গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

৩য় বর্ষ২০তম সংখ্যা।।১৮সেপ্টেম্বর২০১৪।।১লা আশ্বিন১৪২১

এই সংখ্যায় ৫টি অনুগল্প সহ ১১টি গল্প । লিখেছেন - বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়, মৌ দাশগুপ্ত, নীতা মন্ডল, তাপসকিরণ রায়, মিলন বণিক, দোলনচাঁপা ধর, সূর্যস্নাত বসু, দেবাশিস মুখোপাধ্যায় ও অসিত ঘোষ ।

               পড়ুন সূচিপত্র অনুযায়ী - ক্লিক করে

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


অন্য মানুষপণ্য মানুষ

         এক নিওন আলোয় পণ্য হল আজ যা কিছু ব্যক্তিগত । লোকটাকে অদ্ভুত কায়দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল সুগত। পায়ের উপর পা রেখে এক বিচিত্র ভঙ্গিমায় শুকনো মুড়ি চিবুচ্ছিল। চপচানাচুর বা টমাটোর উপস্থিতি অনাবশ্যক । একটি কাচালঙ্কাও মহার্ঘ্য । আর তখনই চোখ চলে গিয়েছিল তার অনাবৃত পায়ের দিকে। দাদ অথবা একজিমা কিছু একটা হবে... তার দাগ ও বহমান চিহ্ন সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে পায়ের নগ্ন অংশে ।ঠিক এই ছবিটাই এখন সুগতর সবচেয়ে বেশি দরকার ।
কোম্পানি বলেছে – একজন জলজ্যান্ত একজিমার রোগী ধরে আনতেবিষয়টিকে লাইভ করতে এরকম মডেল খুব জরুরি। দ্যা মার্কেট হ্যাজ বিকাম কম্পিটিটিভ । প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বিজ্ঞাপন কে হতে হবে ম্যাগনেট । অন্যান্য কোম্পানি গুলো ঠিক এখানেই তাদের ল্যাং মেরে ফেলে দিচ্ছে।সেলিকল বা বি-টেক্স এগিয়ে গেছে কতদূর । তারা পড়ে আছে সেই তিমিরেই । অন্ধকার কি এগিয়ে আসছে । সূর্যের দিকে তাকাল সুগত। আলোর সোনালিরেখা এখনও রয়েছে ।চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখে নিল সে ।অন্য কোম্পানির লোকজন এসে পড়েনি তো নাকেউ খবর পায়নি । একটা দমবন্ধ চিন্তাভাবনার হাত থেকে নিস্তার পেয়ে যাওয়ার মসৃণ আনন্দে সে নেচে উঠতে গিয়েও পারল না । এখানে অন্যমনস্ক হওয়ার কোনও সুযোগ নেই । চ্যালেঞ্জ অ্যাট এনি কস্ট তোমাকে এগোতেই হবে। পুরানো হলুদ হয়ে যাওয়া কথাগুলো আজকের তাৎপর্য নিয়ে ফিরে আসে ।

অদ্ভুত বৃত্তভুমির মধ্যে সাংকেতিক চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সময় । লোকটার দিকে আরেকবার তাকাল সুগত ।- আঃকি কপাল । এরকম মডেল রাও মুড়ি চিবোয় .... শুকনো মুড়ি চপ পেঁয়াজি ছাড়াই নির্জলা মুড়ি  ভালো কোম্পানির হাতে পড়লে বরাত ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারতো । অথচ ... । এ দেশের কিস্যু হবেনা। হতাশাব্যঞ্জক এই মন্তব্য থেকে সরে এসে সুগত ছুটে যায় লোকটার কাছে ।
এই যে... লোকটা কিছুই বুঝতে পারেনা
আমার কথা শুনতে পাচ্ছ লোকটা উত্তর দেয়না। নির্বাক এবং আশ্চর্যজনক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। উদাসীন এক ধুসর পৃথিবী তার চোখে আলোর বলয় তৈরি করে । এবার সে দেখতে পায় সংকেত ।
তুমি ক্যা বাপ ?
আমিআমাকে চেন না ?
না ত । লতুন লক ই ধারে ত কনহদিন নাই দেখি।
হ্যানতুন কিন্তু টি ভি তে রোজ আমার ছবি দেখায় । দুবেলা । নিয়মিত।
 টি ভির লক । সিটা বইলবে ত । লোকটা তার পা চুলকোয় একজিমা নিঃসৃত আদ্র তরল গড়াতে থাকে । লুঙ্গিতে মলিন ছাপ পড়ে । আঁশটে গন্ধে জমাট বাঁধতে থাকে চারপাশ । রক্তাক্ত ক্ষতস্থান চুলকোতে চুলকোতে সে মাথা নাড়ে
– মায়ের কিরা তুমাকে চিনতে লারছি বাপ । 

