গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

৫ম বর্ষ সংখ্যা ১৬ ।। ২৬ জুন ২০১৬

এই সংখ্যায় ১২টি গল্প । লিখেছেন - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, রুখসানা কাজল, সুবর্না রায়, সুবীর কুমার রায়, তাপসকিরণ রায়, কৃষ্ণা দাস, দেবাশিস কোনার, শ্যামশ্রী চাকী, সতীশ বিশ্বাস, পলাশ কুমার পাল, কাওসার পারভীন ও পার্থ রায় । 

                সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করুন

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়



ওরা চারজন
  
শিশির---

বাব্বা কি রাগ, যেন মেয়েদের দিকে তাকাতেই নেই! কে কে স্যরের ক্লাসে একবার মাত্র তাকিয়েছি, এমনিই তাকিয়েছিলাম। দেখি, বড় বড় চোখ করে আমার দিকে সে তাকিয়ে আছে।  আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আজ কপালে জুটবে কিছু। কিন্তু আমি ঠিক করেছি, আজ আমিও বলব। আচ্ছা, আমি নাহয় তাকিয়ে থাকি। কিন্তু  তুমিও না তাকালে বুঝবে কি করে মশাই, শুনি? তুমি তাকালে দোষ হয় না, আমি  তাকালেই দোষ!


জয়ন্তী---

এমন রাগ হয় না,মনে হয় চোখ দুটো অন্ধ করে দিই। অসভ্য একটা! যখনই তাকাও, দেখবে সে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। এ কি রে বাবা! ক্লাসে টিচার পড়াচ্ছেন, তখন কেউ  ওইভাবে তাকায়? কতবার বলেছি , সকলের সামনে  ক্লাসে...ঠিক নয়। শুনলে তো! কি, না যখন মন দিয়ে পড়া শুনি,তখন নাকি দেখতে আমায় ভাল লাগে। এটা কি একটা কথা হল,কি যেকরি!

অমিত---

ব্রততী মানে জয়ন্তীর বন্ধুটাকে খুব একটা খারাপ লাগে  না। শিশির বলে ঐ মেয়েটার নাকি আমার ওপর একটু ইয়ে আছা। তা থাকুক। কিন্তু মুশকিল হল,আমি শিশিরকে,কাউকে বলতে পারছি না, আমি জয়ন্তীকেই পছন্দ করি। শিশির কি জানে, বুঝতে পারে?  

ব্রততী---

অমিতটা মাঝে মাঝে এমন ক্যাবলামি করে, বিরক্ত লাগে। ভাল লাগে, তা বেশ তো বাপু, সেখানেই শেষ কর। তা নয়,আবার জয়ন্তী,শিশিরের সঙ্গে এখানেও আসা চাই,আড্ডা দেওয়া চাই। মুখের ওপর নাবলতে পারি না, কিন্তু মাঝে মাঝে বেশ বিরক্তই লাগে। কি করে বোঝাই, অমিতকে নয়, আমার শিশিরকেই বেশী ভাল  লাগে। শিশির কি জানে, অমিত কি বুঝতে পারে না!

(২)

জয়ন্তী---

এত রাত্রে শিশিরকে কি ফোন করাটা ঠিক হবে? শিশির কি ভাববে! আজ এমন কথা কাটাকাটি হয়ে গেল,খারাপ লাগছে। না হলেই ভাল হত। আমায় পছন্দ কর,  ভাল লাগে, বেশ কথা। কিন্তু তার জন্য সারাক্ষণ অমন হ্যাংলার মত তাকিয়ে থাকা কেন? ছিঃ, সবাই কি মনে করবে! এই সবাই কথাটাতেই ওর মাথা গরম হল। ভাল লাগতে দোষ নেই, সবাই জেনে যাবে,সবাই দেখবে, কি মনে করবে এটাই তাহলে দোষ?
কি করে বোঝাই, মেয়েরা কি অত স্পষ্ট হতে পারে ছেলেদের মত?  মেয়েরা স্পষ্ট হলে সেও তো দোষের! শিশির আজ রাগ করল, কিন্তু আমিই বা কি করতে পারি! কাল যদি না আসে কলেজে,কথা যদি না বলে...এখন একবার ফোন করব...?

