গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০১৫

৪র্থবর্ষ ১৬তম সংখ্যা।।১৫ই জুলাই ২০১৫

এই সংখ্যায় ৮টি গল্প । লিখেছেন – রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, সুবীরকুমার রায়, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, সুমী সিকানদার, আবু রাশেদ পলাশ, মিশকাত উজ্বল, রুখসানা কাজল ও ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী এবং গল্পগ্রন্থ পর্যালোচনা / ‘স্টেথোস্কোপের পান্ডুলিপি’ ।

                  পড়ুন সূচিপত্রে ক্লিক করে

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল

বৃক্ষছায়া 

কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ট্রেনে এসে নামল, অমল হাসিমারা ষ্টেশনে । ষ্টেশন থেকে বেরিয়েই  দেখতে পেলো- অমল বোস ডুবপাড়া টি এষ্টেটলেখা একটা বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে, একজন। প্লেনে যাবার কথা বলেছিল কোম্পানি, কিন্তু বাবার বাধা  । কে জানে, প্লেনে আবার কি সব গণ্ডগোল হচ্ছে আজকাল ।
 কাছে যেতেই লোকটা নমস্কার করে বলেছিল :- স্যার, আপনিই তো অমল বোস? আমাদের বাগানের নতুন সায়েব ?

মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বলতেই, একটা হুডওয়ালা মারুতি জিপের কাছে নিয়ে বলেছিল :- উঠুন স্যার!
 প্রায় জনহীন ছিমছাম ছোট ষ্টেশনের বাইরের দোকান থেকে পাঁচ প্যাকেট সিগারেট কিনে উঠে পড়েছিল জীপে- অমল । একটা সুন্দর জংলা সুবাস ভেসে আসছে চারিদিক থেকে ।
 হঠাৎ মাথার ওপর দিয়ে গর্জন ।  অমল জানতো- হাসিমারা ভারতীয় বায়ু সেনার এয়ার বেস । বুঝলো- একটা জেট উড়ে গেল, মাথার ওপর দিয়ে ।

বেশ খানিকটা সুন্দর পিচ ঢালা রাস্তা ,তারপর চিলাপাতার জঙ্গল দিয়ে যাত্রা শুরু । ড্রাইভারের নাম, খগেন বর্মন । কথায় কথায় নিজের পরিচয় দিল । কোচবিহারের আদি বাসিন্দা । ত্রিশ বছর ধরে কাজ করতে করতে এখন হেড ড্রাইভার । 

সারা রাস্তা, বকবক করে বুঝিয়ে গেল চা বাগানের কালচার ।  চিলাপাতা জঙ্গলের হাতী আর বাইসনের কথা ! কয়েকটা অজানা পাখী ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না যদিও ।
 বোতল থেকে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে অমল বলেছিল- আচ্ছা, খগেন বাবু এবারে একটা হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেলে হতো না ?খগেন পান চিবোতে চিবোতে হেসে বলেছিল :- আমাকে, বাবু বলবেন না, নাম ধরেই ডাকবেন । এই জঙ্গলে আপনি হোটেল খুঁজতিসেন ? চলেন চলেন-  আগত্ বাগানে চলেন । আপনার বাংলো তে চান টান করে লাঞ্চো খাবেন ।

মানে ?

আরে কোম্পানীর কাজ তো সকাল  বিকেল ! হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেলে কাজ করবেন কখন  তা ছাড়া, কোম্পানিরই তো সব পরপাটি ! মালি, কেয়ার টেকার আছে । সব ব্যবস্থা আছে কোম্পানিরই করা ।

অমল বুঝল পরপাটি মানে প্রপ্রার্টি ।

কথা বাড়ায় নি অমল । সুন্দর মাখনের মত রাস্তা পেরিয়েই ফরেষ্ট চেক পোষ্ট । সেটা পেরিয়ে একটু যেতেই ডুবপাড়া টি এষ্টেটের মোরামের রাস্তা শুরু । বাঁ দিকে একটা কালি মন্দির । খগেন ষ্টিয়ারিং এক হাতে রেখে, অন্য হাত দিয়ে একটা নমস্কার ছুঁড়ে দিল, ভক্তি ভরে ।
দু ধারে চা গাছ ।  ধার গুলোতে সিট্রোনিলা গাছ দিয়ে বেড়ার মত করা । এই গাছ চেনে অমল। এই গাছ থেকেই মশা মারার তেল বের করা হয় । ঝাঁঝাল গন্ধ বেশ ।  

চা গাছের মাঝে মাঝে লম্বা গাছ ।  কোর্সে পড়া ছিল, তবে চাক্ষুষ দেখল এই প্রথম- শেড ট্রি । চা গাছকে ছায়া দেওয়াই কাজ ওদের । চা গাছ খুব সুখী, একটুতেই এলিয়ে পড়তে পারে । চা গাছকে আগলে রাখাই কাজ এই শেড ট্রিদের । শেড ট্রি গুলোর গুঁড়ি থেকে একটু ওপর পর্যন্ত সাদা রঙ করা । জেনেছিল- সাদা রঙটা, গুঁড়িতে পিঁপড়ের আনাগোনা আটকানোর জন্য । না হলে, গাছ নষ্ট হবে ।
বাগানের গাড়ীটা দেখে  বড় গেট টা খুলে দিল গেটকিপার । একটা স্যালুটও পেল  অমল । ডান দিকে সশব্দে চলা, চায়ের  সুগন্ধ ছড়ান ফ্যাকটরির পাশ দিয়ে  বাঁদিকে একটা বড় দোতালা কাঠের বাড়ীর সামনে খগেন দাঁড় করিয়েছিল গাড়ীটা । বড় সায়েবের আপিস দোতালায় ।  সিনিয়ার ম্যানেজার হিসেবেই পরিচিত ।