সুগত সব কিছু বুঝিয়ে বলে। তাদের কোম্পানির নাম ধাম । ইয়ার্লি টার্ন ওভার । আগামি দশ বছরে তাদের কোম্পানি কোথায় যেতে পারে এইসব ।আসলে সেমিনারে তাকে যা যা শেখানো হয় সে সমস্ত কিছু উগরে দেয় এই সুযোগে । লোকটা তাকায় । বোধগম্য হয়না । এ তো অন্যমানুষ । ভাষা বুঝতে পারে না । আপন মনে মুড়ি চিবুতে থাকে। কষ বেয়ে লালা ঝরে । অনর্গল মুড়িতে মিশে যেতে থাকে এনজাইম । সুগত জরিপ করে চারপাশ । ততক্ষনে আরও স্পষ্ট ও নির্মল ভাবে চেনা যায় পায়ের দুষ্টু দাগ । সিদ্ধান্তের গভীরতায় পৌঁছে যায় সন্দেহাতীত ও দ্বিধাহীন – যে সে লোক নয় । মডেল হওয়ার উপযুক্ত । স্থির ও সচল ছবি তুলে আজকেই পাঠাতে হবেদ্বিমত নেই এ বিষয়ে । সারাদিন ধরে খুঁজে খুঁজে অনেক কষ্টে সে উপযুক্ত মানুষের কাছে নিজেকে ছুড়ে দিতে পেরেছে  চান্স মিস করা যাবে না কোনোমতেই । ইউরেকা বলতে গিয়ে ঈষৎ টাল খেল সুগত । ওর সামনে দাড়িয়ে এক আগন্তুক। ভদ্র ধোপদুরস্ত চেহারা ।
আপনি কোন কোম্পানির সুগতর গলায় আকস্মিক জিজ্ঞাসা । সন্দেহ হতাশা ও অনিশ্চিতি ভাবনা থেকে এক ধরনের বিপন্নতা তৈরি হয় যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষের বোধ নিরেট অর্থহীনতায় থমকে যায় ।

