গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

'গল্পগুচ্ছ' ৪৫তম সংখ্যা ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩

এই সংখ্যায় লিখেছেন ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, নির্মাল্য চট্টোপাধ্যায়। দেবাশীষ দে , কৌশিক ভাদুড়ী ও মিত্রপক্ষ সাই

নির্মাল্য চট্টোপাধ্যায়


ঘুম

দাদা সব আছে , পছন্দ হবে আসুন আসুন। ও দাদা এদিকে ...... দাদা সব একদম ফ্রেস। (চোখ টিপে) বাঙালি নেপালি বাইরের ষ্টেটের আছে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ফাস্ট টাইম, এক্কেলাস জিনিস আছে দাদা, এ লাইনে পাঁচ বছর স্যান্ডেল ঘসা হয়ে গেছে, এখন কাস্টমারের মুখ দেখে বুঝে নি কে কি খুঁজছে। একটানা বলে চলেছে,পাক্কা সেলস ম্যানের মতই গছানোর ধান্দা কমিশন পাবার জন্য।
সিগারেটের শেষ টুকু চটি তে পিষে অরচিস্মান জিগ্যেস করল কোন ঘরে জেতে হবে। টার্গেট ফুলফিলের খুশি নিয়ে ‘আসুন আসুন এদিকে’ প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের এক ফালি গলিতে ঢুকে পড়লো ছেলেটি, সাথে পা বাড়াল অরচিস্মান।
এই ডলি বলে ডেকে নিজেই সস্তার পর্দা উঠিয়ে ঢুকে গেলো ছেলেটি। চাপা স্বরে কথা বলেই বেরিয়ে এলো খানিক পরে। ‘চলে আসুন দাদা। ডলি পরে আসছিরে দাদা কে দেখিস’ চোখ টিপে বলে চলে গেল চেলেটি ।

সাদামাটা একটা ঘর পুরনো দিনের খাট দেওয়ালে ঝোলানো একটা সস্তার আয়না যাতে নিজেকে দেখে নিতে নিতেই ডলি বললও আসছি অরচিস্মান ঘরটা গ্লোবের নীল চোখের মত করে একবার ডান একবার বাম দিক দেখে নিলো। খাটের ডান পাসের আয়না-তালি পর্দা টা দেখে নিজের মনেই হেসে ভাবতে লাগলো এই পর্দা এই ঘরের আর্থিক অবস্থার মাপকাঠি আর কোন পস এলাকার হাজার স্কোয়ারফিট ফ্ল্যাটে থাকলে গর্বিত দম্পতি বলে উঠবেন সাউথ সিটি মলের অমুক দোকান থেকে কেনা নকশী কাঁথা ডিজাইন, কস্টলি।

সম্বিৎ ফিরে পেল, পর্দা সরিয়ে ডলি জানতে চাইল রাম না হুইস্কি ? মাথা নেড়ে লাগবেনা জানালো অরচিস্মানশুনেই ভুরু কুঁচকে ডলি বলে ‘অন্য কিছু লাগলে বোল ওই বিসু কে মাল কিনে আনতে বলি’
-কিছু লাগবেনা, আমি খাইনা   আপনা্কে কতো দিতে হবে ? ওই ছেলেটি বলেনি আমায়।
- ২৫০ দিন। জামার বুক পকেট থেকে দুটো একশ টাকার আর একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিল। টাকাটা হাতে নিয়ে আবার পর্দার পেছনে চলে গেলো ডলি, ওটাই ওর অন্তঃপুর, ঘরের মধ্যে একফালি ঘর। মুহূর্তেই ফিরে এসে খাটের বালিশ ঠিক করে তাকালো, যেন অরচিস্মানের হুকুমের তামিল করতে ও প্রস্তুত, ২৫০ টাকায় কিনেছে ওকে আর ওর শরীরটাকে
‘জানলা টা বন্ধ করে দেবেন’হো হো করে হেসে উঠলো ডলি, ‘এখানে কেউ কারোর ঘরে উঁকি মারে না ভদ্দর লোকদের মত’ঠিকি বলেছে ডলি, এইখানে ক্রেতা আর খদ্দের মাঝে কি হচ্ছে তা নিয়ে কারোর মনে কোনও কৌতূহল নেই, মনে মনে আওড়াল অরচিস্মান। ‘না তবুও বন্ধ করে দিন অন্ধকার আমার ভালো লাগেক্রেতার নির্দেশ পালন করল ডলি।
ডলির চোখে ঈষৎ বিরক্তি এমন অদ্ভুত খদ্দের সামলাতে আগে হয়নি, তাই নিজেই ব্লাউজের হুক খুলতে শুরু করতেই, অরচিস্মান হাত তুলে নিষেধ করলো। ‘কি করবে বলতো মাইরি, এই বিসে হারামি কে আগেও বলেছি খদ্দের বুঝে আনবি’
‘আমি একটু ঘুমবো’

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


করণিক


কদিন ধরেই একটানা বৃষ্টি হয়েই চলেছে, থামার কোন নাম নেই। আজও অফিস যাবার সময় বিরক্তি বোধ করল অতসী। গত কালকের শাড়ী, সায়া এখনো ভিজে ভিজে হয়ে আছে। কাল ফিরতে রাত হয়েছিল, ভাল করে শুকোবার সময় পায়নি। এখন সাতসকালে উঠেই আবার অফিস যাবার তাড়া। বাইরে পরে যাবার খুব বেশি ভাল শাড়ী, জামা নেই অতসীর । হাত দিয়ে শাড়ীর পায়ের দিকে ফলস পাড় লাগানোর জায়গাটা একবার দেখল, ভিজে রয়েছে অনেকটাই। নিরুপায় হয়ে একটা ধোওয়া শাড়ীর পাট ভাঙল অতসী। অফিস থেকে ফিরে কালকের শাড়ীটা ইস্ত্রি করে রাখতে হবে। সত্যি, তাদের মত মানুষদের কি অবস্থা ! আর ওদের দ্যাখো, মনে মনে মিত্র বাড়ির লিপিদির কথা ভাবল অতসী। গাড়ি করে অফিস যায়, আসে। বৃষ্টিতে ভিজতে হয় না, দেদার জামাকাপড়। এক বুক চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বাথরুমে ঢুকল অতসী।

