গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৩

৩য়বর্ষ ১ম সংখ্যা ।। ১৮ নভেম্বর '১৩।। ২ অগ্রহায়ন ১৪২০

এই সংখ্যায় পাঁচটি গল্প , লিখেছেন রূপঙ্কর সরকার, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, জয় চক্রবর্তী , অদিতি ভট্টাচার্য এবং আফরোজা অদিতি ।

                               গল্প পড়ুন সূচিপত্রে ক্লিক করে

সম্পাদকীয়


পাক্ষিক ‘গল্পগুচ্ছ’ দুই পেরিয়ে তিনে পা দিল । ২০১১’র ১৪ই নভেম্বর ‘গল্পগুচ্ছ’ তার পথ চলা শুরু করে । বর্তমান সংখ্যাটি অতয়েব পাক্ষিক ‘গল্পগুচ্ছ’র ৩য়বর্ষের প্রথম সংখ্যা ।

একটা পাক্ষিক গল্পের পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশ নিতান্তই দুরূহ কাজ । নবীন প্রজন্মের সৃষ্টিতে কবিতা যতটা স্থান পায় গদ্য ততটা পায় না – গুনগত ও পরিমাণগত উভয়তই । এই সময় অনেকগুলি ওয়েব পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে – সবই মূলত ফেসবুক’এর নানান গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত । সেগুলিতে কবিতার সঙ্গে দুএকটি গল্পও থাকে । কিন্তু ফেসবুক গ্রুপের বাইরে শুধুমাত্র গল্পের ওয়েব পত্রিকা খুব বেশি নেই, পাক্ষিক তো নেইই । অন্তত আমার জানা নেই ।

ফেলে আসা দু বছরে গল্পগুচ্ছ প্রয়াস চালিয়ে গেছে বাংলা গল্পকে আরো বেশি পাঠকের ঠিকানায় পৌছে দিতে এবং নবীন গল্পকারদের তুলে আনতে । সেই প্রয়াসে হয়তো কিছুতা সাফল্য পাওয়া গেছে, নাহলে ‘গল্পগুচ্ছ’ দুটো বছ পেরোতে পারতো না ।


আশা করি ‘গল্পগুচ্ছ’র তৃতীয় বর্ষের পথচলাও সার্থক হবে সুধী পাঠক, লেখক ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় । তৃতীয়বর্ষের পথচলার সূচনায় ‘গল্পগুচ্ছ’ সকলকে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাচ্ছে ।

রূপঙ্কর সরকার

মৃত মহাদেব


কাজকুমারী হাঁফাতে হাঁফাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। মামা, মামা, ডেড বডিটা এখনও পড়ে আছে । মুখে মাছি বসতেছে গো। আমি চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজের একটা নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টায় মগ্ন ছিলাম, বললাম, কিসের ডেড বডি? আসলে কাজকুমারী নিয়তই স্কুপ নিউজ ছাড়ার ভঙ্গিতে হাঁফাতে হাঁফাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে নানা রকম খবর সরবরাহ করে। দুহাজার এগার সালে যখন কি একটা ভাইরাসের আক্রমনে রেগুলার কাক মারা যাচ্ছিল, তখনও সে একই ভাবে, জান মামা, ওখেনে একটা পড়ে আছে- বলে চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশন করত। সেটা যে কাক, তা জানা যেত পরে। আমি অবশ্য একবারও অস্বীকার করছিনা, যে একটি কাকের প্রাণের মূল্য মনুষ্যজীবনের চাইতে কম কিছু নয়। কিন্তু যাই হোক আমাদের কাজকুমারী হ্যাঁ কাজকুমারী নামটা নিয়েও কিছু বলা প্রয়োজন। গৃহিনী একবার মজা করে বললেন, রাজার মেয়ে রাজকুমারী আর কাজের মেয়ে কাজকুমারী। সেই থেকে ওর পেছনে লাগতে লাগতে ওই নামই দাঁড়িয়ে গেছিল।

