গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

৫ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা ।। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫

এই সংখ্যায় ১০টি গল্প । লিখেছেন - সুবীর কুমার রায়, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, মৌ দাশগুপ্তা, মুস্তাইন সুজাত, তাপসকিরণ রায়, সোনালী ভট্টাচার্য মুখার্জী, মিলন বণিক, দেবরাজ দাশগুপ্ত, সঙ্ঘমিত্রা রায় ও লোপামুদ্রা মুখার্জী  ।
            
             সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করে পড়ুন

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

অচেনা

বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে বাস থেকে নামতে গিয়ে পায়ের ব্যথাটা টের পেল সুমনা। কাঁধে একটা বড় ব্যাগ ছিল, খাতাপত্রে ভর্তি হয়ে আছে। এছাড়াও শাল, হাতব্যাগ। সব নিয়ে কোনরকমে বাস থেকে নেমে এল সে। কিন্তু নামার পর আর যেন দাঁড়াতে পারছে না সুমনা। ফাঁকা জায়গা, এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু দেখতে পেল না। শুধু দু-একটা চায়ের দোকান, আর অল্প একটু দূরে একটা ধাবা। সুমনা জানে, এখানে আর কোন দোকান নেই, যা আছে, কলোনীর  ভিতরে। ধাবাটাও খুব ভালো কিছু নয়, এসব জায়গায়  যেমন হয়...পথ চলতি যেমন হয় আর কি! ভাল হওয়ার  কথাও নয়। কলোনীর বাইরে এই সব দোকানে ভদ্রঘরের বউ-মেয়েরা কেউ একটা আসে না।  কলোনীর লেবার জাতীয় লোকেরা আর ছেলে-ছোকরারাই আসে কখনো-সখনো। বাস এসে  দাঁড়ায় কলোনীর  মুখের কাছে, রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে কলোনীর গেট। সেদিকেই এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল, পারল না। তীব্র যন্ত্রণা, পা  ভারী হয়ে আসছে। আজ হাতের কাছে মুঠো ফোনও নেই, সকালের তাড়াহুড়োতে বাড়িতেই ফেলে এসেছে। তাছাড়া থাকলেও মা কিছু করতে পারতেন না। বাবা এখন অফিসে, মায়ের পক্ষে একা একা এখানে এসে সুমনা কে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কোনরকমে এক পা এগোতে গিয়ে বুঝতে পারল এখন সে দাঁড়াতেই পারবে না। কিছু  একটা ধরার আশায় মরিয়া হয়ে একটু এগিয়ে একটা বাইকের হাতল ধরার চেষ্টা করল। লাল-কালো রঙের একটা বাইক কেউ দাঁড় করিয়ে রেখেছে দোকান আর ধাবার মাঝখানে। কিন্তু বাইকে হাত রাখতে না রাখতেই তার উপরেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে, সব কিছু আবছা হয়ে আসছে...আর কিছু জানে না।

--শুনছেন...শুনুন, এই যে শুনছেন! আমি বাইকটা নেব...শুনছেন...’, একটি বছর পঁচিশ/ছাব্বিশের ছেলে ডাকছিল সুমনাকে। সুমনা তখনও বাইকের উপরে পড়ে আছে। হালকা কথা-বার্তা কানে আসছিল, কিন্তু সে উঠতে পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণায় চোখমুখ ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে। ততক্ষণে দু/চার জন পথ চলতি মানুষের ভীড় জমেছে। ধাবার মালিক পবনও এসে হাজির। সকলের সামনে ছেলেটিই সুমনাকে ধরে নাড়া দিল। পবনের হাতে জলের জগ, ছেলেটি সেটি হাতে নিয়ে দু একবার জলের ছিটে দিল পাশ থেকে। আবার দু-এক বার দিতে মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনে দেখার চেষ্টা করল। চোখ মেলতেই পবনকে দেখল। ততক্ষণে সে বাইকটা ধরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, কিন্তু কাঁপছে, পারছে না। মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল পবন---
---হায় রাম, ইয়ে তো মাষ্টার দিদিমণি আছে, ই কলোনী মে থাকে, হামি জানি উয়াকে...
ছেলেটি একটু ইতস্ততঃ করে বলল সুমনাকে---আমি বাইকটা এবার নেব যে...আপনি...
একবার সামনে পবনের দিকে, আর একবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে উঠল সুমনা---আমি ঠিক  দাঁড়াতে পারছি না...
ভয় পেল ছেলেটি। সে সুমনাকে চেনে না। কলোনীর ঠিক কোথায়  থাকে, তাও জানে না। কাছাকাছি হলে নাহয় পৌঁছে দিতে পারত, কিন্তু... একবার হাতঘড়িতে সময় দেখল ছেলেটি। আর মিনিট পনেরো সে অপেক্ষা করতে পারবে, তারপর তাকে যেতেই হবে, কোন উপায় নেই। সুমনার দিকে তাকিয়ে বলল-- আপনি কোথায় থাকেন? কাছাকাছি কোথাও হলে আমি নাহয় আপনাকে কিছুটা  এগিয়ে দিতে পারি...। 
ম্লান হাসি হেসে বললে সুমনা---উঠতে পারব কি! বুঝতে পারছি না।
ততক্ষণে পবন তার ধাবা থেকে দু/একজন কর্মীকে ডেকে নিয়েছে। সুমনাকে বলল--হামি আপনাকে পাকড়াবো দিদিমণি, আপনি হামাকে ধরে থাকেন, ঠিক হ্যায়? সকলে মিলে ধরাধরি করে তাকে কোনরকমে বাইকের উপরে বসালো । ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল---ই খুব নজদীক আছে দাদা, লিয়ে যান, বেশিদুর নাই আছে। হাঁ, দিদিমণি, ঠিক সে পাকড়াবেন, পারবেন তো?
নিজের উপরে খুব ভরসা করতে পারছে না সুমনা। ছেলেটির দিকে একবার তাকাল। ছেলেটি বাইকে চড়তে চড়তে বলল---আপনি আমাকে ধরুন, নইলে পড়ে গেলে বুঝব কি করে? আপনার ভয় নেই, আমি খুব আস্তে চালাব... বাইকে স্টার্ট দিল সে।

