গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০১৪

৩য়বর্ষ ১৭তম সংখ্যা ১৬জুলাই২০১৪

এই সংখ্যায় ৭টি গল্প ও ১টি ধারাবাহিক গদ্য । লিখেছেন ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, অরিন্দম চন্দ্র, মুস্তাইন সুজাত, দোলনচাঁপা ধর, অদিতি ভট্টাচার্য, দেবাশিস কোনার , অসিত ঘোষ ও মৌসুমী ঘোষ (রায়) ।

                        পড়ুন সূচিপত্রে ক্লিক করে

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


ধারাবাহিক গদ্য

জেনানা ওয়ার্ডের গল্প

(১) জেলখানার জেনানা ওয়ার্ডের মেয়ে কয়েদীদের লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে প্রথম দেখেছিলাম নুসরত বানুকে। এ তার আসল নাম নয়, আমিই পালটে দিয়েছি। এখন আর জেলখানাও বলে না, বলে সংশোধনাগার। একটি মফস্বল শহরের জেলা সংশোধনাগারে মেয়েদের ওয়ার্ডের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব বর্তালো আমাদের গুটিকয়েকের ওপরে। দায়িত্ব কেউ তুলে দেয়নি। আমরা নিজেরাই কয়েকজন মিলে কিছু একটা করার তাগিদে সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। তারপর যা হয়...এখানে চিঠি-চাপাটি, ওখানে চিঠি-চাপাটি, এখানে অনুমতি, ওখানে অনুমতি এমনি হাজার কাঠখড় পুড়িয়ে, হাজার নিয়ম পার হয়ে অবশেষে মিলল আমাদের জেলের ভিতরে যাবার ছাড়পত্র। তারপর থেকে এটা আমাদের রোজকার জীবনে একটা রুটিন হয়ে গেল বলা যায়।

জেলা শহরের সংশোধনাগার। বিরাট তার এলাকা, হাজার রকম তার নিয়ম-কানুন। কতগুলো গেট পার হয়ে যে ভিতরে যেতে হয় ! এক এক করে গেট খোলে, আর আমরা সেই রাস্তা টুকু পার হয়ে আরও এক গেটের সামনে এসে দাঁড়াই। মেন গেটে জমা দিতে হয় মোবাইল, হাতের সব কিছু। সই করে ঢোকা, সই করে বাইরে আসা। পরিচয় পত্র দেখানো এমনি সব নানান নিয়মের বেড়াজাল। নয় নয় করেও আছেন বেশ কিছু পুরুষ ও মহিলা বন্দী। রোজই তাদের বাড়া-কমা চলে। নতুন কেউ এসে পড়েন, আবার অন্যরা কেউ চলে যান অন্য কোন সংশোধনাগারে বদলি হয়ে কিংবা ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে যান। যাবজ্জীবন দন্ডে যারা অভিযুক্ত, তারা এখন আর জেলা সংশোধনাগারে থাকেন না। তাদের জন্য নির্দিষ্ট আলিপুর সেন্ট্রাল জেল। কতরকমের মানুষ, কতরকমের চরিত্র যে দেখলাম ভাবলে অবাক লাগে। পুরুষ বন্দীদের দেখি শুধু বিকেলে খেলার মাঠে, আমরা যখন সেইসময় মেয়েদের ওয়ার্ড থেকে ফিরে আসি, তখন। সেই সময় বিকেলে মাঠে খেলার সময়। সারা মাঠ জুড়ে তখন খেলার আসর। কোথাও ভলি বল, কোথাও ফুটবল, কোথাও ক্রিকেট। মেয়ে বন্দিনীরা নিজেদের এলাকার বাইরে আসতে পারেন না। কিন্তু রাস্তার দুধারে ভিড় করে অনেক পুরুষ বন্দী যারা নিজেরা খেলেন না কিন্তু অন্যদের খেলা দেখেন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমাদের দেখলে রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ান, পার হবার জায়গা করে দেন। দেখলে কে বলবে এরা অপরাধী! চোর, ডাকাত, খুনী আরও কত রকমের জঘন্য অপরাধ!

