গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

৩য়বর্ষ ৩য় সংখ্যা ।। ১৭ই ডিসেম্বর ২০১৩

এই সংখ্যায় ৮টি গল্প লিখেছেন ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, তাপস কিরণ রায়, , অদিতি ভট্টাচার্য,  আফরোজা অদিতি, বিনু মাহবুবা, সহেলী ভট্টাচার্য, রিয়া দাশগুপ্তা , ইন্দ্রাণী সেনগুপ্তা ।

                              সূচিপত্রে ক্লিক করুন

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

ইন্ডিয়া
১৯৭১ এ রোশনারাদিরা ইন্ডিয়া ছেড়ে বাংলাদেশ চলে গেল। যাবার সময় যখন জাহানারা মানে ছুটকি আমায় জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে তখন ওদের বাড়ির উল্টোদিকে সবজি দোকানের মালিক জিয়ারাম চাচা ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল...কি ব্যাপার, এত কান্না কিসের? রোশনারাদি উত্তর দিল...আমরা যে ইন্ডিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি চাচা...। সেই প্রথম যেন ভাল করে জানলাম এটা ইন্ডিয়া। তার আগে এভাবে কেউ বলেনি। এখন অনেকদিন হয়ে গেছে। তখন আমরা কিছুটা ছোট। ছোট মানে তখনও পেনি ফ্রক পরি। দাদাদের ঘাড়ে চাপি, ঘুমোবার সময় ওদের গায়ে ঠ্যাং তুলে দিয়ে ঘুমোই। তখন চাঁদ, ফুল এসব দেখে মনখারাপ করা শুরু হয়নি। তখনও দুষ্টুমি করলে মা বিরক্ত হয়ে বলেন না...কি হচ্ছে! পা নামিয়ে ঠিক হয়ে বসো।

রোশনারাদির বোন জাহানারা যার ডাক নাম ছিল ছুটকি, সে আর আমি ছিলাম একেবারে হরিহর আত্মা। রোশনারাদির ডাক নাম ছিল টুশকি। আয়ুব কাকা, মানে ওদের বাবা আমায় ডাকতেন রুনকি বলে। মানে কিছু নেই, নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে রাখা, এই আর কি! ছুটকির মাকে আমরা বলতাম গোলাপ-কাকি। ওনার নাম ছিল আনোয়ারা চৌধুরী মিতা। প্রথমে ভেবেছিলাম, ওটা বুঝি ওদের পদবী। যেমন আমাদের ছিল বসুচৌধুরী। কিন্তু রোশনারা, জাহানারা এরা তো মিতা লেখে না! একদিন ছুটকিকে জিজ্ঞেস করলাম ওদের পদবীর কথা। তখন দুজনেই দুবাড়ির মাঝখানের ফটকের উপরে বসে কাঁচা পেয়ারা চিবুচ্ছি। ছুটকি একবার পেয়ারায় কামড় দিয়ে তার রসটাকে শুষে নিয়ে ছিবড়েটা ফেলে দিয়ে বললে----তুই বুঝবি না, ওটা আমাদের নাম। বুঝব না মানে? আমার কি বুদ্ধি কম নাকি! তাহলে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় ওর থেকে তেষট্টি নম্বর বেশি পেলাম কি করে? সেকথা বলতেই ছুটকি বলল---দুটো এক হল? মুখে পেয়ারা ,তাই তখনকার মত ব্যাপারটা মুলতুবি রইল। পরের দিন ইস্কুলে টিফিন-টাইমে এক্কা-দোক্কা খেলার সময় ছুটকির কিছুতেই দুটো পা একঘরে পড়ছে না দেখে একটা পায়ে আমার পা লেগে যেতেই ওর দুটো পা একঘরে পড়ে গেল, ছুটকি আউট হল। আমার দিকে ফিরে বলল---এটা কি হল? আমি বললাম--তুই বুঝবি না। বললে---আমায় পা লাগিয়ে আউট করলি কেন? আমি বললাম---লেগে গেল, দুটো এক হল...?

