রম্য রচনা
আমি মেলায় যাইনি
আমি ডান পাশে হাসি দিয়ে বাঁ পাশের আর্থ্রায়টিস সন্তুলন
করছি । তুমি মুখ থেকে ঝকঝকে কাজু ঝরিয়ে বললে- আমার স্টলটা
দেখেছেন ? আমি ফ্রী টয়লেটের ঝাঁঝের সাথে ফ্রী কাজু খেতে খেতে দেখলাম
ব্যানারের ওপর একক কাকিনী ঘাড় ঘুরিয়ে কামিজে খাঁজার চর্যায় রত । চোখাচোখিতে বায়সোচিত বয়ো:ভঙ্গিমায় বলল-কী করি ? আগ্রাসী বিপণন! সেজেগুজেই থাকি । মেলায় এনেছি বরাক ভ্যালির কমলা কবিতা কেন্দুঝরের
ভুঁইকুমড়ো গদ্য ও মজা ধমনীর প্রবন্ধ । বোঁচকা
নিয়ে ফিরে তো ফিরে যেতে পারি না! ততক্ষণে কলকাতা পুলিশের সত্ববর্ণ প্রহরা
রক্তচক্ষুর মহড়া দিতে লেগেছে- দাদা এখানে ইনটু নয়। এখানে
মার্ডার হচ্ছে
। চার পাশে
তাকিয়ে দেখি ভাড়া করে আনা কবিতার অগণিত শব ধুলোয় মুখ গুঁজে। এক মরণোন্মুখ জবানী
দিচ্ছে- আমরা ফিবছর মদের আসরে বড় সস্তায় গতর খাটাই, একটু সুদিন দেখব বলে অল্প পয়সায় এখানে এসেছিলাম। বরাদ্দ
সুখটুকুও এখানে অলভ্য,
ছুঁয়েও দেখেনা কেউ, যদিও দাদন দিয়েই এনেছে। তাই আমরা নিজেদের গণ আহুতি দিচ্ছি । পাবলিক এড্রেসে প্রেমেন্দ্র মিত্র আবৃত-
“ছাদে যেও নাকো সেখানে আকাশ অনেক বড়, সীমাহীন । তারাদের চোখে এত জিজ্ঞাসা- স্বপন সব হবে বিলীন।” ... বাতের ব্যথায় ঘুম ভেঙ্গে গেল ।
“ছাদে যেও নাকো সেখানে আকাশ অনেক বড়, সীমাহীন । তারাদের চোখে এত জিজ্ঞাসা- স্বপন সব হবে বিলীন।” ... বাতের ব্যথায় ঘুম ভেঙ্গে গেল ।
ভাগ্যিস আমি মেলায় যাইনি। আমি অনুগুলে এবং আমার পিঠের
নিপীড়ক বোঝা ও কান যথাবিহিত রাসভ সুলভ । আর সেই
কাকিনীটিও এখানেই । পিতলার বেল গাছে। যদিচ আজ উদাসীন। বেতালা বেল গাছটা মাঘকে
ফাগুন জ্ঞানে ঝরিয়ে চলেছে বিস্তর পাকা বেল । হাওয়া আমাকে প্রশ্ন করে-তুমি মরলে তোমার লেখাগুলোর কী গতি
হবে? ইথারে গালিবের স্বর-হুঁহুঁ বাবা সেদিক থেকে আমার ফান্ডা
পাকা- “চন্দ্ তস্বীরে-বুঁতা চন্দ্ হসীনোঁ কে খুতূত্; বাদ্ মরনে কে ইয়ে সামাঁ মেরে ঘর সে নিকলা।” (আমার মৃত্যুর পর আমার ঘর থেকে যে জিনিসগুলো বেরোবে, তার মধ্যে কিছু থাকবে প্রেমপত্র, আর কিছু সুন্দরীদের ছবি।) আর তোর তো মসীতে-পত্রে অহি-নকুল। ইঁদুরের ল্যাজ বেয়ে
পিঁপড়েরা সার সার ঢুকে আছে কৃষ্ণ গহ্বরে। তুই ম’লে ওই বেঢপ
পলিপ্লাস্টের খানা খন্দর কে সামলাবে ? আমি ভাবি সাইবারের বুকে আমার ফেস তো প্রোজ্জ্বল। তার বেশী
কী দরকার? দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত বাহাদুর শাহ্ জফ্ফর- “ন তো ম্যায় কিসী কা হবিব হুঁ, ন তো ম্যায় কিসী কা রকীব হুঁ, জো বিগড় গয়া ওহ্ নসীব হুঁ, জো
উজর গয়া ওহ্ দায়র হুঁ । হম পর ফাতেহা কোই আয়ে কিঁউ, কোই