কিন্তু নাম দিলেই তো হবেনা, ওর ভাল নাম বোধহয় সর্বাণী গোছের কিছু একটা ছিল। আজকাল কাজের মেয়েদের অতসী, বাতাসী, এই সব নাম আর হয়না। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি, কড়া ইস্তিরি করা তাঁতের শাড়ি পরা, প্রায় কদমছাঁট ছোটচুল এক ভদ্রমহিলা। গিন্নী একগাল হেসে বলল, এই যে, আমার স্কুল, কলেজ আর ইউনিভার্সিটির একটানা বন্ধু সর্বাণী। অবশ্য ওর সাবজেক্ট আলাদা। আমি নমষ্কার করেই একদম কিচ্ছু না ভেবে বলে বসলাম, আরে, কাজকুমারীর ভাল নামও তো সর্বানী না? ভদ্রমহিলার ভুরু ভাল রকম কুঁচকে গেল, কাজকুমারী ? সেটা আবার কী গিন্নী একগাল হেসে গোড়া থেকে ইতিহাসটা বলল। সেই ইতিহাসে বা গিন্নীর গালভর্তি হাসিতে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত না হয়ে উনি বললেন, দিস ইজ আনঅ্যাকসেপ্টেবল। বাড়িতে কাজ করে বলে এইরকম হেয় করে নামকরণ গিন্নী বলল, আরে না না, ও তো কিছু মনে করেই না, উল্টে নামটা খুবই পছন্দ করে। আমাকে তো ভীষণ ভালবাসে। সর্বাণীদেবী প্রচন্ড রেগে একটা সিগারেট ধরালেন ( স্ট্যাটিউটরি ওয়ার্নিং সিগারেট স্মোকিং ইজ ইঞ্জুরিয়াস টু হেলথ)। তারপর বললেন না না, নিশ্চয়ই তোমরা ওকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল কর। ভৃত্যের প্রভুকে ভালবাসার তো কোনও স্বাভাবিক কারণ নেই। এমনি সময় কাজকুমারী হঠাৎ এক পেয়ালা কুচকুচে কালো ব্ল্যাক কফি নিয়ে ঢুকেছে। সে বলল, না গো মাসি, এই মাইমা আমায় খুব আদরযত্ন করে। মাসি ডাকায় ফল হল উল্টো। আগের সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ঠেস দিয়ে রাখা, তখনও টাটকা, উনি কাঁপতে কাঁপতে আর একটা ধরালেন। তারপর অর্ডার করা কালো কফিতে চুমুক না দিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, না না, এইভাবে যেখানে ডোমেস্টিক হেল্পকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়, সেখানে আমি আর থাকতে পারলামনা, সরি । তারপর গিন্নীর হাঁ করা মুখের সামনে দিয়ে ওঁর দ্রুত এক্সিট। কাজকুমারীর হাঁ-টা আরও বড়। আমি বিড়বড় করে বললাম, কাজকুমারীর আসল নামটা না বললেই হত।

যাই হোক, আমরা এখনও তাকে কাজকুমারী বলেই ডাকি। তার নিত্যকর্মের নানা রকম প্রকারভেদের মধ্যে একটা হচ্ছে, নীচে কোনও কারণে নামলেই হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে এসে আমাকে একটা স্কুপ নিউজ দেয়া। এবং এই কাজটার জন্য সে বেছে নেয় শনি অথবা রবিবার। অন্যদিন তো সাত সকালেই আমি তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমি বললাম, কিসের ডেড বডি, আবার কাকের? কাজকুমারী চোখ বড় বড় করে বলল, না গো মামা, বেইরে দ্যাখোনা, মানুষের গো, আমাদের শঙ্কোদ্দা। আমি প্রচন্ড শক্‌ড হবার মত মুখ করে বললাম, শঙ্কর, আমাদের শঙ্কর? বলেই ভাবলাম, আমি কি অভিনয় করছি? সত্যিই কি ভীষণ শক্‌ড হলাম? শঙ্কর যে আজ হোক, কাল হোক মরবেই, তা তো সবাই জানতাম। তবু  খবরটা খারাপ তা নিয়ে সন্দেহ নেই। অকুস্থলটা আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যায়। বেলপুকুরের মোড়ের কাছে একটা মানুষ উপুড় হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। তার অর্ধেকটা শরীর ফুটপাথের ওপর, বাকিটা রাস্তায়। লোকটার নাম শঙ্কর, শ্রী শঙ্করনাথ স্যান্যাল। ও, এখন তো আর শ্রী নেই, স্বর্গত।

