গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২২ আগস্ট, ২০১২

৩৩ তম সংখ্যা - চারটি গল্প (১) অসমীয়া গল্প 'রাজনীতি না বোঝা মানুষ' অনুবাদ নন্দিতা ভট্টাচার্য (২) 'সখ' - সপ্তাশ্ব ভৌমিক (৩) 'একটি কবিতা ও তিনটি চরিত্র' - মৌ দাশগুপ্তা (৪) 'জাদুকর' - শিবলী শাহেদ


প্রতিবেশী সাহিত্য
রাজনীতি না বোঝা মানুষ 
মুল অসমীয়া গল্প পুরবী বরমুদৈ
বাংলা রূপান্তর নন্দিতা ভট্টাচার্য

অবশেষে সকলের মনে স্বস্তি এনে মালতির একটি বাচ্চা হল । বাচ্চাটি প্রসব হতে সময় ও নেয়নি বেশি । ছোট্ট একটি মানুষ । গোলাপি রংয়ের ছোট্টটি । জন্ম নিয়েই সে শ্বাস নিল ,কাঁদল ঠোঁট ফোলাল । বুকের ভেতর মাথাটি চেপে রাখার সময় হাঁস ফাঁস করল । আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে রাখা একরাশ কাপড়ের মাঝখান থেকে গোলাপি রং এর ছোট্ট মানুষটির মুখখানি উঁকি দিল। সুন্দর মুখ। ভালবাসার মুখ । তাকালেই দুঃখ, ক্লান্তি, বিষাদ,কষ্ট সব ভুলিয়ে দেয়ার এই নিষ্পাপ কোমল মুখখানি । ছেলেটা দেখতে কেমন হবে, সেটাই তখন আলোচ্য বিষয় । কেউ বলল একদম বাপের মত চেহারা , কেউ বলল মায়ের মত হবে ; দুজন বৃদ্ধা বললেন (বাচ্চাটির পিসি) , তাদের আর এক মৃত ভাইয়ের মুখের ছাপ দেখতে পেলেন । অনেকে অনেক কথা বললমালতী কিন্তু ছেলেটার মুখে দেখল এক মুঠো আগুন । সেই আগুনের আলোয় ওর পুড়ে যাওয়া ঘরদোর দেখল । হারিয়ে যাওয়া স্বামীকে দেখল । হারিয়ে যাওয়া হালের দুটো গরু , ছাগল, হাঁস মুরগী , পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া তাঁতে অর্ধেক বোনা লাল গামছা , শোয়ার ঘরের প্রশস্ত বিছানাটা , রান্না ঘরের ভাত রান্নার উনুন ,বাড়ির সামনের দিক , পেছনের দিক , ঠাকুর ঘরটা দেখতে পেল ।  ঐ সময় ওর শরীর খারাপ ছিল । শুধু শরীর নয় মনটাও ভীষণ খারাপ ছিল । বেঁচে থেকে কি হবে মরে গেলেই ভাল এরকমটাই মনে হত সব সময় । শাশুড়ি কিন্তু্ ওকে, কুকুরের বাচ্চাকে যেমন ওর মা সামলে রাখে তেমনি সামলে- সুমলে রেখেছিল । নিজের সমস্ত দুঃখ ভুলে ওকে সান্ত্বনা দিত , নিজে চিৎকার করে কেঁদে ওকে কান্না থামাতে বলত । ওর নিজের মা , দাদা-বাপ- ভাই কেউ নেই।

দূর সম্পর্কের এক মাসির বাড়িতে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে মানুষ সে। দুঃখ কাকে বলে , ও খুব ভাল জানে , কষ্টও সহ্য করতে পারে । কিন্তু শাশুড়ি ওকে বুকে টেনে , মায়ায় জড়িয়েছিল ; ও বুঝেছিল দুঃখে আশ্রয় দেয়া একটি বুক কতখানি ! ও বুঝেছিল দুঃখে আশ্রয় দেবার একটি বুক দরকার , চোখের জল ফেলবার জন্যে একটি বুক দরকার । চৌদ্দ দিনের দিন খবর পাওয়া গেল , ভদ্রেশ্বরের খোঁজ পাওয়া গেছে । একমাত্র সন্তান, শাশুড়ি আলুথালু পাগলের মত ছুটে গেলেন । দুজন তাকে চেপে ধরে রইল । ভদ্রেশ্বরেওর পরনের জামা ও মাথার গামছার একাংশ একটি কাপড়ের পোটলায় কোনরকম বেধে দাহ করা হল । কিসের জন্যে ? কার ক্ষমতার প্রদর্শন হল ? কার খপ্পরে পড়ে এমন হল ? রাজনীতি ও বোঝে না । শাশুড়িও বুঝতেন না ভদ্রেশ্বরও বুঝত না । এরা কি রাজনীতি বোঝে ? এরাও বোঝে না । আর ওরা ? চোখ বুজলেই ভয়ানক চিৎকার , আগুনের ধোঁয়ার মধ্যে মালতী ওদের মুখগুলো দেখতে পায় । যে আমার ঘর জ্বালিয়ে দিল , আমি যার ঘর জ্বালিয়ে দিলাম যার রক্তে আমরা হাত রাঙালাম এগুলো রাজনীতি বোঝার জন্যে ? না, না বোঝার জন্যে ? আগুণ চারিদিকে শুধু আগুন ! আগুণ জ্বলছে । বড়ঘর, রান্নাঘর, ভাড়ার ঘর , ঠাকুরঘর ,সব জায়গায় আগুণ । চোখ বন্ধ করলেই মালতী আগুণ দেখে কালি ঠাকুরের জিবের মত লক লক করছে । আর দেখে কিছু মুখ ডাকাতের মত কঠিন ; নিষ্ঠুর , দয়মায়াহীন জল্লাদের মত লকলকে আগুণের লাল শিখায় । ওদের মুখগুলো গনগন করছিল । আগু্নের আলোয় ওদের হাতে থাকা দা গুলো চক চক করছিল বর্শার ফলা ও কাস্তের আগাগুলো ঝলকে উঠছিল । ওগুলো যেন রক্ত পিপাসায় ব্যাকুল ।

