গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৩০ জুন, ২০১৩

৫৪তম সংখ্যা ১লা জুলাই ২০১৩

এই সংখ্যায় পাঁচটি গল্প লিখেছেন সূর্যনাথ ভট্টাচার্য , ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, ফারহানা খানম, সৌনক দত্ত তনু ও ইন্দ্রানী সেনগুপ্ত ।

                                  সূচীপত্রে ক্লিক করে পড়ুন

সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

চিত্রচরিত্র


     পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে একটা চিঠি খুঁজে পেলাম চিঠির তারিখ বছর তিরিশেক আগের একরাশ পুরনো স্মৃতি মনের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো
     খড়গপুরে হোস্টেলে থাকাকালীন আমরা ক'জন বন্ধু মিলে এক পত্রমিতালি করেছিলাম। এখনকার ই-মেল, চ্যাটিংয়ের যুগে হয়তো আর কারুর মনে নেই, সে সময়ে অনেক সাময়িকীর পাতায় 'পত্রবন্ধু-বান্ধবী চাই' বলে একটা কলাম থাকতো নিজের ঠিকানা ও শখ জানিয়ে অনেকে সমমনের বন্ধু খুঁজতো সে বন্ধুত্বের গন্ডি যদিও সীমাবদ্ধ থাকতো চিঠি-পত্রের আদানপ্রদানে অন্তত প্রথমদিকে ক্রমশ লেখালিখির মাধ্যমেই দু'টো অপরিচিত মন চলে আসতো অনেক কাছাকাছি। এই অক্ষর-বন্ধুত্ব যদি ছেলে-মেয়ের মধ্যে হোতো, অনেক সময়েই তা সূচনা করতো রোমান্সের আর তা না হলেও ব্যাপারটায় যে বেশ একটা রোমান্টিকতা ছিল, তা অস্বীকার করা যায় না

     আমাদেরও এই রকম এক কমন পত্র-বান্ধবী হয়েছিল আমাদের সবার মনের কথা গুছিয়ে একজন লিখতো, অন্যপ্রান্তে চিঠির প্রাপক ভাবতো একজনই লিখছে কিন্তু আমরা সবাই পালা করে বান্ধবীর সাহচর্য অনুভব করতাম। বেশ মনে আছে, তার চিঠি এলেই আমাদের সামুহিক একাকিত্বের মধ্যে খুশীর বন্যা আসতো। প্রত্যেকের কাছে চিঠিটা রাখতে এক একটা রাত বরাদ্দ হোতো। সেই রাতগুলোয় বালিশ বুকে আঁকড়ে সবাই যে যার মত করে স্বপ্ন দেখতাম

     ধীরে ধীরে জানা গেল আমাদের বান্ধবী অষ্টাদশী, সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। কিন্তু তার মনে ছিল এক পরিণত নান্দনিকতা। বড় সুন্দর চিঠি লিখত সে আর মাঝে মাঝে কবিতা। একটা কবিতার খানিকটা এখনও মনে আছে -
যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি
   প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
   আঁধার রাতে, ভোরবেলাতে
   অলস মদির আঁখির পাতে
   স্বপ্ন তো কই ভাসে নি
যে টেলিফোন আসার কথা, আসেনি।...
আরও অনেকটা ছিল, সবটা আর আজ মনে নেই

     তা বেশ কিছুদিন চলল এই পত্রবিনিময়ের খেলা কয়েকটি অর্বাচীন হৃদয়ের বহু অবিবেচক অভিব্যক্তিতে ভরা থাকতো সে সব চিঠির পাতাগুলো। অপরপক্ষ থেকেও ছিল ছলনাভরা মধুর আস্কারা কিছুদিনের মধ্যে আর শুধু লেখায় মন ভরতো না আমরা তার একটা ছবি চেয়ে পাঠালাম সবাই যদিও জানতাম, চাওয়াই সার, কখনই তা আসবে না কিন্তু ফিরতি ডাকেই যখন তার ছবি এসে হাজির হল, আমরা কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে গেলাম এক ঢলঢলে কিশোরীর নবোদ্ভিন্ন যৌবনের ছবি আমার বেশ মনে আছে যে রাতে আমি তাকে পেয়েছিলাম, সারারাত ঘুম আসেনি। অনেকক্ষণ ধরে দেখেছিলাম তার তন্দ্রাহরণ চোখদু'টো, সে স্বপ্নভাসা চোখে ছিল পথভোলানো এক অতলান্ত গভীরতা দৃষ্টির বিলসিত লাস্যে ছিল অনাস্বাদিত কামনার আহ্বান।