যান, দেখা করে আসেন । আমি অপেক্ষা করতেসি, আপনাকে বাংলো পৌঁছে আমি চলে যাব খেতে । -খগেন বলেছিল ।ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে এই চা বাগানে প্রথম আসা, অমলের । শান্তিনিকেতন থেকে কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর পাশ করার পর , কাগজ দেখে একটা দরখাস্ত দিয়েছিল, কপাল ঠুকে ।

চাকরীটা হয়েও যায়, বেশ কড়া ইন্টারভিউর পর । বেশ কয়েকজনকে ডেকেছিল কোম্পানি । দুজন সিলেক্টেড, তার মধ্যে অমল একজন । অন্যজন আসামের চা বাগানে পোষ্টিং পেয়েছে ।
উত্তর বঙ্গ, তার ওপর চা বাগানে কাজ শুনে মার প্রচণ্ড আপত্তি ছিল । বাবা খুব একটা বাধা দেয় নি ।   তাই মায়ের আপত্তি ধোপে টেঁকে নি ।

হিন্দি সিনেমায় রঙীন চা বাগান দেখে আকর্ষণটা বরাবরই ছিল অমলের ।
বাবার আর মাত্র এক বছর চাকরি ছিল তখন । প্রাইভেট একটা আপিসে কাজ । মাইনে পত্তর তেমন না হলেও চলে যেত ওদের তিনজনের ।

হাতি বাগানে বাবার পৈত্রিক বাড়ীটা থাকার ফলে , খুব একটা কষ্ট হয় নি । তবে অমল বুঝতে পারছিল, শান্তিনিকেতনের হোষ্টেলে থেকে ওকে পড়ানোর জন্য বেশ চাপে ছিল বাবা।
তাই আর রিস্ক নেয় নি ।

একটু অপেক্ষা করতেই ডাক এলো বড় সায়েবের কাছ থেকে। জুতো, মোজা আর বেল্ট পরা হাফ প্যান্টের ওপর  হাফ হাতা সার্ট গোঁজা । উনিই বাগানের সর্বেসর্বা । সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবেই তাঁর পরিচয় ।
চেয়ার থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে বললেন- গুড আফটার নুন মিঃ বোস ! ওয়েলকাম টু আওয়ার টি এষ্টেট !  দিস ইজ এ গ্রুপ অফ মফারসন লিমিটেড ।
অমল হাত মিলিয়ে বলল :- গুড আফটার নুন স্যার ।
ওকে !! প্লিজ গো টু দি আদার রুম অ্যাটাচড্ টু মাই অফিস । সাইন দেয়ার ফর ইয়োর প্রেজেন্স ওভার হিয়ার, অ্যাণ্ড ডিপোজিট এ কপি অফ ইয়োর অ্যাপয়েণ্ট লেটার প্রোভাইডেড উইথ দ্য অরিজিনাল ওয়ান । দেন গো টু ইয়োর বাংলো । হ্যাভ ইয়োর থ্রি এস অ্যাণ্ড লাঞ্চ । রিপোর্ট হিয়ার অ্যাট ফোর পি. এম ।
 অমল প্রয়োজনীয় কাজ সেরে  কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে  খগেনের জীপে উঠলো । ঘড়িতে সময় তখন বেলা একটা ।

ভালো করে স্নান করে , বেরোতেই বেয়ারা কিষণ  বলল :- টেবিল পে খানা লাগাউঁ সাব ? ইয়া চায় দুঁ পেহলে কিষণের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে খগেন ।
ট্রেনেই অনেকবার চা খাওয়া হয়ে গেছে তার । তাই চা আর খেলো না । বলেই দিল
হাঁ ! খানা  লগাও ।

রান্নাটা আহামরি কিছু নয়, তবে সাজানো টেবিল আর প্লেট , ছুরি চামচ দেখে মনে মনে হেসে ফেলেছিল অমল ।

ঠিক করে ফেলেছিল মা বাবাকে নিয়ে আসবে । তারপর না হয় কিষণকে মা রান্না শিখিয়ে দেবে । এই রান্না  বেশীদিন খাওয়া যাবে না ।

তার আগে দেখে নিয়েছে- একটা সাজানো গোছানো গেষ্ট রুম আছে । সাধারণত কোম্পানির লোকেরা বাইরে থেকে এলে পদমর্যাদা অনুযায়ী গেষ্ট রুমে থাকে । তবে, অমল জুনিয়ার, তাই এখানে গেষ্টের আসার সম্ভাবনা কম ।

অসুবিধে হবে না, মা-বাবা এলে । এলেও আরও একটা ঘর আছে । আসবাব পত্র সবই কোম্পানির । তোয়ালে, সাবান, দাড়ি কাটার সরঞ্জাম, তেল, সাবান সব অবশ্য  মজুদ করতে হবে নিজের পয়সায়।
ঠিক চারটের সময় খগেন গাড়ী নিয়ে এলো । চালাতে চালাতে বলল :- এবার আপনাকে পৌঁছে দিয়েই আমার ডিউটি শেষ । কাল থেকে আপনার ব্যবস্থা নিজেই করতে হবে ।