ওরা নিষ্ঠুরভাবে মালতীদের বাড়ি ছাড়তে আদেশ দিল । সব মানুষ বিনা বাক্য ব্যয়ে বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় গিয়ে উঠল । তারপর আর কেউ দাঁড়িয়ে থাকে নি । পেছন ফিরে তাকায়নি , প্রাণের ভয়ে স্ত্রীলোকেরা মাঠ-ক্ষেত পেরিয়ে শুকনো মাটির ওপর দিয়ে উন্মাদের মত ছুটেছে । পুরুষ মানুষেরা কেউ কেউ লড়াই করেছে, কেউ কেউ মারা গেছে , কেউ কেউ পালিয়েছে । মালতী গর্ভবতী ছিল সেজন্যে জোরে হাঁটতে পারেনি ; ছুটতেও পারছিল না । শাশুড়ি ওর সঙ্গে সঙ্গে আসছিল । ওর গায়ে ভর দিয়ে মালতী কখন দ্রুত কখনও আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল । ওরা অনেক মানুষের সঙ্গে ছুটছিল । অনেক মানুষের সঙ্গে ও নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে দেখছিল, বাঁশ গাছের মাথায় আগুনের মাঝে ওর ঘর জ্বলছে ---জ্বলছে ওর স্বপ্ন জ্বলছে ওর সংসার ......পাকা রাস্তায় উঠেই ও বুঝতে পারল , আর পা চলছে না ; টলমল করছে শরীর । পেটের ভেতরে পাক খাচ্ছে কোন কিছু , আছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দিতে চাইছে ওকে । ব্যথা ব্যথা । ব্যথায় কাতর হল ও । অসহ্য ! পেট , কোমর , বুক একাকার করে ভেতর থেকে কি যেন একটা বেরিয়ে আসতে চাইছে । পাকা রাস্তার ওপরে ধপ করে বসে পড়ল ও । আশেপাশের লোকজন দাঁড়িয়ে গেল । তারাই ওকে ধরাধরি করে রাস্তার ধারে থাকা বাড়ি গুলোর একটিতে নিয়ে গেল । আর কিছুক্ষন পরেই মালতী বেশি কষ্ট , ভীষণ কষ্ট না পেয়েই তুলতুলে গোলাপি রঙ্গের একটি ছোট্ট মানুষের মা হল ! আমি একজন সাধারণ মানুষ । দোষে গুণে ভরা । ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র , দীন একজন গ্রামের স্ত্রীলোক পৃথিবীর অনেক কথাই আমি জানিনা , আমায় কেউ কিছু শেখায়ওনি, আর আমি কাকেই বা জিজ্ঞেস করব ? তবু আমাকে যদি কেউ বুঝিয়ে দিত,কেন এমন হল,কেন আমাকে আমার যথা সর্বস্ব দিয়ে দিতে হল । বুঝতেই পারিনি কিছু । তাহলে কি লাভ হল ? আমি সর্বশান্ত হওয়ায় বা সব হারানোতে কার লাভ হল ? মনে আছ-- খুব মনে আছে । মালতী ছাগলটাকে মাঠে আনতে যাওয়ায় উদ্যোগ করছিল । দুপুর থেকেই ওর শরীরটা খারাপ লাগছিল । তলপেটে ও কোমরে ব্যথা হচ্ছিল । ও খাবে, তাই শাশুড়ি তাড়াতাড়ি ভাত রাঁধছিলেন

বিকেলের আলো তখনও ধোঁয়া রঙ ধরেনি । ছাগলগুলোকে বাঁধতে বাঁধতে ও দেখল বাইরের বাশের গেটটি খুলে উড়ে এসে ঢুকছে বীরেন নার্জারির মা ।
--কি হল মা ? মালতী এগিয়ে গেল ।
--কি হল না ? তোর শাশুড়িকে বল । তুইও বেরিয়ে পড় পালিয়ে যা পালিয়ে যা এক্ষুনি । তোদের মেরে ফেলবে , ঘর জ্বালিয়ে দেবে --ওদিক থেকে আগুণ লাগানো শুরু হয়েছে । 
--কি হল ? কি হল? --শাকের গোছ হাতের মুঠোতেই রইল ! বাছা আর হল না । বেরিয়ে এলেন তাই ! কি হল বীরেনের মা ? বীরেন নার্জারীর মা ততক্ষনে সদর দরজা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে । ভদ্রেশ্বর তখন ছিল না । একটু পর এল ও । ভয় ও উত্তেজনা ও আতঙ্ক মিশ্রিত গলায় মাকে বলল  তোমরা যে যতটা পার জিনিসপত্র নিয়ে গ্রামের মানুষের সঙ্গে চলে যাও, আমি...... 
--
তুই কি ভাবে যাবি ? মা ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল ।

মাথায় গামছা বেধে বিশাল দা নিয়ে সে বেরিয়ে গেল । যাবার সময় আমি বেরোচ্ছি বলে চলে গেল । যাবার সময় মালতীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে বলল,সাবধানে থাকিস তুই, আমি যাচ্ছি’ ওর আমি যাচ্ছি’ কথাগুলো মালতীর বুকে বজ্রের মত আঘাত করল । এখনও ঐ কথাগুলো ওর বুকের মধ্যে শেলের মত বেধে ।আমি আসছি’  কি নিষ্ঠুর এই কথাগুলো ! কি কঠোর ! এভাবে মানুষ বিদায় নেয় ? আগে সাজপাড় করে । একটা প্রস্তুতি থাকে ! এভাবে বিদায় নিয়ে মানুষ কি যুদ্ধে যায় ? মানুষ মারতে যাওয়ার সময় এভাবে বিদায় নেয় ? ওর শেষের কথাগুলো আগুণের লকলকে শিখা , ধান পোড়ার গন্ধ , সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের চিৎকার , প্রাণভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে না পারা মানুষগুলোর অস্পষ্ট গোঙানি , গরু ছাগলের চিৎকার ও কোলাহল । ভদ্রেশ্বরকে পাওয়া গেল না । অনিরামের বাপ ছেলেকে জোড়ায় কাটল । হলির দাদা মারা গেল , সে কোনরকমে প্রাণ নিয়ে পালাল । বীরেন নার্জারীর বোন ভগ্নিপতিকে কেটে পাঁচ টুকরো করা হল । বসুমতারীর দুটো ছেলেও গেল । অনেকগুলো বড়ো-কছারী গ্রাম আগুণের মধ্যে দাহ হল । এভাবে প্রত্যেকটি খবরই মালতীর কানে এসে পৌছাল । প্রত্যেকটা মানুষের পরিচিত মুখগুলো ওর চোখের সামনে মিছিল করে গেল । সকলেই পরিচিত কেউ অচেনা নয় । হলির বড়ভাই মালতীকে কি সুন্দর করে তাঁতশাল সাজিয়ে দিয়েছিল । অনিরাম অর শাশুড়ির দিকের আত্মীয় । এলে চা জলপান না খেয়ে যেত না । আর রেনুর স্বামী ? বিয়ের মোটে দুমাস হয়েছিল । সেই বিয়েতে মালতীর সারা পরিবার কম খেটেছিল ? বীরেন নার্জারীর বোন রেনুমার সঙ্গে কম দুপুর কাটিয়েছে ? সঙ্গে থাকত কুচি কুচি করে কাটা কাঁচা আম , নুন , লঙ্কা । ওর স্বামী খুব ভাল ছিল । এলে বৌদি বলে ডেকে কথা বলত , ওর হাতের পান না খেয়ে যেত না । তাকে পর্যন্ত কেটে পাঁচ টুকরো করেছে ! আর বসুমতারীর ছেলে দুটোকে ? বেচারা মা কেমন আছে কে জানে ? তাঁতে বসলেই হল , মানুষটি ঠিক বেরিয়ে আসবেই । 