 অমিত---

আজ কলেজে শিশিরের সঙ্গে জয়ন্তীর রাগারাগিটা ভাল লাগছিল না। কি একটা কথায় কথায় ঝগড়া হয়ে গেল। শিশির কি মনে করল! জয়ন্তীর ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। তবে কি জয়ন্তী শিশিরের সঙ্গ পছন্দ করে না, শিশিরকে তার ভাল লাগে না! তবে কি জয়ন্তীকে বলব......না, আরও কয়েকটা দিন যাক্‌। আগে হাবভাব বুঝি, তারপর।

 ব্রততী

জয়ন্তী এমন রাগ দেখাল শিশিরের ওপর,যেন কতই না বিরক্ত! কোন মানে হয় না। শিশিরকে এভাবে বলার কি দরকার ছিল। বেচারা শিশির! আমাদের সামনে কি রকম লজ্জ্বায় পড়ে গেল, আমার এতো খারাপ লাগছিল শিশিরের জন্য। শিশিরকে  যদি ভালই লাগে, অমন করার কি আছে! একটু যদি তাকায়ই তোর দিকে,অত খেপে যাবার কি হল! আমার দিকে তাকালে আমি কিচ্ছুটি মনে করতাম না। তবে কি জয়ন্তীর শিশিরের প্রতি কোন ভালবাসা নেই ...দেখাই যাক্‌ না,কোথাকার জল  কোথায় যায়!
  
শিশির

কেন যে নিজেকে ধরে রাখতে পারি না, আজ ক্যান্টিনে শুধু শুধু জয়ন্তীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হল! আমিই রাগারাগি করে ফেললাম। জয়ন্তী কি একটা বলল, আমার রাগ হয়ে গেল। আসলে খুনসুটি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু রেগে গেলাম। দোষটা আমারই, মেয়েটাকে রাগিয়ে দিলাম। সকলের সামনে ওরও নিশ্চয়ই খারাপ লেগেছে, কাল মাপ চেয়ে নেব। এতো খারাপ লাগছে!
কে আবার ফোন করল...একি! এই নম্বর তো জয়ন্তীর...এত রাতে...হ্যালো... !

রুখসানা কাজল



প্রতিশোধ


         ইশকুল ড্রেস পরা ছোট মেয়েটা উবু হয়ে শুয়ে খালের কালো জলে কি যেন দেখছে। চ্যালা মাছগুলো জ্যামিতিক পিঠ দেখিয়ে যাচ্ছে আসছে ।দু একটি টাকির সাদা পেট ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। তবু ঝুঁকে চোখ বড় করে জলের তলে তাকিয়ে থাকে মেয়েটি। গরুর জন্য কচুরিপানা তুলতে তুলতে নিবারণ মিস্ত্রি ভাবে ডাক্তারের এই মেয়েটা কিছুটা আশ্চর্য রকমের। সবার সাথে থেকেও কেমন আলগা মতন। মাঝে মাঝে ত পুরোদস্তুর ছেলেদের মত ঘুরে বেড়ায় । মারামারি করে আস্ত ছেলে ছোকরাদের মতন। আর দেখো কেমন শান্ত হয়ে জল দেখছে এখনসন্তানহীন নিবারণের বুকের ভেতর ছলকে উঠে মায়াআহা রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে জল ছানতে একা এতদূর চলে এসেছে। নিবারণ মিস্ত্রি নৌকার পাটাতনে উঠে ডাক পাড়ে, অই মা রিমঝিম ! কি দেহিস ?    
--মাছ দেখি নিবারন কাকু!
  