চার ফুল চঢ়ায়েঁ কিঁউ? জাফর আশক কোই বহায়ে কিঁউ, কে ম্যায় বেকসী
কা মাজার হুঁ।”
২
“হম সে অবস হ্যায় গুমাঁ-এ-রন্জিস-এ-খাতির খাক মেঁ উশ্শক কী গুবার নহীঁ হ্যায়।” -‘আ কি মেরি জান মেঁ কারার নহীঁ হ্যায়’...মীর্জা গলিব।আমি সংশয় ও নিস্প্রেম ছাই ওড়ানো বাতাসে
নিস্পৃহ প্রেমীদের রাগাশ্রিত মেঘে ও কুয়াশায় আদৌ নয়। অবশেষে মেলায় গেলাম, ছোট মেলায়
নয় মিলন মেলায়! সেখানে দেখলাম অজস্র কবিতার ডানায় আকাশ ঢাকা পড়ে গেছে। পরস্পর
ঠোক্কর খাচ্ছে। আর ছোট পশরার ঠেকের কথা বলতে সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়ের
আনন্দ বাজার ব্লগ থেকেই কোট করে দিচ্ছি- “লিটিল
ম্যাগাজিন স্টলগুলোকে লিটিল ম্যাগাজিনের আড়ত বললেও কম বলা হয়। কলকাতা থেকেই অন্তত
তিনশো লিটিল ম্যাগাজিন প্রতি মাসে বার হচ্ছে। তিরিশ বছর বন্ধ থাকার পর বের করা
হচ্ছে একটা লিটিল ম্যাগাজিন। গর্বিত হচ্ছেন প্রকাশকরা। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে তিরিশ
বছর পর ঠিক কোন জিনিসটা পুনঃপ্রকাশিত হল ? শুধুমাত্র ম্যাগাজিনের নামটা ? তিরিশ বছর আগে ওই ম্যাগাজিনে যাঁরা লিখেছিলেন তাঁরা কি
তিরিশ বছর আর কবিতা লেখেননি ?
তাহলে তো শুধু ‘নাম’-টা ছাড়া আর সবই সচল ছিল । তিনজন কবি একজায়গায় হলেই বাংলা ভাষায় একটা ‘ছোট’ পত্রিকার জন্ম হয়। পরের পর
ম্যাগাজিনগুলো হাতড়াই। কবিদের কবিতার বই উল্টে যাই পাতার পর পাতা । আমাকে লাইনগুলো কেন যে এখন আর স্পর্শ করে না, আমারই বিভ্রান্তি! আমি তো অনেকদিনই কবিতা লিখতে পারি না।
তাহলে কি আমি কবিদের প্রতি ঈর্ষান্বিত? কবিরা
ভয়ানক স্পর্শকাতর। কারও কবিতাই ভাল লাগছে না বললে কবিতা ভীষণ চটে যাবে। কবি জয়দেব
বসু লিখেছিলেন, ‘জানে বেশী বোঝে কম আজকাল সব ‘কটা মেয়ে’। কবিরা আমাকেও এই দলে ফেলতে
পারেন।” কবি মণীন্দ্র গুপ্তর একটা কথা- ‘একজন কবি তাঁর সারা জীবনে যা লেখেন... তাঁর আত্মজীবনী।’
মেলার মধ্যে মণীন্দ্রদা-দেবারতিদির বাড়িতে গিয়েছিলাম । অনেক কথা হল, কথাক্রমে
এই প্রসঙ্গও। ৭৭ সালে যখন পাড়ায় একটা লিটল ম্যাগাজিন বার করছি...মোটামুটি নিয়মিত
কবিতা লিখছি...তখন সৃষ্টির আবেগ ছিল। ৮৬ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল। তারপর জীবিকার
কারণে অনুগুলে লাগাতার থাকা, বিবাহোত্তর দায় ইত্যাকার বিবিধ
ফ্যাক্টরের লব্ধ, লেখনীকে প্রায় সম্পূর্ণ স্থবির করে দিল ( মানে ব্যাপারটা
উঠোনের দোষ!)। বোধহয় কবিতাকে স্থবির করতে পারেনি। না হলে ২৫ বছর পরে আবার বেরিয়ে
আসবে কেন? পরবাস-৪৮-এর পাতায় ? দীর্ঘ ২৫
বছরে আমার ছেড়ে আসা যৌথ সংসার ঘুনকাটা কাঠ গুঁড়োর মত ঝাড়পোঁছ হয়ে গেছে। পাড়া বা