গোলাপ কাকির নামটা নাকি ওর ঠাকুমা মানে দাদি দিয়েছিলেন। গোলাপের মত সুন্দরী বৌ, তাই নাম গোলাপ। তা গোলাপ কাকি সুন্দরী ছিলেন বটে! আয়ুব-কাকার সঙ্গে কোথাও বেরোলে কালো বোরখার ভিতর দিয়ে ধবধবে হাত দুটো যখন বেরিয়ে থাকত, মনে হোত যেন গোলাপী রঙ করা। ছোটবেলা থেকেই দু-বাড়ির খুব ভাব ছিল। অনেকদিন এমন হয়েছে, আমি রাতের খাওয়া ওবাড়িতে খেয়ে ছুটকি আর কাকির কাছেই ঘুমি য়েছি। একেবারে সকালে স্নান-খাওয়া সেরে এবাড়িতে বই-খাতা নিয়ে একসঙ্গে ইসকুল গেছি। কতদিন বাবা আর আয়ুব-কাকা বিকেলের জলখাবার একবাড়িতে বসে খেয়েছেন। ওদের ঈদের সময় মা আর কাকি মিলে ফিরনি তৈরী করেছে। আমাদের পুজোর সময় কাকিও এসে মায়ের সঙ্গে মিষ্টি তৈরী করেছে। রোশনারাদি আমাদের বাড়ি সারাদিন যাওয়া-আসা করলেও কোনদিন রাতে থাকেনি। দাদা তাই বলত ---তোর খুব গুমোর, দেখিস, যখন বিয়ে হবে, আমরা তোর পিঁড়ি ধরব না...দাদা জানত না, রোশনারাদি দের বিয়েতে পিঁড়ি ধরা হয় না। বাংলাদেশ যাবার সময় রোশনারাদির ইস্কুলের পড়া শেষ হয়েছে। শুনলাম, ওখানে গিয়ে কলেজের পড়া করবে। দাদা একদিন বলল---টুশকি, তুই কলেজের পড়াটা এখানেই করে গেলে ভাল করতিস। তুই থেকে যা, একেবারে ওখানে গিয়ে চাকরি করবি...! রোশনারাদি সেদিনও বলল---এখানকার পড়ায় যদি চাকরি না হয়! তখনো ইন্ডিয়া বলেনি। ইন্ডিয়া শুনলাম একেবারে যাবার দিন জিয়ারাম চাচাকে যখন বলল। বাড়ির সামনে সবাই জড়ো হয়েছে। জিনিসপত্র গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে। এবার বিদায় নেবার পালা। আয়ুব কাকা বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। আমরাও প্রনাম করলাম কাকা-কাকিকে। তারপরই ছুটকির কি কান্না! মাঝে মাঝে সেকথা মনে হলে এখনো কাঁধের কাছটা ভিজে ভিজে লাগে। দাদা একটু হেসে রোশনারাদিকে বললে---টুশকি, তোর বিয়েতে নেমতন্ন করিস, গিয়ে কোমর বাঁধব...

রোশনারাদিও ম্লান হেসে বলল---ইন্ডিয়া থেকে যদি যেতে বা দেয়...! আবার সেই ইন্ডিয়া...! কিন্তু যেতে দেবে না মানে ? ওরা তো আমাদের বাড়ির লোক , ওদের কাছে যাবো না তো কাদের কাছে যাবো? গোলাপ কাকি সেই যে মায়ের হাত ধরেছেন, এখনো আঁকড়ে আছেন। মুখ দেখা যাচ্ছে না,কিন্তু হাতের চাপ বাড়ছে। দাদি সেই যে গাড়িতে গিয়ে উঠেছেন, একবারের জন্যও মুখ দেখাননি। শুধু রোশনারাদির মুখ একটু উজ্বল লাগছে। সে কি কলেজে পড়ার জন্য নাকি ইন্ডিয়া ছেড়ে যাবার জন্য সেটা বুঝিনি। তাহলে এত বছর রইল কি করে? তখন তো ইন্ডিয়া ছিল না? যাবার সময় একে একে সকলে গাড়িতে ঊঠলেন। আমরাও আরো গাড়ির কাছে চলে এলাম। ঘিরে দাঁড়ালাম গাড়ির চারিদিক। যতটা কাছে কাছে থাকা যায়! বাবা আয়ুব কাকাকে বললেন---যখনই এখানে আসবেন তখনই...আর বলা হল না। চশমা খুলে বাবা একবার গাড়ির ভিতরে দাদির হাতটা ছুঁয়ে বললেন...আচ্ছা আম্মা...তখনও বাকিটা বলা হলনা। দাদি রোগা হাত দিয়ে বাবার একটা হাত ধরে কাঁপা গলায় বলে ঊঠলেন......ও বাপন (দাদি বাবাকে বাপধন বলে ডাকতেন, কখনও বা বাপন), খুকনায় (খোকন, আয়ুব কাকার দাদা) আমাকে বাংলাদেশ নিয়ে যায়...কিসের জন্য বাপ? জন্ম-কম্ম সবই তো এইখানে...এতদিন পর এইটা ইন্ডিয়া হল, আর ওইটা হল আমার দেশ বাংলাদেশ...! কিন্তু চোখের পানিগুলান যে এইখান হতে নিয়া গেলাম রে বাপন...ভেঙ্গে পড়লেন কান্নায়। গাড়ী চলে গেল

