গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৪র্থ বর্ষ ২০তম সংখ্যা।। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

এই সংখ্যায় ১০টি গল্প । লিখেছেন সুজাতা ঘোষ, সুবীর কুমার রায়, সাঈদা মিমি, আবুরাসেদ পলাশ, গৌতম সেন, তাপসকিরণ রায়, শেখর কর, অসিত চট্টোপাধ্যায় ও মিলন বণিক ।

                    সূচিপত্রে ক্লিক করে পড়ুন

সুজাতা ঘোষ

আপন অঙ্কুর
[ গত সংখ্যার শেষাংশ ]

প র্ব – ৩

দেখতে দেখতে দুমাস কেটে গেছে, রীনা এখন বাড়িতে বসে আঁকা – গান শিখিয়ে কিছু আয়ের চেষ্টা করছে। এভাবেই চলতে চলতে প্রায় বছর শেষ হতে চলল। রাতুল ফোন করেনি বাড়িতে একবারও। শেষে তৃষ্ণাদেবী নিজেই ফোন করলেন। ওপাশে কোন মেয়ের গলা। তৃষ্ণাদেবী  সোজাসুজি বললেন, রাতুলকে ফোন দাও। একটু পরেই ছেলের গলা শোনা গেল – হ্যালো।
কেমন আছিস?
ভালো, তোমরা?
খুব ভালো। যাদের তোমার মতো হীরের টুকরো ছেলে থাকে, তারা ভালো না থেকে পারে!
দেখ মা, জীবনটা আমার, আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দাও। তাছাড়া তোমাদের সাথে তো আর সম্পর্ক পাল্টাচ্ছে না। যাই হোক, সামনের বছর তোমাদেরকে এখানে বেড়াতে নিয়ে আসব। দেখবে কি সুন্দর জায়গা। লিজা ও কি সুন্দর মেয়ে। ও হো, লিজার কথা তো তোমাদের বলাই হয় নি। ও হোল ............
আমাদের মরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলি না? এই বুড়ো বয়সে ...............
আমি রাখছি। পরে কথা হবে।
তৃষ্ণাদেবী ফোন নামিয়ে রেখে সোফায় এসে বসলেন স্থির হয়ে। মৃগাঙ্কবাবু স্ত্রীর হাতে হাত রেখে বললেন – কেঁদো না। ও এখন মানুষ হয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা – মার কথা মনে রাখবে কেন? বাচ্চা যতদিন না হাঁটতে শিখছে, ততদিনই সে বাবা – মায়ের। হাঁটতে শিখলেই সে নিজের রাস্তা ধরে চলে যায় বহুদূরে, আর পিছনে রেখে যায় দুশ্চিন্তা।
অনেক বছর পর আজ সকালে হাঁটতে বেড়লেন নিঃসঙ্গ তৃষ্ণাদেবী। পরিষ্কার আকাশ, হাল্কা হাওয়া, রাস্তার ধারে বাড়ির প্রাচির ডিঙিয়ে ফুলে ভরা ডাল ঝুলে পড়েছে পথিকদের দিকে। দেখতে দেখতে হেঁটে চললেন, কি শান্তি! ঘরে ফিরতে মন চায় না। মৃগাঙ্কবাবুর কথা খুব মনে পড়ছে। আবার রাতুলের কথাও মনে পড়ল। যেদিন নিজের শরীরের সাথে জুড়ে গেছিল, সেদিন কি আনন্দই না পেয়েছিলেন। ওদের সন্তান, তৃষ্ণা – মৃগাঙ্কের সন্তান। সেদিন শপথ করেছিলেন, যত কষ্টই হোক ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করবেন। তা করেও ছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিসয় হল, ছেলে দায়িত্ব – কর্তব্য ভুলে গেলেও অধিকারটা ভোলে নি। এখন মনে হচ্ছে ছেলের প্রতি কিছুটা কম দায়িত্ব পালন করলে আজ হয়তো সে বাবা – মায়ের প্রতি কিছুটা দায়িত্ব পালন করত।
রোদ মাথায় নাচছে, আস্তে আস্তে বাড়ির পথ নিলেন। ইতিমধ্যেই লক্ষ্মী দুবার এসে ফিরে গেছে। এবারে এসে দেখে তৃষ্ণাদেবী দরজার সামনেই মোরা নিয়ে বসে আছেন। লক্ষ্মী দুমদুম করে পা ফেলে চাতালে বাসনগুলো ঝনাৎ করে ফেলল। দুবার তৃষ্ণাদেবীর দিকে তাকিয়ে হাতে মোটা করে সাবান লাগিয়ে নিয়ে অভিমানের সুরে বলল – সত্যি বাবা, আর পারি নে। দু – দুবার এইসে ঘুইরে গেলুম। কোতায় গেছলে? নক্কির কি আর কাজ নেই? এইবারে তোমার একানেই থাইকতে হবে মনে হচ্ছে। দোর আগলে বসলে ক্যানে? ভিতরে যাও।
আমার শরীরটা ভালো নেই রে লক্ষ্মী।
ও মা, সে কি গো! রীনাদিদিকে ডাকব?
না না, একটু হাওয়ায় বসি ঠিক হয়ে যাবে।  