খাওয়া-দাওয়া, সাজপোশাক সব সেরে ব্যাগ গুছিয়ে অফিসে যখন বেরোল তখন ঠিক নটা বেজে দশ ন্মিনিট। আজ পাক্কা পঁচিশ মিনিট লেট। বাস না পেলে কপালে লাল কালি লেখা আছে। বাড়ির সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে বাসস্টপে এসে দেখল, লীলা, কণিকা, মানসীদিরা সব দাঁড়িয়ে। কি ব্যাপার, আজ সবাই দাঁড়িয়ে কেন ! ওর নাহয় দেরী হয়েছে, কিন্তু এরা যায় নি কেন? মুখে একটা প্রশ্নচিহ্ন করতেই মুখ ব্যাজার করল মানসীদি। কি ব্যাপার... না বাস এখনো আসেনি, এই রুটে বোধহয় কিছু গোলমাল হয়েছে। এখন থাকো বসে ! সকলেই কাছাকাছি থাকে। একবাসে অফিস পাড়ায় যাবার সুবাদে সকলের সঙ্গেই পরিচয়। সকলে এক অফিসে নয়, কিন্তু একসঙ্গে এক জায়গাতেই নামে, ওঠে- তারপর যে যার অফিসে। সে সূত্রেই বন্ধুত্ব। আজ বসের গোমড়া মুখ, লাল কালির দাগ এই ধরণের আলোচনা চলছে বোঝা গেল। এসে দেখল লীলা ছেলেমানুষের মত এখানে রাস্তাতেও কণিকার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এটাই স্বভাব লীলার। রাস্তা পার হবার সময়েও কারো না কারোর হাত ধরে থাকে। বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়েই সকলে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরে আরো কয়েকটি ছেলে-ছোকরা এবং দুটি উঁচু ক্লাসের ছাত্রীও পিঠে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে বাসের আশায়। হঠাৎই পিছনে গাড়ির হর্ণ শুনে চমকে কণিকার হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় লীলা। সকলে একটু সরে দাঁড়াতেই হুস করে পেরিয়ে গেল লাল গাড়িটা। লিপির সঙ্গে চোখাচোখি হল অতসীর। হয়তো হাতছানি দিয়ে ডাকবে ওদের, এমনটাই ভেবেছিল অতসী। গাড়িতে একটিমাত্র প্রাণী, দু-চারজন মেয়ে বা মহিলা কে সঙ্গে নিয়ে যাবার তো কোন অসুবিধে ছিল না, তাছাড়া এখন অফিসের সময়, বৃষ্টিও হয়েছে, বাসের জন্য সবাই দাঁড়িয়ে...কিন্তু মুখের বিস্ময় মুখেই মিলিয়ে গেল‘ইস, হাত তুল্লেই হত...বলে অতসী। ‘ছাড়তো, বড়লোকের ব্যাপার, না থামিয়ে ভালই করেছিস...’-- অতসীর অপ্রস্তুতের হাসি দেখে বলেন মানসীদি। ‘ঠিক বলেছেন মানসীদি, পরে কথা শুনতে হত’-- বলল লীলা। খারাপ লাগছে অতসীর। ঠিক দুটো বাড়ি পরেই থাকে লিপিদিরা। অথচ এমন ভাবে গেল, যেন চেনেই না। অতসী দেখেছে, ওদের ছোট কিন্তু ঝকঝকে বাড়িটাকে। তুলনায় অনেক বড় বাড়িতে থেকেও অতসীদের বাড়ির কোন ছিরিছাঁদ নেই। কবেকার ঠাকুরদাদার আমলের বাড়ি। রঙ চটে গেছে জায়গায়, জায়গায়, পলেস্তরা খসা। সত্যি, রঙ্ করলে এই বাড়িটাই হবে পাড়ার সেরা বাড়ি। অতসীও জানে, এত বড় বাড়ি এ তল্লাটে আর নেই। তার নিজেরও খুব ইচ্ছে, আরো একটু চাকরিটা ভাল হলে, একটা প্রোমোশন হলে সে একটু একটু পয়সা জমিয়ে বাড়িটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলবে। ইস, মা যে কি খুশি হবেন...ভাবল অতসী, ভাইও। এই তো সেদিন, নীলাদ্রি, ভাই এর বন্ধু বলছিল--তোদের খাবার ঘরটা কি বড় রে... ফুটবল খেলা যায় ! নীলাদ্রির কথা শুনে দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল টুটুল। অতসীও মুচকি হেসেছিল। কিন্তু এবার খুব বিরক্তি বোধ করছিল অতসী। আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়াতে হবে কে জানে ! এর চেয়ে বাড়ী চলে যাওয়াই ভাল। নাহয় একটা লিভ নষ্ট হবে, কিই বা করার আছে তার! ভাবতেই একটা হই চই...বাস আসছে। ছুটল সবাই, যে ভাবেই হোক, বাসে উঠতেই হবে। টানা, হ্যাঁচড়া করে উঠতে গিয়ে পায়ের কাছে একটা টান অনুভব করল অতসী। গেল নাকি, সেরেছে ! ফ্যাঁস করে কি যেন মনে হল...বাসের পাদানিতে আটকে গেছে তার শাড়ী। টেনে নিয়ে উঠে পড়ল সে। যা হবার হবে, অফিসে গিয়ে দেখা যাবে। কি আর করবে সে, অফিসে গিয়ে নাহয় শাড়ীটা উলটো করে ঘুরিয়ে পরে নেবে। দুঃখে কান্না এসে গেল তার। আজ যেন জানত কিছু একটা হবে। এত ভাল শাড়ীটা গেল। কটাই বা আছে, যে একটা গেলে আরো একটা হবে ! অফিসে গিয়েই বাথরুমে উলটো করে শাড়ীটা পরে নেবে, কেউ দেখার আগেই। নাহলে নিজেই পা জড়িয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও আছে। আরো গোটা দুই শাড়ী তার না হলেই নয়। একটা প্রোমোশন হলে আগেই তার কিছু কিছু জিনিস কিনে ফেলতে হবে। অতসীর আগে ধারণাই ছিল না এত কিছু লাগে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে দেখেছে, কিছু কিছু জিনিস না কিনলেই নয়। এতদিন বাড়িতে বসে থাকার জন্য এগুলোর প্রয়োজন সে অনুভব করেনি, আজ বুঝতে পারছে, এর প্রয়োজন। অফিসেও শুনেছে, কয়েকজনের নাকি প্রোমোশন হয়েছে, তারা শিগগির তিনতলায় শিফট করবে। নতুন করে তিনতলা সাজানো হচ্ছে তাও দেখেছে। আজ একবার দোতলার কানুদার কাছে যেতে হবে খবরটা নিতে কানুদা মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন ! একদিন বললেন...এই করণিক মানে তো কেরাণী, তাহলে মেয়ে কেরাণীদের কি বলে রে, আরে, তোরা তো বাবা সব মেয়ে কেরাণী।
সেদিন মল্লিকা খুব রেগে গিয়েছিল। কেন, আমরা কেরাণী তো কি কানু দা, তারা কি মানুষ নয়! সত্যিই তো, সেও তো কেরাণীই। দুর...কি হবে এসব এত আগে থেকে ভেবে--অফিসের সামনে বাস থেকে নামতে নামতে ভাবল অতসী। তাড়াতাড়ি চোখ এড়িয়ে নিজের জায়গায় ঢুকে পড়তে চায় সে।

