গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৪

৩য় বর্ষ ৫ম সংখ্যা।।১৯জানুয়ারি ২০১৪।।৫ মাঘ ১৪২০

এই সংখ্যায় ৫টি অনুগল্প এবং আর ৪টি ছোট গল্প , এবং ১টি রম্যরচনা । লেখক সূচি মৌ দাশগুপ্তা, সুবীর সরকার, অর্ধেন্দু শেখর গোস্বামী, গৌতম সেন ও সাঈদা মিমি ।

                           সূচিপত্রে ক্লিক করুন

সাঈদা মিমি

পাঁচটি অনু গল্প

বুড়ীটা

সাতসকালে খালিপেটে পাঁচতলা বেয়ে নামাটা অসহ্যকর, প্রতিবারই এমন হয় আমার, রাগটা করলা মত তেতো হতে থাকে। তার ওপর গতরাত থেকেই বিদ্যুত ঝলসানো বৃষ্টি। পানি কাদা বাঁচিয়েও হাঁটার উপায় নেই, বর্গমূলের ফর্মূলায় ছপাৎ ছপাৎ করে কাদা লেগে যাচ্ছে শাড়ীতে।হাতে ধরা ছাতাটা আরেক বোঝা, এ্যাই.. কে যেন কাঁধ ছুঁয়ে গিয়েছে! অদ্ভুত চেহারার এক বুড়ী! চমকে উঠি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। বুড়িটার একটা হাত বিবশ, ঝুলছেসরু লিকলিকে, চিমসে কালোকোত্থেকে এলো ? এই দূর্যোগের মধ্যে কোন জনমানুষ নেই, একটা রিকসাও চোখে পড়ে না, কিন্তু এই বুড়ীটা! হাসলো সে, হাসলো ? ভালো হাতটা দিয়ে কি যেন গুজে দিলো আমার হাতে, “ বাতাসাডা খাইস, তারপর শিশি খুলবি, মাইছ্যা দেও চাইরডা সোনার মাছ দিবো…..” ঘোরাক্রান্ত দাঁড়িয়ে আছি, অল্পক্ষ নাকি অনেকক্ষণ ? বুড়ী নেই।

আলেয়ার মনস্তত্ব

ঘর পালিয়েছে বলে কোন আফসোস নেই আলেয়ার, হতচ্ছাড়া মরদ নয় বছরে চারটে সন্তান দিয়েছে তাকে, আর দুইটা সতিন। ভূখা পেট, সন্তানদের ঘ্যানঘান, স্বামীর পিটুনি, সতিনদের সঙ্গে বিবাদ এসব ভালো না লাগলেও প্রেমিক নেহাল মণ্ডলের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেম করতে ভালো লাগতো তার।নেহাল তার মরদেরই দোস্ত, আলেয়ার সাথে লটরপটরের খবর চাউর হয়ে গেলে কি পিটুনিটাই দিয়েছিলো তাকে সোয়ামী, নেহালেরও ঘরের দেউড়িতে আসা নিষেধ হলো কিন্তু তাতে দেখাসাক্ষাত বন্ধ হলো না। কোমরে শাড়ী ব্লাউজে পোটলা নিয়ে বাড়ী বাড়ী বিক্রী করে আলেয়া, বাঁধা কাস্টোমার আছে তার বাহারী পোষাকের, আয় রোজগার মন্দ নয়। এই সবকিছু নিয়েই নেহালের হাত ধরে ঘর ছাড়লো সে, লুকিয়ে দেখা করাটা যন্ত্রনাদায়ক হয়ে দাড়িয়েছিলো। সবকিছু নিয়ে ঘর ছাড়লো? ভুল, সন্তানদের ফেলে রেখে গেলো যমের দাওয়ায়।

কেবল মা জানে

কেবল মা জানে সন্তানটা কার, যেমন নাসিমা বানু জানেন ছেলেটা তার ভাসুরের ঔরসজাত। লুকাতে জানতে হয়। কি করতে পারতো সে ? মমতাজ সওদাগর বানিজ্যের ধান্ধায় দুরে পড়ে থাকে, এই ভরা যৌবন তাকে পোড়ায়। তারপরও মালেক সওদাগরের সঙ্গে এহেন প্রণয়ঘটিত ব্যাপারটা তৈরী হতো না যদি না মালেকের বৌ চলে যেতো। মালেকের বৌ তাকে ছেড়ে চলে গেলো কার মালেক রোজগার বিমুখ। জজকোর্টের পেশকার সে, ঠিকমত কাজে যায় না, সারাদিন উদাস ভঙিতে পদ্য রচনা করে কিংবা বাগান নির্মা এমন বেহুদা নিমরদকে তালাক দিয়ে দিলো বৌটা। পাশাপাশি বাড়ীর নিঃসঙ্গ দুটি মানুষের কাছাকাছি আসাটা অস্বাভাবিক ছিলো না, কিন্তু দূর্বলতা আর বমিভাবটা প্রশ্ন তৈরী করে ফেললো। প্রশ্নটা গুজবে রূপ নিতে নিতে পাক্কা তেইশ দিন, মমতাজ সওদাগর ফিরলো ঘরে। সামলে নিলো নাসিমা খানম, সে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা, নশ্বর রুপ আর ধূর্ত বুদ্ধির মিশেল দেয়া রমণী। স্বামীর প্রেমে বাউরা হয়ে গেলো, তার সেবা পরিচর্যায়।পড়শীরা পড়লো ফ্যাসাদে, সত্যমিথ্যার প্যাঁচ লেগে গেলো। তবে নাসিমা সুক্ষ হিসেব ভালোই বোঝে, তার কাছে মালেকের প্রেমের চাইতে মমতাজের বিত্তের মূল্য নিঃসন্দেহে অধিক। সুতরাং মালেক সওদাগরকে পরিত্যাগ করলো সে।