ফোন বাজছে, তৃষ্ণাদেবী দেওয়াল ধরে ধরে বসার ঘরে ঢুকলেন।
হ্যালো।
নমস্কার মা, আমি আপনার বৌমা বলছি।
বৌমা! কোথা থেকে?
আমেরিকা থেকে।
আমেরিকা থেকে?
আপনার নাতি আপনাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
ও তো আমাকে চেনেই না!
আমরা গল্প করি তো, রোজদিন।
তুমিও?
মানে, আপনার ছেলে।
তিন বছর হবে এই মাসের ১২ তারিখে।
তোমার বাড়ি কোথায়?
আপনাদের পাড়ার দুটো পাড়া পরেই।
কোথায় বলতো? তোমার নাম কি?
আমার নাম শুভ্রা। আমি আর রাতুল ছোটবেলা থেকে একই স্কুলে পড়েছি। আমার এক মামা আমেরিকাতেই থাকেন। আমি চাকরি পেয়ে মামার বাড়িতে থাকতে শুরু করি, তখনই ঘটনাচক্রে অফিসের কাজে আমাদের দুজনের দেখা হয়ে যায়। মা, আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাই।
যখন ইচ্ছা হবে, চলে আসবে। রোজ রোজ ফোন করে জিজ্ঞাসা করতে হবে না। এখন রাখছি।
মনে হল পাটা একটু টলকালো, আজকাল আর শরীরটা সায় দেয় না মনের সাথে। ফ্যানটা জোরে চালিয়ে সোফার উপর শরীরটা মেলে দিলেন। লক্ষ্মী জল খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল – কি হোল ঠাগমা, শরীল কি বেশী খারাব? ডাক্তার ডাগব?
তৃষ্ণাদেবী – দরকার নেই, তুই একটু রীনাকে ডাকতে পারবি?
লক্ষ্মী – ফোন করি ডাগব?
তৃষ্ণাদেবী – হ্যাঁ, তাই ডাক। এক কাজ কর, দাক্তারকেও একটু ফোন করে দে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রীনা এসে দেখল দাক্তারবাবু ওনার প্রেসার চেক করছেন। রীনাকে দেখামাত্র তৃষ্ণাদেবী ব্যাস্ত হয়ে বললেন, তেমন কিছু নয়, প্রেসারটা একটু বেড়েছে। চিন্তার কিছু নেই, তুই বস। রীনা টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা ওলট পালট করে দেখতে লাগল। ততক্ষণে ডাক্তার চলে যেতে তৃষ্ণাদেবী রীনাকে পাশে ডেকে নিলেন। আজকে বেশ ক্লান্ত লাগছে দেখতে দুজনকেই। রীনার হাতটা ধরে তৃষ্ণাদেবী অনুরোধের সুরে বললেন, পাড়ার উকিলবাবুকে একটু ডেকে আনতে পারবি? রীনা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, কেন পারব না। কবে আনতে হবে, বল? তৃষ্ণাদেবী ব্যাস্ত হয়ে বললেন, এক্ষুনি ডাক, আর সময় নষ্ট করা যাবে না। রীনা একটু চিন্তিত সুরে জিজ্ঞাসা করল, একথা কেন বলছ? তৃষ্ণাদেবী হেসে বললেন, সময় হলে বুঝতে পারবি। এখন যা, যা বললাম তাই কর।

