টেবিলকে টেবিলই বলতে হবে
মূল রচনা - পিটার
বিকসেল
বাংলায়ন – রহমান
হেনরী
[ পিটার বিকসেল সুইজারল্যান্ড জাত জার্মান লেখক । জন্ম –
মার্চ ১৯৩৫ ]
এক বৃদ্ধের
গল্প এটা, এমন এক মানুষ যে কিনা কথাই বলে না,
ক্লান্তিময় চেহারা, এতো ক্লান্ত যে
হাসতেও পারে না, এমনকি ক্রুদ্ধ হতেও ক্লান্তি লাগে
তার। সে থাকে ছোট্ট এক শহরে,
একটা রাস্তার শেষ মাথায় কিংবা বলতে গেলে, অনেকগুলো
রাস্তার মিলনমোড়ে। সত্যি, বর্ণনাযোগ্য তেমন
কিছুই নেই যা অন্যদের থেকে তাকে আলাদাভাবে চিত্রিত করতে পারে। একটা ধূসর হ্যাট,
ট্রাউজার এবং ধুসর বর্ণেরই কোট পরে থাকে। শীত এলে বড় ঝুলের ধূসর কোট পড়ে,
ঘাড়টা সরু, এবং শুকিয়ে ওঠা চামড়া কোঁচকানো,
ঢিলেঢালা শাদা কলার । বাড়িটার ওপর তলায় তার ঘর,
হতে পারে, কখনও বিবাহিত ছিলো এবং ছেলেপুলেও।
হয়তো অন্য কোনও শহরে থাকতো তখন। নিশ্চয় সে নিজেও এক সময় শিশু ছিলো,
তবে সেটা এমন সময়ে যখন শিশুরাও বড়দের মত পোশাক পরতো। ওর নানীর ফটোঅ্যালবামে
তাকালেই যে কেউ সেটা দেখতে পাবে। ওর ঘরে দুটো চেয়ার, একটা
গালিচা, একটা বিছানা এবং একটা ওয়ার্ড্রোব
আছে । ছোট্ট একটা টেবিলের ওপর একটা অ্যালার্ম ঘড়ি,
তার পাশেই দেখতে পাবে কিছু পুরনো খবরের কাগজ এবং একটা ফটো অ্যালবাম,
দেয়ালে একটা আয়না এবং একটা বাঁধানো ছবি ।
রোজ সকাল-বিকেল
বৃদ্ধটি হাঁটতে বেরোতো, প্রতিবেশিদের
সাথে কথাবার্তা বলতো এবং সন্ধ্যায় বসে থাকতো চেয়ার-টেবিলে। এর কোনও ব্যতিক্রম ঘটতো না, এমনকি
রোববারেও একই রুটিন । আর যখনই সে তার টেবিলে এসে বসতো,
শুনতে পেতো ঘড়িটা টিক টিক করছে, ঘড়িটা
সারাক্ষণ টিক টিক করতো । তারপর একটা বিশেষ দিন এলো,
রৌদ্রোজ্জ্বল, নাতিশীতোষ্ণ,
কূজনমুখর, জনতা বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠলো,
শিশুরা মেতে উঠলো খেলাধূলায়__ এবং বিশেষ
ব্যাপার হলো, হঠাৎ বৃদ্ধটির ভালো লেগে গেল এইসব। ওর
মুখে হাসি ফুটলো ।
"এখন সবকিছুই
পাল্টে যাবে," ভাবলো,
লোকটা ।
বুকের বোতাম খুলে দিলো, হ্যাটটা
নিলো হাতে, কিছুটা দ্রুত হলো হাঁটার গতি,
হাঁটতে হাঁটতে তার মনে ফূর্তি লাগলো এবং নিজেকে মনে হলো সুখি। বাড়ির রাস্তাটায়
পৌঁছালো, শিশুদের দেখে মাথা ঝাঁকালো,
বাড়ির দিকে এগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লো, পকেট
হাতিয়ে বের করলো ঘরের চাবি এবং তালা খুলে ঢুকে পড়লো ঘরে । কিন্তু
ঘরে ঢুকেই দেখলো, সব কিছু তখনও আগের
মতই আছে: একটা টেবিল, দুটো
চেয়ার, একটা বিছানা। এবং যেই না সে টেবিলে
বসলো, শুনতে পেল ঘড়িটা টিক টিক করছে,
আর তার মন থেকে মুছে গেল আনন্দ, কেননা
কিছুই বদলায়নি ।
এবং লোকটা অগ্নিশর্মা হয়ে পড়লো । আয়নায় তাকাতেই দেখতে পেল, রাগে তার
চোখমুখ লাল হয়ে গেছে, দুহাতে মুঠো পাকালো
এবং ঘুঁষি মারতে লাগলো টেবিলে। একবার, দুবার,
তারপর হুংকার দিতে দিতে জেদির মত ঘুঁষাতে লাগলো । "কিছু না
কিছু বদলাতেই হবে।" এবং সে লক্ষ করলো, ঘড়িটা আর
টিকটিক করছে না। তখন তার হাত ব্যথা করতে লাগলো, ভেঙে গেল
গলার স্বর, আবারও ঘড়ির শব্দ শুনতে পেল সে এবং
বদলে গেল না কিছুই ।
"সবসময় সেই
একই টেবিল," লোকটা বলে উঠলো,
" সেই দুটো চেয়ার, সেই
বিছানা, সেই একই ছবি । আর আমি টেবিলকে টেবিল বলছি, ছবিকে ছবি
বলছি, বিছানাকে বিছানা এবং চেয়ারকে বলছি
চেয়ার। ফরাসিরা বিছানাকে লিত বলে, টেবিলকে
টেবিল বললেও, ছবিকে বলে তেবলিয়া এবং চেয়ারকে
চায়েস আর এভাবেই চালিয়ে যায় ওদের কথোপকথন। আবার চীনারাও ওদের নিজস্ব শব্দাবলি দিয়ে
নিজেদের মত কথা বলে । তা হলে কেন নয় ?