সব কাগজেই ছবি থাকে

গুলিস্তানের সস্তা হোটেলে রাজারানীর মতই আছে আলেয়া নেহাল, কেবল পুঁজি ভেঙ্গে চলছে এই যা। আলেয়া চিন্তিত হয়ে পড়ে, নেহালকে জানাতেই সে বললো, ‘কাম কইরাই তো খামু, দুইদিন এট্টু মৌজ কইরা লই এভাবেই চলছে আজ পাঁচদিন। খিদে পেলে বিলাই তকদীরের হোটেল থেকে খেয়ে আসে ওরা, বাকি সময় পলেস্তরা খসানো পেস্ট রঙের চারদেয়ালে। আহা, কি সোন্দর এই জীবন! আলেয়া ভাবে এবং অনাগত দূর্ভাবনা সিন্দুকে রেখে তারা নিজেদের আকাশে তারাবাতি জ্বালায়। ব্যাপারটা ঘটলো ষষ্ঠ রাতে, হোটেলে পুলিশি রেড। এরকম হোটেলে এসব হামেশাই হয়, হয়তো মালিক সেইমাসের বখরাটা সময়মত পৌঁছে দেয়নি।অনেক যুগলের সাথে ধরা পড়লো আলেয়া নেহাল। সাংবাদিকদের ক্যামেরা থেকে কিভাবে মুখ আড়াল করতে হয় জানা ছিলো না আলেয়ার, তার আলুথালু হতভম্ব চেহারার ছবিটা ছাপা হয়ে গেলো পত্রিকায়।ঘটনার রেশ বস্তিঘরগুলিতে রসের উপাদান নিয়ে এলো, এইসব অসভ্য হাওয়ার ফাঁদে পড়ে রইলো তিনটে অসহায় শিশু।

আরব্যরজনীর দৈত্য

 আজ খুব জরুরী একটা কাজ ছিলো, কি কাজ মনে পড়ছে না। হাতে একটা হোমিওপ্যাথির মুখবন্ধ শিশি, বাতাসা ভিজে গলে গেছে। ফেলে দিয়ে এসেছি পথেই। কি যেন বলেছিলো বুড়িটা? ঐরকম ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যে কোত্থেকে এলো সে! গায়েব হলো কিভাবে! এলোমেলো চিন্তায় বেহাল হয় বসে আছি। ঘরে ফিরেছি, কেন? কখন? ভেজা কাপড় ছেড়ে নিশ্চুপ বসে আছি, সামনে একটা শিশি। দিনটা কেমন ঘোরের মধ্যে চরকা কাটছে। নাওয়া কিম্বা খাওয়া অথবা বিশ্রাম! বাতাসাটা কিজন্যে দিয়েছিলো বুড়ি? দৈত্য বশের বর্ম! জানি না, কিন্তু আজ আমার ব্যাংকে টাকা ওঠাতে যাওয়ার কথা ছিলো। এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একারনেই বের হয়েছিলাম, মনে পড়েছে।
সন্ধ্যাবাতিগুলি ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে, আমার ঘরেও; প্রতিটি কামড়ায়। ভয় পাইনি কিংবা ভয় পাইনা বলে যে সাহসটা আজন্মকাল দেখিয়ে গেছি, সেই সাহসটাই সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। চৌষট্টি রকমের আসান মুশকিলগুলোকে কাবু করতে ব্যর্থ। কি হবে শিশির মুখটা খুললে? দৈত্য বেরুবে? খুলবো? না থাক। খুলেই দেখি না! আমি চলার আগেই আঙুল চলেছে, হা করে খুলে আছে স্বচ্ছ হোমিওপ্যাথির শিশি।