শঙ্করনাথের বাপের নাম রুদ্রনাথ, আর তার বাপের নাম কেদারনাথ। এই বাড়িটা তাঁর সময়েই তৈরী। তবে এখানে, এই দশ কাঠা জমিটার ওপর একটা ছোট্ট মত একতলা বাড়ি আগেও ছিল। এপাড়ার অতিবৃদ্ধ লোকেরা আগে দেখেছেন সে বাড়ি। সে বাড়িও এখন নেই, সে বৃদ্ধরাও নেই। শুধু আছে পান্তুবুড়ি। অনেকে আবার পান্তাবুড়িও বলে। তার নাকি বয়সের গাছপাথর নেই। পান্তুবুড়ি থাকত বটতলায় একটা খাপরার ঘরে। কিন্তু বটতলা নামেই বটতলা। সেই বিশাল বটগাছ আর নেই। খাপরার ঘরও নেই সেখানে। সেই জায়গায় এখন একটা ঝাঁ চকচকে জি প্লাস ফোর ফ্ল্যাটবাড়ি, তার নাম আশ্রয়। কার আশ্রয় কে জানে, পান্তুবুড়ির তো নয়। অথচ পান্তুবুড়ি আর বটগাছ, ওই দুজন ওখানে না থেকে যদি আস্ত একটা বস্তি থাকত, তাহলে আশ্রয়’-এর পিলার গাঁথার আগেই কদমছাঁট তাঁতের শাড়িরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে পড়তেন রাস্তায়। কিন্তু একটা ঝুরঝুরে বুড়ো বট আর একটা খুনখুনে বুড়ি ভিখিরী জন্য প্ল্যাকার্ড ফ্যাকার্ড লেখা পোষায়না। পান্তুবুড়ির রাতের আস্তানা এখন যুবকবৃন্দ ক্লাবের বারান্দা। আগে যখন এটা গেরস্ত পাড়া ছিল, তখন পালা করে পান্তুবুড়িকে দুবেলা খাওয়াবার ভাগ নিত পাড়ার লোকেরা। এখন লম্বা লম্বা নতুন ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর লোকজন কেউ চেনেইনা পান্তুবুড়িকে। তাই তার রোজ খাওয়াও জোটেনা। বুড়ি তবু মরেনা।

সাত কাঠা জমির ওপর সেই ছোট্ট বাড়ির মালিককে চিনত পান্তুবুড়ি। তার বাড়ি নাকি বাসনও মাজত কম বয়সে। কেউ সে কথা পাড়লেই বলে, ওই তো ভোলা, ভোলা সান্ডেল। লোক বড় ভাল ছিল গো, প্রেত্যেক পাব্বনে আমায় একটা করে টাকা দিত। সে সময়ে এক টাকা কিন্ত বিরাট ব্যাপার। এই থেকেই বোঝা যায় ভোলা স্যান্যাল দিলদরিয়া লোক ছিলেন। তাঁর বংশজরা সেই ধারা অব্যাহত রেখেছিল। আমাদের শঙ্করও কম যেতনা, তবে সে কথা পরে। ভোলাবাবুর সেই ছোট্ট বাড়িটার জায়গায় এখন একটা ম্যানসন টাইপ চোখ জুড়নো বাড়ি। বাকি জমিটায় নানা রকম ফলের গাছ। হাল আমলে চারিদিকে গজিয়ে ওঠা বিচিত্র রঙের উল্লম্ব ইঁট পাথরের বস্তিগুলোর মধ্যে এই বাড়ি একটা ব্যতিক্রম তো বটেই। কেদারবাবু তাঁর পিতার তৈরী বাড়িটা ভেঙে এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন, কিন্তু সামনের গেটের পাশে মস্তবড় শ্বেত পাথরে খোদাই করে নাম লিখিয়েছিলেন, ভোলানাথ নিবাস।

