গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৪

৩য় বর্ষ একাদশ সংখ্যা ২৫এপ্রিল ২০১৪।।১১বৈশাখ ১৪২০

এই সংখ্যায় ৭টি গল্প লিখেছেন মুস্তাইন সুজাত, নন্দিতা ভট্টাচার্য, সাঈদা মিমি, দীপঙ্কর বেরা, জয়তী ভট্টাচার্য ও আফরোজা অদিতি ।

                           গল্প পড়ুন সূচিপত্রে ক্লিক করে

মুস্তাইন সুজাত

             একটি কদমগাছ এবং কিছুমৃত্যু

বেঘোর বর্ষা ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়ছে লাগাতারথামার লক্ষন নেই । তিন বছর আগে লাগানো কদম গাছটায়সেবার প্রথমফুল ফুটেছে । গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে গাছের নিচে ঘুরঘুর করেআর চাতকের মত একটু পরপর তাকায়উপরের দিকে, নিশানা তাক করে ঝুলে থাকা কদমথোকা বরাবর । আর বৃষ্টি ভেজা মাটি তাদের পায়ের নিচেকাই মাখা হয়কাদা-কদমে মিলে আঁশটে মাতাল চারদিক । ছোটরা ঢিল ছুড়তে গেলে বেশি উপরে উঠে না তাই পাড়ার ডাগর ডাগর মেয়েদের সাথে করে নিয়ে আসেউপরে ছুড়া শক্ত ঢিল কোনটা ফুলের থোকায় ঠেকে আবার কোনটা পাশ কেটে চলে যায় । আর পুবঘরের টিনের চালায় পড়ে বিকটশব্দ হয় । সেই শব্দে আব্বাজান স্বভাবতই বিরক্ত হন এবং রেগে যান । বেশ কয়েকবার গাছটা কেটে ফেলার মনস্থির করেন । কিন্তু কেন যেন শেষ পর্যন্ত গাছটা কাটা হয়ে উঠে না ।
কদম ওরা খোঁপায় গুঁজে । কদম মেয়েদের পছন্দের ফুল কিনা তাই!

খালার বাড়ি বেড়াতে আসা খাইরুনকে প্রথম দেখি কদম গাছটার নিচে ।দেখা থেকেই ভালোলাগা । তক্কে তক্কে থাকি । এক সন্ধ্যায় তিনটা কদমের সাথে মনটাও তুলে দেই খাইরুনের আঁচলে । পরের বছর খাইরুন আমার ঘরণী হয় । এরপর থেকে এই কদম আমার জীবনে আসেনানানা সময়ে নানান স্মৃতি হয়েবিশেষ করে খাইরুনের খোঁপায় যখন কদমফুল গুঁজা দেখতাম তখন আমার প্রেম নদীতে আপনাই জোয়ার উঠতোহয়তো এই কদমখোঁপা দেখব বলেই আমার অপেক্ষাছিল জনম জনমেরখোঁপায় কদম গুঁজা সতের আঠারো বছরের তরুণী-বৌ কতভাবে যে আমাকে শাসাতো! একটা জিনিশ বার বারলক্ষ্য করেছি, খাইরুনের মতএরকম দরদ দিয়ে আমাকে কেউ কোন দিন বলেনি । এইডা কইরো না, ইডা কেল্লাইগা করছ, যাইতে না মানা করলাম এর ফরও কেল্লাইগা ওইহানে গেসলা, কেল্লাইগাঅত দেরি কইরা আইলাআরো কত শত কথা !