ভেতরে ঢুকেই ত্বরিত পায়ে এগিয়ে গেল মেয়েদের সাজঘরের দিকে। সাজঘর না আরো কিছু! দোতলার কানুদা মেয়েদের বাথরুমকে বলেন সাজঘর। ভালো মেজাজে থাকলে হেসে হেসে কথা বলেন কানুদা—‘কি করিস রে তোরা সাজঘরে গিয়ে। এমনিতেই তো ঘটার শেষ নেই, আবার অফিসেও কেন বাবা, পারিস ও তোরা’! মল্লিকা মাঝে মাঝে খুব ঝগড়া করে কানুদার সঙ্গে। না, ঠিক ঝগড়া নয়, খুনসুটি বলাই ভালো। ‘বেশ করি , ঘটা করি ! আহা, আর লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের দেখার বেলা, তার তো কমতি নেই’ !! ছদ্ম রাগে বলে মল্লিকা।
‘এ কি রে, কি বলে মেয়েগুলো... রাম বলো ! তোদের দিকে কে তাকাবে বাবা, তোমরা সব এক একটি অসুর-দলনী দুর্গা’...বলেই হো হো করে হেসে ওঠেন কানুদা। বয়স্ক মানুষটির সস্নেহ হাসি ভাল লাগে অতসীর। আজ একবার যাবে কানুদার কাছে, খোঁজ নেবে সেই প্রোমোশন লিস্টের ব্যাপারে  

সাজঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে টেবিলে গুছিয়ে বসতেই না বসতেই হাঁক ‘...অতসী মজুমদার...... বড় সাহেব ডাকছেন’-- বেয়ারা পূরণচাঁদের হাঁক। অতসীর টেবিলের তিনটে টেবিল ওধারে বসেন বাসুদেব দা, কানুদার চেয়েও বড়, আর মাত্র তিনমাস পরেই রিটায়ার করবেন, অতসীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। যার অর্থ...যাও, বড়সাহেবের চাঁদ মুখখানা দেখে এস। আজ তোমার হচ্ছে। যেমন দেরী করে আসা...উপায় কি! মুখে বিরক্তির ভাব করল অতসী। আজ অনেক দেরী হয়েছে, সে জানত এমনই কিছু হবে। রোজ রোজ দেরী হলে বড় সাহেব কি ছেড়ে দেবেন কাউকে, দোষ তো তাদেরই। মনে মনে প্রস্তুত হয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে বড় সাহেবের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল হাতে একটা বড় সাদা খাম নিয়ে। ভয়ে মুখ সাদা। ভাবতে পারছে না, কি হবে। কোন কথা না বলে নিজের টেবিলে এসে বসল, তারপর ঢকঢক করে এক গেলাস জল খেল। বুঝতে পারছে সামনের টেবিলগুলো থেকে সবাই তার দিকে তাকিয়ে। কারো দিকে তাকাল না অতসী। কেমন যেন লজ্জ্বা, অপমানের মত লাগছে। খামের মুখ ছিঁড়ে একবার, দুবার চিঠিটা পড়ল... আর তারপরই মুখ গুঁজে দিল টেবিলে।
ওপাশ থেকে ছুটে এলেন বাসুদেবদা, মল্লিকা। কানুদার গলাও শোনা গেল।
--
‘কি হয়েছে রে, কি লিখেছে বড় সাহেব, দেখি...’ হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন কানুদা। আর তারপরই চীৎকার করে উঠলেন ‘...মারব একটি থাপ্পড়, বড় দাদাদের সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে, না! তুমি ফাজলামো করছ, প্রোমোশন পেয়েছ তুমি, এবার থেকে তোমার অফিস তিনতলায়, বুঝলে করণিক অতসী মজুমদার...না না, সরি, জুনিয়র লেবার অফিসার মিস অতসী মজুমদার। এবার থেকে কোম্পানীর গাড়ি দেওয়া হবে তোমায় অফিস আসা-যাওয়ার জন্য। আরে, তুই তো একই গাড়িতে আমার সঙ্গে আসবি রে !’ -- আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন কানুদা।  মুখ তোলে অতসী। চোখে জল... ‘না কানুদা, আমি একা না, ওই লীলা, মানসীদি আর কণিকাকেও সঙ্গে নেবো, ওরা নেমে যাবে আমাদের অফিস মোড়ে। বৃষ্টিতে খুব কষ্ট হয়, আপনি না বলবেন না... বাস না এলে..’ আর বলতে পারে না অতসী। হাসিমুখে অতসীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন বাসুদেবদা। বড় সাহেবের কাছে তিনিই অতসীর নামটা রেকমেণ্ড করেছিলেন  করুক, একজনের জন্যও যদি কিছু করতে পারে অন্যের জন্য,করুক না ! এভাবেই তো শুরু। তিনিও তো চেয়েছিলেন অতসীর জন্য। এগিয়ে যাক অতসীরা। পারবে, ওরাই পারবে এগিয়ে যেতে, স্বপ্নপূরণ করতে একদিন।

দেবাশীষ দে


সম্পর্ক


রুমেলি বিজনকে ভালোবাসে। ওদের প্রমের বয়েস চার মাস হলেও রুমেলি বাড়িতে সে  কথা জানায়নি। কলেজে যাওয়া আসার পথে সে সময় দেয় বিজনকে।
       
কলেজে এক্সকারসনে গ্যাংটক যাওয়ার জন্য রুমেলি আবদার করে বাবা মা’র কাছে, একমাত্র সন্তানের আবদার রাখে বাবা মা। এক্সকারসনের নামে বিজনের সাথে শিলিগুড়ি যাওয়ার  কথা বাবা মা টের পায় না।

