এই সংখ্যার লেখকসূচি – সৌরেন চট্টোপাধ্যায়, ঝর্ণা
চট্টোপাধ্যায়, সুবীর কুমার রায়, তাপসকিরণ রায়, দোলনচাঁপা ধর, সীমা ব্যানার্জী রায়,
মনোজিৎ কুমার দাস, আবু রাসেদ পলাশ, দেবাশিস কোনার
গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫
ঝর্না চট্টোপাধ্যায়
শালা...হারামখোর!’ রাগে,
ঘেন্নায় মাটিতে থুক্ করে একদলা থুতু ছড়িয়ে আবার তেড়ে যায় বাবুলাল। নানকী অবাক
হয়ে দেখছে তার মরদকে। নয় নয় করেও পাঁচ সাল শাদী হয়েছে তার, ঘর করছে সে এই মানুষটার সাথে। তারও কিছু আগে থেকে আগে মেলামেশা, জানা-চিনা । সেই
পুরানো বাজারে রেললাইনের ধারে যখন সবজির ব্যবসা করত নানকী, তখন থেকে।
কিন্তু এতদিন ধরে দেখছে বাবুলালকে, এত
রাগতে দেখেনি। মাঝে মাঝে নানকীর উপর চড়াও যে হয়না তা নয়। দারু খুব একটা খায় না,
খেলে জ্ঞান থাকে না বাবুলালের। পয়সা না থাকলে নানকীর যা আছে দু/এক টুকরো রুপো, সব বেচে দিতে চায়,
দিয়েওছে। লোক খুব ভালো নয়, কিন্তু
বাবুলাল তার আদমী আছে, সে কি তাকে ছেড়ে চলে যাবে, থাকতেই হবে তাকে! হায় রাম! এই মানুষটা এমনি হইয়ে গেলো কি করে? কেউ কি গুণ কোরলো!
ভয়ে
ভয়ে দু-হাত এগিয়ে এসে বাবুলালের হাতটা ধরতে যায় নানকী। উদ্দেশ্য,
ঘরে নিয়ে গিয়ে চারপাইয়ে শুইয়ে দেওয়া। মাথা ঠান্ডা হোবে, তারপর খেতে দিবে।
কালকের বাসি রোটি আছে, পাঁচখানা। তাদের
ঘরে ঘি তো নেই, কিন্তু তেল দিয়ে ভেজে রেখেছে সে। আর আলু
চোখা ভাজা আছে, লঙ্কা আর পিঁয়াজ আছে, আর কি চাই! খুশি হবে বাবুলাল। কিন্তু কোথাকার কে এক সুরজলাল সাত সকালেই এসে মাথা গরম করে দিয়েছে। লোকটাকে কোনদিন দেখেছে বলে
মনে করতে পারছে না
নানকী। এই তো কদিন আগেই পরব গেল, বাবুলালের
যত ইয়ার-বন্ধুর দল
সব এসেছিল লেকিন সে সুরজকে দেখেনি । সেদিন মুরগা, রোটি
আর দারু, যত খুশী। বাপ্ রে বাপ্! কি দারু খেতেই পারে
সবাই। বাবুলালও খেয়েছিল।
নেশাভাং খুব একটা করে না
বাবুলাল, করলে মাথার ঠিক থাকে না। সেদিন
নেশায় চুর হয়েছিল বাবুলাল।
এক
ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দেয় বাবুলাল।
তারপর হন্হন্ করে এগিয়ে যায় সুরজলালের দিকে। সুরজও বাবুলালকে ভয় পাচ্ছে
এখন। বছর তিনেক আগে শাদী করবে বলে সুরজ
বাবুলালের কাছে দু-হাজার
টাকা নিয়েছিল। কাম করে শোধ দেবে, তেমনই কথা ছিল।
সেই টাকার জন্যই আজকে বাবুলাল সুরজকে ডেকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সুরজ বেমালুম অস্বীকার করে দিতে। তার
বক্তব্য সে নয়,
বাবুলালই তার কাছ থেকে রুপেয়া নিয়েছিল। তিন সাল আগে তার যখন শাদী
হল, তখন
বাবুলাল রুপেয়া নিয়েছিল। সুরজ টাকা দিতে নারাজ। বাবুলালের টাকা
সে কেন দেবে, তারই তো পাওয়া উচিত। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি, রাগারাগি, শেষে গালিগালাজ...এবার বুঝি মারামারি না শুরু হয়!
সুরজলাল
লোকটা তাগড়াই জোয়ান আছে, তার মরদকে উপর থেকে নিচে
তুলে ফেলে দিতে পারে। একবার
বাবুলাল, একবার সুরজের দিকে চাইল নানকী, তারপর কি ভেবে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। বিছানার তলায় একেবারে এক কোণে তার
এক পায়ের রুপোর মল ছিল। বিছানা
আবার কি! একটা পাতলা
কাঁথার উপর একটা ছেঁড়া চাদর পাতা, ওহ ভি
চাটাই কি উপর! একটা আগেই গেছে, বাবুলালই বেচে দিয়েছে।
পাছে এটাও যায়, মলটা নিয়ে সে তার কোমরের খাঁজে কাপড়ের
মধ্যে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখল। কোন বিশ্বাস নেই। এদের এই ঝগড়া, এই
মারামারি, তারপর একসঙ্গে দারু চলবে। তখন পয়সা না থাকলে এটাই বেচে
দেবে। আছেটাই বা কি! যা দু/একটা লোকের বাড়ি কাম করে নানকী করেছিল, সব বেচে দিতে হয়েছে। এখন কাম ভি নাই, বাবুলাল
দিবে না কাম করতে। লেকিন পয়সার দরকার হোবে, তো নানকীর
জেবর বেচবে। মনে মনে
গালাগাল দিল নানকী। বাবুলাল ভি খারাব আদমী আছে, বহুত খারাব,
কিন্তু মুখে কিছু বলল না। এটা সে দেবে না, কিছুতেই না। বাইরে এসে দেখল সুরজ একদিকে দাঁড়িয়ে আছে আর বাবুলাল যা
মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছে তাকে। সুরজ জোর গলায় কিছু বলতে গিয়েছিল,
বাবুলাল আরো জোরে গালাগাল শুরু করল। এই খেল কতক্ষণ চলবে সে জানে
না, নানকী ঘরের দোর গোড়ায় বসে পড়ল।
(২)
সন্ধ্যেবেলায়
ঘরের সামনে একটা পুরনো বটগাছের নিচে চারপাই মেলে শুয়ে ছিল বাবুলাল। মহল্লাতে এই
একটাই বড় গাছ আছে, বহুতদিনের পুরানা।
সন্ধ্যেবেলায় গরমের দিনে এখানে অনেকগুলো চারপাই পড়ে। মরদরা এখানেই শোয়। সারাদিন
গরমের হলকা বয়ে যাবার পর সন্ধ্যেটা এখানে বসে থাকতে আরাম লাগে। ফুরফুরে বাতাস দেয়।
ঘরের বাইরে মরদরা শুয়ে থাকে, গল্প ভি করে। মেয়েরাও ঘরের
দরজায় বসে এর-তার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করে, ঘর-গেরস্থালির
কথা বলে, বাচ্চা সামলায়। খানিক রাত পর্য্যন্ত এখানে থেকে
মেয়েগুলো ভিতরে শুতে যায়, কারো বাচ্চা কাঁদে তো কারো ঘরে
বড় জোয়ান বিটি আছে। মায়েরা বাইরে থাকে না। কয়েকটা বুড়ো-বুড়ী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মরদগুলার
আশে পাশে এদিক-ওদিক শুয়ে থাকে। লেকিন যেদিন খুব জোরসে দারু, খানা-পিনা হয় সেদিন তারাও থাকে না। দারুর নেশায় সেদিন মরদরা কি যে বলে
আর কি যে করে ! আবার সুবহ সে সব ঠিকঠাক, মালুম ভি হোবে না
কি কাল এইসা ভি হোয়েছিল।
সকাল
থেকে বাবুলালের মুখে রা নেই, গুম মেরে আছে,
রাগে ফুঁসছে। সেই যে সাতসকালে সুরযের সঙ্গে রাগারাগি, ঝগড়া হয়েছে, তারপর থেকে যেন একেবারে অন্য মানুষ। কি যেন ভাবছে...ভেবেই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে উঠে বসে কিছু একটা
হিসাব করছে আবার শুয়ে পড়ছে। দুপুরে কোনরকমে পাঁচটা রোটির মধ্যে দুটো রোটি চিবিয়েছিল
একটা লঙ্কা আর একটুকরো পেঁয়াজ দিয়ে আর এক লোটা পানি, ব্যস ! তারপর বাকি খানা থালা সুদ্ধ নানকীর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। পানি ভি
না দেখল, গন্ধা আছে, কি সাফা
আছে। নানকী রোটি খাবে কি খাবে না ভেবে খেয়েই নিল, খিদেও
পেয়েছিল খুব। রাতে খানা বনাবে, গরম গরম চাউল, ঔর পোড়া মরিচ দিয়ে আলুভাতে। কিন্তু বাবুলাল খাবে তো, বাপ রে...যা মিজাজ !
