গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১ জুন, ২০১৩

শৌনক দত্ত তনু

যদি তারে নাই চিনি গো... ( শেষাংশ )

[ আগের সংখ্যায় যেটুকু পড়েছেন - সামায়নের সঙ্গে বিদিতার আলাপ আর তা থেকেই ঘণিষ্ঠতা । কিন্তু বিদিতাকে কোনদিন সাক্ষাতে দেখেনি সামায়ন । ট্রেন যাত্রায় সামায়নের সঙ্গে বিদিতারও যাবার কথা ছিল , কিন্তু সে জানিয়েছে যেতে পারবেনা, টিকিট বাতিল করেছে । ট্রেনের সেই সিটএর সহযাত্রীনির সঙ্গে আলাপ হয় । সারা রাত জেগে গল্প করে দুজনে , খাবার ভাগ করে খেতে চায় । সামায়নের ভালোমন্দের খর নেয় সে, উদ্বিগ্ন হয় তার অসুস্থতায়  সামায়ন উপভোগ করে কিন্তু সহযাত্রিনীর নামটা এখনো জানা হয়ে ওঠেনি । সহযাত্রীনি কি এক রহস্যের জালে মুড়ে রাখে নিজেকে আর মেপে নিতে থাকে সামায়নকে । ট্রেন থামলে মাঝরাতে প্ল্যাটফর্মের খাবারের দোকানে ঢোকে দুজনে । এর পর ......