                                             দুই

তোমার ময়লা জামাছেঁড়া জিন্স এনামেল উঠে যাওয়া দাঁত-এই তো দুস্প্রাপ্য ছবি চড়া দামে কিনে নেব আজ।
আমি একটি টেলিফিল্মের স্ক্রিপ্টরাইটার । টেলিফিল্ম বোঝেন তো লোকটির কথায় সম্বিত ফিরে আসে সুগতর । যাক বাঁচা গেল । প্রতদ্বন্দ্বী নয় । সুগত ইতিবাচক মাথা নাড়ে ।
-তারই স্ক্রিপ্ট তৈরি হবে – খিদের রঙ । মানুষের অভাব দারিদ্র নিয়ে নিউ কনসেপ্ট । একটু অন্যরকম ভাবনা । নিরীক্ষা মূলক । বাজারি বস্তাপচা গল্পের বাইরে নতুন থিয়োরি । ফরেন এ যাবে । এসব গল্প পাব্লিক খুব খায় আজকাল
-ভালো খুব ভালো । আশ্বস্ত হয় সুগত । আপনার নাম ?
পলাশ দেব । শুনে থাকবেন হয় তো । চারদিকে এত কাজের চাপ । টি ভি তে প্রায় ই ... পলাশ দেব নাম টা মনে করতে পারল না সুগত। তবু বলল
- খুব চিনিআপনি পলাশ দেবকী সোভাগ্য আমার । বেশ বুদ্ধিজীবি হাসি হাসল পলাশ
- আপনি ?
-আমি সুগত বাসু এক্সিকুটিভ ডাইরেক্টর । তারপর কোম্পানির নাম খুব মৃদু স্বরে বলল । অনেকক্ষণ ধরে লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করে পলাশ দেব । ওর খাওয়ার ধরণ । পোশাক এবং ঘা- ময় শরীর । এসব পুরোপুরি লিখতে পারলে দারুন জমবে
– ফাটাফাটি । মার্কেট এমন সাবজেক্ট পেলে ক্যাচ করে নেবে । সুগতও দেখতে থাকে এক নাগাড়ে । ভাবে - লোকটা যে সে লোক নয় মার্কেট ভ্যালু আছে । কপাল মন্দ তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুড়ি খাচ্ছে ।  অথচ আশ্চর্য সব মানুষজন রয়েছে চারদিকে । এখনও যাদের মেরুদণ্ড নেই শিরদাঁড়া নেই মেধা মনন এমনকি একজিমাও নেই তবু করে কম্মে খাচ্ছে কর্তার ইচ্ছেয় । চেতনার গভীর তল থেকে এই বার্তা ভেসে আসে সুগতর মনে । লোকটা তাকায় নির্মেঘ আকাশে । যা তার আশ্রয় ,এতদিনের ঘরবাড়ি । বাস্তুচ্যুত হওয়ার ভয় কি ওকে পেয়ে বসেছে ওর কাছাকাছি এল সুগত ।
এই যে শুনছ শুনতে পাচ্ছ আমার সাথে এস।
-আপনার সাথে মানে পলাশ দেবের চোখে আগুন ।
-আমার সাথে মানে আমার সাথে । এটা না বোঝার তো কারণ নেই।
-আমি অলরেডি ওকে বুক করেছি।
মগের মুল্লুক না কি মামাবাড়ির আবদার
– বুক করেছি ।
আমার ছবিতে ওর বিরাট রোল । সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার ।
সেই কোন সকাল থেকে ওকে দেখছি দুমিনিট দেখেই আপনার হয়ে গেল । আমি ওকে মডেল বানাব । মডেল
-কত টাকা দিতে পারবেন ওকে । আপনাদের মুরোদ আমার দেখা আছে ।
বাজে বকবেন না । আপনি মশাই আচ্ছা দু নম্বরি মাল তো ।
মাল । স্ল্যাং লাঙ্গুয়েজ ইউজ করছেন আচ্ছা ছোটলোক তো ।
-আপনি মশাই থার্ড পার্সন । আমাদের দুজনের মাঝে অযথা নাক গলাতে আসছেন ।
আ বে চোপ ।
আমি ওকে কাজ দেব । বহুত কাজ ওর লাইফ বদলে দেব ।
আমি ওকে পরিচিতি দেব । অনেক লোক চিনবে । 