শেষের দিকে সব কিছুর উত্তর আমি জমিয়ে রাখতাম ঠোঁটের কোনে। আমার জবাব ছিল হাসি হাসি মুখ। এতেই খাইরুন যা বুঝার বুঝে যেতপ্রথম প্রথম জবাব দিতে দিতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে যেতাম। রাগ করতাম, এক সময় ঘর থেকে বের হয়ে সোজা চলে যেতাম। উদ্দেশ্য যেদিকে দুচোখ যায়। অবশ্য আমার চোখ খুব বেশি দূরে যেত না, বড়জোরপাঁচকোনা মোড় বাজারেনিতাই ঘোষদের মিষ্টির দোকানপর্যন্তওখানে কেউ না কেউ আমাকে আটকে দিত অথবা আমি নিজেই আটকে যেতাম শুরুর দিকে খাইরুন পরপর বেশ কয়েকদিন আমার পেছন পেছন এসে একটা জিনিশলক্ষ্য করেছে, বেশি দূরযাবার সাহস এবং সামর্থ্য কোনটাই নেই আমারধরে নিয়েছে ওটুকুই আমার সর্বোচ্চ সীমানা তাই বোধহয় আমাকে নিয়ে তার বড় রকম ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা ছিল না কোন দিনই

নিতাই ঘোষএখন যে ছোট্ট দোকানটায় আছে, তার পেছনের সারের আড়তটা ছিল তাদের আসল দোকান । দেশ স্বাধীনের আগে নিতাই ঘোষের বাবার জমজমাট মিষ্টির ব্যবসা ছিল এই পাঁচকোনা মোড়ের বাজারে।মিষ্টির দোকান বলতেও এই একটাই ছিলসাত-পাঁচ গ্রামেনিতাই ঘোষের দাদাএই দোকান চালু করেছিলেনআরো অনেক আগে । তখনদোকানের সামনের এক কোনে একটা কেটলিতে চায়ের পানি ফুটতো বক বক করেতরুন নিতাই ঘোষের কাজ ছিল চায়ের দোকানটা আগলানো আর কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী রঙচা, দুধচা বানিয়েদেওয়াসমাজের কামলা থেকে চাকুরে, মুচি-মেথর থেকে জেলেসবাই এখন চাখোর ।তখনকার দিনে কিন্তু এই এলাকার মানুষ খুব একটা চা খেত নাযে দুই চার শিক্ষিতজন, সকাল সন্ধ্যা দেশের রাজনীতি নিয়ে জ্ঞান গর্ভ কথা বলতেন নিজেদের মধ্যে, তাদেরই আড্ডা বসত চায়ের দোকানে ।দীর্ঘ ইতিহাসের ঘুরপ্যাঁচে বাপের জৌলুস গিয়ে নিতাই ঘোষের বর্তমান অবস্থা এতটাই খারাপ যে কোন রকমে বেঁচে আছে বলা যায়  । আর বেঁচে থাকার একমাত্রসম্বল বলতে এই চায়ের দোকানটা । আর চাটা বেশ ভালো বানায় বলে সকাল সন্ধ্যা লোকের ভীড় লেগে থাকে দোকানে নিতাই ঘোষকে কেউ কাকু, কেউ জ্যাঠা, কেউ দাদু বলে ডাকে। আমি অবশ্য নিতাইদাই বলি
বাড়ি থেকে খইরুনের সাথে ঝগড়া করে দোকানের কাছে আসতেই নিতাইদাকে দেখতাম দোকান সামলাচ্ছেন ।আমার নাম ধরে ডাক দিত ।চুপচাপ গিয়ে বসতাম বাইরের বেঞ্চিতে । দিনের বেলায় এলাকার মুরুব্বীরা খুব একটা আসতো না এদিকে । তাই নিঃসংকোচে একটা পাতার বিড়ি ধরাতামনিতাইদাকিভাবে যেন বুঝে যেত বিড়ির সাথে আমার চা দরকার এককাপএকটু পরেই নিতাইদা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলতো,
কিতারে মগা, আজকাও বৌয়ের সাতে কাইজ্জা করসস নি কিতা ?”
আমি একমনে বিড়ি ফুঁকতামএকটা বিড়ির আগুন দিয়ে আরেকটা ধরাতাম। নিতাইদা আমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকতো না কখনোইজানে উত্তর পাওয়ার আশা এই মুহূর্তে দুরাশা তাছাড়া কত কত কাস্টমার তার দোকানে? একদিকে মন থাকলে কি আর দোকান চলে?
ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি বসে থাকতাম বেঞ্চিতেকখনো সখনো নিতাইদা আমায় ডেকে বলতো,
ওরে মগা, জগাইদের চাপ কলেত্থাইক্কা এক বালতি জল আইন্না দিতে ফারবে নি রে?”
বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে রওয়ানা দিতাম বালতি হাতে। ফিরে এলে নিতাইদা একটা বিরাট হাসি দিয়ে এক কাপ চা এগিয়ে দিত আমার দিকে। কখনো কখনো একটা পাউরুটি চেয়ে নিতাম নিজ থেকেই