মৌ দাশগুপ্তা

শনিবারের কলম

শনিবারের দুপুরবেলা ঘরের কাজপাট সেরে ভিজা চুল এলিয়ে খাটে আধশোয়া হয়ে খবরের কাগজে অভ্যাসমত চোখ বোলাচ্ছিল নন্দিতা। এটা ওর রোজকার রুটিন। সকালে সময় হয়না,দুপুরে সংসারের হাজার টুককিটাকি কাজের মাঝে যে ক্ষণিক অবসর মেলে সেটা একান্ত নিজের কাজে লাগায় ও। খবরের কাগজ, গল্পের বই, কবিতার খাতা। ভাতঘুমের নেশা ওর কোনকালেই নেই। আছে গোপনে একার মনে কলমপেষার নেশা। তা আজকের শনিবারের বিশেষ উৎসব সংখ্যার গল্প বিভাগের পাতায় এসে থমকে গেল নন্দিতা। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। পরম উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসল। শ্বাস দ্রুততর হল। নামটা আবার পড়লো নন্দিতা। নাহ,ভুল না। নন্দা সেন। নন্দা ওর ডাকনাম। সেন বিয়ের আগের পদবী। এই নামেই দুমাস আগে শনিবারের অণুগল্প প্রতিযোগীতায় লেখা পাঠিয়েছিল নন্দিতা। প্রাপ্তি সংবাদটুকুও পায়নি বলে ভুলেও গেছিল। তার মানে ওর গল্পটাই প্রথম হয়েছে। বিশেষ উৎসব সংখ্যার নির্দ্দিষ্ট খোলা পাতাটা চোখের সামনে ধরে রেখে নন্দিতা কিছুক্ষন চুপ করে বসেই রইল।গতকাল রাতেই এই লেখালেখি নিয়ে স্বামী স্ত্রীর নরমে গরমে একটু হয়ে গেছে। নন্দিতার লেখালেখি নিয়ে চন্দনের কোন সমস্যা নেই, বরঞ্চ বউ যে বইপাগল গল্প কবিতা লেখে এনিয়ে চাপা দূর্বলতা ও হাল্কা প্রশ্রয়ই আছে কিন্তু সারা বাংলা কবিতা প্রেমী সমাজ যে পূজোসংখ্যা বার করছে তার গ্রাহকচাঁদা একহাজার টাকাটা ফালতু খরচা বলে উড়িয়ে দেওয়াতেই বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে। সেই মানুষটা যদি শোনে নন্দিতা প্রথম হয়েছে তাহলে নিশ্চই খুব খুশী হবে।গল্প প্রকাশ বা প্রতিযোগীতায় জেতার চেয়ে ওর আনন্দ বেশী হচ্ছে অন্য কারনে।হঠাত্ করেই হাতে কিছু টাকা আসবে। টাকার অংকে দেড়হাজার খুব কম টাকা হলেও এই মুহূর্তে নন্দিতার কাছে অনেক।

চন্দনের একার উপার্জনেই সংসার চলে। চন্দন যদিও মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা নন্দিতাকে হাত খরচ দেয় তবুও এই টাকায় কিছুই হয়না। নন্দিতাও লজ্জায় আর চাইতে পারেনা। চন্দন মানুষটা ওই রোগাভোগা শরীরেই এম্নিতেই অনেক কষ্ট করে। আগে বেশ হাসি খুশী থাকতো। ইদানিং শেয়ার বাজারে বড়সড় একটা ধাক্কা খাওয়ায় সেই হাসিটুকুও বিলীন হয়ে গেছে। পুরুষ মানুষের বড়বড় প্রয়োজনের পাশে ঘর গেরস্থালীর মেয়েলী টুকিটাকির প্রয়োজনীতা একেবারেই খেলো। মাঝে মধ্যে বাচ্চাদের অকারন আবদারের দায়ভাগটাও নন্দিতার ওপর দিয়েই যায়। পাঁচ পাঁচটা মানুষের সংসার আর চন্দনের ব্যাঙ্কের সামান্য ক্লার্কের রোজগার। খরচের কথায় আজকাল চন্দন কেন যে এত খিটখিট করে সেটা বাচ্চারা না বুঝলেই নন্দিতা বিলক্ষন বোঝে বলেই সব সময় সব কথা আর চন্দনকেও বলতে সাহস পায়না। মাঝেমাঝে নিজের অক্ষমতার কথা মনে হতেই নন্দিতার কান্না আসে।

মনে মনেই পুরস্কারের হাজার টাকা দিয়ে কি করবে তার একটা চটজলদি তালিকা বানিয়ে নেয় নন্দিতা,নাহ ,মজার কথা হল, গ্রাহক চাঁদার ব্যাপারটাই এখন আর মনে পড়ল না ওর। চন্দনের একটা টিশার্ট কিনতে হবে। আন্দাজ ৫০০ পড়বে। ওর ভালো টি শার্ট একটাই। দুবছর আগে নন্দিতার ছোট বোন অনিন্দিতা প্রথম চাকরী পাবার আনন্দে যেটা কিনে দিয়েছিল। সেই এক টি শার্ট চন্দন অনেক দিন ধরে পড়ছে । মাঝেমাঝে নন্দিতারই খুব বিরক্ত লাগে। নতুন শার্ট পেয়ে নিশ্চয়ই চন্দন খুব অবাক হবে। বড় মেয়ে নন্দিনীর দরকার একটা স্কুল ব্যাগ।অনেকদিন ধরে বলছে। হাতিবাগানে একটু ঘুরে কিনলে শআড়াইয়ের মধ্যে হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। ছোট চাঁদনীর অনেকদিনের বায়না এটা বারবি। দর করে দেখেছে নন্দিতা, চারেক যাবে ওতে। বাকি রইলো এই সাড়ে তিনশোর মত। তা দিয়ে শাশুড়ীমায়ের একটা চপ্পল হয়ে যাবে।হিসাবটা সেরে নন্দিতা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চন্দনের এক কলিগের বিয়ে আসতে দেরী হবে। এদিকে কাল রবিবার। নন্দিতার আর তর সইছে না। আজই একবার হাতিবাগান ঘুরে আসতে হবে। তবে তার আগের গন্তব্য পত্রিকার অফিস। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নেয় নন্দিতা। দুই মেয়েকে শাশুড়ীর জিম্মায় রেখে বাসস্টপের দিকে হাঁটা দেয়।