ঘরের
দোরগোড়ায় বসেছিল নানকী।
টুকটাক কথা বলছিল আরো পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে। হঠাৎ চারপাই ছেড়ে ঘরের
মধ্যে ঢুকে বাবুলাল এক হ্যাঁচকায় টান মারে নানকীকে। টাল সামলে কোনরকমে উঠে দাঁড়ায়
নানকী। অবাক হয়ে গেছে সে। এ আবার কি! সারাদিনের পর এখন কি তার পেয়ার উথলে উঠল নাকি,
তাও আবার সন্ধ্যাবেলায়! তার আদমীর কি মাথা খারাপ হল নাকি? বাবুলালের
মুখের দিকে চেয়ে রইল সে। কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল বাবুলাল---
শা...,নাচনেওয়ালী ...বহ পায়ল
কিধার, নিকাল...নিকাল জলদি, নহী
তো লাগাউঁ এক ঝপ্পড়...! চল্...নিকাল...অভি নিকাল’
এবার
বুঝল নানকী। তার এক পায়ের মলের খোঁজ পড়েছে। সারাদিন ধরে তাহলে সেটা খুঁজেছে
বাবুলাল, পায়নি। তাই এখন আরো মেজাজ চড়েছে। কিন্তু কেন
দেবে সে? তার জিনিস হাতছাড়া করবে না কিছুতেই...। বেওফুক,
বেইমান মরদ! যা ছিল সব একে একে বেচেছে। কাম করবে, ফির ভি গিরভি রাখবে সব। দুবেলা ঠিকমত ভাত দিতে পারে না। তাই না আগের বৌ ভেগে ছিল, নানকীকে
দুসরা সাদী করল! হ্যাঁ, নানকী বাবুলালের দুসরা বউ আছে ।
আরো কিছু মনে মনে ভাবছিল নানকী, কিন্তু বাবুলাল চাপা গলায়
হিসহিস করে----উ আমার চাই...অভি নিকাল, নহী তো চির কে রখ
দুঙ্গা...নিকাল...’ একটা
জঘন্য গালি দেয় বাবুলাল।
--উ
আমার আছে, কেনো দিব?’--নানকী
মুখের উপর বলে, কিন্তু গলা জোরে নয়, ধীরে। জানে গলা তুললে বাবুলাল মেরেই ফেলবে তাকে। তার ভয় করছে এখন
বাবুলালকে।
--এক
ঝপ্পড়...তুর আছে? কে দিল তুকে, চল্ নিকাল...তুরন্ত নিকাল...’
--ওহ,
সুরজ কি গুণ করল নাকি? ইত্না
গুসসা...আগে তো কভি...’কথা শেষ হবার আগেই এক ঝটকা
নানকীকে। একটা হাত পিছনে টেনে নিয়ে দুমড়ে দেয় বাবুলাল। যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে নানকী।
-
উ তুর আছে... বেইমান, উ হামার জরুর আছে,
আমি দিইছি তুকে... বহ মুংলির আছে, মুংলি
মেরা জরু...তুঝে ক্যায়া...নিকাল, নহি তো জিন্দা গাড়
দুঙ্গা...’ প্রায়
ঠেলে মাটিতে ফেলে দেয় নানকীকে বাবুলাল।
--আমি
কি করে জানব কুথায় আছে--জেদের বশে বলে নানকী। ‘ হামি কি জরু নাই আছি?
খালি মুংলিই তুমার জরু আছে, তো ভাগল
কেনো...জরু আছে...হুঃ ’ এতগুলো কথা বলে হাঁপায় নানকী।
--চল্
সাঙা করছি তুকে, মুংলি জরু আছে হামার...’ বলে বাবুলাল। ‘আমি জরু আছি... ‘ নানকীর গলা নকল করে মুখ ভ্যাঙ্গায় বাবুলাল। চোখে জল আসে নানকীর।
হায়, কোথায় যাবে সে! আজ পাঁচ সাল বাদ মুংলি, যে ভেগে গেছে, সে জরু আছে আর নানকী সাঙা করা মেয়েছেলে
! সে কি...র...আছে, বাবুলালের কাছে থাকে, তাকে কি সাদী করে নি নিয়ে আসেনি বাবুলাল। এতো বড় কথা বাবুলালের মুখে!
ঘেন্না হল নানকীর। সুরজ ঠিক কথাই বলেছিল,
সুরজের টাকা মেরে দিয়েছে বাবুলাল। ধোঁকেবাজ...! কোমরের খাঁজ থেকে
পায়ের মলটা বার করে জোরে বাবুলালের মুখে ছুঁড়ে মারে সে। হয়ত জোরেই লেগেছিল
বাবুলালের। চীৎকার করে উঠল বাবুলাল।
--লে
যা...জরু কি গুলাম ! নানকী তেরা
জরু নহী তো নানকী তেরা রখেল ভি নহী। ভির কভি মুহ মত্ দিখানা ...বেইমান মরদ...জানওয়ার কঁহি কি!’ বলে মাটিতে থুঃ করে থুতু
ছিটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায় নানকী।
বাবুলাল
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে...দুস্রা মে ইত্না জোর..., তো জরু কৌন ?