রীনা চলে যেতে লক্ষ্মী ওষুধ নিয়ে ফিরে এল। তৃষ্ণাদেবীকে বিশ্রাম নিতে দেখে আর বিরক্ত না করে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে জলখাবার আর ওষুধ নিয়ে এসে ডেকে তুলল। তৃষ্ণাদেবীর আপত্তি সত্বেও জোর করে খাবার আর ওষুধ খাইয়ে দিল। ইতিমধ্যে উকিলমশাইও উপস্থিত হলেন। তৃষ্ণাদেবী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে হাতের থালা লক্ষ্মীর হাতে দিয়ে ওনাকে বললেন – আপনি একটু বসুন, আমি আসছি। উকিলবাবু সোফায় বসতেই লক্ষ্মী বলল – চা খাবেন তো, নিয়ে আসছি।
উকিল – অবশ্যই খাব, তবে চিনি ছাড়া।
তৃষ্ণাদেবী  - আমার জন্যও আনিস।
উকিল – কি ব্যাপার বৌঠান এত জরুরি তলব কেন?
তৃষ্ণাদেবী – শরীরকে বিশ্বাস কি, কখন বিগরে যায়। তাই ভাবলাম একটা উইল করে রাখি।
উকিল – সে তো ভালোই, তবে আপনার তো একমাত্রই ছেলে।
তৃষ্ণাদেবী – ছেলে ছাড়াও আরও কিছু মানুষের গুরুত্ব আছে আমার জীবনে।
উকিল – বেশ তো, আপনি বলুন, আমি সব তৈরি করে দেব।
তৃষ্ণাদেবী তার সম্পত্তির ভাগাভাগি করে দিয়ে শেষে অনুরোধ করলেন, উইলের একটা কপি যেন অবশ্যই রীনাকে দেওয়া হয়। উকিলবাবু উঠে যাওয়ার আগে বলে গেলেন – আপনি কিছু চিন্তা করবেন না, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তৈরি করে পাঠিয়ে দেব।

প র্ব – ৪

আজ মহাঅষ্টমী। ছেলে – বৌমা আর নাতি তৃষ্ণাদেবীর ঘর আলো করে রয়েছে। বহু পুরনো রাগ, দুঃখ নিমেষের মধ্যে আবছা হয়ে গেছে। হালকা অভিমান ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের আনাচে কানাচে, তা বোধহয় ভালবাসারই আরেক নাম। সারাদিনের হাসি, ঠাট্টা, ক্লান্তির পর খাবার টেবিলে হঠাৎই রাতুল বলে উঠল – মা, টাকার ব্যাবস্থাটা হয়ে গেলে ভালো হত। এমনিও তো শুধু শুধু ব্যাঙ্কে পড়ে আছে .........।
তৃষ্ণাদেবী – আমি তো এখনও বেঁচে আছি, তাছাড়া রীনার প্রতিও তো আমার একটা কর্তব্য আছে।
রাতুল – রীনা! ও কোথা থেকে এল আমাদের মধ্যে?
তৃষ্ণাদেবী – কথা বাড়িও না, খাওয়া শেষ হলে ঘুমাতে যাও।
রাতুল উত্তেজিত হয়ে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করল – না, আমাকে জানতেই হবে, কেন ও আমাদের পরিবারের মাঝখানে আসছে।
তৃষ্ণাদেবী – তুমি হয়তো ভুলে গেছ যে, একদিন ওকে তুমি ঠকিয়েছিলে। তারই প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে হবে।
আর কোন কথা হয় নি, খাওয়াও শেষ হয় নি, যে যার নিজের ঘরে উঠে চলে গেছে।

সকালে লক্ষ্মী কাজে এসে তৃষ্ণাদেবীকে দেখতে না পেয়ে সোজা ওনার ঘরে ঢুকে গেল। অনেক ডাকাডাকির পরেও কোন সাড়া না পাওয়ায় লক্ষ্মী সোজা দৌড়ল রীনাদের বাড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়ার লোক জড়ো হয়ে গেল বাড়ির সামনে। এরপরে পুলিশের ভ্যান।

সবার সাথে কথা বলার পর পুলিশ এই সিদ্ধান্তে আসে যে, মৃত্যুটি সন্দেহজনক। বডি পোস্টমর্টমে পাঠিয়ে রাতুল আর তার স্ত্রীকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।  আবার আর একবার রীনাকে লজ্জায় পড়তে হল সকলের সামনে পুরনো সম্পর্কের রেশ ধরে। না চাইলেও মানুষের জীবনে অতীত ঘুরেফিরে মুখোমুখি দাঁড়ায়। একটা দীর্ঘশ্বাস পাক খেতে খেতে বেড়িয়ে আসল মনের অনেক গভীর অন্ধকার থেকে। আবছা হয়ে আসা স্মৃতিগুলো পায়ে মাড়িয়ে রীনা এগিয়ে চলল সামনের দিকে।।








