গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩

গল্পগুচ্ছ ৫১তম সংখ্যা ১৮ই মে ২০১৩

এই সংখ্যায় ৩টি গল্প ও ২টি রম্য রচনা । লিখেছেন মৌ দাশগুপ্তা, শৌনক দত্ত তনু, রাণা আলম, দেবাশীষ কাঞ্জিলাল এবং শাইদুর রহমান মিলন ।

মৌ দাশগুপ্তা


আমি নদী



" কিছু কথা কাউকে বলা যায় না, শুধু বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াতে হয়..." ~ সমরেশ মজুমদার

আমি নদী, না না, আমি সেই স্কুল পড়ুয়াদের মত একটি নদীর আত্মকাহিনীলিখতে বসিনি সত্যিই আমি নদী রীতিমত ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি হাইটের শ্যামলী মানুষ,আরো ভালো করে বলতে গেলে, মেয়েমানুষ। নামটা রেখেছিলেন আমার বাবা। কেন যে রেখেছিলেন জানিনা। জিজ্ঞাসাও করিনি আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেরই নাম নদীর নামে, গঙ্গা,সরস্বতী,ইব,আমি কিন্তু শুধুই নদী। নাম নির্দিষ্ট থাকলে তো ধরনটাও নির্দিষ্ট হয়ে যাবে,তখন তো নিজের দামই কমে যাবে, তাই আমি শুধুই নদী।
রাঙামা বলতো নদীর নামে নাম হলে সে মেয়েরা ভারী দুঃখী হয়, চোখের জল শুকায় না। চোখের জল নদী হয়ে যায়। নিজেকে দেখিয়েই বলতো। রাঙামার নাম ছিল অলকানন্দা। জীবনটা সত্যিই বড় দুঃখের ছিল ওনার। তবে এখন থাক সে কথা। নিজের কথা বাদ দিয়ে রাঙামাকে নিয়ে পড়লে তো ধন ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়ে যাবে।এখন নিজের কথাই বলি। আমি দুঃখী কিনা জানি না। তবে আমার খুব কম মন খারাপ হয়। আসলে আমি না খুব সহজেই মন ভালো করে ফেলি, কিংবা হুটহাট কাঁদতে পারি, তাই বেশিক্ষণ মন খারাপ থাকে না। অল্প জিনিস চাই, তাই আমার ভেতরে অতৃপ্তি আসে না। কিছু না পেলে সেটাও মেনে নিই, ভেবে নিই সবাই তো সব কিছু পায় না। চলার পথে কিছু হারিয়ে গেলে ভেঙে পড়ি না ফিরে পেতে চাই, কিন্তু না পেলেও জীবনকে থমকে যেতে দিই না। ভালবাসি বেঁচে থাকতে।। ভালবাসি পথ চলতে, নদীর মত স্রোতস্বিনী হয়ে বেঁচে থাকতে। ভালবাসি কলকল সুরে কথাকলিটি হয়ে বয়ে যেতে, সোজা কথায় আমি আমার জীবন কে বড় ভালবাসিনে ।
নামের কারণেই কিনা, জল আমার খুব প্রিয়। আমার বাড়ী থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে বইছে এক ছোট্ট নদী তারও নাম আছে। রিক্তা। ঐ দূরের পাহাড়ী ঝোরা থেকে বেরিয়ে এসে এঁকেবেঁকে পশ্চিমবাংলার সীমান্ত পেরিয়ে বিহারের দিকে চলে গেছে। ওখানে আবার নাম বদলে হয়েছে পুনপুন বাড়ী থাকলে প্রতি ভোরে নিয়ম কর এসে বসি চৌধুরীবাড়ীর ভাঙ্গাঘাটে। দাঁত বার করা শ্যাওলা ধরা পৈঠায় বসে পা ডোবা জলে পায়ের পাতায় জলের আলতো নরম ঠান্ডা ছোঁয়া পেতে পেতে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউগুলোর দিকে তাকিয়ে মনেমনে তাদের সাথে হারিয়ে যেতে কি ভালোই না লাগে। চৌধুরীবাড়ীতে কেউ থাকেনা। পোড়ো বাড়ী জঙ্গলে ঢেকে গেছে। চারধার জনমানবহীন, শুনশান,খলি হাওয়ার ফিসফিসানি, জলের ছলা ছল, পাখীরডাক। গাছগুলো ঝুঁকে এসেছে নদীর ওপর,কানেকানে কিছু বলবে বলে।জলের ওপরেই খসে পড়ে শুকনো পাতা,ফুল।কিছুক্ষন মুক্তির আনন্দে ভেসে, তারপরই আক্ষেপহীন আনন্দে শুকিয়ে যায় ওরা। আমি দেখি, প্রতিক্ষণে আলোর সাথে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে জল।ক্রমশ আলো বাড়ে। জলের ভাষা বদলায়। জলেতে আলোতে তরঙ্গে মিলিত হয়ে ঝংকার ওঠে।নদীতে সুর তোলে ক্রমশ মত্ত হয় বাতাস, ঘন হয়ে আসে মেঘের ছায়া। ঘাটের পাশেই দেবতাবিহীন ভাঙ্গা মন্দির।দেবতা নেই কিন্তু ছোট লোহার ঘন্টাটা কেন জানিনা রয়ে গেছে । সামান্য বাতাসেই নীলাভ বাতাসের স্তর তরঙ্গিত করে শব্দ ওঠে, টং ... দূর থেকে রাখালাবাঁশীর মন কেমনকরা সুর ভেসে আসে। আমি নদী, আনমনে তাই শুনি।