          পাগলি মেয়ে। লগি বেয়ে এপারে এসে নৌকায় তুলে নেয় মেয়েটিকে। তার বাড়ি  খালের ওপারে। নৌকা থেকে নামলেই দু পা। নিবারণ দেখে বইয়ের বাক্স। পায়ে বাটা সু। ইশকুল থেকেই এসেছে মেয়েটি । আজ সায়ক নেই সাথে এমন তো হয় নাএই গুণ্ডি যেখানে সায়ক থাকে সেখানে। দুটিতে মহাভাবআবার কথায় কথায় মারামারি, ঝগড়া
  
          মোক্তার দর্জি বাজারে যাচ্ছিল শহরের নামকরা কাজি টেইলার্সের হেড খলিফানিবারন হাঁক দেয়,  ওরে ও মুক্তার, নিরাময়  ফার্মেসিতে একটা খবর দিয়ে দিস তো মোক্তার দর্জি দাঁড়ায় । তারপর হেসে বলে, বড় মেমান দেহি! তা আমাগের বাড়িতে এডডু ঘুরায় আইনো তোমার মেমানরে। বিবিজানের অনেকদিনের সখ মাইড্যারে দেখপার। নিবারণ হাসে, আচ্ছা  আনবানি। তুই জানা্য়ে দি্স কলাম নালি ডাক্তার চিন্তায় পড়ি যাবেনে 
    
          ছাতা বগলে মোক্তার দর্জি জোড়া বাঁশের পুল পেরিয়ে চলে যায়। মেয়েটা খালের জলে আঙ্গুল দিয়ে রেখা কাটে । জল ছিটোয়। কচুরিফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে জলে ফেলে। জল দেবী হয়ে সাগ্রহে তুলে নেয় ছেঁড়া ফুলের নৈবদ্য। জলের দিকে মুখ   রেখে জলের মতই  হাসে মেয়েটি এক বোঝা চুলের মাঝে শ্যাওলাপানা মুখ।   নিবারণের বুকের ভেতর ছলকে উঠে গান, কালো মায়ের পায়ের  তলে -----  
  
          ঠা ঠা রোদ্দুরে সায়ক এসে হাজির। কি করে যে বোঝে রিমঝিম কখন কোথায় থাকে! ট্যাংরা মাছের ঝোল দিয়ে খাওয়া শেষে নিবারণের বউ  মেয়েটাকে কোলের কাছে নিয়ে সবে গল্প শুনছে আর নিবারণ বাক্স গুছিয়ে রেডি হচ্ছে রিমঝিমদের বাড়ির নতুন জানালা কাটতে হবে। পাগল কিসিমের মানুষ এই ডাক্তার  আজ এরকম কাল ওরকম করে বাড়ি ডিজাইন করে সারা বছর তাই কাজ লেগে থাকে নিবারণেরতাতে বেশ লাভ হয়। ফ্রী ওষুধ তো পায়ইতাছাড়া উৎসব পার্বণে পরিবারের জন্য শাড়ি কাপড়ও দেয় বড় বৌদি। সবচে বড় কথা ও বাড়িতে ছি, অচ্ছুৎ বলে কোন শব্দ নাই। রিমঝিম তো তার সামনেই এই সেদিন জন্মালো!
     
           সায়ক  এসেই গাছে উঠে পড়ে। আম পেড়ে নুন দিয়ে খেতে খেতে বলে, নিবারণ কাকা, তোমাকে একটা শুয়োরছানা দেব। নিবারণের বউ আঁতকে উঠে , না না এমা ---চ্ছিঃ  আমরা শুয়োর পালি না।” - কেন নয় । ও  আচ্ছা আচ্ছা তোমরা ত হিন্দু আছ! আচ্ছা কাকি তাহলে একটা কুকুরছানা দেব কেমন! এবার কিছু নাড়ু দাও তো বেলা তখন বারোটা । নিবারণ মিস্ত্রি দুই গুন্ডা বাচ্চা সামলে সুমলে যখন মূল শহরে ডাক্তারের বাড়ির গেট ঠেলে ঢোকে রিমঝিমের মা বড় বৌদি তখন রাগে অগ্নিশর্মা  