 (২)
মাস তিনেক পরে এক বিকেলে যথারীতি স্কুল থেকে কলোনীর গেটে নামার সময় চোখ পড়ল লাল-কালো রঙের একটা বাইক। সেই বাইকটা না! চমকে উঠল সুমনা। হে ভগবান, সেই যেন হয়! সেদিনের পর থেকে কত খুঁজেছে সুমনা সেই ছেলেটিকে। সেদিন যন্ত্রনায় কাতর ছিল, ছেলেটিও কোনরকমে সামনের ঘরে পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছিল। তাঁর নাম-ধাম, ফোন নম্বর কিছুই জানা হয়নি। তারপর থেকে কত খুঁজেছে সুমনা। কিছুই  করতে পারেনি। নিজেও প্রায় সপ্তাহ দুয়েক ঘরবন্দী ছিল। না, ভেঙ্গে-টেঙ্গে যায়নি কোথাও, কিন্তু ডাক্তার, ওষুধ, ফিজিওথেরাপি, মায়ের রাগ, বাবার বকুনি সব মিলিয়ে একেবারে জেরবার। সেদিন বাস থেকে নামতে গিয়ে সাময়িক ভাবে পায়ের পেশিতে টান ধরেছিল তীব্রভাবে। হয়ত বাস থেকে নামতে গিয়ে হয়েছিল, কিংবা অনেকক্ষণ বাসে একটানা বসে থাকার পর দাঁড়াতে গিয়ে...ঠিক কিভাবে হয়েছিল সুমনা জানে না। কিন্তু সেই ব্যথা  এতটাই তীব্র ছিল, যে সেদিন প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সুমনা। ওই ছেলেটী না থাকলে কি করে যে সেদিন বাড়ি পৌঁছত...! সত্যি, রাস্তাঘাটে এমন কিছু মানুষ আজও আছেন  বলেই ভরসা। বাইকটার দিকে এগিয়ে গেল সুমনা। একটু অপেক্ষা করে যাবে সে, যদি ছেলেটি হয়! মুখ নিচু করে কিছু ভাবতে যাচ্ছিল সুমনা, আওয়াজ শুনল---আপনি?...আপনিই  সেদিন...আপনাকেই তো  একদিন পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম, তাই না?
মৃদু হাসি হাসল সুমনা। --সত্যি, আপনি না থাকলে কি যে হত সেদিন। অথচ দেখুন,  আপনার কোন খবরই নিতে পারিনি, এক কাপ চা খাওয়ানোও হয়নি। ভাবলে এত খারাপ লাগে...!
--আরে, না না, সে পবন দারা ঠিক  কিছু একটা ব্যবস্থা করে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। উনি তো চেনেন আপনাকে... হেসে বলল ছেলেটি।
এখানে কোথায়...জিজ্ঞেস করল সুমনা।
--এই তো, কলোনী থেকেই ফিরছি... উত্তর দিল ছেলেটি। কলোনীতে থাকে... কিন্তু দেখেছে বলে মনে করতে পারল না সুমনা। তারাও প্রায় সাত বছর হল এখানে এসেছে, কোনদিন দেখেছে বলে মনে হয় না। জিজ্ঞেস না করে পারল না সুমনা... আপনি কলোনীতে থাকেন?
--আমি নতুন এসেছি, আপনাদের কলোনীতে নতুন যে ব্যাঙ্কটা হয়েছে, সেখানে এসেছি বদলি হয়ে, রামগড় থেকে।
ওহ্‌...--এবার বুঝল সুমনা। --একদিন আসুন বাড়িতে, আপনার তো চেনা হয়ে গেছে, মা-বাবাও বলছিলেন আপনার সেদিনের কথা...
--না না, কি এমন...যাব একদিন--বাইকে ওঠার চেষ্টা করল ছেলেটি। না উঠে এগিয়ে এল ---আপনি কি এখন ওখানেই যাবেন? মানে, স্কুল থকেই ফিরছেন তো! কি ভাবে যান, খানিকটা তো মনে হয় হাঁটতে হয়...
--যাবার সময় বাবা স্কুটারে নামিয়ে দেন, ফেরার সময় সারাদিনের পর এটুকু হাঁটতে ভালই লাগে। আমি যেতে পারব, আর কোন অসুবিধে নেই। আপনি আসুন... একটু যেন লজ্জ্বা পেয়ে বলল সুমনা।
আচ্ছা বেশ। গেলাম তাহলে... বাইকে স্টার্ট দিল ছেলেটি।

(৩)
পরের দিন রবিবার। গতকাল স্কুল থেকে ফেরার পর বাবা-মাকে বলা হয়নি সেই ছেলেটির কথা। সকালে উঠেই মনে হল এখন  চায়ের টেবিলেই বলবে। নিখিলেশ সুমনার দিকে একবার ইঙ্গিত করেই  খেতে শুরু করে দিয়েছেন। সুমনা অপেক্ষা করছে মায়ের জন্য। মা এলে একসঙ্গে শুরু করবে। খাবার টেবিলটা রবিবারের দু/তিনটে খবরের কাগজ, দুটো পত্রিকা, চা-জলখাবারের প্লেট, কাপ-চামচে বোঝাই হয়ে আছে। মিনতি নিজের চায়ের কাপ রাখার জন্য একপাশে একটা কাগজ সরিয়ে রেখে বসলেন। চায়ের কাপ মুখে দিয়েই আবার নামালেন।  আজকে  বেশ কিছু কেনা-কাটার দরকার, আগে সেগুলো বলে নিতে চান, নইলে কে, কখন, কোথায় বেরিয়ে যাবে, হয়ে উঠবে না। সেসব ফিরিস্তি শেষ হলে সুমনা জিজ্ঞেস করল নিখিলেশকে...বাবা, তোমার কিছু?
নিখিলেশ কাগজে মুখ ঢেকে রয়েছেন। হাতের ইশারায় জানিয়ে দিলেন---না।
একথা-সেকথায় একরকম ভুলেই গেল সুমনা মা-বাবাকে সেই ছেলেটির কথা বলতে। আজ তার অনেক কাজ। জামা-কাপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, আবার সাতদিনের সব ব্যবস্থা করে রাখা। কাজের মাসির কাছে চুলে তেল দিতে হবে। নিজেকেও আজ একটু ঘষা-মাজা  করতে হবে--একবার ঝুমুরের বাড়ি যেতে হবে, খবর নিতে। কালকে দেখা হয়েছিল শীলা কাকিমার সঙ্গে একেবারে বাড়ির মুখেই। ঝুমুর তার এখানকার একমাত্র বন্ধু,গলাব্যথা আর জ্বর নিয়ে বিছানায়, কাকিমা হাসপাতাল থকে ওষুধ নিয়ে ফিরছিলেন। উঠে পড়ল সুমনা। আজ আর তার সময় নেই, বহুত কাজ ।