শুনতে শুনতে মনে পড়ে আকাশের কথা। আকাশ আমার ছোটবেলার বন্ধু।খেলার সাথী আমাদের একসাথে পড়াশুনো, গ্রাম ছেড়ে শহরে পড়তে যাওয়া,সভ্য মুখোশপরা মানুষের মানবিক আচরণে ধাক্কা খাওয়া, প্রথম বাঁশবনের শেয়াল রাজার তকমা ছেড়ে বিফলতাকে খুব কটুভাবে আস্বাদ করা আমি রেগে যেতাম,চি কার করতম,কাঁদতাম,আবার আকাশের স্বান্তনায় সব ভুলেও যেতাম। আর আকাশ দু চোখে বিখ্যাত লেখক হবার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশনোর পাশাপাশি রাত জেগে নিজের অভিজ্ঞতাকে পূঁজি করে গল্প লিখতো,কবিতা লিখতো। তারপর বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতো, প্রকাশকের সন্ধানে ঘুরতো।কেউ হয়তো আশা দিতো,পিঠ চাপড়ানি কথা বলতো কিন্তু কেউ ছাপতো না। তাতেও দমতো না আমার বন্ধুটি। বলতো,
- “বুঝলি নদী,আমি জীবনের প্রতিটি যন্ত্রণা, প্রতিটি সুখের অনুভব টের পেতে চাই, টের পেতে চাই যে আমি বেঁচে আছি জীবন মানে কেবল একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকেই ছুটে চলা, এটা কেমন কথা হলো! কোথায় যাবো, কত দূরে যাবো কিছুই তো জানি না! পথ জানা নেই, সহযাত্রী চেনা নেই, আবহাওয়ার পূর্বাভাস নেই - সব অজানা! তবুও আমি জিতবোই, দেখিস,আমি জিতবোই ।
জিতেছিল কি ? মনে নেই আমার, শুধু মনে আছে মর্গে ওর বাস এক্সিডেন্টে ক্ষতবিক্ষত দেহটা যখন সনাক্ত করতে গেছিলাম, তখন ওর রক্তাক্ত মুখে হেরে যাওয়ার ছাপটাই প্রকট ছিলো, ওর এভাবে চলে যাওয়াটা আমার মনের আঙিনাটা অনেক বেশি শূন্য করে দিয়েছিলে ।যাবার আগে আমার চোখে চোখ রেখেছিলে কিনা জানিনা, কিছু বলতে চেয়েিল কিনা তাও জানিনা। নদী হয়েও শেষ সময়ে প্রিয়বন্ধুকে দিতে পারিনি শেষ জলটুকুও ,তারপরেও অনেক রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। । রাতে বসে বসে আকাশপানে চেয়ে থাকতাম । আজও সকাল সন্ধ্যা আকাশ জুড়ে আমার ভালোলাগারা মন্দলাগারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।
ভাবতে ভাবতেই নীল জলের বুক থেকে অবিকল ডানা মেলা পাখীর মতো ভোরের সূর্যটা পূর্ব আকাশে উঁকি দিলো রক্তলাল আলোর একটা ঝলক ঢেউ-এর চূড়ায় চূড়ায় মায়ামায় রঙের বাহার ছড়াতে ছড়াতে স্রোতের টানে টানে বেগে ছুটে যেতে থাকলো ভাঁটার দিকে। রঙে রঙে তখন একাকার হয়ে উঠলো রিক্তানদীর মুখ।যেন হাসির দমকে খুশীর ছটায় লাল হয়ে উঠলো এক ছটফটে হাসিখুশী কিশোরী সাগরও এইরকম হাসতো।অকারনে,কারনে কিংবা আমার গোমড়ামুখ দেখে আরো রাগিয়ে দিতে অথবা হয়তো আমায় হাসাতে। সাগরের কথা মনে হতেই আজও ওর আলিঙ্গনের সুখস্মৃতি মনে ভেসে ওঠে ,আর মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে । ওর কথা মনে হলে এখনও দুচোখ কানায়-কানায় ভরে ওঠে জলে সবার চোখের আড়ালে আলতো ছুঁলে, কি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটু হাতটা জড়িয়ে নিলে মেয়েদের মত লজ্জায় লাল হয়ে উঠতো কিন্তু মুখের লাজুক হাসি বুঝিয়ে দিত কতটা ভালোলাগা ছড়িয়ে যাচ্ছে ওর সারা দেহে, মনে। সাগরের ঠোটের এক চিলতে হাসির জন্য নিজেকেও ভুলে যেতে রাজী ছিলাম আমি। আমার খুব ইচ্ছে ছিল কোন একদিন একান্ত নিজের করে পাবো সাগরকে । সেই সাগরও কিন্তু কথা রাখেনি রাখতে পারেনি শৈশবে মাতৃহারা সাগর ওর রাশভারী বাবা আর খুব ভালোবাসার ঠাম্মার মনে কষ্ট দিয়ে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে আমার হাতটা ধরে রাখতে পারে নি।ওর বাবার পছন্দ করা মেয়েকে জীবনসঙ্গী করে বিদেশে গিয়ে হয়ত ভুলেই গেছে এই নদীর কথা। জানি, আর কোনদিন আমি সাগরকে দেখতে পাবো না। সেটা ভাবতে আমার যে ভাল লাগেনা,কিন্তু কি করি বলতো ?
সলিল একের পর এক ঢিল ছুঁড়েই যাচ্ছে রিক্তানদীর জলে । থামবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না ।