না, রোশনারাদিরা আর কোনদিন আসেনি। হয়তো ইন্ডিয়া থেকে চলে গিয়ে ভালই আছে। যাবার দিন ছুটকি আমায় একটা ড্রইং খাতা দিয়েছিল, তাতে দুটো বাচ্চা মেয়ের ছবি আঁকা---আমি আর ছুটকি। সেটা আমার ঘরে আছে, যদি কোনদিন ছুটকি আসে...!


তাপসকিরণ রায়

                     
রমাকান্তের পাশবালিশ 
                    
           বয়েস অনেক হয়েছে রমাকান্তর। তেষট্টি বছর ছুঁই ছুঁই। উল্টো গুনতি কি সময় থেকেই শুরু হয় ? শরীরের কথাই ধরা যাক--শক্তি ক্ষয়,বীর্য ক্ষয়,ইচ্ছা ক্ষয়--চার দিক থেকে ক্ষয় আর ক্ষয়!

মন মেজাজেরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে--একটুতেই ফস করে রেগে যান তিনি। সে সময়টা নিজে বুঝতে পারেন না--যে সময় গলার স্বর আচমকা সা রে গা মার শেষ চড়া সা থেকে শুরু হয়ে যায়।নিজের কানও কি তা ধরতে পারে ? হ্যাঁ,কখনো কখনো মনে হয় শব্দগুলি যেন ফুস করে কানে ঢুকে গেল আর কানের পর্দায় ঢাকের কাঠি পিটল কেউ !

স্ত্রী,শৈলবালা,রমাকান্তের চে বছর ছোট,তার মানে বালাই ষাটের কাছ ধরাধরি করছে!সব ছেড়ে দিয়ে কানে তার ধার বেশী,তিনি স্বামীর পানে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে থাকেন। কিছু সময় আগে স্ত্রীর বাক্যবাণ রমাকান্তের  উদ্দেশ্যে ছুটে গিয়েছে। কিন্তু তিনি কি তা স্পষ্ট ধরতে পারেন নি ! মুখ খুলে তিনি শুধু একটু হওয়া ছাড়লেন,কিছু বলার চেষ্টা করলেন,স্ত্রীর কথার জবাব দিলেন--এমনি ভান করলেন। তার নিজের কাছেই নিজের গলার স্বর অচেনা অচেনা লাগছিল। কথা না বাড়িয়ে ঝিম মেরে গেলেন তিনি।
শৈলবালার নখের খোঁচা খেয়ে ফিরে তাকালেন
--বলি কথা কানে গেল না ? স্ত্রীর ঝাঁজসুরেলা কণ্ঠ ভেসে এলো। 
রমাকান্ত কথা না বলে তাকিয়ে থাকলেন।
--কালা,বলি কথা কানে গেল কি না ? প্রায় চীৎকার দিয়ে উঠলেন যেন শৈল। রমাকান্তের কান দুটো এবার ঝাঁ ঝাঁ মেরে উঠলো,এত চিল্লাছ কেন?
--তুমি ওটা কি করছ শুনি ?
--কোনটা ?
--আহা ! ন্যাকা বুড়ো,কানেও আজকাল কম শোনেন।আবার নিজের অঙ্গভঙ্গির কথাও টের পান না উনি!
--মানে?
--ওই পাশবালিশ নিয়ে অমন খুট খুট করছ কেন? ছাড়ো, ছাড়ো, ওটাকে ছাড়ো বলছি!
রমাকান্ত দেখলেন তার পাশে রাখা পাশবালিশ কখন যেন তিনি জড়িয়ে ধরেছেন। স্ত্রীর কথায় বালিশ ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুলেন।
--বুড়ো বয়সে ভীমরতি!
--মানে ?    
--আবার মানে ? তোমায় না বলেছি যে আমার সামনে পাশবালিশ তুমি কখনো জড়িয়ে ধরবে না ! আবার বলছি,তোমার কানটা কিন্তু সারানো দরকার,কালই যাবে তুমি--ডাক্তারের কাছেবুঝলে ?