মেয়েদের ওয়ার্ড ছোট। জনা পঞ্চাশেক থাকার মত। কিন্তু দোতলা বাড়িটিতে মনে হয় আরো থাকার মত জায়গা অনায়াসেই জুটবে। তাদের আর চাই না, কিন্তু প্রয়োজনে থাকার মত জায়গা আছে। চারিদিকে উঁচু পাঁচিলের ভিতরেই আলাদা করে আরো উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বিরাট গেটে বিরাট তালা ঝোলানো থাকে সবসময়। ভিতরে-বাইরে পুলিশ মোতায়েন থাকে। ভিতরে মেয়ে রক্ষী, বাইরে পুরুষ রক্ষী। বাইরের ঘন্টি বাজলে ভিতর থেকে গেটের মধ্যে অল্প ফাঁক করা জায়গা দিয়ে দেখে নেয়, তারপর দরজা খোলে। আবার ভিতর থেকে বাইরে আসার সময়েও ভিতর থেকে ঘন্টি বাজলে ভিতরের তালা খোলার পর বাইরের তালা খোলে, গেট ফাঁক হয় অল্প করে, আমরা একে একে বেরিয়ে আসি ভিতর থেকে। তার আগে লাইন দিয়ে গুনতি করে মেয়েদের ভিতর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে গ্রিলের বড় গেটে তালা পড়ে। এমনি আরো কত কি নিয়ম! অবাক হই ভেবে--এত রকমের বিস্ময় জমা হয়ে ছিল আমাদের জন্য!

মফস্বল জেলা শহরের সংশোধনাগারের বেশির ভাগ মহিলা কয়েদীরাই আসেন আশে-পাশের গ্রাম গঞ্জ থেকে যার অধিকাংশই বধূ-হত্যা, পণ দেওয়া-নেওয়া এসব মামলার আসামী হিসাবে। শহরের বার-রেস্টুরেন্টের ড্যান্সিং গার্ল রাও আসেন যখন পুলিশের কড়া নজরদারি চলে। পতিতাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত মেয়েরাও আছেন, সংখ্যায় তারাও কিছু কম নয়। দু/চার জন বাংলাদেশী মহিলা বা স্বল্পবয়স্কা মেয়েও আছেন যারা কাঁটাতার পেরিয়ে এপারে খদ্দেরের সঙ্গে ওঠা বসা করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। বিহার-ইউপি তে নানান মেলায় নাচাগানা করতে গিয়ে ট্রেনে ধরা পড়েছেন এখানের কাছাকাছি কোন ষ্টেশনে, অগত্যা এই সংশোধনাগারে স্থান হয়েছে, এমন নাচনেওয়ালীও দু/একজনেকে দেখেছি। নুসরত বানুও এই মেয়ে কয়েদীদের একজন। না, লুকিয়ে ট্রেনে ফেরার পথে ধরা পড়ে এখানে আসার মত কেস তার নয়। বাড়িতে অভাব, বাবার মদের ঠেকে রাতদিন পড়ে থাকা। সংসারে ভাতের প্রয়োজনে বাবাই তার মেয়েকে নামিয়েছে এই রাস্তায়। নুসুরতের প্রথম হাতেখড়িও বাবার সাহায্যে বাবার ইয়ার-বন্ধুদের দ্বারাই। চলছিল এভাবেই প্রায় বছর দুয়েক। তারপরে একদিন খদ্দেরের আবদারে কোন এক সন্ধ্যার অন্ধকারে খোলা মাঠে বসেছিল তারা কয়েকজন। পুলিশ তাড়া করলে সকলেই পালাতে পারলেও নুসরত বানু পালাতে সক্ষম হয়নি। পুলিশের হাতে ধরা পরার পর থেকে তার স্থান জেলা শহরের এই সংশোধনাগার।