আমার একটাই নাম, মগা। এই মগা নামের ভিড়ে নিজের বাপ মার দেয়া নামটা কখন যে চাপা পড়ে গেল বুঝতেই পারিনি একেবারে। ছেলেবেলা থেকেই সবাই আমাকে মগা নামে ডাকেদেখতে গায়ে গতরে একটু নাদুস ছিলাম ছোটকাল থেকেই, সেই তুলনায় বুদ্ধি নাকি একটু কম ছিল আমার, মার কাছ থেকে শুনেছি অনেক বার আশেপাশের ছেলে মেয়েরা যখন ঘটা করে আমার কম-বুদ্ধির কথা বলে খেপাতো, তখন খুব খারাপ লাগতো। অবশ্য পেশি শক্তিতে তারা পেরে উঠত না কখনোই। তাদের কথার মারপ্যাঁচে ভড়কে যেতাম আমিআর তখনই এক দৌড়ে চলে যেতাম মায়ের আঁচলে। কোন রকমে ম্যাট্রিক পর্যন্ত গিয়ে আর এগোনো হল না ।বড় হবার সাথে সাথে মানুষেরখুঁচা কথাআর গায়ে লাগতো না তেমন একটামগা নামটাও সয়ে গেছে আস্তে আস্তেএখন এবং তখন এই এলাকায় মগা বলতে সবাই একনামে আমাকেই চেনে। বিয়ের প্রথম দিকে এই নিয়ে খাইরুনেরও অনুযোগ ছিল মেলাবাইরে বের হলেই মগারবৌ ডাকটা শুনতে হত তাঁকে কারনে অকারনে ।দিনকে দিন একই নামশুনতে শুনতে, পরে অবশ্য তারও অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলশুরুর রাগটা শেষে পানি হয়ে গড়িয়ে পড়েছিল মনের ঢাল বেয়ে ।

আমার জন্ম দেশ স্বাধীনের ঠিক বছর বিশেক আগে। সেই হিসাবে আমার বয়স এখন ষাট পেরিয়েছে নিঃসংকোচে। নিতাইদা আমার চেয়ে চার/পাঁচ বছরের বড় হবে।সে মতে নিতাইদার বয়স সত্তরের কাছাকাছিনিতাইদার বছর দুয়েকের ছোট একটা ভাই ছিল। আমরা তিনজন একসাথে একাত্তরে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলামনিতাইদাযুদ্ধে তার ভাইকে নিতে চায়নি বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা । তাদের দেখাশোনার লোক লাগে একজন । কিন্তু বড় গোঁয়ার ছিল নিতাইদার ভাইটা। এক রকম জোড় করেই আমাদের দলে যোগ দিয়েছিলো। একদিন প্রতিপক্ষের সাথে সামনা সামনি যুদ্ধে প্রাণ হারায় চরম সাহসী নিতাইদা ছোট্ট একটা দল নিয়ে সেদিন হায়েনাদের ক্যাম্প দখল করেছিলো কি দুর্দান্ত প্রতাপে, আজো শিউরে উঠে সারা শরীর ।আমার কাটাহাতে আজো শিনশিনেঅনুভূতি জাগে