স্ত্রীর কথা গুলি ফুস ফাস কানে ঢুকে যাচ্ছিল--কোনটা ছোট ভাবে আবার কোনটা তীব্র ক্রমে। বড় বিশ্রী লেগেছিল রমাকান্তের।দিনকে দিন তার স্ত্রী যেন মুখিয়ে উঠছেন। যত না বয়স বাড়ছে তার চে বেশী খাকড়ি দেওয়া গলা বনছে। শৈলের কি ধরনের কথা হয়েছে ! পাশবালিশ না হয় তিনি আধঘুম চোখে জড়িয়ে ধরে ছিলেন--তাতে এমন কি মহাভারত শুদ্ধি করনের প্রয়োজন পড়েছে?পাশবালিশ জড়িয়ে ধরলে রমাকান্তর সামান্য আমেজ আসে বটে,পুরনো দিনের প্রেম পিরিতের কথাগুলি মনের কাছে এসে ধাক্কা দিয়ে যায় !

         ঘ ঘোর অন্ধকার--রাত এগারটা পার করে গ্যাছে। ঝিম ঝিম ঘুমটা স্বপ্নের আবেশ নিচ্ছিল মাত্র--রঙিন স্বপ্নের ঝাঁক উড়ে এসে মনে মাত্র জুড়ে বসছিল--শৈল দিল বারটা বাজিয়ে।
--কটা বাজে বুঝতে পারছ ? পাশশয্যা থেকে নির্ঘুম শৈল আবার কথা বলে উঠলেন।
--তুমি তো একটু আগেই নাক ডাকছিলে!রমাকান্ত একটু সাহস নিয়ে বলে উঠলেন।
--আমি ! আমি নাক ডাকছিলাম ? দু চোখের পাতা বলে একবারও জুড়তে পারলাম না--আর তুমি তো পাশবালিশ নিয়ে স্বপ্নসুখে বিভোর ছিলে
--কি যা তা বলছ ?
--যা তা নয়,ওই পাশবালিশ কাল থেকে আমি আর বিছানায় রাখব না। 
--ফালতু,কথা বাড়াবার দরকার নেই,রমাকান্ত মনে মনে ভেবে নিলেন। পাশবালিশের পেছনে পড়েছে শৈল। বেশ অনেক দিন ধরেই তিনি দেখছেন যে রাতে কাত হলে কখন যেন পাশবালিশ তার দু পায়ের মাঝে এসে চিপে যায় ! এমনটা বছর আগেও হত না,আর কোন ক্রমে পাশবালিশে পা চাপা দৃশ্য শৈলর চোখে সহ্য হচ্ছে না,এটাও লক্ষ্য করেছেন। এই বালিশ যেন শৈলর সতীন হয়ে পড়েছে!

রিটায়ারমেন্টের বছর আগেও শৈলকে মাঝে মাঝে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেছেন। একটু হাসপাস করলেও সহন করে নিয়ে ছিল।তার পর কোন এক দিন ঝন ঝনিয়ে গলা বাজিয়ে উঠে ছিল,আর না,অনেক বয়স হয়েছে,ছেলে ছোকরামি ছাড়ো--সোজা হয়ে শোও--গা জড়াবে না বলে দিচ্ছি ! ব্যাস সেই থেকে বন্ধ--ভুলেও হাত পা ওর গায়ে ছুঁয়ে গেলে অমনি এমন দেখাবে যেন ফুটন্ত তেলে বেগুনের টুকরো পড়ল ! অভ্যাস যাবে কোথায়। বিয়ের পর থেকে এতগুলি বছর যত দিন রসকষ ছিল শরীরে স্ত্রীকে পাশ বালিশের মত জড়িয়ে থাকার বলতে গেলে একটা অভ্যাস হয়ে গিয়ে ছিল। কিন্তু আজকাল শৈল নিজের শরীরে হাত পা ছোঁয়া বার জাগা তো দেই না--সেই সঙ্গে পাশবালিশের সঙ্গে একটু আধটু আমেজ আনন্দতেও ওর ঘোর আপত্তি !
--কি হল ঘাপটি মেরে পড়ে আছ কেন ?
রাগ হল রমাকান্তর ভীষণ,টানমারা সুরে বলে উঠলেন, চুপ করে শুয়ে থাকাও বারণ নাকি ?
--ওই পাশ বালিশ জড়াবে না বলে দিচ্ছি।