           বেড়ালছানার মত ঘাড় ধরে রিমঝিমকে নিয়ে যায় ভেতরে।  তারপর দোতলার গেট টেনে আটকে দেয়দুদিন রিমঝিমের বাড়ির বাইরে বেরুনো  নিষেধ হয়ে গেল। সায়ক পালিয়েছে আগেই। কাকিমাটা হিটলার টাইপের জানে ও   অবশ্য দুপুরে রিমঝিমের বাপি খেতে এলে নিষেধজ্ঞা উঠেও যেতে পারে। ওর বাপীর মত ভাল মানুষ আর কেউ নেই। বন্দি রিমঝিম ভাইয়ার আঁকা ছবিগুলোয় রঙ দিয়ে  ভরিয়ে দিতে থাকে। ভাইয়াটা পচা আর্টিস্ট কিচ্ছু জানে না। আকাশ কি কখনো এমন  ফ্যাকাশে হয় ? একটু গাঢ় নীল আকাশ হলে কি সুন্দর লাগে । নীল আকাশে উড়বে  একটা লাল ঘুড্ডি । তার লেজ থাকবে হলুদ রঙের। চটপট আঁকতে বসে রিমঝিম।  
   
          ছবিতে রঙ মাখাতেই ধপ করে একটা শব্দ শোনে । সিওর সায়ক  দেওয়াল ঘেঁষে কৃষ্ণচূড়ার গাছ বেয়ে দোতলায় নেমে পড়েছে , চল পালাই এক মুহুর্ত ভাবে রিমঝিম বারান্দায় গিয়ে পাখির মত ঘাড় কাত করে দেখে নেয় মা কোথায় । তারপর গাছ বেয়ে নামতে শুরু করে। খুব সহজ একটা হিসেব করে রিমঝিমদের ফার্মেসিতে ছুটে যায় ওরা রিমঝিম বাপির মুখ ধরে বলে, বাপি শোন শোন আজ না আবার আমি ইশকুল ---  বাপি কি শোনে কে জানে ।  দুজনকে দুটো ভিটামিন সি দিয়ে কবিতা লেখায়  মন  ডুবিয়ে দেয়। এর কিছু পরেই দেখা যায় রিমঝিম আর সায়ক পিন্টুদের বাগানে চোখ পাকিয়ে, হাত ঘুরিয়ে পা নাচিয়ে গল্প করছে। ওদের গল্প শুনে ফিকফিকিয়ে হাসছে ফোকলা দাঁতি পিন্টুর সৎ দাদি  
      
          পিন্টুদের বাসার পাশে মুস্তফা উকিলের পোড়ো বাগানবাড়ি। খুব   অন্ধকার অন্ধকার। সাপের আড়ত আছে বলে সবাই অই বাগানে যায় না কিন্তু নানা জাতের অজস্র পেয়ারার গাছে লাল টসটসে পেয়ারা ঝুলে থাকেপাড়ার ছেলেমেয়েরা দিনের বেলায় সাহস করে বাগানে ঢুকে তাই পাড়ে। রিমঝিম আর  সায়কও থাকে তাদের সাথে বহুবার বারণ করেছে এমনকি মার পর্যন্ত দিয়েছে কিন্তু দুজনের কেউই সেই বারণ মার মনে রাখতে পারে না। ওরা আজও এসেছে পেয়ারা চুরি  করতে।