সুবীর কুমার রায়।

বিমল


অফিসে বিমল জানা নামে এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ছিল। সে খুব ভালো রান্না করতে পারতো এবং মাঝেমধ্যে অফিসের ক্যান্টিনে ভালোমন্দ রান্না করে আমাদের খাওয়াতোও। ছেলেটা খুব ভাল ছিল, কিন্তু তার পিছনে লেগে আমরা খুব মজা পেতাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, সে রোজ দুটো করে ডিমসিদ্ধ খাওয়া শুরু করেছে। তখন আমার অল্প বয়েস, কথায় কথায় কবিতা লিখে ফেলতাম। একটা কাগজে বড় বড় করে জানার মাথায় গোবর পোরা, উঠবে এবার সিং। বুদ্ধি কী আর বাড়ে জানা, খেলে ডবল্ ডিম? লিখে ক্যান্টিনের দেওয়ালে সেঁটে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে ক্যান্টিনে চিৎকার চ্যাঁচামিচি শুনে গিয়ে দেখি, বিমল কবিতার কাগজটা দেওয়াল থেকে খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার শ্রীমুখ দিয়ে অনর্গল খিস্তি ছুটছে।

এই বিমল তার বিয়েতে ছবি তোলার জন্য বিশেষ ভাবে ধরলো। আমি একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ক্যামেরা কিনে মাঝে মাঝে ফটো তুলি বটে, কিন্তু ফ্ল্যাশগান না থাকায় রাতে ছবি তোলার সুযোগ ছিল না। নাছোড়-বান্দা বিমলকে এটা কিছুতেই বোঝাতে না পেরে শেষে সহকর্মী সুজয়কে অনুরোধ করতে বুদ্ধি দিলাম। জায়গাটা ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে হওয়ায় সুজয় রাজী হলেও, একা যেতে কিছুতেই রাজী হল না। শেষে সুজয়কে সঙ্গ দেবার জন্য আমাকেও সঙ্গী হতে রাজী হতে হল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল সেই ফ্ল্যাশগান নিয়েই। সুজয়ের ক্যামেরাটার ফ্ল্যাশগান নাকি মাঝেমধ্যেই কাজ করছে না। শেষে সুজয় ও বিমলের বিশেষ অনুরোধে খুঁতখুঁতে ও সন্দেহবাতিক জয়দেব তার ফ্ল্যাশগানটা দিতে রাজী হলে, সুজয় তার ক্যামেরা নিতে বাড়ি চলে গেল।

বিকাল বেলা জয়দেবের বাড়ি থেকে ফ্ল্যাশগানের সুদৃশ্য প্যাকেটটা নিয়ে সুজয়ের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। সুজয় তৈরী হয়েই ছিল। যাবার আগে তার ক্যামেরায় ফ্লাশগানটা একবার লাগিয়ে দেখে নিতে গিয়ে জানা গেল, ফ্ল্যাশগানের প্যকেটে তারটা নেই। সব ফ্ল্যাশগানেই দেখি একটা সরু তার ফ্ল্যাশের সাথেই লাগানো থাকে, যেটা ক্যামেরায় গুঁজতে হয়। এর আবার তারটা দুদিকেই খোলা যায়। খুঁতখুঁতে জয়দেবের ফ্ল্যাশের তারটা সম্ভবত তার ক্যামেরার সাথেই অবস্থান করছেঅন্য উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে সুজয়ের ফ্ল্যাশ নিয়েই যাওয়া স্থির হল। 