অরিন্দম চন্দ্র


এক বালকের আখ্যান

         বালক ও বালিকা সমুদ্রতীরে বেড়াইতে আসিয়াছে,সঙ্গে তাহাদের তরুণী কন্যা বালক ও বালিকার উভয়েরই দ্বিতীয়বার বিবাহ, তাই পাঠক আন্দাজ করিয়া নিবেন সব কিছু ইহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না।যাহা হউক,দ্বিপ্রাহরিক সঙ্গমকালে বালক ও বালিকার মধ্যে কিঞ্চিত বাদানুবাদ হয়,যাহা বালিকাকে বাধ্য করে উহাদের তরুণী কন্যার ঘরে স্থানান্তর করিতে এবং তথা হইতেই এই বিড়ম্বনার উৎপত্তি। বালক, বালিকা ও তাহাদের কন্যা সন্ধ্যার পর সমুদ্রতীরে গিয়া বসিল।বালক অতি ক্রুদ্ধ,সাগর পাড়ে অধুনা নির্মিত খট্টাঙ্গ ছাড়িয়া সমুদ্র তীরের প্রস্তরখণ্ডের উপর বসিল,বালিকা ও তাহাদের কন্যা খট্টাঙ্গে বসিয়া নাসিক্য বর্ণে গান জুড়িল।ইহা কবিগুরু রচিত গীতমালা,তাই ইহার সম্বন্ধে লেখকের মন্তব্য অসংখ্য চপেটাঘাত আনিতে পারে,তাই বালককে আপনার স্থানে ছাড়িয়া দেওয়াই বাঞ্ছনীয়

        বালক ইতোমধ্যেই কারণবারির সুবাদে যথেষ্ট নাবালক হইয়াছিল,আর সমুদ্র দেবতাও তাহা বুঝিতে পারিয়া অজস্র ঢেউ প্রস্তরখণ্ডের উপর আছড়াইয়া ফেলিতছিল।ইহা বালকের অসমাপ্ত সঙ্গম হেতু ক্রন্দন না সমুদ্র দেবতার ক্রোধোচ্ছাস,তাহা আমি বলিতে পারি না,কিন্তু প্রকৃতির শোভায় সাময়িক পুলকিত হইয়া বালক সমুদ্রের আরও নিকটবর্তী একটি উপলখণ্ডে বসিল এবং তাম্ব্রকূট জ্বালাইয়া সুখটানে মগ্ন হইল।তাহার চেতনায় তখন নব নব দার্শনিক বোধের উদয় হইতেছে,তথাপি বালিকার দ্বিপ্রহরের দু-একটি কথার স্মৃতিচিহ্ন তাহাকে জীবনবিমুখ ও হতাশ করিতেছিল এবং তাহার কেবলই মনে হইতেছিল এই প্রবল জলোচ্ছাস যদি তাহাকে আজই গ্রাস করে তবে বালিকার প্রাণ জুড়ায়,তাহার নিজেরও,যদিচ মৃত্যুকালে কাহার কি ভাবে প্রাণ জুড়াইবে তাহা বালকেরও অজানা,বোধ করি লেখক ও পাঠকও তাহা ঠিক মত জানেন না। আজ গুরুপূর্ণিমা,তাই সমুদ্রের জলোচ্ছাস ক্রমে বাড়িয়া চলিতেছে রাত যত বাড়িতেছে আরও ফেনিল ঊর্মিমালা প্রস্তরখণ্ডগুলিকে চূর্ণ করিয়া দিতে উদ্যত হইয়া প্রবল পরাক্রমে ধাইয়া উঠিয়াছে এমতঃ, বালক কিঞ্চিত ভীত হইল পিছনে তাকাইয়া দেখিল কেহ তাহাকে ডাকে কি না,বালক বাঙ্গালী কি না । 

        কেহ ডাকিবার নাই দেখিয়া তাহার পৌরুষ আহত ব্যাঘ্রের মত ক্ষেপিয়া উঠিল,বীরদর্পে আরেকটি তাম্ব্রকূট জ্বালাইয়া বালক মনে মনে মার্ক্স,ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ ও পোস্ট-মর্ডানিসমের তত্বগত মিলনের বিষয়ে তাত্বিক আলোচনা জুড়িল