সুবীর কুমার রায়
জমিদারী
প্রথা অনেকদিন আগেই বিলুপ্ত হলেও চৌধুরীদের তিনশ’ বছরের বিশাল বাড়িটা আজও মাথা
তুলে অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষ বহণ করছে। বংশানুক্রমে শরিকের সংখ্যা বেড়েছে, তার সাথে
বেড়েছে বাড়ির বাসিন্দার সংখ্যা ও ছোট ছোট ঘরের সংখ্যা। যদিও অন্যের সুবিধা-অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখা
তো দুরের কথা, কেউ কারো খোঁজও রাখেন না। অতিবৃদ্ধ, বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, যুবক, কিশোর ও
শিশু মিলিয়ে চার পুরুষের বাস। আয়োজনে খামতি দেখা দিলেও এখনও সাবেকী ঐতিহ্য
রক্ষার্থে বাড়ির জীর্ণ শিবমন্দিরে প্রতি সোমবার পুরোহিত এসে দায়সারা পূজা করে যান।
রুটিন মাফিক এক এক মাসে এক-একজন শরিকের ওপর শিবলিঙ্গ পূজার ভার পড়ে। অন্য শরিকরা
সেই মাসে শিবের বা পুরোহিতের সুবিধা অসুবিধার ব্যাপারে কোন খোঁজখবর রাখেন না।
রাখার প্রয়োজনও বোধ করেন না। তবে এখন পর্যন্ত প্রতিবছর পুরাতন ঐতিহ্য মেনে, বাড়িতে
দূর্গাপূজা হয়। পূজার চার-পাঁচটা দিন বাড়ির সবাই কোন মন্ত্রবলে কে জানে, একে অপরের
সাথে রক্তের টান অনুভব করেন, একত্রিত হয়ে পূজার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
দরিদ্র
পূজারী ব্রাহ্মণ, সাতকড়ি চক্রবর্তী এই বাড়ির সব পূজা করেন। সবাই জানে এই চক্কোত্তী
বামুনের বিদ্যে চালকলা পর্যন্ত। তবু তিনিই এই বাড়ির কুলপুরোহিত, কারণ কথিত আছে
সাতকড়ি চক্রবর্তীর অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ, এককড়ি চক্রবর্তীর আমল থেকে বংশানুক্রমে
তাঁরাই এই বাড়ির পূজাপার্বন, জন্ম, মৃত্যু, উপনয়ন, বিবাহের কাজ, দায়িত্ব নিয়ে
সুসম্পন্ন করে আসছেন। আমার উপনয়নও এই চক্কোত্তী বামুনই দিয়েছিলেন। অবশ্য এই হত
দরিদ্র ব্রাহ্মণটিকে দিয়ে পূজা বা অন্যান্য কাজ করানোর পিছনে আরও একটি কারণ আছে।
ইনি অহেতুক ফর্দের বহর বাড়ান না, চাহিদাও বিশেষ কিছু নেই। যাই দেওয়া হোক, ইনি
তাতেই খুশী, তাই বোধহয় পুরোহিত মশাই সম্বধনটুকুও তাঁর কপালে জোটে নি। এ হেন
কুলপুরোহিতটির খোঁজখবর কিন্তু কেউ রাখেন না, এমন কী তিনি কোথায় থাকেন, বাড়িতে তাঁর
আর কে কে আছে, এ বাড়ির কেউ জানেন না। হয়তো ধমনীতে জমিদারী রক্ত বওয়ায়, গরীব চালকলা
বিদ্যের পুরোহিতটির খোঁজখবর রাখার প্রয়োজন অনুভব করেন না।
গতবছর
দূর্গাপূজার আগে চক্কোত্তী বামুন যথারীতি এসে পূজার ফর্দ দিয়ে গেলেন। পঞ্চমী থেকে
নবমী, বাড়িতে বিরাট হৈ চৈ। একসাথে পূজার কাজ, দু’বেলা পাত পেড়ে খাওয়া, এমন কী
রাতেও নিজের ঘর পরের ঘর বলে কোন ভেদাভেদ রইলো না। যে যেখানে পারলো গড়িয়ে নিয়ে
রাতটা কাটালো। দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের পর গোটা বাড়িতে শ্মশানের নীরবতা।
পরদিন
চক্কোত্তী বামুনের সাথে তাঁর বাড়ি যাওয়ার জন্য আমি বায়না শুরু করলাম। গরীব
ব্রাহ্মণের বাড়িতে আমার থাকাখাওয়ার কষ্ট হবে, পড়াশোনার ক্ষতি হবে, সর্বপরি গৃহশিক্ষক
এসে ফিরে যাবেন, এইসব নানা কারণ, প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো। চক্কোত্তী বামুন
সকলকে আশ্বস্ত করে বললেন, “কোন অসুবিধা হবে না, আমি লক্ষ্য রাখবো”। আমার বয়স এখন
তিরাশি, আজ থেকে প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে, তখন আমি মোটেই ছেলেমানুষ ছিলাম না, তবু
বাড়ির অভিভাবকদের রাজী করাতে অনেক সময় গেল। শেষে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে দুপুরের
দিকে চক্কোত্তী বামুনের সাথে তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
আমাদের
বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা রেলওয়ে স্টেশন পার হয়ে আমরা নামলাম। চক্কোত্তী বামুন জানালেন
আগে তার পূর্বপুরুষদের, আমাদের বাড়ি আসার জন্য এই পথটা হেঁটে অথবা গরুর গাড়িতে
আসতে হ’ত। যদিও আজ এত বছর পরে এত উন্নতির
পরেও স্টেশন থেকে হেঁটে ও ভ্যান রিক্সায় অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে, সন্ধ্যার দিকে আমরা তালডুংড়ি গ্রামে এসে
পৌঁছলাম। চারিদিক আম কাঁঠলের গাছে ঘেরা একটা বড় বাগান পার হয়ে, কিছুটা পথ গিয়ে
একটা মাটির দোতলা ছোট্ট বাড়ি। আমরা আসবো এদের জানার কথা নয়, তাই ঝকঝকে উঠোন দেখে
বোঝা গেল এরা আমাদের থেকে অনেক বেশী পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। চক্কোত্তী বামুনের হাঁকডাকে
ও পায়ের আওয়াজে দু’তিনজন মহিলা বেরিয়ে এলেন। চক্কোত্তী বামুন আমাদের পরিচয় দিয়ে
ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিছানা পাতা একটা চৌকিতে বসালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক
বৃদ্ধা ঘটি করে জল নিয়ে এসে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে আরাম করে চৌকিতে উঠে বসতে বললেন। না,
ঠিক বললাম না, বসতে অনুরোধ করলেন বললেই ঠিক বলা হবে। চক্কোত্তী
বামুন পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানালেন, ইনি তাঁর স্ত্রী। আমরা সেইমতো হাতমুখ ধুয়ে
পরিস্কার হয়ে কাপড় বদল করে চৌকিতে আরাম করে গুছিয়ে বসলাম। চক্কোত্তী বামুন কিন্তু
ঘর ছেড়ে কোথাও গেলেন না।
অল্প
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভদ্রমহিলা দুই হাতে দুই থালা মুড়ি নিয়ে এলেন, সঙ্গে কিছু ভেজানো
ছোলা, বাদাম ভাজা, নারকেল টুকরো আর অতি সুস্বাদু খানিকটা তাল পাটালি। সবে
দূর্গাপূজা শেষ হয়েছে, কাজেই ঠান্ডা না পড়লেও গরম কিন্তু সেরকম নেই। ভদ্রমহিলা তবু
একটা হাতপাখা নিয়ে আমাদের পাশে বসে হাত নাড়তে নাড়তে তাঁর স্বামীকে বললেন, “আমি
বসছি তুমি জামাকাপড় বদলে এসে এনাদের পাশে বসে একটু বাতাস করো। আমি বরং ঐ দিকটা
একটু দেখি”।
চক্কোত্তী
বামুন ফিরে এসে আমাদের পাশে এসে হাতপাখা নিয়ে বসলেন। কোনমতে তাঁকে বাতাস করা থেকে
বিরত করা গেল। একজন মহিলা এসে চা দিয়ে গেলেন। আমরা চৌকিতে বসে তাঁর গ্রামের কথা
শুনতে লাগলাম। হ্যারিকেনের স্বল্প আলোয় এই একটা ঘরের অবস্থা দেখেই এঁদের অর্থনৈতিক
অবস্থাটা জলের মতো পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। যতই চালকলা বিদ্যার ব্রাহ্মণ হোক, তাঁর
বিনয় ও ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে সারা বছর শিব পূজা, অন্যান্য অনুষ্ঠান, ও
দূর্গাপূজায় যৎসামান্য প্রণামী দিয়ে বিদায় করাটা আমাদের বাড়ির কত বড় অন্যায়, কত বড়
প্রবঞ্চনা এখন বুঝতে পারছি। আমাদের বাড়ির কোন পরিবারই খুব অবস্থাপন্ন নয় ঠিক কথা,
কিন্তু কারো খাওয়াপরার অভাব নেই। এঁদের দুবেলা যথেষ্ট আহার জোটে কিনা সন্দেহ।
কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর গৃহকত্রী এসে আমাদের কিছু লাগবে কী না, আমাদের কোন অসুবিধা
হচ্ছে কী না, খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন।
ক্রমে
রাত বাড়তে আমাদের খেতে ডাকা হ’ল। মাটির দালানে পিঁড়ে পেতে বসতে দেওয়া হয়েছে।
কলাপাতায় খাবার ব্যবস্থা। আমরা তিনজন খেতে বসলাম। খাবার আয়োজনও অতি সাধারণ। লাল
চালের ভাত, ডাল, একটা চচ্চোড়ি আর ছোট ছোট মাছের ঝোল। চক্কোত্তী বামুন বললেন “আপনারা
দয়া করে গরীবের বাড়িতে কষ্ট করে এসেছেন বলে, গিন্নী পাশের পুকুর থেকে জাল ফেলিয়ে
মাছ ধরার ব্যবস্থা করলেন। খেতে নিশ্চয় আপনাদের কষ্ট হবে”।
খাওয়া
শেষ হলে আমাদের দু’জনের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটায় আমাদের নিয়ে গিয়ে চক্কোত্তী বামুন
বললেন, “আজ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে নিশ্চয় আপনারা ক্লান্ত। বিছানা করে দেওয়া আছে আপনারা
বিশ্রাম করুন। রাতে ওঠার দরকার হলে ডানদিকের একবারে শেষে বাথরুম। বাইরে ছোট করে
হ্যারিকেন জ্বালা থাকবে। আপনাদের ডানপাশের ঘরটাতেই আমি থাকি, কোন প্রয়োজন হলে আমায়
ডাকবেন। বিছানা করাই ছিল, আমরা দুই বন্ধু অনেকক্ষণ গল্পগুজব করে শুয়ে পড়লাম।
রাত
তখন কত বলতে পারবো না, আমার একবার বাথরুমে যাবার প্রয়োজন দেখা দিল। ঘর থেকে বেরিয়ে
লম্বা একটা বারান্দা মতো। পর পর তিনটে ঘর, তারপরে বাথরুম। আমাদের ঘরের বাঁপাশের
ঘরটা বন্ধ দেখেছিলাম। চক্কোত্তী বামুন বলেছিলেন আমাদের ডানপাশের ঘরটায় তিনি থাকেন।
রাত অনেক হয়েছে, স্বাভাবিক ভাবে ঘরটা অন্ধকার। কিন্তু বাঁপাশের ঘরটার দরজা সামান্য
ফাঁক, এবং তার ভিতর থেকে হাল্কা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। তাহলে কী চক্কোত্তী বামুন
বাঁপাশের ঘর বলতে গিয়ে ভুল করে ডানপাশের ঘর বলেছিলেন? কৌতুহলবশত বাঁপাশের ঘরটার
আধভেজানো দরজাটার কাছে গিয়ে চমকে উঠলাম। ছোট একটা জলচৌকির উপর একটা বই নিয়ে পাশে কুপি
জ্বালিয়ে তার পিছনে দরজার দিকে মুখ করে বসে চক্কোত্তী বামুন একমনে বই পড়ছেন। ঘরের
মেঝের অধিকাংশ জায়গাই লাল সালুতে মোড়া বোঁচকা দখল করে রেখেছে। আসবাবপত্র বলতে বোঁচকা
ছাড়া ঘরে ঐ একমাত্র জলচৌকিই শোভা পাচ্ছে।
আমি
দরজাটা খানিকটা খুলে দরজার সামনে দাঁড়ালাম, তিনি কিন্তু টেরও পেলেন না। আমি দু’-দু’বার
তাঁকে ডাকার পর তিনি মুখ তুলে চাইলেন।
দরজার বাইরে আমাকে দেখে তিনি বললেন “বাথরুমে যাবেন? ডানদিকে আপনাদের পরের ঘরটা
আমার ঘর, তার পরেরটা বাথরুম”।
“কিন্তু
এত রাতে আপনি এ ঘরে বসে কী পড়ছেন? শুতে যাবেন না”?