বিকেলে বাজার সেরে মায়ের সঙ্গে জিনিসপত্র নামিয়েই চলে গিয়েছিল ঝুমুরের বাড়ি। সেখান থেকে ফিরতে একটু সন্ধ্যেই হয়ে গেল।  বাড়িতে পা রেখে দেখল বসার ঘরে বাবার বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব রয়েছেন, উমেশ কাকার উত্তেজিত কথাবার্তা কানে আসছিল। সুমনা বুঝল কিছু একটা আজ হয়েছে কলোনীতে। নইলে এতজন এখানে আসতেন না। মাঝে মাঝে অবশ্য দল বেঁধে যে আসেন না, তা নয়। কিন্তু সে বিশেষ কোন দিনে, সাধারণ ভাবে নয়। সুমনা সে ঘরে না গিয়ে সোজা মায়ের কাছে। মায়ের দিকে ভুরু কুঁচকে চাইতেই মিনতি বলে উঠলেন...কি জানি, আমি কি সব জানি!
--যা জান, তাই বল না... বলে উঠল সুমনা... কি হয়েছে, মা!
--কে বাপু একটা নতুন ছেলে এসেছে রাঁচী না রামগড় থেকে, এখানে ব্যাঙ্কে, সে বেশ কিছু টাকা চুরির দায়ে ধরা পড়েছে। ওর আগের অফিস থেকেও নাকি খবর পাঠিয়েছে, সেখানেও একই ঘটনা...আমি অত কিছু জানি না।  তোর বাবার সঙ্গে উমেশদারা কথা বলছিলেন, চা দিতে গিয়ে খানিক শুনলাম। কি সব ছেলে বাবা... ভয়ে-ভয়ে কিছুটা  বিরক্তিতে বলে উঠলেন মিনতি।
ধ্বক্‌ করে উঠল সুমনার বুক। সেই ছেলেটা নয় তো! সেও যেন এমনি কিছু একটা বলেছিল। রাঁচী না রামগড় থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছে। কিন্তু তাই বলে চুরি! ছেলেটির চেহারা, কথাবার্তা, ভদ্র ব্যবহার, পরোপকার...এগুলোর সঙ্গে কোথাও মিল খুঁজে পাচ্ছিল না। চুরি করলে কেউ নিজের সত্যি কথা বলে? সে যে রামগড় থেকে এখানে বদলি হয়ে এসেছে, বলেছে তো, কোথাও কি ভুল হচ্ছে...!
--তুমি ঠিক জান, মা?
--আমি কি ওখানে চাকরি করি নাকি? উমেশ দারা বলাবলি করছিলেন, বিরক্ত হচ্ছিলেন...তাই শুনলাম। ছেলেটিকে দেখে নাকি বোঝাই যায়নি...’  
--ভুলও তো হতে পারে...মা!
--না, তাহলে ওর আগের অফিসও একই কথা বলে খবর করবে কেন? মিনতি হয়ত আরো কিছু বলছিলেন। সুমনা নিজের ঘরে চলে এল। খারাপ লাগছিল তার, খুব খারাপ লাগছিল। কেমন যেন একটা কষ্টের মতো কিছু গলায় আটকে গেছে...কই, একবারও তো ছেলেটিকে দেখে কিছু মনে হয়নি। কি মমতার সঙ্গে সে সেদিন বাড়িতে এনে দিয়ে গেছে। ভাল না হলে কেউ দেয়? এত ভদ্র ব্যবহার...মনে মনে ছেলেটির হয়ে যুক্তি সাজাচ্ছিল সুমনা। কালকেও কি সুন্দর ব্যবহার করেছে ছেলেটি। এগুলো কি তবে মুখোশ? যদি, কালকেই এই ঘটনা হয়ে থাকে, তারপরেও কি করে ছেলেটি অমন স্থির ছিল? মানতে পারছিল না সুমনা। মানুষকে চিনতে এত ভুল করল সে, নাকি  চেনা সত্যিই যায় না!
কি করে এমন হয়, কেন হয়! ভাবতে পারছিল না সুমনা। তাঁর সরলতা, বিশ্বাস, ছেলেটির প্রতি মুগ্ধতায় কোথাও আঘাত লাগছিল। নিজের ঘরের জানালা দিয়ে দুরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল সে। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা যেন কুরে কুরে খাচ্ছিল সুমনাকে.....