বিছানাকে ছবি বলা চলবে না কেন ?" এসব বলতে
বলতেই আবারও হাসি ফুটলো ওর চোখেমুখে, ঘর
কাঁপিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো লোকটা এবং ততক্ষণ হাসিটা চালিয়েই গেল,
যতক্ষণ না পাশের ঘর থেকে প্রতিবেশিরা দেয়ালে থাবা মেরে থামতে বললো তাকে ।
"এই বদলে
যাবে," বলে উঠলো সে,
এবং সেই মুহূর্ত থেকেই বিছানাকে ছবি বলে উল্লেখ করতে শুরু করলো । "ক্লান্ত
আমি, এখন ছবিতে যাচ্ছি,"
বৃদ্ধটি এই কথা বললো, এবং সকালে অনেকক্ষণ
ধরে ছবিতেই গড়াগড়ি করলো আর ভাবতে লাগলো চেয়ারটাকে কী বলে ডাকবে,
ওটাকে ঘড়ি বললো সে । বারবার সে তার এই নতুন ভাষাটি নিয়ে
স্বপ্নবিভোর হলো তারপর শৈশবের গানগুলোকে অনুবাদ করে ফেললো সদ্য-উদ্ভাবিত
ভাষায় এবং নিঃশব্দে নিজেকেই নিজে শোনাতে লাগলো ওইসব গান । উঠে পড়লো,
পরে নিলো পোশাক-আশাক, ঘড়িতে বসে
পড়লো এবং হাতদুটো এলিয়ে দিলো টেবিলে। কিন্তু টেবিলকে তখন আর টেবিল বলা হচ্ছে না,
বলা হচ্ছে গালিচা ।
অতএব ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই,
সকালবেলায় লোকটা ছবি থেকে উঠলো, গালিচার
সামনে ঘড়িতে বসলো এবং ভাবতে লাগলো অন্য সবকিছুকে কী বলে ডাকা যায় ।
সে তার বিছানাকে বললো ছবি,
টেবিলকে গালিচা,
চেয়ারটাকে ঘড়ি,
খবরের কাগজগুলোকে বিছানা,
আয়নাটাকে চেয়ার,
ঘড়িটাকে বললো ছবির অ্যালবাম,
ওয়ার্ড্রোবকে খবরের কাগজ,
ছবিটাকে টেবিল,
এবং ফটো-অ্যালবামকে আয়না
।
কাজেই:
সকালবেলায়
লোকটা অনেকক্ষণ শুয়ে থাকলো ছবিতে, ওর ফটো-অ্যালবামটা
সকাল ৯টায় অ্যালার্ম বাজালো,
লোকটা ছবি ছাড়লো এবং ওয়ার্ড্রোবের ওপর উঠে দাঁড়ালো,
ফলে নিথর হলো না তার পদযুগল । তারপর খবরের কাগজের
ভেতর থেকে পোশাকগুলো বের করে পরে নিলো সে,
দেয়ালের চেয়ারের মধ্যে নিজের মুখটা দেখে নিলো, গালিচায়
ঘড়ির ওপর বসলো, এবং যতক্ষণ না সে তার মায়ের টেবিলটা
খুঁজে পেলো, আয়নার পাতাগুলো ওল্টাতেই থাকলো ।
লোকটা এর মধ্যে মজা খুঁজে পেলো এবং মনে
রাখার জন্য সারাদিন ধরে চর্চা করতে লাগলো নতুন শব্দগুলো। প্রতিটি জিনিষকে
আলাদাভাবে ডাকা হবে, সে মানে পায়ের
পাতাগুলো এবং পায়ের পাতাগুলো সকালবেলা, আবার
সকালবেলাকে বলা হবে একটা লোক। এখন, এভাবে
তুমি নিজেও তোমার নিজের জন্য একটা গল্প বানিয়ে নিতে পারো। এবং সেটা এই লোকটার মত
করে, প্রতিটি শব্দকে বদলে নাও অন্যকোনও