একের পর এক ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে এক সময় ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে লাগল । অত্যাধিক পরিশ্রমে ঘামে ভেজা পাঞ্জাবীটা গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে একদম । তারপর হাঁপাতে হাঁপাতেই কেমন এক হতাশ-উদাস দৃষ্টিতে শান্ত নদীর দিকে আনমনে চেয়ে রইল নদী আজ শান্ত, কোথাও ঢেউ নেই। আকাশটাও আজ বড় নীল। কোথাও মেঘ নেই । বিশাল আকাশের বুকে বিশাল শূন্যতা। শূন্যতা তো ওর মনেও। ও তো চাইলেই বলতে পারত- নদী আমি তোকে ভালবাসি । তোকে ছাড়া আমার চলবে না ।নদী কি ওর কথা শুনত ? বুঝতো ? নাকি স্রেফ হেসে উড়য়ে দিত? বন্ধুদের সাথে এই নিয়ে পরে হাসাহাসি করতো ?
নদী তো ওকে ভালবাসতোনা , ও তো সাগরকে ভালবাসতো আজ সাগর নেই তাও কি নদী সাগরকে ভুলতে পারবে? ওর জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারবে? সাগরকে দেওয়া কথার বাইরে যেতে পারবে? বোধহয় না। ভালই হয়েছে । কথাটা ওকে বলা হয়নি। ভাবতে ভাবতে সলিলের নির্বাক মন জুড়ে শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে- 'আমার নদী হারিয়ে যাচ্ছে , নদী আর আমার নেই ,” মনের আকাশে দুঃখের ঘনকালো মেঘ জমলে দুচোখ জুড়ে বৃষ্টি তো নামবেই
নদী সলিলের জীবনে এসে ওকে পুরোপুরি বদলেই দিয়েছিল । আজকের সলিল আর তখনকার সলিলের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক । একসময় সলিল ছিল অগোছালো, খাপছাড়া আর ভবঘুরে টাইপের ছেলে বাপের অঢেল পয়সা থকলেও ওর থাকা- খাওয়া- পোষাক- পরিচ্ছদ- চলা- ফেরা কোনকিছুরই কোন ঠিকঠিকানা ছিল না । বন্ধুবিহীন বোহেমিয়ান জীবনটা সলিল ভালই উপভোগ করত । খানিকটা মাদকাসক্তির প্রভাবেই হয়তো বেশির ভাগ সময়ই ও একা একা থাকত আর ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে গাদা গাদা কবিতা লিখত । এত কবিতা লেখার কারণে সবাই ওকে কবিতার পিপে বলে ডাকত । এভাবেই ওর একলার ভবঘুরে জীবনটা দিব্যি কাটছিল কিন্তু এই কবিতার সূত্রেই ওর প্রথম বন্ধুলাভ হল আকাশ ও ছিল আরেক কবিতা পাগল। দুজনের দেখা কলেজে,সেখানে বন্ধুত্ব। আকাশের হঠা ই ওভাবে চলে যাওয়াটা আজও মন থেকে মনে নিতে পারে নি সলিল । সেই আকাশের সূত্র ধরেই এসেছিল নদী আকাশের ছোটবেলার বান্ধবী, এই নদী এসেই ওর জীবনের বাঁকটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল । ভালইতো ছিল সলিল । হঠা করে কি থেকে কি হয়ে গেল তা ও নিজেই জানে না। মনে মনে নদীকে নিয়ে কত আকাশকুসুম স্বপ্নই যে বুনে নিয়েছিল একন্তে তার হিসার বোধয় ওর মনও রাখে নি। রাখতে পারে নি।
নদীর সাথে সলিলের শেষ দেখা হয়েছিল দুবছর আগে, কলেজ রি-ইউনিয়নে, তখন ও সাগরের বাগদত্তা কথাটা জেনে নিজের ভেতরেই এক অদ্ভুদ ভাঙ্গন টের পেয়েছিল। নদীর ওপর ওর একতরফা টান থেকে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি সলিল। গোটা পৃথিবীটাই কেমন রঙহীন ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল ওর চোখের সামনে।আর পড়াশুনায় মন বসছিলো না। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ ভালো লাগছিল না। তাই নিজে থেকে সরে গেছিল নদীর জগত থেকে। এই কটা বছর নদীর থেকে দূরে থাকলেও নদীর চিন্তা থেকে মনকে দূরে রাখতে পারেনি তাই হয়তো চিরকালের মত বিদেশ পাড়ি দেবার আগে একবার নদীকে দূর থেকে শুধু একঝলক দেখার বাসনায় এতদূর ছুটে এসেছিল ও।দেখা হয়তো হয়ছে কিন্তু না দেখা হলেই বোধহয় বেশী ভালো হত। নদী আজ গতি ছন্দ হারিয়ে ফল্গুপ্রায়। নদীর ধারে দেখা হতে চোখে চোখ মিলতেও যেন সলিলকে চিনতেই পারেনি ওর মানসী। প্রস্তরীভূত বিষাদপ্রতিমার মত একমনে ঘাড় গুঁজে নিশ্চুপে বসে থেকেছে রিক্তার চোখে চোখ রেখে তারপর উঠে যান্ত্রিক পুতুলের গতিতে কোনদিকে না তাকিয়ে মাপা পদক্ষেপে মিলিয়ে গেছে সরু মোরামের রাস্তা ধরে।
কত সময় যে এভাবে কেটেছে কে জানে, কখন নদী এসে ওর পাশে এসে বসেছে তা ও খেয়ালই করে নি । চমকে তাকাতেই সুন্দর মুখে একটা ম্লান হাসি ছড়িয়ে নদী বললো, ‘-কিরে, কখন এলি ?
-এইতো । দুটি মাত্র কথা, তারপরেই বিষণ্ন দৃষ্টিতে রিক্তার জলে চেয়ে রইল নদী। সলিলও যেন হঠাত্‍ করে ভাষা হারিয়ে ফেলল । কত কথাই না ওর বলার ছিল। কত কথাই না বলবে ভেবে তৈরী হয়ে এসেছিল।