মানে, এতবড় চা বাগানটা আমি কি হেঁটে ঘুরবো নাকি, দেখাশোনা করতে ?
হা হা হা ! আগে তো সায়েবরা সাইকেলে চড়ে ঘুরতেন সারা বাগান । ট্রাক্টরে করে যেতেন, কাছে পিঠের বাজারে ।  পাতা নিয়ে যাবার জন্য একটা বড় চার চাকার ট্রলি থাকে, ট্রাক্টরের সঙ্গে । এখন অবশ্য সবাই মোটোর সাইকেলে ঘোরে ।  আপনি মোটোর সাইকেল কেনার জন্য ব্যাংক লোন পাবেন, আর মাসে বিশ লিটার তেলও পাবেন- তবে, এক বছর বাদে ।
এক বছর বাদে কেন ?পার্মিনেন্ট হলেই তো পাবেন !

অফিসে পৌঁছতেই, বড় সায়েব সব ম্যানেজার দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন  । ফ্যাক্টরি তো বটেই, তার সাথে বাগানের ইরিগেশন, গুয়াটেমালা গ্রাসের পাতা বা সিট্রোনিলা গাছ ছেঁটে মাটিতে ফেলে জৈবিক সার করা, পেষ্টিসাইড স্প্রে , ওয়ার্কারদের ওয়েলফেয়ার, ফ্রি রেশন, দরকারে রেশন মাপা পর্যন্ত, জ্বালানি কাঠ, ফ্রি চা , চা গাছের স্যাপলিংস্ জমিতে লাগান, ইয়ং ট্রিস্ নারচার করা-  সব বুঝে নিতে হবে ওঁদের কাছ থেকে একে একে, এই এক বছরে ।
অমল হেসে ঘাড় নাড়ল  ।

নাও গেট রেডি টু গো টু আওয়ার ক্লাব, হুইচ ইজ ওয়ান্স ইন এ উইক টাইম । উই মিট দেয়ার এভরি থার্সডে  ।  দি ক্লাব ইজ ইন আ গাডের্নজাষ্ট টোয়োন্টি কিলোমিটারস্ ফ্রম হিয়ার । ইউ উইল বি ইনট্রোডিউসড্ দেয়ার ।

হাও কান আই আকম্পানী ইউ স্যার ?

নো প্রোবলেম , ইউ উইল বি পিকড্ আপ বাই মিঃ মিশ্রা আওয়ার সিনিয়ার অ্যাসিন্টান্ট ম্যানেজার টু হুম ইউ উইল রিপোর্ট নাও অনওয়ার্ডস ।

ক্লাবে গিয়ে কোম্পানির আরও যে সব বাগান আছে ডুয়ার্সে, তাদের অফিসারদের সাথে পরিচয় হলো ।
বড় গ্লাসে একটা পাতিয়ালা পেগ হুইস্কি ঢেলে-  কোম্পানির অন্য বাগানের একজন অ্যাসিণ্টান্ট ম্যানেজার বললেন চীয়ার্স !

এই জায়গায় বিনোদন বলতেসপ্তাহে একবার দেখা করা সবার সাথে ।   জম্পেশ ক্রিকেট বা ফুট বল ম্যাচ হলে বড় স্ক্রীনে সে সব দেখা হয়, একসাথে । ম্যানেজারদের ,মিসেসদের  মধ্যে নানা রকম প্রতিযোগিতাও হয় । আলপনা দেওয়া থেকে শুরু করে, মায় বড়ি দেওয়া, আচার থেকে, ওয়াইন তৈরি করা পর্যন্ত । প্রাইজের ব্যবস্থাও থাকে ।


 

সন্ধে বেলায় ডুয়ার্সের এই চা বাগানের অফিসার্স  বাংলোতে  একা বসে টিভি দেখছিল অমল ।  ডি.টি.এইচ কানেক্সান আর টিভিও কোম্পানির ।
মূল চা বাগান থেকে একটু দূরে এই বাগানটা  আউট ডিভিশন নামেই পরিচিত ।  অনেকটা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন , আন্দামানের মত । বাংলোটা তাই একটেরে । পাশে একটা কাঠের উঁচু বাড়ীতে থাকেন আউট হাসপাতালের কম্পাউণ্ডার ।  আশে পাসে চা গাছের সারি । রাতের বেলা চৌকিদার থাকে ।
খবরের কাগজ আসে  আঠেরো কি মি দূরের সদ্য জেলা হওয়া শহর থেকে ।  আসতে আসতে বেলা এগারটা । সেই সময় অমল থাকে ফিল্ডে । মনে হয়, কোলকাতার সূর্য এখানে উদয় হয় বেলা এগারটায়  ! লাঞ্চে, ফিরে উত্তরবঙ্গ সংস্করণের কাগজে চোখ বুলোয় ।