         সমুদ্রের দেবতার বুঝি কিছু অন্য অভিপ্রায় ছিল প্রবল ফেনিল স্রোত আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল,সফেন বীচিমালার ধূম্রজাল সমুদ্রতটকে আচ্ছন্ন করিল।বালকের চেতনা যখন দূর নীলিমায় মগ্ন সহসা সে আবিস্কার করিল যে সে এক্ষণ বড় মুক্ত ও স্বাধীন,যাহা বালিকার স্নেহচ্ছায়ায় পাওয়া দুস্কর। উপরন্ত, তাহার উপরোক্ত চিন্তাজাল শুধু মিলাইয়াই যায় নাই,সম্পূর্ণ নির্মোহ তন্ময় এক ভাব আসিয়াছে।বালক কিঞ্চিৎ দূরে তাকাইয়া দেখিতে পারিল সমুদ্রতীরের প্রস্তরখণ্ডের উপর একটি ঘুমন্ত মানুষের দেহ। সে ছুটিয়া গেল। লোকটিকে তাহার খুব চেনা মনে হইল,কোথায় দেখিয়াছে ঠিক মনে পড়িল না।ঘুমন্ত ব্যক্তির ললাটে ফাটা দাগ দেখিয়া সে শিহরিত হইল,বাল্যকালে পড়িয়া গিয়া তাহারও তদ্রুপ চিহ্ন ছিল।সহসা মনে হইল তবে কি সে...?? একটি ভিজা ভিজা ভাব তার চেতনাকে গ্রাস করিল।হারামজাদা মাতাল,এখানে এসেও আমাকে শান্তি দেবে না,ঢাল বুঁচকি আরও জল।”...বালকের চেতনা ফিরিল । প্রতিজ্ঞা করিল আর কোন দিন সে মার্ক্স নিয়ে কিছু ভাবিবে না।


মুস্তাইন সুজাত


ক্ষুধা


এক

ক্ষুধা যেন চাগার দিয়া উঠে নছরআলির । পেটে খেলে তবে না পিঠে সয় !
রাক্ষইস্যা ক্ষুধা তার । অল্পে মেটে না এই ক্ষুধা । ভুখা পেট, কতদিন যে আয়েশ পুরে খায় না ? ভাবতে গেলেই চোখে জল আসে । আফসোসের জল ।
ইউনিয়ন পরিষদের চওড়া বারান্দা ।একটা পিলারে পিছমোড়া দিয়ে বাঁধা নছর আলি। হাত পাঁচেকদূরত্বে কাঠের নড়বড়ে টুলে বসে আছেহাড় জিরজিরে ময়ব চৌকিদার । ঝাঁঝালো রোদ আর অস্থির গরমে চারদিক কাতর । গাছের পাতা নেতানো আর স্থিরনৈঃশব্দতা । চৌকিদারের গায়ের গেঞ্জিটা পুরনো হতে হতেহালকা হলদে রঙ ধরেছে ।ঘামে ভিজে গিয়েলেপটে আছে চামড়ায় । তার পাঁজরের হাড় ২০০হাত দূরে থেকেও ঠিক ঠিক গুনে ফেলা যায় । নছর আলিকে পাহারা দেবার জন্য বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে । একটু পরপর চৌকিদার আর নছর আলি পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে আর চোরাদৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে তাদের মধ্যে । যে পিলারের সাথে নছর আলি বাঁধা আছে ওটা কংক্রিট ঢালাই দেয়া, ১০ বাই ১০ । হাতে চিকন দড়ির বাঁধ ।কয়েক গাছি সুতা একসাথে করে দড়ি পাকিয়ে নেয়া হয়েছে । একটু টান খেলেই ছিঁড়ে যাবে । দড়িরবাঁধ ছিঁড়ে দৌড় দিলে ময়বচৌকিদারের ক্ষমতা নেই ঠেকানোর। কিন্তু নছর আলির সে ইচ্ছা হয়না । বরং তার ক্ষুধা পায়, প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং সে ভাত খেতে চায় ।

দুই
এই অঞ্চলে হাতেনাতে চোর ধরা পরলে ভয়ঙ্কররকমএক শাস্তি দেয়া হয় ।প্রতি হাত থেকে মধ্যমা এবং কনিষ্ঠা আঙুল বেছে নিয়ে নখের গোঁড়ায় সুঁই ঢুকানো হয় । আর এতে সাধারণ সুঁই ব্যবহৃত হয়না; অতি চিকন, সোনামুখি সুঁই লাগে । এই বিধান কখন কে যে শুরু করেছিল কেউ বলতে পারে না ।তবে চলে আসছে ।একাজের জন্য এলাকার সবচেয়ে সাহসী মানুষ খবির খাঁকে ডেকে আনা হয় আর আঙুলে পুরার কাজটা অতি সাবধানে সারেনতিনি । সুঁই ফুটানোর তীব্র ব্যথায় অপরাধী কুঁচকে যায়, খবির খাঁ দমে না ।
অবশ্য নছর আলিকে শেষ পর্যন্ত এর কিছুই করা হয় না । কেন হয় না ? এর কোন সুনির্ধারিত কারনও খুঁজে পাওয়া যায় না । 