 পনার খুব খিদে পেয়েছে তাইনা’ ? মুখ ভর্তি মিষ্টি তাই মাথা নেড়ে সন্মতি জানালাম সহযাত্রী হাসতে হাসতে ট্রেনে দিকে এগলো । কফি খাবেন? ঘাড় ফিরিয়ে একপলক তাকালো সহযাত্রী 'হ্যাঁ খাবো' বলে ট্রেনে উঠে গেলো কফি শপে বেশ জটলা। কফির অর্ডার দিয়ে ফেসবুকে ঢুকলাম অপ্রত্যাশিত ভাবে বিদিতার মেসেজ 'কি করছো ? নেটে আছো? উত্তর দিয়ে কেক আর বিস্কুট কিনলাম কফির ভিড় কিছুটা কমে এসেছে রাতের স্টেশনে একটা মায়াময়তা আছে,অনেকটা জীবনের চল্লিশোর্ধ সময়ের মতো আজই প্রথম মনে হলো বিদিতার উত্তর এসেছে 'বেশ তো মাঝরাতে অচেনা স্টেশনে নেমে অজানা সঙ্গীর সাথে মিষ্টি খাচ্ছো, তার জন্য কফি নিতে দাঁড়িয়েছো আমি না এসে তো তোমার ভালোই করলাম তাই না?' মেসেজটা পড়ে খারাপ লাগলো। বিদিতা কেন এমন ভাবছে ! বিদিতা এলে তো আর সহযাত্রী সুযোগ পেতো না কফি,কেক,বিস্কুট নিয়ে কামরার দিকে আসতে আসতে মনে হলো, বিদিতার কেকের কথা বিদিতা যেদিন কেক বানালো সেদিন বিদিতা বলেছিলো 'তুমি কোনদিন এলে তোমাকে বানিয়ে খাওয়াবো '
- এত কেক বিস্কুট কেন ?
- রাতে লাগবে না?
- এখনো বুঝি খিদে মিটেনি ?
- না, খিদে নেই। এমনি আনলাম। আসলে রাত জাগলে আমার খুব খেতে ইচ্ছে করে।
- প্লেন  কেক কেন? চকলেট..
- কেন আপনার বুঝি চকলেট কেক প্রিয় ?
- না, মানে এমনি বলছিলাম।
বিদিতার কথা আবার মনে পড়লো আমার চকলেট কেক প্রিয় বলে ও বলেছিলো 'তুমি এলেই চকলেট কেক বানাবো আমরা দুজন ছাড়া কামরার সবাই ঘুমে কফির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বাইরে তাকালাম জানলার বাইরে অন্ধকার ঝুলে আছে ট্রেনের গতির সাথে ছুটছে অন্ধকার কখনো কখনো দূরের বিক্ষিপ্ত আলোর ঝলকানী এভাবে বসে থেকে বুঝি রাত কাটবো? সহযাত্রীর কথা শুনে বাইরে থেকে চোখ ফেরালাম
 - না,তা কেন ? আমরা গল্প করবো।
- গল্প করবেন তো চুপ করে বাইরে তাকিয়ে আছেন যে ?
আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি এখনো প্রশ্নটা শুনেই একগাল হাসলো সহযাত্রী। আমি জেন্টস ফাস্ট এ বিশ্বাসী’ ! সহযাত্রীর বলার ভঙ্গি আমাকেও হাসালো
- আমার নাম সামায়ন আপনার ?
- আগে আপনার ইন্টারভিউ নেবো পরে আমার সব বলবো কি করেন আপনি ?
- শব্দ নিয়ে খেলি
- তারমানে ?
- এই টুকটাক লেখালেখি
- আপনি কি তবে সামায়ন দত্ত ?
- হুম।
- এ মা কিছুদিন আগেই আপনার একটা লেখা পড়েছিলাম আপনি বিদিতাকে চেনেন ? ও ই আপনার লেখা পড়তে দিয়েছিলো
- বিদিতা ! আপনি বিদিতাকে কিভাবে চেনেন ?
- আরে ও আমার ছোট্টবেলার বন্ধু সারাদিন শুধু আপনার লেখা কোট করে, জানেন !
- তাই বুঝি ! আর কি বলে ?
- ওর ব্যাগে কিছু থাকুক না থাকুক আপনার বই থাকবেই আপনারা খুব ভালো বন্ধু তাই না ?
এ প্রশ্নের উত্তরে আসলে কি বলা উচিত বুঝতে পারি না বিদিতাকে যে আমি আজো দেখিনি এটা কিংবা  বিদিতা দেখতে কেমন ? জানতে চাওয়া যায় ? সহযাত্রী কি কি বলে যাচ্ছে আমার কানে কিছুই ঢুকছে না বিদিতা কে দেখার আকুলতা মনের ভেতরে পাড় ভাঙছে - কি হলো উত্তর দিলেন না যে ঘোর ভেঙ্গে আমতা আমতা করে বললামহ্যাঁ
- আপনি তো ওকে আজো দেখননি,তাই না ?
- না কিন্তু আপনি.. একটু হেসে মুখের উপর ছলকে পড়া চুলকে বাঁহাতে আলতো করে সরিয়ে বললো 'বিদিতা আমাকে সব বলেছে অদেখা, অজানা মানুষটিকে কি করে ভালো বলুন তো ?'
- তা তো জানি না
- আপনি কি জানেন আজ আমার সাথে বিদিতার ও এই ট্রেনে আসার কথা ছিলে কিন্তু শেষ সময় একটা প্রবলেম হওয়ায় ও আসতে পারেনি ইস কি মিস যে ও করলো আচ্ছা,ও কি জানে আপনি এ ট্রেনে যাবেন ?
বিদিতা কি তবে নিজে না এসে তার বন্ধুকে পাঠিয়ে মেসেজ এ মজা নিচ্ছে এই সব কি তবে বিদিতার পরিকল্পিত ? বিদিতাকে কখনো এমন মনে হয়নি যতবার কথা হয়েছে মনে হয়েছে বিদিতা নিজেকে মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী, বিদিতা বয়সের চেয়ে অনেক বেশী যেন ফুরিয়ে গেছে পরিবারের বোঝা বইতে গিয়ে কোথায় যেন ফেলে গেছে নিজেকে সেই বিদিতা এমন পরিকল্পনা করতে পারে ? প্রশ্ন আর উত্তরে নিজের ভেতর লড়ছি সহযাত্রীটি কে কি বলি ?   অনেক ভেবে বললাম, ‘ না বিদিতা জানে না