কেন এরকম শুরু হল ? মানুষগুলো একে অপরের শত্রু হয়ে গেল । জ্যাঠা , খুড়া , মা , দাদা , বাবা , ঠাকুমা বলে ডাকা মানুষগুলোর বিরুদ্ধে কি করে অস্ত্র ধরতে পারল ? রক্তে রাঙ্গা হাতগুলো মুছতে ওদের বুক ভেঙ্গে গেল নাআমি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একজন স্ত্রীলোক,  কিছুই বুঝি না । গহপুরের ওপাশে কি আছে আমি জানি না । আর গহপুরের ওপাশটাই যদি শেষ সীমা হয় তাহলেও আমার কিছু করবার নেই । মালতী নিজেকেই নিজে বলে । খবরের কাগজে আমাদের কথা কি সব লিখছে ! আমাদের কথা সারা পৃথিবী জানছে । ছবি ছাপিয়েছে । কি জানছে সারা বিশ্ব ? মানুষ কি জেনেছে ? কিভাবে আমরা একসঙ্গে থাকতাম , কি ভাবে আমরা একে ওপরের সুখে সুখী , দুঃখে দুঃখী হতাম ? আমি একজন সাধারণ মানুষ । তবুও আমি পৃথিবীর মানুষের কাছে হাতজোড় করে বলছি , আমাদের শান্তি দাও , যা হারিয়েছে হারিয়েছে । যা আছে তা নিয়ে আবার আমরা আগের মত স্বপ্ন দেখতে চাই । আমরা কারো শত্রু নই , কেউ আমাদের শত্রু নয় । আমরা কখন রক্ত চাইনি , রক্ত চাইতে পারিনা । তাহলে আমরা কাদের শত্রু ? আমাদের শত্রু কে ? কি ভাবে আমি আবার রেনুমার সামনে দাড়াব ? কিভাবে বলব ,আমি কি বলতে পারব ? কি রেনু তোমাদের মানুষগুলোই আমাদের মানুষ ! ভাবে বলবযে রেনু তোমার মানুষটিকে আমার মানুষটি কেটে ফালা ফালা করেছে ! আমি বলতে পারব না , পারব না ! ওরা কখনও আমাদের শত্রু ছিল না । আমরা কখনও ওদের শত্রু ছিলাম না । বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে মালতী শুয়ে থাকে কখনও ঝিমুনি আসে , কখনও আসে না । দৈনিক রেশনের চাল ডাল নিয়ে কিছু মানুষ তর্কাতর্কি করে । সর্বস্বান্ত মানুষগুলো একমুঠো চাল ডালের জন্য কি হাহাকার করছে ! মালতী চুপ করে থাকে । শাশুড়িও নিজের মন্দকপালকে দিনরাত অভিশাপ দিচ্ছে । বক বক করছে । বিরক্ত লাগছিল আমার । যত দিন যাচ্ছে বিরক্তি ও হতাশা ছেকে ধরছিল । এভাবে প্রত্যেকদিন মানুষের দয়ার ওপর নির্ভর করে দৈনিক রেশনের একমুঠো চালডালের জন্যে অপরের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকা যায় ? হে ভগবান, এভাবে আর কতদিন ? এভাবে লোকের হাতের দিকে আর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কতদিন ? একদিন কিন্তু স্বস্তি এল । শরনার্থী শিবিরে ত্থাকা মানুষগুলো কিন্তু ফেরত যাবে । মায়ের বুকের মত নরম , মায়ের কোলের মত কোমল নিজের ভিটেমাটিতে ফিরে যাওয়ার কথা মানুষের মুখে মুখে মৌমাছির মত গুন গুন করছে ভদ্রেশ্বর নেই । তাই ওদের ঘর পুরান ভিটেতে গায়ের কয়েকজন যুবক মিলে বানিয়ে দিল । দুজন বাস করার মত ছোট একটুখানি ঘর । ভদ্রেশ্বর ছাড়াই সে বাড়িতে ঢুকতে হবে । ভদ্রেশ্বর শূন্য একটি ঘরে ওকে হাঁটাচলা করতে হবে । সে না থাকা একটি শূন্য বিছানায় ওকে শুতে হবে । মালতীর বুকে একটি অবুঝ পাথর ! বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে আগে আগে শাশুড়ি । কয়েকদিন থেকেই মানুষটা কাঁদছে । চোখমুখ ফুলে গেছে । হাঁটাচলা শ্লথ । পেছন পেছন পোটলা পুটলি নিয়ে মালতী । ওর চোখ অন্ধ কেঁদে কেঁদে । কিন্তু ছোট থেকেই লাঞ্ছনা গঞ্জনা সয়ে সয়ে জীবনের কঠিন দিক,অন্ধকার দিকটির সঙ্গে ওর ভালই বোঝাপড়া ছিল । তাই সহ্য করার ক্ষমতা ওর অসীম । 