রুমেলি শিলিগুড়ি হোটেলে। বাবা মাকে ফোনে জানায় ঠিক ঠাক পৌঁছেছে ও। বিজন, বাইরে কিছু খাবার আনতে হবে, বলে রুমেলিকে। বিজনের মোবাইলে ব্যাটারি চার্জ নেই তাই সে রুমেলির ফোনটা সঙ্গে নেয়, যাওয়ার সময় বলে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার নিয়ে ফিরে আসছে সে।
       
প্রায় আধ ঘন্টা পর দুজন লোক এসে হোটেলে রুমেলিদের দরজা নক করে। রুমেলি বিজন ভেবে দরজা খুলে দেয়। তারা জানায় রাস্তায় বিজনকে একটা গাড়ি ধাক্কা মেরেছে,ও বেহুঁস এখন, রুমেলিকে তারা সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় হসপিটালে। রুমেলি কিছু ভাবতে পারে না, ওদের সঙ্গে  যায়।
       
গাড়ি বেশ কিছুটা যাওয়ার পর একটা  ছোটো বাড়ির সামনে থামে। রুমেলি সামনে হসপিটাল দেখতে পায় না, বিজনকেও দেখতে পায় না। ওরা ধাক্কা দিয়ে রুমেলিকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। ওদের কাছে বিজনের কথা জানতে চাইলে ওরা খারাপ খারাপ কথা বলে, ভয় দেখায়............ তার পরের কথা রুমেলির মনে পড়ে না।
       
তিনদিন হল রুমেলি এখন ব্যবসায়ী হয়ে গিয়েছে। রোজ খদ্দের আসে তার ঘরে, রুমেলি বুঝতে পারে না সে এখন কোন দেশে আছে। বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ তার। অসহায় রুমেলি বোঝে ভালবাসাতেও চোরা বালি থাকে।
       
রুমেলির বাবা মা বহু চেষ্টা করেও মেয়ের সন্ধান পায় না । অসহায় দুজোড়া চোখ শুধু রেডিও, পেপার আর টিভিতে খুঁজে বেড়ায় তাদের একমাত্র সন্তানকে।





কৌশিক ভাদুড়ী


পাগল


বিকল কলের নীচে
ফোঁটা ফোঁটা জল।
সেইস্থল ঘন শ্যামল
তৃণ তো বলে না তাকে
লোকে।
সেই সব প্রশস্ত ফার্ন
খেয়ে বেড়ে ওঠা গরু
তার জিভে ঘাসের প্রকৃত স্বাদ
ভুভুজেলায় আড় বাঁশির
উপরিপাত
কোনো ভাবে নয় ঘাস
সেই সব গবাদিরা
শৈবালজীবি না পাগল
না কী সঙ্গত ভাবে কবি
             
       পাড়ার জীবনদাকে আমার কৈশোরে দেখা। ওঁকে সম্বোধন করতে কারোকে শুনিনি। অনুপস্থিতিতে প্রসঙ্গোত্থাপন হলে সবাই অবশ্য জীবন পাগলাই বলত। খ্যাত ও কুখ্যাতদের যেটা হয়- বাবাও যে সম্পর্ক ধরে ডাকেন- ছেলেও তাই তা জীবনদা ছিলেন পাড়ার ছেলে বুড়ো সবারই দাদা। মার্জিত ভাষী। মৃদু কন্ঠী। চৌধুরী বংশ জমিদার বংশ সেই কুল জাতসিঁদুরে আমের মত গায়ের রং। মধ্যম উচ্চতা দীর্ঘ নাসা। দীঘল চোখ। কিন্তু পাগল। জ্ঞাতিরা ওঁর পৈতৃক সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে প্রায় গৃহচ্যুত করেছিল। বিশাল প্রাসাদপ্রম বাড়ি বারবাড়ির একতলায় দরজা জানলাহীন এক প্রাচীন প্রকোষ্ঠে রাত কাটাতেন তিনিআর দিনের বেলা পাড়ার অলিতে গলিতে। খিদে পেলে, চেনা বাড়ির ফটকে দাঁড়িয়ে ডাক পারতেন। আমার ঠাকুমা গ্রামসম্পর্কে ওঁর বৌদি। কত শুনেছি বিরল কম্পাঙ্কের সেই ডাক- যেন চক্কররত বোলতার পাখার আওয়াজ- বৌদি.........ই খেতে দিন......... কখনও হয়ত দিদিয়া, আমরা ঠাকুমাকে ওই নামে ডাকতাম, বলতেন- জীবন চান করেছ ? যাও করে এস অমনি জীবনদা শানেরঘাট, মানে সামনের পুকুর থেকে একটা ডুব গেলে আসতেন মোছামুছির বালাই নেই, আর কী করেই বা গা মোছা যায়, কাপাস বলতে তো উর্দ্ধাঙ্গ নিরাভরণ, নিম্নাঙ্গে প্রলম্বিত ছেঁড়া শার্ট, যার হাতা দুটি কোমরে বেল্টের মত করে বাঁধা। সেটা তো প্রকাশ্যে উন্মোচন করার নয়। তাই গা মোছারও ব্যাপার নেই। ভাইপো ভাইপোবৌরা আছে, পাড়ার ভেতর সর্বদা ঘুরছে ফিরছে। অগত্যা সিক্ত তনু রৌদ্র কর বিচ্ছুরিত মাণিকদ্যোত জীবনদা হাজির হাতে এক বিশাল মানকচু পাতা, ভাত খাওয়ার জন্য পুকুরপাড় থেকে সংগৃহীত।

          এই জীবনদা দেখি একদিন, রাণুদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছেন, হাতে এক পরত শুকনো রুটি। রাণুদের রোয়াকে শুয়ে আছে এক পশ্চিমাগত মুটে। হয়তো আজ কাজ জোটেনি, উপোস থাকাও অসম্ভব নয়। নয়তো খেটেখুটে এসে হাত-পা চাড়িয়ে নিচ্ছে। জীবনদা হঠাৎ করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন- খেয়েছিস? খা না একটা রুটি...রুটি...রুটি...রুটি। এই ছিল জীবন পাগলা