কেদার বাবুর ছেলে রুদ্রনাথ। খুব বড় সিভিল এঞ্জিনীয়র ছিলেন। একবার স্ত্রীকে নিয়ে উত্তর ভারতে তীর্থ করতে গিয়ে গাড়িশুদ্ধু খাদে পড়ে যান। শঙ্করের বয়স তখন চার। শঙ্করনাথ দাদুর কাছেই বাড়তে থাকে। কেদারবাবুর স্ত্রীও গত হয়েছেন ততদিনে। পাড়াশুদ্ধু লোক শঙ্করের অভিভাবক তখন, শঙ্কর পাড়াময় দস্যিপনা করে বেড়ায়, সবাই চোখে চোখে রাখে। আমরা এখানে এসেছি সেই সময়েই। তখন থেকেই দেখছি ছেলেটাকে। ছেলে বড় হ, স্কুল থেকে বেরোল পরীক্ষায় ভাল ফল করে, শিবপুরে এঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ভর্তি হল বাপের মতই। কিন্তু বাপের সময় ছিল আলাদা। এখনকার ছেলেদের বাড়ের বয়সটা খুব সাবধানে রাখতে হয়। কেদারবাবু তখন ভগ্নস্বাস্থ। পাড়ার কাকা জ্যাঠারাও প্রোমোটারদের হাতে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে সোনারপুর বা মধ্যমগ্রামে চলে যাচ্ছেন একে একে। নজরদারির অভাবে শঙ্করের পা পিছলোনো শুরু হল।

একদিন গিন্নীকে নিয়ে নাইট শোয়ে ছবি দেখে ফিরছি, দেখি শঙ্করের জামা ঝুলছে প্যান্টের বাইরে, পা পড়ছে এলোমেলো। গিন্নী বলল, মদ ধরেছে ? আহারে, বেচারাকে দেখবার কেউ নেই। আমি বললাম, এই বয়সে একটু অমন হয়েই থাকে। তারপর এঞ্জিনীয়ারিং কলেজে বিগড়ে দেবার সঙ্গীর তো অভাব নেই। যাক, কিছুদিন আপনি সামলে নেবে। ভুল বলেছিলাম। অনিয়মত ক্লাস করার জন্য একটা বছর নষ্ট হল শঙ্করের। তখন প্রায়ই তাকে পাড়ায় দেখা যেত রাত্তিরে। হস্টেল থেকে পালিয়ে এসেছে। সঙ্গে তার একটা গিটার কাঁধের ওপর আড়ে ঝোলানো। গিটার সে বাজাতে পারতনা, শুধু সবকটা তারের ওপর আঙুল বাজিয়ে ঝংকার তুলত, রাত নটার পর বটতলার অন্ধকারে তার চিৎকার শোনা যেত - ভেবে দেখেছ কি তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, আরও দূরে, তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে কিছুক্ষণ পর আর্তনাদ ভেসে আসত  আ-হা হা হা -  শঙ্কর ফুটপাথে গড়াচ্ছে, বিড়বিড় করে বলছে, পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে বটের ঝুরিকে জড়িয়ে শঙ্কর বলে , আ-হা-হা-হা তারপর পড়ে যায় মাটিতে। পান্তুবুড়ি বলে, আ হা হা হা, তোবড়ানো ঘটি করে জল এনে মুখে ঢালে। আমরা দেখি, কষ্ট পাই, গিন্নী বলে আ-হাবেচারা।