শব্দের সাথে। ব্যস, তা হলেই হলো ।
বেজে ওঠা বলতে রাখা
থেমে থাকা মানে তাকানো
বসে বা শুয়ে তাকা মানে বেজে ওঠা
উঠে দাঁড়ানো বলতে থেমে থাকা
রাখা বলতে পৃষ্ঠা ওল্টানো
তা হলে কথাটা দাঁড়ালো:
লোকটায়
বৃদ্ধ সকালবেলাটি তার ছবিতে অনেকক্ষণ ধরে বাজলো, তার ফটো-অ্যালবাম ৯টায় রাখা হলো,
পায়ের পাতাদুটো থমকে দাঁড়ালো এবং ওয়ার্ড্রোবের পৃষ্ঠা ওল্টাতে লাগলো কাজেই সে
সকালগুলোর দিকে তাকাবে না ।
বৃদ্ধটি একটা নীলরঙের নোটবুক আনলো এবং তার
পাতায় পাতায় নতুন শব্দগুলো টুকে রাখতে লাগলো, এই বিপুল
কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় কদাচিৎ রাস্তায় তার দেখা মিলতো । এরপর প্রতিটি বস্তুর নতুন শব্দার্থ সে মুখস্ত করলো। তার কথা
ও চিন্তাজুড়ে স্ব-উদ্ভাবিত নতুন এক ভাষা জন্ম নিলো ।
খুব শিঘ্রী সেই ভাষা প্রচল ভাষায় বদলে নিতে তার সমস্যা হতে
লাগলো, কেননা,
পুরনো ভাষাটি প্রায় ভুলতে বসলো সে এবং পুরনো ভাষায় অনুবাদ করে নিতে হলে তাকে
ওই নীল নোটবুকের শব্দসম্ভার দেখে নিতে হতো । অন্য মানুষের সাথে
কথা বলতে গেলে বিব্রত হয়ে পড়তো সে । তাকে অনেক্ষণ ধরে ভেবে নিতে হতো মানুষ কোন জিনিষটাকে ঠিক
কোন শব্দ দিয়ে বুঝিয়ে থাকে ।
লোকেরা তার ছবিকে বলে বিছানা
গালিচাকে টেবিল
ঘড়িকে চেয়ার
বিছানাকে খবরের কাগজ
চেয়ারকে আয়না
ফটোঅ্যালবামকে ঘড়ি
খবরের কাগজকে ওয়ার্ড্রোব
ওয়ার্ড্রোবকে গালিচা
আয়নাকে ফটোঅ্যালবাম
এবং তার টেবিলকে ছবি
বলে অন্যেরা যখন পরস্পর কথা বলতো, হাসি পেতো
তার । তাকে
হাসতে হতো যখন সে কেউ একজনকে বলতে শুনতো,"আগামীকালের
ফুটবলম্যাচটা কি দেখবে তুমি ?" কিংবা
যখন কেউ বলতো, "দুই মাসব্যাপী বৃষ্টি হচ্ছে ।" অথবা কেউ যদি বলে,
" আমেরিকায় আমার এক কাকা আছেন।" তাকে হাসতেই হতো, কেননা,
এসব কথার বিন্দুবিসর্গও সে বুঝতে পারতো না ।
কিন্তু
এটা কোনও মজাদার গল্প বা রম্যকথা নয় । এই কাহিনী বিষাদের
জন্ম দিয়েছিলো এবং পৌঁছে গিয়েছিলো বিষাদময় পরিণতিতে।
ধূসর কোট পরা সেই বৃদ্ধ মানুষের আর কোনও কথাই বুঝতে পারতো না,
এটা খুব খারাপ হয়েছিলো শুধু তাই-ই নয়; ঘটনার চরম
অবনতি এই যে, লোকেরা কেউই আর তারও কোনও কথা বুঝতে
পারতো না ।
এবং সেই বৃদ্ধ লোক আর কোনদিন কথাই বলতে পারলো না । সারাক্ষণ নীরব
থাকতো, কথা বলতো নিজেরই সাথে,
এমনকি অন্য কাউকে অভিবাদন পর্যন্ত জানাতে পারতো না ।