         লোকটা এখনও বসে আছে ফুটপাথে । এরকম ব্যক্তিত্বকে কি আর লোক বলা যাবে যদিও আলাদাভাবে এর কোন পরিচয় নেই । এখনও ঘেয়ো মাছি ছিঁড়ে খাচ্ছে পুষ্টিকর খাবার । রক্তাক্ত ঘা থেকে গড়িয়ে পড়ছে জলীয় দ্রবন । লোকটির দূষিত রক্ত থেকে গন্ধ ভেসে আসে যেখানে পরজীবিদের যাতায়াত । বায়ুতাড়িত গন্ধসন্ধানী সেইসব কৃমিকীট জড়ো হয় প্রাকৃত উৎসবে । নর্দমার কাদার মত সে পড়ে থাকে লক্ষহীন । তার জীবনে থাকে আঁকুপাঁকু খিদে । এই ঘা মারাত্মক । সংক্রামক রোগের চেয়েও ভয়ানক । কোন শিল্পই নেভাতে পারেনা এই দাহ । বজ্রপাত হয় তবু বৃষ্টিহীন । ফসলের আকাঙ্খা থেকে বহুদূরে পড়ে থাকে শস্যভুমি । লোকটা উঠে দাঁড়ায় । মুড়ি শেষ হয়ে গেছে কখন । খিদে মরেনি তবু । শালপাতার ঠোঙা ছুঁড়ে দেয় আস্তাকুড়ে । ততক্ষনে কুকুরেরা টানাটানি ও ভাগাভাগি শুরু করে দিয়েছে এঁটো পাতার অংশীদারি নিয়ে । এখানেও ঝগড়া কোলাহল যুদ্ধের প্রস্তুতি । দাঁত ও নখের আয়োজন । কোথায় যাবে সে লোকটা দেখে
- বিচ্ছিন্ন নীরব আঁধারে শুয়ে আছে আধপোড়া পৃথিবী ।



মৌ দাশগুপ্তা


অনির রথ

রথের দিন আষাঢ়ের আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘড়িতে সকাল ছটা কিন্তু বাইরে আলো একদম নেই । রাত রাত লাগছে । নিমাইয়ের চায়ের দোকানের পিছনে বাঁশের বাখারী দেওয়া চার দেওয়ালের ওপর খড়ের চাল, গতকাল মোটা প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা হয়েছে বলে আজ জল টপকাচ্ছে না তবে জলের ছাঁট আসছে। ঘরে সাকুল্যে একটা তক্তাপোষ তাতেই কাকা ভাইপোর সংসার। ছোট্ট অনি পাড়ার দেবুদাদার গত বছরের বই নিয়ে দুলে দুলে ইতিহাস পড়ছে, ‘মানবসভ্যতার প্রথম অবদান চাকা আবিস্কার।পড়তে পড়তে আড়চোখে কাকা কোথায় দেখতে গিয়ে আনমনা হয়ে যায় অনি, এবারের রথের কি খবর ওদের নয়ানপুরে ?। পুঁটে মাধুদের জন্য রথ কি কেনা হয়েছে ? আর রঙিন কাগজ, রাংতা, ফুলমালা ? প্রসাদের চিনি আর কলা ? ওখানেও কি আজ বৃষ্টি
হয়েছে? ঠাকুমা যে বলতো,রথের দিন নাকি বৃষ্টি হবেই। এবারও রথের মেলায়  গাছ বিক্রি হবে নিশ্চয়ই ? সবেদা পেয়ারা জামরুল লেবু রক্তচন্দন, সাথে জবা, গন্ধরাজ, রঙ্গন, আর স্থলপদ্মের চারা ।

রথের মেলা জুড়ে দেদার বিক্রি হবে পাঁপড়, নিমকি, কুচো গজা, ফুটকড়াই, ফেনী বাতাসা,বাদামভাজা, গরম জিলিপি এছাড়াও আসবে বাঁশীওয়ালা সনাতনদাদু, কমল নামের হাসিখুশী বেলুনওয়ালা দাদাটা , মাধোপুরের করিমচাচা আসবে বুড়ির চুল নিয়ে , চৌকানো কালো কাপড় ঢাকা বাক্স নিয়ে রহিমদাদা দেখাবে আজব সিনেমা, থাকবে রঙ বেরঙা কাগজের চরকি. লাট্টু, সাবান ফেনার বুদবুদ, কত যে মজা হবে। পুঁটে মাধু বিন্তি সোনু কানাই,মান্তিরা কি মজাটাই না করবে আজ, আচ্ছা ওদের কি আজ একবারও অনির কথা মনে হবে ? অনির বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করত, গত বছর এই রথের দিনেই বাড়ী ফেরার পথে লরী চাপা পড়েছিল, চাকার তলায় পিষে রক্তমাখা দেহটা চেনার উপায় ছিলনা অনিকে তাই কেউ দেখতেও দেয়নি । অনি মাকে দেখেনি কোনদিন। ওর ঠাকুমা বলতো জন্মকালে মরে মা তার দুঃখ ঘোচে না। সে ঠাকুমাও তো নেই। মরে হেজে থাকার মধ্যে এই এক কাকা। গত কয়েকমাস কাকার চায়ের দোকানেই কাকা ভাইপোর সারাদিনের সংসার। আজ রথ কিনা,আজ ওদের পথশিশুদের ইস্কুলেও ছুটি তবে খুব কাজ আজ দোকানে, বড় কড়া চাপবে, বেগুনী পেঁয়াজী পাপড় ভাজতে হবে। সকাল থেকেই খাটতে
হবে। কাকা কাল রাত থেকেই পাখীপড়া করে বলে দিয়েছে। সব যোগাড়-যাগার করে
হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে তারপর শুয়েছে গতকাল।