এঞ্জিনীয়ারিং কলেজ বিদায় দিল শঙ্করকে। তখন আর মদে হয়না, শুকনো নেশায় পেয়েছে তাকে। এ নেশায় প্রচূর অর্থ লাগে। প্রায়ই অশক্ত কেদারবাবুর ওপর হামলা চালায় শঙ্কর। ভোলানাথ নিবাসের প্রকান্ড ঘরগুলো থেকে প্রায়ই উচ্চরবে আওয়াজ শোনা যায়, টাকা দাও দাদু, সত্যি বলছি, কাল থেকে আর চাইবনা, প্রমিস -। কেদারবাবু অশক্ত হাতে দেরাজের চাবি খুলে টাকা বের করে দেন আর বলেন, এই শেষ। আর টাকা দেবনা আমি। বাড়িঘরদোর কিচ্ছু দেবনা তোমায়, দানপ্ত্র করে  রামকৃষ্ণ মিশন কে শঙ্করের গিটারের ছ্যাঙ্‌ ছোঙ্‌ ভেসে আসে, আর বেলপুকুরের নৈঃশব্দ খান খান করে শোনা যায় -পাশাপাশি বসে একসাথে দেখা, একসাথে নয় আসলেতে একা-তোমার আমার ফারাকের নানা ফন্দি আ-হা-হা-হা

এক রাত্তিরে রোজকার মত দেয়াল ধরে টাল সামলাতে সামলাতে শঙ্কর ফিরছিল পাড়ায়। সামনে পড়ল তার চেয়ে বয়সে কিছু বড় সাদামাটা চেহারার এক যুবক। সে বলল, নমষ্কার, আপনি এই পাড়াতেই থাকেন ? শঙ্কর জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, কেন দাদা ? আগন্তুক বলল, আচ্ছা, এপাড়ায় একটা ঘর ভাড়া পাওয়া যাবে কিনা বলতে পারেন? আসলে দালালি দেবার আমার ক্ষমতা নেই, তাই শঙ্কর বলল, হে হে ভাল লোককে বলেছেন। আমি নিজেই কোথায় আছি মাঝে মাঝে ভুলে যাই, তো লোকটি বলল, আচ্ছা আপনাদের বাড়িতে খালি ঘর নেই ? আমাকে ভাড়া দিননা। আমি লোক খারাপ না। শঙ্কর লোকটির গলা জড়িয়ে বাড়ি ফিরল। বলল, দাদু, এ আমার দাদা হয়। আজ থেকে নীচের ঘরে থাকবে, ব্যাস। লোকটি ভক্তিভরে কেদারনাথকে প্রণাম করল। তিনি অসন্তুষ্ট হয়েও জিজ্ঞেস করলেন, নাম কী? কোত্থেকে আসা হচ্ছে? লোকটি বলল, আমার নাম শ্রী ভোলানাথ চক্রবর্তী। কেদারবাবুর মুখের ভাবের অনেক পরিবর্তন হল। বিড়বিড় করে বললেন, ভো-লা-না-থ, ভোলা-নাথ,  ফিরে এলেন ? মুখের আদলেও কিছুটা মিল তারপর বললেন, জানতো আমরা সবাই মহাদেবের নামে পরিচিত। আমি কেদারনাথ, আমার ছেলে ছিল রুদ্রনাথ, নাতি শঙ্করনাথ। আমার বাবাও ছিলেন তোমার নামেই, ভোলানাথ স্যান্যাল। আচ্ছা তুমি নীচের সামনের ঘরের চাবি নিয়ে যাও। লাগোয়া বাথরুম, রান্নাঘর সব আছে। ভোলানাথ মিনমিন করে বলল, ভাড়াটা কেদারবাবু বললেন, লাগবেনা।