তিন

মণ্ডল বাড়িতেসিঁদ কাটতে গিয়ে গত রাতে ধরা পড়েনছর আলি । শাস্তির এন্তেজামও হচ্ছিল নিয়ম মোতাবেক । কিন্তু চৌকিদার মারফৎ খবর পেয়েই চেয়ারম্যাননছর আলিকে নিয়ে আসে ইউপিতে, নিজের করায়ত্তে । এই প্রথম তরুণ চেয়ারম্যান প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় । অনেকেচেয়ারম্যানকেসাধুবাদ জানায়; কেউ কেউ গতানুগতিক প্রথার বিরোধিতা করায় চেয়ারম্যানকে শাপান্ত করে ।

চার

‘চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না পরে ধরা’ কথাটা বেজায় সত্য যেমন জানে সবাই, নছর আলিও জানে ।
চুরিবিদ্যার হাতেখড়ি দশ বছর বয়সে এবং মুলত নছর আলিসিঁদেল চোর । এই ষাট বছর বয়সেও টনটনে হাতের কাম । দীর্ঘ চুরির জীবনে মাত্র একবার ধরা পড়েছিল । অবশ্য ধরা পড়ার কারণও ছিল একটা । চুরি করতে গিয়ে বাড়ির রান্না ঘরে ঢুকে যখন মাংস-পোলাওয়ের গন্ধ পায়, তার ক্ষুধাটা চাড়া দিয়ে উঠে । খাওয়া শেষে অন্ধকার ভেদ করে মাটির সাংকিটা রাখতেগিয়েইঘটে যত বিপত্তি । সাথীরা চলে এলেও নছর আলি বের হতে পারেনিসেদিন ।ঠিক আটকে যায় ।ক্ষুধাচক্রে আটকে যায় ।
এরপর আর কোনদিন কেউ তাকে আটকাতে পারেনি ।এই শেষ বেলা, জীবনের একেবারে শেষ সময়ে এসে গতরাত ধরা খেল । তাও কি ধরতে পারতো কেউ ? বয়স্ক চোখের অভিশপ্ত ছানিটা ধরিয়ে দিল তাকে । কখনো আধ পেটা, কখনো ভুখা পেটা; মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলছে এভাবেই । ক্ষুধার তাড়নায় গত রাতে গিয়েছিল মণ্ডল বাড়িতে । রমজান মণ্ডলের মেয়ের বিয়ে ছিল গেলহপ্তাহে । রোস্ট-কোরমা, পোলাও-জর্দা, মাংস-দৈ এ সারাটা গ্রাম যেন গন্ধে মৌ মৌ করছে এখনো । তিন গ্রাম পর থেকে নছর আলির নাকে গন্ধ লাগে আর সাথে সাথে ক্ষুধাটা চাগাড় দিয়ে উঠে । অবশ্য গন্ধটা যায়বিয়ে বাড়িতে দাওয়াতি মেহমানদের কথার পিঠে সওয়ার হয়ে । সেই গন্ধে পেটটা তার মোচর খায় আর জিভ জলে ভরে ।

সবই ঠিক ছিল । রান্না ঘর দিয়েইঢুকেছিল । চোখের সামেন কিছুই পায়নি । চারদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । অথচ ভেতরে আসতেই একটা সুস্বাদু গন্ধ নাকে ঠেকে । এগিয়ে যায় গন্ধটা নিশানা করে । ছানি পড়া চোখে ঘরের দেয়ালের পাশে রাখা ফ্রিজটা আবছা দেখতে পায় । ডালাটা খুলতে গেলেই ক্যাঁচ করে শব্দ হয় আর ভেতরের আলোটা ঠিক চোখে এসে পরে । ঘরটা চকিতেফর্সা হয় । নছর আলি ভয়ে কয়েকপা পেছাতেই কার যেন পায়ে পা লাগে । ঘুম পাতলা কাজের মহিলা তড়াক করে উঠে পড়ে আরগায়ের জোড়ে চিৎকার তুলে,
চোর চোর । ঘরের মাইজ্জে চোর হামাইসে ।