কিষণ এসে জিজ্ঞেস করল- আজ ডিনারমে কেয়া লেঙ্গে সাব ?
ফ্রিজ মেঁ কেয়া হ্যায় ?
য়্যাদা সব্জী নেহী , লেকিন চিকেন হ্যায় সাব !
ঠিক হ্যায়, চিকেন কারি অওর চাওল বনাও । শুনো- ফ্রিজ সে বরফ ,পানি অওর কাবার্ডসে হুইস্কিকা বটল লানা , সাথমে গ্লাস । স্যালাড‌্ ভি বনাকে লানা । কল, কিসি কো ভেজেঙ্গে বাজার মেঁ ।
ইদানীং এই তথাকথিত বদ অভ্যেসটা হয়ে গেছে  তার । অবশ্য কিনতে হয় না । বিভিন্ন ম্যানেজাররা কোলকাতার হেড অফিসে গেলে উপহার পান । তার থেকে জুটে যায় অমলের ।


সেল ফোনের শব্দে চটকা ভাঙল অমলের । সিনিয়র অ্যাসিটাণ্ট মানেজার মিশ্রজীর ফোন নং টা ভেসে উঠলো সেল ফোনের স্ক্রীনে ।
 গুড ইভনিং স্যার !
গুড ইভনিং ! শুনো বোস, কল বিএলআরও কো লোগ আয়েঙ্গে । গার্ডেনকা  জো জমিন হ্যায়, ও কুছ সিভিল লোগোঁনে ক্যাপচার কর রক্খা হ্যায় । উধার আভি স্যাপলিংস্ লগানা হ্যায় । মৈঁ আপকো, পর্চা ভেজতা হুঁ অভি, ও জরা সাথ মেঁ রখনা । কাম মেঁ আয়েগা শায়দ ।
ইয়েস স্যার !

এই কয়দিনে অমল বুঝে গেছে কোম্পানি কালচার । দেখা হলেই বা ফোন এলে উইস করতে হয়।
সকাল সাতটা থেকে ডিউটি শুরু  । আউট ডিভিশনে একটা চক্কর মারে অমল । একটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মোটোর সাইকেল কিনে নিয়েছে আপাতত ।  পেট্রলটাও পাচ্ছে কোম্পানি থেকে।
মিশ্রজি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ।

চা বাগানে তোলা চা পাতার ওজন হচ্ছে । স্থানীয় ভাষায়- মেলা । তা মেলাই বটে । বেলা বারোটায় কাজ শেষ ওয়ার্কারদের । মধ্যে  এক ঘন্টা খাওয়ার ছুটি, তারপর আরও দু থেকে তিন ঘন্টা চলে দুটো পাতা, একটা কুঁড়ি তোলার কাজ ।
নতুন চা গাছ লাগান দরকার । বেশীর ভাগ চা গাছ প্রায় একশো বছরের ওপর পুরোনো । তাই ফলন কম ।
সাড়ে এগারটা নাগাদ , বিনাপুর লাগোয়া বাগানের জমিতে বিএলআরওর লোকজন এসেছে ।
শাসক দলের স্থানীয় এক নেতা কি সব বোঝাচ্ছে ওদের ।

একটা জায়গায় দোকান করার তোড়জোড় চলছে, গুয়াটেমালা গ্রাস কেটে  । অমল গিয়ে বলল :- একি ! আপনারা বাগানের জমিতে  দোকান করছেন কেন ?

নেতা মাড়ী বের করা হাসি হেসে বলল :- ওই যে আপনাদের বড় সাহেব, আমাদের দুর্গা পুজোর চাঁদা হাজার টাকা দিয়েছেন ! তাই । চাঁদাটা বাড়াতে বলুন, আমি চলে যাব । না হলে কিন্তু, ওয়ার্কাররা ঝামেলা বাধাবে ।

বিএলআরওর লোকেরা চুপ । অমল পর্চা দেখিয়ে বলল এই দেখুন, আমাদের এটা রেকর্ডেড জমি বাগানের । এটা ইলিগাল এনক্রোচমেন্ট ।

অবাক হয়ে দেখল অমল, তাও কথা  সরছে না ওনাদের ।
হঠাৎ কোত্থেকে বুধিয়া সোরেন মাটি ফুঁড়ে দাঁড়াল, কিছু ওয়ার্কার নিয়ে ।
তুরা টাকা লিয়ে কি করিস হামাদের জানা আছে । বেশী কথা বলবি না ।  ই মাটি হামাদের খেতে দেয় । ঝামেলা করবি তো হামরা  একশো লোক লিয়ে তুর কেলাবে ঝামেলা করব , বুঝলি ? ওই দিক যানা কেনে, দুকান করবি তো !

নেতা একটু পেছিয়ে গেলে , আপিসের বাবুরাও নড়ে চড়ে বসল ।
মিশ্রাজী কোথা থেকে খবর পেয়ে চলে এসেছেন ।
নেতাকে বললেন :- আপ অগর হাজার রুপেয়া লেঙ্গে তো ঠিক হ্যায় । আশপাশ অওর ভি পুজা হোতা হ্যায় । সব কো দেনা পড়তা হ্যায়, সমঝে নেতাজী ?

বুধিয়া ঘাড় নেড়ে বলল ঠিক! নেতা বেগতিক বুঝে মোটোর সাইকেলে ষ্টার্ট দিলেন।

বুধিয়া সোরেন থুতু ফেলে বলল শালা !