বিমল বিয়ে করতে যাবার আগে তার বাবা আশীর্বাদ করছেন, সুজয় দুদুটো ফটো নিল, কিন্তু একবারও ফ্ল্যাশ কাজ করলো না। এরপর খুব কায়দা করে পালকিতে ওঠার আগে বিমল একবার মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো, সুজয়ও তিন-তিনবার সার্টার টিপলো। কারণ তৃতীয়বারেই শুধু আলো জ্বলেছিল। একটা বাচ্চাছেলে সুজয়কে জিজ্ঞাসা করলো, যে সে রঙ্গীণ ছবি  তুলছে কী না। তাকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, তার বাবা রঙ্গীন ছবি তোলে। সুজয়কে বললাম যে এখানে অন্তত একজন লোক আছে, যে ক্যামেরার ব্যবহার জানে। কাজেই সাবধান হতে হবে। যাহোক, বর পালকি চড়ে এগিয়ে চললো, হ্যাজাকের আলোয় আমরা সবাই তার পিছন পিছন হেঁটে।

সরু মেঠো রাস্তা দিয়ে বিয়ে বাড়ি পৌঁছলে, আমাদের সবাইকে একটা খুব বড় বারান্দায় আপ্যায়ণ করে বসতে দেওয়া হল। সবাইকে চা ও গরম সিঙ্গারা দিয়ে যাওয়া হলেও, সুজয়কে পাত্রীর ভাইবোনের আব্দার মেটাতে চা ফেলে ক্যামেরা কাঁধে যেতেই হল। যাওয়ার আগে ও আমাকে সঙ্গী হিসাবে পেতে চেয়েছিল, কিন্তু ফিরে গিয়ে অফিসে হাসির খোরাক হবার ভয়ে তাকে একাই যেতে বললাম। 
বেশ কিছুক্ষণ পরে গম্ভীর মুখে ফিরে এসে সে জানালো, পাঁচটা ছবির মধ্যে দুবার মাত্র আলো জ্বলেছে। এভাবে চললে তো এখনই ফিল্ম শেষ হয়ে যাবে, তাই সে ফিল্মটা রিওয়াইন্ড করে নিয়েছে। এখানে এসে বিমলের ছবি তুলতে গিয়ে আবার দুটো ফটো নষ্ট হল। আবার রিওয়াইন্ড করতে গিয়ে ফ্লিমটা কিভাবে জড়িয়ে গেল। ক্যামেরা খুলে দেখা গেল ফিল্মটা মুড়ে ভাঁজ হয়ে গেছে। ছবির অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ থাকলেও, বাধ্য হয়ে দাঁত দিয়ে বেশ খানিকটা ফিল্ম ছিঁড়ে, নতুন করে লাগানো হল।
বিশাল ছাদে বিয়ের জায়গাটায় আলোর অভাব হলেও, ফটো তোলার পক্ষে আদর্শ। সুজয় বেশ কয়েকটা ছবিও তুললো, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফ্ল্যাশ কাজ করে নি। সে আমাকে দুএকটা ছবি তুলতে বলে বললো, তুলে দেখ না, যদি তোর হাতে ভাগ্য ফিরে যায়আমি অফিসে মুরগী হবার ভয়ে ক্যামেরা বা সুজয়ের ভাগ্য ফেরাবার ঝুঁকি নিলাম না, কারণ এই ছবি তোলা নিয়ে আমরা আগে দুজনকে খোরাক করেছি।

 এবার খই পোড়ানোর ছবি। বিমল তার নববধুর পিছনে দাঁড়িয়ে, সামনে হাত বাড়িয়ে, দুজনে মিলে আগুনে কুলো করে খই ফেললো। অনেকগুলো ছবির পরে ফ্ল্যাশ জ্বললো বটে, কিন্তু তার আগেই সব খই আগুনে পড়ে গিয়ে দুজনে ফাঁকা কুলো হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
বাসরে আরও অনেকের মাঝে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার হিসাবে সুজয় ঘর আলো করে বসে আছে, পাশে তার সাঁকরেদ হিসাবে আমি। ঘন ঘন ছবি তোলার অনুরোধ আসছে। আলো সমেত, আলো ছাড়া কয়েকটা ছবিও তোলা হয়েছে। সুজয় আবার আমাকে দু-একটা ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করলো। আমি ঐ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে, তাকে হাত দিয়ে ফ্ল্যাশগানের লাইট জ্বেলে আপাতত মান বাঁচিয়ে অবস্থার সামাল দিতে পরামর্শ দিলাম।

কোনমতে রাতটা কাটিয়ে ভোর হতেই আমরা বিদায় নিলাম। সেদিনের সেই ফাঁকা কুলো হাতে বরকনের বিখ্যাত ছবিটা নিয়ে মোট আটটা ছবি উঠেছিল। অফিসে সুজয়ের অবস্থার কথা আর নাই বললাম।