সুবীর কুমার রায়

যেখানে আঁটের ভয়

বৃদ্ধটি হাত জোড় করে ডুকরে কেঁদে উঠে বললোবাবু আমার জোয়ান ছেলেটা মরে গেছে, তার কাজে টাকার প্রয়োজন। টাকাটা আমায় তুলতে দিন। আমি আপনার ঋণের টাকা ঠিক শোধ করে দেব।  
মেদিনীপুর জেলার একটা গন্ডগ্রামে অবস্থিত, একটা সরকারী ব্যাঙ্কের শাখায়, আমি তখন রুরাল ডেভেলপমেন্ট্ অফিসার হিসাবে কর্মরত। এ অঞ্চলের আর প্রায় সকলের মতো, এ লোকটাও তার ঋণের টাকা পরিশোধ করে না। আজ সে তার সেভিংস্ একাউন্ট থেকে সামান্য জমানো টাকা তুলতে আসলে, আমি তাকে ভয় দেখাবার জন্য, টাকা তুলতে দেব না বলায়, তার মুখ চোখের অবস্থা করুণ হয়ে যায়, এবং কান্নায় ভেঙ্গে পরে আমায় কথাগুলো বলে।
জোয়ান ছেলে মারা গেল কী ভাবে?
বাবু, তারে আঁটে নিয়ে গেছে। বৃদ্ধটি হাতজোড় করে কপালে ঠেকালো। আমার উদ্দেশ্যে না আঁটের উদ্দেশ্যে, বুঝলাম না।
তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম— “ঘটনাটা ঘটলো কী ভাবে”?
বাবু, দুদিন আগে সন্ধ্যাবেলা আমার বড়ছেলে, তার ছোট ভাই এর সাথে হ্যারিকেন নিয়ে পাশের পুকুর ঘাটে গিয়েছিল। সেখান থেকেই তারে আঁটে নিয়ে গেছে। ছোটছেলের চিৎকারে আমরা গিয়ে দেখি, সব শেষ।
ছোটছেলের বয়স কত?
তা দশ-বার হবে বোধহয়, ওর মা বলতে পারবে।
পুলিশে খবর দিয়েছিলে?
কী যে বলেন বাবু, পুলিশ কী করবে?
ডাক্তার ডেকেছিলে?
এ গাঁয়ে ডাক্তার কোথায়? নন্দ হোমপ্যাথকে ডেকে ছিলাম। সে সাঁঝের বেলা ভয়ে সেদিক মাড়ায় নি।
পঞ্চায়েত এ খবর দাও নি? মেম্বারকে জানিয়েছিলে?
পঞ্চায়েতের মেম্বার দুলালের ভাইরে আর বছর আঁটে নিলে। তারে বলতে সে বললে, আমি আর কী করবো, পুজো দাও।
ছেলের দেহ কী হ?
কী হবে? আর পাঁচজন মরলে যা হয়, মাঠের শ্মশানে পুড়ায়ে ফেললাম।
এই এলাকায় এসে প্রথম আঁটের কথা শুনি। আঁট এখানকার ব্রহ্মদৈত্য গোছের কিছু একটা হবে। প্রায় সকলের মনেই একটা ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা আঁটের প্রতি আছে। আঁট নিয়ে অনেক গল্প, যদিও এরা বলে ঘটনা, শোনা হয়ে গেছে। ফলে আঁট সম্বন্ধে একটা কৌতুহল আমার মনে জেগে ছিল। শেষে বৃদ্ধটিকে টাকা তুলতে দেওয়ায়, সে নমস্কার করে, টাকা নিয়ে চলে গেল।
আমি আঁট নিয়ে আরও খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম। অনেক নতুন নতুন তথ্যও পেলাম। আঁট হিন্দু হয়, মুসলমানও হয়, তবে অন্য কোন ধর্মের আঁট, এ অঞ্চলের মানুষ দেখে নি। হয় কী না জানেও না। আঁট শুধু মাত্র পুরুষই হয়। মেয়ে আঁট বা আঁটী (?) হয় না। ফলে এদের বংশ বৃদ্ধি না হওয়ায়, আঁট সম্প্রদায় যাতে লুপ্ত না হয়ে যায়, সেই জন্য এরা পুরুষ মানুষ মেরে আঁটের সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
এর কিছুদিন পরেই অফিসের হেড ক্যাশিয়ার রাধেশ্যামবাবু, চিৎকার করে একজন লোককে খুব ধমক দিয়ে বলছে— “বেঞ্চি থেকে নেমে দাঁড়াও, ওর ওপর উঠেছ কেন? নেমে দাঁড়াও
তার চিৎকারে লোকটার দিকে চোখ গেল। আমি যে জায়গাটায় বসে আছি, সেখান থেকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি, লোকটা মাটিতেই দাঁড়িয়ে আছে। অসম্ভব রকমের লম্বা, চোখ দুটো যেন গর্তের মধ্যে থেকে ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে, গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। কাউন্টারের অপর প্রান্ত থেকে রাধেশ্যামবাবু, লোকটার মাথা থেকে বুকের কিছুটা নীচ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। ফলে আর পাঁচজন কাষ্টোমারের থেকে অত উচ্চতায় লোকটার মাথা দেখে, তার ধারণা হয়েছে যে লোকটা বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা সকলে হাসাহাসি করায়, লোকটা কেমন ঘাবড়ে গিয়ে চলে গেল। রাধেশ্যামবাবুও তার বোকামির জন্য লজ্জা পেয়ে গেল। পঞ্চায়েতের একজন মেম্বার আমার কাছে কাজে এসেছিল। সে-ই আমাকে গোপন খবরটা দিল— “ফিলটারবাবু, ওকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করবেন না, ও কিন্তু আঁট। ওর এই ব্র্যাঞ্চে লোন আছে
এই প্রথম আমার আঁট দর্শন। লোকটা মুসলমান। লোন নিয়ে আঁট হয়েছে, না আঁট হয়ে লোন নিয়েছে, জানা গেল না। শুধু ফিল্ড্ অফিসার বা এই অঞ্চলের ফিলটারবাবু হিসাবে বুঝলাম, এর লোন আদায় হবার নয়।
এ অঞ্চলে একজন ফর্সা, বেশ লম্বা লোককে প্রায়ই রাস্তায় দেখি। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। সবাই দেখি তাঁকে হাত তুলে নমস্কার করে। একদিন শুনলাম এই ভদ্রলোক এই এলাকার একমাত্র জীবিত মানুষ, যিনি আঁটের হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছেন। হয়তো আঁটের কবল থেকে বেঁচে ফিরে আসা একমাত্র জীবিত মানুষ হিসাবে তাঁর নমস্কার প্রাপ্য, কিন্তু আমার আঁট সম্বন্ধে কৌতুহল, ভদ্রলোক আরও বাড়িয়ে দিলেন।
এইভাবে বেশ দিন কাটছিল, হঠাৎ আমাদের অফিস প্রায় আধ কিলোমিটার দুরে একটা নতুন তৈরী বেশ বড়, সুন্দর বাড়িতে স্থানান্তরিত হল। বাড়িটার ঠিক পাশে একটা বড় বট গাছ এবং কতগুলো চালতা গাছ ছিল। গোটা অঞ্চলে বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের ব্যবস্থা এখনও হয় নি। আগের বাড়িতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের রাজা-বাদশাদের মতো পঙ্খাপুলারের ব্যবস্থা ছিল। দুটো ছেলে পালা করে মাদুরের বড় বড় পাখা, দড়ি ধরে টানতো। নতুন বাড়িতে পাশের বটগাছের নীচে, শেড্ করে জেনারেটার বসানো হল। আমাদের কষ্ট কিছুটা কমলো। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সেটা বিকল হল। সারানোর কয়েক দিনের মধ্যেই আবার খারাপ হল। সন্ধ্যার সময় জায়গাটায় আলোর ব্যবস্থা করার জন্য, বটগাছ থেকে তার ঝুলিয়ে একটা বাল্ব জ্বালানো হত।