ক’টা
বাজে? বলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন “সর্বনাশ, সাড়ে তিনটে বেজে গেছে? কাল আবার সকাল
সকাল উঠতে হবে। চলুন শোয়ার ঘরে যাওয়া যাক”।
আমাকে
বাথরুমটা দেখিয়ে দিয়ে তিনি শুভরাত্রি জানিয়ে আমাদের ঘরের ঠিক ডানপাশে নিজের ঘরে
চলে গেলেন।
পরদিন
সকালে চক্কোত্তী বামুনের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটা বড় থালায় করে দু’কাপ চা নিয়ে
তিনি মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের উঠে বসতে দেখে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কাল রাতে ঘুম হয়েছিল? নতুন জায়গা, কোন কষ্ট হয় নি তো”? আমাদের
রাতে কোন কষ্ট হয় নি এবং ভালো ঘুম হয়েছে শুনে তিনি আশ্বস্ত হয়ে চা খেয়ে মুখ হাত
ধুয়ে তৈরী হয়ে নিতে বলে, চলে গেলেন। বন্ধুকে বললাম “আমার এখানে থাকাখাওয়ার অসুবিধা
হবে ভেবে বাড়ির লোক চিন্তা করছিল, বিশ্বাস কর, আমার আঠারো-ঊনিশ বছরের জীবনে এই
প্রথম বেড-টি খাওয়ার সুযোগ হ’ল”।
হাতমুখ
ধুয়ে চক্কোত্তী বামুনের কথমতো তৈরী হয়ে নিলাম, যদিও কেন তৈরী হতে বলা হ’ল বুঝলাম
না। গৃহকত্রী ছোট ছোট থালায় করে গরম গরম রুটি ও তরকারী নিয়ে এলেন, সঙ্গে কালকের
মতো তালপাটালি। চা ও দিয়ে গেলেন। এই তালপাটালি জিনিসটা ভারি সুন্দর খেতে। যাহোক্,
খাওয়া শেষ হলে চক্কোত্তী বামুন আমাদের নিয়ে গ্রাম দেখাতে বেরলেন। অল্প জমির ওপর
ছোট্ট বাড়ি, ছোট বাগানে সুন্দর ফুলের ও সবজীর গাছ। বাড়ির পিছন দিকে ছোট একটা
পুকুর। সম্ভবত এই পুকুর থেকেই গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের জন্য মাছ ধরা হয়েছিল। চক্কোত্তী
বামুনের গোটা বসত বাড়ি ও বসত বাড়ি সংলগ্ন এলাকা ছবির মতো সাজানো। গতকাল সন্ধ্যায়
হঠাৎ আমরা এসে হাজির হয়েছি। আমরা আসার পর পরিস্কার করার কোন সুযোগ ছিল না, অর্থাৎ এটা স্বীকার করতেই হবে যে, চক্কোত্তী
বামুন ও তাঁর বাড়ির লোকজন খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।
গোটা
গ্রামটা চক্কোত্তী বামুন ঘুরে দেখালেন। গোটা গ্রামটায় আর যাই থাক, তালগাছের অভাব
নেই। তালগাছের আধিক্যের কথা চক্কোত্তী বামুনকে বলতে উনি বললেন “এখানে প্রচুর
তালগাছ থাকায়, তালগুড়ের পাটালি প্রচুর হয়। চেষ্টা করে দেখবো আপনাদের যদি কিছুটা
জোগাড় করে দিতে পারি”। শুনে খুব আনন্দ হ’ল, কারণ কাল এবং আজ তালপাটালি খেয়ে
দেখেছি, সন্দেশের থেকেও ভালো খেতে।
ফেরার
পথে চক্কোত্তী বামুনকে জিজ্ঞাসা করলাম কাল অতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে রাত জেগে কী
পড়ছিলেন। উত্তরে তিনি শুধু বললেন, “কয়েকটা দিন পূজা নিয়ে কেটে গেল। যাবার আগে জর্জ
বার্নার্ড শ্যয়ের একটা বই কিছুটা পড়ে চলে যেতে হয়েছিল। এইকটা দিন মনটা ওতেই
পড়েছিল। ভেবেছিলাম কাল রাতে শেষ করে দেব। কিন্তু শেষ করতে পারলাম না। শুনে তো আমার
ভিরমি খাবার উপক্রম। চক্কোত্তী বামুন বর্নার্ড শ্য পড়ছেন?
দুপুরে
খাবার পর, চক্কোত্তী বামুনের সাথে গতকালের ঘরটায় গেলাম। উনি অবশ্য আমাদের বিশ্রাম
নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। ঘরে ঢুকে উনি একটা মাদুর পেতে আমাদের বসতে বললেন।
উনি নিজে গতকালের মতো জলচৌকির পাশে বসলেন। জলচৌকির ওপর উল্টো করে রাখা খোলা বইটা
দেখে আমি ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম। SOCIALISM FOR
MILLIONAIRES BY BERNARD SHAW, PUBLISHED & SOLD BY THE FABIAN SOCIETY, PRICE
ONE PENNY.
আমার
সামনে বসে এ কোন চক্কোত্তী বামুনকে দেখছি? আমাদের বাড়ির সকলের পরিচিত চালকলা
বিদ্যের সেই চক্কোত্তী বামুন তো ইনি নন। ইনি যে বার্নার্ড শ্য পড়ছেন, তাও আবার
অনুবাদ নয় অরিজিনাল। কৌতুহল বশত তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “সারা ঘর জুড়ে এই লাল সালুর
বোঁচকাগুলোতে কী আছে”?
উনি
খুব লজ্জিত হয়ে বললেন “কী করবো বাবা, বাড়িতে এগুলো রাখার মতো ভালো জায়গার বড় অভাব।
একটা বড় আলমারীর খুবই প্রয়োজন, কিন্তু তাও কেনা হয়ে ওঠে নি। ওগুলো সব বই। বাবার
কেনা, আমার কেনা। ঠাকুদার সংগ্রহের কিছু বইও ওতে আছে, তবে যত্নের অভাবে সেগুলো
নষ্ট হতে বসেছে”।
আমি
একটু কিন্তু কিন্তু করেই বললাম, “আমি একটু খুলে দেখবো”? উনি মৃদু হেসে বললেন,
“দেখবেন? তা দেখুন, তবে খুব সাবধানে।
একবারে পাঁপড় ভাজা হয়ে গেছে। আমার পড়তে খুবই অসুবিধা হয়”। এক এক করে যত লাল সালুর
গাঁটরি খুলি, বিষ্মিত হওয়ার সাথে সাথে বুকের না মনের ঠিক বলতে পারবো না, কোথায় যেন
একটা যন্ত্রণা শুরু হ’ল। মনে হ’ল কোন হাস্যকর অহমিকা বা পাপবোধই এই যন্ত্রণার উৎস।
কাশীরাম দাসের মহাভারত, রামায়ণ, উপনিষদ, বেদ, চাণক্য শ্লোক, বিভিন্ন মঙ্গল কাব্য, বিভিন্ন
পৌরানিক কাব্য, ইতিহাস তো আছেই, আর আছে বিবেকানন্দ, রামমোহন, রবীন্দ্র নাথ এমন কী
কোরাণ পর্যন্ত। বিদেশী ইংরাজী বইয়েরও অভাব নেই। JOHN
KEATS, WILLIAM BLAKE, WILLIAM WORDSWORTH, SHELLEY, LORD BYRON, H.G.WELLS,
ALEXANDRE DUMAS, WILLIAM SHAKESPEARE, কে নেই?
ধীরে
ধীরে আবার যত্ন করে সব আগের মতো সাজিয়ে, সালু জড়িয়ে রেখে দিয়ে এসে নিজের জায়গায়
বসে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার সংগ্রহে এত বই, কে পড়েন, কখনই বা পড়েন? চক্কোত্তী
বামুন হেসে বললেন, “তিন পুরুষের সংগ্রহ। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ করে এম.এ.