         আমার জানা নেই অমন্ত্রিত সেদিন রুটি খেয়েছিল কি না  কাল্‌দার ভালো নাম কি হতে পারে একটু অনুমান লাগাই ...ধরুন কালাচাঁদ। তবে আলাপন কালে মেজজ্যেঠু ওকে কাল্‌দা বলেই সম্বোধন করতেন। বিশেষ ভ্রাম্যমান ছিলেন না বিশাল এক পোড়ো বাড়ি- ওঁকে ছাদে দেখতাম পায়চারী রত। আমার জন্মের এগারো বছর এক মাস এগারো দিন আগে দেশ ভাগ হয়েছিল। সুতরাং এ পাড়ায় তাঁর সপরিবার পত্তনের সময়টা সঙ্গত ভাবেই দেখিনি, তবে অনেক শুনেছি মেজজ্যেঠুর কাছে একহারা গড়ন। ছ ফুটের বেশী উচ্চতা। চামড়ার রঙ ঘোর কালো একদিন দেখি শানেরঘাটের ভাঙ্গা ঘাটের সিঁড়ির প্রথম ধাপেপূর্ণ নিরাভরণ। সেটা বড় অসাধারণ নয়। কেন না চান করে ওঠার পর ধুতিটা শুকোতে দিতেন ঘাটের পাশেই, আমদের বেহাত হয়ে যাওয়া জমিটাতে শুকোলে, পরে বাড়ি যেতেন। সেদিন দেখি বারবার নতজানু হয়ে বসছেন, সূর্য প্রণামের মুদ্রায় প্রণাম করছেন, পূব পানে। অথচ সূর্য তখন মধ্য গগনে। আঁজলা ভরে জল নিয়ে পুকুর পাড়ের লতাগুল্ম আগাছাগুলোকে দিচ্ছেন। যেন পিতৃ তর্পণ গণ্ডুষ ভর জল নিয়ে আচমন করছেন। যেন স্বপিণ্ডকরণ। কাছে গিয়ে শুনি মন্ত্র পড়ছেন-  নীল যমুনার জল/ ওপারে রাজশাহীর আলো/ আমারে লয়া চল/

         অন্ধের মতন পাগলেরও কী বা রাত কী বা দিন! সতুদার পোশাকি নাম পাড়ায় যাঁরা জানতেন তাঁরা ইহলোকে নেই। ওনাকে দাদা ডাকার বিষয়টাও জীবনদার আখ্যানের অনুরূপ। ওঁর পাগলামির অশেষ নমুনা। তখন নতুন গুড়ের সময়ে সত্যি সত্যি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা থেকে বাঁকে বয়ে নাগড়ি, মাটির কেঁড়েতে কোরে চাষীরা নলেন গুড়, পাটালি নিয়ে আসত। সহরতলির অলিগলিতে ফেরি করত। সে রকম এক জনকে ডাকলেন সতুদা গুড় চাখলেন। স্ত্রীকে চাখালেন। ছেলে মেয়ে কুল্লে আট সব্বাইকে চাখালেন। সবাই হাতের তালুতে নিয়ে চেখেটেখে এ ওর মুখ চাওয়া-চায়ি করছে। অবশেষে রায় দিলেন সতুদা স্বয়ং- জল ভাগ বেশি...জল ভাগ বেশি গুড় বিক্রেতা কালক্ষেপ না করে সেখান থেকে বিদায় হল। সতুদার পদবী মৈত্র ছিল। অঞ্চলের খাঁড়া বা রক্ষিতদের চোখে ওরকম পদবীধারীরা পূব বাংলার, সে অভিমত আজও প্রতিষ্ঠিত। যেমন আমি। পদবীতে বয়ে চলেছি সেই পরিচিতি, যদিও অভিবাস ঘটেছিল, সে রকম প্রতিপাদন পারিবারিক নথি সুত্রে কোথাও পাইনি। বরং যে টুকু জানি, হয়ে থাকলেও সে বাংলায় ব্রিটিশ গেড়ে বসার আগের ইতিহাস। 

         তা দেশ ভাগের পর ওপার থেকে আগত সংবিগ্ন পরিবারকুল যখন এ পারের বিভিন্ন অঞ্চলে বসত অভিপ্রায়ে ছড়িয়ে পড়ছিলেন, সে সময়ই আমাদের পাড়ায় আসেন দত্ত পরিবার। দত্তরা জীবিকা পরম্পরায় স্বর্ণবণিক। সৌভাগ্যক্রমে ডামাডোলের ভেতর পারিবারিক ঐশ্বর্যের অনেকটাই সঙ্গে আনতে পেরেছিলেন। এ দিকে সতুদা ও ওনার স্ত্রী চামেলিদি, পাড়ারই ছেলে মেয়ে হলে কি হয়, ওনারা নাকি অপ্রকৃতিস্থ যুগল। অন্তত চৌধুরীদের জমিদারী সেরেস্তা থেকে সে কথাই প্রোথিত করা হয়েছে আবাসীদের কানে ও মনে। ফলত তাঁরা গ্রামে, মানে আমার সময় অবশ্য পাড়া, একঘরে। আমাদের পাড়ার লোকেদের তদানীন্তন পেশা, যেমনটা বিদ্যাসাগরের রচনায় উল্লেখ আছে, 'সওদাগরী হৌস'-এ চাকরি। ব্রিটিশ রাজের সেই গোলামির তকমা পেতে গেলেও সুপারিশ দরকার, সেই সুপারিশ গ্রামের কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির থেকেই আসত। কিন্তু সতুদার ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে সে রাস্তা বন্ধ। সতুদা বাপ মা মরা ছেলে, ছেলেবেলায় প্রতিবেশীর অনুগ্রহ উচ্ছৃষ্ট ও স্নেহে পালিত। থাকার মধ্যে বড়সর একটা দ্বিতল কোঠা। 

চামেলিদির জন্ম আখ্যান শকুন্তলা প্রম। যদিও মাতৃহারা হওয়ার আগে বেড়ালিনীর মত তাঁর মা তাঁকে পড়ারই মধ্যে এ ঘরের আনাচে সে ঘরের কোনায় রেখে লালন করেছেন, আর চামেলিদিও মালিনীর মত নির্ভয়ে বেড়ে উঠতে থেকেছেন। সেই বাড়ন্ত বয়েসে তেরো বা চোদ্দ যাই হোক, সতুদার সতেরো বছর বয়েস সতেরটি প্রমোদ পোতের ঝাঁক হয়ে ভিড়েছিল চামেলিদির জীবনে, কে জানে ভ্রমে না জাগরণে। শোনা যায় গ্রামের এক ধনী তিলি পরিবারের ছেলের নজর থেকে বাঁচাতেই সতুদাকে সক্রিয় হতে হয়েছিল