দেশ স্বাধীনের পর যখন গ্রামে ফিরে আসি তখন গ্রাম আর গ্রাম ছিলো না । বাতাসেমিশেছিলো মাংস পোড়া গন্ধ । চারপাশে বাড়িঘরের দৈন্যরূপ, ভয়ানক মৃত্যু শিহরণ । এখানে সেখানে পড়ে থাকা মানুষজনের পচা দেহ আর কংকাল নিয়েকাক-শকুন-কুকুরে টানাটানি । বাড়ি ঘরগুলো খাঁখাঁ করছে,চারদিকে শুধুই শূন্যতাএই নয় দশ মাসে কত কিছু যে বদলে গেছে ? বিশেষ করে নিতাইদাদের পাড়াটাতার বাবা-মার হদিস কেউ দিতে পারেনি সেদিননিতাইদাদেরএকমাত্র চায়ের দোকানটার নিশানাও মুছে ফেলেছে কারা যেন । পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি নিজেদের ভিটে-মাটি-জোত-জোয়াল যা কিছু ছিলসবই গেল নিতাইদাদেরপাঁচ পাঁচটা দুধেল গাই ছিল, ষাঁড় ছিল, বকনা বাছুর ছিললুটে নিয়েছে কারা যেন ।

একদিকে ভাই হারানোর শোক, অন্যদিকে বাবা মা সহায় সম্পত্তি সব খোয়া যাওয়ায় পাগল প্রায় নিতাইদা শেষ পর্যন্ত আবারওচায়ের দোকান দেয়ার চিন্তা ভাবনা করে শুন্য ভিটে আগলে বেঁচে থাকতে চায় ।

এর মাঝে একদিন খবর আসে নিতাইদার বাবা-মা ভারতের কৃষ্ণনগরে তার এক দূর সম্পর্কের মামার আশ্রয়ে আছেননিতাইদাকেও চলে যেতে বলেছে ওখানে । নিতাইদা মত দেয়নি । যে দেশে রয়েছে তার দশ পুরুষের ভিটে, যেখানের মাটিশুষে নিয়েছে ভাইয়ের রক্তের ফিনকি, সে দেশ ছেড়েসে দেশের মাটি ছেড়েকোথাও যাবেনা । এমনই পণ নিতাই ঘোষের ।আস্তে আস্তে শোক ভুলে ঘুরে দাঁড়ানোনিতাইদা অনেক বলে কয়ে তাদেরই দোকানের এক কোনে একটা ছোট্ট কাঠমাচায় পান সিগারেট আর চায়ের জন্য জায়গা পেয়েছেআরতিল তিল করে গড়ে তুলেছে নিজের বেঁচে থাকার অবলম্বন।কিশোর বয়সে চা বানানো হাত প্রৌর বয়সে যেন আরো বেশি স্বাদ ছড়াচ্ছে

খাইরুনের সাথে আমার বিয়ে হয় সংগ্রামের বছর পাঁচেক আগে । সংগ্রাম গেল আজ চল্লিশ বছর ।খাইরুন চলে গেল সে বছরই খাইরুনকে রেখে যেদিন যুদ্ধে যাই সেদিন তার ডাগর ডাগর চোখে ঢল নেমেছিল শ্রাবনেরযতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়েছিলো, বুকের সাথে দুহাতে জড়িয়ে ধরা লেপটে থাকা কদম গাছটাকেছাড়তে চায়নি । দূরে থেকে আবছা দেখলাম আমার বাবা-মা ওর হাত ছাড়ায়ে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘরের দিকে । জিন্দা লাশ দেখেছিলামসেই প্রথম ।
আজ কদম গাছটা নুয়ে পরেছে বয়ভারের । নিশি রাতে যখন বুকের ভেতরটা হুহু করে দংশায়, তখন গাছটার নিচে গিয়ে দাড়াই । টের পাই খাইরুনের কচি হাতের নিশানা লেগে আছে গাছের বাকল জড়িয়েগাছটাকে আলতো স্পর্শে যেন আজো খাইরুনেরে অনুভব করি
এই স্পর্শানুভব থেকেই আসে মানুষিক শান্তি । আর এই অনুভবটা আসে দুভাবে মনে । একদিকে বৌয়ের হাতের স্পর্শ অন্যদিকে কিছুকষ্টের আর্ত চিৎকার ।