বিদিতা কে মনে পড়লেই আমার আকাশের কথা মনে আসে আমার লেখালেখির অনেকটা জুড়ে বিদিতা কখনো মুখোমুখি হইনি আমরা তবু আমাদের বোঝা পড়াটা ঈর্ষনীয়। যদিও প্রথম দিকটায় আমার ভাবনা, আমার অনুভূতির সাথে বিদিতা তাল মেলাতে পারতো না ধীরে ধীরে সেই
দুরত্বও ঘুচে গেছে।একবার কি এক উত্সবে ওকে শাড়ি কিনতে বলেছিলাম প্রথমে কিনবে না জানালো
এখনো মনে আছে সেদিন আমার খুব রাগ হয়েছিলো আমি তখন ওকে বুঝাতে পারিনি ভার্চুয়াল পরিচয় কেবল ভার্চুয়াল নয় এতে প্রাণ দেবার দায়িত্ব নিজেদেরই নিতে হয় তবেই ভার্চুয়াল লাইফে রিয়ালিটির ছোঁয়া লাগে টান তৈরী হয় রাত এখন তিনটা আড্ডার ফাঁকে বিদিতার অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে সহযাত্রী হাসির রেশ রেখে উঠে গেলো বাথরুমের দিকে আমি ফেসবুকে ঢুকে মেসেজ করলাম বিদিতা কে, বিদিতা এখন নিঃশ্চয় গভীর ঘুমে কিংবা জেগে অপেক্ষা করছে ! কয়েকটা স্ট্যাটাস পড়তে পড়তেই বিদিতার উত্তর এলো। 'তোমার সহযাত্রী আমার বান্ধবী ! কি নাম তার ? আর সে যদি আমার বন্ধু হয়েও থাকে এত রাত জেগে তার সাথে কি এমন আড্ডা দিচ্ছো শুনি '
বিদিতার মেসেজ পড়ে মনে পড়লো সত্যিই তো এতক্ষণ আড্ডা দিচ্ছি নামটা তো বললো না আমাকে !
নাম জানাতে এত অনিহা কেন ? কথাটা ভাবতেই দেখি সহযাত্রীটি আলো অন্ধকার ঠেলে সিটের দিকে আসছে এই চায়ে গরম ! চা,চা,চা ফেরিওয়ালার আওয়াজে সহযাত্রীটি পেছনে মুখ ঘুরিয়ে দেখলো তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে জানতে চাইলো আমিও মাথা নেড়ে সন্মতি দিলাম চায়ের গ্লাস হাতে আমরা মুখোমুখি বসেছি হঠাত্ মনে হলো যদি সহযাত্রীর বদলে আজ এখানে বিদিতা থাকতো !
- কি হলো চুপ মেরে গেলেন যে! ঘুম পেয়েছে নাকি ?
- না
- তবে ?
- আপনি এখনো আপনার নামটা কিন্তু বলেননি
‘হঠাত্ নাম নিয়ে পড়েছেন কেন ? বিদিতা বুঝি জানতে চেয়েছে’ ! কথাটা বলেই হাসতে থাকে সহযাত্রী
আমার ভেতরে একটি অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে এভাবে জানতে চাওয়াটা বুঝি ঠিক হয়নি আলাপে আলাপে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে কামরাও জেগে উঠছে একটু একটু করে কেউ কেউ ব্যাগ গোছ গাছে ব্যস্ত। রাত ভেঙে ভোরের এই জেগে ওঠাটা আমি এর আগে কখনো দেখিনি সহযাত্রীটির চোখে মুখে রাত জাগার ক্লান্তি তবু কথা থেমে নেই আমাদের ভোরের আকাশে তাকিয়ে বিদিতার কথা মনে হলো এ জীবনে হয়ত আমাদের ভোর দেখা হবে না কোনদিন। ঘুম চোখে ক্লান্ত বিদিতাকে দেখা হবে না
‘সামায়ন’ ! সহযাত্রীটির ডাকে ঘোর কাটে আমার ফ্যালফ্যাল করে তাকাই সহযাত্রীটি হাসছে
-
সামনে নামতে হবে
- হুম। আপনার নামটা কিন্তু,...
একমুখ হাসি ছড়িয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে সহযাত্রীটি ঘাঁড় ফেরালো
- জানা কি খুব দরকার !
ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলাম সহযাত্রীটির কাছে সহযাত্রী চোখ নাচিয়ে একটু হেসে বললো তুমিই বলো দেখি আমার কি নাম ? শুনেছি সাহিত্যিকরা অনেক কিছু না বললেও জেনে যায় এই শাড়িটা দেখো তো চেনো কিনা বলে নেমে যায় সহযাত্রীটি
নিজের অজান্তে আমার ঠোঁট নড়ে ওঠে....’বিদিতা
                                     
                                     গল্পগুলি পড়তে হবে সূচীপত্রে ক্লিক করে