পাঁচ

বেলা দ্বিপ্রহর । একটু আগে নছর আলির হাতের বাঁধ খুলে দেয়া হয়েছে । চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ভাত-মাংস রান্না করে পাঠানো হয়েছে । চোখ চক চক করছে এবং সে এখন খাবে । অদূরে কাঠের বেঞ্চিটার উপর বসে আছে ময়ব চৌকিদার । নছর আলি তাকে ইশারায় ডাকে। ময়ব চৌকিদার নড়েনা কিংবা নড়তে চায় না । ভাবে, কি না কি করে বসে আবার, চোরের মতিগতি ? এদিকে তার পেটেও অসহ্য ক্ষুধা । সকাল থেকে না খাওয়া চৌকিদারের ক্ষুধার জ্বালা আর কেউ না বুঝলেও নছর আলি ঠিক ঠিক বুঝতে পারে । চতুর্থ ডাকে চৌকিদার এগিয়ে আসে এবং এদিক সেদিক তাকিয়ে বসে পড়ে নছর আলির সাথে । নছর আলি চৌকিদারের পাতে খাবার তুলে দেয় । ওরা তৃপ্তি ভরে ভাত মাখায় ।মাংসের ঘন ঝুল আর ইরি ধানের ভাত লেপটালেপটি হয় পাতে । নলা মুখে পুরেই কাঁচা মরিচে একটা কামড় বসায় নছর আলি আর আয়েশে চোখ বুজে । আর তৎক্ষণাৎচোখর সামনে ভেসে উঠে গত হওয়া স্ত্রীর অনাহারী মুখটা । চোখ খুলতেই এক ফোঁটা অশ্রু টপ করে পড়েমাটিতে ।

আপাতত নিজের পাতে মন দেয় নছর আলি । গোগ্রাসে ভাতের দলা মুখে পুরতে থাকে একের পর এক । জীবন কেবল যার ক্ষুধাচক্রে বাঁধা তার আবার কিসের অতীত, কিসের ভবিতব্য !






দোলনচাঁপা ধর

বন্ধন

সকালের নরম সূর্য এখন মাথার উপর,যদিও এই ভরা শীতে তার আমেজটা মন্দ লাগছিল না বংশীর।তার গ্রাম থেকে পাকা সড়ক মাইল খানেকের পথ সেখান থেকে রেল স্টেশন আবার সাড়ে তিন মাইল,আগে আগে এই পথটাও হেঁটেই পার করতে হত তবে তারপর ভ্যান আর এখন তো বাইক ভ্যান যার ডাক নাম নাকি লাদেন তাই হয়েছে ওর নাম লাদেন কেন তা নিয়ে বংশীর খুব কিছু মাথা ব্যাথা নেই কারণ ঈশ্বরের ইচ্ছায় পা দুখানা থাকতে সে কাছে পিঠে যেতে আর কোন কিছুর উপর ভরসা করে না । ভরসা না করার আর এক কারণ হল ভাড়ার টাকার অপ্রতুলতা, তার দিন আনি দিন খাই এর সংসার চাকায় তালি মারা সাইকেলের মত চলে কোনমতে খুঁড়িয়ে,তার মধ্যে ভ্যান চড়া তার কাছে বাবুগিরি ছাড়া কিছু না