কয়েক দিনের মধ্যে জেনারেটারের মালিক আমাদের জানালো, সে আর জেনারেটার ভাড়া দেবে না। অথচ এ অঞ্চলে অন্য কোথাও তার জেনারেটার ভাড়া দেবার কোন সুযোগ নেই। বনু নামে একটা জোয়ান ছেলে ঐ জেনারেটারটা চালাতো। সে আগের বাড়িতে মাদুরের পাখাও টানতো। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন তার মালিক জেনারেটার ভাড়া দিতে চাইছে না। ভেবেছিলাম সুযোগ বুঝে ভাড়া বাড়ানোর কথা বলবে।
টাকা কী কম দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছে?
না স্যার।
তবে কেন চালাতে চাইছে না?
অন্য অসুবিধা আছে স্যার।
কী অসুবিধা খুলে বল, না বললে বুঝবো কী ভাবে?
দেখছেন না বারবার জেনারেটার খারাপ হচ্ছে?
দেখছি তো। ওটাকে ভালভাবে মেরামত করার ব্যবস্থা কর।
আমাদের মেশিন ভালই আছে স্যার, অন্য কারণে বারবার খারাপ হচ্ছে।
কী কারণে ?
স্যার, আপনারা অন্য জেনরেটারের ব্যবস্থা করুন। ওরা চাইছে না আমরা জেনারেটার চালাই।
কারা চাইছে না?
স্যার, এখানে আঁট আছে। তারা অসন্তুষ্ট হচ্ছে। শব্দ বা আলো ওরা পছন্দ করে না।
মরেছে, মাদুরের পাখা খুলে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া সে গুলোর যা হাল হয়েছিল, নতুন করে লাগানো যাবে বলেও তো মনে হয় না। কোথায় খুলে রাখা হয়েছে, তাও তো জানি না। এ তো ঢাকও গেল, ঢুলিও গেল অবস্থা। শেষে অনেক বোঝাবার পর, সে চালাতে রাজী হল বটে, তবে সন্ধ্যের পর চালাতে পারবে না, পরিস্কার জানিয়ে দিল।
ঠিক আছে তাই হবে।
এরপর থেকে কোন কারণে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ থাকলে, নিজেরাই জেনারেটার চালাতে শুরু করলাম।
দিন কয়েক পরেই বনু জানালো, মালিক বলেছে দুপুরের দিকটা মেশিনটা কিছুক্ষণ চালানো যাবে না।
কেন? দুপুরে আবার কী অসুবিধা?
ঐ সময়ে সব শুনশান্ হয়ে যায়। মেশিনের আওয়াজে আঁটেদের অসুবিধা হয়।
এ তো মহা আপদ। তোমার মালিক কী আঁট, না আঁটরা তোমার মালিকের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন, যে সে এত খবর পায়?
অত বুঝি না। আমার জানানোর কথা জানিয়ে দিলাম, এবার আপনারা যা ভাল বোঝেন করুন।
পাড়ার অনেকেই এই জেনারেটার চালানো নিয়ে আপত্তি তুললো। এতে তাদের ও আমাদের কত ক্ষতি হতে পারে, তাও জানালো। তবে এর পরেও জোড়াতালি দিয়ে কোন মতে জেনারেটার চালানো চললো, তবে বনু দুপুরের দিকে বা সন্ধ্যার সময় জেনারেটারের শেডে না থেকে, ব্র্যাঞ্চের ভিতর বেঞ্চে বসে থাকতো।
এর মধ্যে অতসীদি দুদিন অফিসে আসলো না। অতসী মন্ডল আমাদের অফিসে, সাব স্টাফের কাজ করে। ওর স্বামী এই ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার ছিলেন। ভদ্রলোক সম্ভবত ব্লাড ক্যানসারে মারা যাবার পর, অতসীদি চাকরী পায়।
কী ব্যাপার, দুদিন অফিস কামাই করলেন কেন?
আর বলবেন না। আপনাকে বললে তো বিশ্বাস করবেন না। আমাদের পাশের বাড়ির একটা বাচ্ছা ছেলেকে আঁটে ধরে খড়ের চালে গিঁথে রেখেছিল। শরীরের অর্ধেক খড়ের চাল ফুঁড়ে বাইরে, অর্ধেক ছাদ থেকে ঘরে ঝুলছে। শেষে অনেক চেষ্টা, অনেক পুজো, অনেক সাধ্যসাধনার পর, তাকে মুক্ত করা হয়েছে।
কী জন্য ছাদে উঠেছিলো? ঘুড়ি ধরতে বোধহয়?
আরে না না। সন্ধ্যের পর বাচ্ছাটার চোখ মুখ লাল হয়ে, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। তারপর সে কী রকম অস্থির হয়ে যায়। শেষে তার শরীরে কী রকম একটা শক্তি জন্মায়। এক লাফে খড়ের ছাদ ভেদ করে, ঐ রকম ভাবে আটকে যায়।
আপনি বাচ্ছাটাকে মেঝে থেকে লাফিয়ে ছাদ ভেদ করে যেতে দেখলেন?
আমি দেখবো কী ভাবে? আমি কী তখন ঐ ঘরে ছিলাম?
তবে কে কে দেখেছে?
তা জানিনা বাপু, তবে অনেকেই বলছে ঐ ভাবে ছাদে আটকে গেছে।
বাচ্ছাটার পা দুটোতো ঘরের ভিতর ঝুলছিল। পা দুটো টেনে তাকে নামিয়ে, ডাক্তার ডাকলে তো পারতেন।
আপনার কোন ধারণা নেই বলে, এ কথা বলছেন। আঁটে ধরলে তাকে টেনে নামানো, বা ঠেলে সরানো সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব।  
এতো দেখছি আঁটে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।
আশেপাশের কাষ্টোমাররা সুযোগ পেয়ে আঁট সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করলো। এদের কাছ থেকেই আঁটের মানুষ ধরার একটা নতুন কায়দার কথা জানতে পারলাম। সাধারনত সন্ধ্যের পর যখন অন্ধকার নেমে আসে, তখন আঁটরা তাদের পছন্দ মতো কোন একজন নিরীহ লোককে কায়দা করে পুকুর পাড়ে, বা কোন জলা জমির কাছে নিয়ে গিয়ে, তাকে তাদের সমাজের সদস্য হতে আহ্বান জানায়। কোন মানুষই এই প্রস্তাবে রাজী হয় না। কেউ হয়তো করুণ সুরে মিনতি করে বললো তাকে ছেড়ে দিতে, কারণ তারা খুব গরীব এবং সে নিজে সংসারে একমাত্র উপায় করে। বাড়িতে অনেক লোক তার সামান্য আয়ের ওপর বেঁচে আছে। আঁট সঙ্গে সঙ্গে লোকটার হাতে একটা টর্চ লাইট দিয়ে বললো, সামনের গাছটার নীচে একবার আলো ফেলেই নিভিয়ে দিতে। আঁট হঠাৎ টর্চ কোথায় পেল, এরাই বা এত খবর কোথা থেকে পেল জানতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এদের কাছে এসব প্রশ্নের কোন মূল্য নেই। যাহোক্, বাধ্য হয়ে লোকটা গাছতলায় আলো ফেললো এবং সঙ্গে সঙ্গে টর্চ নিভে গেল। ঐ স্বল্প সময়ে লোকটা দেখতে পেল গাছ তলায় অনেক, অনেক টাকা রাখা আছে। তখন লোকটাকে আঁটরা নির্দেশ দিল টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে, এবং আগামী কাল সন্ধ্যাবেলা ঠিক একই জায়গায় ফিরে আসতে। লোকটার পক্ষে এ নির্দেশ অমান্য করার সাহস বা উপায় থাকে না। পরদিন তাকে ঐ জায়গায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।   