পড়তে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। ওখান থেকে পাশ করে বেরিয়ে কতবার চাকরী করবো
ভেবেছি। অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় সংসার আর চলতো না, অবশ্য আজও ভালভাবে চলে না। কিন্তু
এই হতচ্ছাড়া বইগুলো আমায় সে সুযোগ দিল কই? ওদের নিয়েই তো এতগুলো বছর কেটে গেল,
কিছুই করা হ’ল না। পয়সার অভাবে কত বই এ জীবনে পড়তে বাকী রয়ে গেল। সে যাহোক্,
আপনারা তো আজ বিকালেই চলে যেতে চান। ইচ্ছা করলে দু’দিন থেকে যেতে পারেন।
কিছুক্ষণ
চুপ করে বসে থাকলাম। আমার উপনয়ন এই চক্কোত্তী বামুনই দিয়েছিলেন, আজ তিনিই আবার
চক্রবর্তী পন্ডিতমশাই হয়ে, আমার আর একবার উপনয়ন দিলেন। বললাম, “না জ্যাঠাবাবু,
আমরা আজ বিকেলেই চলে যাব। পরে আবার আসবো”।
বিকেলে
তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বিদায় নিলাম। জীবনে এই প্রথম তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম
করলাম। স্টেশন পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দেবার জন্য তিনি সঙ্গে একজনকে পাঠালেন। সঙ্গে
তালপাটালি দিয়ে দিতেও ভুললেন না। ভ্যান রিক্সায় বসে যাওয়ার পথে একটা কথাই মনে হ’ল,
চাকরী পেলে প্রথম মাসের মাইনের টাকা থেকে তাঁকে একটা সুন্দর মজবুত বইয়ের আলমারী
তৈরী করে দেব।
দোলনচাঁপা ধর
দুল
দুল ঝুমকোজবার গাছের লাল সবুজ আকাশের ফাঁকে ফাঁকে উকি দেয় হলদে রঙের কুমড়ো ফুল।
কুমড়োর লতাটা উঠেছে শশাঙ্কদের পাকা কোঠার ভেতর-পাঁচিল থেকে,
কিন্তু তাতে কি? ফুল তো বেশী ফোটে এই
ঝুমকোজবার গাছের উপরেই, এই গাছটার সাথে খুব ভাব যে,
তাই সব ফুল ওরই গায়ে। শেষ রাতের দিকে গরমে ঘরের তলায় থাকতে না
পেরে তাই প্রায়ই বনরাজ এসে বসে থাকে এই জবা গাছের ভেতর ডালে আর গরম ভুলে মুগ্ধ হয়ে
দেখে কেমন করে ছাই রঙা অন্ধকারের ভিতর থেকে লাল হলুদ সবুজ আর সোনা মেশা নীল রঙের
দিন শুরু হয়ে যায়। জবা গাছটায় একবার চড়ে বসলে বাইরে থেকে ঠাহর হয় না মানুষ আছে বলে,
মানুষ আসে ফুল নিতে তবে তা বাইরের দিকেই এত ফোটে যে কেউ তেমন
ভেতরে খোঁজে না। একবার শুধু দত্ত বুড়ো ভোর রাতে ফুল তুলতে এসে দাঁতকপাটি লেগে
পড়েছিল ভুত মনে করে, বনরাজই শেষটায় ধরে বাড়ি তুলে দিয়ে
আসে, লাভের লাভ একটাই, দিন পাকা
না হলে কেউ আর বড় জ্বালাতে আসে না।
তা
বলে জ্বালার অভাব নেই কিছু, রোজ রাত্তিরে উঠে আসার
কারণ জানতে চায় রাই, কি এমন গরম যে ফি-রাতে ঘরের বাইরে
যেতে হয়? পাঁচ জনে শুনলে রাই মুখ দেখায় কিকরে?এই কৈফিয়ত দিয়ে আসতে হচ্ছে আজ পাঁচ মাস যাবৎ, সেই
অঘ্রাণের নতুন ধানের সাথে যেবার বাড়িতে আলতা মাখা পা রাখল রাই, দিদিমা ভেবেছিলেন একটা বিয়ে দিলে হয়ত ঘরে মন বসবে মা-বাপ হারা ছেলের,
আর হয়ত নিশিদিন জলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে না। তা সত্যিই বেশ কিছুদিন
ঘর চিনল বনরাজ, দেখে শান্তি পেলেন দিদিমা। সেই কবে
থেকে যমকেও ঠেকিয়ে রেখেছেন শুধু এই নাতির কথা ভেবে, মেয়ে
জামাই হারানোর শোক বুকে পাথর চাপা দিয়ে তিল তিল করে বড় করে তুলেছিলেন বনরাজকে তবু
মানুষের মুখ বন্ধ করতে পারেন নি, কত লোকে বলেছে- তেমন
যত্ন পায় না বলেই না ছোট থেকে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। আজ তারা এসে দেখুক কেমন
সংসার করছে নাতি তার, দেখে যাক এসে। দুঃখ পেলে মানুষ সুখ
পাবার কামনায় বেঁচে থাকে কিন্তু সুখ পেলে ভবিষ্যতে দুঃখ পাবার মত উদারতা প্রায়ই
দেখাতে পারে না, তাই মনপ্রাণ খুলে উদ্বাহু হয়ে আনন্দ করে
আর তাতেই বিপদ আসে অতর্কিতে, ওই হঠাৎ বেশী ভোল্টেজ
বিদ্যুৎ এসে যাওয়ার মত। বুড়িও আনন্দের হাতে পরাজিত হল, বয়সও
হয়েছিল বেশ, পৌষ কাটল না, আর
ফাল্গুনের থেকে শীতেও লাগাম লাগলে পুরনো নেশায় পেয়ে বসল বনরাজকে।
যে
বছর আবাদের কাজে গিয়ে ঈশ্বর ফিরল না আর, সঙ্গের
লোকেরা বলেছিল সাপের কামড়ে মরেছে, ভবানী মানতে পারে নি সে
কথা, শীতের দিনে সাপে কাটে এমন কথা কে কবে শুনেছে?কাজ শেষে ফেরার পথে সাথে টাকা থাকত বেশ কিছু, সংসারের
কথা ভেবে লোকটা কখনো একটা টাকাও বেশী খরচ করত না। সেই টাকার লোভেই হয়ত
প্রাণ গেছে মানুষটার, বনরাজ তখন তিন বছরের
ছেলে, তাকে নিয়ে বাপের বাড়ি এসে উঠতে হয়েছিল। আর সব ঠিক
ছিল কিন্তু কপালের সিঁদুরের টিপের গোলটা বড় বড় হতে হতে শেষে কপালজোড়া হল, কথাবার্তাও অসংলগ্ন হয়ে উঠল, তারপর একদিন
ভবানীকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সেই কোন ছোটবেলা থেকে বনরাজ শুনে আসছে তার মায়ের কথা দিদিমার মুখে,
কখনো শোনে মা আছে তারা হয়ে কখনো নাকি শিউলি ফোটা ভোরে লুকিয়ে আসে
বনরাজকে দেখতে। রোজ
রাতে ঘুমোতে যাবার সময় মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করে সে,
ঘুম জড়িয়ে আসে যখন তখন জেগে থাকে সূর্যের মত লাল টিপ আর ধোয়া
কাপড়ের গন্ধ।
তাপসকিরণ রায়
তখন
সবে শৈশবের খোলস ছেড়ে কৈশোরের পোশাক পরতে শুরু করে ছিলাম। সব কিছু তখন রঙিন
ছিল--কাঁচের রংচংয়ের চুড়ি থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের ফুল পর্যন্ত সব আসল মেকি
একাকার হয়ে ছিল।
সরল
সাদাসিধা তথা কৈশোর বয়সের বোকা একটা ছেলে ! পৃষ্ঠা উল্টে মলাটের ভেতর দেখতে পায় না। তখন তার
মনের মাঝে অনাবিল আনন্দ থাকে--নীল বিষাক্ত যন্ত্রণা কোথায় ! তখনও সে শিশুদের মত নীল আকাশের বেলুন ওরা
দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। মরা চাঁদের বন ভূমিতেই সে হারিয়ে যেতে চায় ! সবুজের
পাতায় পাতায়--কিশলয় চকচক চোখ নিয়ে সে হারিয়ে যেতে চায় তার মন মাখা সৌন্দর্যে।
সে
ছিল এক খরা দিনের কথা। বৈশাখের শুরু। ঝড় ঝাপটা--দাঙ্গা বাঁধা মেঘদের ছুটোছুটির সঙ্গে
সঙ্গে মাঝে মধ্যে চমকে ধমকে ওঠা বজ্র বিদ্যুৎ। আর তারই মাঝে দু পশলা বর্ষার ছাঁচ ভেজা মাটির মন মাতানো
সোঁদা গন্ধ ! এ গন্ধ কিন্তু বড় মোহময়ী--মনের টান আর মাটির টান এক জাগায় মিশিয়ে দেয়--নিজের দেশ মাটিকে ভালবাসতে শেখায় !