ব্যাস,দু মিনিট সময় যেতে না যেতে রমাকান্ত শুনতে পেলেন,ঘড়র ঘড়র,শৈলবালার নাকের ডাক। তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছেন ওই নাক ডাকা লক্ষণ বড় খারাপ। নাক ডাকা মানে হালকা ঘুম--মানে রমাকান্তর চিত হয়ে ঘরের ছাদ দেখে দেখে নির্ঘুম শুয়ে থাকা।
ধুর শালা,রাত বারটা  বাজে, চোখে ঘুম নেই! নাক ডাকার শব্দ থেমে গেল--তাকালেন তিনি স্ত্রীর মুখের দিকে--রাগত মুখ এখন শান্ত লাগছে--যদিও নাসা রন্ধ্রের দুদিকের ফোলা ভাব এখনও  কমে নি ! পাশ ফিরলেন তিনি আর সামান্য দুরে পড়ে থাকা পাশ বালিশটাকে আরাম করে জড়িয়ে ধরলেন।

রমাকান্ত বয়সকালে কিছু দিন হারমোনিয়াম নিয়ে চেষ্টা করে ছিলেন। গান শেখার ইচ্ছেটা ছিল--বয়সে এমনি ইচ্ছে কার না জাগে ? দু চারটে মিষ্টি গান যদি গলার ভাঁজ থেকে নেমে আসে তবে মন্দ কি?আর ওই সময়,ওই রঙিন সময়টার কথাই আলাদা--নায়ক নায়ক ভাব শরীরে আনার কি না প্রচেষ্টা চলতে থাকে। রমাকান্ত দেখেছেন,গান,রামবাণ--মেয়েদের কাছে টেনে আনার ব্যাপারে। খুব বেশী শেখার দরকার নেই--এই চার পাঁচটা  প্রেমিক প্রেমিক গানযেমন--চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি...নতুবা,হাত দুটি রেখো মোর হাতে...যদিও গানের আগের পাছের কথা গুলি এখন মন থেকে ভো কাটা হয়ে গেছে !

তিন দিন সা  রে গা মা টেনে গেয়ে ছিলেন রমাকান্ত--এর মধ্যে এক দিন ভোর রাতে--আর চতুর্থ দিন টানা দিনভর ঘুম--বুঝে ছিলেন সব তার ব্যাপার নয়। কিন্তু তা হলে ? চেহারা তো তেমন নায়কোচিত নয়--চলবে কি করে ? গান ব্যাপারটা তাঁর মাথায় গোড়া থেকেই আগা গোড়া কিছুই না বোঝার মত আকার ছিল। সাধারণ আওয়াজ থেকে ক্রমশ: গিয়ে চীৎকারে ঠেকা বিষয়টা আজও তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। গায়করা কি সুন্দর ইচ্ছে মত কখনো কম আওয়াজে আবার কখনো উচ্চ স্বরে একই গান সুরে টেনে নিয়ে যান--আহা!গান বস্তুত বড় বিচিত্র গো !

রমাকান্তর স্ত্রী গান খুব পছন্দ করেন--যেমন আর নিরানব্বই শতাংশ মেয়েছেলেরা পছন্দ করে। বিয়ের পর পর ভুলে ভটকে কোন গায়কজন,মানে,কোন পরিচিত গায়কবন্ধু,ঘরে ঢুকে পড়লে বড় অস্বস্তি বোধ করতেন তিনি। কারণ ওই গানের প্রসঙ্গ শুরু হলে স্ত্রী তাঁর চিপকে যাবেন--না গানবন্ধুর সঙ্গে না--গানের সঙ্গেশেষে আলাপ আলোচনা--ভালো মন্দ গালগল্প নানান ফ্যাচ ফ্যাচানি শুরু হয়ে যাবে!
শাশালা,বড় শুকনো কষ্ট গলায় ঠেকে রমাকান্তর--অনেক চেষ্টা করেও তিনি গলায় গান লাগাতে পারলেন না! 

অন্য পাড়ায় থাকত মেয়েটি,রমাকান্তর মনে পড়ল--সামান্য রঙচটা হলেওইয়েমানে,তেল চক চক ভাব ছিল শরীরে। শ্যামলা বরন...নাম কি যেন,হ্যাঁ,মনে পড়েছেশ্যামলী। বাঃ,শ্যামলা বরন,নামও শ্যামলী। এদিক থেকে জমজমাট রমরমা ছিল বটে!ও একটু আধটু রমাকান্তের কাছাকাছি আসতো। প্রথম দিকে তিনি পাত্তাও দেন নি।মনে মনে ভেবে ছিলেন,না,এর চে তার স্ট্যান্ডার্ড আরও কিছু বেশী।
কিন্তু কৈ ওই তিন তলার ছাদে উঠে যে মেয়েটা তার দিকে চেয়ে থাকত--সেই সুন্দরী নায়িকা নায়িকা মেয়েটার কথা খুব করে মনে আসত তাঁর ! রোজ সূর্য ডোবার আগে--লালচে গোধূলির আগুন নিয়ে ছাদ থেকে তাকিয়ে থাকত মাটির দিকে! নাকি ওর দিকে ? শুরুতে মনে হয়েছিল, মেয়েটি মাটি থেকে অনেক ওপরে দাঁড়িয়ে মাটির গন্ধ নেবার চেষ্টা করছে না তো ! গোধূলিরঙ ঠিক তার মাথার পেছনে গোলাকার চালার মত ছড়িয়ে যেত--মনে হত সত্যি কোন মেয়ে দাঁড়িয়ে,না কি কোন দেবীর আবির্ভাব ঘটেছে!