পুরো দেড় মাসের পর দুজন মানুষ ওদের সাতপুরুষের ভিটেমাটির কাছে এসে দাঁড়াল । এখনও সেখানে ছাইয়ের স্তুপ । বাড়ির চারদিক শূন্য । বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল । ওগুলোও নেই । উঠোনের সামনে একটি শিউলি ফুলের গাছ ছিল । গাছটি নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে ।উঠোনের একপাশে তুলসিতলাও অনাদৃত পড়ে আছে । বাচ্চাটাকে কোলে দিয়ে শাশুড়ি মাটিতে বসে পড়ল । --আপনার কি হল মা] ? মালতী শাশুড়ির কাছ ঘেসে এল । ঠিক তক্ষুনি মালতী দেখল দুটো দুটো বাড়ির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে বীরেন নার্জারীর মা ।
--তোরা এলি ? মানুষটার উদ্বেগ চোখেমুখে ! 
--হ্যা, বীরেনের মা । শাশুড়ি উত্তর দিলেন ।
তুই ঘরের ভেতর থিতু হয়ে বোস । ঘরের ভেতরটা আমি পরিষ্কার করে রেখেছি । বেড়াগুলো সবাই লেগে পড়ে ঠিক করে দেব । তোমরা ভেতরে যাও । কথার মধ্যে কোন ঘৃণা নেই , অসূয়া নেইদৃষ্টিতে কোন আগুণ নেই । মানুষটির দিকে তাকিয়ে মালতীর চোখে পড়ল ওর দিকে এগিয়ে আসছে আরও একজন মালতী ! নিজের মতই একইরকম সর্বস্বান্ত হওয়া যমজ আকৃতির আর একটি নিজেরই মুখ ।
--এলি বৌদি ?
--হ্যা , আসলাম । দুজন মালতী দুজনের দিকে এগিয়ে গেল । 
-- তোদের ছাগল দুটোকে খুঁজে এনে বেঁধে রেখেছি আমাদের বাড়িতে। তোমাদের কাল ছাগলটা বাচ্চাও দিয়েছে ।       
অবলীলাক্রমে মালতী আরও এগিয়ে গেল , দেখা গেল একজন রাজনীতি না বোঝা মানুষ আরও একজন রাজনীতি না বোঝা মানুষের বুকে ওর কচি বাচ্চা টাকে তুলে দিচ্ছে । আরও দেখা গেল দুজন রাজনীতি না বোঝা মানুষের বুক থেকে একই রকম দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল , আর একই সময়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল । 

সখ
সপ্তাশ্ব ভৌমিক

অধ্যাপক শুভ্রজিৎ রায় কলেজে ঢুকতে গিয়েও হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। আজ আর কলেজ করবেন না। নিজের ইচ্ছে মতো দিনটা কাটাবেন। একটু ভিন্নরকম না হলে আর পাঁচটা মানুষের সঙ্গে কি প্রভেদ থাকল? এই প্রভেদ রাখতে গিয়েই তার ছুটির ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। তবু তিনি কলেজ গেট থেকে ইউ টার্ন নিয়ে শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।। আজ আর কিছুতেই কলেজ নয়। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্টান্ডের সামনে এসে দাঁড়ালেন। উদ্দেশ্যহীনভাবে শিলিগুড়িগামী বাসে চেপে বসলেন।

জলপাইগুড়ি শহরের সীমানা পার হতেই বাস প্রচণ্ড গতিতে চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর কন্ডাক্টর এলেন। শিলিগুড়ির টিকিট কেটে অধ্যাপক রায় চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করলেন আজকের দিনটি কীভাবে এনজয় করবেন। হঠাৎ মনে হলো আজ কিছতেই চেনা ছকে চলবেন না। শিলিগুড়ির টিকিট কাটা হয়েছে তো কী হয়েছে? মাঝ পথে ফাটাপুকুরেই নেমে পড়বেন। সেখান থেকে রিকশা করে বেলাকোবা। বেলাকোবার চমচম নাকি খুব বিখ্যাত। ফাটাপুকুরে নামার পরই সমস্যা দেখা দিল। বেলাকোবা যাওয়ার একটা রিকশাও নেই।

কিছুদিন হল এ রুটে অটো চালু হয়েছে। তারপর থেকেই রিকশা চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। কিন্তু কাল রাতে কোনো মাতাল প্যাসেঞ্জার এক অটো ড্রাইভারকে মারধর করেছে। সে কারণে আজ অটো স্ট্রাইক। ফাটাপুকুর থেকে রাজগঞ্জে যাওয়ার কিছু রিকশা আছে, কিন্তু তারা কেউ বেলাকোবা যাবে না। অধ্যাপক রায় দ্বিগুণ ভাড়ার প্রলোভন দেখালেন। সম্ভবত গত রাতের গণ্ডগোলের কারণে কেউ বেলাকোবা যেতে রাজি নয়। এমন সময় এক প্রৌঢ় রিকশা চালক কাছে এসে বললেন, “ আপনি কি আনন্দ চন্দ্র কলেজে পড়ান”? অধ্যাপক রায় মাথা নাড়লেন। রিকশাচালক অতি বিনীতভাবে বললেন চলুন স্যার, আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি খুব ধীরে ধীরে রিকশা বেলাকবার দিকে এগোতে শুরু করল। দুপুরের প্রচণ্ড গরমে বয়স্ক চালকের যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে। ফাটাপুকুর থেকে বেলাকোবার দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। চলতে চলতে রিকশা চালকের সঙ্গে টুকটাক কথাও চলছে। প্রায় অর্ধেক পথ অতিক্রান্ত হওয়ার পর রিকশা চালক জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, বেলাকোবায় আজ আপনার হঠাৎ কী কাজ পড়ল’? অধ্যাপক রায় হাসতে হাসতে বললেন, ‘কোনো কাজ নেই। হঠাৎ মনে হল আজ অন্যভাবে জীবন কাটাব। কলেজে ঢুকতে গিয়েও বাসে চেপে বসলাম। তারপর বেলাকোবা গিয়ে চমচম খাওয়ার সখ হল

দুপুরের ভয়ানক গরমে ঘামতে ঘামতে প্রৌঢ় চালক একটি গাছের ছায়ায় রিকশা দাঁড় করালেন।তারপর মৃদু স্বরে বললেন, ‘জানেন স্যার, আমার মেয়ে আপনার কলেজে পড়ে। দু-বছর আগে ওকে ভর্তি করতে গিয়েই আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম। ঠিক চিনতে পেরেছি। আমার বাড়ি রাজগঞ্জ গ্রামের অনেক ভিতরে। রোজ দু-মাইল হেঁটে মেয়েকে কলেজ যেতে হয়। আজ কলেজে গিয়েও আপনার ক্লাস করতে পারবে না। আপনার সখ বলে কথা। এই গরমে আমারও এই গাছের ছায়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার সখ হয়েছে। আজকে তো রিকশা, অটো কিছুই পাবেন না। মাত্র তিন কিলোমিটার হাঁটলেই বেলাকোবা পৌঁছে যাবেন। তারপর সখ মিটিয়ে চমচম খান