         পাড়ায় প্রথম এসে দত্তরা এক পোড়ো বাড়ির একটি মাত্র কামরায় সপরিবার ভাড়া থাকতেন। ওঁদের বড় পরিবার। সঙ্গতিও আছে। কেনার জন্য বাড়ি খুঁজছিলেন। এদিকে দত্তদের ছেলের সাথে সতুদার সখ্যতা ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে। প্রতি দিনই তাদের বাসস্থানের অসংকুলান সতুদা শুনছেন পবিত্র দত্ত শুনছেন সতুদার প্রবল অনটন। নাম মাত্র ভাড়ায় সতুদা বন্ধুর পরিবারকে তাঁর বাড়িতে থাকতে দিলেন। সময়ের সঙ্গে বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেল। অর্থের বিনিময় সতুদা দত্তদেরই বেচে দিলেন। পাড়াতেই পৈতৃক এক চিলতে জমি। টালির চালা বানিয়ে সপরিবার। কিন্তু প্রবল আক্রোশ তৈরি হোলো দত্ত পরিবারের প্রতি। যেমন ধরুন, পবিত্র দত্তর দিদিকে পাত্র পক্ষ দেখতে এসছে, বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে সতুদার কাছে অন্বেষা চক্রে পৌঁছে গেছে। সতুদা প্রকাশ্যে তারস্বরে ভাঙচি দিতে শুরু করলেন। বলুন, পাগলামি ছাড়া কী! এ সব ঘটনা আমার জন্মের আগেরআমি পরবর্তী কালে  সংগ্রহকৃত তথ্য থেকে বলছি

          সতুদার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, গিনিপিগ জ্ঞানে পর্যবেক্ষণ চালানোর প্রেরণা ছিল একটা ঘটনা। ১৯৭১ সাল। আমার বয়েস বারো ও তেরোর মাঝখানে। একদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙলো বড়োদের চাপা গুঞ্জনে। উঠে দেখি সতুদা আর চামেলিদিকে পেটে পাটের দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে, নীল উর্দি ইংলিশ টুপি পরা পুলিশ। জানা গেল পবিত্র দত্তকে পাওয়া গেছে সতুদার বাড়ি থেকে। কিছুদিন হল সন্দেহমূলক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ খুঁজছিল। ফেরার ছিলেন।  পাড়ার ভেতর কানাকানি- আশ্চর্য! পবিত্র আর সতুদা যে দীর্ঘকাল অহি-নকুল!

         গতবছরেও আনন্দবাজার পত্রিকার ওয়েবসাইটে প্রত্যেক ব্লগের নীচে পাঠকদের লেখার জন্য মেসেজ বক্স ছিল। মন্তব্য লিখলে প্রকাশিত হত। পাঠকদের মন্তব্য পড়া যেত। সদ্য প্রয়াত সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্লগটা দেখি এখনও দৃশ্যমান। ওনার একটি ব্লগে পাগলদের বিষয়ে একটা লেখা ছিল। আমি ওতে মন্তব্যও লিখেছিলাম, অনেকদিন সেটা সাধারণ-গোচর ছিল। তা পাগলদের ব্যাপারে আমার একটু বিশেষ আকর্ষণ হয়ত সঙ্গতই। আমার ঘনিষ্ঠরা, আত্মীয়রা এখনও আমাকে পাগল অভিধা দেন। 


মিত্রপক্ষ সাই


শাইনিং ইন্ডিয়া

        বিড়ি জ্বালাইলে জিগর সে পিয়া... কি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ভায়া কন্যার জিগর থেইক্যা নাকি আগুন জ্বলে ! সেই আগুনে আবার বিড়ি ধরে ! খারাপ না ব্যাপারটা মনটা খারাপ হইয়া গেল সকাল বেলাতেই গানটা শুনে আমার প্রিয়ার জিগরে শুধু জল ক্যানে !
মুম্বইয়ে কি মেয়েদের জিগর থিক্যা আগুন জ্বলে নাকি! আবার কলকাতা কয়, শূন্য বুকে... বাংলাদেশ রেডিও আরও একটু সেন্টু সেন্টু সুরে বাজায়, পাখী মোর আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়...
দূর আজকাল এতো সেন্টু নিয়ে ডাকলে পাখীও পালায়! শুরুটাই করতে হবে আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, দিয়ে মানে কোন অবস্থাতেই বলা বারন, তোমার মনের কন্ডিশান মুখে দাঁড়ি থাকতে হবেই না হলে সিকোয়েন্স টা ঠিকঠাক জমবে না বিড়ি টাইপের কালার হতে হবে শরীরের কিন্তু ওয়াইল্ড স্টোন রাখতে হবে পকেটে না বুকে ধরে রাখতে হবে পাথর, বুঝলে ভায়া! পাত্থরেরও নাকি আবার গন্ধ থাকে!

বিড়ি বেশ সেন্টিমেন্টাল টাইপের হয় মানে জ্বলে দুমদাম করে কিন্তু একটু না টানলেই নিভে যায় একটু অবজ্ঞা মানেই লেপের তলে সিটিয়ে থাকা নতুন বউয়ের নাক ডাকা সিগারেটের কিন্তু সেই অর্থে এতো সেন্টু নেই জীবন দিয়ে জ্বলবে নিঃশেষে প্রান যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই... টাইপ হৃদয় একদম জ্বালাইয়া ছাই কইরা তবে তবে ছাড়ব একদম কর্পোরেট দের মতো বিহেভ রিফাইন্ তামাকের গুন নেই একদম খাটি নেপালি তামাকের সাথে সিগারেটের তামাকের তুলনা চলে! আমার হৃদয় নেপালী বিড়ির পাতার মতো সর্বদা শূন্য বুকের মতো খাঁ খাঁ করে

