আপন
অঙ্কুর
[ গত সংখ্যার শেষাংশ ]
প র্ব – ৩
দেখতে দেখতে দুমাস কেটে
গেছে, রীনা এখন বাড়িতে বসে আঁকা – গান শিখিয়ে কিছু আয়ের চেষ্টা করছে। এভাবেই চলতে
চলতে প্রায় বছর শেষ হতে চলল। রাতুল ফোন করেনি বাড়িতে একবারও। শেষে তৃষ্ণাদেবী
নিজেই ফোন করলেন। ওপাশে কোন মেয়ের গলা। তৃষ্ণাদেবী সোজাসুজি বললেন, রাতুলকে ফোন দাও। একটু পরেই
ছেলের গলা শোনা গেল – হ্যালো।
কেমন আছিস?
ভালো, তোমরা?
খুব ভালো। যাদের তোমার মতো
হীরের টুকরো ছেলে থাকে, তারা ভালো না থেকে পারে!
দেখ মা, জীবনটা আমার, আমাকেই
সিদ্ধান্ত নিতে দাও। তাছাড়া তোমাদের সাথে তো আর সম্পর্ক পাল্টাচ্ছে না। যাই হোক,
সামনের বছর তোমাদেরকে এখানে বেড়াতে নিয়ে আসব। দেখবে কি সুন্দর জায়গা। লিজা ও কি
সুন্দর মেয়ে। ও হো, লিজার কথা তো তোমাদের বলাই হয় নি। ও হোল ............
আমাদের মরা পর্যন্ত অপেক্ষা
করতে পারলি না? এই বুড়ো বয়সে ...............
আমি রাখছি। পরে কথা হবে।
তৃষ্ণাদেবী ফোন নামিয়ে
রেখে সোফায় এসে বসলেন স্থির হয়ে। মৃগাঙ্কবাবু স্ত্রীর হাতে হাত রেখে বললেন – কেঁদো
না। ও এখন মানুষ হয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা – মার কথা মনে রাখবে কেন?
বাচ্চা যতদিন না হাঁটতে শিখছে, ততদিনই সে বাবা – মায়ের। হাঁটতে শিখলেই সে নিজের রাস্তা
ধরে চলে যায় বহুদূরে, আর পিছনে রেখে যায় দুশ্চিন্তা।
অনেক বছর পর আজ সকালে
হাঁটতে বেড়লেন নিঃসঙ্গ তৃষ্ণাদেবী। পরিষ্কার আকাশ, হাল্কা হাওয়া, রাস্তার ধারে
বাড়ির প্রাচির ডিঙিয়ে ফুলে ভরা ডাল ঝুলে পড়েছে পথিকদের দিকে। দেখতে দেখতে হেঁটে
চললেন, কি শান্তি! ঘরে ফিরতে মন চায় না। মৃগাঙ্কবাবুর কথা খুব মনে পড়ছে। আবার
রাতুলের কথাও মনে পড়ল। যেদিন নিজের শরীরের সাথে জুড়ে গেছিল, সেদিন কি আনন্দই না
পেয়েছিলেন। ওদের সন্তান, তৃষ্ণা – মৃগাঙ্কের সন্তান। সেদিন শপথ করেছিলেন, যত কষ্টই
হোক ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করবেন। তা করেও ছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিসয় হল, ছেলে
দায়িত্ব – কর্তব্য ভুলে গেলেও অধিকারটা ভোলে নি। এখন মনে হচ্ছে ছেলের প্রতি কিছুটা
কম দায়িত্ব পালন করলে আজ হয়তো সে বাবা – মায়ের প্রতি কিছুটা দায়িত্ব পালন করত।
রোদ মাথায় নাচছে, আস্তে
আস্তে বাড়ির পথ নিলেন। ইতিমধ্যেই লক্ষ্মী দুবার এসে ফিরে গেছে। এবারে এসে দেখে
তৃষ্ণাদেবী দরজার সামনেই মোরা নিয়ে বসে আছেন। লক্ষ্মী দুমদুম করে পা ফেলে চাতালে
বাসনগুলো ঝনাৎ করে ফেলল। দুবার তৃষ্ণাদেবীর দিকে তাকিয়ে হাতে মোটা করে সাবান লাগিয়ে
নিয়ে অভিমানের সুরে বলল – সত্যি বাবা, আর পারি নে। দু – দুবার এইসে ঘুইরে গেলুম।
কোতায় গেছলে? নক্কির কি আর কাজ নেই? এইবারে তোমার একানেই থাইকতে হবে মনে হচ্ছে।
দোর আগলে বসলে ক্যানে? ভিতরে যাও।
আমার শরীরটা ভালো নেই রে
লক্ষ্মী।
ও মা, সে কি গো! রীনাদিদিকে
ডাকব?