একটু পরেই বড় সাহেব ফোন করলেন অমলকে :- গুড ইভনিং । ওয়েল ডান । নাও প্লিজ কাম টু দা অফিস । আই হ্যাভ এ গুড নিউজ ফর ইউ ।
আজই কনফার্মেশনের চিঠি পেল অমল ।  

তপতীর সাথে তার প্রেমটা অনেকদিনের । শান্তি নিকেতনের দু বছরের জুনিয়র তপতী । কলেজেই পরিচয় । মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে তারই মত । বার্ণপুরে বাড়ী ওদের ।  ইদানীং আর ফোন করা হয়ে ওঠে না । তপতী মাঝে মাঝে ফোন করে ঠোঁট ওল্টায় অভিমানে । দু পক্ষের অভিভাবকরা জানলেও , এখনই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ছিল না দু জনেরই । মাকে ফোন করে কনর্ফামেশনের খবরটা জানিয়ে, তপতীকে ফোন করল ।

বাব্বা, সাহেবের ফুরসত হলো ! তপতীর ফিরতি জবাব ।

অত জানি না !  তুই  আমার সারাজীবনে, শেড ট্রি হয়ে থাকবি ? জবাব দে ।
কেন রে ? এত তাড়া কিসের, আর তা ছাড়া তোর ওই ধ্যাদ্দাড়া ডুবপাড়া যাব না আমি। বয়েই গেছে আমার ।

আমি এখন নিজেই চা গাছ, এই খানেই প্ল্যান্টেড হয়ে গেছি । আসবি না, বৃক্ষছায়া হতে ?

খিল খিল করে হেসে তপতী বলল যাঃ !

সুবীর কুমার রায়

টেনশন
  
 আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের থেকে দীনবন্ধুবাবুর জীবনটা অনেক সুখে, অনেক শান্তিতেই কাটছিল। বি.. পাশ করেই বেশ ভাল একটা চাকরী পেয়ে যাওয়ায়, জীবনটা আরও মসৃণ গতি পেয়েছিল। স্ত্রী রমলা ও ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। কিন্তু যত গোলমাল দেখা দিল রাঘবের মৃত্যুতে।
রাঘব তার বন্ধু ভৈরব এর ছোট ভাই। তার থেকে বয়সে অন্তত বছর সাতেক এর ছোট। হঠাৎ বুকে যন্ত্রণা শুরু, ডাক্তার আসার আগেই সব শেষ। ডাক্তার এসে নাড়ী টিপে জানায়— “সরি সব শেষ, ম্যাসিভ্ হার্ট অ্যাটাক

খবরটা শোনার পর থেকে দীনবন্ধুবাবুর মনে একটাই চিন্তা, তার থেকে সাত বছরের ছোট একটা লোকের যদি এরকম হার্ট অ্যাটাক হয়, তাহলে তার তো যে কোনদিন এ রোগ হতে পারে। তার কিছু হলে সংসারটা তো ভেসে যাবে। এই চিন্তায় তিনি ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শেষে ডাক্তার এসে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা করে জানালেন, দীনবন্ধুবাবু সম্পূর্ণ সুস্থ। তার শরীরে কোন রোগ নেই। তবে ক্রমাগত এই ভাবে চিন্তা করলে, সত্যিই হার্টের ক্ষতি হতে পারে। সব রকম টেনশন, উত্তেজনা, দুঃখ থেকে দুরে থাকতে হবে। মনে আরও আনন্দ, ফুর্তি আনতে হবে। প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে, কড়কড়ে চারশটাকা ভিজিট নিয়ে, দীনবন্ধুবাবুর মনে টেনশন এর বীজ বপন করে, তিনি চলে গেলেন।
ছেলে শ্যামাচরণ প্রেসক্রিপশন খুলে দেখলো তাতে দুটো মাত্র নির্দেশ লেখা আছে। এক, স্টপ টেনশন, আর দুই, একটা মাল্টি ভিটামিন টনিক।

বাড়ির সবার অনুরোধে দীনবন্ধুবাবু, ডাক্তারের নির্দেশ মতো দুবেলা টনিক খেতে শুরু করলেন,‌ এবং যাতে কোন রকম টেনশন না হয়, উত্তেজনা না হয়, তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কী ভাবে টেনশন কমানো যায়, তা নিয়ে এক নতুন টেনশন শুরু হল।

বাজারে জিনিসপত্রের দাম যে ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাতে তার চিন্তা বাড়তে পারে, টেনশন হতে পারে ভেবে, তার বাজারে যাওয়া বন্ধ করা হল। রাস্তার পাশে ছোট্ট সুন্দর বাড়ি। বাড়ির সামনে সামান্য একটু জমি। জমিটাতে কিছু গাছপালা লাগিয়ে একটা বাগান। সকালে উঠে চা খেয়ে একটু বাগানের পরিচর্যা করা, তারপর স্নান সেরে, খেয়ে দেয়ে অফিস যাওয়া, আর অফিস থেকে ফিরে চা জলখাবার খেয়ে, টিভি নিয়ে তার সময় কাটতে লাগলো।

সকালে একটাই বাস, এবং সেই বাসেই তিনি এতদিন অফিস যেতেন। কিন্তু বাসটা ভাঙ্গাচোরা রাস্তা দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে যায়। রোজই তার মনে হ, বাসটা না উল্টে যায়। এতদিন ঠিকই ছিল, কিন্তু এখন আর ঐ বাসে যাওয়ার সাহস তার হল না। অগত্যা রিক্সায় অফিস যেতে গিয়ে, দেরী হয়ে যাওয়ার ভয়ে রোজ তার টেনশনের পারদ চড়তে শুরু করলো। কাজকর্মও আর আগের মতো নির্ভয়ে দক্ষতার সাথে করতে পারেন না।