এমনি
এক দিনের কথা। এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। টুয়েলভের পরীক্ষা কাছে ছিল,বন্ধুর বাড়িতে একটা বই আনতে গিয়েছিলাম। আর পথেই আবার চলছিল এই ঝড়
জলের বিপত্তি। স্ট্রিট লাইট এতক্ষণ যেগুলি জ্বলছিল হঠাৎ গেল নিভে। কাক ভেজা থেকে
বাঁচার জন্যে
এক অন্ধকার দালান বাড়ির বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। বেশ কিছু সময় আগে
সন্ধ্যে হয়ে গেছে।
মিনিট
পনের হয়ে গেল,দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছিলাম।
রাস্তায়ও
পা বাড়াতে পারছিলাম না,কারণ বৃষ্টি আরও ঝেঁপে আসছিল। হঠাৎ খেয়াল হল,অন্ধকার দালানের ভিতর ঘরগুলিতে কখন
যেন আলো জ্বলে গেছে। কিছু
মেয়েলি কণ্ঠ
কানে আসছিল --সে
সঙ্গে হি হি,হা হা,হাসির শব্দ--মাঝে মধ্যে কিছু অস্পষ্ট বার্তালাপ!
আরও
কিছু সময় কেটে গেল। বর্ষা তখনও থামে নি--লাগাতার একই ধারায় পড়ে চলেছে। তবু ভিজে
হলেও বাড়ি তো ফিরতে হবেই ! বাড়ি পৌঁছাতে হলে আরও প্রায় পনের মিনিট হাঁটতে হবে। বাড়িতে
মা,বাবা নিশ্চয় চিন্তা করছেন। বারান্দা থেকে রাস্তায় পা বাড়াব ভাবলাম। ঠিক এমনি
সময় খুট,একটা
আওয়াজ কানে এলো। আর বারান্দার দিকের একটা জানালা খুলে গেল। এক ঝলক আলো এসে যেন
ঝাঁপ দিল বাইরের বারান্দায়। আমি মুহূর্তের জন্যে থমকে গিয়ে ছিলাম। একটা
সুরেলা কণ্ঠ আমার কানে এসে বাজলো--বাইরে ভীষণ বর্ষা গো--এখন বাইরে যেও না,ভিজে যাবে !
জানলার
দিকে তাকালাম
আমি,একটা মেয়েকে দেখতে
পেলাম, আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
--ভেতরে এসো--এখন বর্ষা,থামলে যেও। মেয়েটির কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছল হাসির শব্দ
শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম না--এই মেয়েটি হাসল,নাকি ভিতর থেকে অন্য কোন মেয়ে হাসল
!
বারান্দার
দিকের দরজা খুলে গেল। আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে মেয়েটি--সে মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী ! ঘরের কম পাওয়ারের আলো ওর মুখে এসে পড়েছে।
কাজল আঁকা টানটান চোখ জোড়া--যুগল ভ্রু। কারুকাজ করা শৈল্পিক চোখের পলক- কেশ--কাঁধের দু পাশে ঝুলে
আছে কেশ গুচ্ছ বিনুনি। তাতে রজনী গন্ধা বা অন্য কোন সুগন্ধিত সাদা ফুল
জড়ানো। হরিণ চোখের দৃষ্টি নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার চার পাশ ঘিরে মনে হল এক অদ্ভুত
মায়াময় পরিবেষ্টনীর সৃষ্টি হয়েছে। আমি স্তব্ধ ও নিশ্চল হয়ে গিয়ে ছিলাম। মনে হচ্ছিল
আমি আমির মধ্যে নেই--কোন
স্বপ্নের ঘোরের মাঝে পড়ে আছি!
--কি ঘরের ভিতরে এস--মায়াবী তার স্বর্গীয় ইশারায় হাসির ফুল ফুটিয়ে বলে উঠলো,মনে হল এ যেন কোন স্বর্গীয় সংলাপ আমার
কানে ভেসে এলো !
আমি
নিজের স্থিরতা ভঙ্গ করলাম। সামনে কোন দেবী বা অপ্সরা যেই হোক তার কথা যেন আমি ফেলতে
পারব না। নির্বাক আমি এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে--মেয়েটির পাশ কাটিয়ে আমি সুড়সুড় করে ঘরে প্রবেশ করে গেলাম। মেয়েটি এবার
দরজা বন্ধ করে দিল। এবার আমি কি করব ভাবতে পারছিলাম না--ভেতরের ঘর থেকে খিলখিল হাসি আমার কানে এসে আঘাত করল।
--ওই চেয়ারটায় বসো--আমি জল্পনা,তোমার নাম কি ? মেয়েটি নির্দ্বিধায় কথা বলল,আমার মুখ খুলতে ক’মুহূর্ত সময় লেগে গেল। ধীরে বলে উঠলাম,সপ্তক।
--বাঃ,সুন্দর
নাম তোমার !
চেয়ারে
বসে ছিলাম। মেয়েটি দাঁড়াও,তোমার জন্যে জল আনি,বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পাঁচ,সাত
মিনিট সময় পার হয়ে গিয়ে ছিল। এখন আমার কেন যেন সামান্য ভয় ভয় লাগছিল। বাস্তবতা খুঁজে
বেড়াচ্ছিলাম। কোন অলৌকিক ঘটনার কথাও মনে আসছিল। ঘর থেকে অন্য ঘরে যাবার আরও দরজা আছে
দেখলাম। আমার কি এ ঘরে বসে থাকা উচিত হচ্ছে ?
ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে একটা দরজার দিকে এগোলাম। দরজার ওপারে
ঘর থেকে ফিসফাস কথা বার্তা শুনতে পারছিলাম--পুরুষ ও নারী উভয়ের কণ্ঠস্বর। ভয় ও কৌতূহল নিয়ে দরজার ফাঁকে চোখ রাখলাম।
কে ওরা ? কি
করছে ? দেখলাম
স্ত্রী ও পুরুষটির ঠিক মাঝখানে ওপরে ঝুলে আছে এক থোকা কালো আঙুর। ওরা দুজনই
সেই থোকা আঙুর থেকে মুখ বাড়িয়ে ঝটপট ছিঁড়ে নিচ্ছে একেক করে আঙুর। কেউ তাতে হাত লাগাচ্ছে
না। আঙ্গুর খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছিল যেন
! ওদের পরস্পরের মুখে মুখ ঠেকে যাচ্ছিল--গায়ে গা ঘেঁষে যাচ্ছিল। মনে হয়েছিল মেয়েটার
বাবা,মা হবেন। ওরা হয়তো বর্ষা বাদলের নিভৃত দিনে নিজেদের আনন্দ নিয়ে মেতে আছেন। মেয়েটি
ঘরে ঢোকার সাথে সাথে আমি দরজার কাছ থেকে সরে গেলাম।
--কি--দেরী
হয়ে গেল আমার ?