না না, একটু হাওয়ায় বসি
ঠিক হয়ে যাবে।
ফোন বাজছে, তৃষ্ণাদেবী
দেওয়াল ধরে ধরে বসার ঘরে ঢুকলেন।
হ্যালো।
নমস্কার মা, আমি আপনার বৌমা
বলছি।
বৌমা! কোথা থেকে?
আমেরিকা থেকে।
আমেরিকা থেকে?
আপনার নাতি আপনাকে দেখার
জন্য পাগল হয়ে গেছে।
ও তো আমাকে চেনেই না!
আমরা গল্প করি তো, রোজদিন।
তুমিও?
মানে, আপনার ছেলে।
তিন বছর হবে এই মাসের ১২
তারিখে।
তোমার বাড়ি কোথায়?
আপনাদের পাড়ার দুটো পাড়া
পরেই।
কোথায় বলতো? তোমার নাম কি?
আমার নাম শুভ্রা। আমি আর
রাতুল ছোটবেলা থেকে একই স্কুলে পড়েছি। আমার এক মামা আমেরিকাতেই থাকেন। আমি চাকরি পেয়ে
মামার বাড়িতে থাকতে শুরু করি, তখনই ঘটনাচক্রে অফিসের কাজে আমাদের দুজনের দেখা হয়ে
যায়। মা, আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাই।
যখন ইচ্ছা হবে, চলে আসবে।
রোজ রোজ ফোন করে জিজ্ঞাসা করতে হবে না। এখন রাখছি।
মনে হল পাটা একটু
টলকালো, আজকাল আর শরীরটা সায় দেয় না মনের সাথে। ফ্যানটা জোরে চালিয়ে সোফার উপর
শরীরটা মেলে দিলেন। লক্ষ্মী জল খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল – কি হোল ঠাগমা,
শরীল কি বেশী খারাব? ডাক্তার ডাগব?
তৃষ্ণাদেবী – দরকার
নেই, তুই একটু রীনাকে ডাকতে পারবি?
লক্ষ্মী – ফোন করি
ডাগব?
তৃষ্ণাদেবী – হ্যাঁ,
তাই ডাক। এক কাজ কর, দাক্তারকেও একটু ফোন করে দে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রীনা
এসে দেখল দাক্তারবাবু ওনার প্রেসার চেক করছেন। রীনাকে দেখামাত্র তৃষ্ণাদেবী
ব্যাস্ত হয়ে বললেন, তেমন কিছু নয়, প্রেসারটা একটু বেড়েছে। চিন্তার কিছু নেই, তুই
বস। রীনা টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা ওলট পালট করে দেখতে লাগল। ততক্ষণে ডাক্তার চলে
যেতে তৃষ্ণাদেবী রীনাকে পাশে ডেকে নিলেন। আজকে বেশ ক্লান্ত লাগছে দেখতে দুজনকেই।
রীনার হাতটা ধরে তৃষ্ণাদেবী অনুরোধের সুরে বললেন, পাড়ার উকিলবাবুকে একটু ডেকে আনতে
পারবি? রীনা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, কেন পারব না। কবে আনতে হবে, বল? তৃষ্ণাদেবী
ব্যাস্ত হয়ে বললেন, এক্ষুনি ডাক, আর সময় নষ্ট করা যাবে না। রীনা একটু চিন্তিত সুরে
জিজ্ঞাসা করল, একথা কেন বলছ? তৃষ্ণাদেবী হেসে বললেন, সময় হলে বুঝতে পারবি। এখন যা,
যা বললাম তাই কর।
রীনা চলে যেতে লক্ষ্মী
ওষুধ নিয়ে ফিরে এল। তৃষ্ণাদেবীকে বিশ্রাম নিতে দেখে আর বিরক্ত না করে সোজা
রান্নাঘরে গিয়ে জলখাবার আর ওষুধ নিয়ে এসে ডেকে তুলল। তৃষ্ণাদেবীর আপত্তি সত্বেও
জোর করে খাবার আর ওষুধ খাইয়ে দিল। ইতিমধ্যে উকিলমশাইও উপস্থিত হলেন। তৃষ্ণাদেবী
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে হাতের থালা লক্ষ্মীর হাতে দিয়ে ওনাকে বললেন – আপনি একটু
বসুন, আমি আসছি। উকিলবাবু সোফায় বসতেই লক্ষ্মী বলল – চা খাবেন তো, নিয়ে আসছি।
উকিল – অবশ্যই খাব, তবে
চিনি ছাড়া।
তৃষ্ণাদেবী - আমার জন্যও আনিস।
উকিল – কি ব্যাপার
বৌঠান এত জরুরি তলব কেন?