একদিন অফিস যাওয়ার সময় তিনি লক্ষ্য করলেন বাগানের বাতাবি লেবু গাছটায়, ছোটছোট বেশ কয়েকটা লেবু হয়েছে। গাছটা একবারে রাস্তার পাশে বেড়ার ধারে হওয়ায়, যে ডালটা বেড়ার বাইরে রাস্তার দিকে বেড়িয়ে আছে, সেই ডালে অনেক বেশী লেবু হয়েছে। রিক্সা করে অফিস যাওয়ার পথে তিনি একটা ব্যাপারে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেনরাস্তার দিকের লেবুগুলো চুরি হয়ে যাবে না তো? যা সব বাঁদর ছেলে মেয়ে। অফিসে কাজে মন বসাতে পারলেন না। সারাদিন চিন্তায় চিন্তায় থেকে, অফিস থেকে ফিরেই আবার লেবু গাছটা ভাল করে দেখলেন। রাস্তার ওপর বেড়ার বাইরে দশটা লেবু হয়েছে। 
সন্ধ্যায় টিভির সামনে বসে তার প্রিয় সিরিয়ালে মন বসাতে পারলেন না। কী ভাবে লেবুগুলো চোরের হাত থেকে বাঁচানো যায়, ভাবতে ভাবতে সিরিয়ালটা দেখলেন। শেষে এই ভেবে শান্তি পেলেন যে, লেবুগুলো এখনও খুবই ছোট। বড় হয়ে খাওয়ার উপযুক্ত হতে এখনও অনেক দেরী, ততদিনে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে।

কী ব্যবস্থা করা যায় ভাবতে ভাবতে রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে উঠেই লেবুগুলো আবার গুণে দেখলেন, হ্যাঁ দশটাই আছে। এই ভাবে রোজ তিনি অফিস যাওয়ার সময় একবার গুণে দেখেন, আবার অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢোকার সময় আর একবার গুণে দেখেন বটে, কিন্তু কোন পাকাপাকি ব্যবস্থার কথা ভেবে উঠতে পারলেন না। শেষে লেবুগুলো যখন সামান্য বড় হ, তখন তার মনে হ, এই লেবুগুলোই তার টেনশনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ডাক্তারের মতে তার পক্ষে বিপজ্জনক। কাজেই এই নিয়মিত টেনশন থেকে বাঁচতে গেলে, লেবুগুলো ছিঁড়ে ফেলাই শ্রেয়। কারণ ভবিষ্যতে যখন লেবুগুলো সত্যিই চুরি হয়ে যাবে, তখন সেই অপেক্ষাকৃত বড় আঘাত, তিনি সহ্য করতে পারবেন না।

পরদিন সকালে গুণে গুণে দশটা লেবুই, গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেললেন। ছোট ছোট বাতাবি লেবু, খাওয়াও যাবে না, তাই ফেলে দিলেন। কিন্তু ফেলে দেওয়ার পর একটু মনোকষ্ট হলেও, পরে তার নিজেকে বেশ টেনশন ফ্রী ও হাল্কা মনে হল।

রোজ সকালে বাগান পরিচর্যার সময় তিনি লক্ষ্য করেন, লেবুগুলো কেমন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, তারপর এক সময় বেশ বড় বড় লেবুগুলো কী রকম হলুদ রঙের হয়ে যাচ্ছে।
একদিন অফিস থেকে ফিরে, বাগানের গেট খুলে বাড়িতে ঢুকবার মুখে বাঁ পাশে দৃষ্টি যেতে তিনি লক্ষ্য করলেন, রাস্তার দিকের ডালে একটা বেশ বড় হলুদ রঙের লেবু। ছোট থাকা কালীন যখন তিনি অন্য লেবুগুলো ছিঁড়ে ফেলেন, এটা বোধহয় তখন পাতার আড়ালে ছিল।

মনমরা হয়ে গেট বন্ধ করে বাড়িতে ঢুকে তিনি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। স্ত্রীর প্রশ্নে আক্ষেপ করে স্ত্রীকে সব কথা খুলে বলে, বললেন কেন যে লেবুগুলো ছিঁড়ে ফেললাম। যে লেবুটা দেখতে পাইনি, সেটা কী সুন্দর বড় হয়েছে। চোরে ছুঁয়েও দেখে নি। তার মানে অন্য দশটাও একই রকম বড় হ, চুরিও হত না। আজ লেবুগুলো থাকলে কত ভাল হত। আক্ষেপ করতে করতে একসময় তার গলা ধরে এল, চোখ দুটো চিকচিক্ করতে লাগলো। স্ত্রী রমলা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাকে শান্ত করবে কে? কান্না মেশানো গলায় তিনি বললেন, ঐ সাইজের এক একটা লেবুর কত দাম, হায়! হায়! এ আমি কী করলাম?