নদীর চোখের দিকে চেয়ে সলিল বুঝতে পারল নদী ভালো নেই। । কিন্তু জিজ্ঞেস করতেও কেন জানি ভয় করছে । কেন জানি শুনতে ইচ্ছে করছে না । উদাস দৃষ্টিতে সেও জলের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল । এভাবে অনেক্ষণ কেটে গেল । তারপর হঠাত্‍ করেই নীরবতা ভেঙ্গে নদী বলল , ভালো লাগছে না রে কিছু , বলেই বেশ বড় করে একটা র্দীঘশ্বাস ছাড়ল । নদীর সে র্দীঘশ্বাসটা যেন রিক্তার বুকে ঘুরপাক খেয়ে সলিলের বুকের ভেতরটায় ঢুকে কঠিন একটা ঘা মারল । চিনচিন একটা ব্যথা অনুভব করল ও।
-কেন ?
-সব কেন-র উত্তর থাকে না রে সলিল ।
-নদী! তোর কি মন খারাপ ?
-না তো , আচ্ছা একটা কথা বলবি , আমি যাদেরই ভলোবাসি তারাই আমায় একা ফেলে চলে যায় কেন ? কেন এত কষ্ট দেয় আময় ? এত চোখের জল ঝরায় কেন? আকাশ নেই, সাগর নেই এখন তো তুই আমার একটা মাত্র বন্ধু । তুই ও কি আমায় একা ফেলে চলে যাবি ? সেটা বলতেই এসেছিস বুঝি?
আমার কপালটাই এমন যে, যাকেই নিজের ভেবে চাই সেই আমার নাগাল ঠেলে সরে যায় বহুদূরে আর সে কষ্ট সহ্য করার সামর্থ্য আমার নেই রে সলিল। নিজে সাথে লড়তে লড়তে আমি হেরে বসে আছি অনেক আগেই তুই ফিরে যা. আর আসিস না
আর পারলো না সলিল। এতক্ষন ধরে জোর করে চেপে রাখ বাঁধভাঙ্গা চোখের জল ঝরঝর করে ওর গাল বেয়ে নেমে এল । নদীও চুপ করে ওর পাশে বসে রইল । ওর মুখে আর একটা কথাও বেরুল না
আস্তে আস্তে চোখ মুছে সলিল ওর হাতটা নদীর হাতের উপর রাখল । একটু হাসলো ওর চোখে চোখ রেখে। নদী সবলে হাতটা আঁকড়ে ধরল। কারো মুখেই আর কোন কথা নেই। প্রয়োজন ও তো নেই। কথায় বলে .যে পুরুষকে নারী ভালবাসে সে যদি তার দিকে তাকিয়ে হাসে এবং তার চোখের তারায় ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকায় - নারী তখন মোমের মত গলে যায়।নদী তো এখন সলিলের ছোঁয়ায় মোমের নদী হয়ে বইছে তপ্ত, উষ্ণ, স্রোতস্বিনী, লাবণ্যময়ী, জীবনের আনন্দে ভরপুর।