আমার যুদ্ধে যাবার গোপন খবর পেয়ে একদিন বাবাকে অমানুষিক টর্চার করা হয় । একজন বৃদ্ধের সাথে যতটা নির্দয় হওয়া যায় তারও চেয়ে বেশি নৃশংসভাবে । এক সন্ধ্যায় তাকে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে ধরে নিয়ে যায় কদম গাছটার কাছে । ওখানে গিয়েই বাবা দুহাতে কদম গাছটাকে আগলে ধরেনপরে শুনেছি কদম গাছটাকে জড়িরে ধরা অবস্থায় নাকি তার মৃত্যু হয় । খায়রুন আর মা রান্না ঘরের পেছনে লেবু ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে পড়েছিল তখন । পাকি পশুরা আর তাদের দোসর রাজাকারা চলে যাবার পর ওরা বাবার কাছে ফিরে এসে দেখে সব শেষ । রাতের অন্ধকারে খাইরুন আর মা মিলে বাবাকে চিরশায়িত করে কদম গাছের নিচে । সেই যে মায়ের মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঠিক হয়নি পুরোপুরি । দুই দুইটা হত্যা চোখের সামনে ঘটতে দেখে মার যে স্মৃতিভ্রম হয়, এটা চির স্বাভাবিকএরপর থেকে মা সারাদিন ঝিম মেরে বসে থাকতেনবার বার জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যেতএক আধবার

খাইরুনকে প্রথমে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় বাবাকে হত্যা করার ঠিক তিন দিনপর । রাতের অন্ধকারে কারা যেন ঘরে ঢুকে প্রথমেই মাকে বেঁধে ফেলে । মায়ের দিকে রাইফেল তাক করে ওদের কজন মত্ত উল্লাসে গোঁফে পাক তুলে এগিয়ে যায় ভয়ার্ত খাইরুনের দিকে । গুলির ভয় উপেক্ষা করে মা শুধু বলতে পেরেছিল,
খাইরুনি পালাইয়া যা ।

এরপর মায়ের কি হয়েছিল জিজ্ঞেস করিনি কোনদিন । মাও বলতে চায়নি । না বলা কথা আমি মায়ের চোখে পড়ে নিয়েছিলাম সব । খাইরুন থাকলে হয়তো জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া যেত । কিন্তু খাইরুনও তো বেশিদূর পালিয়ে যেতে পারেনি সেই রাতে ?ঐ যে কদম গাছটা, ওটা তাকে পালাতে দেয়নি । চারদিক থেকে হায়েনার দল যখন কদম গাছকে ঘিরে ফেলে তখনএক পর্যায়ে কদম গাছকে জড়িয়ে ধরে খাইরুনেও মৃত্যু ঘটে । পরে মায়ের কাছে শুনেছি, জ্ঞান ফিরে আসার পর কদম গাছের নিচে একটা নতুন কবর দেখতে পানতিনি

আমি বাড়ি ফিরে আসি দেশ স্বাধীনের প্রায় একমাস পর । আমার স্মৃতি বিকৃত মায়ের পাশে থেকে আস্তে আস্তে তার স্মৃতি ফিরে পাবার সব রাস্তা খুঁজতে থাকি । যখনই মা কিছুটা ভালো থাকেন তখনই একটু একটু করে সব ঘটনা জেনে নিতাম কিংবাজেনে নেয়ার চেষ্টা করতামযেদিন মা মারা যান, শেষ নিঃশ্বাস বন্ধ হবার আগে শুধু এটুকু বলেতে পেরেছিলেন,
কদম
আমি যা বুঝার বুঝে গিয়েছিলাম এই এক শব্দের মাঝে
মায়ের কবরটা কদম গাছের নিচে বাবার কবরের বাঁপাশে । খাইরুন আর মায়ের কবরের মাঝে এক কবর পরিমান ফাঁকা জায়গা ।

সেদিন কথায় কথায় আমি নিতাইদাকে বলে দিয়েছি যা বলার । নিতাইদাও বুঝে গেছেন বোধয় কারণ তার আদ্র চোখের ভাষা আমার শুষ্ক চোখ পড়ে নিয়েছিলো নিমিষে ।