এই ভাবে কিছুক্ষণ হা হুতাশ করার পর, তিনি বুক চেপে ধরে মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। ছেলে ছুটলো ডাক্তার ডাকতে। সেই ডাক্তার আবার এলেন। নাড়ী টিপে ধরে বললেন— “সরি সব শেষ, ম্যাসিভ্ হার্ট অ্যাটাক। চারশটাকা গুণে নিয়ে তিনি চলে গেলেন।



ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

সঙ্গী


শীতের সকালে একা একা মৃতা পঁচাত্তর বছর বয়সের  স্ত্রীর হাত ধরে বসে রইলেন সুমিতশেখর। সুহাসিনীর মৃত্যুকালে তাঁর চার ছেলেমেয়ের কেউই পাশে ছিল না। তখন শীতকাল। সুহাসিনী ঘরের বাইরে বাঁধানো চাতালে বেতের চেয়ারে বসে সকালের চা খাচ্ছিলেন। একদিকে সুমিতশেখর, তিনিও  বসে ছিলেন।  সুমিতশেখর তাঁর স্বামী, যথারীতি সকালের পূজা-পাঠ শেষে পায়ে মোটা মোজা, মাথায় টুপি,গায়ে  পাঞ্জাবীর উপরে একপ্রস্থ গরম জামাকাপড়, তাঁর উপরে শাল মুড়ি দিয়ে সুহাসিনীর পাশে বসে চা খেতে খেতে কথা বলছিলেন। বেশির ভাগ কথাবার্তাই সাংসারিক, মধ্যে ছেলেমেয়েদের কথাও হচ্ছিল। গত কয়েকদিন ধরেই সুহাসিনী কথায় কথায় ছেলেমেয়েদের কথা তুলছিলেন। ক্রমাগত একই কথা  বারবার বলায় বিদ্রুপের সুরে সুমিতশেখর বলে উঠলেনভারি তো ছেলেমেয়েদের কথা ভাব, কই, এতবার করে যে ওদের বললে এখানে আসার জন্য, একজনও এলো? তুমি শুধু ওদের নিয়ে চিন্তা কর, ওরা করে না, বুঝলে?’   

সুহাসিনী এই কথায় দুঃখ পান। আজও পেলেন। ছেলেমেয়েরা থাকে কত দূরে। ঘর-সংসার, নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, স্বামীদের আপিস-কাছারি সব ফেলে মেয়েরা,  বৌমারা কি করে এতদুরে এসে বসে থাকবে? এত  দুরে আসতে গেলে তো আর এক/দুদিনে র জন্য আসা যাবে না, হাতে কয়েকদিনের সময় নিয়ে তবে আসা । তিনি নিজে কি তা জানেন না? তাহলে শুধু শুধু সুহাসিনীকে কষ্ট দেওয়া কেন!  বেশ তো ছিলেন ছেলেদের কাছে। বড় শহরে থাকা, খাওয়া, আরামের তো কোন অসুবিধে ছিল না! ছোট ছেলের কাছে যখন বিদেশে ছিলেন, ছেলে-বৌমা, নাতনি কত করে বলেছিল ওখানে থাকার জন্য। কিন্তু সুমিতশেখরের সেই এক কথা---বিদেশের মাটিতে মরব কি রে, আমার কি নিজের দেশ নেই ?’ যদি ওরা আরো বেশিদিনের জন্য আটকে রাখে, তাড়াতাড়ি তিনমাসের মাথায় চলে এলেন কলকাতায় বড় ছেলের বাড়িতে। তা সেখানেও তো দিব্যি ছিলেন! হেসে-খেলে, শরীর চর্চা করে, বাজারে ঘুরে ঘুরে মাছ, শাক-সব্‌জি কিনে, নাতির সঙ্গে পার্কে খেলা করে তাঁর তো দিন মন্দ কাটছিল না! কিন্তু কি যে হল,  আবার  পালিয়ে এলেন। মানুষটার বোধ হয় এক জায়গায় বেশিদিন মন টেঁকে না।  সব ছেড়ে ফিরে এলেন সেই বাপের ভিটেয়। ছেলেমেয়েরা তাঁদের চাকরি জীবন, সংসারজীবন ফেলে রেখে  এখানে এসে থাকতে পারে ? তাঁর নিজের চাকরি জীবনে তিনি এসে কদিন ছিলেন বাপ-মায়ের কাছে!
সুমিতশেখর এসব যে বোঝেন না তা নয়, তবু বলা চাই, আর এইজন্যই সুহাসিনী মনে মনে কষ্ট পান। সারা জীবন বড় বড় শহরে, ঠাটে-বাটে থাকার পর সুহাসিনীর কি কষ্ট হয়না, এই আধা শহরে এসে থাকতে? কি আছে এখানে, দুটো ভাল করে কথা বলার মত লোক পাওয়া যায় না! কিন্তু সুহাসিনী হলেন  সেই ধরণের স্ত্রী, যিনি স্বামীর কথায় কোনদিন অবাধ্য হবেন না, স্বামীর কথাই শেষ কথা, যত কষ্টই হোক  না কেন, মানিয়ে নেবেন। তবে আর শুধু ছেলেমেয়েদের কথা বারবার তুলে তাঁকে কষ্ট দেওয়া কেন?