একটি কবিতা ও তিনটি চরিত্র

মৌ দাশগুপ্তা

ব্যস্ত যান্ত্রিক মহানগর, ঠাট্টা করে যাকে বলে আনন্দ নগরী – ‘সিটি অফ জয়’, কল্লোলিনী কলকাতা। ঠাসাঠাসি মানুষের ভীড়, যন্ত্রদানবদের অকারণ তর্জন গর্জন, ম্রিয়মান সবুজকে অগ্রাহ্য করে মিশকালো ধোঁয়ার সবল আস্ফালন , রাতে সোডিয়াম লাইটের তীব্র নিয়নের  আলোয় ঝিকিয়ে ওঠে ধোঁয়াটে পিচঢালা পথ আকাশচুম্বী অট্টালিকার দাপটে নিরীহ আকাশ মুখ ঢাকে অপরিসীম লজ্জায়। তারাঘন রাত বুঝি পথ হারায় যান্ত্রিকতার অমোঘ বিমূর্ত  সময়ে। কারেন্ চলে গেলে এই শহরের সব বাতি নিভে যায়। আজ কিন্তু তবু  সেই কালো মহানগরীর বুকে অতন্দ্র প্রহরীর মত জেগে আছে এই শহরের একটি চিলেকোঠা। আর সেই চিলেকোঠার অন্ধকার অপরিসরে একলা দাঁড়িয়ে আছে বকুল, বকুল আহমেদ। সরকারী অফিসের কলমপেষা বড়বাবু। রাজ্যসরকারী আমলা। চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে তার ঘরের একমাত্র দক্ষিণমুখী জানালাটার পাশে। জানালার বাইরে চেয়ে দেখছে কালো গাছের সিলু্য়েটে থোকা থোকা  জোনাক পোকাদের অদম্য উড়ান, অন্ধকার ঘরে একাকী সিগারেটের কুন্ডলিত ধোয়ার ভীড়ে  সে খুঁজে নিচ্ছে তার জীবনে একান্ত দুঃখবিলাস।

চিলেকোঠার এক প্রান্তে পড়ে আছে কবি বকুলের বস্তাবন্দী কবিতার জীবন। অথবা বলা যায় বৃত্তে বন্দী কবিমনের স্বপ্নসুধা । হলিউডের আ্যাকশেন ছবির চিত্রনাটের মতো আজ সে প্রতিনিয়ত নিজেকে নিজে  বদলাচ্ছে বদলাচ্ছে  তার আমিত্বকে। সিগারেটের জ্বলন্ত ফুলকির সাথে এক এক করে পুড়ে যাচ্ছে তার অনুভবী কবিমনের সব রং। মনে হচ্ছে অনন্তকাল আলোর জন্য অপেক্ষার পর যেন আত্মপোলব্ধী হয়েছে যে এখন আমার আর কোন অপেক্ষা নেই” রোজকার শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনে আজ ঝড় উঠেছে, একলহমায় সে ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে ওর মনের শান্তি। বিছানার ওপর পড়ে থাকা বাংলা বিনোদন পত্রিকাটার কবিতার পাতাটা চুম্বকের মত টানছে ওকে, কবিতার নাম- অন্তহীন শৈশব

শৈশব ছিলো বড় অভিমানী,অল্পেই চোখে জল, 
কথা বলবো না আড়ি আড়ি আড়ি” 
সহজ দলবদল। 
কৈশোরে ছিল রূপসা নদী,বকুল,যূথীর গন্ধ, 
বুড়ো শিবতলা, তালপুকুর আর 
সুনিবিড় আনন্দ। পুতুলখেলার সঙ্গী ছিলো
সকালে কিম্বা রাতে, 
কোনদিন কোন বিভেদ বুঝিনি ধর্ম কিংবা জাতে। 
সাহসী কিশোর ছুঁয়েছিলো মন
সুগভীর অনুরাগে, 
নতুন চোখে, নতুন আলোয়, নতুন স্বপ্ন জাগে। 
বাস্তব বড় অচেনা জগত,হিসাব মেলানো দায়, 
যাই ভেবে রাখি এক ফুৎকারে হাওয়ায় উড়িয়ে নেয়। 
শেষ বিকালে হিসাবের ছলে যখন নিজেকে দেখি, 
হাতে রয়ে গেছে শুধু পেন্সিল, বাদবাকি সব ফাঁকি”

নাসিক শহরে আজ বৃষ্টি নেই। সন্ধ্যার গাঢ় আকাশে কোন তারাও নেই, বোধহয় দল বেঁধে কোথাও বেড়াতে গেছে ওরা।যেমন টানা চারদিন পরে বৃষ্টি থামায় হৈ হৈ করে শপিংয়ে বেরিয়ে গেছে ওর বউ সুধা, সাথে অবশ্য ছেলেমেয়ে দুটোও গেছে। মেজাজটা বিগড়ে থাকায় সঙ্গ দেয়নি আনন্দ। ওর মনের মতই চারপাশে কেমন যেন একটা থম ধরা ভাব । দোতলার পূবমুখী খোলামেলা ঘরটার সবকটা জানালা খুলে দিলেও হাওয়ার নামগন্ধ নেই। মাথার ওপরে ঘুরন্ত  কৃত্রিম হাওয়াটাও  এখ গোঁসাভরে থমকে আছে। ইলেকট্রিসিটি নেই। কদিন ধরেই এমন হচ্ছে,  রাত্তিরে মেঘ ডাকলেই ফুরুৎ হয়ে যায় সে। অনেকদিন পর আজ আনন্দ খুঁজে পেতে সেই পুরোনো হ্যারিকেনটা জ্বালালো আজ অন্ধকারে থাকতে মন চাইছে না। অথচ এমর্জেন্সী লাইটের ঝকঝকে আলোটাও বড় চোখে লাগছে আজ।  কেমন যেন নিজেকে অস্থির লাগছে। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে মন খারাপের কালো মেঘ। সাথেআচম্বিতেই ভীড় করেছে কত অজানা,   অস্থির, চিন্তা ধারা। সময়ের সাথে সাথে মানুষের মন বদলায়, আশে পাশে পুরানো কে ভুলিয়ে কত নতুন মুখ আসে, কিন্তু স্মৃতিগুলো বদলায় কিভাবে? স্মৃতির সরণি বেয়ে আজকের কৃতী বাস্তুবিদ আনন্দ দিনভর অহেতুক  নিজেকে খুঁজে ফিরেছে, সোনালী অতীতে, ধূসর বর্তমানে, কিন্তু কিছুতেই কিছু মেলাতে পারেনি।