তৃষ্ণাদেবী – শরীরকে
বিশ্বাস কি, কখন বিগরে যায়। তাই ভাবলাম একটা উইল করে রাখি।
উকিল – সে তো ভালোই,
তবে আপনার তো একমাত্রই ছেলে।
তৃষ্ণাদেবী – ছেলে
ছাড়াও আরও কিছু মানুষের গুরুত্ব আছে আমার জীবনে।
উকিল – বেশ তো, আপনি
বলুন, আমি সব তৈরি করে দেব।
তৃষ্ণাদেবী তার
সম্পত্তির ভাগাভাগি করে দিয়ে শেষে অনুরোধ করলেন, উইলের একটা কপি যেন অবশ্যই রীনাকে
দেওয়া হয়। উকিলবাবু উঠে যাওয়ার আগে বলে গেলেন – আপনি কিছু চিন্তা করবেন না, আমি যত
তাড়াতাড়ি সম্ভব তৈরি করে পাঠিয়ে দেব।
প র্ব – ৪
আজ মহাঅষ্টমী। ছেলে –
বৌমা আর নাতি তৃষ্ণাদেবীর ঘর আলো করে রয়েছে। বহু পুরনো রাগ, দুঃখ নিমেষের মধ্যে
আবছা হয়ে গেছে। হালকা অভিমান ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের আনাচে কানাচে, তা বোধহয় ভালবাসারই
আরেক নাম। সারাদিনের হাসি, ঠাট্টা, ক্লান্তির পর খাবার টেবিলে হঠাৎই রাতুল বলে উঠল
– মা, টাকার ব্যাবস্থাটা হয়ে গেলে ভালো হত। এমনিও তো শুধু শুধু ব্যাঙ্কে পড়ে আছে
.........।
তৃষ্ণাদেবী – আমি তো
এখনও বেঁচে আছি, তাছাড়া রীনার প্রতিও তো আমার একটা কর্তব্য আছে।
রাতুল – রীনা! ও কোথা
থেকে এল আমাদের মধ্যে?
তৃষ্ণাদেবী – কথা বাড়িও
না, খাওয়া শেষ হলে ঘুমাতে যাও।
রাতুল উত্তেজিত হয়ে
প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করল – না, আমাকে জানতেই হবে, কেন ও আমাদের পরিবারের মাঝখানে
আসছে।
তৃষ্ণাদেবী – তুমি হয়তো
ভুলে গেছ যে, একদিন ওকে তুমি ঠকিয়েছিলে। তারই প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে হবে।
আর কোন কথা হয় নি,
খাওয়াও শেষ হয় নি, যে যার নিজের ঘরে উঠে চলে গেছে।
সকালে লক্ষ্মী কাজে এসে
তৃষ্ণাদেবীকে দেখতে না পেয়ে সোজা ওনার ঘরে ঢুকে গেল। অনেক ডাকাডাকির পরেও কোন সাড়া
না পাওয়ায় লক্ষ্মী সোজা দৌড়ল রীনাদের বাড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়ার লোক জড়ো হয়ে
গেল বাড়ির সামনে। এরপরে পুলিশের ভ্যান।
সবার সাথে কথা বলার পর
পুলিশ এই সিদ্ধান্তে আসে যে, মৃত্যুটি সন্দেহজনক। বডি পোস্টমর্টমে পাঠিয়ে রাতুল আর
তার স্ত্রীকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। আবার আর একবার রীনাকে লজ্জায় পড়তে হল সকলের
সামনে পুরনো সম্পর্কের রেশ ধরে। না চাইলেও মানুষের জীবনে অতীত ঘুরেফিরে মুখোমুখি
দাঁড়ায়। একটা দীর্ঘশ্বাস পাক খেতে খেতে বেড়িয়ে আসল মনের অনেক গভীর অন্ধকার থেকে।
আবছা হয়ে আসা স্মৃতিগুলো পায়ে মাড়িয়ে রীনা এগিয়ে চলল সামনের দিকে।।