দিনে দিনে ভোলা হয়ে উঠল চোখের মণি। সে হাত ধরে কেদারবাবুকে বেড়াতে নিয়ে যায়, ডাক্তারবাড়ি নিয়ে যায়, রান্নার লোককে ঝাল বেশি দিলে বকাবকি করে। আসলে সে এখন ওপরেই খায়। একদিন কেদার বাবু বললেন, বাবা ভোলা, তোমার পৈতেটা অত ছোট কেন বলত? কাল বারান্দা থেকে দেখলাম ভোলা তড়বড়িয়ে বলে, ইয়ে ঐযে, বাথরুম থেকে বেরোচ্ছিলাম তো, কানে জড়ানো ছিল তাই কেদারবাবু বললেন, কানে ? কি জানি আজকাল চোখেও ভাল দেখিনা। শঙ্কর এখন প্রায় রাতেই বাড়ি ফেরেনা। তার গিটারের তার ছিঁড়ে গেছে, জড়ানো গলায় সে গায়, - তার চেয়ে এসো খোলা জানালায়, পথ ভুল করে কোন রাস্তায়, হয়ত পেলেও পেতে পারি আমি সঙ্গী আ-হা-হা-হা- সকালে দেখা যায় পান্তুবুড়ির কোলে মাথা রেখে সে ঘুমোচ্ছে। পান্তুবুড়ি গভীর মমতায় তার কপালে হাত বুলোচ্ছে।  সেদিন কেদারবাবুর আরামকেদারার হাতলে বসে শঙ্কর বলল, দাদু কিছু টাকা দাও মাইরি, আমি আর চাইবনা কেদারবাবু বললেন, এক পয়সাও পাবেনা। বাড়িঘর, কিচ্ছু পাবেনা। আমি সব ভোলানাথকে উকিল ডেকে দানপত্র করে দিয়েছি। সামনের মাসেই ওর বিয়েও দেব। বেশি উত্তেজনা ওই বয়সে ভালনা। শেষ রাত্তিরে কেদারবাবু পরলোকে যাত্রা করলেন। ভোলা এমন কাঁদল, যে নোনা জলের পুকুর হয়ে গেল।

শঙ্করকে দেখলে এখন আর চেনা যায়না। চুলদাড়ি বহুকাল কাটা হয়না, হাত পা কাঁপে, পাড়ায় পুরোন লোক অনেক কমে গেছে, তবু যাকে সামনে পায় তার কাছেই টাকা চায়। গিন্নী সেদিন বাজার করে ফেরার পথে যা বেঁচেছিল, সব দিয়ে এল। আমি বললাম, কেন দিলে, ও পয়সা তো খাবারের জন্য খরচ হবেনা। গিন্নী বলল, কী করব, চাইল খাবার যোগায় পান্তু বুড়ি। ভিক্ষের পয়সায় কিছু চাল, আলু কিনে ইঁটের মধ্যে শুকনো ডাল আর পাতা দিয়ে আগুন জ্বালে, তাতে তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে দুজনের খাবার ফোটে বগবগ করে। রাত্তিরে এক কাঁথাতেই দুজন শুয়ে থাকে পাশ ফিরে। একদিন সকালে পান্তু বুড়ি আর উঠলনা। বয়স একশ পেরিয়ে গেছিল। অনন্তকাল তো বেঁচে থাকার কথা নয়। দুদিন পরে শঙ্কর গিয়ে ভোলানাথ নিবাসের বেল বাজাল। ভোলাদা, নীচের ঘরে একটু থাকতে দাও মাইরি, আমার আর থাকার জায়গা নেই, দুদিন কিছু খাইনি, প্লীজ ভোলা বলল, সেকী, আহা বড় কষ্ট তোমার, দেখলেও কান্না পায়। এ তো তোমারই বাড়ি। তুমি থাকবে এ আর বেশি কথা কী। কিন্তু ভাই ছেলেটা বড় হচ্ছে, চোখের সামনে তোমায় দেখলে ও বখে যাবে। তুমি বরং এইটা রাখ, বলে একটা কুড়ি টাকার নোট বাড়িয়ে দিল।