          উকিলের পাহারাদার দুজন খুব কড়া। ধরতে পারলে বাবামার কাছে নিয়ে হাজির হয়। সারাক্ষণ কাঁচামিঠে আমগাছের নীচে তাস খেলে আর নেশা করে। সায়কের পাপা এই শহরের সিভিল সার্জন হয়ে এসেছে প্রায় সাত বছর হলো।  এখানকার মানুষের ভালবাসায় আটকে গেছেন তিনিবদলির কথা উঠলেই বদলি ক্যান্সেল করতে ছুটোছুটি শুরু করে দেয় এখানকার সবাইতিনি খৃষ্টান কিন্তু কোনদিনই গির্জামুখী হতে দেখেনি কেউকাজ পাগলা মানুষ । কাজই তার ঈশ্বর
    
          মুস্তফা উকিলের বাগানের একজন পাহারাদার আগে হাসপাতালের গুদামে কাজ করত। সায়কের পাপা এই হাসপাতালে আসার পর গুদাম থেকে চুরি  করে ওষুধ সরানোর জন্যে চাকরী চলে যায় সেই নুরু মিয়া সায়ককে দেখলেই লাল চোখে তাকিয়ে থাকে। কখনো যদি  ধরতে পারে তো হাত মুচড়ে এমন ব্যাথা দেয় যে সাতদিন ব্যাথা থাকে। কোনো কোনো দিন সায়ককে ধরে ওর পাপার রুমে হাজির করে। অফিসের অন্যদের শুনিয়ে বার বার বলতে থাকে, আমি ছোটলোক, ছোটজাত,  গরিব, মুর্খ বলে চুরি করেছিলাম! বড় লোকের ছেলে কেন চুরি করে হা  আল্লাহ রব্বুল আল আমিন।
  
           সায়কের পাপা লজ্জায় ক্ষেপে গিয়ে সায়কের দিকে রাগে গনগন করে তাকায়। সেই সময় নুরুমিয়ার মোটা খয়েরি ঠোঁটে শয়তানি হাসি খেলে উঠে। চোখ বুজে আসে অপার্থিব  আনন্দে। কিন্তু মুখটিকে করুন করে ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে। সায়কের পাপার সহকারীরা তাড়াতাড়ি কিছু দিয়ে বিদায় করে দেয় নুরুমিয়া   হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বার বার পেছন ফিরে তাকায়। কখনো বা বড় নিমগাছটার ধারে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে চা খায় আর জুল জুল করে এদিক সেদিক দেখে। রুগী, ডাক্তার , ওষুধ , ব্যান্ডেজ এমনকি ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া ওষুধের খালি ফয়েলও নুরুমিয়া খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে।  
           সায়ক সেদিন মার খায়জানতে পেরে এক টানে বিড়ির আগুন ঠোঁটের কাছে এনে হায়েনার মত খিক খিক করে হাসে নুরু সংগী আকবর মুন্সীকে  বলে, দে দে আরেকটা বিড়ি দে তোশালার ডাক্তার তোর বংশ আমি ধ্বংস করে দেব শুয়োরের বাচ্চা। চোরের বাচ্চা চোর। তুই চোর তোর গুষ্টি চোর হারামজাদা বাঞ্চোত” 
  