নিজেকে বড় বেশি একা মনে হচ্ছে আজ। যেন কারো বা কাদের থাকার কথা ছিল ওর পাশে কিন্তু কেউ নেই। কেউ কথা রাখেনি। অভিমানে অনেকদিন পরে চোখ জলে ভরে যায়, নিজের কাছে নিজেকে লুকাতে মুখ তুলে তাকাতে গিয়ে দেয়ালে টাঙান একটা পেইন্টিং এর দিকে চোখ আটকে গেলো। পেইন্টিংটা কাঁচা হাতে আঁকা একটা ফটোগ্রাফের রেপ্লিকা, তবু আনন্দের মনে হয়  আশ্চর্য রকমের একটা দ্যুতি আছে। পেইন্টিং এর কিশোরী মেয়েটির কাপড়ের ভাঁজে, বাঁধা চুলে, আর মুখের হাসিতে অবিশ্বাস্য সজীবতা। ভীষণ চেনা অভিমানী ভ্রূ-ভঙ্গী।  যূথীর পড়ার ঘরের দেরজে রাখা ফ্যামলি অ্যালবাম থেকে  থেকে কৌশলে যূথীর মায়াবী মুখের ছবিটি লুকিয়ে এনেছি বকুল। যূথী জানতে পেরেছিল অনেক পরে। জেনে খুব  অভিমান করেছিল । কথা বল বন্ধ করে দিয়েছিল দুজনের সাথেই। কেন, তা আনন্দ জানে না ! তবে যূথীর ব্যবহারে নিজের ভুল বুঝে, রাগে - লজ্জায় অথবা কিছুটা নিজের ওপর ধিক্কারে, প্যান্টের পেছনের পকেটের ওয়ালেটের নিভৃত আশ্রয় থেকে ছবিটা বার করে অন্ধকারেই বুড়ো শিবতলার মাঠের খালধারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে গেছিল বকুল। চোরের মত চুপিসারে সে ছবি কুড়িয়ে নিয়েছিল আনন্দ। একটু পরেই ফেরত এসে পাগলের মত অন্ধকার মাঠ হাতড়াতে শুরু করেছিল বকুল,ছবিটা পকেটে রেখেও অজানা কুন্ঠায় আর বুকের ভেতর রক্ত ছলকানো গোপন আনন্দে সেটা বন্ধুকে ফেরত দিতে পারেনি আনন্দ। ছবিটা খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে কান্নায় বকুলের ভেঙ্গে পড়াটা আজও স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পায়। এতদিন সাফল্যের পিছনে ছুটতে ব্যস্ত যান্ত্রিক মনে অতীতের কোন ছায়াটুকু ছিল না। আজ একটা বাংলা ম্যাগজিনের এক ছোট্ট কবিতা ওর রোজকার ধরাবাঁধা জীবনটায় ঝড় তুলে দিয়েছে। 

 হ্যারিকেনের স্বল্প আলোতেই আবার অন্তহীন শৈশব কবিতাটা পড়তে আরম্ভ করে। আচমকাই সমুদ্র পাড়ের হু হু বাতাসের তীব্রতা বাড়ে । ফাজিল দমকা সামুদ্রিক হাওয়া সদ্য তরুণী জুনের গায়ের বাসন্তী ওড়নাটা উড়িয়ে নিয়ে কাছেই ঝাউগাছটার ডালে ঝুলিয়ে দেয়। কাছেই হোস্টেলের বন্ধুরা বিচভলি খেলছিল।  হইহই রবে তারা হাততালি দেয় । সোনিয়া সিটি দিয়ে ওঠে। রুমমেট অন্তরা খেলা ছেড়ে এসে ওড়নাটা হাতে দিয়ে যায়। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে । লক্ষ্য করে, এই পড়ন্ত বেলায় কমলা আকাশে চুপিসারে ভীড় জমাচ্ছে কালো মেঘ। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা লাগছে চোখেমুখে।দেখতে দেখতে ঝুপ করে কাঙ্ক্ষীত সন্ধ্যা নেমে আসে।নীল আরব সাগরের বুকে, সোনালী বালুতটে, পিচঢালা রাস্তায়, জনাকীর্ণ ঝুপড়িতে, ক্যাসুরিনা ঝাউয়ের পাতায়, সবুজ দূর্বার ডগায়।চুপ করে বসে নির্বিকার ঘোরগ্রস্থর মত পৃথিবীর বুক থেকে সূর্য্যের আলোর শেষরশ্মিটাকে মুছে যেতে দেখে সে। বন্ধুরা ডাকলেও তাদের সাথে পানপুরী- ভেলপুরীর দোকানের লাইনে দাঁড়াতে ইচ্ছা করেনা তার। জুনের রাগত মেজাজ দেখে বন্ধুরাও জোরজার করে না। নোনাবালিতে আধডোবা এক পাথরের ওপর পা ঝুলিয়ে অলস ভঙ্গিতে সে বসে থাকে । হঠাৎই একটি ঢেউ তার পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিয়ে যায় । তার হৃদয়ও ভিজে যায় । হৃদয় ভেজা এই অনুভূতির নাম তার অজানা । মাকে মনে করে সকাল থেকে নীরবে রক্ত ঝরছে তার সদ্য মা-হারা হৃদয়ে।এবার মায়ের শেষ কাজ সেরে হোস্টেল ফেরত আসার আগে মায়ের নিজস্ব আলমারীতে বিয়ের শাড়ীটার ভাঁজে যত্ন করে তুলে রাখা মায়ের ডায়েরীর পাতায় লেখা কবিতাগুলো তার চিরপরিচিত মাকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে জুনকে। তার থেকে একটা পাঠিয়েছিল নামকরা এক বাংলা ম্যাগাজিনের কবিতার পাতায়, আর ওকে হতবাক করে সম্পাদকের সম্মতিসূচক চিঠি আসার পর থেকেই ওর সাগ্রহে দিন গোনা শুরু হয়েছিল। আজ তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ছাপার অক্ষরে ম্যাগাজিনের কবিতার পাতায় মায়ের নামটা এক অদ্ভুদততৃপ্তি দিয়েছে ওকে। মায়ের কথা মনে পড়তেই আবার এক ভীষণ মন কেমন করা অনুভূতিতে দুচোখ জ্বালা করে জলে ভরে আসে । ঘাড় তুলে আকাশে ফুটে থাকা তারার ভীড়ে কি যেন খোঁজার চেষ্টা করে জুন।  ওর অজান্তেই দুগাল বেয়ে মুক্তোর দানার মতো অজস্র বৃষ্টি বিন্দু ঝরে ঝরে পড়ে । আর কান্নায় কাঁপতে থাকা ঠোঁটের আগল খুলে দিয়ে এক ধাক্কায় তখন একটা ভীষণ পরিচিত শব্দ ছিটকে বেরিয়ে আসে।
         - “মা”!