চ্যাটার্জি বাবুরা যেদিন কাঠের ব্যাবসা ছেড়ে প্রোমটারই শুরু করলেন বেশী লাভের চেষ্টায় সেদিন থেকেই বংশীর অকাল অবসর,এমনিতে বরাবরই সে ভোলা ভালা গোছের আর তা নিয়ে বউএর গঞ্জনাও কম শুনতে হয়নি চটপট কোন একটা কাজ জুটিয়ে ফেলা তার পক্ষে অসম্ভব,এদিকে বাড়িতে খাওয়ার লোক নয় নয় করে নয় জন,চারটি ছেলে মেয়ে নিয়ে তারা স্বামী স্ত্রী তে ছয় জন,বাবা , মা, আর মুক্তা তার বিধবা বোন।বাবা সারাদিন হাঁপায়,সেই কবে যখন রং এর কারখানায় কাজ করত তখন কি গ্যাস লেগে পর্যন্ত এই রোগ,আর মা সারাদিন বিলাপ করে আজকাল, কাকে যে এত গাল দেয় দিনভর বংশী তা জানে না। সংসারের হাল দেখে পারুলকে তাই মজুমদার গিন্নী ডেকে বললেন- ----- বাছা সেই যখন গতর খাটিয়ে খাচ্ছ তখন শহরে গেলে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পেতে,সোয়ামীর কাজ যাওয়া ইস্তক তো হাঁড়ির হাল দেখছি, তাই বলা

রাতে মুক্তার সঙ্গে পারুল অনেক পরামর্শ করে স্থির করল, যাবে তারা শহরে, এভাবে সত্যি দিন কাটে না,ননদ ভাজে গেলে ভয়টাও কম।সেই মত মজুমদার গিন্নিকে সব বলে কয়ে তৈরি হয়ে পরদিন ভোরের ট্রেন ধরতে স্টেশনে পৌঁছতে ওরা বেশ অবাক হয়ে গেল,ওদেরই মত কত মেয়েরা এসে জুটেছে, সবার গন্তব্য এক।অদ্ভুত এক ভরসা আসল মনে,সকলের সাথে নিজেদের কোথাও একটা মিল খুঁজে পেল ওরা আর কদিন যেতে না যেতেই ওরা সব এদের বিনিদি, ভারু বৌদি,সুন্দুরি দি,তাপসী কাকি আরও কত কি হয়ে উঠল একে একে

রোজ পাঁচটার ট্রেনে যাওয়া আর তিনটের ট্রেনে হই হই করতে করতে আসাতে ওরা বেশ রপ্ত হয়ে উঠল সংসারের অবস্থাও আগের মত নেই,মাথায় তেল, পেটে ভাত,পরনের ভদ্র পোশাক এমনকি তালদির গুনিনের দেওয়া দৈব তেলও এসেছে মুক্তার বাবার জন্য।শাশুড়ির বকবকানিও গায়েব কোন ওষুধ ছাড়াই ভাল দিন গড়ায় তাড়াতাড়ি,পারুল আর মুক্তার দিনগুলোও বছরে গড়িয়ে গেল,মুক্তা এখন শিফন শাড়ি পরে,বেণী বেঁধে কবার সিনেমা হলে ঘুরে এসেছে শশাঙ্কর সাথে,শশাঙ্ক ড্রাইভারই করে নিউ আলিপুরে এক বাড়ি,তাদের ওদিকেই থাকে পাথরপ্রতিমা তে, ভাল ছেলে। পারুল বলেছে যদি মন চায় তবে ভাব করতে দোষ কি ? তা মন মুক্তার সত্যিই চায়,সেই কোনকালে যেন সে সুখে ছিল আর মনে পড়ে না,আজ যদি আবার সুযোগ আসে তাকে ছাড়ে কোন বোকায়? শশাঙ্ক সব জেনেই তাকে পছন্দ করে
,একেবারে নিজের করে চায়,তাই তাকে ফেরাতে পারবে না মুক্তা

বংশী যখন স্টেশনে পৌঁছাল তখন বেলা যায় যায়,আবার যখন সে ফিরবে তখন আঁধার গভীর, কিন্তু এই সময়েই তাকে যেতে হয় মাসে একবার মুক্তার কাছে মুক্তা এখন কালীঘাটে থাকে,শেষ যেবার শশাঙ্কর সাথে সিনেমায় গেল সেই থেকেই,গতর খাটিয়ে খায় তবে এখন আগের মত কম টাকায় খাটে না সে,খদ্দের মালদার হলে সেও টাকা নেয় হাঁকিয়ে,তাই পারুলকে আর শহরে আসতে হয় না।মাসের খরচটা বংশীর হাতেই সে পাঠায় যাতে সংসারটা ভদ্র ভাবে চলে