আজও অনি ঘুম ভেঙে ওঠার আগে থেকেই দোকান খুলে একা হাতে চা বানাচ্ছে কাকা। এবার না গেলে বকা দেবে। অনি উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাইরে থেকে নিমাইয়ের গলা ভেসে আসে -       বলি ও নবাবপুত্তুর, আর কত পড়ার কেত্তন করবি ? উনুন যে নিভতে চললো, বলি সুজ্জি যে মাথার ওপর উঠলো সে খেয়াল আছে? হতচ্ছাড়া ছেলে, আয় বলছি একফালি জানলায়  দাঁড়িয়ে জলে ভেজা পথ দেখছিল ছেলেটা। আর রথ সাজানো নেই, মেলায় যাওয়া নেই। কাকার মৃদু বকুনি কানে আসতেই  যন্ত্রচালিতের মত হাতের বই তক্তাপোষের নীচে ঢুকিয়ে রেখে দেওয়ালে টাঙানো পুরানো জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার ক্যালেন্ডারে ঢিব করে প্রনাম ঠুকেই দৌড় লাগালো । সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর ফুরিয়ে বিকেল, বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যা নামছে ধীর পায়ে । মায়াজড়ানো আবছা আলোয় জড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট মানুষজন ।

দোকানের সামনে দিয়ে ষষ্ঠীতলার মদনমোহন মন্দির যাবার রাস্তা । লোকজন, হৈচৈ, মেলা বসে কিনা মন্দির ঘিরে তাই মা বাবার হাত ধরে বাচ্চারা আসছে, যাচ্ছে, কেউ রথ টানছে, কেউ বাঁশীতে ফু দিচ্ছে, কেউ ভেঁপু বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছে,কারো হাতে পুতুল, কাঠের খেলনা, বেলুন, কারো হাতে কাগজের লাল নীল চরকি। ককার নির্দেশ মেনে শালপাতায় মুড়ে বেগুনী, ফুলুড়ি, ঝালবড়া ,পাপড়, কি জিলিপি অর্ডার মত লোকের হাতে তুলে দিতে দিতে অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে অনি। কেমন যেন একটা হচ্ছে বুকের মধ্যে, যেখানে স্মৃতিরা ঘুমিয়ে থাকে ... । বিষাদ আর আনন্দের মাঝামাঝি ... কিছু একটা, ঠিক বোঝানো যায়না । বারবার কিসের একটা না পাওয়ার দুঃখে চোখ আবছা হয়ে যাচ্ছে। বারবার কাকার বকুনী খাচ্ছে আর বকুনী খেয়েই চটকা ভেঙে পরনের ময়লা গেঞ্জিতে চোখ মুছে হাত চালাচ্ছে অনি কাজ করতে করতে আড়চোখে ভাইপোর ম্লানমুখ নিমাইও দেখছে কিন্তু ও বেচারাই বা কি করে । ছোট্ট দোকান, অল্প মূলধন, লোকও কাকা ভাইপো বই কেউ নেই। এই উৎসব-টুৎসবেই যা দুটো বিক্রিবাটা হয় । তবু বাপ মা মরা ভাইপোটার ম্লানমুখ নিমাইয়ের কাজের গতি শ্লথ করে দেয় । মন খারাপ কাটাতে অনিকেই ধমকে ওঠে। অনির চোখের জলের মত জল ছলছল আকাশে শুরু হয় বৃষ্টি, আবছায়া নেমে আসা রাস্তায় তখন