একবার মনে হয়ে ছিল,না,তা নয়,মেয়েটি তো তার দিকেই তাকিয়ে থাকে হ্যাঁ,লক্ষ্য করে তাই মনে হয়েছিল--অবিকল ওর দৃষ্টি যেন রমাকান্তর চোখের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। ওই মেয়ের সঙ্গে কথা বলার কোন ফন্দিফিকির তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনতলা বাড়ির সদর দরজা চিনে নিয়েছিলেন।তখন তিনি নতুন নতুন কলেজে ভর্তি হয়েছেন। কলেজ থেকে ফিরেই বাড়ির জানলার কাছে এসে দাঁড়াতেন,দূরদৃষ্টি নিয়ে ওপরে দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকতেন ওই ছাদের মেয়েটির দিকে।
--এই যে শুনছেন ? প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মেয়েটি।
--আমাকে ? নিঃস্পৃহ মেয়েটি রমাকান্তর দিকে তাকাল
--আমায় চিনতে পারছেন ?
--না,কখনো দেখেছি বলে তো মনে করতে পারছি না! অনেকটা বিরক্তি নিয়ে যেন মেয়েটা বলে উঠেছিল।
--আপনিই তো ছাদে দাঁড়িয়ে--
--হ্যাঁ,তাতে কি হয়েছে ? নিজেদের বাড়ির ছাদে দাঁড়াতে পারব   না?
--না,তা নয়,মানে আমায় চিতে পারছেন না ?
--আশ্চর্য,বললাম তো আপনাকে চিনি না,আর কথা না বাড়িয়ে সামনের রাস্তা ধরে মেয়েটি হন হন করে বেরিয়ে গেল।
--তবে ? কাকে দেখে ওপরওয়ালা মেয়েটা ? তবে কি নিচের মাটির লোকদের দেখে ও নাক সিটকায়!...এমন হতে পারে--মাটি,মাটির গন্ধ ও খুব ভালোবাসে--আড়াল থেকে--লোক চক্ষুর অন্তরাল থেকে ও টেনে নেয় মাটির গন্ধ!...উঁচু তলার লোকেরা মাটি পছন্দ করলেও মাটির ধার ঘেঁষা লোকদের হয় তো পছন্দ করে না!