আমি
কথা না বলে নীরবে শুধু হাসলাম।
--বস না চেয়ারে ! ও এক হাতে আমায় ছুঁয়ে বলে উঠলো,কিশোর শরীর আমার চনমন করে উঠলো,সুন্দর
মোলায়েম পুষ্প ছোঁয়ার মত মনে হল।
--এই নাও তোমার চা--
আমি
বোকার মত বলে ফেললাম,আমি
তো চা খাই না !
--আজকে এই ঠাণ্ডায় একটু না হয় খেলে
!
আমি
ইতস্তত করছিলাম।
জল্পনা
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমার মুখের সামনে তুলে ধরে মিষ্টি হেসে বলল,প্লীজ চা’টা খেয়ে নাও !
চায়ের
কাপ হাতে নিতে গিয়ে আবার মিষ্টি হাতের ছোঁয়া পেলাম। সে সঙ্গে তার গায়ের ও চুলের মিষ্টি সুবাস। বিভ্রাট ঘটল চা’য়ে চুমুক
দিতে গিয়ে,গরম চায়ে বড় টান দিয়ে চুমুক দিয়ে ফেলে ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি আঁতকে উঠলাম,সম্ভাবনার চে অনেক বেশী গরম পেয়ে
আমার শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। হাত থেকে চায়ের কাপ ছিটকে পড়ে গেল--শব্দ করে খানখান হয়ে বেশ কিছু টুকরো
হয়ে ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল।
আমি
আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। জল্পনা আমার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল,তুমি বস,তুমি বস।
কাপ ভাঙার শব্দ শুনে দু
তিনটে মেয়ে দ্রুত ঘরে এলো। কাপ ভেঙেছে দেখে নিজেদের মধ্যে কিছু সময় হাসাহাসি করল
তারপর মেঝে থেকে ভাঙ্গা কাপের টুকরোগুলি সযত্নে খুঁজে,তুলে নিয়ে চলে গেল।
এবার
পাশের ঘরের দরজা খুলে গেল। দেখলাম সেই আঙুর খাওয়া স্ত্রীলোকটি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন,জল্পু,এ ছেলেটি কে ? তোমায় না বলেছি আমাকে না বলে তোমার ঘরে কোন দিন কাউকে তুমি ঢুকতে
দেবে না ?
--না মা,ও
ভাল ছেলে--ঝড় বৃষ্টিতে বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে ছিল তাই--জল্পু নিজের স্বপক্ষে কথা বলার
চেষ্টা করল।
স্ত্রী
লোকটি জল্পুর মা,আমায়
ভাল করে নিরীক্ষণ করে নিলেন। তারপর কি মনে হল অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় বলে উঠলেন,ঠিক আছে,এখন ঝড় বৃষ্টি থেমে গেছে--ওকে যেতে দাও। জল্পুর মা আবার নিজের ঘরে
ঢুকে গিয়ে দরজা এঁটে দিলেন। আমি চেয়ারের পাশ থেকে আমার বইটা হাতে তুলে নিয়ে বাইরে
বের হব বলে প্রস্তুত হলাম। জল্পনা আমার কাছটাতে এসে বলল,আর একটু বস না,মার কথা তোমার খারাপ লাগছে ?
আমি
চুপ করে ছিলাম। জল্পনা হঠাৎ আমার একটা হাত ধরে বলে উঠলো,আমায় খারাপ মেয়ে ভেবো না--আমি নিজেকে বিলোই নি গো !
আমি
এবার অবাক চোখে জল্পুর দিকে মুখ তুলে তাকালাম। ওর কথাগুলি ঠিক আমার বোধগম্য হচ্ছিল
না। ওর মুখটা বড় করুণ লাগছিল। আমার দিকে ও চোখ ফেড়ে তাকিয়ে ছিল। আমিও সে চোখের
দিকে না তাকিয়ে পারি নি। পবিত্র,নিষ্পাপ এক সুন্দরী মেয়ে--আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে
আছে ! আমি অবাক হয়ে গেলাম--ওর চোখ ফেটে বিন্দু বিন্দু জল গাল বেয়ে গড়িয়ে আসছিল।
বুঝতে পারছিলাম
না,ও কেন কাঁদছে--কি এমন দুঃখ ওর ?
জল্পনা
আমারই বয়সী হবে--বয়সের অনেক মারপ্যাঁচ সেও হয় তো জানে না। আমি ওর একটা হাত নিজের
হাতে তুলে নিলাম। ওর কাছে আরও ঘন হয়ে গিয়ে বললাম,তুমি কাঁদছ কেন ? জল্পনা একান্ত আপন হয়ে বলে উঠলো,জানো,আমার
বাবা নেই--মা ভাল নয়--আমি জানি--কিন্তু আমি—আমি--,ওর গলা ধরে এলো,কান্না ধরা গলায় ও বলে উঠলো,আমি কিন্তু ভাল,সপ্তক ! আমি এখনও
ওদের থেকে দূরে থাকি। আমি জীবনে কখনো চাই না ওদের মত হতে--কান্নায় ভেঙে পড়ল
জল্পনা।
আমি
জল্পুকে ধরে থাকলাম। কান্নায় ভিজে যাওয়া ওর দু চোখ মুছিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম,তুমি খুব ভাল মেয়ে,আমি জানি জল্পু ! আবার
আমি ওর চোখে চোখ হারালাম।
--জানো,মা
বলে আমি বেশী কথা বলি,আমি নাকি পাগল,কিন্তু আমি তো চাই না মার মত নিচে নামতে। এক
দিন নিশ্চয় আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবো,কান্না ভরা চোখ নিয়ে জল্পু আমার দিকে তাকিয়ে
রইল।
মনে
হচ্ছিল যে এই খানিক সময়ের মাঝে আমি জল্পনাকে ভালবেসে ফেলেছি। এই গভীর ভালবাসার জোড় বুঝি আর কোন
দিন খোলার নয় !
এবার
জল্পু অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে বলল,তোমার মা,বাবা নিশ্চয় তোমার জন্যে খুব ভাবছেন—
আমার
সম্বিত ফিরল--এবার যেতে হবে।
--আমায় ভুলে যাবে না তো ? জল্পুর কথাগুলি কাতর প্রার্থনার মত শোনাল।
--না,কখনোই
না--আমি কালই তোমার কাছে আবার আসবো--
--আমি কিন্তু তোমার পথ চেয়ে বসে থাকবো,সপ্তক !
আমি
ধীরে ধীরে বারান্দা পার করে রাস্তায় নেমে এলাম। দেখলাম দরজায় দাঁড়িয়ে আমার জল্পু ! করুণ মুখে ম্লান হাসি
নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে আছে সে।
পর
দিন বন্ধু বলে ছিল,ওই দালান বাড়ি নাকি নিষিদ্ধ পল্লীরই এক অংশ। জল্পুর মুখটা খুব,খুব
করে মনে পড়ছিল। আমি বিশ্বাস করি যে ও নিষ্পাপ,ও সরল একটি কিশোরী মেয়ে। ওর জন্যে বহুদিন আমি গুমরে মরেছি। অনেক
দিন মনে এসেছে যে কেন,কেন জল্পনার মত অসহায় নির্দোষ মেয়েরা হৃদয় থেকে চাইলেও পাকচক্র
থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না ?
আমিও
পারিনি,সমাজের বেড়া জাল ডিঙিয়ে পারিনি,একবার ওর হাত ধরে বলতে,জল্পু ! তুমি আমায় ক্ষমা করো !
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)