টলমল করছে ছোটো ছোটো রথ। কাঁসর বাজছে । বৃষ্টি বাড়তে লোকজনও ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক, বাড়ীর দিকেই দৌড় অধিকাংশের । বৃষ্টি ভিজে মেলা দেখার থেকেও টিভি সিরিয়াল আর ঘরের নিভৃত আশ্রয়ই বেশী ভালো লাগে সবার । অনিও দুদন্ড ফুরসত পায় । রাস্তায় চোখ রাখে। শালপাতা, ফাটা বেলুন, চকোলেট আইসক্রীমের মোড়ক, কাগজের টুকরো, ছেঁড়া ফুল, খুচরো পয়সা স্মৃতির মতো ছড়িয়ে পড়ছে জনহীন রাস্তায় । জলে জলে এলোমেলো হয়ে গেছে চারধার।  মাটি দেখা যাচ্ছে না, অনি ভাবে যা বৃষ্টি, ওর ফেলে আসা গ্রাম ঘেঁষে বয়ে চলা বউমরা খালে নিশ্চয়ই আজ হইহই করে জল বইছে। আর পুঁটুদের মাছচাষের পুকুরও তাহলে এবার ঠিক ভেসে গেছে। সব মাছ পালিয়ে যাচ্ছে খালের জল বেয়ে   মাছেদের মুক্তির আনন্দ ওর ভেতর দিয়ে বয়ে যায় ওর না মেটা আনন্দ হয়ে, ভাবে, হে ভগবান, ওরা যেন পালাতে পারে । ফিরে যেতে পারে নিজের জায়গায়, বাধা না পায়। এদিকে  জল আসতেই এক হাতে রথ আর কোলে রথের ক্ষুদে চালককে তুলে দৌড় দিয়েছে কোন এক  মা। তাড়াহুড়োয় ঈশ্বর পড়ে রয়েছেন পথেই, ঝড়জলে। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে,অসহায় ঈশ্বর ভিজছেন জনহীন পথে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বৃষ্টিতেই ভিজতে ভিজতে পথে নেমে আসে অনি,কেউ কোথ্থাও নেই, দুহাত দূরের দৃশ্যও ঝাপসা


ভীরু হাতে রথের দড়ি হাতে তুলে নেয় অনি। গেঞ্জিটা খুলে ভেজা রথের ওপর চাপিয়ে দেয়। যদি জল একটুও আটকানো যায় । ধীরে ধীরে রথের রশিতে টান পড়ে। জলে
ভাসা পথে টলোমলোভাবে এগোয় রথ, একটু এগোতে না এগোতেই বিপত্তি, হাল্কাহাতে রশিতে টান দিলে জল কেটে এগোচ্ছে না রথ আর জোরে টানলে উল্টে পড়ে যাচ্ছেন জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা, হঠাৎই রথের কাঠামো সাবধানে দুহাতে সামলে কেউ ধীরে ধীরে ঠেলা দেয় সামনে,রথের চাকা ঘোরে, রথ এগোয়চমকে তাকাতেই অনি দেখে দোকান ফেলে বৃষ্টিতে ভেজা কাক হয়ে কাকাও নেমে এসেছে পথে। অপরাধীমুখে লাজুক হাসে অনি । নিমাইয়ের মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। ভক্তের ভগবান ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণে বরুনদেবকে পাঠিয়ে দিয়েছেন মাটির পৃথিবীতে, অকৃপন হাতে জল ঢালছেন বৃষ্টির দেবতা । অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মহানন্দে কাকার সাথে রথ
টানতে থাকে অনি।