জাদুকর

 শিবলী শাহেদ
        
         ‘শুনুন ভাই , পুরো ব্যাপারটা এভাবে এক বৈঠকে বলা সম্ভব নয় । তাছাড়া আপনি তো জানেন গল্প বলার একটা পরিবেশও লাগে । এই মুহূর্তটি কোনোভাবেই গল্পের উপযোগী নয়’একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে একপলক সময়টা দেখে নিলেন কবি শেরিফ আরমান । বাইরে দু-একটা কাক খুব সাবলীল ভাবেই তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে । একটা অসহ্য নীরবতা পুরো পরিবেশটাকে ভারি করে তুলছে । এই নীরবতা কাটানোর জন্যই আমি আবার কথা বলা শুরু করলাম ।
-দেখুন , কাহিনীটা আমার জানা প্রয়োজন । তাছাড়া নিজেও একজন লেখক হওয়ায় কোনোভাবেই আপনার কাহিনীটি শোনার লোভ সামলাতে পারছিনা । 
- আপনি তো ভাই দেখি নাছোড়বান্দা । তা একগ্লাস পানি পেতে পারি ?
আমি তাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম । একটু সময় নিয়ে পুরো পানিটা শেষ করলেন তিনি ।
তারপর আর দেরি না করেই গল্প বলা শুরু করলেন...

        আমি ভাই সাহিত্যের মানুষ । ছোট বেলা থেকেই কবিতা , গল্প লিখতাম তবে কখনই উপন্যাস লিখতাম না কারণ ওটা অনেক ধৈর্যের ব্যাপার । ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই অলস প্রকৃতির । আমার বয়স তখন বাইশ থেকে চব্বিশের ভেতর । প্রচণ্ড আবেগের মধ্যে বাস করতাম । আমাদের পাড়ায় বড় একটা চায়ের দোকান ছিল । আমরা সাহিত্যপ্রেমী কয়েকজন সেখানে নিয়মিত আড্ডা দিতাম । একদিন ওই দোকানের একেবারে শেষের দিকে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম । ভীড় কম ছিল তাই পুরো দোকান জুড়ে একটা শান্ত শান্ত ভাব । হঠাৎ বিশালাকৃতির এক লোক দোকানে ঢুকলেন । চায়ের অর্ডার দিয়ে আমার থেকে একটু দূরে চেয়ার টেনে বসলেন । আমি লোকটাকে ভালো করে একবার দেখে নিলাম । আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়েনা । এ পাড়ায় নতুন বোধহয় । লোকটার মাথায় গালিবী টুপি , চোখে সুরমা , লম্বা এক পাঞ্জাবি পরা । লোকটার চেহারায় একটা দার্শনিক দার্শনিক ভাব আছে । আর এই দার্শনিক ভাবটাই আমাকে বাধ্য করলো তার দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে খুব ইচ্ছে হলো তার কাছে গিয়ে পরিচিত হই কিন্তু আমার স্বভাবজাত অন্তর্মুখিতার কারণে তৎক্ষণাৎ কাজটি করা গেলনা ।

        লোকটি চা শেষ করে বিল মিটিয়ে দ্রুত চলে যায় । আমি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম-লোকটা কে ?
-কোন লোকটা ?
-এই যে মাত্র বিল দিয়ে গেলো । পাঞ্জাবি পরা লম্বা করে ...
 -ওহ । তারে আগে কহনো দেখি নাই ভাইজান । মনে হয় নতুন আসছে এই পাড়ায় । ক্যান ভাইজান, কি
   হইছে ?
-না এমনি । আগে কখনও দেখিনি তো তাই জিজ্ঞেস করলাম 
        