     তারপর স্বাভাবিকভাবেই সেও আমা(দে)র একটা ছবি চেয়ে চিঠি দিয়েছিল এই সেই চিঠি তারিখ দেখে বুঝতে পারছি, আমাদের হোস্টেলবাসের মেয়াদ তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। কার ছবি পাঠানো হবে সে মীমাংসা আর হয় নি। আমরা নানাদিকে ছড়িয়ে গেলাম চিঠিখানা আমার কাছেই রয়ে গিয়েছিল পড়াশোনার শেষে চাকরি খোঁজার ফাঁকে চিঠিটার কথা কি করে বিস্মৃত হয়েছিলাম কে জানে আজ এতদিন পরে চিঠিটা দেখে মনে পড়ল, ছবি আর পাঠানো হয় নিমাঝ থেকে কোথা দিয়ে এতগুলো বছর কেটে গেল ?

     এখন কি পাঠিয়ে দেবো নাকি আমার একটা ছবি? আমার এই এখনকার ছবি ? ভাবনায় রোমাঞ্চিত হলাম। এখনো কি সে তার সেই ঠিকানায় থাকবে? থাকতেও তো পারে। বিয়ে? নানা কারণে আমার আর সে পথে যাওয়া হয় নি কিন্তু তার বিয়ে ? সেটাও কেন কে জানে মনে তেমন স্থান পেল না।

     কিন্তু আমার ছবি সম্বন্ধে আমি আবার কিছুটা রক্ষণশীল। ফটো তোলাতে বিশেষ উৎসাহ বোধ করি না তার কারণটা ঠিক বলে বলে বোঝাতে পারবো না আসলে আমার ছবি কখনো ভালো আসে না আমার মুখশ্রীতে আমাদের প্রাকবিবর্তন পূর্বপুরুষের সাদৃশ্য নিয়ে দুর্জনে কটাক্ষ করে থাকে। আমি অবশ্য সেসব কথায় কান দিই না আমি জানি, আমাকে বেশ ভালই দেখতে। ক্যামেরার চক্রান্তে রাগ হয় একটু আধটু ইয়ে...ওরকম সবারই থাকে। তাবলে সেগুলো অবিকল ফটোতে ফুটিয়ে তোলার কি দরকার রে বাবা ?  

     এই প্রসঙ্গে অনেকদিন আগের একটা কথা মনে এসে গেল বউদি স্থানীয়া এক সুন্দরী মহিলা একবার আমার একটা ফটো চেয়েছিল আহ্লাদে গলে গিয়ে 'আমার ফটো নিয়ে কি করবে, বউদি ?' জিজ্ঞেস করায় বউদি বলেছিল, 'ছোট ছেলেটা ভীষণ দুরন্ত হয়েছে, তাকে ভয় দেখাতে কাজে লাগবে '
বউদির কথায় খুব রাগ হয়েছিল মনে হয়েছিল তখুনি তাঁকে বলে দিই, দাদা তাঁর সম্বন্ধে কি বলেন দাদা পকেটে সবসময়ে বউদির একটা ফটো রাখতো। আমরা ঠাট্টা করায় বলেছিল, কি করবো ? যখনই কোন সমস্যায় পড়ি ওই ছবিটাই তো সাহস যোগায়। তার সামনে কোন সমস্যাই আর বড় মনে হয় না

এ কথা আর বউদিকে বলিনি অবশ্য তাঁর সুখের সংসারে ভাঙ্গন ধরিয়ে কি লাভ ? তা ছাড়া বৌদির কথা তেমন ধর্তব্যেরও নয়, কেননা যখনকার কথা তখন আমার মাথায় বড় বড় ঝাঁকড়া চুল ছিল বাচ্ছারা দেখলে ভয় পেতেই পারতো এখন আর বড়-ছোট কোন চুলই বিশেষ অবশিষ্ট নেই সামনের দাঁতদুটো একটু বেয়াড়ারকম উঁচু মুখে গোটাকয়েক দাগছোপ আছে আর চোখটা লক্ষ্মীট্যারা কিন্তু এইসব ছোটোখাটো ত্রুটি বাদ দিলে আমার মুখ বেশ ফটোজেনিক