সাঈদা মিমি / দুটি গল্প

কুতুরুন্নেসা বানু এবং ভাকু সদাগর

কুতুরুন্নেসা বানুর হাঁস মুরগিগুলো বড়ই পরিপুষ্ট, তেল চকচকে বছরকাবারী ডিম খেয়ে, বেঁচে, হাতে জমা বেশ ভালোই থাকে এসব তার না করলেও চলে, স্বামী ভাকু সদাগর মস্ত ব্যাবসায়ী, টাকার অভাব নেই তিনজন কাজের মানুষ, গাছপালা ঘেরা বিশাল বাড়ি, দুই ছেলে, সুখ তার অঙ্গে অঙ্গে ভাবতরঙ্গে
সে যখন জন্মেছিলো, তখন ওয়া করে কান্নার পরিবর্তে কোঁ কোঁ শব্দ করে উঠেছিলো, সেই থেকে তার এমন ছন্নছাড়া নাম তারপর বিয়ের পরে পড়লো আজদাহা পরিবারে, পাঁচ দেবর, চার ননদ! কুতুরুন্নেসার কোঁ কোঁ গেলো হাপানীর মত বেড়ে দেবরদের কেউ বিয়ে করে আলাদা হলো, ননদদের বিয়ে হলো সে দুই ছেলের মা হলো এবং ভাকু সদাগর আলাদা বাড়ি কিনে বৌ বাচ্চাদের নিয়ে খুলনা শহরে স্থায়ী হলো
যদিও তার সদাগরী ব্যাবসা, বাড়িতে আসে মাসে দুইবার কুতুরুন্নেসা একাকীত্ব ভুলতে হাঁস-মুরগী, গাছগাছালী নিয়ে ব্যস্ত থাকে, নিয়ম মেনে কাজের মানুষদের সাথে প্রবল চেচামেচি করে, ছেলেদের পিটুনি দেয় এবং সবশেষে কাঠের চেয়ারে বসে কোঁকায়
ভাকু সদাগরের সমান অংশীদার লেকু মুন্সি, খুবই ধূর্ত লোক, ভাকু তাকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে, জানে, লেকু ঠিকই কাজ উঠিয়ে আনবে দুইজনের বন্ধুত্বও মজবুত আর সেই সূত্র ধরেই কিনা লেকু সদাগরের কালিগঞ্জের বাড়িতে ভাকুর যাতায়াত
লেকুর কালোমতন কুশ্রী চেহারার যে বোনটির বিয়ে হয়নি, সে ভাকু সদাগর কে বড়ই যত্নাদি করে ভাকুও ভাবে, আহা রে, কেবল কালো কুচ্ছিত বলে মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না! কে বিয়ে করবে? সে নিজেই কখনও এই জিনিস ঘরে তুলতে রাজি হবে না
তারপর পরের সপ্তাহ এলো, খুলনায় যাওয়া হলো না ভাকুর লেকু অনুনয় করে পড়েছে, 'দোস্ত, আমার সাথে কালিগঞ্জে চল, সাবেরার একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে, যত টাকা লাগুক, এবার ওকে পার করবই মানবিক আবদার, ভাকু গেলো
সবাই রাতের খাবার খাচ্ছে, সাবেরা কে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো লজ্জা নিয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে সে খাওয়া শেষে খানিক গল্প সেরে, পান খেয়ে, শুতে গেলো ভাকু, কামরায় ঢুকে দরজার খিল লাগিয়ে দিলো, ডাসা ও
কুতুরুন্নেসা কে মনে পড়লো তার, আহা, এখন বৌ কে বুকে নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার কথা ছিলো!!! খাটের দিকে এগিয়ে যেতেই ভাকুর ওপর ঝাপিয়ে পড়লো সাবেরা... 'না, না, আপনে আমার এত বড় সর্বনাশ কইরেন না...!! কোনমতে দরজা খুলে বের হয়ে আসতেই চোখ কপালে উঠলো ভাকুর দরজার সামনে লেকু, তার বাবা-মা, ভাইয়েরা বউসহ, তিন বোন এবং বোনের জামাইয়েরা এতক্ষণে সবকিছু পরিস্কার হয়ে উঠলো ভাকুর কাছে কাজিসায়েব এলেন, পাড়াপ্রতিবেশীরা এলো, ভাকু বর সাজলো
সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেকক্ষণ ছেলেদের পড়াতে বসে মন দিতে পারছে না কুতুরুন্নেসা তার বুকের মধ্যে কেবলই কুকপক্ষী ডেকে যাচ্ছে