         আপাতত এই অদম্য কৌতূহলটাকে চাপা দিয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালাম  বাসায় গিয়ে নিজের কাজ সেরে যথারীতি একটা বই নিয়ে বসলাম । কিন্তু পড়ায় মন বসছিলো না । কোনোভাবেই যেন লোকটার চিন্তা মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না । এর কয়েকদিন পর আবার লোকটার দেখা পেলাম । পুনরায় সেই চায়ের দোকানেই । এবার আর সুযোগ হাতছাড়া করলাম না । নিজ থেকেই তার কাছে গেলাম ।
-বসতে পারি লোকটি এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো যে মনে হচ্ছিলো আমার ভেতরের সব খবর সে জেনে যাচ্ছে । অদ্ভুত শীতল এক দৃষ্টি । আমার রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেলো ।
- হ্যাঁ শিওর । বসুন । 
-আমি শেরিফ । এই এলাকাতেই থাকি । আপনি
-আমি শামস । এখানে নতুন এসেছি । তা ভাই আপনি কি করেন ? মানে চাকরি কিংবা পড়াশোনা ?
-আমি স্টুডেন্ট । টুকটাক লেখালেখি করি । 
-বাহ ,বেশ । সাহিত্যের মানুষ আমার খুব পছন্দ । আমি নিজেও লেখালেখি করি কিনা ...
কথাটা বলেই তিনি এমন এক ভাব করলেন যেন এই কথাটি আমাকে বলে তিনি খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছেনপরিস্থিতি কাটানোর জন্যই বোধহয় তিনি দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টালেন ।
-তো শেরিফ সাহেব , একদিন আসুন না আমার বাসায় । খুব কাছেই । দুজনে মিলে আড্ডা দেয়া যাবে । 
-আসব একদিন সময় করে । ফোন নাম্বার বিনিময় করে আমরা সেদিনের মত বিদায় নিলাম । এক শুক্রবার সময় করে তাকে ফোন দিলাম । তিনি তার বাসায় আসতে বললেন । তার দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী তার বাসায় পৌঁছলাম । পড়ন্ত বিকেল । নক করার সাথে সাথেই দরজা খুলে ভেতরে আমন্ত্রন জানালেন শামস । পুরো ঘরে কেমন একটা ধূপ ধূপ গন্ধ । মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করে উঠল হঠাৎ । 
-আপনি একা থাকেন ?
-হ্যাঁ । -আপনার স্ত্রী
আমি অবিবাহিত ।
-ওহ , এ ব্যাপারে আর কথা না বলাই সুবিধাজনক মনে করে অন্যপ্রসঙ্গে চলে গেলাম ।
-আপনার লেখালেখি কেমন চলছে ? তিনি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন । কোনো উত্তর দিলেন না আমি তার এই রকম অদ্ভুত আচরনে একটু বিস্মিত হলাম । ভেতরে ভেতরে একটা সূক্ষ ভয় কাজ করছিলো । হঠাৎ তিনি মুখ খুললেন । 
-দেখুন , আমি লিখি এ কথা সবাইকে বলতে চাইনা । কারন এ কথা বললেই তারা আমার লেখা পড়তে চাইবে । আর তারপরই শুরু হবে ঝামেলা । 
- কী ঝামেলা আমার চোখে মুখে বিস্ময় । 
-সেটা নিয়ে না হয় আরেকদিন আলোচনা করা যাবে । 
আমি নাছোড়বান্দার মতো তাকে রিকোয়েস্ট করতেই থাকলাম ব্যাপারটা খুলে বলার জন্য । অবশেষে তিনি আমার অদম্য অনুযোগের কাছে হার মানলেন ।
-আসুন আমার সঙ্গে ।
আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকি । তিনি আমাকে একটা রুমে নিয়ে গেলেন । একটা অচেনা গন্ধ নাকে এসে লাগল । রুমের দেয়ালে দেয়ালে বিচিত্র ভাষায় কী সব লেখা কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না । তিনি একটা ছোট্ট টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন । ড্রয়ার খুলে বড় সাইজের কয়েকটা কাগজ বের করলেন । কাগজগুলো বেশ পুরোনো । তিনি একটি কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিলেন । 
-এটা কী ?
-পড়েই দেখুন । আমি লিখেছি । প্রায় বিশ বছর আগে । ওটা ছিলো একটা কবিতা । আমার পড়া সবচেয়ে বিস্ময়কর একটি কবিতা ।
আমি কবিতাটি পড়া শুরু করলাম । প্রতিটি লাইন অদ্ভুত জাদুকরী মায়ায় আমাকে এক মন্ত্রমুগ্ধ মূর্তি বানিয়ে রাখলো । কবিতাটি পড়ছিলাম আর শুনতে পাচ্ছিলাম অগনিত মানুষের কোলাহল । হঠাৎ মনে হলো আমি এক অন্য জগতে চলে এসেছি । মাথার উপর দিয়ে প্রচণ্ড শব্দে বাজপাখি উড়ে যাচ্ছে । চারিদিক থেকে একটা লাল আলো ক্রমশ আমাকে ঘিরে ধরছে । 
-শুনতে পাচ্ছেন ওদের শব্দ শামসের কথাটুকু খুব অস্পষ্ট শোনালো । আমার চোখের পাতা কাঁপছে সেই সাথে দ্রুততর হচ্ছে হৃদস্পন্দন । মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পেলাম হঠাৎ । আর তারপরই আমি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি । জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমার বেডরুমে । বাবা পাশে বসে আছেন ।
-কেমন লাগছে এখন ?
-ভালো । 
-কাল রাতে এক লোক তোকে বাসায় দিয়ে গেলো । বলল তোর খুব ঘুমের প্রয়োজন । তুই নাকি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলি হঠাৎ ? কোথায় গিয়েছিলি বাবা ?
-না , তেমন কিছু হয়নি । এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি । তুমি ও নিয়ে চিন্তা কোরো না ।
        
         বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘর থেকে বের করে কাগজ কলম নিয়ে বসলাম কাল রাতে যা হয়েছে সব লিখব বলে । কিন্তু সমস্যা হলো যে কবিতাটি কাল পড়েছিলাম তা আর মনে করতে পারছিলাম না । কষ্টে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো । কোনোভাবেই একটা লাইনও মনে করতে পারলাম না । দেরি না করে শামসের খোঁজে ঘর থেকে বের হলাম । শামস কে পেলাম না । দরজায় বড় তালা ঝুলছে । এমন আশঙ্কাই করছিলামআমার আগে থেকেই কেন জানি মনে হচ্ছিল ওকে আর খুঁজে পাবোনা । মনে অনেক প্রশ্ন এবং আক্ষেপ নিয়ে সেই চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম ।
-ভাইজান, ওই লম্বা আলখাল্লা পরা লোকটা এসেছিল, আপনার জন্য একটা চিঠি দিয়া গেছে 
আমি হন্তদন্ত হয়ে দোকানদারের কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম -- “আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেন সেদিন আমি লেখালেখির বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম । যাই হোক , কেন এমনটা ঘটে সেই ব্যাখ্যায় আমি যাবো না । তবে আমি এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি কারণ আমার একান্ত কিছু ব্যাপার আর গোপন থাকলো না । বাই দ্যা ওয়ে , আমি পত্রিকায় আপনার একটি কবিতা পড়েছি । আপনার লেখার হাত ভালো । আপনার জন্য আমার একটা ক্ষুদ্র উপহার রয়েছে । এই চিঠির উল্টোপিঠে সেটি পাবেন । ভালো থাকবেন ভাগ্যে থাকলে আবারো দেখা হতেই পারে , বিদায়” দ্রুত চিঠিটার অপর পাতায় চোখ রাখি । একটা কবিতা । তবে আসলে ওটা কবিতা নাকি কোনো মন্ত্র বুঝতে পারলাম না কারণ এর পর থেকেই আমার লেখার মান বাড়তে থাকে । আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে । আজকাল তো অনেক পাঠক প্রায়ই বলে থাকেন যে আমার লেখায় নাকি একটা সম্মোহনী ক্ষমতা আছে ...

        এই পর্যন্ত বলে শেরিফ থামলেন এবং এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস । তবে এই দীর্ঘশ্বাস তৃপ্তির না ক্লান্তির তা বোঝা গেলো না । শামসের ব্যাপারে খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো তাই প্রশ্নটি করেই ফেললাম --
-
শামসের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি
-নাহ । আমি জানি ওর সাথে আমার আর দেখা হবেনা । কিন্তু আপনি শুনলে অবাক হবেন মাঝে মাঝে আয়নায় আমার নিজের জায়গায় শামসকে দেখি । তবে পুরো ব্যাপারটা যে একটা সাধারণ হ্যালুসিনেশন তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই । হাহাহা ... শেরিফ ক্রমাগত হাসছেন । মানুষের হাসি এত মায়াময় হতে পারে!