সকাল সকাল এই গানটা কানে আসতেই কত স্বপ্ন যে দেখে ফেললাম, লেপের তলায় ! সেটা সেন্সর করা বলা বারন স্যরি উসখুস কইরা কোন লাভ নেই এমন কিছুই ঘটেনি এটা হিন্দি ফিল্ম জিসম পার্ট ফোর নয় ভায়া মনটা শান্ত থাকা ভীষণ জরুরী পরবর্তী অংশ সহ্য করতে আজকাল কথায় কথায় গান সোনালী গানের এই এক সুবিধে সিকোয়েন্স বুঝে বোতাম টিপলেই হলো সব রঙ্গিন, সব উত্তর হাতের কাছে, সব কিছু চোখের সামনে একদম ফকফকা এরবেশী বলা বারণ...
সেদিন আমি আমার প্রেমিকাকে বললাম আমায় সত্যিই ভালবাস! কেন ভালোবাস? শেষ দু'বছরে প্রেমের এই চতুর্থ অধ্যায়ে এটাই সবচেয়ে বড় সময়ের ইনভেস্টমেন্ট আমার মানে গোটা দশেক বই, ক্যাডবেরি, সিনেমা, আইসক্রিম খায় না গলায় ব্যাথা আছে, আর প্রেমের অভারঅল অপারেটিং কস্ট সর্বসাকুল্যে হাজার দুয়েক টেনেটুনে মেয়েরা ভালবাসলে সব মেনে নেয়, তাই আমাদের কপালে প্রেম জোটে দেখি পাত্তাই দেয়না আমার কথার কানে মোবাইল ফোনের হেডফোন গুজে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো আবার শুধোলাম, সত্যি বলোনা ভালবাস আমায় ! কেন ভালবাস! কেমন জানি একবার চোখ টানটান করে তাকিয়ে আমার ডান কানে হেডফোন গুজে দিল আবার চোখ বন্ধ করলো মুখে বলল, চুপ শোন শুধু, কথা বলোনা...

ইয়ার্কি পেয়েছে, অনিন্দ্য অনিন্দ্য বলে সকাল সন্ধ্যা কাৎরাচ্ছে আমার সামনে, আর এখন আবার কানেও কালা করে দেয়ার প্রয়াস কিছুতেই হতে দেব না আজ জবাব চাই হেস্তনেস্ত করবোই আজ আমি রাগে আমি কান থেকে হেড ফোন ছুড়ে ফেলে দিয়ে গাছের পাতা গুনছি কোন ভ্রূক্ষেপ নেই তার গাছের গায়ে একপায়ে হেলান দিয়ে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছে সিগারেট শেষ চোখ আর খোলেনা আমার দু'বছরের প্রেমিকা

রাগে উল্টোমুখো হয়ে পালাবো ভাবছি বিড়ি টানতে কারণ মেয়েদের সামনে আর যাই হোক বিড়ি টানা যায়না পকেট ফুটো ধোসার টাকা মিটিয়ে চোখ খুলেছেন তিনি কাছে না পেয়ে মেয়েরা বড্ড বেশী ভরসা করে তাদের সঙ্গীকে আর তাই বোধহয় মেয়েরাও প্রেমে পড়ে কোন কোন সময় শেষে পেছন থেকে এসে বলল, এতো রেগে যাও কেন! গানটা শুনেও রেগে গেলে!
- আমি কোন গানটান শুনিনি আমার মন ভালো নেই যা বলার তা তো বলেই দিয়েছ, আর গান শুনে কি হবে!
- আরে শোন না, অনিন্দ্য...
- মানে তোমার নতুন প্রেমিক!! বাহ কি করে ! ইঞ্জিনীয়ার না ডাক্তার!
- আরে তোমার প্রিয়...
- হ্যাঁ, তোমার যে প্রিয়, তাকে আমাকেও গিলতে হবে ! কেন ! হোম টোম নাকি তোমার অনিন্দ্য!
- আরে শোন না... বলা বারন... অনিন্দ্য' গানটা শুনতে বলেছিলাম মেয়েরা সব কথা মুখে বলতে পারেনা
- হুম, তা বলবে তো তুমি অনিন্দ্যর গানে আমার কথার উত্তর দিচ্ছ বেবাট টাইপ হয়ে গেলাম হাসলে আমায় সত্যিই বেবাট টাইপ লাগে আমি জানি ইশ, দুমদাম মন খারাপ করে ফেললাম তবে এটাও ঠিক, শেষ তিন অধ্যায়ে দেখেছি, চলে যাওয়ার সময় ওড়নায় নখ প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বেশ বলে যেতে পারে মুখেই, বিদায় বন্ধু, ভাগ্যে নেই, তাই তুমি নেই কি করবো তুমি তো একটা কিছুই করে উঠতে পারোনি এখনও না বলে এসেছি, বাড়িতে প্রচুর মানুষ রেন কোট টাইপ ভাগ্য আমার ভাবি, এই অধ্যায় যদি ভাগ্যে থাকতো, কি যে হতো আমার অবস্থা ! এরচেয়ে অনেক ভালো আমার এই চার অধ্যায় এই নিয়ে দশবার গেছেন উনি, আর আজ নিয়ে এগারো বার আবার এন্ট্রি নিয়েছেন উনি এলেই আমি শেষের কবিতার পাতা চোখে দেখি চলে গেলে পড়ি জীবনানন্দ 

আমি যে একটু পাগল টাইপের তা আমি জানি মানে কবি কবি ভাব, কিন্তু কবিতার অভাব কস্মিনকালেও একটি কবিতা লিখতে পারিনি তবে সে চলে গেলে কাব্য ভর করে মাথায় একবার লিখেছিলাম ক্লাশ টেন লিখেছিলাম -
'মাথার উপর নীল আকাশ,
পায়ের নিচে দূর্বাঘাস,
তোমার আমার পেছনে বরাক বাঁশ'
মানে, বরাক বাশের উপর বসে ছিল মিষ্টি দিদিমণি আর নতুন স্যার এই স্যারকে দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলে যায় মিষ্টি দিদিমণিকে দেখলেই, আমার মন ভালো হয়ে যেত মোটেই 'ম্যারা নাম জোঁকার টাইপের' গল্প নয় সবকিছুতে গন্ধ না খোঁজাই ভালো ! কি সুন্দর করে হাসতেন, নরম করে কথা বলতেন ইস্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে দিদিমণির পাশে দাড়িয়ে গান গাইতাম কি মিষ্টি গন্ধ পেতাম সারাটা মাস রিহার্সাল চলতো, আমরা সবাই রাজা...
আমি ভাবতাম একবার যদি দিদিমণির হাতটা ছুঁতে পারতাম! তাই লিখে ফেলেছিলাম কাব্য আমার এই কবিতা পড়ে আর মুখ দর্শন করেননি আমার আমায় দেখলেই ট্যারা করে তাকাতেন সেই প্রথম ধাক্কা আমার প্রেমের চার অধ্যায়ের মধ্যে অবশ্য এই দিদিমণিকে আমি ধরি না হাতে এরপর থেকে আর সেই ছন্দের চেষ্টা করিনি বাকিটা বলা বারন কি করে বুঝবো বল ? তুমি আমার হৃদয়ে সঙ্গীত ফিরিয়ে দিচ্ছ ! দেখুন এই আমার বদ অভ্যাস সুযোগ পেলেই কাব্য করি প্রেক্টিকেল হতে হবে, জানি কন্যা, দু'চার দিন বাদে কোন ডাক্তারের বুক জ্বালাইবা তুমি সক্কাল সক্কাল বিড়ির মতো সেন্টু সেন্টু মুখ করে