     তবে পুরনো পত্রবান্ধবীকে ছবি পাঠাতে হলে কোনরকম রিস্ক নেওয়া উচিত হবে না বলেই মনে হল আমার চেহারায় সামান্য যা দোষত্রুটি, তা মেক-আপ করেই একটা ফটো তোলাবো ঠিক করলাম প্রথমেই চোখ দেখলাম এ বিষয়ে ডাক্তারের সাহায্য ছাড়া চলবে না। পাড়াতেই ছিলেন এক বড় আই-সার্জেন ভদ্রলোকের ঠোঁটকাটা বলে নাম ছিল, কিন্তু বাবার পরিচিত। তাই একদিন তাঁর বাড়ীতেই গিয়ে হাজির হলাম তাঁর এক পেশেন্ট তখন সেখানে উপস্থিত, ডাক্তারবাবুকে কি একটা গিফট দিচ্ছেন আমাকে দেখে মন্দিরদ্বারে ভক্তের গদগদ হাসি হেসে বললেন, 'একটু আধটু আঁকি-টাকি ডাক্তারবাবু এতো ভালো চোখের অপারেশন করেছেন, সেই খুসীতে একটা চোখের ছবি এঁকে ওনাকে উপহার দিতে এসেছি '

ডাক্তারবাবু মন দিয়ে ছবি দেখছিলেন বেশ খানিকক্ষণ পরে মুখ তুলে বললেন, 'হুঁ, মন্দ হয় নি তা গত বছর ডঃ লাল তোমার পাইলস অপারেশন করেছিলেন না ? তাকেও ছবি দিয়েছিলে নাকি হে ?'
কথার মানেটা ধরতে লোকটির একটু সময় লাগলো। তারপর একটু এদিক-ওদিক দেখে দেঁতো হাসি হেসে, 'হেঁ হেঁ, কি যে বলেন?' বলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়লো
অতঃপর ডাক্তারবাবু আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতেই কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়ে বলে ফেললাম, 'ইয়ে, মানে আমার এই চোখটাকে একটু ঠিক করা যায়, স্যার ?'

     তিনি চশমার ওপর দিয়ে আমাকে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ', ... তা যাবে না কেন ? অনেকটাই করা যায় এখন তো অনেকরকম স্কুইন্ট-কারেকশন বেরিয়েছে। চেম্বারে এসো, চেক করে নেবো খরচাটা হয়তো একটু বেশী...' বলে টাকার যে অঙ্কটা শোনালেন, তারপর 'ও আচ্ছা' বলে বেরিয়ে আসা ছাড়া আমার আর কোন পথ রইল না ডাক্তারবাবু মস্ত সার্জেন, কিন্তু বাবার পরিচিত বলে বিলকুল রেয়াৎ করলেন না
বুঝলাম এ রাস্তায় ঠিক সুবিধে হবে না। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে মনে এলো আমার এক বন্ধু সত্যজিতের কথা কলেজে আমরা তাকে 'মুদি' বলে ডাকতাম (কেন জানি না), সেও অম্লানবদনে সাড়া দিত। এখন একটা অ্যাডভার্টাইজ এজেন্সিতে বড় ফটোগ্রাফার হয়েছে তাকেই গিয়ে একদিন ধরে বললাম, 'এই আমার মুখটাকে একটু ঠিকঠাক করে একটা ফটো তুলে দিতে পারিস ?'
সে বিজ্ঞের মত বেশ খানিকক্ষণ ধরে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলো আমি তাড়াতাড়ি বললাম, 'সব ট্রিটমেন্ট করে ঠিক করতে কিন্তু অনেক খরচ।' বলে চোখের ডাক্তার যে খরচটা বলেছে, সেটা শুনিয়ে দিলাম 'বেশী বলেছে আরে, বলে কত কানা-খোঁড়াকে হৃতিক রোশন বানিয়ে ছাড়লাম, আর তুই তো তাদের কাছে রাজপুত্তুর ' আমাকে আশ্বস্ত করে নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগলো, 'দাঁতের সেটিং, গ্রাফটিং, ওয়্যাক্সিং, সান-গ্লাস, উইগ, ...হ্যাঁ, হাজার পনের লাগবে, তার বেশী নয় '