মানিক জোড়ের কিসসা...

রাণা আলম

তখন সবেমাত্র ইস্কুল মাস্টারির চাকরিতে ঢুকেছি। প্রথম দিন। নিজেই একটু জড়োসড়ো হয়ে আছি। একটা ক্লাস নিয়ে বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আচমকা,পায়ের কাছে একটি ছেলে প্রায় হামলে এসে পড়ে বলল সার,সার,আপনাগো বগল গলি পালিং গেলআমি হাঁ করে রইলাম। ছেলেটি আমার হতভম্ব ভাব দেখে তার পূর্ব উচ্চারিত বাক্যবাণটি আবার নিক্ষেপ করলো, “সার,সার,আপনাগো বগল গলি পালিং গেল
আমি এমনিতেই গন্ডমূর্খ, গুরুজনদের আশীর্বাদে কোনরকমে চাকরি পেয়েছি, তার উপর প্রথমেই যদি এ জাতীয় বিজাতীয় শাব্দিক হানাদারির মুখোমুখি হতে হয় তা কি অবস্থা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। তখন কার্যত আমি এক্কেবারে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছি আর অভিযোগকারী ছেলেটি আমাকে বোবাকালা অথবা মদন মিত্র ভেবে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে,এমন সময় পাশের সিনিয়র কলিগ দাদা এসে আমায় বোঝালো যে ওই পুণ্যশ্লোকটির সাধারণ বাংলায় অর্থ হল, ‘সার,আপনার বগলের তলা দিয়ে পালিয়ে গেল এখন কে পালিয়ে গেল, কেনই বা পালিয়ে গেল আর পালিয়ে গেলে আমাকেই কেন বিচলিত হতে হবে, এজাতীয় কূট প্রশ্নাদির জবাব পাওয়ার আগেই একটি হতাশাসূচক উক্তি করে ক্ষুদে প্রাণীটি বেপাত্তা হয়ে গেল। পরে জানা গেল, অভিযোগকারীর জনৈক সহপাঠী তাকে বিনা অনুমতিতে একটি জোরালো চাঁটি মেরে প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই নির্লজ্জের মতন দৌড়ে আমার পাশ দিয়ে পালিয়েছে। অভিযোগকারী তাকে ধরতে না পেরে আমার কাছে এসে তার অভিযোগটি জানিয়েছিল। কিন্তু,আমি সুনীতি আচার্য না হওয়ার দরুণ তার এই প্রচেষ্টা মাঠে মারা যায় এবং নিজেই দুষ্কৃতীর পিছু ধাওয়া করে। এটাই ছিল কিরণের সাথে আমার প্রথম আলাপ।
কিরণের জিগরি দোস্ত হল দেবরাজ মাঝি।প্রসঙ্গত,দেবরাজ আর কিরণ,দুজনেই আপাতত ক্লাস সেভেন,কিন্তু কি করে উঠলো তা আমার জানা নেই।কিরণ খুব কথা বলে,দেবরাজ চুপচাপ। দুজনে যাকে বলে হরিহর আত্মা। অথচ,স্কুলে একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ করতেই এদের সময় কেটে যায়। দেবরাজ আসলে মানসিকভাবে জড় বুদ্ধি সম্পন্ন। ওর শারীরিক বয়স হয়ত তেরো কিন্তু মনের বয়স ছয় সাতের বেশী নয়। কিরণ ছাড়া সহপাঠী কারুর সাথে ও মিশতে পারেনা।যেদিন কিরণ আসেনা,সেদিন বড় বড় চোখ নিয়ে হয় লাস্ট বেঞ্চে চুপ করে বসে থাকে নয়ত অফিসের পাশে ঘুরঘুর করে। কিরণ হচ্ছে ফিচেল, অতি দুষ্টু আর দেবরাজ অতি সরল , জেদী আর একগুঁয়ে
আমার ইস্কুলের ছেলে মেয়েদের নিজের একটা দেওয়াল পত্রিকা আছে,যার নাম রঙ মশাল’,ছেলে মেয়েরা নিজেদের আঁকা ছবি দিয়ে সেটা সাজায়।বছরে একটা দিন ওদের ছবি আঁকার জন্য বরাদ্দ।সেদিন স্কুলের চেহারাটাই অন্যরকম হয়। যাইহোক,গতবছর রঙ মশালএর দিন, সবাই খুব ব্যস্ত,কিরণ আমার কাছে এসে বলল সার, একডা কথা ছিল আমি জানতে চাইলাম ,‘কি ?’
কিরণ বলল’ ‘আমাকে একডা হাতি এঁকে দেন। আমি কখনো হাতি দেখিনি
আমি খানিক চুপ করে চেয়ে রইলাম। নিজের স্থূলতার জন্য নানা জায়গাতে উপহাসের পাত্র হতে হয় বটে, কিন্তু এই অজ পাড়া গাঁয়ে ক্লাস সিক্সের একটি গ্রামের ছেলে, আমার সাথে রসিকতা করছে, এমনটা বোধ হলনা শেষ অব্দি।
দেবরাজ অফিসে কিরণের বিরুদ্ধে নালিশ জানাচ্ছে সার,উ আমাকে দেখি খালি হাসছে,আমি অকে ফাটিং দিবো
কাউকে দেখে হাসাটা পেনাল কোডে কোন জাতীয় অপরাধ,তা মনে করতে না পেরে কিরণকে ডেকে পাঠালাম।জিজ্ঞেস করলাম হাসির কারণ।তা বাবু অম্লান বদনে জানালেন উ আমার বন্ধু সার। অর দিকে তাকিয়ে হাসবো লাতো কি আপনার দিকে তাকিয়ে হাসবো?’...অকাট্য যুক্তি,সন্দেহ কি?
আমার সহকর্মী,পলাশের খ্যাতি আছে ছাত্র পেটানোর।ফলে সবাই ওকে ডরায়।একদিন,স্কুল তখনও শুরু হয়,কিরণ আর দেবরাজ এসে জিজ্ঞেস করলো সার,পলাশ সার আসবে?’
আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম এই তো,আর একটু পরেই ঢুকে যাবে
কিরণ বলল আপনি আসতে মানা করেন
আমি বললাম কেন?’
নাছোড়বান্দা কিরণ আবার বলল আপনার ফোং আছে তো, ওটা দিয়ে মানা করেন
আমি বললাম আগে কারণ টা বল
কিরণ বলল কাল পড়া পারিনি বলে পলাশ সার পাছায় এমন চাপা চাপালছে যে সকাল থেকে হাগতে বসতে পারছিনা
প্রসঙ্গত, আমি চাকরি করি বীরভূম আর ঝাড়খন্ড ঘেঁষা একটি গ্রামে। এদের ভাষা অন্যরকম। ক্রিয়াপদ গুলো অদ্ভূত। যেমন সাধারণ বাক্য যদি এরকম হয় আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম এদের মুখে সেটি হবে আমি ঘুমিং গেলছিলামআর একটা ঘটনা,পলাশের কথা আগেই বলেছি। একটু রগচটা ছেলে।কিন্তু ভালো পড়ায়।একদিন ক্লাস সেভেনের ঘর থেকে ডাক পড়লো।গিয়ে দেখি পলাশ চুপ করে দাঁড়িয়ে আর সামনে দুই মানিকজোড়, কিরণ আর দেবরাজ। ঘটনাটা এইরকম,পড়া না পারায় পলাশ কয়েক ঘা দেওয়াতে দেবরাজ হুমকি দিয়েছে সার,বেশি বেশি করবেন তো আপনাকে ফাটিং দিবো
একদিন ক্লাসে মনীষীদের গল্প করছিলাম আর প্রত্যেক কে জীবনে কে কি হতে চায় তা জানতে চাইছিলাম।হয়ত প্রথমে দেখা গেল,কারুর সেই অর্থে কোন লক্ষ্য নেই,কিন্তু বড় মানুষদের গল্প শুনে সে অণুপ্রাণিত হয়ে নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। কিরণ কে ক্লাসের প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম কিরে,বড় হয়ে কি করবি?’বাবু উত্তর দিলেন মোষ চরাবোযাই হোক,পড়াশোনা করে চাকরি পেলে বা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কতজন কোন জায়গাতে গেছে তার উদাহরণ দিলাম।সকলেই বেশ অণুপ্রাণিত হল।আবার কিরণ কে জিজ্ঞেস করলাম কিরে,বড় হয়ে কি করবি? কিরণ উত্তর দিল চাকরি করে টাকা জমাবো আর তার পরে মোষ কিনে মোষ চরাবো
আর একটা ঘটনা দিয়ে এই মানিকজোড়ের কিসসা শেষ করবো; সদ্য স্কুলের স্পোর্টস শেষ হল। দেবরাজ ভালো দৌড়ায়খান তিনেক থার্ড প্রাইজ পেয়েছে।
প্রাইজ ডিস্ট্রিবিঊশনের একটু আগে। কিরণ আমার কছে এসে বলল সার, দেবরাজের পেরাইজ গুলান বদলে দেন
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন ?’
কিরণ বলল আপনারা সব একই পেরাইজ দিছেন দু একটা অন্য দিলে তবেই তো ভালো লাগবে।
আমি বাক্যহারা। বাংলায় যাকে বলে,স্পিচলেস।