সব ভাবনা ভেঙে  গিয়ে রমাকান্তর ভুল ভেঙ্গে ছিল। মেয়েটি ওকে দেখত না--ওদের দুটো বাড়ির পাশের পাঁচ তালা বাড়ির ছোকরাটাকে দেখত। ছোকরাকেও তিনি উঁকি ঝুঁকি মেরে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছেন। তারপর তো সব সমাধান হয়ে গেল--এক দিন রাস্তায় ওদের দুজনকে দেখতে পেলেন তিনি। সন্ধ্যার অন্ধকার তখন চারদিক জড়িয়ে নিচ্ছিল। আগে থেকে সন্দেহ হয়ে ছিল তাঁর,সামান্য এগিয়ে গিয়ে দেখলেন,দুজনের দু হাত ঠিক ছুঁয়ে আছে--আর খলখল ছলছল চাপা হাসি ওদের মুখ থেকে যেন ছলকে পড়ছিল। রমাকান্তকে পাশ থেকে ওরা চিনতে পারে নি নিশ্চয়--আর চিনবেই বা কি করে ? তখন তো ওদের ছিল অন্য পৃথিবী,সমস্ত পৃথিবীর বাইরে শুধু দুজনের কুজনের পৃথিবী! 
,হ্যাঁ,রমাকান্তর মনে পড়ল শ্যামলীর কথা।ও কিন্তু গান ছাড়াই ওঁর কাছে বেশ ক বার ঘুর ঘুর করে ছিল। কিন্তু ওই যে ব্যাপারটা--ঘষা মজা চেহারা--লক্ষ্মী শ্রী ভাবটাও বোধ হয় কম--চেহারার চেও ন্যাকামি ছিল বেশী!গা ছোঁয়া,গা ছোঁয়া,ভাব ছিল তার।
সে দিন কলেজ থেকে ফিরছিলেন রমাকান্ত পথে দেখা হয়ে গেল শ্যামলীর সাথে--কোথায় যেন যাচ্ছিল ওঁকে দেখে কেবলুর মত হেসে উঠলো,কলেজ থেকে আসছ নাকি,রাম দা ?
ব্যাপারটা কি হল?রাম দা ? তার মানে রমাকান্তর ঘরের ডাক নামটা কি ভাবে পেল !মনের রাগ চেপে মুখে হাসির চিলটা দাগ বানিয়ে বলে উঠেছিলেন,হ্যাঁ
--তোমার সঙ্গে একটু কাজ ছিল--আমি আসতে পারি ?
--কি কাজ ? আসো--একে বারে না,করে দেওয়াও যায় না। সমত্ত মেয়ে,সাজ সজ্জার পর মুখমণ্ডল বেশ দেখাচ্ছিল কিন্তুসটান,না,করে দেওয়া সম্ভব নয়। উঠতি বয়সের রমাকান্ত--শ্যামলীর সাজ সজ্জায় সাময়িক চটক প্রতিফলিত হচ্ছিল। হেন অবস্থায় নাকারাত্মক শব্দ কখনো মুখে আসতে পারে ?
ছোট ভাই ঘরের দরজা খুলে দিল। বলল,মা বাবা মার্কেটে গিয়েছেন,আমি একটু ঘুরে আসছি ভাই শ্যামলীর দিকে একবার তাকিয়েযাত্রার গতি সামান্য শ্লথ করে বেরিয়ে গেল।
তার মানে ঘর খালি। কি করা যায় এখন ? রমাকান্ত ভাবতে ভাবতে ঘরের ভিতরে ঢুকলেন। শ্যামলীও বলার অপেক্ষা না করে ঘরে ঢুকে পড়ল।
বৈঠক ঘর অতিথীদের স্বাগত করে বসাবার জন্যে চার পাঁচটা চেয়ার, একটা টেবিল রাখা ছিল। তাকে সোফা বোধ হয় বলা যাবে না--সেই টাইপেরই  নিম্নমধ্যবিত্তর চেয়ার টেবিল আর কি !
--বসুন,আমি এখনি আসছি,কথা কটা বলে রমাকান্ত হাত পা ধুয়ে চট করে পোশাক বদলে মাথায় টেরি কেটে সামান্য ফিটফাট হয়ে বৈঠক ঘরে এলেন।
কিন্তু কি! শ্যামলী কোথায় ? ঘর খালি,চোখে পড়ল,ওর ছোট পার্সটা টেবিলের কনে রাখা। তার মানে কি ভিতরের ঘরে কোন ইমার্জেন্সি কাজে ঢুকেছে ? না কি ঘরের বাইরে কোন কাজে--
রমাকান্ত ভেতরের ঘরের দিকে গেলেন। দেখলেন শ্যামলী জানলার ধারে দাঁড়িয়ে--তার চোখ সুদূর আকাশের দিকে প্রসারিত।
--কি ব্যাপার,এখানে আপনি?
--আপনার প্রেমিকাকে দেখছি!মুখ টিপে হেসে বলল শ্যামলী।
--মানে ? অবাক হয়ে রমাকান্ত বলে উঠলেন।
আমি দিন ধরে পথে যাতায়াতে লক্ষ্য করছিলাম,ওই তেতলার ছাদ ধরে একটা মেয়ে আপনাদের জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে।
--কি যা তা বলছেন--
--আসুন,আসুন দেখুন এসে!আসুন না,ন্যাকা ন্যাকা টোন নিয়ে শ্যামলী বলে ওঠে।
ইতস্তত করে জালনার কাছে এগিয়ে যান রমাকান্ত।
আঙুল তুলে শ্যামলী বলে ওঠে,ওই,ওই দেখুন,মেয়েটা ছাদে দাঁড়ানো--কেমন ডেব ডেব চোখে দিকেই তাকিয়ে আছে!
আমল দিলেন না রমাকান্ত,বললেন,না,আমাদের জালনার দিকে না,ওর অন্য জালনার দিকে চোখ।
--সত্যি বলছেন ? যেন অনেকটা আশ্বস্ত হল শ্যামলী
--হ্যাঁ,আমি দেখেছি,বড় বাড়ির ছেলেটার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে।ওই বাড়ির জানলার দিকেই তাকিয়ে থাকে।
এবার কেন যেন কিছুটা উচ্ছল হল শ্যামলী। জানে অনজানেই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,যাক বাবা,বাঁচলাম!
--মানে ? রমাকান্ত শ্যামলীর কথা ঠিক ধরতে না পেরে বলে উঠলেন।