           ছোট্ শহরের সবার খুব মন খারাপ। কদিন ধরেই অনবরত মাইকিং হচ্ছে, ভাইসব, ভাইসব, একটি বিশেষ ঘোষণা  দুটি শিশুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের নাম সায়ক এবং রিমঝিম। কোন সহৃদয় ব্যাক্তি যদি--” ওদিকে দুর্গা পূজার মেলা হচ্ছে । সার্কাস, পুতুলনাচ, যাত্রা খাবার দাবার মাটির পুতুল, হাঁড়িকুড়ি  আর কাঠের জিনিসপত্রের অস্থায়ী দোকানে উপচে পড়ছে ভিড়হই হই কাণ্ড । এরি  মধ্যে সায়ক আর রিমঝিম কোথাও নেইকেউ বলে ওরা পুতুলনাচ দেখতে গেছিল কেউ বলে ওরা সার্কাসে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খেলা দেখতে গিয়েছিল। কোন কোন বাচ্চা বলে সেদিন সার্কাস পার্টির জোকারের সাথে ওদের দেখা গেছে। সায়কের মাথায় জোকারের টুপি ছিল। তারপরেই একেবারে গায়েব হয়ে গেছে ওরা সমস্ত মেলা তন্ন তন্ন করেও পুলিশ ওদের খুঁজে পায় না। নুরুমিয়া রোজ এসে সায়কের বাবার অফিসের সামনে খাওয়া নাওয়া বন্ধ করে বসে থাকে। কখনো রিমঝিমদের ফার্মেসির বাইরে সিঁড়িতে বসে হাহা করে কেঁদে উঠে। ছোট শহরের সবাই অবাক হয়। মানুষটি শিশুদের এত ভালবাসত ! আহা মানুষের মন। রক্তের সম্পর্ক দিয়ে কি আপন পর চেনা যায়। নুরু মিয়াকে অনেকে সান্ত্বনাও দেয়।
  
          ছেলেমেয়েদের সামলে রাখছে সবাই। অতিরিক্ত সতর্কতা সবার মনে। সায়ক রিমঝিমের বাবা মায়েরা পাগলের মত হয়ে গেছে । সাত দিনের মেলা চার দিনে তুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সিভিল সার্জন ডেভিড ডি কস্টা পাগলের মত খুঁজে যাচ্ছে। সায়ক তাদের একমাত্র সন্তান ছিল আর ছোট্ট রিমঝিম বাড়ির সকলের  আদরের ছোট্টটি । আশেপাশের গ্রাম খুঁজেও পাওয়া যায় না ওদের। আশ্চর্যভাবে উধাও শিশু দুটির খোঁজ না পেয়ে সবাই ভাবে মেলা না হলেই বোধহয় ভাল হত!

                      এক মাসের উপর কেটে গেছে । সায়কের পাপার ট্রান্সফারের অর্ডার এসেছে। তিনি চাকরি করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সায়কের মা এখন সারাদিন  গির্জায় পড়ে থাকে। এই শহর ছেড়ে ওরা কোথাও আর যেতে চান না। সায়ক যদি   ফিরে আসে। রিমঝিমের মা অসুস্থ। কেবল নিজেকে দোষ দেন । আহা কেন আরো  বেশি ভালবেসে তিনি ছোট মেয়েটাকে আদর করেন নি ! হারিয়ে যাবে এভাবে কে জানত! নুরুমিয়া সায়কের পাপার অফিসের সামনে বসে থাকে। কখনো কাগজ  টুকায়। নিজেই বাগান সাফ করে । মালীর সাথে হাতে হাত লাগিয়ে আগাছা নিড়ায়, জল দেয়, শুকনো পাতা কুড়ায়। 
  
         সারাদিনের ময়লা ঝাকায় তুলে রাখে। উলুঝুলু চুলে এলোমেলো সায়কের পাপা অফিস থেকে বাসায় ফিরে গেলে নুরুমিয়াও মোস্তফা উকিলের বাগানে ফিরে  আসে। বহু যুগ আগের পরিত্যক্ত সেফটি ট্যাঙ্কের  ভেতর জমানো ময়লা ফেলতে ফেলতে শকুনের মত হেসে উঠে সে,  এই সায়ক হুই রিমঝিম পাঁপড় খাবেন,  পেয়ারা ? চলেন চলেন জোকারের টুপি পরবেনকেউরে বলেন না যেন । হাহাহা  এখন কেমন লাগে চোরের ছেলে চোর । তোর বাপ চোর, তুই চোর হুই রিমঝিম তোর বাপটাও সাক্ষী দিলো রে। আমি চোর হলাম। খা খা পেয়ারা খা । পাপড় খা  হাহাহহা--