     আমি ফের চুপসে গেলাম অনেক আশা নিয়ে বন্ধুর কাছে এসেছিলাম। সেও আমার দুঃখ বুঝলো না আমার সাথে রাজপুত্রের সাদৃশ্যেও খুব খুশী হতে পারলাম না, শুকনো মুখে বলি, 'কি মাইরি, দু'চারশোর রেঞ্জে মুখের জিওগ্রাফিটা খানিক চাপা দেওয়া যায় না ?' আরও খানিকটা ভেবে সত্যজিৎ বললে, 'আছে আর একটা উপায় খুব সস্তায় হয়ে যাবে ফেরত পথে হাতিবাগান থেকে নিয়ে নিস একটা বোরখা।' একটা দার্শনিক হাসি দিয়ে আর কথা বাড়াবার অনীহা জানিয়ে দিল সে আমারও রাগে আর কথা বলতে প্রবৃত্তি হল না। বোরখা! শোন কথা ! ঠিক বুঝলাম, কলেজে ওকে মুদি বলার শোধ নিল

     বন্ধুর নির্দয় রসিকতায় ভেঙ্গে না পড়ে একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিলাম যা থাকে কপালে, আমার এই মুখশ্রীরই একখানা ছবি তুলে বান্ধবীকে পাঠিয়ে দেবো বলে ঠিক করলাম। একটা বোরখাপরা ছবি দেওয়ার চেয়ে অন্তত সেটা বেশী যুক্তিযুক্ত, তাই না  ? কেন এ দুর্মতি হল বলতে পারবো না তিরিশ বছরের পুরনো ঠিকানায় তার থাকার সম্ভাবনা প্রায় কিছুই ছিল না। কোনভাবে চিঠি তার কাছে পৌঁছলেও সে নিশ্চই তার ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত, পুরনো কথা মনে না পড়ারই কথা। কিন্তু ফটোখানা তাও পাঠিয়ে দিলাম সেই পুরনো ঠিকানায় সঙ্গে একটা কাগজে বেশ কিছু নস্টালজিয়ার সাথে সেই কবিতাটা উদ্ধৃত করে লিখলাম, 'সে টেলিফোন কি অবশেষে এলো ?'

     চিঠিটা পোষ্ট করার পরেই বুঝলাম ছেলেমানুষি করে ফেলেছি কিছুদিন এ নিয়ে মনে মনেই লজ্জিত হলাম। কিন্তু একটা অজানা প্রতীক্ষার অনুভূতি মনের কোনে দানা বেঁধেছিল। চিঠির উত্তর কি আসবে ? ক্রমশ অবশ্য তা ক্ষীণ হয়ে এলো। অবশেষে মাস খানেক পরে আর এ ব্যাপারে কিছু মনে রইল না
     ভুলে যেতে পারলেই বোধহয় ভালো ছিল কিন্তু তা হল না। দুমাস পরে একদিন অফিসে বসের কামরায় তলব পড়লো। যখন সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম, কারোর দিকে আর চোখ তুলে তাকাবার অবস্থা ছিল না। ঠিক মনে হচ্ছিল আমার অঙ্গের পরিধেয়টি বোধহয় চুরি হয়ে গেছে, নয়তো স্বচ্ছতা প্রাপ্ত হয়েছে এবং সবাই তাই দেখে বিস্তর মজা পাচ্ছে

     কিভাবে জানিনা, আমার চিঠি ও ফটো যথাস্থানেই পৌঁছেছিল এবং পত্রপ্রাপিকা এতদিনের ব্যবধানেও আমাদের পত্রমিতালি বিস্মৃত হন নি শুধু তাই নয়, তাঁর সব পুরনো কথা মনে আছে এবং সেসব গপ্পসহিত ফটোখানা তিনি তাঁর স্বামীকেও দেখিয়েছেন তাতেও ক্ষতি ছিল না, তিরিশ বছর তিনি অবিবাহিতা থাকবেন এমনটি না হওয়াই স্বাভাবিক কিন্তু তিনি যে কুচক্রী প্রজাপতির নির্বন্ধে আমারই বসের গলায় মালা দিয়ে বসে আছেন, ভাগ্যের এ পরিহাস আমার কল্পনার বাইরে ছিল!

     অমন সাধের চাকরিটা ছাড়তে হল আমার কমার্স ডিগ্রী চুলোয় দিয়ে এখন আমি হিমাচল প্রদেশে আপেল গাছের পরিচর্যা করি