শ্যামলী রমাকান্তর অনেকটা কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখের মোহিনী চাহনি ছড়িয়ে দিয়ে ছিল রমাকান্তর অপলক চোখেও কি তখন মদনের মায়া বন্ধন এঁটে আসছিল! লমলমে বেড়ে ওঠা মনটা তখন বোধ হয় চড়মড় করে উঠছিল--শরীরের কেমিস্ট্রির ধীর পরিবর্তন তখন কি তিনি টের পাচ্ছিলেন ? শ্যামলীর গায়ের প্রসাধন গন্ধ তখন সমানে ছড়িয়ে যাচ্ছিল ঘরময়--চকমকি ফুটে ওঠা ওর চোখগুলি মিট মিট ফসফরাসের মত আলো ফেলছিল। এবার উষ্ণ ঘন শ্বাস এসে রমাকান্তকে ঢেকে নিচ্ছিল--এক শূন্যতায় ঝুল ছিলেন তিনি--হালকা ফুর ফুর শরীর নিয়ে--স্থান কাল পাত্র তলিয়ে যাচ্ছিল উপলব্ধির অতলে...শ্যামলী ফিসফিসিয়ে উঠলো,রাম দা ! অমন করে তাকিয়ে আছ কেন?

যেন ভরপুর অক্সিজেন কেউ ওদের মধ্যে ঢেলে দিয়ে গেল। চৈতন্য চেতন যেন ক্রমশ:ডুবে যেতে থাকলো--এক এককেন্দ্রিক বলয় মনের অলক্ষ্যে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছিলো আর ঠিক এমনি সময় শ্যামলীর অতিচেতন মানসিকতা কি কুট করে বিষ পিঁপড়ের মত কামড়ে দিয়ে ছিল ? অতশত মনে নেই,রমাকান্ত একটা চীৎকার দিয়ে শ্যামলীর থেকে ছিটকে দুরে সরে গেলেন
একটা ঝাঁকুনি খেলেন রমাকান্তঘুম মার্কা ঝিম ভাবনাটা ভেঙে গেল--কোলবালিশ থেকে এক হাত দুরে ছিটকে গেলেন তিনি পাশে সোয়া স্ত্রীর গায়ে বা হাতটা ঝপ করে গিয়ে পড়ল। স্ত্রীর ভয়ে জড়সড় হয়ে চুপ মেরে শুয়ে থাকলেন তিনি। স্ত্রীর ভয়ঙ্কর কোন প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করলেন।মুহূর্ত পরে চোখ যখন খুললেন, দেখলেন,স্ত্রী শৈলবালা বড় বড় চোখ করে তাঁর বুকের ওপর ঝুঁকে আছেনপরখ করছিলেন--রমাকান্ত ঘুমিয়ে না জেগে ? অন্ধকারে স্ত্রীর জ্বলন্ত চোখগুলি পলক মাত্র দেখেই চোখ বুঁজে আবার ঘুমের ভান করলেন তিনি।
অল্প সময় পরেই স্ত্রীর নাকডাকা কানে এলো।বড় বাঁচা বেঁচে গেলেন কি তিনি ? তা না হলে আবার সেই পাশবালিশ নিয়ে কথা হতো--আবার

কিন্তু ডান হাতের কব্জিতে টনটন একটা ব্যথা তিনি অনুভব করছেন কেন ? মনে পড়ল রমাকান্তের,সে দিন ডান হাতের কব্জিতে ভীষণ যন্ত্রণা করে উঠে ছিল--তিনি দেখে ছিলেন,এক ফোঁটা রক্ত হাতের কব্জি বেয়ে বেরিয়ে আসছে--তার মানে শ্যামলী তার হাতে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে !
ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন রমাকান্ত,শ্যামলীর দিকে তীক্ষ্ণ চেয়ে বলে ছিলেন,এটা কি হল
শ্যামলী মুখ কাচুমাচু করে বলে উঠে ছিল,তুমি আমায় নষ্ট করতে যাচ্ছিলে,রাম দা !