অনেক গুলো চিন্তা মাথায় নিয়ে নন্দিতা প্ত্রিকা অফিসের দিকে গেলেও সম্পাদকের সাথে দেখা করে পুরস্কারের টাকা পাওয়াটা যত কঠিন হবে বলে মনে হয়েছিল তার কিছুই হলনা। পুরষ্কারের টাকাটা হাতে নিয়ে নন্দিতা অভিভূতের মত অফিস থেকে বেরিয়ে আসল। সম্পূর্ণ নিজের একক প্রচেষ্টায়, একার যোগ্যতায় জীবনে এত বড় সম্মান ও আগে পায় নি। হাতের পার্সটায় কড়কড়ে তিনটে পাঁচশো টাকার নোট। তিন টুকরো স্বপ্ন, তিন ফালি আনন্দ, নগদ দেড় হাজার টাকা। ভাবতেই ভালো লাগছে।

বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে নন্দিতার যেন হুঁশ এলো। লিখে এত সম্মান পাওয়া যায়? এত ভালো লাগে নিজের? হাতের মুঠোয় পার্সটা শক্ত করে ধরে। চন্দনকে না জানিয়ে এ আজীবন গ্রাহক চাঁদাটা দিয়ে দিতেই পারে। এটা ত সংসারের হিসাবের খরচা নয়।পুরোপুরি বেহিসাবী উপরি পাওনা। বদলে প্রতি মাসে বাংলা কবিতাপ্রেমী সমাজের মাসিক পত্রিকায় প্রতি মাসে নিজের নামটা ছাপার অক্ষরে দেখা যাবে। একান্ত নিজের রোজগারে নিজস্ব বিলাসিতা । কথাটা মনে হতেই নিজের স্বার্থপরতায় নিজেই ধাক্কা খায় নন্দিতা। ছিঃ চন্দন তো এরকম ভাবে না। এরকম একপেশে ভাবনা ভাবলে আর সংসার করা কেন? বরঞ্চ টাকাটা চন্দন ফিরলে ওর হাতেই তুলে দেবে নন্দিতা। হাসলে ভারী মিষ্টি লাগে মানুষটাকে। ভাবতে ভাবতে নিজেই গালে টোল ফেলে ফিক করে হেসে নিল। তারপর সবাই মিলে একজায়গায় বসে ঠিক করবে টাকাটা দিয়ে ঠিক কি কি করা যায়! অতএব ফিরতি বাসে চড়ে নন্দিতা সোদপুরের দিকে রওনা হল। লোকাল বাসে এম্নিতেই প্রচন্ড ভীড় থাকে। আজ আবার মহালয়ার আগের শনিবার। লোকে লোকারণ্য পথঘাট যানবাহন। অনভ্যস্ত নন্দিতা শাড়ী ব্যাগ সামলাতে সামলাতে টলোমলো পায়ে কোনরকমে বাস থেকে নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু তখনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভীড়ের মধ্যে কেউ একজন ওর পার্সটা হেঁচকা টান দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ভাগ্যদেবতা এক হেঁচা টানে ছিনিয়ে নিয়ে গেল নন্দিতা নামের এক সাধারন মেয়ের কিছু অনাস্বাদিত সুখ, না মেটা ইচ্ছে। তিনটি নিঃষ্প্রান পাঁচশ টাকার নোট আর একটি সচল প্রানের একান্ত গভীর কিছু স্বপ্নমুকুল।

প্রাণপনে চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো নন্দিতা, কিন্তু গলা দিয়ে অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে গোঙ্গানী ছাড়া কিছুই বার হল না, তাতেই শনিবারের অলস ভাতঘুমটা মাঝপথে ভেঙ্গে গেল। মাথার ওপর ফ্যানটা ঘুরতে ঘুরতে দাঁড়িয়ে গেছে অনড় হয়ে। লোডশেডিং। চাঁদনী ঘুমের ঘোরে মায়ের গায়ের ওপর পা তুলে দিয়েছে বেকায়দায়। ওকে সরিয়ে ঠিকমত শুইয়ে দিয়ে উঠে বসলো নন্দিতা। শাড়ীর আঁচলেই কপাল গলার ঘামটা মুছে নিয়ে তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত বাড়ালো লেখার খাতাটার দিকে। আবার কলম ধরতে হবে। স্বপ্ন বুনে নতুন গল্প বানাতে হবে। নতুন করে তৈরী হতে হবে।


অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

উনিশ’শ একাত্তর
  
 
       মনুর দিনকাল এখন ভাল যাছে না। কেমন একটা অসুখের মতন হয়েছে তার। দিন সাতেক আগে ডায়ারিয়া হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল ঘোরাঘুরি না করতে। কিন্তু সে ডাক্তারকে বলতে পারেনি যে আসলে ডায়ারিয়া নয়, এই ঘোরাঘুরি করাটাই তার অসুখ। সাতসকালেই মনু ঘুম থেকে ওঠে, ষ্টোভ জ্বেলে চা খায়। বাথরুমে যায়, খুশি  মনে শাওয়ারের তলায় মাথা পেতে ‘আমিও একাকী, তুমিও একাকী’ গান গায় এবং চান সেরেই ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যাওয়ার পরই তার ভাবনা হয় কোথায় যাবে। কিন্তু সাত-পাঁচ ভেবে সময় নষ্ট করার ছেলে মনু নয়। কোথাও যাওয়া ঠিক করতে না পারলেই সকাল বেলার এই সময়টা সে গড়ের মাঠের দিকে  চলে যায়। ওখানে বেওয়ারিশ খেলা হয়। একসঙ্গে এক মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি জমে যায়। মনু খুশি মনে একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। বিড়ি খায় এবং পয়সা  থাকলে দশ পয়সার চিনেবাদামও। এক সময় মনু খুব ভাল ফুটবল খেলত।  এই  ফুটবল খেলতে গিয়েই তার ডান পা-টা ভেঙে যায়। তাকে তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। তাবলে সে জন্যে মনু খেলা ছাড়েনি। ছেড়েছে সে অন্য কারণে।  ফুটবল খেলা তাকে বড় দুঃখ দিয়েছে। আসলে দোষটা মনুরই। সে মাঠে নেমে অন্য মানুষ হয়ে যায়। খেলতে খেলতে ভুলে যায় যে সে মনু। খেলার সময়টুকু তার  নিঃশ্বাসহীন এক প্রহর হয়ে যায়। এটাও তার একটা অসুখ। মনু জেতার জন্যে খেলে। সে জেতার লক্ষ্যে এক সজীব যন্ত্র হয়ে যায়। তাই মনু হেরে গেলে কেঁদে  ফেলে। মাঠে পড়ে পড়ে কাঁদতেই থাকে শুধু। সে নিজের ঘর ভুলে যায়। এবং  একটা সীজ্‌ন সে সব খেলাতে শুধু হারতেই থাকল। সেই দুঃখে সে খেলা ছেড়ে দিয়েছে। আসলে মনু এখন বুঝে গিয়েছে, ভুলে যাওয়াটাই তার অসুখ। তা নইলে ফুটবল তাকে এমন কিছু দুঃখ দিত না।

                      বেলা বেড়ে গেলে মনু ময়দান রেস্টুরেন্টে আরেক কাপ চা খেয়ে নেয়। পকেটে তেমন পয়সা থাকলে দুটো কচুরি বা দুটো সিঙ্গাড়াও। প্রাতঃকালীন জলযোগের পর মনু নতুন উৎসাহে আবার বেরিয়ে পড়ে। এই কলকাতা শহরে থেকেও সে কোনদিন বাসে বা ট্রামে চড়েনি। অথচ সে বারো ঘণ্টা কলকাতা চষে বেড়ায়। এই আশ্চর্যজনক ব্যাপারটা কিন্তু মনুর মনে ধরাই দেয়নি কখনও। লোকভর্তি বাসট্রাম আসলে তার মনে কোন বিশেষ বোধই জাগায় না। সে দৃশ্যের দ্যাখে ট্রামবাস, যেমন দ্যাখে ভিক্টোরিয়া, গড়ের মাঠ, মেট্রো, গ্র্যান্ড, আকাশবাণী ভবন এবং ফুটপাথ। খালি বাস দেখলেও মনুর অঙ্গ এলিয়ে পড়ে না এবং এই প্রায় স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার চিন্তাটিও তার মাথায় আসে না।