এলাকার পুরনো সাহিত্য চক্র চুরমার হয়ে গেছে। আনুগুল ও শিল্প নগর মিলিয়ে হাতে গোনা
বাঙ্গালী, তাঁদের মধ্যে কেউই লেখালেখির ধারে কাছে নেই। তাই এক
জায়গায় লিখেছিলাম- কন্টিনেন্ট শিফট, কতটা বিশ্বায়ন কতটা বিশ্ববিপণন
কতটা জন বিস্ফোরন সে সব না জেনেই বুঝি । পুণর্জন্মের পর দেখলাম সেই সৃষ্টির আবেগকে ছাপিয়ে একটা তাগিদ... কবিতার
কাছে আশ্রয় খোঁজা...নিজেকে খোঁজ করার তাগিদ। তাই মেলার মধ্যে যেমন কবিতার
(কবিদের!) গ্যালাক্সিতে বসে একবার লিখছি- নখ ও
নক্ষত্র হোঁচোট খাওয়া নখটা নীল হতে হতে এতো হয়ে গেল বলা ভালো স্বতন্ত্র
নক্ষত্র । নখ হাত
থেকে খসে নখ হাতে উঠে আসে শরীরে থাবা বসায় । অসংখ্য
নখেরা রোজ হোঁচোট খাওয়ার
দিকে ঈর্ষায় তাকায়। সরল কানাকানি দুর্বল ধ্বনি- ক্ষরণ না হলে সম্পূর্ণ হওয়া যায়? ছাঁটাই নখেদের মৌন মিছিল মর্গে পৌঁছয় পথ দুর্ঘটনায় চোটগ্রস্ত নখের দেহ ছিঁড়েকুটে ভিসেরা পেল বটে, তবে চোট ও
নক্ষত্র জন্মের গাণিতিক সম্পর্ক এখনও অনাবিষ্কৃত ।
লিটল ম্যাগ চত্বরের পাশেই বেনফিশের স্টল। পাশে এক ফালি
ঘেসো জমি যেন তাড়াহুড়োতে কামাতে গিয়ে ছেড়ে যাওয়া দাড়ি। শক্তি চট্টপাধ্যায়ের “সমুদ্র তোর আমিষ গন্ধ”-র মতন নাকে
আসছে ১৯৭৪ সালের প্রথম দেখা পুরীর সৈকত...যখন জন-বিস্ফোরন ততটা হয়নি যতটা হলে
পরিবেশ লুঠ হয়ে যায়...সমুদ্রে আমিষ গন্ধ বিরল হয়ে যায়। এ ছাড়া আর আমার বিকল্প কী...অনুগুল...কোয়ার্টার্স লাইনের
ভেতর দিয়ে যেতে যেতে উগ্র পেঁয়াজ রসুন ভাজার গন্ধ...হয়তো নিরামিষ রান্নাই
হচ্ছে...সব ব্যাঞ্জনেই একই মশলা, ফলত ব্যাঞ্জন ব্যাঞ্জনা রহিত।
গাধা সচারচর ডাকে না। মোট বওয়ার সময় তো একেবারেই নয়। অলস সময়ে হয়তো দাঁড়িয়ে
আছে...হঠাৎ ডেকে উঠল...থামতেই চায় না। তার পর যখন থামলো তো থামলোই। আমারও কি
কিছুটা তাই নয়? ২৫ বছর পরে কবিতার কাছে ফেরা ? এই ভাবে
কবিতার কাছে ছাদ খুঁজতে খুঁজতে বাড়ি ফিরে যেটা লিখি-
ঋণ শোধ
মায়ের ঋণ শুধতে স্ফুলিঙ্গ বেচে
দিলাম।
পেটের দায়ে বয়স বেচে দিলাম।
সন্তান দায়ে হাত বেচে দিলাম।
দায় নিভে গিয়ে জন্ম দেয়ে নতুন
দায়।
এক সময়ে দেখলাম ক্রমান্বয়ে
সর্বাঙ্গ বিকিয়ে
আমি বিদেহী। বিনিময় যা এসেছে কোন পকেটে রাখি...
বুকই নেই তো বুক পকেট।
হঠাৎ মনে হল বিদেহে তো দায়
থাকতে নেই
তবে কীসের সঞ্চয়? এখন আমি হাওয়া-জলতল ঘ্যাঁসা
আর্দ্র হাওয়া-মরুবালি ঘ্যাঁসা
শুষ্ক হাওয়া-
উনুন ফোঁড়া রূদ্র হাওয়া-তুষার
ছোঁয়া
শিরদাঁড়া শিউরোনো হাওয়া-অতি সহজেই ছুঁতে পারি
সেই সব অনুষঙ্গ যেখানে কোনও শরীরী অঙ্গ পৌঁছয় না ।
অতএব...ঠকিনি।