শঙ্করনাথ স্যান্যালের দেহটা ফুটপাথে অর্ধেক আর রাস্তায় অর্ধেক, পড়েছিল অনেকক্ষণ। তারপর পুলিশ তুলে নিয়ে গেল। সৎকার কি হয়েছিল ? আমি জানিনা। আমার রোববার অনেক কাজ, মাংস আনতে হবে, ছেলের ক্রিকেট কোচের কাছে একবার যেতে হবে। দুপুরে ক্লাবে ব্রিজ কম্পিটিশন আছে। ভোলাকে বারান্দায় বা বাড়ির ধারে কাছে দেখেনি কেউ। দিন তিনেক পর খুব মেঘ করল। আকাশ কালো হয়ে এল। ভোলার বৌ, ছেলেকে বলল, ওহ, দারুন ওয়েদার। চল ভিজবি ? বলে গান গাইতে গাইতে ছাদে উঠল,- এই মেঘলা, দিনে একলা, ঘরে থাকে না তো মন চড় চড়াৎ করে বাজ পড়ল। ভোলানাথ নিবাসের ছাদে পুড়ে ঝামা হয়ে যাওয়া দেহ দুটো সেই পুলিশের গাড়িই নিয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ পর।

কিছুদিন পর ভোলানাথ শঙ্করের মত দেখতে হয়ে গেল। চুল-দাড়ির জঙ্গল, হাত পা কাঁপে বিনা নেশাতেই, সম্ভবতঃ নার্ভের রোগে। বারান্দায় একলা বসে বিড়বিড় করে কি জানি বকে। একদিন কাউকে কিচ্ছু না বলে দরজা জানলা সব খুলে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। চোরেরা প্রথমে এসে ছোটখাট জিনিষ, যেমন গয়নাগাঁটি, মোবাইল, হাতঘড়ি এইসব নিয়ে গেল। কিছুদিন পর, ক্লাবের ছেলেদের কয়েকজন এসে ফ্রিজ, টিভি গুলো তুলে নিয়ে গেল। তারপর কারা যেন এসে জানলা দরজাও খুলে নিয়ে গেল। আমি সে সব দেখিনি, বয়স বাড়ছে, কে কার হেফাজত করে। সেবাড়িতে এখন প্যাঁচা আর ভাম বাস করে। সারা দেয়াল বেয়ে অসংখ্য বট আর অশ্বত্থ গাছ বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে। দু একবার সিনেমা ওয়ালারা এসে কী সব ভূতের ছবি শুট করে গেল। সদর গেটের বাইরে কিন্তু শ্বেত পাথরের ফলক এখনও চকচকে ভোলানাথ নিবাস। সেদিন সর্বাণী দেবী আবার এসেছেন। মেজাজ বেশ নরম দেখলাম। আজ আর কাজকুমারী কফি আনেনি। আমার গিন্নী নিজে হাতেই এনেছে। বললেন, মোড়ের কাছে বাড়িটার কোনও ক্লেম্যান্ট নেই ? সাপখোপের বাসা, আপনাদের তো কাছাকাছি থাকাও রিস্কি। আমি বললাম, ভোলানাথ নিবাসের ভোলানাথই তো বিবাগী হয়ে কোথায় চলে গেছেন। উনি ভুরু কুঁচকে বললেন, কে ভোলানাথ ? আমি বললাম ঐ তো, বাড়ির মালিক-ভোলানাথ চক্কোত্তি। উনি একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ওর নাম রতন। রতন সেনগুপ্ত। কোচবিহারে বাড়ি, আমার বাবার স্টেনো ছিল। বাবা অবশ্য বেশিদিন রাখেনি, লোকটা কেমন সন্দেহজনক।