        তাবলে মনু সব সময় নিজেকে ভুলে থাকে না। কেন সে জানে না, ঠিক দুপুর বারোটায় সে অদ্ভুত তীক্ষ্ণভাবে সচেতন হয়ে যায়। সচেতন হয়েই তার মনে পড়ে – আমি মনু, আমি বৌবাজার সুইমিং ক্লাব সংলগ্ন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছি এবং রাস্তার কোন লোক আমাকে খেয়াল করছে না। প্রতিদিন দুপুর ঠিক বারোটার সময়। অন্তত এই সময় মনু একবার তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্যাখেই। বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা – এই সময়টুকু মনুর বড়ো কষ্টের সময়। এই সময় তার মাথার মধ্যে বড় বড় জলের ফোঁটার মতো ‘আমি মনু – আমি মনু – আমি মনু’ ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে। তার মস্তিষ্ক ঝাঁঝরা হতে থাকে। বুকের মধ্যে এক তরল ডাক ক্রমশ জমাট হয়ে বসে যায়। এক প্রচন্ড গতিবেগ আলোর পর্দা ছিঁড়তে ছিঁড়তে তাকে অন্ধকারতম নিরুদ্দেশে নিয়ে যায়। ঠিক বারোটা। ঠিক বারোটায় মনু মন মেলে গুটিয়ে নিয়ে আসে নিজেকে নিজের মধ্যে। কষ্টের স্বাদ নেয়, তার বুকের রক্তে গোলাপীর ছয়লাপ ঘটে যায় – তারপর আধ ঘণ্টার মধ্যেই আবার যে কে সেই, ছড়িয়ে যায় মনুর মন রাস্তায় রাস্তায়।

        কখনো-সখনো কারুর কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তারা কথা বলে, মনুও বলে, ঠিক যেমনভাবে সে ময়দানে খেলা দ্যাখে, বাদামের খোসা ছাড়ায় বা বিড়ির টুকরো ছুঁড়ে ফ্যালে। প্রায়ই দেখা হয় মেসোমশায়ের সঙ্গে। একটা-দেড়টার সময়। উনি য়ু্নিভারসিটিতে পড়াতে আসেন। মনু তখন বৌবাজার ক্লাব ছাড়িয়ে কফি হাউসের কাছে। জিজ্ঞেস করেন হাসিমুখে, - মনু, ভালো আছো?  

মনু ঘাড় নাড়ে। উনি বলেন, - তোমার কী যেন অসুখ করেছিল?
মনু তাড়াতাড়ি জবাব দ্যায়, - হ্যাঁ মেসোমশাই, ক’দিন ধরে টাইফয়েডে খুব ভুগলাম।
মেসোমশায় হাসেন। তিনি জানেন মনুর ডায়ারিয়া হয়েছিল; তিনি জানেন, মনু বলবে টাইফয়েড বা ব্রঙ্কাইটিস বা আমাশয়। তাই তিনি হাসেন। মনু তাড়াতাড়ি চলে যায়। তখন তার মনে পড়ে, টাইফয়েড নয়, তার ডায়ারিয়া হয়েছিল, ডাক্তারবাবু ঘোরাঘুরি করতে বারণ করেছেন। এক বান্ধবী আছে বিডন স্ট্রীটের এক গার্লস স্কুলে পড়ায়। মনু কোনদিন হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে চলে যায়। তখন দুটো। টিফিন সময়ে বান্ধবী ওকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে আসে। বলে, - অনেকদিন তোমাকে দেখি না মনু, ভালো আছো?

মনু তখন পালটা জিজ্ঞেস করে, - সবাই ভালো থাকার কথা জিজ্ঞেস করে কেন বল দিকিনি?
বান্ধবী কৌতুকের হাসি মুখে মাখিয়ে মনুর চোখে তাকিয়ে থাকে। মনু বলে, - ভালো থাকাটা কি খুব জরুরী? আসলে কি জানো ঝুমু, আমাদের থাকাটা নিয়েই কথা। ভালো থাকা – মন্দ থাকা, কোন ব্যাপারই নেই। আমি কেন বুঝতে পারি না ঝুমু, আমি ভালো আছি না মন্দ আছি! আমি তো যেমন আছি তেমনই থাকি, যেমন থাকি তেমনই আছি, কেন আমাকে লোকে শুধুই জিজ্ঞেস করে – ভালো আছো, কেমন আছো – এইসব!

        চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে প্রতিদিন মনু পৌঁছে যায় ডালহৌসির অফিসপাড়ায়। এই সময়ের দৃশ্য মনুকে অভিভূত করে দ্যায়। সে দ্যাখে সবাই বাড়ি ফেরে। দ্যাখে, কী প্রচন্ড তাড়া তাদের। বুড়ো মানুষেরাও কী দৌর্দন্ড বিক্রমে যুবকদের সঙ্গে যুদ্ধ করে লাফ দিয়ে বাসে ওঠে, ট্রামে চড়ে। কেউ মুহূর্ত দেরি করে না। সব ঘরে ফেরে। সব ঘরে ফেরে। মনুর মাথায় পাক খায় – সব ঘরে ফেরে। এই দৃশ্য মনুকে আর একবার ভাসিয়ে দ্যায় এক প্রশ্নে, কেন ফেরে? ঘরে ফেরে কেন মানুষ! ঘরে কে আছে, কী আছে? মনুর মনে পড়ে না তার ঘরে কী আছে, কে আছে। তার পকেটে তখনও দু-একটা বিড়ি থাকে, দু-দশটা পয়সা থাকে, সারা কলকাতার মাঠ-ময়দান-ফুটপাথ থাকে, এ ছাড়িয়ে ঘরে আর কী আছে?
--মনুদা, এখন ঘরে কে কে আছে বলতে পারো?
জিজ্ঞেস করেই সে মনুকে একটা সিগারেট দ্যায়। সে মনুর বোনের প্রেমিক। মনু কলকাতার ফুটপাথের মতই তাকে চিনতে পারে, জবাব দ্যায়, - ঘরে শাওয়ার আছে, বিছানা আছে, আর ডায়ারিয়া-টাইফয়েড-আমাশয় আছে।