কিরণ আর দেবরাজ, দুজনেই আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে এসেছে। দুবেলা ভাত খেতে পায় কি না সন্দেহ। এই প্রবল শীতেও পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নেই।
দারিদ্র ওদের মুখের হাসি কাড়তে পারেনি।
এই হিংসাদীর্ণ পৃথিবীটা এখনও কোথাও না কোথাও এখনও সুন্দর, ওদের জন্য।
তাই না ?



যদি তারে নাই চিনি গো...

শৌ ন ক দ ত্ত ত নু

যাত্রায় এমনটা ঘটবে ভাবিনি ট্রেনটা ছেড়ে দেবার পর সিটটা খুঁজে পেলাম টু সিটের একটা আমার,অন্যটা খালি। কামরাটাও প্রায় ফাঁকা। জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে গেছি। ঘুম যখন ভাঙলো কামরাটা তখন মুখোরিত। আমার সামনের সিটে একজন প্রায় সমবয়সী নারী। পরনে অফ হোয়াইট ঢাকাই জামদানী। বাঁহাতে গোল্ডেন চেইনের ঘড়ি। চোখে চশমা। পড়ার
নিমগ্নতা ভেঙ্গে আড় চোখে একপলক তাকালো যেন,তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে পড়ায় মন দিল
ট্রেনের গতি কিছুটা কমে এলো বাইরে গোধুলির কমলা আলোর মায়াময়তা। পাখিরা ডানায় ক্লান্তি মেখে ফিরছে ট্রেনের গতি কমতে কমতে একটি স্টেশনে এসে দাঁড়াল । জানালা দিয়ে প্ল্যাটফর্মের কফিশপটা দেখে কফির পিপাসা যেন জেগে ওঠলো। কফির কাপে একটা চুমুক দিতেই মনে হলো কেউ ডাকছে। পিছন ফিরে দেখি আমার সহযাত্রী ডাকছে দয়া করে এক কাপ কফি এনে দেবেন? বিশটাকার নোটটা বাড়িয়ে দিয়ে সহযাত্রীর অনুরোধ আমার কফির কাপটা সহযাত্রীর হাতে দিয়ে কফিশপে আসতেই গাড়িটা নড়ে উঠলো থাক, থাক চলে আসুন। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে কিছুটা কফি হাতে প্যান্টে ফেলে দৌড়ে এ কাপটা সহযাত্রীর হাতে দিয়ে ট্রেনে চাপলাম -খুব কষ্ট দিলাম আপনাকে তাই না?
-
আরে না কফিতে চুমুক দিয়ে, ঠোঁটে নিটোল হাসি ছড়িয়ে সহযাত্রী বইয়ের কালো অক্ষরে ডুবে যায় আর জানালায় সন্ধ্যা ঘিরে আসে।
আলো আঁধারীর খেলা দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে গেলো খাবারের অর্ডার নিতে এলো একটি ছেলে আমি কি অর্ডার দেবো ভাবছি তক্ষুনি সহযাত্রী বই থেকে মুখ তুলে বললোআমাদের কিছু লাগবে না। ডিনারের শেষে দুকাপ কফি দিতে পারবে কি? ক্যান্টিন কারের ছেলেটি মাথা নেড়ে পারবে জানিয়ে খাতায় অর্ডার লিখতে লিখতে এগিয়ে গেলে। সহযাত্রী আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো- ‘রুটি,পনিরের তরকারী আর বেগুন ভাজা আছে চলবে তো? আমি একটু বিব্রত, কি বলি বুঝতে পারছিনা। তবু ইতস্তত করে বললাম আমি তো অর্ডার দিচ্ছিলাম, আপনি..’. কথাটার রেশ টেনে সহযাত্রী, আপনি বিব্রত হবেন না। যা আছে তাতে দুজনের হয়ে যাবে। তা এখন খাবেন নাকি আরেকটু পরে?
-
পরে। আপনি পড়াটা শেষ করুন। - হুম। আপনি কি পড়ছেন? - নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে। আর আপনি?
-
অরণ্য পথিক। খুব পুরনো একটি জঙ্গল উপন্যাস - অরণ্য পথিক! চারুব্রত মুখোপাধ্যায়ের লেখা ?
-
ওমা,আপনার বুঝি পড়া ? - এই তো কদিন আগেই শেষ করেছি। - আপনি কি জানেন চারুব্রত বাবু ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র হলেও পেশায় ঠিকাদার ছিলেন? - তাই নাকি? - হুম। এই বইটি তিনি ওড়িশার মহানদীর সাতকোশিয়া খন্ডের কাঠের ঠিকাদারী করার সময় দেখা বনজঙ্গলের মানুষদের খুব কাছ থেকে দেখার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মুনশিয়ানা এবং রসবোধের সঙ্গে ভাষার মাধুর্যে লিখেছেন। জঙ্গলের ঠিকাদারের স্মৃতিচারণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এই লেখাটিতে অত্যন্ত উঁচুদরের সাহিত্যগুণের দেখা মেলে। এই উপন্যাসটির বেশ কিছু অংশ বিশেষ করে উপন্যাসের শেষটুকু উচ্চমানের সাহিত্য হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত।
- তাই বুঝি ?
- হ্যাঁ। তা আপনার বনজঙ্গল নিয়ে লেখা বুঝি খুব প্রিয় ?
- যা পাই তাই পড়ি,এই যা আর আপনার ?
- আপনার মতোই হাতে যা আসে তাই পড়ি। কখনো যদি সুন্দরবনের পটভূমিতে বনজঙ্গলের লেখা পড়তে চান তবে শিবশঙ্কর মিত্রের আর্জান সর্দার পড়ে দেখবেন আশা করি ভালো লাগবে কথা বলতে বলতে আমার সহযাত্রী হটপট বের করে ফেলেছে।ঠিক আছে মনে থাকবে। ফ্রেশ হয়ে আসুন,খেতে খেতে কথা বলি
বেসিনে হাত ধুতে ধুতে মনে হলো অচেনা, অজানা একজন নারী এভাবে অর্ডার বাতিল করে দিয়ে নিজের ডিনারের ভাগ দিচ্ছে এটা কতটা স্বাভাবিক ? এই সহযাত্রীটি কি আমার পূর্ব পরিচিত ?
তক্ষুনি মনে হলো আমরা এখনো কারো নাম তো জিজ্ঞাসা করিনি। ফেসবুকে এই ভ্রমণের একটা স্ট্যাটাস দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে নোটিফিকেশন গুলো দেখছি। সদ্য দেয়া স্ট্যাটাসে বিদিতা কমেন্টে লিখেছে ' সুন্দরী ? একজন অচেনা নারী একজন অপরিচিত সহযাত্রীর খাবার অর্ডার বাতিল করে নিজের খাবারের ভাগ দিচ্ছে খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার, বি কেয়ারফুল অজ্ঞান পার্টি হতে পারে। 'কমেন্টটা পড়ে