সব শুনে অতসীদিকে জিজ্ঞাসা করলাম— “তা হঠাৎ আপনাদের আঁট মহারাজ এই বাচ্ছাটাকে না মেরে, জিওল মাছের মতো জিইয়েই বা রাখলো কেন? বাচ্ছাটাকে তারা ছাদ ভেদ করে নিয়ে যেতেই বা পারলো না কেন? আঁটেদের বোধহয় বাচ্ছাটাকে পছন্দ হয় নি”?
আপনি কোনদিন ওদের হাতে পড়লে অবিশ্বাস করা ছুটে যাবে। আপনি শহরের লোক, গ্রামের কতটুকু খবর রাখেন? যাহোক্, আজ কিন্তু সকাল সকাল বাড়ি চলে যাব। আজও অফিসে আসার ইচ্ছে ছিল না, খুব বেশী ছুটি নেই বলে, বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে।  
কেন আজ আবার কী?
আজ পাড়ায় ভিডিও শো আছে।
ভিডিও শো এর জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে? কোথায় হবে?
ঐ ছেলেটার বাড়ির পাশে, একটা মাঠে।
কেন? হঠাৎ ভিডিও শো কেন?
আঁটকে খুশী করার জন্য। পুরহিত মশাই বলেছেন।
কোন ছবি দেখানো হবে, বাংলা না হিন্দী? কার পছন্দ মতো ছবি দেখানো হবে, পাড়ার লোকের, পুরহিতের, না স্বয়ং আঁটের পছন্দ মতো?
অত শত জানিনা। আপনার মতো অবিশ্বাসী লোকের সাথে কথা বলা মানে সময় নষ্ট করা।
বিকেল হতেই অতসীদি চলে গেল। তাড়াতাড়ি যাওয়ার কারণ আঁটের ভয় না ভিডিও শো, সেই জানে।
সন্ধ্যের পর আমি আর প্রসুনবাবু অফিস বন্ধ করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। আমরা পাঁচজন একই শাখার কর্মী, একটা দোতলা বাড়ির এক তলায় মেস্ করে থাকি। প্রসুনবাবু আমাদের অফিসের ম্যানেজার। অফিস থেকে বাড়ির দুরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার পথ। আমরা দুজনে প্রায় রোজই এক সাথে হেঁটে বাড়ি ফিরি। একতলায় একটা ঘরে আমি একা থাকি। প্রসুনবাবু অন্য একটা ঘরে আর একজনের সাথে থাকেন। তৃতীয় ঘরটায় আরও দুজন স্টাফ্ থাকে। অসম্ভব গরম পড়ায়, প্রসুনবাবু দোতলার গ্রীল দিয়ে ঘেরা বারান্দায় একটা বড় চৌকিতে রাতে একা শুতে যায়। আমি সাধারণত রাতে ছাদে শুই। নিজের ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত হ্যারিকেনের আলোয় বই পড়ে ছাদে চলে যাই। কখনও কখনও নিজের ঘরে বা প্রসুনবাবুর পাশেও শুয়ে পড়ি।
বাড়ি ফিরে প্রসুনবাবু হঠাৎ বললো, “আজ রাতে আপনি দোতলায় আমার পাশে শোবেন তো”?
কেন আঁটের ভয় পাচ্ছেন নাকি? চারিদিক তো গ্রীল দিয়ে ঘেরা, ভয়টা কিসের?
না না, প্রচন্ড গরম পড়েছে বলে বলছি। ওপরটা বেশ ঠান্ডা।
আমি তো রোজই ছাদে শুতে যাই। গরম লাগলে নাহয় ছাদেই চলে যাব।
কী দরকার? ছাদে হিম পড়ে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। দোতলায় বারান্দায় শুয়ে পড়বেন, চৌকিটাতো বেশ বড়। চারিদিক গ্রীল দিয়ে ঘেরা। বেশ ঠান্ডা, আরামে ঘুমবেন।
আজ হঠাৎ জলা বা পুকুর ছাড়া ঘরেও আঁট আসে, আর খড়ের ছাদ ভেদ করে বাচ্ছাটাকে নিয়ে যাবার কথা শুনে, ভয় পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। আমি আপনাকে কথা দিতে পারি, যে আঁট গ্রীল দিয়ে ভিতরে ঢুকলেও, আপনাকে কিছুতেই গ্রীলের ভিতর দিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না।
বাজে কথা রাখুন। প্লীজ আজকে দোতলায় শুতে চলুন না।
ঠিক আছে রাতে দেখা যাবে।
প্রসুনবাবু রোজই সবার আগে খুব তাড়তাড়ি দোতলার চৌকিতে শুতে চলে যায়। আমরা বলতাম পাছে অন্য কেউ শুয়ে পরে, তাই আগেভাগে গিয়ে জায়গাটার দখল নেয়। অন্য কেউ তার পাশে শোয়, এটা তার খুব একটা পছন্দ হত না।
রাত দশটা নাগাদ প্রসুনবাবু আমার ঘরে এসে জানালো যে সে দোতলায় যাচ্ছে, আমি যেন বেশী রাত না করে, দোতলায় তার পাশে শুতে চলে যাই।
দেখা যাবে।
দেখা যাবে কেন? এ ঘরে কষ্ট করে গরমের মধ্যে শোবার দরকারটা কী?
তাহলে ছাদে চলে যাব। আচ্ছা দেখবো কী করা যায়।
দেখবো না। ছাদে শুলে ঠান্ডা লাগার ভয় আছে। কী দরকার ছাদে শোবার? আমি একটা এক্সট্রা বালিশ নিয়ে যাচ্ছি।
আচ্ছা যাব।
বেশী রাত করবেন না। গুড নাইট।
ঠিক আছে। গুড নাইট।
ও চলে যেতে আমি বই এ মনোনিবেশ করলাম। অনেক রাতে ঘূম আসায়, আমি নিজের ঘরেই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। ওপরে যাবার কথা মনেও ছিল না।
গভীর রাতে হঠাৎ প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ধরমর করে উঠে বসে হালকা আলোয় ঘুমচোখে দেখি, বিছানার কাছে কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। ভাল করে দেখে বুঝলাম আঁট নয়, প্রসুনবাবু।
আপনি তো আচ্ছা ছোটলোক মশাই, দোতলায় যাবেন বলে গেলেন না।
আপনি কী এতক্ষণ জেগে ছিলেন?
না, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি আপনি পাশে নেই, তাই নীচে নেমে এলাম।
এত রাতে আর ওপরে গিয়ে নতুন করে আবার ঘুমের সাধনা করতে ভাল লাগছে না।
তাহলে আমিই না হয় এখানে শুয়ে পড়ি।
শুধু শুধু আপনি ভয় পাচ্ছেন। আঁট যদি আসেই, তাহলে আমি কী তাকে আটকাতে পারবো? তাছাড়া আমাদের মধ্যে আপনাকেই যে আঁটের পছন্দ হবে, তারই বা গ্যারান্টি কোথায়? কাল থেকে বরং ঐ ভদ্রলোক, যিনি আঁটের হাত থেকে ফিরে এসেছেন, তাঁকে পাশে নিয়ে শোবেন।
থামুন মশাই, এত রাতে আর আপনার লেকচার ভাল লাগছে না। আপনি ওপরে যাবেন না তো?
নাঃ, এত রাতে আর ভাল লাগছে না।
তবে আমি এখানেই একটু জায়গা ম্যানেজ করে নি।
বাধ্য হয়ে ছোট একটা চৌকিতে, গরমের মধ্যে, ঘেমো গায়ে দুজনে পাশাপাশি, ঠেসাঠেসি করে শুয়ে পড়লাম।
এরপর থেকে কোনদিন প্রসুনবাবুকে একা দোতলায় শুতে যেতে দেখি নি।