        সন্ধেবেলাটাতে মনু শহীদ মিনারের পায়ের তলায় গিয়ে বসে কোন শায়িত হিন্দুস্থানির মাথার কাছে। তখন চৌরঙ্গীতে আলোয় আলোয় ছয়লাপ। সে অন্ধকারে বসে আলো দ্যাখে, তার স্বপ্ন বলে বোধ হয়। চাওয়ালা চা – চা হেঁকে যায়। মনুর পকেটে বুঝি পয়সা ফুরিয়ে যায়, নতুবা তার এক ভাঁড় চা খাওয়ার বাসনা হয়। দু-একজন দেঁতো লোক অথবা একাকী মেয়েমানুষ তার কাছে ঘোরাঘুরি করে এবং চলে যায়। মনু তখন বোনের প্রেমিকের দেওয়া সিগারেট পকেত থেকে বের করে, পাশের লোকের সিগারেটের আগুন থেকে ধরায় এবং নিশ্চিন্তে ধোঁয়া ছাড়ে। সামনের চওড়া রাস্তায় এলোমেলো হর্ন, মাঝে মাঝে হেডলাইটের আলো, গাড়ির ঢল বয়ে যায়। মনু মিনারের অন্ধকার পাদদেশে বসে এই বয়ে চলা দ্যাখে। সাদা ধোঁয়াতে তার ফুসফুস ভরে ওঠে, নীল ধোঁয়ায় তার মুখ আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে বসে থাকে। তার ফুটবল খেলার বাসনা হয়, দৌড়োবার সাধ হয়, ফিরতে ইচ্ছে হয়। সে বসে থাকে। এবং প্রতি সন্ধেবেলায় এখানে বসে তার মনে হয়, বস্তুত তার কোন কিছু করার নেই। আর ফুটবল হবে না, দৌড়নো এক অস্পষ্ট ছবি মাত্র, মনু নামে ছেলেটি নিভে গেছে। তার বুকের ভেতর একরাশ ছাই এবং তার এই ঘোরাঘুরি, এই বস্তুবাদী পর্যবেক্ষণ, ভুলে যাওয়া – এখানে সে নির্বাসিত।

        এবার মনু ওঠে, ক্ষণপূর্বের সিদ্ধান্ত মগজের সাদা পাতায় রেখা আঁকে না। সে আর কিছু ভাবে না, দ্যাখে না ফুটপাথ, মাঠের ঘাস, চৌরঙ্গীর আলো বা মানুষজন। হারিয়ে যায় সে নিজের মধ্যে। ঘোরাঘুরি করে না – হাঁটতে থাকে খালি। হাঁটতে হাঁটতে ফেরে, কেন ফেরে না জেনেই ফেরে। পাড়াতে এলে পরিচিত দু-চার জন জিজ্ঞেস করে, - মনু ফিরলি? মনু শুনতে পায় না। সে বাড়িতে ফিরে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ে। ছোট্ট ভাইঝি মনুকে বড় ভালোবাসে। সে ছুটে এসে তার কাকুর চুলে বিলি কাটে। মনু তখন নিজের মধ্যে, সে তার প্রিয় ভাইঝিকেও ভুলে যায়। ভাইঝি ঠোঁট ফুলিয়ে চলে যায়। মা আসেন, মনুকে খাইয়ে দেন। মনু মায়ের হাতে খেয়ে নেয়, কী খায় ভুলে যায়। তাকে খাওয়াতে গিয়ে প্রতিদিন মায়ের চোখের কোণ ভিজে যায়, মনু মায়ের চোখের দিকে তাকিয়েও বুঝতে পারে না। মা চলে যান। একা ঘরে বন্ধ দুয়ার খুলে পুলিশের সাদা পোশাক তখন মনুর দিকে ধেয়ে আসে। পেছনে তাদের নিষ্ঠুর চোখ, ক্রুর চোয়াল। তখন মনুর বুকে ঢিল পড়ে, ঢেউ ওঠে। রুদ্ধ দুয়ারের কড়া নড়ে। আঘাতের শব্দ দুম্‌ দুম্‌ দুম্‌ মনুর মাথায় ঢাক বাজে, তার সারা শরীরে কষ্ট শুরু হয়। বন্ধ ঘরে সে ছুটতে থাকে, লক্ষ্যহীন। বুকের কষ্ট ছাড়া তার আর কিচ্ছু মনে থাকে না। এক যন্ত্রণা তরঙ্গে তরঙ্গে তাকে দ্বিধাবিভিক্ত করে ফেলে, এক মনুর থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয় মনু বেরিয়ে আসতে চায়। দেওয়ালে তার মাথা ঠুকে যায়, খাটের পায়াতে হোঁচট খেয়ে সে মেঝেতে আছড়ে পড়ে। একসারি হলুদ ফুটকি চোখের সামনে খেলা করে। সে দরজা খোঁজে। বায়ুহীন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সে আলো খোঁজে, ভালবাসা অথবা জীবনকে হাতড়ে ফেরে। আর তখনই সে চিৎকার করে ওঠে, আমি মনু আমি মনু আমি মনু – সে নিজেকে খোঁজে।
        তখন মা আসেন। মনুকে বুকে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। মনু মাকে জড়িয়ে কাঁদে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। 
                                           