করে উঠলো। সিগারেটটা ফেলে হাত ধুয়ে সিটে এসে দেখি খাবার বন্টন শেষ করে সহযাত্রী বসে আছে।
- হাত ধুতে এত দেরি
- হুম। না, মানে একটু বমি হলো।
 - বমি !  কেন?
- মনে হয় এসিডিটি। সকাল থেকে কিছু  খাইনি তো।
- সে কি সকাল থেকে কিছু খাননি কেন ? আপনার কাছে ওষুধ আছে? - ওষুধ তো নেই।
- ঠিক আছে,আপনি অল্প একটু খান কিছু তারপর ওষুধ খেয়ে নিন। আমার কাছে ওষুধ আছে
-
ওষুধ। না,না আপনি ব্যস্ত হবেন না আমি সচারচর ওষুধ খাই না আপনি বরং খাবার খেয়ে        নিন।
-
খালি পেটে থাকলে শরীর আরো খারাপ করবে।
এই সিটে আজ বিদিতার থাকার কথা ছিলো বিদিতা থাকলে তো আজ আর এই খাবার ভয়ে অসুস্থতার অভিনয় করতে হতো না ভিতরে অজানা এক ভয় কাজ করছে বিদিতার কথা যদি ঠিক হয়, সহযাত্রীটি যদি সত্যিই অজ্ঞান পার্টির মেম্বার হয় !
বিদিতার সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকে প্রোফাইলে ও আমার ছবি দেখলেও আমি বিদিতাকে দেখিনি আজো তাই কথা ছিলো এই ভ্রমণে ও আমার সঙ্গী হবে।গতকাল সকাল পর্যন্ত তাই কথা ছিলো। দুপুরে ফোন করে জানালো বিশেষ এক কাজের জন্য ও টিকিট বাতিল করছে। পরে দেখা হবে। বিদিতার সাথে পরে কোথায় দেখা হবে জানিনা। আদৌ দেখা কি হবে? এত বছরের পরিচয়ে আজো আমরা সরাসরি কেউ কাউকে দেখিনি। পরিচয় কখন ভালোবাসায় গড়িয়ে গেছে আমরা জানতেও পারিনি কেউ কেউ বলে স্পর্শের মাঝে থেকেও যেখানে প্রেম ফিকে হয়ে যায় সেখানে এই অদেখা ভালোবাসা কতটুকু দাবী রাখে? আমরা জানি,আমাদের বিশ্বাস এবং আস্থায় অদেখা ভালোবাসা অকৃত্রিম। আমরা দুজন পারিবারিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে হয়ত একে অপরকে বেষ্টন করতে পারিনি কিন্তু মনের বন্ধনে আমরা স্পর্শের অধিক।
-
কফি খাবেন তো?
- হুম।
- শরীর খারাপ লাগছে নাকি ?
- না তো
- কয় চামচ চিনি দেবো ?
- দুই চামচ।
-
এত চিনি ! এই বয়সে
- পেটে আমার ইদুঁর দৌড়াচ্ছে
সহযাত্রী এক চামচ চিনি নাড়তে নাড়তে কফির মগ এগিয়ে দিলো সঙ্গে এক প্যাক মেরী বিস্কুট। ট্রেনের কামরা এখন অনেকটা নীরব হয়ে এসেছে বিক্ষিপ্ত কয়েকজন জেগে আড্ডা দিচ্ছে বাকী প্রায় সব সিটের যাত্রী লাইট অফ করে শুয়ে পড়েছে। - একটু উঠুন চাদর পেতে দেই। আপনি কি আপার বাথে শুবেন ?
 - আপনার বুঝি আপার বাথে সমস্যা আছে?
- তা নয়। আপনি যেটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন সেটাতেই থাকুন।
- আরেকটু পরে যাই ?
অরণ্য পথিক নিয়ে সহযাত্রী আর নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে নিয়ে আমি পড়তে বসে গেছি
কিছুক্ষণ পড়ার পর বই থেকে চোখ তুলে সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখি সহযাত্রী আমাকে অপলক দেখছে চোখে চোখ পড়তেই দুজনেই চোখ নামিয়ে নিলাম। সহযাত্রী একটু  লজ্জা পেলো মন হয় পরিস্থিতি হালকা করতে একটু হেসে বললাম
- আজকের রাতটা জেগে কাটালে কেমন হয় ?
- হুম,ভাল। কিন্তু আপনার তো শরীর খারাপ। রাত জাগলে যদি..
- কিচ্ছু হবে না। কিন্তু আপনার সমস্যা হবে না তো?
- না। কিন্তু জেগে করবেন কি? পড়বেন? - আরে না,গল্প করবো।
আসলে ঘুমাতে আমার একটু ভয় করছে যদি কফিতে কিংবা বিস্কুটে কিছু মিশিয়ে থাকে বিদিতা হয়ত ঘুমিয়ে গেছে। বিদিতাকে মেসেজ করেছিলাম তার উত্তর পাইনি এখনো। সহযাত্রী উঠে ওয়াশ রুমের দিকে গেলো বই বন্ধ করে বিদিতাকে আবার মেসেজ করলাম। মেসেজ করতেই উত্তর এলো ' কিছু খেয়ে নাও। রাত জাগবে কেন ? ভালই তো অভিনয় জানো! রাত অনেক হলো আমি শুতে গেলাম বিদিতার এই এক সমস্যা রাত হলেই কেন জানিনা এভয়েড করে শুয়ে পড়ে নিজেকে খুব ছোট মনে হয় তখন আমার রাত কি দুজন মানব মানবী কে দূর্বল করে দেয় ? নাকি রাতের অন্ধকারে মানুষ অদিম হয়ে উঠে বলে বিদিতার এই সচেতন সরে থাকা ? আজো তার উত্তর আমার অজানা     সহযাত্রী ফিরে এলো ট্রেনটা একটা স্টেশনে দাঁড়ালো বেশ বড় কোন জংশন স্টেশন হবে আলোর ঝলকানীতে রাত এখানে দিনের মতো উজ্জ্বল। পেটে ইদুঁর দৌঁড়াচ্ছে কি যে করি সহযাত্রীর কথায় ঘোর কাটলো ‘এখানে ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়াবে চলুন নামি’.. দুজনে নামলাম ঘড়ির কাটায় তখন বারটা অথচ সারাটা ট্রেন গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে ‘মিষ্টি খাই চলুন’ সহযাত্রীর কথায় খিদাটা আরো বেড়ে গেলো যেন প্ল্যাটফর্মের দোকানটায় ঢুকে টপাটপ কয়েকটা মিষ্টি খেলাম সহযাত্রী অপলক তাকিয়ে আমাকে দেখছে
               [শেষ অংশ পরবর্তী সংখ্যায় ]

সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে

দেবাশিস কাঞ্জিলাল      
          



হাঁপাতে হাঁপাতে অমলবাবু অফিসে এসেই ঢুকলেন আমার ঘরে । খুব কুন্ঠিতভাবে বললেন, আজও বড্ড দেরী হয়ে গেল স্যার, আসলে এতদিক সামলে আসতে হয়কিছুতেই পেরে উঠি না ! ঘর্মাক্ত ভদ্রলোককে দেখে মায়া হচ্ছিল, বসতে বললাম ।  কুন্ঠিত হয়ে বসলেন সামনের চেয়ারে ।
আমার জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,'আপনি আমাকে একটু বলুন তোসংসারের সব কাজ কি আপনি একাই করেন ?' 'না না, আমার স্ত্রীই তো সবদিক সামলান সংসারের, আমি শুধু সব বাইরের কাজ, বাজার-হাটছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, পড়ানো,এই সবগুলিই করি !  সংসারের সব ঝক্কি-ঝামেলা সবই আমার স্ত্রীই সামলান !'
'               হুঁ, শুনুন অমল বাবু,আপনাকে কয়েকটি কথা বলি !  মহিলারা সংসার সামলাবেন, ' এক স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা ! এ তো যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে, চলবেও !  শুধু সব সময়ে মনে রাখবেন, গৃহিনীরাই গৃহকে শোভিত করেন !  এ সংসার-রাজ্যে তাঁরা হলেন গৃহমন্ত্রী, স্বগৃহে-স্বরাট !  আর আমরা হলাম সেখানে বিদেশ ও প্রতিরক্ষা-মন্ত্রী ! আমাদের কাজ হলবাইরের সব জটিল ব্যাপারে ভালোভাবে নিজেদের অবহিত রেখে সম্ভাব্য প্রতিকূলতা থেকে গৃহিনীদের সচেতন করা !
যেমন ধরুন,আমাদের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সৌরভকে তাড়ানোর পেছনে কে কি চক্রান্ত করেছিল, জয়দের বাঙ্গালী না কি আসলে ওড়িয়া ছিলেন,চাঁদে জমির দাম কত, মঙ্গলে জলের আনবিক গঠন কি, সাহারা-মরুভূমিতে যে আবাসন প্রকল্প হবে  তাতে ফ্ল্যাট নিতে হলে সেই মরু-শ্রী লোকটিকে টাকা কোর্টের মাধ্যমে দিতে হবে কি না !
আর এই জন্য আমাদের গৃহিনীদের এইসব বড়ো ব্যাপারে বিব্রত না করে, এই সব বড়ো জটিল সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য নিজেরা মাথা ঘামিয়ে,তাঁদের সব ছোট্ট ছোট্ট কাজ গুলি করতে দিলেই যথেষ্ট !
তাই আপনি বাজার-হাট,ছেলে-পড়ানো,সহায়িকা না এলে ঘর মোছারান্না করা,আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ, এইসব অকিঞ্চিৎকর তুচ্ছ কাজ থেকে দূরে থাকবেন, দেখবেন আর সময়ের কোন অভাব হবে না ।
এই আমাকে দেখুন না, আমার স্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করেন।  সকাল ন'টার আগেই চলে যান, ভোর চারটেতে উঠে সংসারের সব কাজ সারেনআমাকে এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে ঢুকতেই দেননা !  তাঁর অফিস অভিমন্যুর ব্যুহের মত, প্রবেশের ঠিক আছে, কিন্তু নির্গমন অনিশ্চিত !  তবে মোটামুটি রাত ন'টার মধ্যেই ফেরেন সেখানে সব সামলে !
তবুও আমি সংসারের কোন ব্যাপারেই নাক গলাই না ! শুধুমাত্র তিনি যা বলেন তা'ই শুনে চলি । সকালে উঠে কাগজ পড়ে, চা খেয়ে , নাকে মুখে কোনমতে কিছু গুঁজে অফিসে চলে আসি।  তাই আমার কখনো দেরী হয় না ! আপনিও এই ভাবে চলুন, শান্তিতে থাকবেন !
আর ভালো কথা, মনে রাখবেন, নারীজাতি দেবীর অংশ, তাঁদের ক্ষমতা অসীম, তাঁদের স্থিতিস্থাপকতা আমাদের চিন্তার অতীত ।  তাই তাঁদের দেবীর মত সম্মান দিয়ে তাঁদের মাথায় করে রাখবেন, তাঁতে তাঁরাও খুসি,আপনিও নিশ্চিন্ত !  যাকে ম্যানেজমেন্টের ভাষায় বলে উইন-উইন সিচ্যুয়েসন ! মনে রাখবেন ,তাঁরা মানবাতীত শক্তি, সেখানে তাঁদের মাথায় করে রাখাই আমাদের একমাত্র কাজ ! আপনি সত্যজিত রায়ের 'দেবী' সিনেমাটি আরেকবার দেখলে আরো ভালো করে ব্যাপারটি বুঝবেন ।  সাধে কি আর সেই প্রাচীনযুগ থেকে মুনি-ঋষিরা বলে এসেছেন 'সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে' ! এ কথার অনেক গ্যূঢ়ার্থ আছে ! আচ্ছা এখন আসুন,আবার পরে কথা হবে !'
অমলবাবু আমার দিকে এক বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলেন !  মনে হয় তাঁর অপরাধ বোধের বিব্রততার মাত্রা একটু কমানো গেল !

আচ্ছা, সত্যি কি তা' কমানো গেল ? না কি আরো গুলিয়ে গেল ! কে জানে !

কালো পলিথিন !



শাইদুর রহমান মিলন



দিনটা আজ রোদেলা নয় ! গরম নেই, সুন্দর বাতাস, বসন্ত উড়ে এলো দেশ থেকে ? এসি বন্ধ করে জানালা খোলার এমন সুযোগ সহসা হয় না ! সুযোগ নিলাম, নন এসি বাতাস ঘরে নেয়ার !

শুয়ে গান শুনছি খোলা জানালায় চোখ, দৃষ্টি একটু দুরের ফ্লাট এর ছাদে ! কবুতরের জীবন দেখছি, কি নিশ্চিন্ত, দল বেঁধে নাচানাচি, উড়াউরি, পাখার পতপত, গলায় ওঁ ওঁ উমম উমম , হরেক শব্দ আনন্দের, বাঁচার, হিংসে হচ্ছিল সুখ দেখে !
ভালই লাগছিল দেখতে ! কিন্তু ... চুপ করে গেল সহসাই সব, হটাত করেই গণউড়াল এবং পলায়ন, একেবারে দৃষ্টির বাইরে !
কি হল ...কি হল ?
তাকিয়েই ছিলাম, কারণটা চোখে পড়ল এসময় ! একটা দুই স্কয়ার ফিট এর দুমড়ানো মুচড়ানো কালো রঙ এর পলিথিন উড়ে এসে পড়ল ওদের জীবনানন্দের পৃথিবীতে, সেই ছাদে ! সুখি বোকা কবুতর দল সেটাকে না চিনে ভয়ে খেলা ছেড়ে, মাঠ ছেড়ে পালিয়েছে !
আমরা মানুষরাও অমন করেই পালাই ?
জীবনের ভীতিগুলো দুমড়ানো মোচড়ানো কালো পলিথিন ?
তাকেই শিকারি বাজ ভেবে পালাই ? কবুতরের মতো ? জীবনের মাঠ ছেড়ে ? জীবনানন্দ ছেড়ে ?