বিড়ি নিয়ে দৌড়াচ্ছি নদী পারের দিকে (হাসির কোন কার নাই, এই দেশের ষাট শতাংশ মানুষ এখনও ট্রেন লাইন, ফাঁকা মাঠ আর নদীর পাড়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারেন) এরপরেও 'সাইনিং ইন্ডিয়া' ডুবে না আমি তাই আপাতত ভাবছি কম পয়সায় পাকা ল্যাট্রিন বানানোর ব্যাবসা করবো ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম লোন চাইতে দেখে বলে দিল ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, ওইটা বাকিতে হইব না কষ্ট হবে বুঝলেন ! কোষ্ঠকাঠিন্য ব্যাবসায় ওয়ালমার্ট লগ্নী করবে না কাগজের তিন নম্বর পেইজটা পড়বেন বুঝলেন ! ব্যাবসার পাতা আপানাদের মতো তরুণ ব্যাবসায়ীদের জন্য কতো বড় বাজার ! ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি চায় কিছু গ্যারান্টি দিতে পারবেন !
- আপনি কি বিবাহিত ! আমার এই প্রশ্নে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার
- হুম বিবাহিত
- মেয়ে আছে ! কোন কলেজে পড়ে !
- সুরেন্দ্রনাথে ! ইংলিশ নিয়ে পড়ছে !
- হ্যাঁ তো কেন ! আমার মেয়েকে চেনেন আপনি !
- হ্যাঁ আমার প্রেমিকা আপনি উনার বাবা মানে আমার পরবর্তী শ্বশুর
চিৎকার করছেন ভদ্রলোক অবস্থা ভালো নয় বুঝতে পারছি চা তখনো শেষ হয়নি এক চুমুকে শেষ করলাম নিজের মেয়ের কথা অধস্থনদের কাছে ফলাও করে বলবে না জানি চেয়ার থেকে উঠে গিয়েও আবার বসে পড়েছেন খুব শান্ত হয়ে বললাম, আমার সঙ্গে ক্লাশ টুয়েলভ থেকে প্রেম করছে লাস্ট টু ইয়ারে আমার সব ইনভেস্টমেন্ট আপনার মেয়ের কাছে সেই আমার সিকিউরিটি আপাতত চলবে ?
ভদ্রলোক ঘামছেন বললেন, তুমি বাড়ি এসো, পরে কথা হবে গার্ড...’
- লোনটা দেবেন, সিকিউরিটি আমার আপনার ঘরে গচ্ছিত সত্যি বলছি রিটার্ন পাবেই ব্যাঙ্ক
- তুমি যাবে !
নাস্পষ্ট জানিয়ে দিলাম লোনটা না পেলে আমি যাবো না আর বের করে দিলে সবাইকে জানিয়ে যাবো, আপনি আমার পরবর্তী হবু শ্বশুর হয়েও আমাকে বিশ্বাস করেন না আপনার মেয়ের কাছে আমার সব জমানো গচ্ছিত এখন সে অনুপমের সঙ্গে প্রেম করছে আমায় ছেড়ে দিয়েছে বলেছে আমি নাকি কোন কাজের না প্রমাআছে সব চিঠি, ইনবক্সে মেসেজ, ফোন কল, ছবি...’
- তুমি কি পাগল ! ইয়ার্কি মারছো সাত সক্কাল বেলা কত ইনভেস্ট করেছো টু ইয়ার্সে !
- মানে এমাউন্ট টা কতো ! কেন দিয়েছ !
- টু ইয়ার্সে চারবার তেত্রিশ লক্ষ ইন্টু চার, মানে ওয়ান ক্রোড়ের কাছাকাছি
ভদ্রলোকের কপাল থেকে ঘাম এবার দুম করে ঝরে পড়ল আমার প্রজেক্টের উপর ঘামছে, শুধু ঘামছে
- ইয়ার্কি পেয়েছ ! চুরি করো নাকি !
- হ্যাঁ চুরি করেই, আপনার ফ্ল্যাটে দু'বার আর বন্ধুর ঘরে দু'বার
- মানে ! আমার ঘরে তো চুরি হয়নি কোনদিন ! তুমি কি পাগল ! উন্মাদ ! যাও বেরিয়ে যাও এখুনি
- থাক সেই হিসেব করবেন না লোটা সেংশান করে দিন চলে যাচ্ছি
- কোনমতেই না
- ঠিক আছে তাহলে ডাকাতিটা আজ সেরেই ফেলি বলুন !
- মানে ? কি ডাকাতি ভয় দেখাচ্ছ ! গার্ড...
- মানে আজ আমরা পালাবো আমি আর আপনার মেয়ে আমার শেষ দুবছরের ইনভেস্টমেন্ট  আর আপনার একুশ বছরের...
- আমি পুলিশে জানাচ্ছি
- জানান, আমরা লিগ্যাল মেরেজ সেরে নিয়েছি শুধু টাকা নেই তাই লো চাইতে এসেছি দেখুন এটা একটা ব্যাবসা শুধু নয়, মানুষের জন্যেও কাজ হবে এতে কত মানুষ বাঁচবে বলুন এই যেখানে সেখানে...
- থাক আর বলতে হবে না আমার একুশ বছরের ইনভেস্টমেন্ট চুরি করেছ লোটা হয়ে যাবে নেক্সট উইকে এসে একবার দেখা করো এখানে নয় বাড়িতে আসবে তোমার বাবাকে নিয়ে আসবে সঙ্গে
- এই রে কেন বাবাকে দিয়ে কি হবে?
- আমার মেয়ের গ্যারেন্টার

ব্যাঙ্ক থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন দেখি রাইজিং ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপনটা সত্যিই ঝকঝক করছে দাঁড়িয়েছিল নিচেই ভয়ে চোখমুখ ফ্যাকাসে জানতে চাইলো কি বলল বাবা !
বলা বারণ... ইন্ডিয়া শাইনিং কিন্তু আকাশে মেঘ আজও জানিনা কপালে কি আছে মেঘ না রোদ্দুর ! যাই থাক থাক, তুই থাক, শূন্য বুকে থেকেই যা তুই