                                             [দুই]


        মনু বড়ো ভালো ছেলে ছিল, পবিত্র ছেলে ছিল। সে বেশি কথা বলত না, তর্ক করতে পারত না। অথচ সে নীরব কৃতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষায় পাস করেছিল। তাকে সবাই ভালবাসত; যে দেখত সেই। খেলার মাঠেও তার অনেক ভক্ত ছিল। সে একদিন বড় খেলোয়াড় হতেও পারত। সে একটি মেয়েকে মনে মনে ভালবাসত; কিন্তু বড্ড লাজুক ছিল সে, কোনদিন তার সাথে কথা বলতে পারেনি। মর্নিং কলেজ-ফেরত মেয়েটিকে দেখবে বলে সে একদিন বউবাজার সুইমিং পুল সংলগ্ন ফুটপাথে বেলা বারোটার সময় সুর্যকে ঠিক মাথার ওপর নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তখন সাদা পোশাকের পুলিশ এসে তাকে নকশাল সন্দেহে ধরে নিয়ে যায়। তিনদিন লক আপে রেখে ত্রিমাত্রা প্রয়োগে মনুর গোপন কুঠরিতে ঢুকে পুলিশ যখন দেখল সেখানে বিপ্লব নেই, শুধুই প্রেম – তখন নিঃশব্দে তারা তাকে বউবাজার ফুটপাথের ঠিকানায় ফিরিয়ে দেয়। ততক্ষণে তেইশ বছরের মনুর মগজ ভুল ঠিকানায় পৌঁছে গেছে। সে ভুলে গেছে ভালবাসা, ভুলে গেছে সেই মেয়েটিকেও। তখন থেকে তার শুধুই ঘোরাঘুরি। সে দৃশ্যের মতো দ্যাখে মানুষজন, যাবতীয় ঘটনা, ট্রাম-বাস, গড়ের মাঠ, ফুটপাথ এবং চিনেবাদামের খোসা। রোজ সকালে সে বাড়ি থেকে বেরোয়। প্রথম প্রথম তাকে বাড়িতে বন্ধ করে রাখা হোত। কিন্তু তাতে সে একেবারে নির্জীব হয়ে পড়ত বলে ডাক্তারের পরামর্শে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মনু এখন দুপুরদিন ঘুরে বেড়ায়, বিড়ি খায়, সেই মেয়েটিকে দেখলে চিনতেও পারে না। এখন তার ডায়ারিয়া হয়, ব্রঙ্কাইটিস-টাইফয়েড-আমাশয় হয় – কিন্তু তার কোন অ-সুখ নেই আর। সুখ-দুঃখের কোন রেখা নেই। তার সামনে কলকাতা এক নীল নদী, ফুটপাথে স্রোত, গড়ের মাঠে চকচকে কিছু নুড়ি, ডালহৌসিতে রূপোলী মাছ। মনু দ্যাখে সারাক্ষণ, দিনদুপুর ঘুরে ঘুরে। তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া তিনটি দিন বাড়ির লোকের কাছে রহস্য হয়ে থাকলেও মনুর মন থেকে উধাও হয়ে গেছে। সেখানে জেগে থাকে কেবল বেলা বারোটা। তখন ঢেউ ওঠে, তার নাক-মুখ-চোখ নোনা জলে ভরে যায়, জ্বালা করে। তারপর সেই এক নিস্তরঙ্গ নদী কলকাতা, কিছু চকচকে নুড়ি, রূপোলী মাছ – কোন জ্বালা নেই, অ-সুখ নেই, সে সুখী নয়, দুঃখী নয়, কোন মেয়ে নেই কলকাতায়, সে কেবল দুপুর শেষে রাত হলে সামান্য ভয়ে আশ্রয় চায়, তখন মাকে জড়িয়ে একটু গান শোনায়, গানের মাঝে থাকে – কলকাতা এক নীল নদী, গড়ের মাঠ চক্‌চকে কিছু নুড়ি, ডালহৌসি রূপোলী মাছ, আর কোন মেয়ে নেই, ফুটপাথ শুধু স্রোত। মনুর জীবন না-শব্দে, না-যন্ত্রণায় কেবল বয়ে চলে !