাত  ভীষন  আনন্দ নিয়ে বসে থাকে মুখের দিকে তাকিয়ে । জয় বলে বেটা ভাগ্য করে প্রেয়সী পেয়েছে । আমাদের ফাটা কপালে এসব জুটবে না রে। আর বলিস না  হিংসে এসে যাচ্ছে মনে।বিশ্বাস কর সব সত্যি ।মারিয়া  মিথ্যে বলতে জানেই না।আমি  ওর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো মিশি।ও আমাকে ওর সব কথা বলে। কিছু লুকোয় না।

         আমার  কথা শুনে আমার  ন্ধুরা চুপ হয়ে গেল । অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বললো না ।তারপর  আস্তে  আস্তে  আমাকে  বললো প্লিজ তুই আমাদের ক্ষমা করে দে।আমরা ওদেরকে  অনেক  খারাপ কথা বলেছি খারাপ  ইঙ্গিত করেছি।এখন আমরা সত্যিই লজ্জিত । ভালোবাসা তো এরকমই হওয়া উচিত।বিদেশ বিভুঁই এ এসে যখন  একা ফিল করে তখন সবাই অসহায় হয়ে যায়।সেখানে  এরকম  একজন  দরদী মহিলার  সাহচর্য তাকে নতুন করে এগিয়ে নিয়ে যাবে । আরো  দুর্গম পথে দুজনে ঘুরে  বেড়াবে।মনে কোথাও কোন দ্বিধা নেই । সব বোঝা হয়ে গেছে। চলার পথে সুস্থ জীবনের পথে এইরকম  সঙ্গী তো সবাই  চায়।ক জন পাই এই রকম  ভালোবাসা ।ক জন পারে এরকম ভালোবাসতে? আমরা সবাই ওদের নতুন করে  ভালো ভাসতে শুরু করলাম । ওদের আনন্দে আমরাও যোগ দিতে  শুরু করলা । সবাই মিলে একটা  পরিবার  হয়ে গেলাম 'দিনে। জন তার উদাত্ত গলার সুন্দর সুন্দর গান উপহার দিত প্রতি সন্ধ্যা বাসরে। ভাষা অন্য কিন্তু  সেই সুর আমাদের মুগ্ধ করে রাখত অনেকক্ষণ । আমরা বুঁদ হয়ে  শুনতাম  আর ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়তো সকলের হৃদয়ে ।জন যখন  হো হো করে হেসে  উঠতো ওর সরল হাসি সকলের মন ছুঁয়ে যেতো।ওকে আমরাও  ভালোবেসে  ফেলেছিলাম ।এরকম  একটি  নিষ্কলুষ ছেলে টিকে কতো ভুল  বুঝে অন্যায় করেছি ভাবলে মনে খারাপ হয়ে যায়।মারিয়া  আমাদের  চা পরিবেশন করে  ওর আনা কুকিস দিয়ে । কতো যত্ন  করে  জিজ্ঞেস করে  আর  নেবে? ওর ব্যাবহার  আমাদের  অনেক কিছু  শেখায়।কী বিনয় ।আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই ।

       আমাদের পাহাড়ের দিন ফুরিয়ে গেল । এবার ঘরে ফেরার পালা। জন আর মারিয়া কিছু দিন থাকবে এখানে । তারপর নতুন কোন জায়গা নতুন কোনও পাহাড়ে ঘুরে  বেড়াবে।ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে ফিরে যাবে নিজের দেশে । মনে হলে বিয়ে করবে নাহলে এইভাবে  কাটিয়ে দেবে সারাটা  জীবন ।আমাদের  সবার  মনেই কিন্তু  এরকম একটি জীবনের সাধ রয়ে গেল । এবারের পাহাড়ে এইরকম একটা ইচ্ছে মনে  গেঁথে নিয়ে এলাম । হয়তো এখানে অবাস্তব মনে হতে পারে কিন্তু সংগোপনে  এরকম  একটি জীবন অংকুরের মতো সবার মনেই জন্ম নিল।



এটি নিছক কল্পনা নয়। আমার ট্রেকিং জীবনে দেখা সত্যি ঘটনা।