গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৬ জুন, ২০১৩

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

অচ্ছুৎ 


সুরতিয়া, চানের জলটা দিয়ে দিস...রান্নাঘর থেকেই হাঁক দিল চন্দনা । আজ কদিন হল সে তার বাপের বাড়ির গ্রামে এসেছে । এসেই দ্যাখে বিভ্রাট । তিন দিন আগে এ অঞ্চলে বিরাট জল-ঝড় হয়ে গেছে । কোথায় কোন জঙ্গলে দুটো ইলেকট্রিকের পোল উল্টেছে, তার-ফার ছিঁড়ে একাকার । আজ আবার দীপু, চন্দনার বড় জ্যাঠার ছেলে এসে খবর দিল দশটা ইনসুলেটর ভেঙ্গে গুঁড়ো, আজও বিজলী আসার কোন সম্ভাবনা নেই । আগামীকাল হয়ত সন্ধ্যার দিকে আসতে পারে   -সে কী রে- বিস্ময়ে বলে ওঠে চন্দনা ।
তোদের কলকাতা নাকি, হাতের কাছে সবকিছু... কোথায় কোন জঙ্গলে কী হয়ে আছে, খুঁজতে কদিন লাগে দ্যাখ ...বলে দীপু  
-আর মানুষ গুলো কেও বলিহারি , কেঊ কিছু বলেও না...! উষ্মা প্রকাশ করে চন্দনা ।
 --খুব তো কলেজে পড়াস, এখানে যা না, আমবাগানে একটা স্কুল করে বসগে,এই গাঁয়ের লোকগুলো বাইরের আর কোন পৃথিবীকে জানে, যে ওরা তোদের মত ছুটে যাবে ? কার কাছে যাবে ? শোন, ওদের তোদের মত অত নেই-নেইনেই বুঝলি, ওদের মনে অত অশান্তি নেই......বড় বড় পা ফেলে ফটকের দিকে এগিয়ে গেল দীপু
চন্দনাদের গ্রামের বাড়িটা বিহারে । না, এখন ঝাড়খন্ডে । এসব অঞ্চলে শালের জঙ্গল খুব বেশি । পাহাড়ী গ্রাম, চারিদিক শাল-মহুয়ার জঙ্গল। তাদের পরিবারেরও একসময় ছিল শালের জঙ্গল, এখন আছে না গেছে সেকথা আর চন্দনা বলতে পারবে না । কতদিন পর আসা এই গ্রামের বাড়িতে । এসব জায়গায় কোথায় কোন ইলেকট্রিকের খুঁটি উপড়ে পড়ে রয়েছে, খুঁজে বার করাই মুস্কিল । গ্রামবাসীরাও তা জানে । সারাদিন বিকেল পর্যন্ত তো কোন অসুবিধে নেই । ঝলমলে আলো । রোদের কিন্তু প্রচন্ড তাপ। শরীরের ভিতর থেকে সবটুকু যেন শুষে নেয় । বিকেলের দিকে ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে । সারাদিন যে এত উষ্ণতা ছিল তা বোঝাই যায় না । বাড়ির চারদিকে খাটিয়া, চেয়ার, মোড়া যার যা আছে, সব পেতে লোকে উপভোগ করে সন্ধ্যের বাতাসটুকু । লালটেন কিম্বা কুপী জ্বালানো থাকে । একটি/দুটি দিন এভাবে তাদের কোন অসুবিধে হবার কথা নয়, তারা বিচলিতও হয় না, অসহিষ্ণুতাও নেই ব্যবহারে । কিন্তু চন্দনা দীর্ঘদিন গ্রামের বাইরে। কলকাতার বাবুগিরিতে সে অভ্যস্ত । সেখানে বিদ্যুৎ গেলেও জেনারেটর আছে, ইনভার্টার আছে । আলো গেলেও আলো থাকে, টিভি সিরিয়াল দেখার কোন অসুবিধে সেখানে হয় না । এখানে এসে অন্ধকারে বিরক্ত বোধ করছে সে । যদিও