মৌ দাশগুপ্তা

ইন্দ্রিয়

চোখ
তের পর রাত চোখের পাতা এক করতে পারেনা সুমি।চোখ বুঁজলেই মেয়েটার নরপশুতে খোবলানো শরীর, ক্ষত বিক্ষত মুখ বুক, খোলা মৃতচোখে রাজ্যের বিভীষিকা আর আতংক। সুমির দম বন্ধ হয়ে আসে। রাগে ক্ষোভে অসহায়তায় গায়ে আগুন লাগিয়ে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেতে ইচ্ছে করে ওর। পারে না সুমির বাপ আর ওদের আরো দু সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে। মনের আগুন তুষানল হয়ে দিনরাত জ্বলে আর জ্বালায়। কটা আর মদনা। নামদুটো ইষ্টদেবতার থেকেও বেশীবার করে মনে পড়ে। স্রেফ প্রমানের অভাবে ওরা আইনের কাছে ছাড়া পেয়ে গেছে কিন্তু মায়ের মনের আদালতে ওদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
এরপর এভাবেই কেটে গেছে আরো অনেকগুলো দিন,মাসের পর মাস,ঘুরে গেছে চার চারটে বছর।কটা মদনার স্বভাব পাল্টায়নি মোটেও।বরঞ্চ অপরাধের মাত্রা তথাকথিত মামা দাদাদের ছত্রছায়ায় আরো বিকশিত হয়েছে,সূক্ষ্মতর হয়েছে। হয়ত সুমির বুকের তূষের আগুন স্তিমিত হয়েছে কিন্তু নেভেনি মোটেও। তাই খবরের কাগজে যেদিন কটা মদনা আর ওদের দুই সংগীকে পুলিশ এক নাবালিকাকে ধর্ষণ ও খুনের দায়ে গ্রেফতার করেছে খবরটা পড়েছে সেদিন থেকে সুমি আবার ন্যায়বিচারের আশায় বুক বেঁধেছে।এবার মেয়েটার লাশ বয়ে নিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা অব্ধি ঘটনার এক সাক্ষী আছে যে।
নিম্ন আদালতে যেদিন রায় ঘোষণা হল সেদিন অনেকদিন পরে টিভির স্ক্রিনে চোখ ছিল সুমির. টিভিতে সাংবাদিক সাক্ষ্য দেওয়া শপিংমলের নাইটগার্ড ছেলেটির বাইট নিচ্ছে। চারবছর পরেও যে মুখ চিনতে একটুও ভুল হয়নি সুমির... আকাশভাংগা ঘুম তাই সুমির চোখে।আজ স্বপ্নে মনি নেই, আজ স্বপ্নে সেই অল্পবয়সী ছেলেটার রক্তাক্তমুখ, সাইকেল এক্সিডেন্টে যার দুটো চোখ নষ্ট হয়ে গেছিল বলে মনির চোখদুটো বসানো হয়েছিল।

কানে শোনা
ঠাকুমা ঠিকই বলে..সোনুদের এখন সময়টাই খারাপ যাচ্ছে।প্রথমে হটাত করে দুদিনের জ্বরে দাদুমনি চোখ বুজলো.।সংসারের একমাত্র রোজগেরে কাকাইয়ের কাজটাও চলে গেল। বাড়ীর বড়দের হা হুতোশি শুনে সোনু টুনু ভাইবোনেরও মুখ শুকিয়ে আমসি।এর মধ্যে বিপদের ওপর বিপদ।ওদের বাড়ীর একতলাটা জুড়ে লাখোটিয়া ব্রাদার্সের জুয়েলারি শপ,কথা নেই বার্তা নেই সেখানে দোকানের শাটার ভেঙ্গে ডাকাতি।যা কিনা কস্মিনকালেও এপাড়ায় হয়নি। তাও শুধু ডাকাতি হলেও চলত , ডাকাতি করার সময় বাঁধা দেওয়ায় দোকানের রাতপ্রহরী সোনুটুনুদের পচাকাকূকেও খুন করে ফেলে রেখে গেছে।
পাড়া জুড়ে হৈচৈ,থানা পুলিশ ,টিভি খবরের কাগজের লোকজন,পাড়াপ্রতিবেশী,চেনাঅচেনা কত মুখ ! খেলা বন্ধ ..স্কুল বন্ধ..ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ! হাওয়ায় শতেক গুজব হাজার রটনা।.যদিও সুরাহা কিছুই হলনা,তবে যতই পৌষের রাতের ঘটনা হোকনা কেন. ওপরের তলায় থেকেও নীচের তলায় এতবড় কর্মকান্ড বিন্দুমাত্র টের না পাওয়াটা কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলনা। সন্দেহভাজনের তালিকায় থাকা পরিবারের ওপর দিয়ে তাই ঝড়ঝাপ্টাও কম গেলনা। শেষমেষ পুলিশও হাল ছেড়ে দিল। লাখোটিয়ারা সোনার দোকান তুলে নিয়ে গেল অন্যত্র।একতলায় ব্যাঙ্কলোন নিয়ে প্রেস খুলে বসল সোনুর কাকাই। খালি এই বছরখানেক সময়ের মধ্যেই কেমন যেন পাল্টে গেল সোনু টুনুর দুনিয়া। ওরা কিছু দেখেনি সেদিন, কিন্তু নিজেদের কানে শুনেছিল রাতে সদর দরজায় পরপর তিনটে টোকার আওয়াজ। ওদের ঘরের ঠিকপাশেই কাকাইয়ের ঘরের দরজা খোলার মৃদু ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ,সদর খোলার শব্দ, অনেক লোকের ফিসফিস কথা,.একটা মুখচাপা আর্তচিতকার থেকে কাকাইয়ের সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে ফিরে আসার শব্দ। কানে শোনা শব্দেরা পরের দিন গোটা কাহিনী মেলে ধরেছিল ওদের মনের সামনে, যাকে বলে কিনা কানে শোনা সত্যিকারের রহস্য কাহিনী!!