সুহাস কি ছেলেমেয়েদের কথায়  তাঁর উপর রাগ করে চলে গেলেন! ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে বিরক্তি প্রকাশ কি তাঁকে খুব বেশী আঘাত দিল? সুহাসিনী চিরদিনই বড় বেশী সন্তানভক্ত। এমন মা বুঝি কোটিকে গুটিকও মেলেনা। সুমিতশেখরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে অত আহ্লাদেপনা নেই। তাঁদের মানুষ করেছ, লেখাপড়া শিখিয়েছ,ব্যস! এবার ছেড়ে দাও। সুহাসিনীর মত কে মাছ ভালবাসে, কে ছোট মাছ খায় না, কার রসগোল্লা পছন্দ, কে কারিপাতা দেওয়া ডাল মুখে তোলে না,এসব মনে থাকে না,অত আদিখ্যেতা ভালও বাসেন না। তাই কি ছেলেমেয়েরা তাঁকে একটু এড়িয়ে চলে? নাতি-নাতনীরাও সুহাসের ভক্ত বেশী। তিনি নিজেই বা কি কম! সুহাসের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন সুমিতশেখর।    
কতক্ষণ কেটে গেছে সুমিতশেখর নিজেও জানেন না। বড় ফটকটার গায়ে  কেউ যেন জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। শব্দ শুনে সম্বিৎ ফিরল সুমিতশেখরের,কিন্তু সুহাসকে ছেড়ে কি করে এখন উঠবেন বুঝতে  পারছিলেন না। শব্দটা কি অনেকক্ষন হচ্ছে! বাড়ির ফটকটা খানিক দূরে। বাঁধানো চাতাল পেরিয়ে কিছুটা ঘাসের লন মত আছে। সুহাসের আবদারেই এটা করতে হয়েছিল। গাঁ-গঞ্জে থাকি বলে কি গাছপালা, ঘরদোর সব অগোছালো করে রাখতে হবে নাকি! ঘরদোর সাজানোয় খুব শখ ছিল সুহাসের। খুব মামুলী জিনিস দিয়েও এত সুন্দর করে সাজিয়ে রাখত, মন জুড়িয়ে যেত দেখলে। শব্দটা আরো জোর হচ্ছে। কেউ কি ডাকছে? সুহাসের হাতটা আরো জোরে চেপে ধরলেন সুমিতশেখর।

(২)

ধপ করে একটা আওয়াজ আর বাড়িতে কাজ করে যে দেহাতী মেয়েটা, যুগিয়া, তার ছোট ছেলেটা লাফ দিয়ে পড়ল এপারে। সুমিতশেখর যেন কিছু দেখেও দেখলেন না। যুগিয়ার ছেলে, যার নাম কিনা টংলু, সেখান থেকেই হাঁক দিল----দাদা, হেই দাদা...হাঁকছি কখন থেক্যে, শুনতে নাই পাও? মা দাঁড়ায় আছে বাহারে..চাবি খুল...

সুমিতশেখরের দিকে ছুটে এল  টংলু। কি বুঝল কে জানে, একছুটে ঘরে ঢুকে একটা ছোট্ট বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে বাইরের ফটকের চাবি নিয়ে তালা খুলল। আর তারপরই শোনা গেল তার চীৎকার--- ও মা,আস্যো আস্যো...দিদির কি হইছে দ্যাখ, কে কুথাকে আছো গ,আস্যো আস্যো...ইদিকে আস্যো গ...
যুগিয়াই ছুটে এলো সকলের আগে। সকালের বাসী কাজ করার জন্যই সে এসেছে। এসে  দ্যাখে এই কান্ড! টংলুকে পাঠাল আশাপাশে বাড়িতে খবর দিতে।

তারপরের ঘটনা দ্রুত ঘটে যেতে লাগল। একেবারে যেন ঘড়ির কাঁটা ধরে। আশেপাশে বাড়ির লোকজনেরা  এলেন,সুহাসকে ঘরের ভিতর খাটে শোয়ানো হল। ছেলেমেয়েদের খবর দেওয়া হল। বিকেল নাগাদ বড় ছেলে, বৌমা, নাতি আর ছোট মেয়ের দলবল এসে হাজির হল। সুমিতশেখরের জন্য শোবার, বিশ্রাম করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কিন্তু সুহাসের পাশে বসে একটি হাত ধরেই তিনি বসে রইলেন আগের মতই। সুমিতশেখর কি কিছু বুঝতে চাইছেন, কোন প্রশ্ন আছে তাঁর সুহাসের কাছে, নাকি তিনি ক্ষমাভিক্ষা করছেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুঃখ দিয়েছেন বলে, কটু কথা বলেছেন বলে? সুমিতশেখর যেন সেটাই জানতে চান।

সুহাসকে নিয়ে যাবার সময় মেয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। একবার তাঁকে অন্য ঘরে নিয়ে যাবার চেষ্টা  করল। সুমিতশেখরের মুঠি আরো দৃঢ হল। যুগিয়া পায়ের কাছে কাঁদতে লাগল ---মা ঠাকরুণ  নাই বাবা, যাত্যে দাও উনাকে...।‘

শেষে টংলু এসে হাত ধরল সুমিতশেখরের---দাদা, আমি যাব্যো, তুমি চল আমার সঙ্গে।সুমিতশেখর কিছু বুঝি বলতে চান। যুগিয়া বলে উঠল---চল বাবা, আমরা যাব্যো।

শববাহকদের সঙ্গে যেতে কষ্ট হবে ভেবে মেয়ে জামাই তাঁকে গাড়ীতে তুলে নিতে চাইলেন। সুমিতশেখর কোন কথা না বলে টংলুর একটা হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন।
পড়ন্ত বিকেলের আলোয় সুহাসের পাশে পাশে শ্মশানযাত্রীদের সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন সুমিতশেখর। একহাতে ধরা রইল টংলু আর পিছনে তাঁকে সাবধানে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল যুগিয়া। শেষজীবনের সঙ্গী তো এরাই!

ঢালের কাছে এসে শক্ত করে টংলুর হাত ধরলেন সুমিতশেখর।