অনেক--অনেক দিনের পরে গতকাল রাত্রিতে ফোল্ডিং খাট পেতে সে বাড়ির উঠোনে শুয়েছিল আর সকলের সঙ্গে। কলকাতায় এভাবে শোয়ার কথা ভাবাই যায় না । বিরাট উঁচু পাঁচিল ঘেরা পুরোন দিনের বাড়ি তাদের। জ্যাঠা-কাকাদের ছেলেরা, বাচ্চারা সব বাড়ির ছাতে । বাড়ির মেয়েরা ভিতরে উঠোনে । কি আরাম ! ভোর রাত্রে শীত করছিল । উঠে গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে চাদর নিয়ে এসে ভাল করে মুড়ি দিয়ে আবার ঘুমিয়েছিল সে । কে বলবে সারাটা দিন কি যন্ত্রণায় কেটেছে ! কিন্তু সকালে উঠেই আবার সেই প্রচন্ড দাবদাহ । তার ওপর বিদ্যুৎ নেই, কলে জল নেই । মাথা খারাপ হয়ে আছে চন্দনার । কুয়ো থেকে জল সে তুলতে পারবে না   রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপগুলো একটা থালার ওপর বসিয়ে নিয়ে বাইরে এসে টুলের ওপর রাখল । সুরতিয়ার চায়ের গেলাস মাটিতে নামিয়ে রাখল যেখানে লম্বা বারান্দার এককোণে সুরতিয়া বসেছিল । চায়ের গেলাস নামিয়ে রেখে দুটো বিস্কুট দিতে গেলে হাত পেতে নিল সুরতিয়া । আবার বলল চন্দনা--পানি এনে দিয়ে তবে ঘর যাবি ওরা বাড়ি বলে না, ঘর বলে । দুটো কথার মধ্যে তফাৎ কিন্তু অনেক । বাড়ি বললেই কেমন যেন ইঁট-কাঠের জঙ্গল মনে হয় । ঘর বললেই ভরা সংসার । তাই কি ওরা এত সুখী
-হামরাকে ছুয়া লিবে, ক্যা--বলে ওঠে সুরতিয়া   কেন, না নেবার কি আছে  ?
ইস, দিদি যেন কি ! সব ভুলে গেছে সসুরাল গিয়ে । পুরা কলকাত্তাইয়া বনে গেল !
-- হামরা কে মাহাত আছি... হামরাকে ছুয়া পানি কি করে লিবে...হাসতে হাসতে বলে সুরতিয়া
চন্দনা দেখছিল সুরতিয়াকে । ফর্সা রঙ । বেগুনী রঙ্গের একটা জংলাছাপা শাড়ী পরেছে । রোগা ছিপছিপে চেহারা । মাথায় বেশ লম্বা । ঘোমটা আছে মাথায় । শাড়ীর আঁচল ঘুরিয়ে অবাঙ্গালীদের মত করে পরা । একটু উঁচু করে শাড়ী পরেছে সে, গোড়ালি দেখা যাচ্ছে । ওর পায়ের দিকে তাকাল চন্দনা । এত কাজ করে মেয়েটা, ছাগল চরায়, লোকের বাড়ি খাটে । ওর বরটা একটু রুগ্ন । বেশি কাজ করতে পারে না । আশে-পাশের কলিয়ারী থেকে মাথায় করে কয়লা এনে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে । ঘরের সব কাজ করে এই মেয়েটা । সুরতিয়া এখানকার বউ । ওর বাপের বাড়ি মধুবনী তে, সেই দ্বারভাঙ্গার জিলা । বিয়ে হয়ে এখানে আসার পর থেকেই এটা-ওটা দরকারে এ বাড়িতে কাজ করে দেয় । ওর শ্বশুরবাড়ির দাদা, পরদাদারাও যুক্ত ছিল এবাড়ির সঙ্গে । কিন্তু এত কাজ করেও হাসে কি করে মেয়েটা ! নিজের পায়ের দিকে একবার তাকাল চন্দনা । হিন্দি সিনেমা না হলেও টিভি সিরিয়ালে অনায়াসেই নামিয়ে দেওয়া যায় ওকে, ভাবছিল চন্দনা
চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াল সুরতিয়া । এগিয়ে গিয়ে কুয়োতলায় জল নিয়ে হাত ধুল, গেলাস ধুল । গেলাস বারান্দায় নামিয়ে রেখে বললে- যাই দিদি
--জলটা দিয়ে যাও, আরে চান করব না নাকি !  এবারেও হাসে সুরতিয়া । কোমরে হাত রেখে বোঝাতে শুরু করে--হামরাকে মাহাতো আছি দিদি । হামরাকে ছুয়া পানি নাই চলবে । উ যে খানা বনাবে দিদি, উ আসি পানি দিবে । হামরাকে অচ্ছুত আছি দিদি । কাল ঠাকুরবাবার পূজা আছে, সব অচ্ছুত হইয়ে যাবে।
ঠাকুরবাবা মানে চন্দনার বাবা। এখানে ওদের সকলে ঠাকুর বলে। পরিবারে এখন চন্দনার বাবাই সকলের বড়। ছোটকাকা বাদ দিয়ে বাকি কাকা, জ্যাঠারা চলে গেছেন। বাড়ির পুরোন মন্দিরের পাশেই আবার নতুন করে একটা মন্দির বানিয়েছেন চন্দনার বাবা । আগামীকাল তার প্রতিষ্ঠা উৎসব, চন্দনারও সেকাজেই এখানে আসা । বিরাট বড় পরিবার তাদের । আরো জ্যাঠা, কাকাদের কিছু ছেলেমেয়ে, বৌ রাও এসেছে এই উপলক্ষ্যে
মন্দিরের সিঁড়িতে গ্রামের আরো কয়েকজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন ঠাকুরবাবা, মানে চন্দনার বাবা। চন্দনা সেখানে গিয়েই হাজির -কুয়ো থেকে কে জল তুলে দেবে, বাবা ? কোন লোক কি পাওয়া যাবে ?
বাবা একবার এদিক, ওদিক তাকিয়ে দেখে বলে উঠলেন--কেন, ওই সুরতিয়াকে বল মা, ওই বাথরুমের বালতিগুলো কুয়ো থেকে জল এনে ভরে দিক।‘  গ্রামের যারা কথা বলছিলেন বাবার সঙ্গে, একজন বলে উঠলেন--আরে, ও তো মাহাতো...জল তোলার কি অন্য লোক পাওয়া যাবে না চন্দনার দিকে একবার তাকিয়ে বাবা বলে উঠলেন--আবার কে কাকে খোঁজ করতে যাবে, দরকার কি! ওকেই বল মা, জলটা তুলে দিয়ে বাড়ি যাক । কিন্তু তুমি তাড়াতাড়ি এস, এখনও কত কাজ বাকি... এত দেরি করলে চলে !
মুখে হাসি ফিরে এল চন্দনার। ভয় পেয়েছিল সে। এতদিন পর গ্রামে ফিরে এসে বাবা-মাও আবার ওদের মতই হয়ে যাবেন না তো ! যদি সুরতিয়াকে জল আনতে না দেন ! মন্দিরের সিঁড়ি থেকেই হাঁক দিল চন্দনা--সুরতিয়া, যাও, পানি লেকে আও। দের না করিও...
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সুরতিয়া । একবার চন্দনার দিকে, একবার ঠাকুরবাবার দিকে, আর একবার গ্রামের লোকগুলির দিকে তাকায় সে । তারপর ধীরে ধীরে কুয়োতলার দিকে এগোয়। ওর পিছু পিছু গিয়ে সুরতিয়ার হাত ধরে চন্দনা--পুরা কলকাত্তাইয়া, না ! লেকিন দিল তো ওহি না...তুমরাকে লিয়ে’ ! চোখে একটা ঝিলিক তুলে মাথার ঘোমটা টা আর একটু টেনে দেয় সুরতিয়া