ঘ্রাণ
কদিন ধরেই শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা তুলসীর।.ক্লান্ত লাগছে খুব। পেটে একটা চাপ চাপ যন্ত্রণা। জোরে শ্বাস নিলেও খচখচ করে লাগছে। ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে মনে হচ্ছে। এমনিতে তুলসী খুব স্বাস্থ্যসচেতন, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে অসুখবিসুখও বিশেষ হয়না তাই ডাক্তার বদ্যির সাথে বিশেষ সদ্ভাবও নেই,কিন্তু এবার ব্যাপারটা অন্যরকম লাগছে।
বিশেষত এই গন্ধটা! কেমন ওষুধ ওষুধ, চামড়া পোড়া,মশাতাড়ানোর ধুপপোড়ার গন্ধ মিশানো আজব একটা গন্ধ। সারা ঘরে,সব খাবারে, এমনকি মনে হয় নিজের সারা ঘায়ে গন্ধটা ছেয়ে গেছে। নাকি ওর নাকেই গন্ধটা পাকাপাকি ভাবে বাসা বেঁধেছে? ঘরে অন্য কেউ কিন্তু গন্ধটা পায়না।ওর বর শিমুল, মেয়ে শিউলি, ছেলে মন্দার, কেউনা।উল্টে ওকেই খেপায় গন্ধবাতিক হয়েছে বলে।
পেটব্যাথাটা বাড়তে বাড়তে অসহণীয় হয়ে উঠতে ডাক্তারের কাছে গেল তুলসী। পারিবারিক ডাক্তার ভালো করে দেখে গম্ভীরমুখে মাথাটাথা নেড়ে একগাদা টেস্ট করতে দিলেন। তারমধ্যে একটা খট করে কিনে বাজলো..."বায়োপ্সি"'.,আড়চোখে নজরে পড়ল একনিমেষে শিমুলের মুখও শুকিয়ে আমসি।
দোতলায় বেডরুমে শুয়ে শিমুলের অপেক্ষায় তুলসী,আজ মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট আসবে।নীচে মৃদুশব্দে ইনোভাটা এসে দাঁড়ালো। ড্রয়িংরুমে টিভি চলছেনা। শিউলি দরজা খুলে দিল বোধহয়,সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে চেনা পায়ের আওয়াজ, ক্লান্ত অথচ সাবধানি। ঘুমের ভান করে ব্যাথা চাপতে চাপতে চোখ বোজে তুলসী। সারা ঘরে উড়ে বেরাচ্ছে সেই উগ্র গন্ধটা। গন্ধটাকে এখন ও চিনতে পেরেছে। ছোটবেলায় এই গন্ধটাই ও ওর অকালমৃতা মায়ের ঘরে ঢুকলেই পেত।মায়ের বিছানায়, পোশাকে,সারাগায়ে। ওর মা গলব্লাডার ক্যান্সারে মারা গেছেন সে ও তো প্রায় বছর চল্লিশেক হল।।

স্বাদ
শঙ্খলাগা গোধুলীর আলোয় মেয়েটিকে প্রথম চুমু খেয়েছিল ছেলেটি I ভারী মিষ্টি লেগেছিল সেদিন।তারপর চল্লিশ বছর ধরে ওদের বিবাহিত জীবনে অনেক টক, ঝাল,মিষ্টি,তিতো,পানসে স্বাদের সংমিশ্রণ ঘটেছে, তবু সেই চুমুর স্বাদটা আজো ভোলেনি ছেলেটা। আজ আবার সেই গোধুলীবেলা, শ্মশানঘাটে মেয়েটির হিমশীতল কপালে জীবনের শেষচুমুর ছোঁয়াটুকু রাখতে রাখতে ছেলেটা ভাবছিল আজ জিভে এত নোনতা স্বাদ আসছে কেন?


স্পর্শ
বিনীতা অন্ধ, তাই নিজের সৌন্দর্য্যটা ওর অজানা। বিনীতার বাবা সম্পন্ন মানুষ, ব্রেইল স্কুলে পড়াশুনো শিখেছে, ভালো গান গাইতে পাড়ে, রীতিমত ওস্তাদ রেখে তালিম নিয়ে গান শিখেছে বিনীতা। তাই অন্ধ হলেও স্তাবক কম ছিলনা বিনীতার। চোখ নেই বলে স্শর্শেন্দ্রিয় ওর বড় সজাগ। ওর শরীরের প্রতি অঙ্গে অনেক গোপন স্পর্শের ইতিহাস লেখা আছে একাকী থাকলে সেই স্পর্শ সুখ বা অ-সুখের স্মৃতিচারণ করেই দিন কাটায়।হাওয়ার স্পর্শ,ঘাসের স্পর্শ, মাটির স্পর্শ, বৃষ্টির স্পর্শ,আগুনের স্পর্শ,মানুষের স্পর্শ, দাম্পত্যের স্পর্শ,খালি সারাজীবন যে স্পর্শসুখের জন্য ওর অধীর অপেক্ষা,যাকে আশ্রয় করে ওর শরীরে আজ ভালোলাগার ইতিহাস রচিত হচ্ছে সেই সঙ্গীত লহরীর স্পর্শসুখ ও পায়না। সে এক অন্য ইতিহাস ।।