একটি পেশেন্ট বেডের আত্মকাহিনী

নিন, শুয়ে পড়ুন, আমি হাতুড়ি দিয়ে আস্তে টোকা দেবো, যেখানে ব্যথা প্রবল অনুভূত হবে, সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন ডাক্তার সাহেব কাজে লেগে পড়লেন, পেশেন্ট কিঞ্চিত আতংকিত সন্দেহ করা যাচ্ছে রোগী কয়েকবার বাতজ্বরে ভুগেছিলো
রোগাভোগা যে দুজন এলো, একজন তরুণ, আরেকজন যুবক কেবল রোগাই নয়, মুখের পেশিতে ঝুলে পড়া দাগ, কোটরাগত লাল চোখ, চারপাশে শিরা জেগে আছে, এরা দুই ভাই সারাদিন কারখানায় কাজ করে, রাতে বাসায় ফিরে রান্না - খাওয়াl এরপর তারা মরার মত ঘুমায় না, কারণটা বড় লজ্জার নারীবর্জিত জীবন কিসব প্রয়োজনে দুইজন সমকামী হয়ে গেছে এই সমস্যার সমাধান আমার কর্ম নয় ডাক্তার সাহেব পেশেন্ট বেডে এদের চেকাপ করে সমাধান দেবেন
এক তরুণী এসেছিলো তার স্বামীকে নিয়ে, সে গর্ভপাত করাতে চায়, ডাক্তার সাহেব যেন শারীরিক দূর্বলতা সহ আরও কারণ দেখিয়ে একটা কাগজ লিখে দেন! হতভম্ভ ডাক্তার ব্যাপারটা বুঝে ওঠার পর হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, এটা গাইনির সমস্যা, আর আপনারা এসেছেন মেডিসিনের ডাক্তারের কাছে! দম্পতির বিবিধ-বিচিত্র কান্না শুনে তিনি একজন গাইনি ডাক্তারের নাম লিখে কাগজটা ধরিয়ে দেন ওদের কৃতজ্ঞতাবশত স্বামীটি একটি তথ্য দিয়ে যায়, তারা মূলত স্বামী স্ত্রী নয়, ঢাকা শহরে সিংগেল বাসা না পেয়ে দুইজন একত্রে থাকে দম্পতি পরিচয়ে একই কারখানায় কাজ করে তাই সখ্যতা একটু বাড়াবাড়ি রকমের নেক্সট বেলে চাপ দেয়ার আগে ডাক্তার মশায় খানিক ভাবুক হয়ে পড়েন, আহা, কি সমৃদ্ধ জীবন ওদের!!
বুড়ি মানুষটা এসে সোজা পেশেন্ট বেডে সটান, -আপনার সমস্যা তো বলেন আগে? -কোন সমস্যা নাই বাজানl বুড়া মানুষ, দুইমাইল হাইট্টা জিরানের যাগা পাইনাই আমনের সামনের ঘরে বইয়া এট্টু ঝিমাইছি, এইহানে কাইত হইয়া আরাম লাগতাছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ডাক্তার চেয়ারে বসে পড়েন এমন হলে তিনি ডাক্তারী ভুলে যাবেন, রোজগারপাতি শেষ
আজ অনেক রোগী ছিলো রাত নয়টা পর্যন্ত কোন অবকাশ মেলেনি ফাতরা লোকের আনাগোনা ছিলো না অষুধ কোম্পানী আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকেও লোক এসেছিলো পকেট এখন ঝলমল করছে এতক্ষণে ক্লান্তিটা টের পাওয়া গেলো, বাসায় ফেরার আগে পেশেন্ট বেডে শুয়ে পড়লো সে, একটু জিরিয়ে নেয়া যাক চোখটা মুদে এলে আজকের তরুণী পেশেন্টের কথা মনে পড়লো, কানে না শুনলেও চোখের ভাষা সে ভালোই বোঝে

[ বিঃ দ্রঃ ডাক্তারদের নীচু করার জন্য এই লেখা নয় আমাদের শহরে প্যারামেডিক পাশ একজন ছিলেনl সবাই তাকে ডাকতো ডকরছাব তার কথা মনে করে অথবা তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ]